কন্সার্টটা ক্যালানো নয়, রিভিয়্যুটা ক্যালানো। মর্মবস্তু অল্প। অযথা প্যাঁচানো। মনে হয়েছিল যে একটা সামারি লিখতে পারব অন্তত। হলো না শেষ পর্যন্ত। হলো না কেন, অন্তিম প্যারায় কারণ দর্শাইব।
কন্সার্টসামারি লিখতে লেগে দেখি যে ম্যাটেরিয়্যাল মগজে এনাফ নাই। ক্রিকেটের ম্যাচসামারি লিখতে/ন্যারেইট করতে যেটুকু সংখ্যাতাত্ত্বিক স্মৃতির দরকার পড়ে, একটা গানবাজনার অনুষ্ঠানসারাংশ রচিতে যেয়েও অন্তত ওইটুকু তো চাই; মানে, — কে কে গাইলেন, কি কি গাইলেন, কোনটার পরে কোনটা গাইলেন, কোন গানে কে কি বাদ্য বাজাইলেন, কোথায় কোন কোন পয়েন্টে জোড়টা ভালো হলো, কোথায় বিযুক্তি বিন্দাস হলো, যন্ত্রে-রেকর্ডেড গলাতেই শিল্পী তীব্র তেজে গাহিয়া যাইলেন উরাধুরা গান নাকি ইম্প্রোভাইজেশনের নজরনিশানা হাল্কা চালে দেখা গেল, কণ্ঠের সঙ্গে ইন্সট্রুমেন্টের হার্মোনাইজেশন কতটা ভালো হলো অথবা খারাপ — এইসব নিয়া আলাপ তোলা অ্যাফিশিয়েন্ট একটা মিউজিক্যাল কন্সার্ট সামারিতে এক্সপেক্টেড। কোনোটাই নিবন্ধের এই বৈঠকে অফার করা যাচ্ছে না।
যাচ্ছে না, প্রারম্ভে এই স্বীকারবিবৃতি রিডারের সিম্প্যাথি ড্র করার জন্য নয়; যাচ্ছে না তার কারণও অবশ্যই এক্সপ্ল্যাইনেবল্। করা হবে এক্সপ্ল্যাইন যথাজায়গায় টাইমলি, ইন-শর্ট হলেও।
‘অগ্রযাত্রায় দূর্বার বাংলাদেশ’ শীর্ষক (ওই বানানেই দুর্বার, দীর্ঘউকারে, তোরণে স্ক্রিনে মাল্টিপ্রোজেক্টরে লেটারহেডে ব্যানারে গেটপাসকার্ডে ‘দূর্বার’ সর্বত্র) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজন করেছিল কন্সার্টটা। বাহাদুরের আয়োজন, সরকার বাহাদুরের, অতএব ধামাকা থাকবেই। ছিলও ধামাকা। ফায়ারওয়ার্ক্স। জায়ান্ট স্টেজ এবং ডিভ্যাস্ট্যাইটিং ডেকোর। ওইসব তো আর কন্সার্ট না, পার্ট অফ কন্সার্ট যদিও, বাংলাদেশে কন্সার্টরিভিয়্যু পরিণতমনস্ক যতদিন না-হচ্ছে এইধারা বাহ্যিক রঙবাহার নিয়া বাহ্যি যাওয়াই রিভিয়্যু গণ্য হবে। নো ওয়ে।
গেয়েছেন দলছুট বলা যেত সঞ্জীব থাকলে বেঁচে। এখনও দলছুট বলা হয় ব্র্যাকেটে যদিও। পদ্মলোচন নামে একটা কানা ছেলে। সঞ্জীব চৌধুরী রিপ্লেইস করা মানবসংসারে সম্ভব? বাপ্পা ব্যর্থ বলা হচ্ছে না, বাপ্পার হাত নাই এইসব মনেপড়াপড়ির পিছনে, তালে-লয়ে-বাদ্যিবাজনায় বাপ্পা পারদর্শী। কিন্তু দলছুট তো নয়। বাপ্পার পক্ষে দলছুট সম্ভব নয়। মিউজিকে নিপুণ বাপ্পা, ম্যাজিকে নয়। ম্যাজেস্টিক ম্যাজিশিয়্যান কষ্ট পেয়ে চলে গেছে, ফেরানো সম্ভব হয় নাই, ফেরানো যাবে না তারে এই সুরের শোহরতভরা পারাবারের পৃথিবীতে। এইটা কাজেই বুঝে ফেলা গ্যাছে যে সঞ্জীবের প্রত্যাগমন সম্ভব না-হলে দলছুট সম্ভব নয়। বাপ্পারও দশা হয়েছে ‘নট উয়িথ য়্যু নর উয়িদাউট য়্যু’। দলছুট পুনরুৎপাদন সম্ভব নয়, দলছুটস্মৃতি ইরেইজ করাও সম্ভব নয়। বেচারা! পার্ফোর্মার এবং কম্পোজার বাপ্পা অ্যাপ্রিশিয়্যাব্লি গ্যুড, বাট প্রেডিক্ট্যাবল্। ম্যাজিশিয়্যানের চাই আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি। জিনিশটা বাপ্পায় নাই। মিউজিকে আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি না-থাকা আদৌ দোষের নয়। কালেভদ্রে একাধজন শুধু অতিকায় আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি নিয়া আল্লার দুনিয়ায় আবির্ভূত হয়।
ঠিক মাগ্রেবের আজানের পরে, এশা-মাগ্রেব সন্ধিক্ষণে, স্টেজে আবির্ভূত হন বাপ্পা। ধারাবাহিক গেয়ে গেলেন হালি-দুয়েক। মন্দ না। ভালো। শোভন চেয়ারে বসা বাংলাদেশ রেলওয়ের প্যাসেঞ্জার মনে হচ্ছিল শ্রোতার জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজেদেরে। প্ল্যানড রেলগাড়ি চালিয়েছেন অবশ্য। ধুপধুপ ধিমধিম ঝিকঝিক ঠাশঠাশ আওয়াজে স্টেডিয়াম কোলাহলখলবলিত। জুধা করা না-মুমকিন কোথায় গিটার বাজছিল কোথায় প্যাড-বোর্ডস্-ড্রামস্। দৌড়ের উপ্রে বেবাক দুনিয়া। আখাউড়া জংশনেও থামাথামি নাই। পিনিকের শিশিওয়ালা বাপ্পা হতে পারেন নাই সিলেট স্টেডিয়ামে ১৮ মার্চের উন্নয়ন ক্যানভ্যাসিং কন্সার্টের সন্ধ্যায়। গান গেয়েছেন যদিও ‘পরী’, ‘বায়োস্কোপ’, ‘বায়ান্ন তাস’ ইত্যাদি। ‘তীরহারা ওই ঢেউয়ের তরী পাড়ি দেবো রে’ গাইলেন। বোধহয় ইন মেমোরি অফ মার্চ। বৈশিষ্ট্যহীন রেন্ডিশন। পরে, শেষের দিকটায়, একদম ঘোষণা দিয়া গাইলেন ‘গাড়ি চলে না’। কাভারভার্শন অফ আবদুল করিম বাই দলছুট। সঞ্জীবের গলায় এইটা মাতোয়ালা করেছিল বদ্বীপবাসীদিগেরে। ঢের বছর চলে গেছে এরপর ধূসর অতীতে। এখনও অমলিন। মধ্যমার্চরজনীতে বাপ্পার গাওয়া ওই একটা গানেই জোয়ারি ছিল। জোয়ারি মিউজিকে, রেন্ডিশনে, প্রেজেন্টেশনে। ব্যাড না। ভালো। শুকনা গলায় ভালো।
মমতাজ কেমন গাইলেন, সংক্ষেপেই বিবরণ সেরে নেয়া যায়। বিস্তারে বিশদে বলার কোনো মওকা রাখিয়া যান নাই ওয়ান্স-আপঅন-অ্যা-টাইম ফোকসম্রাজ্ঞী অ্যাট-প্রেজেন্ট এমপি মমতাজ বেগম ২০১৮ মার্চের সিলেটসন্ধ্যায়। শি ইজ্ রিয়্যালি অ্যা মিউজিক পার্সোন্যালিটি। কিন্তু গ্রস্ গানবাছাই আর গদগদ উন্নয়নক্যানভ্যাসারের ভূমিকায় পার্ট নিতে যেয়ে ন্যাজেগোবরে পার্ফোর্ম করেছেন ফাইট্টা-যাওয়া গানগগনের এই ঈশ্বরী। ইন্সট্রুমেন্ট হিশেবে ক্ল্যারিনেট বা যাত্রার ফ্ল্যুট তো দুর্ধর্ষ। তবে মমতাজের সহশিল্পীরা বাদনে এমন একটা কায়দা অ্যাপ্লাই করে গেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, খোদার তিরিশটা গানই বিয়াবাড়ির মৌজফুর্তি ছাড়া আর-কিছু মনে হয় নাই। কিন্তু গানগুলো সব তো আর ফুর্তিজীব্য ছিল না, ব্লান্ডার ঘটেছে এইখানেই। ‘আমার বন্ধু দয়াময় / তোমারে দেখিবার মনে লয়’ গানখানি বিবাহগীতিকার বাদ্যপ্রয়োগে গাইলে যে হা-হতোস্মি বিকার ঘটে, ব্যাপারটা আন্দাজ অসাধ্য হবে না অনুপস্থিত সমুজদারের পক্ষেও। কয়টা গান গেয়েছেন মোটমাট তিনি? তিরিশটা? না, আট-দশটা হবে। করিম গাইলেন, রাধারমণ গাইলেন, মরার কোকিলা গাইলেন, আর হালের হিপহপ ডিস্কো মমতাজ ‘লোকাল বাস’-‘পাঙ্খা’ না-গাইয়া শো খতম দিবেন বলিয়া মনে হয়? ঠিকই ধরেছেন। মমতাজের পার্সোন্যাল প্রিয় বোধহয় গানদুইটা। আল্লায় জানে, কে কখন মতিভ্রমে পতিত হয় তা কি আর বান্দার নিয়ন্ত্রণে? মাবুদ!
সব-কয়টা গানই ছিল গুণপনাহীন গায়নের, উল্লেখ বাহুল্য। তবে একটা গান অসাধারণ লেগেছে কেবল লিরিকের গুণে, এইটাই একমাত্র যা এই রিভিয়্যুয়ারের পূর্বাভিজ্ঞতায় ছিল না। মাটির একটা মূর্তি বানাইয়া আল্লায় নিজে সেই মূর্তির ভিতর ঢুকে মানুষ দিসেন নাম, এই-রকম সেই গানের মুখপাতের পঙক্তিনির্যাস। ওজনদার গান, মমতাজ গেয়েছেনও সুন্দর। মনে গেঁথে গেল অভিজ্ঞতাটা। গানকর্তার নামটা পাত্তা লাগাতে হবে। অ্যানিওয়ে। যে-ব্যাপারটা হাল্কা উল্লেখে ক্ষ্যামা দিয়া যাব তা এ-ই যে, মায়ের সঙ্গে মামুর বাড়ির গল্পটা না-করলেই নিজেও মমতাজ বেগম বাঁচতেন আমাদেরেও বাঁচাইতেন অস্বস্তির কবল হইতে। রাধারমণ-করিমের দেশে এসে এত্তগুলা রাধারমণ-করিম বিব্রতকর উচ্চারণে এলেবেলে রেন্ডিশনে গেয়ে একটা হাইলি এক্সপেন্সিভ মঞ্চের অযথা ব্যবহারই করে গেলেন বলা যায়। এত গুরুভক্তি যদি, নিজের গুরুর নামটাও নিলেন না আর গাওয়া তো দূর হনুজ দিল্লি। নিশ্চয় শাহ আলম সরকারের নাম আমরা কানের লতি চিমটি কেটে উচ্চারিব মমতাজের প্রসঙ্গ উঠলে। ঝিলমিল ঝিলমিল করা ময়ূরপঙ্খি নাও মমতাজের কাছে শেখ হাসিনার নাও হয়ে যায়, বঙ্গবন্ধুর নাও হয়ে যায়, ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে আওয়ামী লীগের নাও হয়ে যায়; কিন্তু এইভাবে কতদূর এবং কতদিন একটা গান দিয়া পার্পাস সার্ভ করাইবেন দলভোক্তা দেশপ্রেমী শিল্পী মহোদয়? সিচুয়েশন অপরিবর্তিত রইবে কালান্তর তক, দোয়া রাখব। নইলে এসএ করিম নিজের গানটাও সনাক্ত করতে ব্যর্থ হবেন ধানছড়া-পাল্লা-লাঙ্গল-কাস্তেহাতুড়ির আমদানিতে একদিন। মনে শুধু রাখি না কেন যে একটা গান আল্লার কালাম যেমন নয় তেমনি স্বীয় দলের প্যাম্ফলেট মনে করাও সংগীতে অভক্তির লক্ষণ।
অতঃপর মঞ্চারোহন হয় দানবের, রাত্রি সাড়ে-দশটায়। কিন্তু দর্বেশ বানিয়ে ছাড়েন উপস্থিত অধীর সংগীতাগ্রহী লিস্নারদেরে। জেমস্। মনে হয় না আর-কিছু স্মরণ করা সাধ্যিসীমায় আছে এই রিভিয়্যুয়ারের। সম্ভব নয় এই নিবন্ধবৈঠকে অ্যাট-লিস্ট। পরে ফের একটা ট্রাই দেয়া যাবে। এখন সম্ভব নয়। এখনও দুই দিন গত হয় নাই, ভীষণ দানবের ধাক্কায় দীক্ষিত দর্বেশরূপান্তর শুধু এই রিভিয়্যুয়ারের হয়েছে বললে একদম খাড়া বেঈমানি হবে। কেউ কারো দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারে নাই ঝিমদোলা রাইতের সেই মাঝময়দানে। কেউ কিছুই নয়ান মেলে তাকিয়ে দেখতে সক্ষম হয় নাই ছিলেন তিনি যতক্ষণ দীক্ষাদানের মঞ্চে।
জেমস্ যদি না-গাইতেন ওই মঞ্চে, ফেয়ার একটা ট্রাই করা যেত অনুষ্ঠান রিভিজিটের। গুণনিষ্ঠ একটা ব্যাল্যান্স বজায় রাখা যেত অবশিষ্ট সবাই কি গাইলেন কেমন গাইলেন ইত্যাদি ইনিয়েবিনিয়ে লেখার মধ্য দিয়ে। জেমসের সঙ্গে শেয়ারের স্টেজ নিয়া পাগল ও শিশু কোনো তরফেই স্পিচলেস হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। পাকনাদের ব্যাপারস্যাপার আলাদা। ক্যালানো কন্সার্ট নয়, ক্যালানো রিভিয়্যু বলছিলাম; কেন — বোঝা গেল কি মিস্টার অ্যান্ড মিজগণ? দোয়েল, ময়না, বুলবুলি, টিয়া গাইবে একমঞ্চে আদাব-সালাম দিয়া; তাদের পাশে দানব রাখলেই বিনাশ। দানবের শুরু হয় সেখানেই, দিনদুনিয়ার যেখানে শেষ। জেমস্ না-গাইলে এইটা একটা ব্যাল্যান্সড রিভিয়্যু হতে পারত, সম্ভাবনা ছিল অন্তত। দোয়েল নিয়া বাকবাকুম হয়, দানবের সাক্ষাতে চুপচাপ দাঁড়ায়ে থাকতে হয়। নিশ্চুপ, নির্ভয়। মিউজিকলিটারেসি থাকলে এই নিশ্চুপদশাটা ল্যাঙ্গুয়েজে এই রিভিয়্যুয়ার নিয়া আসতে পারত।
ভবের এই বাজারে মানববন্দনা দস্তুর, মানুষেরই হয় নিন্দা ও নন্দনা, দানববন্দনা আনভুবনের কাজ। কত আর! মানবের এই সংসারে এমনিতেই দীর্ঘ দৈত্যপ্রশস্তি গেয়ে এই রিভিয়্যুয়ার হইয়া রইছে গুনেগার, কত আর! ‘তবে তফাৎ তফাৎ থাকো’, দূর হঠ, অডিয়েন্সপূর্ণ উন্মুক্ত রজনীর ময়দানে বেবাক হিংসুক লোকেরে একরাত্র দর্বেশ-বানানো অয়ি বিপুলা দানব!
নতজানু, দুইহাত-প্রসারিত …
[metaslider id=”4234″]
… …
প্রতিবেদক : সুবিনয় ইসলাম
- গোপালটিলায় গানসন্ধ্যা - February 2, 2021
- গান ও গঞ্জনা - December 1, 2019
- নগরনাট সঞ্জীবস্মরণ - November 21, 2019
COMMENTS