অপর্ণা সেন নির্মিত ‘জ্যাপানিস্ ওয়াইফ’ (The Japanese Wife) দেখছিলাম, কয়েকটি বিশেষ দৃশ্য ঘুরে দেখছিলাম বস্তুত, বলা যায় এই নিয়া ‘জ্যাপানিস্ ওয়াইফ’ ছয় কি সাত নম্বরবার দেখা হলো। পুরোপুরি দেখা নয়, পয়লাবার পুরো দেখার পর, রিভিশন আসলে। এইটা আমার বলার দরকার নাই যে অপর্ণা সেন মেধাবী সিনেমানির্মাতা, ভালো অভিনয়শিল্পী, গুণী ফিল্মমেইকার। আমি বা আমরা না-বললেও অপর্ণা তা-ই। কিন্তু সন্ধেবেলাকার বৃষ্টিবিষণ্ন অতিকায় একলা হাওয়ায় ‘জ্যাপানিস্ ওয়াইফ’ সিনেমার সিলেক্টেড কয়েকটি সিন্ রিভাইজ্ দিতে যেয়ে চেষ্টা করছিলাম মনে করতে যে, এই মেইকারের সমগ্র দেখা সারা কি না আমার। মনে হলো, ‘ছত্রিশ চৌরঙ্গি লেইন’ ও ‘পরমা’ ছাড়া আর-সব হয়েছে দেখা। ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গি লেইন’ অপর্ণার ডেব্যু ম্যুভি, নির্মাতা হিশেবে, অঞ্জন দত্তের একটা গানে এই লাইনটা মনে পড়ে : “একবার দেখে যাও সেই একলা মেমসাহেবের বাড়ি ছত্তিরিশ চৌরঙ্গি লেইন / একা লাগবে না আর ফাঁকা লাগবে না আর, তোমার এই পচা শহরে” — এছাড়া এর স্টোরিলাইন পড়েছি কোথাও কোনোকালে, যেমন ‘পরমা’ সম্পর্কে বেশ-কয়েকটি রিভিয়্যু।
তো, একটু আগে সিনেমাটা দেখতে যেয়ে মনে পড়ল, এইটা পয়লা দেখেছি ২০১১ সালে, এরপর এ নিয়া বার-ছয়েক নানান সময়ে। এবং মনে হলো, কতকিছুই তো ভুলিয়া যাই আমরা, জীবন আমাদেরে ভুলিয়ে দেয় কতকিছুই, যেন এই সিনেমাটার কথা বহু বছর বাদেও ভুলিয়া না-যাই, স্মৃতিস্থিত করিয়া রাখবার জন্যই ফিরে দেখতে বসি সিনেমাটি। বৃষ্টি ধরছে না, কাজেই, ভাবলাম এইখানে রাখি টুকে সিনেমাটার নাম অন্তত। অনুভূতি প্রকাশিতে পারব না, বা দেখনোত্তর অভিভাব, অত শক্তি নাই আমার। হাহাকার শুধু, কিছুই না আর, বৃষ্টিনিঃশেষ হাওয়ার ন্যায় হাহাকার। মধুর হাহাকার। জগৎ-সংসার মিথ্যে প্রতিপন্ন করে দেয় এমনতর মধুর হাহাকার। কিছুই না আর। মধুর-মধুরতর হাহাকার। হাহাকার, আর কিছু না, অরব-অব্যক্ত-অস্ফুট হাহাকার শুধু।
বৃষ্টি হয়ে গেল ঘন, ঝরঝর, টানা আধঘণ্টা বৃষ্টি হয়ে গেল সিনেমার শেষের দিকে। সিনেমায়, ব্যপ্ত স্ক্রিনে, বাস্তবেও। জল পড়ছে এখন ঢেউটিনের ঢেউসারি বেয়ে জানালার পাশের মাটিতে। অন্ধকার মাটি, বৃষ্টিভেজা, বা মাটির অন্ধকার। টপটপ-টুইটুই জলপতনের আওয়াজ শুধু। জলস্বর, বৃষ্টিমৃদু, হাওয়ামার্জিত হাল্কা শীতানুভূতি। হাহাকার … হাহাকার … হাহাকার শুধু। জীবন যদি কেউ যাপন করে জীবনের প্রতি পর্যাপ্ত সম্মান দেখিয়ে, এই হাহাকারের হাত হইতে নিস্তার নাই তার। হাহাকার, হাহাকার শুধু … মধুর-মধুরতরা হাহাকার … বৃষ্টিবিধুরতা আর মেদুর হাহাকার … না-পেয়ে পাবার হাহাকার — অনেককিছুই — পেয়েও না-পাবার — অমল-ধবল মন্দমধুর হাহাকার …
পোস্টস্ক্রিপ্ট : অপর্ণানির্মিত অন্য দুই অদেখা ছায়াছবি — ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গি লেইন’ ও ‘পরমা’ — ইতোমধ্যে দেখা সারা হলেও সবিস্তার কথা পাড়বার ফুরসত বা সামর্থ্য কোনোটাই নিবন্ধকারের নাই এ-মুহূর্তে। একদিন কলকাতাভিত্তিক বাণিজ্যিক ছায়াছবির ইন্ডাস্ট্রি নিয়া আলাপ জুড়তে পারলে একটা কাজের কাজ হতো বৈকি। বিশেষত অপর্ণা সেন, ঋতুপর্ণ ঘোষ প্রমুখের পদাঙ্ক ধরে এই সময়ের সৃজিত মুখোপাধ্যায় বা সুজিত সরকার বা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় যে একটা ধারায় সিনেমা বানায়ে চলেছেন, মূলত মধ্যবিত্ত দর্শকদের মধ্যে যেগুলো প্রদর্শিত হয়ে বেশ প্রভাব বিস্তার করছে এবং পয়সাও উঠায়ে আনছে, যে-সিনেমাধারাটা বাণিজ্য ও বুদ্ধিদীপ্তি দুইয়েরই মিশেল ঘটাতে চেয়েছে আগাগোড়া, পারছেও বটে ব্লেন্ডিং ঘটাতে, এই কেইস নিয়া স্টাডি দরকার আমাদেরই সিনেমার অগ্রগতিস্বার্থে। কেন বাংলাদেশের নির্মাতারা না-ঘরের না-ঘাটের একেকটা মড়া বানাচ্ছেন বছর বছর আর চিল্লায়া গ্রাম মাথায় তুলছেন, না হচ্ছে ব্যবসা না বুদ্ধিবৃত্তি, ট্যক্-শো হচ্ছে কেবল — এইসব মামলা আলাপে-এজলাসে তোলা আশু দরকার; আখেরে এ-ধারায় আলাপগুলো বাংলাদেশের ম্যুভিবাজারে ব্রেকথ্রু আনয়নে হেল্প করতেও পারে। ব্যবসাবাণিজ্য তো শুধু লক্ষ্মী-গণেশের অধিষ্ঠান পোক্ত করবে তা না, আখেরে সরস্বতীরও অস্তিত্ব ফকফকা রাখনে এইটা আবশ্যক। অপর্ণা, ঋতু, কৌশিক, সৃজিত, সুজিত এবং এমন আরও অনেক কলকাতাবেইসড ফিল্মমেইকারদের নিয়া আন্দাজনির্ভর লেখাপত্রও সওদাগরি বুদ্ধি বাৎলাতে আমাদের কাজে আসবে বোধহয়।
২.
জ্যাপানিস্ ওয়াইফ ম্যুভির অন্তর্গত ঘুড়িদৃশ্যটাই খুঁজছিলাম, নোটোত্তোলনকালে, ইনসেটে সেঁটে দেবার জন্য। যদিও ঘুড়ি-উড্ডয়নকালীন মনুষ্যজটলা বাস্তবানুগ মনে হয় নাই সিনেমায়, গ্রামে এই দৃশ্যগুলো অনেক বেশি আনইভেন ও শোর-মাচানো হয়ে থাকে বস্তুত, তবে আকাশে-ভাসমান ঘুড়িদৃশ্যটা বাংলা চলচ্চিত্রে মেমোরেবল হয়ে রইবে মনে হয়েছে। এই ইম্যাজিন্যাশন ও রিয়্যালিটি ব্লেন্ড-করা আকাশঘুড়িদঙ্গলের দৃশ্য ফটোগ্র্যাফের আকারে চেয়েছিলাম নোটের সঙ্গে সেঁটে দিতে, গ্যুগলে গরুখোঁজা দিয়াও কমন কয়েকটা প্রিমিয়ার-ইভেন্টের ফটোসেশন ছাড়া আলোচ্য ম্যুভিটির ভালো কোনো পোস্টার পাই নাই। কিংবা এই সিনেমার আরেকটা দৃশ্য আনবিয়ারেবল মনে হয়, যেখানে জাপানিবধু নৌকা থেকে নেমে শুকনো বালিভরা পাড় ধরে উঠে আসছেন অছোঁয়া সেই বন্ধুবাড়ির অভিমুখে, ন্যাড়া মাথা তার, থানপরা বিধবার, আর মুখেও প্রাচ্যদেশীয় বৈরাগ্যবিধুর প্রশান্তিবিষাদ, সব মিলিয়ে এ এক বড় ধাক্কাই ছিল দর্শক হিশেবে আমার কাছে। এছাড়া এই সিনেমায় রাইমা সেনের অভিনয়হীন অভিনয়ের তারিফ তো করতেই হবে, যেমন সম্প্রতি শব্দ সিনেমাতেও সুচিত্রানাতনির পার্ফোর্ম্যান্স স্পেলবাউন্ড করে রেখেছিল। ও হ্যাঁ, ফিফ্টিন পার্ক অ্যাভেন্যু তো অবশ্যই ভালো, কঙ্কনার অভিনয়ে মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার তো দুর্দান্ত, অথবা পারমিতার একদিন বা কোনটা রেখে কোনটা বলবেন আপনি! “একবার দেখে যাও সেই একলা মেমসাহেবের বাড়ি / ছত্তিরিশ চৌরঙ্গি লেন” … অঞ্জন দত্তের গানের পঙক্তি। কিন্তু থার্টিসিক্স চৌরঙ্গি লেইন কি ভুলিয়া যাবার? ঋতুপর্ণ ঘোষ ও অপর্ণা সেন মিলে তো বাংলা সিনেমায় একটা আলাদা ঘরানাই নিয়ে এসেছেন বলতে হয়, বুদ্ধি-আবেগ ও বাণিজ্যের মেশামেশি একটা ব্যাপার। এই অ্যাকোমোডেইটিভ মধ্যপন্থা-অবলম্বী সিনেমাধারাটা আস্তে আস্তে কমার্শিয়াল টালিউডি সিনেমাব্যবসায় হৃষ্টিপুষ্টি যুগিয়েছে। এখন সেই ফল গোলায় উঠছে টালিউডের। অঞ্জন দত্ত এই সমন্বয়ধর্মী নিশানাতেই নিজের সিনেমাসৃজন ও বিজনেস জারি রেখেছেন। সৃজিত প্রমুখ অনেকেই এখন এই বাজারমারা কৌশল রপ্ত করেই ফি-বছর ব্লকবাস্টার হাঁকাচ্ছেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা গৌতম ঘোষ প্রমুখ এই কম্পার্টমেন্টের নন, বলা বাহুল্য। দুইজনের মধ্যে প্রথমোক্তজন আমার কাছে বেশি গুরুত্ববহ। যদিও অপর্ণা-ঋতু ম্যুভিক্রিয়ার ক্রিটিকগুলো মনে করে যে এই সমন্বয় আদতে আপোসের একটা লোকদেখানো অজুহাত। বাজার খুশি রাখা, জনরুচি সমঝে চলা, পাতিবুর্জোয়া পয়সাবান গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনা। তাদিগের চিকেনহার্ট ইন্টেলেক্ট যেন কোনোক্রমেই তকলিফবোধ না-করে, হ্যাপা না-পোহায় যেন মুহতারামদের মস্তিস্ক, সদা খুশ রহে যেন উনাদের নীতিনৈতিকতা, সমন্বয় বলতে এইগুলো কৌশলে খেয়াল রাখা। না-হক নয় নিশ্চয় এসব ক্রিটিকের অনেককিছুই, জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ে এগুলো পড়ে, কিন্তু দেখাদেখির জায়গা থেকে সিনেমা আদৌ দৃষ্টিপীড়ক বা চিত্তপ্রদাহী মনে হয় নাই কখনো। অপর্ণার সিনেমানির্মিতি নিয়া আপনি লিখতে পারেন তো, সময় নিয়ে একবার সিনেমাগুলি রিভিশন দিলেই লিখতে পারা কঠিন হবে না আপনার জন্য, অবশ্য লেখাটা কায়িক শ্রমেরও বটে, এইখানেই একটু সমস্যা। হাজার দিনানুদৈনিকতার পর লিখনশ্রম, অলমোস্ট ইম্পোসিবল হয়ে উঠছে দিন-কে-দিন।
৩.
পরিণত বয়সের অনেক আগে আকস্মিক প্রয়াণের কারণেই ঋতুপর্ণ ঘোষ নিয়া বাংলা ভাষাভূখণ্ডের স্বাধীন ও পরাধীন উভয় ভাগের মিডিয়ায় ঋতুমত্ততা কারো নজর এড়াবে না; তার কারণও অমূলক নয়, মৃত্যুজনিত শোকবিহ্বলতা আর জীবিতের অনুতাপ মিলে একটা আলোচনা হয় এতদঞ্চলে যে-কোনো বইসিনেমাআর্ট ক্রিয়েটরদের নিয়ে। এইটাও তো নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন আপনি, মৃত্যুর পরের আলোচনা সাধারণত অত্যুচ্ছ্বাসের ফেনায় ঘেরা থাকে বেশি। কিন্তু মরণের আগের আলাপের ফলে ফিল্মমেইকার কিছুটা লাভবান হন হয়তো। যদিও মরণের আগে এক স্তুতিস্তাবকতা আর দুই খারিজি ক্রিটিক ছাড়া আর-কিছু জুটে গেলে সেইটা ফিল্মমেইকারের ভাগ্য। সবার ভাগ্য হয় না অত প্রসন্ন। প্রসঙ্গত, অপর্ণানির্মিত ম্যুভি নিয়া বাংলায় কোনো কথাবার্তা কেন-যে তেমন হয় না, খানিকটা আজবই লাগে। একদিক থেকে অবশ্য বলা যায় যে অপর্ণাম্যুভিগুলো প্রচারের আলো প্রচুরভাবেই পায়, রিলিজের আগে-পরে সর্বভারতীয় বাংলা-ইংরিজি পত্রিকাগুলোতে একটা কাভারেজ তো পায়, কিন্তু ঠিক অ্যানালিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন বলতে যা বোঝায় তা তো নয়। অবশ্য বঙ্গভাষায় ম্যুভিক্রিটিক খুব অল্পকাল হলো শুরু হয়েছে, এদ্দিন ছিল দর্শকপ্রতিক্রিয়া টাইপের জিনিশপত্তর। তবু শ্যাম বেনেগাল নিয়া খুচরো কথাবার্তা বাংলাতে শুনলেও দীপা মেহতা বা মীরা নায়ার নিয়া আলাপ ওইভাবে হয় নাই। এইটা আজিব, আবার পুরনো ও বোধগম্য কারণে আজিব নয়ও। অতএব অপর্ণা নিয়া আপনি লিখতে লেগে গেলে দেখবেন এই আজিব জিনিশের আন্ডারলায়িং রাজনীতি তথা গোটা অ্যারেঞ্জমেন্টটা আমূল উঠে আসছে আপনাআপনিই। কাজেই এইটা করা জরুরি তো বটেই, আমাদের সবার জন্যই জরুরি।
Film Title: The Japanese Wife ।। Released Year: 2010 ।। Genre: Drama, Romance ।। Duration: 1h 45min ।। IMDb Score: 7.6/10 ।। Director: Aparna Sen ।। Story by: Kunal Basu ।। Stars: Rahul Bose, Raima Sen, Moushumi Chatterjee, Chigusa Takaku ।। Cinematography: Anay Goswamy ।। Music Score: Sagar Desai
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- জানালাবায়োস্কোপ - January 23, 2025
- প্রকাশ্য সন্ধ্যায়, শীতে - January 4, 2025
- মর্মস্পর্শী মিসকিনদের দেশে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড - January 1, 2025
COMMENTS