গেল-বছর সংক্রান্তিতে গেছিলাম রূপকদের বাড়ি, নিকটবর্তী এলাকাতেই অবশ্য ওদের বাড়ি, তিন-চার ক্রোশ হবে দূরত্ব। রূপক ছিল আমার আবাল্য সহপাঠী, আযৌবনের স্যাঙাৎ ও সহযাত্রী, চিরবন্ধু-চিরনির্ভর। সে নেই আর কনকনে শীত ও গনগনে গ্রীষ্মের ভরপুর এই ভুবনে। রূপক লোকান্তরিত হয় ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে। সে যাক, যে গেছে সে যাক।
সংক্রান্তি তো অনেক আছে আরও; তুমি কোন সংক্রান্তির কথা বলতেসো বলো দিকি! জ্বি, বলছিলাম মকর সংক্রান্তির কথা। মানে, ইজি বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি। তিলু-সংক্রান্তি বলতাম আমরা বালবেলায়। বিশেষত যবনদের কাছে এইটা তিলু-সংক্রান্তিই ছিল। অন্য সংক্রান্তিগুলো কোন ফোকর দিয়া আসে বা যায় তা-সবের খবর ম্লেচ্ছরা রাখে না। খালি তিলু-সংক্রান্তির আগে একটা চাঞ্চল্য পয়দা হতো পোলাপানসমাজে। এমনকি বৃদ্ধসমাজেও পৌষ-সংক্রান্তির আগে একটা আলোড়ন হতো ছোটখাটো। কোথায় কার বাড়িতে লুটের আইটেম কেমন ইত্যাদি নিয়া আলাপ হতো। লুট মানে হরিলুট। অরিল্লুট বলতাম আমরা। আমাদের গুরুজনেরা যেমন সংক্রান্তিকে বলতেন সংরাইন। দেখা যেত, কারো বাড়িতে কেবল তিলের তিলু আর চিনির তিলু দিয়াই লুট উড়ানো হতো। মুখভার হয়ে যেত যবন পোলাপাইনদের। ধুর ব্যাটা, এরা বাতাসাও লুটে দিলো না, কমলা দেবে সেই হিম্মতই এদের নাই। কিন্তু কোনো কোনো বাড়িতে আবার কমলালেবুও লুটে দেয়া হতো। কমলালেবু তখন এই শহরে সিজনকালে এত প্রচুর উঠত বাজারে এবং গরিবগুর্বারও ঘরে যে এই শ্রীহট্ট কমলালেবুর দেশ বলিয়াই মশহুর ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলী স্মর্তব্য। কৈশোরে দেখেছি খারাভরতি কমলালেবু ঘরে আসত। তবু লুটের আইটেমে কমলালেবু যোগ করা সবার সাধ্যি ছিল না, যারা করত তারা ছিল অবস্থাপন্ন। পলিথিনের প্যাকেট তখনও দুনিয়ায় মেইনস্ট্রিম হয় নাই। কিন্তু ঠোঙা ছিল কাগজের। ঠোঙা ভরে নিয়া আসতাম আমরা বাতাসা-তিলু। দুইচাইরটা কমলালেবুও। ছোটচাচার বন্ধুর বাড়ি কিংবা আব্বার বন্ধুর বাড়ি গিয়া অরিল্লুট সমাধা হলে পরে অভ্যাগত যবনদেরকে গেরস্তের অভ্যর্থনাকামরায় সাদরে বসিয়ে আপ্যায়ন করানো হতো। প্রত্যাবর্তনকালে একটা ভাগ ব্যাগে পুরে দেয়া হতো ভাবীদের জন্য। বাবা-কাকার বন্ধুদের ভাবীরা ছিলেন আমাদের মা-চাচিমা। হোমপ্যাকেজের সঙ্গে আমাদের লুটে-বাগানো মালসামানের ছোট্ট পুঁটলি যুক্ত হয়ে যেত।
অনেক অনেক ধূসরতর বছরের বাদে সেদিন সংক্রান্তিতে গেছিলাম রূপকদের বাড়ি, সন্ধ্যার পর, গিয়েছিলাম আমি ও আমার সাড়ে-চার বছরের ফড়িঙফর্ফর শৈশব। শৈশবের নাম রোহান, নথিপত্রের বাইরে সে আনোফিশিয়্যালি বিল্টু ডাকনামে প্যপুলার। তো, সংক্রান্তির আপ্যায়ন হিশেবে রোহানের সামনে এল প্লেটভরতি পিঠাপুলি, মোট সাতটা আইটেমের সাতখানা পিঠা। পাটিসাপ্টা আস্তখানা সে মন দিয়ে খেল, অন্যান্য ছয়খানা আইটেমের প্রত্যেকটা পিঠা সে কামড় দিয়া দিয়া আদ্ধেক বা আদ্ধেকের-আধা খাইয়া বা কামড়াইয়া আমার প্লেটে ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিল। তার কাণ্ড দেখে আমরা — তার সংলগ্ন লোকজন — হো হো হাসছিলাম, তবে সে এ-সমস্ত কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ না-করে একমনে তার কাজ করে যাচ্ছিল। মজার ব্যাপার যে, আমিও সন্তানের সাতখানা আধখাওয়া পিঠা খাইলাম নিজের ভাগের প্লেট সাবড়ে পেটপূর্তির পরেও! মনে পড়ল, বছর-পঁচিশেক আগে একইভাবে আমিও আমার ছোটকাকার সঙ্গে তার বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম সংক্রান্তিসন্ধ্যায় এবং একই ভঙ্গিতে খেতে খেতে আর খেতে-অপারগ হয়ে আধাকামড় দিয়ে দিয়ে কাকাকে এগিয়ে দিতাম আমার উচ্ছিষ্টাংশ। জীবনের এই বৃত্ত পুরো হয়ে আসার ঘটনাটা আমার ভেতরে একদম অঝোর শিশির ঝরালো, হু হু করে এল ফিরিয়া আমার নিজের শৈশবদিনগুলো। ভেবেছিলাম একটা-কিছু লিখব আমার জীবনের মধুরতর সংক্রান্তিসন্ধ্যাগুলো লইয়া, আমি যেমন লিখি সচরাচর প্যানপ্যানানি, কিন্তু হপ্তা গেল চলে, গেল বছরও উড়ে একফাঁকে, লেখা আর হয়ে উঠল না। যা-হোক, পৌষসংক্রান্তি ফি-বছরই ফিরিয়া ফিরিয়া আসে যেহেতু, এইবার ভাবলাম অন্তত একটা কমেন্ট-টাইপ যৎকিঞ্চিৎ লিখি জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সংক্ষেপে।
এই জীবন জিনিশটা আশ্চর্য চকোলেট এক, মুখে পুরে দিতে না দিতেই গলিয়া যায়, ফুরাইয়া যায় জীবনের মধুরৌদ্র দুগ্ধজ্যোৎস্না, হায়! হ্যাঁ, সত্যিই তা-ই, যায়, আসে না, আবার আসেও তো! শৈশব চলে যেয়ে ফেরেও তো সহসা কোনো দমকা হাওয়ায়, ফেরে খুদে একেকটা মুহূর্তের পিঠে চেপে, ফিরতে দেখি অ্যাব্রাপ্টলি। স্মৃতিনিখিলের এই নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর লেখাটায় এসেছে-যে হাহাকারহাওয়া, তা যেমন সত্য, তেমনি এর উল্টোপিঠও তো মিথ্যে নয়। সেই সকালবেলার আগের ভোর-ভোর মুহূর্তে ধানকাটা ক্ষেতের খড়-নাড়ার আঁটি দিয়া বাঁধানো ঘর পুড়ানো — আমাদের সময় এই ঘর-পোড়ানো রিচুয়্যালটাকে বলা হতো ‘মেড়ামেড়ির ঘর পোড়ানো’, সিলেটিরা ভেড়া প্রাণিটাকে বলে মেড়া — এই-রকম অনেক ব্যাপারই আজ আর নাই নিশ্চিত, থাকলেও ক্ষয়িষ্ণু, তবু শৈশব উদযাপনের অনেককিছুই এখনো রয়েছে ছড়ায়ে-ছেটায়ে চারিপাশে।
সেইটাই তো! সন্তানের মুখে একটি চুমু হয়ে ফেরে তো শৈশব! দয়িতার কোনো-একটা আদরমুহূর্ত অথবা স্বামীকে চুটিয়ে বকাবকির মুহূর্তে সহসা বাড়ৈপাখির মতো চকিতে ফেরে তো মায়ের কোনো-এক আচরণ ও অভিব্যক্তি! পিঠেপুলি খেতে খেতে হঠাৎ দেখে উঠি, এই তো, ফিরিয়াছে ফের আমার দ্বিতীয় শৈশব! তবে, এইবার আর অবহেলা নয়, জীবনে যত অবহেলা আর অপমান পেয়েছিল আমার প্রথমা শৈশব, এইবার তার সবকিছু পরিণত করে ফেরাব মনোনিবেশ ও ভালোবাসার আদলে, দ্বিগুণ উল্লাসে। হ্যাঁ, হাহাকার তারপরও পশ্চাতে ফেরে, হায়! ‘চলে যায়, মরি হায়’ … অরিল্লুটের তিলু-বাতাসায় উড়ে যায় আয়ুপাখির পালকগুলি একে একে …
প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS