বিধ্বংসী দুনিয়াযাত্রা ও জনৈক ত্রাতা ||  ফাইয়াজ বিন নুর

বিধ্বংসী দুনিয়াযাত্রা ও জনৈক ত্রাতা ||  ফাইয়াজ বিন নুর

খ্রিস্টানদের যিশুখ্রিস্ট আর ইসলামে ইসা (আ.) — যাকে আদর্শ মেনে চলে অনেক মানুষ। যার উপর মানুষের বিশ্বাস এবং সম্মান দুটোই বিদ্যমান। যার পুনর্জন্ম বা পৃথিবীতে পুনরায় আগমন নিয়ে অনেকের মনেপ্রাণে বিশ্বাস। যদি তা ঘটে, মেসায়াহ তাহলে এ-রকমই এক ব্যক্তিত্ব যার সাথে সম্পৃক্ত কিছু মিরাক্যল বা অলৌকিকতা — আর বর্তমান আধুনিক যুগের মানুষের ভিতরে মেসাইয়ার আগমন ঘটলে কেমন ঘটনা হতে পারে, কেমনভাবে প্রতিফলন ঘটাবে সেই বিমানবীয় গুণাবলির মানবের আবির্ভাব এই মানবদুনিয়ায় তারই প্রতিচ্ছবি হচ্ছে এই সিরিজ টিভিফিকশন। মেসায়াহ বা আল-মাসিহা ধারাবাহিকটি স্ট্রিমিং ভিশ্যুয়্যাল প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে দেখা যায়।

সিরিজের শুরুতে দেখা যায় দুটি দেশের তুমুল যুদ্ধ যেখানে মেসাইয়াহ বা আল-মাসিহ ‘পায়াম গোলশিরি’ নামে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে মুসলিম সাধারণ মানুষদের উদ্দেশ্যে বিশ্বাস রাখতে বলছেন তাদের সৃষ্টিকর্তার উপর। যেখানে সবাই বেঁচে যায় ঐ যাত্রায় এবং তাকে অনুসরণ করতে থাকে। একই সময়ে টেক্সাসে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে সব বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যায়, বেঁচে যায় শুধু খ্রিস্টানদের চার্চ। এভাবে একের পর এক মিরাক্যল ঘটেই চলে এবং সর্বত্র একটা মানুষের উপস্থিতি সনাক্ত করা যায়। যেখানেই তার উপস্থিতি, মিরাক্যল সেখানেই, মানুষ ও জনপদ রক্ষা পায় আশ্চর্য অব্যাখ্যায় উপায়ে। যেন লোকটা ত্রাণকর্তা। ত্রাতা। মানুষও তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে।

সন্দেহপ্রবণ জনতা কয়েকবার তাকে কারাগারবন্দি করে রাখে কিন্তু মাথার উপর কোনো এক অলৌকিক ছায়া যেটা বারবার তারই রক্ষক হয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়। যেহেতু মুসলিম পরিবারে জন্ম লোকটার, মানে মেসায়ার, সেহেতু প্রশ্ন উঠেছিল তাহলে আল-মাসিহ কেন তার আপন ধর্মের সৃষ্টিকর্তার আরাধনা করেন না, উত্তর ছিল — “আমি সকল মানুষজাতির মধ্যেই আছি, সবার সাথেই পথচলা আমার।” যা-ই প্রশ্ন করা হচ্ছে মেসায়াকে উত্তরটা এমন ভাষা ব্যবহারে পাওয়া যাচ্ছে যেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সাথে আলাপের অংশ প্রকাশিত হচ্ছে এইমাত্র। মনুষ্যত্ব বোধ, ভালোবাসা আর মানবতার স্থান মনুষ্যসংসারে সবার উপরে — এই কথাটা বারবার এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জনগণের প্রশ্ন অবিরাম উঠছে মেসায়াকে নিয়ে, মেসায়ার কাছে, গণমাধ্যমে এবং খোদ রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতাকাঠামোর ভিতরে, মেসায়া উত্তর দিবার সময় মাঝেমধ্যেই উল্লেখ করা হচ্ছে, — “আমি সৃষ্টিকর্তার বার্তা পোঁছে দেই এবং এটাই আমার কাজ, সৃষ্টিকর্তাকে যেন খোদ সামনে আসতে না-হয় তাই আমার মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন করছেন তিনি।”

শান্তিতে বসবাস কে না চায়? কে চায় যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাক, খুনখারাবি, একে অন্যের ধ্বংস ও পতন আনুক, শান্তিতে বাধা দিয়ে সাময়িক সুখলাভের মাধ্যমে অন্যের জীবনের ধ্বংসলীলা চোখের সামনে উপভোগ করে কী ফায়দা যখন এই ক্ষতি সারাজীবন নিজের ভিতরে বয়ে যেতে হবে এই মানুষকেই জিন্দেগির অন্তিমকাল এবং কালের অনন্ত পর্যন্ত? বিসর্জনে আনন্দ চিরস্থায়ী — এ-কথা সবাই জেনেও কেউ কখনো পালন করে বলে আমার মনে হয় না। পালন করা হলেও সেটা ক্ষণিক সময়ের জন্যে। সমস্ত কল্যাণচিন্তা সমস্ত ভালো সমস্ত শুভ ভুলে গিয়ে, ভালো মানসিকতা জলাঞ্জলি দিয়ে আবার ধ্বংসমত্ত হয় এই মানবজাতি। নিজ স্বার্থে ক্ষণিক আনন্দ উপভোগ যখন বন্ধ হবে তখনই আমরা হব মানুষ। আর তখন প্রত্যেক মানুষই হয়ে উঠবে একেকজন আল-মাসিহ। যখন থাকবে না পৃথিবীতে কোনো বর্ডার, থাকবে না দুই জাতির মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র, এগুলোর কোনো সৃষ্টিছাড়া দরকার থাকবে না যেদিন, রক্তপাত আর অনিষ্ট যেদিন থাকবে না মানবকুলে, মেসায়াহ বা মাসিহা সেদিনই সার্থক হবে।

এ-ই ছিল সিজন-১-এর দৃশ্যপট। সিজন-২ আপাতত নেটফ্লিক্স থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে কভিড-১৯ বিপর্যয়জনিত বৈশ্বিক অচলাবস্থায়। সিরিজটা ভাবাবে সবাইকে। যেন ভাবায়, বিভেদমূলক বিধ্বংসী দুনিয়াযাত্রা যেন বন্ধ হয়, যেন লোকে ফিরে তাকায় আয়নায় তার বীভৎস বিকটতার দিকে, এই দোয়া রইল।


ফাইয়াজ বিন নুর। সংস্কৃতিবীক্ষক, লেখক, শিক্ষার্থী। সিলেট

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you