বাংলাদেশের সব শ্রেণি এবং সব বয়সের দর্শকের কাছে যে-নায়িকার গ্রহণযোগ্যতা, শাবানা তার নাম। অবশ্য দেড়-দশকেরও উপরে হয়ে গেছে উনি সিনেমায় নাই আর। তারও আগে থেকে উনি সিনেমায় নায়িকার রোল ছেড়ে চরিত্রাভিনেত্রীর রোলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে দেড়-দশকেরও উপরে কাজ করে গেছেন। উনার সময়ের অন্য নায়ক-নায়িকারা যেখানে মেকাপে-গেটাপে কড়া মাইঞ্জা মেরে নিজেদেরে ছোকরাছুকরি প্রমাণে স্টেমিনা ও এনার্জি ব্যয় করেন, শাবানা এইখানে এক উজ্জ্বলতর ব্যতিক্রম।
অবশ্য যখন নায়িকা হিশেবে শাবানা বাংলাদেশের সিনেমায় এন্টার করেন, তখন তার মতো অবলীলায় স্ক্রিন অধিকার করিয়া রাখা নায়িকা দ্বিতীয়জন ছিল বলা টাফ হবে। ন্যাচারাল অভিনয়ে শাবানার জুড়ি ছিল না। ন্যাচারাল অভিনয় করেও উনি ড্রিমি একটা অ্যাটমোস্ফিয়ার-অ্যাম্বিয়্যান্স স্প্রেড করে দিতে পারতেন। মোটামুটি পাকিস্তান আমলটা বিদায় নিতেই শাবানা বাংলাদেশের সিনেসমুজদার পুরুষদর্শকদের কাছে ড্রিমগার্ল হয়ে দেখা দেন। নারীদর্শকরা তাকে একটা আদর্শের জায়গায় রেখে দিয়েছিল গোড়া থেকেই।
উনার সমসাময়িক নারী-অভিনয়শিল্পী যারা নায়িকার পার্ট নিতেন তাদের তুলনায় শাবানা কেন অনন্য ও আলাদা, এই জিনিশটা বুঝতে চাইলে শাবানা-অভিনীত পুরানা ছায়াছবিগুলো ছুটিদিনে দেখে নিলেই হয়। শাবানা সেই সময়ের অভিনেত্রী যখন ছবিতে গল্পের নিটোল কাঠামোটাকে প্রেফ্রেন্স দেয়া হতো। গত দুই দশক ধরে গল্পের কোনো আগামাথা গাছপাথর না রেখেই সিনেমা বানানো হয়। কাজেই, শাবানা তার সময়ের সুবিধাটা পেয়েছেন পুরা মাত্রায়। পেয়েছেন এবং কাজে লাগাইতেও কসুর করেন নাই।
কিন্তু যখনই তিনি খেয়াল করেছেন সময়টা খানিক বেঁকে যেতেছে, ধুমধাড়াক্কা বাজে বইয়ের মোচ্ছব লেগেছে দেশে, কালবিলম্ব না করে বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেত্রী শাবানা নায়িকার ন্যাকামি-ন্যাংটামি ছেড়ে চরিত্রাভিনেত্রী হিশেবে নিজেকে সিনেমায় প্রেজেন্ট করতে শুরু করেছেন। নায়িকা হিশেবে যেমন সবার শ্রদ্ধা আর প্রেমের আসনে ছিলেন, চরিত্রাভিনেত্রী হিশেবেও ওই জায়গাটা আদায় করে নেন সবার কাছ থেকে। এক-সময় শাবানা যদি সিনেমায় ভাবী বা মায়ের চরিত্রে থাকতেন তাইলে সিনেমার নায়ক-নায়িকার নখরামির চেয়ে বেশি স্পেস দিতেন পরিচালকেরা শাবানাজিকেই। কারণ, ফালতু একটা কাহিনির সিনেমা শাবানাই শেষতক একটা জায়গায় উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন। দর্শক নায়ক-নায়িকার লাফঝাঁপ দেখে ক্লান্ত হয়ে একটু পরপর শাবানাকে দেখতে চাইত। পরিচালকেরা নিরাশ করতেন না।
আনকনভেনশন্যাল বিউটি বলতে যা বোঝায়, শাবানা ছিলেন এক্স্যাক্টলি তা-ই। শুরুর সময়ের নায়িকা শাবানা কেমন ছিলেন দেখতে চাইলে উনার ‘আনাড়ি’, ‘চকোরী’, ‘ছোটসাহেব’ সিনেমাগুলো দেখতে হবে। এই সময় তিনি পাকিস্তানি নায়ক নাদিমের সঙ্গে একটা দারুণ রসায়নের জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন। পরে ওয়াসিম, উজ্জ্বল, মাহমুদ কলি, রাজ্জাক সহ অনেকের সঙ্গেই হিরোয়িন হয়ে ব্যবসাসফল বই উপহার দিয়েছেন। তবে শাবানার সবচেয়ে দীর্ঘকালিক জুটি বোধহয় আলমগীর। অবশ্য পুরা ব্যাপারটা আরেকভাবে ভাবতে হবে যদি শাবানার ভাবী হিশেবে চরিত্রগুলো কন্সিডারেশনে রাখি। কেননা লাস্ট একটা ডিকেইড ভরে শাবানা ভাবী এবং মমতাময়ী মা বা প্রেমময়ী স্ত্রী হিশেবে জসিমের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন প্রচুর সিনেমায়।
জীবনভর শাদামাটা সাজপোশাকের বাঙালি নারীটির চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন মাতিয়ে রেখেছেন শাবানা। তার ন্যায় এমন গৌর গাত্রবর্ণ আর উন্নতনাসা বাঙালি ফিমেইল ফিগারের দেখা পাওয়া আদতেই বিরল। উনার শরীরটা চ্যাপ্টা গড়নের, ফলে ছিপছিপে বয়সটা পার করে যখন শরীর মধ্যবয়সের ভাঙনকবলিত, মধ্যবয়সেও উনি মেদসমস্যায় না ভুগে বেশ নির্ভার শক্তপোক্ত টানটান রাখতে পেরেছেন নিজেরে। একটা ব্যাপার খেয়াল করলে বেশ মজা লাগে যে সেই-সময় প্রায় সব নায়িকাই বিলেতি কায়দায় কেশবিন্যাস করতেন, খোঁপাফোলানো চুলের নায়িকাই ছিলেন সবাই। কিন্তু শাবানাই ছিলেন স্রোতের উল্টোদিকে বেণীবাঁধা নায়িকা।
না-গ্রাম না-শহর একটা ভাব তিনি তার রোলগুলো দিয়ে প্রেজেন্ট করতে পারতেন। আধাগ্রাম আধাশাহরিক যে-বাংলাদেশ আমরা আজকে পেয়েছি এতদিনের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়, শাবানা এই সময়েরই ক্যারেক্টার হিশেবে বেশ আগে থেকেই নিজেরে এস্ট্যাব্লিশ করে গেছেন। নিজেকে এত কনফিডেন্সের সঙ্গে বুঝতে পারতেন যে স্ক্রিপ্ট দেখেই তিনি নিজের ক্যারেক্টারটার একটা গতি ঠিকই করে ফেলতেন ভুয়া কাহিনির ভিতরেও।
উনি প্রায় স্ক্যান্ডাল ছাড়াই ক্যারিয়ার করে গেছেন। উনার স্বামীও চলচ্চিত্রব্যবসায় টাকা লগ্নি করেছেন দীর্ঘদিন। উনাদের একটা প্রযোজনা সংস্থাও ছিল। অনেক ব্যবসাসফল ছবিও উপহার দিয়েছেন প্রযোজক হিশেবে। এক-সময় শাবানার মেয়েটি ইলোপ করে অ্যামেরিকায় কি-একটা লাফাঙ্গার সঙ্গে। এরপর থেকে শাবানা পারিবারিক মানইজ্জতের দোহাই দিয়ে নিজেরে প্রত্যাহার করে নেন সিনেজগৎ থেকে। একদম পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপে শাবানা রাইতদিন মশগুল হয়ে যান ইহলৌকিক বিলাসব্যসনের দেশ অ্যামেরিকায়। নামাজকালাম ছাড়া শাবানা আজকে ইম্যাজিনও করা যায় না। আল্লা তারে হেদায়েত করেছেন শত শত সিনেমায় নাচিয়ে নিয়ে। এখন বোরখাপরা শাবানাকে দেখা যায় পিএম শেখ হাসিনার কাছে যেয়ে স্বামীর টিকেটের লাগিয়া তদবির করতে। শেখ হাসিনাও রসিক এবং বিদুষী, তিনি স্বামীর পরিবর্তে শাবানাকেই রাজনীতিতে এসে নেমে ফের অভিনয়ের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে এ-যাত্রা শাবানাজির আব্দার সামলান।
রিসেন্টলি দেশে এসে এক কাণ্ড করেন শাবানা ম্যাডাম। অনেক বছর বাদে কালো বোরখাপ্যাকড শাবানা ঢাকায় অবকাশযাপনে এসে দেখেন যে প্রত্যেক শুক্র-শনিগুলোতে চ্যানেলে চ্যানেলে তার নাচগান দেখানো হয়। তিনি বেহেশ্ত হারাইবার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেশবাসী সকলের কাছে ফরিয়াদ করেন যেন উনার সিনেমাগুলো প্রদর্শন থেকে বিরত থাকেন দেশের ব্যবসায়ী সিনেসম্প্রদায়। কিন্তু উনার কথা রাখতে গেলে বেহেশ্ত হয়তো উনি পেয়ে যাবেন ঠিকই, সিনেমাশিল্প লইয়া বাংলাদেশের কর্ণধারেরা আরেকবার নয়া স্টার্ট করতে বাধ্য হতেন যে এই-রকমের আব্দার তো সকল মুমিনমুসলমান বাংলাদেশি হিরোয়িনরাই বয়স ভাটি নিলে এসে করবেন, তখন আমাদের সিনেমাব্যবসার কি হবে? দেশবাসীর হাসিঠাট্টায় শাবানাজি আপাতত ক্ষান্ত দিয়া অ্যামেরিকায় আরামআয়েশের জীবনে ফিরে গেছেন। সেখান থেকে সরাসরি বেহেশ্তে যেতে পারলে তো গেলেনই, না পারলে ফের সামনের বছরে এসে বেহেশ্তের লাগি রিট্রাই করবেন।
তবে এই-যে ব্যাপারটা, সারাজীবনের কাজটাকে তিনি স্বীকৃতি না দিয়া উপড়ে ফেলে দিতে চাইছেন, ওদিকে এই পরিচয়ের উপরে দাঁড়াইয়াই তিনি পিএমের দরবারে এন্ট্রি নিচ্ছেন, তদবির করছেন স্বামীর রাজদরবারে এন্ট্রির ব্যাপারে, এই পরহেজগারি দিয়া জাতি কি করবে এইটা একটা লাখটাকার প্রশ্ন। উত্তর একেকজনের কাছে একেকরকম। আপাতত উত্তর তালাশে আমরা না যাই। যে-পাত্রে খেয়ে এত বড় হইলেন শাবানা ম্যাডাম, সেই পাত্রটারেই তিনি কিনা মাটিচাপা দিয়া ফালাইতে চাইছেন, এ কেমন স্বর্গলোভাতুর মনুষ্য উনি! বোরখার ভিতরে সেঁধিয়ে থেকে শাবানাজি নিজের চোখজোড়া হারাই ফেলসেন কি না, জাতি জানতে চায়। এইভাবে দেখলে তো উনি ইহকাল-পরকাল দুইখানেই ঠাট্টামশকরার শিকার হইবেন। এইখানে চ্যাংড়াপ্যাংড়া পোলাপানদের কাছে, ওইখানে ফেরেশ্তাদের কাছে। ম্যাডামেরে আল্লা বোধবুদ্ধি দিন এই দোয়া করিনু।
প্রতিবেদনকারী : মিল্টন মৃধা
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS