ওয়েবজিন রিভিয়্যু : দেশ-বৈদেশ || আহমদ মিনহাজ

ওয়েবজিন রিভিয়্যু : দেশ-বৈদেশ || আহমদ মিনহাজ

গানপার-এ বই, ম্যুভি ইত্যাদির ওপর আলোকপাতের ধারায় এই সংযোজন (ওয়েবজিন রিভিয়্যু) দরকারি ছিল। বাংলা ও ভিনভাষী ওয়েবজিন/ছোটকাগজ/জার্নাল ইত্যাদির পরিচিতিমূলক আলাপ ফাঁদার ছলে নিজের পয়েন্ট অফ ভিউ  তুলে ধরা, — এইটা ভালো লাগছে। ভাবগম্ভীর বিশ্লেষণে যান নাই আবার আত্মসমালোচনার জায়গা অথবা যদি বলি ফিরে ভাবার প্রণোদনা পাঠককে ধরায়া দিতে পারছেন, যে-কারণে জিনিসটা টাচি   হইছে।

ব্লগ প্রমোশনের পরিভাষা ঘাঁটলে দেখবেন অন্য সাইটকে নিজের সাইট থেকে প্রমোট করার রেওয়াজ শুরু থেকে চলে, অন্তত বিদেশে। এতে নাকি নিজের ব্লগের পরিচিতি ও অংশগ্রহণ আর গ্যুগল অ্যানালিটিক্স-এ ব্লগের রেটিং বাড়ে। সার্চ-ইঞ্জিনেও সাইটের তরক্কি খানিক বৃদ্ধি পায় ইত্যাদি। সত্য-মিথ্যা কইতে পারি না তবে বাংলা ব্লগিং বা অনলাইন লেখালেখির জগতে রেওয়াজটা বিশেষ চোখে পড়ে না। সদ্য চালু করা ফিচার গানপার-এর পাঠ-বিস্তারণে কতটা কী প্রভাব রাখবে সেটা মু্ই ন জানি,  তবে কন্টেন্ট যেভাবে আপ  করছেন তার কদর হওয়া উচিত।

ছোটকাগজে (আপনাদের মনে থাকার কথা) একসময় অন্য ছোটকাগজকে পরিচয় করানোর ধারা বেশ সচল ছিল। আলোচনা যদিও সবসময় যুৎসই মানের হইত না, তবু এক কাগজের দেহে অন্য কাগজের গন্ধ টের পাওয়ানোর চেষ্টা কিন্তু মন্দ লাগত না। অনলাইনে জায়গাটা আরো ব্যাপক। বিচিত্র বিষয় নিয়া ব্লগ/ওয়েবজিনের ছড়াছড়ি এখানে। গানপার-এর লেখককুল যদি নিজ পছন্দ অনুযায়ী সাইট/পত্রিকা/ছোটকাগজ শেয়ার করেন, পরিচিত করানোর সঙ্গে নিজের ভাবনা ও বক্তব্য তুলে ধরেন তবে চমৎকার ঘটনা জন্ম নিতেও পারে। আমার দিক হইতে সময়-সুযোগ বুঝে পছন্দের সাইট/কাগজ নিয়ে দু-ছত্র লেখার চেষ্টা তাই থাকবে।

টেস্টিমনি ও মুনিমেন্ট  নামে এ-রকম দুটি ফিচার সহচারী  ব্লগে একসময় চালু করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন ব্লগ/ওয়েবজিন/জার্নালে প্রকাশিত লেখার সারসংক্ষেপ তুলে ধরার ফাঁকে নিজের ভাবনা (সহমত ও ভিন্নমত সহকারে) জুড়ে দেওয়া। এহেন কাজে লেগে থাকা কঠিন। সাইট সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার খাটনি রহিয়াছে! লেখা পাঠ ও সারসংক্ষেপ তুলে ধরা আর ক্রিটিক্যাল রিডিং  ইত্যাদি একত্রে জুড়তে বহুত মেহনত হয়। পরে দুটো ফিচারই আর্কাইভড  করা ছাড়া উপায়ান্তর ছিল না। আপনাদের প্রয়াস অবশ্য সেদিক থেকে আলাদা। এখানে পিনপয়েন্ট  হচ্ছে কাগজ বা ওয়েবজিন। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির রচনাকে পরিচিত করানোর জন্য গানপার-এর নতুন ফিচার নিবেদিত নয় মনে হয়েছে। তো এইটা একদিক দিয়ে সুবিধার। আবার একটি কাগজের পরিচয় প্রদানের সঙ্গে তার কাজের ধরন পড়ে ওঠার ঘটনা মাথায় নিলে এই কামেও খাটনি বহুত!

মনে পড়ে যায়, সূনৃত-এর ছয় বা সাত নাম্বার সংখ্যায় বিদেশের সিজন্যাল ছোটকাগজ নিয়া আমরা পরিচিতিমূলক কয়েক পৃষ্ঠা বরাদ্দ রেখেছিলাম। আপনারা যে-অঙ্গে রিভিয়্যু লিখছেন সেভাবে নয়, তবে পাঠককে বিদেশের ছোটকাগজ সম্পর্কে নিবিড় করতে ভাবনাটি মাথায় এসেছিল। বিদেশে তো আবার অনলাইন লিটারারি কাগজগুলার সবটাই মোটের ওপর পেশাদারি ছকে চলে। তিন থেকে চার মাস অন্তর একটি করে সংখ্যা বের হয়। লেখা পাঠানোর জন্য আবার বছরের নির্দিষ্ট কিছু মাস উনারা খোলা রাখেন। বাকি সময় ওইসব লেখা পড়া, বাছাই, সম্পাদনা ইত্যাদি চলে বোধহয়। সম্মানীও দিয়া থাকে। ভারতীয় ঘরানায় এ-রকম একটা কাগজ হচ্ছে অগ্নি। পরে নোবেল পেয়েছেন এমন একাধিক লেখকের যাত্রা অগ্নি  দিয়াই নাকি শুরু হইছিল। লেখা সিলেক্ট না হলে মেইলে জানায়। আমি একবার কৌতূহলবশে আংরেজি সেমি-ফিকশন টাইপের একখান লেখা পাঠিয়েছিলাম। সিলেক্ট করতে পারতেছে না সেই কখা মাসখানেক পরে জানাইছিল। যুক্তরাজ্যভিত্তিক এ-রকম আরেকটি বেশ নামকরা কাগজে (এখন নাম মনে পড়ছে না) লেখা পাঠানোর দুই মাস পর লেখার বিষয়বস্তু নিয়া সম্পাদকীয় মন্তব্য সহ জবাব দিয়াছিল। পড়ে বেশ ভালো লেগেছিল। কারণ, লেখার টোন ওরা ধরতে পেরেছিল এবং আপত্তির জায়গাটা পাঠকের স্বাধীনতার জায়গা থেকে ক্লিয়ার ছিল। যেইটা আবার অগ্নি-র ঘটনায় পাই নাই।

এই ধাঁচে কাগজ চালানো ও পেশাদারিত্ব কেন জানি বেশি দিন নিতে পারি নাই। মনে হইছিল সবই ভালো কিন্তু প্রাণ নাই! তারুণ্যের সৃজন-ব্যাকুলতার সঙ্গে ভুলত্রুটি ও স্পর্ধার মিশ্র্রণ ছাড়া ছোটকাগজকে ম্যাড়মেড়ে লাগে। পেশাদারী কাগজের গুরুগম্ভীর ভাবসাবও আবার কেন জানি আজকাল প্রাণে সয় না। কমিউনিটি ব্লগিং-এ নিবেদিত ব্লগের কাটতি জোরালো হইলেও আমার ভালো লাগে ব্যক্তিগত ব্লগ বা ওয়েবজিনগুলা। মিউজিক, ফটোগ্রাফি, সিনেমা, খেলা এমনকি সায়েন্স বা ফিলোসোফি নিয়া এই ধাঁচের ইংরেজি ব্লগ/ওয়েবজিনগুলা অনেক বেশি আগ্রহ জাগায়া যায়। ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যনির্ভর অনলাইন প্লাটফর্ম আমারে বেশি দিন টানে নাই। জানি না কেন!

লিটহাবমিলিয়ন্সপ্যারিস রিভিউ-র মতো লিটারারি ওয়েবজিন ভালো কন্টেন্ট নিত্য আপ  করে কিন্তু (এ আমার সীমাবদ্ধতা) মনকে তারা তাড়িত করায় না। এই প্রফেশনালিজম-এর মধ্যে কোথায় জানি অসীম দূরত্বের সুর কানে বাজে, যার লগে সহবত করতে মন চায় না। কমিউনিটি ব্লগিঙের আদলে ব্যক্তির একক মেহনতে চলে এ-রকম বহু সাইটকে বরং ঢের সৃজনমুখরিত ও বুদ্ধিদীপ্ত মনে হইছে। এই মুহূর্তে ব্রেইন পিকিংস-এর নাম নিতে পারি। এক ভদ্রমহিলা সাইটটি একলা হাতে সামলান। লেখার ধরন ও বৈচিত্র্য সোজা কথায় মচৎকার। তথ্যবহুল রচনা পরিবেশনার গুণে মগজের জন্য কতটা উত্তম খাদ্য হইতে পারে সেইটা পরখ করতে এই সাইটে সময়-সুযোগ করে ঢুঁ মারি। সাইট চালানোর খরচা ভদ্রমহিলা মূলত একা বহন করেন। ডোনেশনের একখান আর্জি অবশ্য থাকে, যেইটা তাঁরে খানিক সহায়তা করে বলে মনে হয়। বিজ্ঞাপন ছাড়া পেইড সাইট  চালু রাখা বিরাট ঝক্কির কাম কিন্তু উনি এই জিনিসটা পারছেন।

পাঠকের উদ্দেশে নীড়পাতায় ঝুলানো ব্যানারখানা সাইট চালানোর নেপেথ্যে ভদ্রমহিলার প্যাশনকে ধরতে সাহায্য করে :— ‘For 15 years, I have been spending hundreds of hours and thousands of dollars each month to keep Brain Pickings going. It has remained free and ad-free and alive thanks to patronage from readers. I have no staff, no interns, no assistant thoroughly one-woman labor of love that is also my life and my livelihood.’ … ‘One-woman labor’ — কথাটির অন্তরালে তাঁর শ্রমঘামের ঝাঁঝ নাকে ধক করে লাগে। লেখার বিষয়বস্তুর দিক থেকে এই সাইটের সঙ্গে আমি গানপার-এর মিল খুঁজে পাই। পার্থক্য হয়তো এ-ই যে, ব্রেইন পিকিংস-এর লেখাচক্র মোটের ওপর স্বাস্থ্যবান। যখন যে-বিষয়ে লেখেন সেইটার ডিটেলিং পড়তে তাই ভালো লাগে। বোঝা যায় এর পেছনে মগজের নিউরণকোষ সে ধ্বংস করেছে এবং রচনার মিনিং-এর জায়গাটা পাঠককে ধরায়া দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখে নাই। প্রায় প্রতিটি রচনার উপস্থাপনায় পরিচ্ছন্ন সম্পাদনা ও ইলাস্ট্রেশনকে লেখা থেকে সংযোগরহিত মনে হয় নাই। রচনাগুলা মূলত ইনফরমেশন ক্যারি  করার কামলা খাটে কিন্তু তথ্যকে আলোচনাযোগ্য করে তোলার কায়দাটি সেখানে সাবলীল স্রোতে চলে। এও একপ্রকার পেশাদারিত্ব কিন্তু নিষ্প্রাণ নহে। সাহিত্য সহ সাংস্কৃতিক উপাদান প্রচুর, আবার বিজ্ঞান বা দর্শনের গুরুভার বিষয় নিয়া এমন রচনা চোখে পড়ে যেইটা বিনোদনের সঙ্গে ভাবতে বাধ্য করায়। সোজা কথা, মেজাজে সিরিয়াস  কিন্তু পরিবেশনায় তুলার মতো পলকা। এইখানে ব্রেইন পিকিংস-এর কামিয়াবি, অন্তত আমার কাছে।

তো, এ-রকম আরো বহু সাইট অনলাইনে বিরাজে। দুয়িন্না জারা নামে এক জার্মান তরুণী ছবি আাঁকার সঙ্গে সঙ্গে Mathematical Surrealism  নামে ব্লগ চালায়। গণিতের বিমূর্ত সৌন্দর্য নিয়া ছড়ার ছন্দে কবতে করার সঙ্গে ছবি আঁকা প্রকল্পনার অংশ হিসাবে সে এই ব্লগ প্রসব করছিল। তার কবতে সহযোগে সম্পাদিত গাণিতিক চিত্রকর্ম নিয়া ‘সহচারী’ ব্লগে একসময় লিখছি। খুব খুশি হইছিল পড়ে। কিংবা ধরেন বাচ্চাদের মনোজগতে গণিতের রস ঢোকানোর কারবারে নিবেদিত Math with Bad Drawings নামে শিশুতোষ মনে হইলেও কামের দিক দিয়া চমৎকারা। ইংরেজি ব্লগবাজদের মধ্যে সায়েন্স, ফিলোসোফি আর ফটোগ্রাফি নিয়া যাগো কারবার তাদের অধিক রিচ  মনে হইছে। কবিতার হালত বিশেষ কইতে পারি না। আর হ্যাঁ, পেশাদার কমিউনিটি ব্লগিঙে টুইটার-প্রমোটেড ব্লগ মিডিয়াম  যথেষ্ট সমৃদ্ধ। দারুণ সব আর্টিকেল মুফতে পাওয়া যায় আবার ওদের পেইড প্লাটফর্ম  ছাড়াও ফ্রিতে যেইটা চলে সেখানে যে-কেউ নিজের ইচ্ছামতো লেখার পসরা নিয়া বাজার বসাইতে পারে। ওইটা ওরা মডারেশন  করে না। সহচারীর একাধিক লেখা এই প্লাটফর্মে হেফাজত করার বাসনায় কিছুদিন আপ  করছি, পরে আর এ্যানার্জিতে কুলায় নাই। এখন বোধহয় ওরা সেটা অ্যাক্টিভ নই দেখে বন্ধ করে দিয়াছে। অনলাইন লেখালেখির জগতে বৈচিত্র্য ও কপিলেফ্ট মুভমেন্ট-এর ওপর দাঁড়ানো সাইটগুলাও মনে প্রসাদ জাগায়।

Biblioklept নামের সাইটটা আকর্ষিক। সে ওদের নিজেকে পরিচয় করানোর মধ্যে বেশ ধরা পড়ে :— ‘Biblioklept was founded in AD 2006 by Edwin Turner. Reviews, rants, and riffs on books (and things that aren’t books) … Biblioklept also posts pretty pictures (and pictures that aren’t so pretty, perhaps). Paintings of readers and books. Film clips, full films, stuff like that.’ সাহিত্য বা শিল্পকলার বিচিত্র জগৎ থেকে কাটপিস  হাজির করার কামে বিবলিয়োক্লেপ্ট-এর কামিয়াবি নজর কাড়ে। চিত্রকর্ম, আলোকচিত্র অথবা বইয়ের একেকখান কাটপিস  ধরায়া দিয়া চুপকে চুপকে কেটে পড়ার এহেন ধরতাইয়ে ধাতস্থ হওয়ার পর কিন্তু বেশ লাগে। এর অর্থ হইল ওরা পাঠকের জন্য স্পেস ক্রিয়েটের কামে নিয়োজিত। যেইটা আপ করল তার ভালোমন্দ নিয়া বক্তিমা ঝাড়ার দায় কান্ধে নিতে রাজি না। পাঠক দেখুক এবং ভাবতে বা দু-কথা বলার থাকলে মন্তব্যে গিয়া বলুক। না-চাইলে লাইক-শেয়ার তো রইলই। ওদের ব্লগ চালানোর ফিলোসোফি মাথায় নিলে ঘটনা মন্দ লাগে না। এ-রকম আরো শত-শত আছে। সময়-সুযোগ করে বলা যাবে খন।


তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: