বুদ্ধদেব বসুর গল্পের পাঠ-উত্তর ভাবনাটি (বুদ্ধগল্প) পড়লাম। খুব কম জায়গা নিয়ে দরকারি কথাটা বলেছেন দেখে বেশ লাগল। এই সূত্রে দু-চারকথা বলতে ইচ্ছে করছে, তাই এই পত্রের অবতারণা। আপনার বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেই প্রলম্বন হিসেবে মনে হয় ইলিয়াস ও আজিজ চর্চিত বাস্তবতাবাদী ঘরানা নিয়ে বাড়তি দুকথা বলা প্রয়োজন। এই ঘরানায় লিখে বিশিষ্ট হয়েছেন দুই বঙ্গে এমন লেখকের যেমন অভাব নেই, সংগত কারণে সার্থক গল্পেরও অভাব নেই সেখানে। তিনজন বন্দ্যোপাধ্যায় তো সর্বাগ্রে রয়েছেনই, তার ওপর সতীনাথ ভাদুড়ি থেকে অভিজিৎ সেন বা স্বপ্নময় চত্রবর্তী সহ আরও অনেকে, কিংবা আমাদের এখানে ইলিয়াস-আজিজ-শওকত আলী ও আবুবকর সিদ্দিকী থেকে মঞ্জু সরকার হয়ে হালের কোনও গল্পকার অবধি লম্বা লিস্টি টানা যায়। ফলে এইসব গল্প পড়তে গিয়ে অনেকসময় একঘেয়েমি পেয়ে বসে। বিরিয়ানি-পোলাও রোজদিন কি আর খেতে ভালো লাগে? অথচ ব্যতিক্রম ধারায় যেসব গল্প, আখ্যানধর্মী গল্প অথবা গোটা আখ্যান বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে তার সংখ্যা আমার ধারণা একেবারে কম হবে না, কিন্তু কেন যেন পাঠকের নজর কাড়েনি।
ত্রৈলোক্যনাথ কী চমৎকার লিখে গেছেন এক সময়! তাঁর কাহিনির বিষয়, বয়নকৌশল ও ভাষাপ্রকৌশল নিয়ে কোনও আলোচনা দেখি না। বঙ্কিম জনপ্রিয় লেখক হওয়া সত্ত্বেও বিস্মৃত প্রায়। অথচ এখনও তাঁর উপন্যাস হাতে নিলে গল্প বুনোটের কায়দা আর মায়াময় ভাষা স্রোতের মতো টানে। নারী চরিত্র ও অন্তঃপুরের জগৎ নির্মাণে বঙ্কিমের মুন্সিয়ানা খুব কম লেখকে পাই। অমিয়ভূষণের গল্প তাঁর উপন্যাসের চেয়ে অধিক গুরুত্ব রাখে এবং সেটা গল্পের পটভূমি ও ভাষার রূপবদলের কারণে, যদিও আলোচনা হয়েছে অল্পই। কমলকুমারের গল্প নিয়েই বা পাঠক কতটুকু কী ভেবেছেন জানি না। ওয়ালীউল্লাহর গল্পগুলার কথা একবার ভাবুন! ‘নয়নচারা’ বা ‘না কান্দে বুবু’ ভোলা মুশকিল। সমরেশ বসুর গল্প একসময় খুব পড়তাম। বামঘরানায় বৃত্তবন্দি থেকেও তার বাইরের লেখক মনে হতো তাঁকে। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ঠাসা বলে তাঁর গল্পপাঠে প্রচলিত ছকের মাঝে অন্যরকম স্বাদ নিয়ে আসত মনে। যদিও আমার বেশি ভালো লেগেছে কালকূট ছদ্মনামে একসময় ভ্রামণিক যে-লেখাগুলা তিনি লিখেছেন সেগুলা। ‘কোথায় পাবো তারে’ এখনও মনে হয় হাতে নিলে পড়তে ভালো লাগবে। সেখানেই অথবা ‘গাহে অচিন পাখি’ শিরোনামে সমরেশ লিখেছিলেন :—
‘কার আজ্ঞায়, কে বা রাখে নাম। নাম, কালকূট। অর্থ যার তীব্র বিষ। মনে করতে পারছি না, কেউ মুখে আঁচল চেপে হেসে বলেছিল কী না, ‘কী না নামের ছব্বা!’ ভেবেছিলাম আমিও। অমিয় অমৃত সুধা। কিছু এলো না মনে, এলো তো, একেবারে সংসার ছাড়া নাম, মহা হলাহল। আজ্ঞাটা যে কার, আমি নিজেও জানি না।’ ইত্যাদি… স্মৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি বলে ভুলচুক হতে পারে। তবে শুরুতেই বর্ণনাভঙ্গি পাঠককে ভিতরে টেনে নেয়। সমরেশ অভিজ্ঞতার খনি ছিলেন এবং সেটাকে ব্যবহারও করেছেন যেমন ইচ্ছা। সমরেশ জাত ভবঘুরে ছিলেন বলে হয়তো এমনটা লিখতে পেরেছিলেন, পড়তে গিয়ে সেই অনভূতি হয়েছিল তখন। কিংবা কোনও-এক গল্প বা আখ্যানে পড়েছিলাম, সম্ভবত ‘টানাপোড়েন’, এখন আর অতশত মনে নেই, তবে মনে গেঁথে গিয়েছিল, যেখানে কাহিনির চরিত্র উক্তি করে :— ‘জীবনটা বুনা হইচ্যে, টানা ভরণায় বুনা হইচ্যে। জীবন বুনা কর…জীবন বুনা কর।’ এই মনের মধ্যে দাগ কেটে স্থায়ী হয়ে যাওয়াটা পাঠকের জন্য প্রাপ্তি। ব্যাপক বাণিজ্যিক লেখার ভিড়ে তাঁর গল্প আর ভ্রামণিক রূপে মানুষের রঙ্গ দেখার জাদুকরি রচনাগুলা চাপা পড়ে গেছে। এখন আর কাউকে স্মরণ করতে দেখি না।
আত্মপ্রচার হয়ে যাচ্ছে হয়তো, তবু আপনার সঙ্গে শেয়ার করছি বলে বলছি, নতুবা বলার ইচ্ছে বা প্রয়োজন হতো বলে মনে হয় না, ‘ওসমান সমাচার’ নামক আখ্যানটি ফাঁদার সময় সমরেশের সাঁওতালী উক্তি মনে উঁকি দিয়াছিল। ইংরাজ আমলে ইতিহাসের ফেরে বিহারের ছোটনাগপুর থেকে চা-বাগানে কুলি শ্রমিক রূপে চালান হওয়া ভাগ্যবিড়ম্বিত এক সাঁওতাল আখ্যানের প্রয়োজনে ছোট্ট জায়গা করে নিয়েছিল। র্যাডক্লিফ সায়েব তখন ভারতবর্ষ ভাগের মানচিত্র প্রণয়নে ব্যস্ত। সে-নিয়ে তাঁর দোটানা, অস্বস্তি, বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির সঙ্গে জিন্না, তারিণী বাবু, খান সাহেব আর সেন্টু নামে এক পাগল ছিল আখ্যানের সেই পর্বের মুখ্য বিষয়। মানচিত্র নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার ক্ষণে মাঝরাত্তিরে তাঁর ঘরে ভূতের মতো দেহাতি সেই কুলির আবির্ভাব ঘটে এবং র্যাডক্লিফের ঘাড়ে চড়ে বসে নিজের বাখান গায় :—
‘হেই সায়েব, তুই যাবি কেনে? তুই চলে গেলে হামার কী হবে! তু হামার সাথে লড়াই করলি। হামি তখুন ছোটনাগপুরে থাকি। বনের মইদ্যে হামার সুখের ঘর। তু সিখানে আসি উৎপাত শুরু করলি। তুর সঙ্গে লড়াই করলু হাম। সিধু, কানু’রা জান দিল। সাঁতালের রক্তে সাঁতাল পরগণা লাল হই গেলু। তু হামার ভগমানরে অপমান করলি। মুকে খেস্টান বানাই দিলি। সাঁওতাল থাকি মুই খেস্টান হই গেলাম। তু কইলি হামি সুখে থাকিব। হামাক বাঙ্গাল দেশে চালান করি দিলি। চা বাগানে কুলির কাম দিলি। হামি সাঁতাল থাকি কুলি হই গেলু। তুর কারণে হামি সাঁতাল পরগণা ছাড়িলাম। হামার বউ-বিটি-পরিবার ছাড়িলাম। ইখানে আসিয়া বাঙালি হইছি। বাংলা শিখতে তু হামারে বাইধ্য করলি। হামাক নিয়া এতো কিছু করলি সায়েব, কিন্তুক হামার দিন ফিরাই দিলি না। হামি তুরে বিলাত যাইতে দিবো না। তুর কারণে হামি জাত ছাড়ছি। হামার ভগমান ছাড়ছি। হিদু ও মুছলমানের মইদ্যে খেস্টান হইয়া থাকি। তারা হামারে নিয়া মজাক করে। কালা খেস্টান কইয়া হামার পিছে লাগে। হামি কিছু কইতে পারি না। এখুন তু চলিয়া গেলে হামার কী হইবে? হিদুরা মুকে বাগান থাকি খেদাই দিবে। বাগানে হিদু কুলির ঘর বেশি। হামি ওদের সঙ্গে পারিবো না। মুছলমান হামাক জাগা দিবেক না। হামি সাঁতাল থাকি খেস্টান হইছি। এখুন ভগমান বদলাইতে পারিবেক নাই। তুর কারণে হামার জাত গিয়াছে। হামি তুরে যাইতে দিবো না। তু গেলে হামারে সঙ্গে নিতে হবে। এই হামি তুর ঘাড়ে চড়িলাম। সিধু ও কানু হইলাম। এখুন হামারে তুই নামা।’
রুদালীর মতো গল্পের বয়নকার মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীকে চিনতে ও বুঝতে সাহায্য করেন ঠিক, কিন্তু সমরেশ সেই আদিবাসীর লড়াই বয়ন করতে গিয়ে যে-ভরনার প্রসঙ্গ টানেন সেটা মনে দাগ রেখে যায় এবং হয়তো উত্তরকালের পাঠক-লেখককে অচেনা জগতে একপাক ঘুরে আসার সাহস যোগায়। আমি একচিলতে অর্থাৎ ওসমান সমাচার-এ যতটুকু না-হলে-নয় তার বেশি যাইনি। আপনার লেখার সঙ্গে এই জায়গায় সহমত হয়েই বলি :— ওই জীবন আমার ব্যাপক জানা নেই! আর দূর থেকে দেখা ও জানায় অনেক তফাৎ থাকে বলে আগ বাড়িনি; আর এর বেশি দরকারও ছিল না। তো যা-ই হোক, সমরেশকে আজ আর কোথাও আলোচনায় দেখি না। আমরা কি ক্রমশ অন্যকে পাঠ করার অভ্যাস থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিচ্ছি? অথবা অত্যধিক নিজের কথা লেখার চাপে বাকি সব ভুলতে বসেছি? এমনকি জনপ্রিয় লেখকের পাঠও কি ঠিকঠাক হয় এখন? সুনীল–শীর্ষেন্দুর ব্যতিক্রম কিছু গল্প পড়েছি মনে পড়ে, যা তাঁদের মারমার কাটকাট গল্প-উপন্যাসের তলে চাপা পড়েছে। কাউকে কথা বলতে দেখি না। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প নিয়েও এখন আলোচনা হয় কি? ঘরানা বাস্তববাদী কিন্তু ‘তেলানাপোতা’ (মৃণাল সেন সম্ভবত ‘খণ্ডহর’ নামে সিনেমা বানাইছিলেন) মনে রাখার মতো গল্প ছিল।
বাংলাদেশে মাহমুদুল হক নিয়ে সবাই দেখি ইদানীং খুব কথা বলেন। আমি মাঝখানে একবার তাঁকে ফিরে পড়তে গিয়েছিলাম। জানি না কেন মন টানেনি। মনে হলো তাঁর ভাষার অন্যরকম এক গতি হয়তো পাঠককে আটকে রাখে। এর বাইরে ঠিক কি আছে সেটা বুঝে আসে নাই। হয়তো আমারই ব্যর্থতা যে আমি তাঁকে ঠিকঠাক পড়তে পারিনি। তারচেয়ে হুমায়ূন আহমেদ সই। তাঁর গল্প সুখকর। কী একটা জাদু আছে ভদ্রলোকের গল্প বয়নে, পড়ার পর মন আর্দ্র হয়ে ওঠে। কোনওকিছু বলার চেষ্টা না করে অনেকটা বলে ফেলার ক্ষমতা হুমায়ূনের ছিল এবং গল্পগুলো সে-কারণে মন ভেজায়।
তো স্মৃতি থেকে এইসব খুচরো উদাহরণের মধ্যে আপনি যখন বুদ্ধদেবের গল্পের প্রসঙ্গ টানেন তখন আমার বা আপনার জীবনের তারে বাঁধা গল্প যারা লিখেছেন তাদের নিয়ে পাঠকের প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনের ঘাটতি ও শূন্যতার জায়গাটা তীব্র হয়ে ফোটে। বাংলাদেশে এখন নতুন ট্রেন্ড দেখি। ওপার বাংলার লেখকদের নিয়ে পারতপক্ষে কথা-না-বলা! তারা যেহেতু বলেন না, অগত্যা আমরাও বলি না। তারা ‘বলেন-না’ এটা তাদের সীমাবদ্ধতা এবং আমাদের সেখানে থোড়াই কেয়ার করা উচিত ছিল মনে করি। আমাদের লেখা ও লেখকরা যদি সত্যিই ভারে কাটে উনারা কতদিন না-পড়ে অথবা কিছু না-বলে থাকবেন? জাতীয়তার এইসব অভিমান ও বাদবিবাদ এখন আর ঠিক বুঝি না! সত্যি বুঝি না! পাঠক ও লেখকের আবার কিসের দেশ-বিদেশ? যাঁকে প্রয়োজন তাঁকে দমভরে তারা পাঠ যাবেন। সে কলকাতা না আফ্রিকা এইসব দেখার টাইম নাই। সমগ্র বিশ্বকে পাঠ যাওয়ার মধ্যেই তো নিজের রাস্তা খোঁজার রসদ মিলে বলে জানতাম এতদিন। এখন ছফা–সলিমুল্লাহ’র প্যাঁচালে পড়ে মনে হয় আমরা নিজের শক্তি ও তরক্কি দিয়ে ওপার বাংলার কাছে পৌঁছানোর পরিবর্তে বিবাদ আর জাত্যাভিমান দিয়ে নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছি আর ওদের পিঠ চুলকাচ্ছি। ওরাও হয়তো তা-ই করছেন। আজব কারিগরি বটে! উনাদের সার্টিফিকেটের প্রত্যাশা আমাদের কেন থাকবে? আমরাই-বা উনাদেরকে সার্টিফিকেট দিতে যাব কেন? দরকার পারস্পরিক পাঠ ও আলোচনার বাতায়ান তৈরি করা। সে-কাজ করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবিতার ধরন নিয়ে দ্বন্দ্ব এমনকি মার কাটকাট কুতর্কও থাকবে, কিন্তু তা-বলে উনারা আমাদেরটা পড়ে না বা পোছে না দেখে আমরাও উনাদেরটা পাঠ যাব না এ কেমন কথা! সত্যি বুঝি না এখন!
দুই বাংলা মিলে আমরা অনেকরকম গল্প লিখেছি, আবার এটাও সত্য আরও বহুরকমের গল্প আজও সেভাবে লিখতে পারিনি। বহমান সময়কে স্বয়ং চরিত্র করে লিখতে পারিনি। তুচ্ছ দৈনন্দিনে কতরকম চিহ্নের প্রবাহ স্রোতের মতো বহে, সেগুলা নিয়ে লিখতে পারিনি। আমার-আপনার জীবন যে-ব্যক্তি যাপন করে তার অনুভবগুলা নিয়ে ছোট কিংবা বড় পরিসরে সত্যি লিখেছি কি? রোজকার দিনযাপনের চাপে সব গুলিয়ে ফেলে সাংঘাতিক ফ্যান্টাসিতে ডুবে যাওয়ার গল্পগুলা লিখতে পারিনি। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের মতো শিশুতোষ রূপকথার ছলে গভীর জীবনবাদি মন-আর্দ্র-করা গল্প রচনা আমাদের দিয়ে আজও হলো না! ঠাকুরামার ঝুলি থেকে বেতাল পঞ্চবিংশতির গল্প বয়নের রীতিকে ব্যবহার করে আমরা লিখতে পারিনি। আমরা আজও বোধহয় মহাভারত বা আরব্য রজনীর শৈলীটাকে কাজে লাগিয়ে গল্পের-ভিতরে-গল্পের বুনোট ঠেসে মহাকব্যিক আখ্যান অথবা আখ্যানসম গল্প লেখার কৌশলটা রপ্ত করতে পারিনি। মধ্যযুগে বিরচিত মঙ্গলকাব্যের প্যাটার্নকে দুরস্ত করে গল্প ফাঁদার দিকে কেন যাইনি সে-প্রশ্নটি দেবেশ রায় একসময় তুলেছিলেন মনে পড়ে। এখানেও ভাবার রসদ আছে এবং এভাবেও হয়তো গল্প লেখা সম্ভব। চিন্তার প্রবল স্রোতকে আজও গল্প করে তুলতে পারিনি। বোর্হেসের মতো প্যারাবলের আঙ্গিকে লেখার ভাবনা আমাদের কেন যেন ধাতে সয় না। অথচ এভাবেও লেখা যায় এবং মননশীলতাকে গল্পের অমোঘ সাবজেক্ট করে তোলা যায়।
হেন বিষয় নেই যা নিয়ে লেখা যায় না! এমনকি অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়েও লেখা যায়, যদি চোখকান আর মগজটা সেই অভিজ্ঞতাকে ধারণ করতে জানে। আমাদের সমস্যাটা এখানে :— গবেষণা ও তথ্য-উপাত্তকে ব্যবহার করে হৃদয়প্লাবি গল্প বা আখ্যান লেখার মতো ভাষা ও কাঠামোই আমাদের নেই। আপনার লেখার সূত্রে এই প্রশ্নটি তাই আসে :— সত্যি কি গবেষণা করে আমরা লিখতে পেরেছি আজোবধি? ইতিহাসকে ব্যবহার করে অনেকে লিখেছেন, কিন্তু সেটা ইতিহাসের বিবরণ, পাঠ্যবইয়ে যেমনটা পড়ে থাকে লোকে সে-রকম। কলিংউড যেমন ইশারা দিয়েছিলেন, ইতিহাসকে কেমন করে কল্পনা ও অনুমানের ভিতর দিয়ে নতুন করে নির্মিতি দিতে হয়, আমরা কি সে-রকম কোনও ইতিহাসনির্ভর আখ্যান লিখতে পেরেছি? আমার সঠিক জানা নেই অথবা বলতে পারেন চোখে পড়েনি। যে-কারণে আমাদের লেখকরা গবেষণা সত্যিই করেন কি না এ-নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। যদি তা-ই হতো তবে এতদিনে একজন একো (Umberto Eco) অন্তত জন্ম নিত বঙ্গে।
তো এ-রকম বহু না-পারার মধ্যে বুদ্ধদেব বসু বা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাদের বাঁধাধরা স্বীকৃতির বাইরে খানিক আলাদা হয়ে যখন গল্পটল্প লিখেন, কেন যেন মনে হয় তাদের দিকে পাঠকের একবার তাকানো উচিত। আপনি বুদ্ধদেব বসুর দিকে তাকিয়েছেন দেখে ভালো লেগেছে। আমি বসুর গল্প বিচ্ছিন্ন পড়েছি দু-একটা। উপন্যাস টানেনি; তবে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা তাঁর গল্পের চলচ্চিত্রায়ন ‘একটি জীবন ও কয়েকটি মৃত্যু’ দেখেছিলাম মনে পড়ে। গল্প হিসেবে বিশেষ কিছু না, তবে হরিচরণের জীবনকাহিনি হওয়ার কারণে ভালো লেগেছিল। শেষটা যদিও মর্মান্তিক ছিল। যেমনটা বঙ্গে হয়ে থাকে, হরিচরণের ভাগ্যে সেটাই জুটেছিল আর-কি! আপনার সুবাদে আগ্রহ জাগছে বসুর গল্প পাঠ করার। তবে মনজুরুল ইসলাম পড়েছি এবং এই সময়ের বিবেচনায় যেসব গল্প আমরা আজও লিখতে পারিনি সেইসব গল্প লেখার জায়গা থেকে তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের যাত্রী মনে হয়েছে। ‘গল্পপাঠ’-এর বিশেষ সংখ্যাটি ছাড়া তাঁকে নিয়ে তেমন আলোচনা আজও চোখে পড়েনি। যদিও বাংলাদেশে যারা ফ্রেমের বাইরে গিয়ে নতুন আঙ্গিকে নাগরিক জীবনের গল্পগুলা লিখতে চাইছেন তাদের জন্য মনজুরুল ইসলাম পাঠ প্রয়োজন মনে করি।
বিদেশি ধাঁচে প্রভাবিত হয়ে লিখছেন বলে তাঁকে তাচ্ছিল্য যাওয়ার কিছু নেই। বিদেশি ধাঁচে ওয়ালীউল্লাহ আরও আগেই লিখেছেন। লোকনাথ ভট্টাচার্যও এক কদম এগিয়ে দার্শনিক চেতনাপ্রবাহকে লেখার উপজীব্য করেছিলেন। এতে জাত যাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের নিভৃত কোনও গ্রামে বসেও আজকের একজন বাঙালের মনে মহাবিশ্বে শামিল হওয়ার খায়েশ জাগতে পারে, যেহেতু যে-বীজধানে ফলবান ভাতের দানা সে পেটে পোরে সেটার স্বত্ব আর তার হাতে নেই। ধানবীজের মতো আজকের গণ্ডগ্রামের মানুষটিও বহুজাতিক ও বহুজাগতিক। যে-কারণে সে বাংলাদেশে যেমন থাকে, আবার সেখানে থাকেও না। লেখার বিষয়-আশয়-চরিত্র-উপাদান সবকিছু অমোঘভাবে দেশি হওয়ার পরেও মানুষ সত্যিকার অর্থে কোনও দেশে বিলং করে কি না সন্দেহ!
আমাদের হয়তো প্রবলভাবে ক্লাসিক বা ধ্রুপদি সাহিত্যের জগতে ফেরত যাওয়া প্রয়োজন। নতুবা এটা বুঝে আসবে না কেমন করে স্থানিকতায় জারি থেকেও সমগ্র পৃথিবী তথা মহাবৈশ্বিক চেতনার তরঙ্গে নিজের উঠানকে নিরিখ করতে হয়। উর্দু সাহিত্যে কুররাতুল আইন হায়দার বিরচিত ‘আগ কা দরিয়া’ বা ‘আগুনের নদী’ আখ্যানে এ-রকম একটি সফরের অভিজ্ঞতা হয়েছিল মনে পড়ে। নন্দ রাজবংশের পতন দিয়ে শুরু করে লেখক শ্রীমঙ্গলের রেলস্টেশন অবধি কাহিনিকে টেনে নিয়েছিলেন। হাজার মাইলের এই সফরের মধ্যে ইতিহাস তার নিজস্বতায় তরঙ্গিত হলেও দ্বন্দ্ববিহীন ছিল না। কুররাতুল পাকিস্তান সৃষ্টির যন্ত্রণাদগ্ধ বয়ানটি উপজীব্য করেছিলেন কিন্তু সে-বয়ানে ‘সময়’ স্বয়ং চরিত্র হয়ে উঠেছিল। বাংলায় এই চেষ্টা রিজিয়া রহমান-এর বং থেকে বাংলায় পাই। সুখপাঠ্য, কিন্তু হায়দারের আগ কা দরিয়ার মতো দূরবিস্তারী নয়। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ যেমন তার ভাষাশৈলীর অভিনবত্বের কারণে চমকপ্রদ হলেও গল্প কেমন জানি ইতিহাসের চোরাগর্তে আটকে যাওয়ার পর আর বেরোতে পারেনি। তবু এটি শওকত আলীর স্মরণীয় নির্মিতি। রিজিয়া বা আলীর এই ধারার নতুন নির্মিতি ও সম্প্রসারণ কি হয়েছে বঙ্গে?
প্রসঙ্গত অসীম রায়কে মনে পড়ে গেল! সাম্যবাদী ভাবনাছকে বিরাজ করেও ছাপোষা কেরানিজীবনকে তাঁর গল্প ও আখ্যানে মহিমা দিয়েছিলেন। শ্রেণিসংঘাতের রগ ফুলিয়ে রাগটাগ না ঝেড়ে ক্রাইসিসটাকে চিন্তায় জারিত করেছিলেন এই লেখক। বড় সহজ ভাষায় লিখতেন। মনোটনির মধ্যে ব্যক্তির একা হয়ে যাওয়ার গল্পগুলা লিখতেন। ‘আবহমান’-এ আমাদের বাংলাদেশে কাটানো শৈশবের গল্প লিখেছিলেন। মন-আর্দ্র-করা সেই বাখানে মুন্সিগঞ্জে পদ্মার জীবন্ত ধারাবর্ণনা আজও মনে পড়ে। এই ধারাটাকে আগানো যায়নি। অসীম রায় নামটি এখন আর উচ্চারিত হতে দেখি না। কায়েস আহমেদ-এর কথাই ধরুন। গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত আর সংখ্যালঘুদের জগৎ নিয়ে লিখে গেছেন আত্মহননের আগে অবধি। প্রচলিত গল্পবয়নের ছকে লিখেছেন, তার মাঝেও ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভিটেমাটি ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’ বা এ-রকম কাছাকাছি নামে লেখা প্রতিবেদনধর্মী গল্পটির কথা এখন মনে পড়ছে। অন্যরকম ছিল। এই অন্যরকম ধাঁচটিকে নিয়ে পরে কেউ আর কাজ করেননি।
এইসব মনে এলে ইলিয়াসের ‘ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?’ নামক মিথ-হয়ে-ওঠা লেখাটিকে একপেশে লাগে। একটা কাঠামোবাদী ছকে বাংলা গল্প ঘুরছে এবং এখন অবধি বেরোতে পারেনি; ইলিয়াস সেখানে দাঁড়িয়ে সেভাবেই লিখেছেন। তিনি গল্পে অতুল, কিন্তু তাঁর মননজাত ভাবনাগুলা বিশেষ দরকারি মনে হয় না আর। যেমন হাসান আজিজুল হকের গল্প আর মননজাত প্রবন্ধ সমতুল নয়। তাঁর গল্প ও আখ্যানভাবনার জায়গাগুলো ক্লিশে এবং প্রথানুগ। স্পর্ধা হয়ে গেল হয়তো, তবু পাঠকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থেকে যা অনুভব করেছি তা বললাম। ভালো গল্পকার হলেই উৎকৃষ্ট চিন্তক হবেন এমনটা অন্তত বঙ্গে বেশি সুলভ নয়। যে-কারণে আমাদের গল্প লেখা বা বয়নের ধাঁচগুলো বৃত্তবন্দি। সেখানে নতুন করে ভাবা ও ভাবানোর মতো অতুল রচনার সন্ধান লণ্ঠন দিয়ে খুঁজতে হয়। দেবেশ রায় ছাড়া কারও নাম এই মুহূর্তে মনে আসছে না যিনি গল্প বয়নের সঙ্গে এর জায়গাজমি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার চেষ্টা করেছেন।
মোদ্দা কথা, গল্প-আখ্যান নিয়ে আলোচনার প্রথাটা পুনরায় সজোরে ফেরত না এলে যেসব গল্প আমরা আজও লিখতে পারিনি সেসব নিয়ে ভাবার চল গতি পাবে না। সাহিত্যতত্ত্ব পড়ে লিখতে হবে এমন নয়, তবে তত্ত্ব সাহায্য করে নতুন জায়গা খুঁজতে, নিজেকে পরখ করতে, এই চর্চাটা বাংলাদেশে হয় কি না জানি না। অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যেসব গল্প আমরা প্রচলিত কাঠামোয় বসে লিখেছি এবং কাঠামোর বাইরে গিয়ে নতুন কোনও কাঠামো ফেঁদে এখনও লিখতে পারিনি অথবা কিছুটা হয়তো লিখেছি এবং আরও লেখা প্রয়োজন … এইসব নিয়ে লেখালেখির মাধ্যমে ভাবনাচিন্তা হাজির করার কোনো চেষ্টা আমাদের দেশে একবিন্দুও দেখি না; থাকলে, আমার বিশ্বাস, অন্তত গল্পপাঠ-উত্তর আলোচনার ধারায় আবার ফেরা যেত।
গানপারসঞ্চালকের পত্রযোগের ধারাবাহিকতায় লেখকের সাড়া তাৎক্ষণিকা আকারে এই নিবন্ধিকায় গৃহীত। — গানপার
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS