পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্য এক্স-ফাইলস্

পূর্ণদৈর্ঘ্য দ্য এক্স-ফাইলস্

গত শতকের শেষ দশকে যে-কয়টা ধারাবাহিক ইংরেজি টিভিফিকশন বাংলাদেশের টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছে, পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা, সেগুলোর সংখ্যা হাতের পাঞ্জায় ক্যাল্কুলেইট করে ওঠা কঠিনই হবে। এর মধ্যে ‘ম্যাকগাইভার’ তো রয়েছেই, রয়েছে ‘র‍্যাভেন’, রয়েছে ‘দ্য অ্যা-টিম’, রয়েছে ‘দ্য ফলগাই’ ইত্যাদি। ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’ বা ‘ডালাস’ বা ‘ডায়ন্যাস্টি’ কিংবা ‘নাইট রাইডার’ ইত্যাদি সিরিজ যদিও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কন্টিনিউ করেছে, প্রচারশুরুর বিচারে এগুলো নব্বইয়ের আগের দশকের বলিয়াই বিবেচিত হবে। এই সিরিজগুলোর বেশ-কয়েকটা পরবর্তীকালে ফ্যুল-লেন্থ ফিচার ফিল্ম হিশেবেও মুক্তি পেয়ে সিরিজভক্ত ও ম্যুভিসমুজদারদের মন ভরিয়েছে।

The X-Filesএকটা ধারাবাহিকের নামোল্লেখ হয়নি উপরের অনুচ্ছেদে। এতক্ষণে নিশ্চয় ক্লিয়ার সবার কাছেই সিরিজটার নাম। দ্য এক্স-ফাইলস্ (The X-Files)। দশ-পাঁচটা ট্র্যাডিশন্যাল টিভিসিরিজের চেয়ে এর ব্যাপারস্যাপার আলাদাই ছিল বলতে হবে। এইটা সাই-ফাই ঘরানার সিরিজ। প্যারানর্ম্যাল অ্যাক্টিভিটি নিয়াই সিরিজটা আবর্তিত হয়েছে। ট্র্যাডিশন্যাল থ্রিলার সাস্পেন্স অ্যাকশনের গতানুগতিকতা থেকে একেবারেই ভিন্ন হওয়ায় এই সিরিজ শুধু বাংলাদেশের দর্শকদের কাছেই নয়, প্যপুলার হয়েছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। অ্যামেরিকায় তো অবশ্যই। ইউকেতেও। গোটা বিশ্ব বলতে আর বাকি রইল কই? বাংলাদেশের কথা তো বলা হয়েছেই। কিন্তু কথা সেইটা না। কথা হচ্ছে এক্স-ফাইলস্ ম্যুভি নিয়া।

টানা পাঁচ সিজনের মতো সম্প্রচারের পরে এক্স-ফাইলস্ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিশেবে মার্কেটে রিলিজ্ হয় নাইন্টিএইটে। ক্রেইজ্ প্রায় ঝিমিয়েই গিয়েছে তদ্দিনে এক্স-ফাইলস্ টিভিসিরিজের। ঝিমানো অবস্থায় একটু হলেও উত্তেজের সঞ্চার হয়েছিল ম্যুভি রিলিজের খবরে এক্স-ফাইলস্ ফ্যানদের মধ্যে। শেষমেশ খুব কি সফল হতে পেরেছিল? বলতে পারি বাংলাদেশের কথা। না, যতটা ভাবা গিয়েছিল ততটা হয় নাই। কিন্তু এই না-হওয়ার পিছনে একটা কারণ বোধহয় ‘টাইট্যানিক’। এতই ম্যাসিভ হিট হয়েছিল ছবিটা, টাইট্যানিকের কথা বলছিলাম, বাংলাদেশের তৎকালীন ভিডিয়োদর্শক পরবর্তী কয়েক বছর একটানা টাইট্যানিকজ্বরেই ছিল বুঁদ। দ্য এক্স-ফাইলস্ মুক্তি পেয়েছিল টাইট্যানিকের অব্যবহিত পরের বছরেই।

কিন্তু ম্যুভিভার্শন এক্স-ফাইলস্ খারাপ হয়েছে বলার উপায় নাই। বিগ বাজেটের ম্যুভিই, সিরিজের সমস্ত গুণপনা ব্যাহত না-করে এক্সট্রা ম্যাটেরিয়াল্স যোগ করা হয়েছে বেশকিছু। মোটমাট ষাট মিলিয়ন ডলার খর্চায় নির্মিত ম্যুভি। সিনেমা আসছে ঘোষিত হয়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু যখন এসেছে তখন অনেক দেরিও হয়ে গিয়েছিল বৈকি। বিশ্ব তখন রোজ-জ্যাক জুটি নিয়া মাতোয়ারা। অ্যাজেন্ট ডানা স্কালি আর অ্যাজেন্ট ফক্স মোল্ডারের প্রায় প্লেটোনিক রিলেশনের এক্স-ফাইলস্ অন্তত বাংলাদেশে সেভাবে দর্শকনন্দিত হতে পারে নাই। কিন্তু খোদ অ্যামেরিকা থেকেই উঠিয়ে এনেছে সে তার খর্চার পুরাপুরিটা। ব্যবসাও তো মন্দ করে নাই। ধীরগতির প্রোফিটও হয়েছে বেশ লম্বাচওড়া।

The X-Files
আমরা কথা বলছি এক্স-ফাইলস্ সিরিজের অভিষেক সিনেমাভার্শন নিয়ে। এর একটা উপনামও রয়েছে সিনেমাভার্শনে, ‘ফাইট দ্য ফিউচার’। ‘দ্য এক্স-ফাইলস্ : ফাইট দ্য ফিউচার’ নামে এইটা ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত। মনে পড়বে অনেকেরই যে সিরিজেও প্রত্যেকটা এপিসোডের একেকটা উপনাম থাকত। “দ্য ট্রুথ ইজ্ আউট দ্যেয়ার” মন্ত্রটি সিরিজে যেমন তেমনি সিনেমাতেও অপরিবর্তিত রয়েছে। ড্রামাসিরিজের নিয়মিত অভিনয়শিল্পী অনেকেই সিনেমাতেও কাস্ট হয়েছেন। মূল দুই চরিত্রে ডেইভিড ড্যুকোভনি এবং জিলিয়্যান অ্যান্ডার্সন তো রয়েছেনই, রয়েছেন উইলিয়াম বি. ডেইভিস ও মিচ পিলেগি সহ অনেকেই। সিনেমায় এছাড়াও রয়েছেন অস্কারজয়ী অভিনয়শিল্পী মার্টিন ল্যান্ডাউ, রয়েছেন অভিনেত্রী গ্যিনিথ প্যাল্ট্রো-র মা ব্লিথ ডানার। প্রথমোক্ত অভিনয়শিল্পী ডিপ থ্রোটের মতো চরিত্রটা করেছেন, দ্বিতীয়োক্ত করেছেন একজন হার্ডকোর এফবিআই অ্যাজেন্টের চরিত্র।

স্টোরিলাইনেও অনেক নতুনতা আছে। দেখা যায়, স্কালি ও মোল্ডার ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে বের করেছে এমন একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার অস্তিত্ব, যে-সংস্থাটা গোপনেই নিয়োজিত গ্রহান্তরের বাসিন্দাদের পৃথিবীগ্রহে সহিসালামতে আন্ডারকাভার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। এছাড়া মোল্ডারের অপহৃত বোন সামান্থা, সিগ্রেটস্মোকিং ম্যান ও স্কালির ক্যান্সার বিষয়ে সিনেমায় আলোকপাত করা হয়েছে যা ধারাবাহিক নাটকে সেভাবে ফোকাস করা হয় নাই আগে। এমনিতে অ্যাজেন্ট স্কালির নাক দিয়া রক্ত পড়তে দেখেছি সিরিজে, কিংবা অ্যাজেন্ট মোল্ডার তার অ্যালিয়েন-দ্বারা-অপহৃত বোনের ব্যাপারে ফ্ল্যাশব্যাকে গেছে মাঝেমধ্যে। সিনেমায় এইসব খুঁটিনাটি ডিটেইল-আউট করার দিকেই ডিরেক্টর মনোযোগী ছিলেন লক্ষ করা যায়। এবং দর্শকদেরে মাতায়ে রাখতে স্পেশ্যাল এফেক্ট আর অ্যাকশনের দুর্ধর্ষ প্রয়োগ তো রয়েছেই সিনেমায়।

এক্স-ফাইলস্ সিনেমাভার্শনের দৈর্ঘ্য পৌনে-দুইঘণ্টা। ছায়াছবি হিশেবে এর পরিচালনায় রব বোম্যান যথেষ্ট করেছেন। ম্যুভি ফাইলসের পরিচালক এর আগে সিরিজ ফাইলসের গোটা-পঁচিশেক পর্ব পরিচালনা করেছেন। কাজেই সিনেমায় খারাপ করবেন কেউ মনে করে নাই। সিরিজের কাহিনিকার ক্রিস কার্টার সিনেমাতেও রয়েছেন, সঙ্গে যোগ হয়েছেন ফ্র্যাঙ্ক স্পটনিটস্। ওয়ার্ড রাসেলের সিনেমাটোগ্র্যাফিতে এই ফিল্মের মিউজিক স্কোর করেছেন মার্ক স্নো। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স রয়েছে এর প্রযোজনা ও পরিবেশনায়। প্রযোজকের কার্ডে ‘টেন থার্টিন প্রোডাকশন্স’ শুধু যুক্ত হয়েছে নতুন।

The X-Files
মোল্ডার ও স্কালি সিস্টেমের বাইরে থেকেই কাজ করে এক্স-ফাইলস্ নিয়া, কাহিনির আগাগোড়া আমরা এইটা দেখিয়া যাই সিরিজে এবং সিনেমায়। ক্রিস্ কার্টার, এক্স-ফাইলস্ গল্পের অরিজিন্যাল আইডিয়াকার, একটা সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে এর ম্যুভিরূপের কাহিনি নির্মাণকালে ফ্যানদের কথা মাথায় যেমন রাখতে হয়েছে তেমনি ফ্যান নয় এমন দর্শকের কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে। এমনটা তো অসম্ভব যে এক্স-ফাইলস্ ম্যুভি দেখার আগে একজন-কেউ পুরানা ড্রামাসিরিজের এপিসোড দেখে আসবে, আবার এইটাও ভাবতে হয়েছে যে একটা বিশালাংশ দর্শক সিরিজের পুরানা কাসুন্দি সিনেমায় দেখতে পছন্দ করবে না স্বাভাবিক নিয়মে। চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক।

বড় পর্দায় আনতে যেয়ে ডেইভিড ড্যুকোভনি আর জিলিয়্যান অ্যান্ডার্সন অভিনীত চরিত্রদ্বয়ে খুব বেশি চেইঞ্জ আনা হয় নাই। ড্যুকোভনি সিরিজে যেমন স্বল্পভাষী, মৃদুস্বভাবী, সিনেমাতেও অনুরূপ। ধরে রেখেছেন অ্যান্ডার্সনও স্কালিরূপে তার সিরিজখ্যাত সেই দৃষ্টির শীতল অথচ মোহবিস্তারের শান্ত ভঙ্গিটা। তারপরও দুই চরিত্রের সম্পর্করসায়নে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায় যা ধারাবাহিকে বহুপ্রত্যাশিত হলেও কোনোদিন হয়ে ওঠে নাই। সিরিজের সাফল্যের পেছনে এইটাও একটা কারণ ছিল যে সেক্স-ভায়োলেন্সের দুনিয়া অ্যামেরিকায় এমন দুই সুদর্শন সহকর্মী একসঙ্গে এতদিন কাজ করছে, দুইজন দুইজনকে কেয়ার করছে, কিন্তু শরীর ইত্যাদি বিষয়ে কড়াকড়ি সাবধানী রইছে দুইজনে। এইটা ধারাবাহিকের ব্যাপার। সিনেমায় এতটা প্ল্যাটোনিক থাকে নাই রিলেশনটা। প্রায় চুম্বনেরই দৃশ্য ম্যুভিতে মিলবে, যেইটা ধারাবাহিকে ছিল অকল্পনীয়। ডানা স্কালির আবছা নিতম্বও দর্শকদেরে দেখিয়েছেন সদয় পরিচালক। সমস্তকিছু মিলে এক্স-ফাইলস্ সিরিজদর্শকদের কাছে এর ম্যুভিভার্শন অনেকটা আকাঙ্ক্ষাপূরণের মতো হয়েছে। একটা চাপা টেনশন বিরাজ করত দর্শকদের ভিতরে সিরিজ দেখাকালে যে এই পর্বেই বুঝি বিছানায় যাবে ফক্স-স্কালি, কিন্তু তা তো হয় নাই, বিছানা পর্যন্ত না-গেলেও ম্যুভিতে বেশকিছু যৌনপ্রচ্ছন্ন ক্যাথার্সিস্ অ্যাভেইলেবল।

ছবি হিশেবে একবাক্যে তুখোড় বলার মতো কোনোকিছু নয় এক্স-ফাইলসের এই ‘ফাইট দ্য ফিউচার’। তবে তৃপ্তিকর একটা ভয়ের আবহ তো রয়েছেই সিনেমায়, সিরিজে যেমন থাকত। ছবির শুরুতে টেক্সাস দেখানো হয়, খ্রিস্টপূর্ব তিনহাজারপাঁচশ অব্দের টেক্সাস, যেখানে কিছু গুহাবাসী অ্যালিয়েন দ্বারা আক্রান্ত হয়। এরপর কাট। ফিরাইয়া আনা হয় বর্তমানকালে। একটা বাচ্চাকে হোঁচট খাইতে দেখা যায় প্রেজেন্ট টাইমের সূচনাদৃশ্যে। এরপর কাহিনি এগোতে থাকে। প্যারানর্ম্যাল অ্যাক্টিভিটি আর ইনভেস্টিগেটিভ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়া আমরাও অংশ হই ডানা স্কালি আর ফক্স মোল্ডারের ব্যাখ্যাতীত রহস্যাভিযাত্রার।

 Film Title: The X-Files: Fight the Future ।। Released Year: 1998 ।। Genre: Science fiction thriller ।। Duration: 2h 1min ।। IMDb Score: 7/10 ।। Director: Rob Bowman ।। Stars: David Duchovny, Gillian AndersonMartin LandauBlythe Danner, Armin Mueller-Stahl ।। Music Score: Mark Snow ।। Net profit approximately $189.2 million

রিভিয়্যুকারী : মিল্টন মৃধা

মিল্টন মৃধা
Latest posts by মিল্টন মৃধা (see all)

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you