সুমনের জন

সুমনের জন

জন ডেনভারের ৯টা গান বাংলায় গেয়েছেন সুমন। বাংলাদেশে ‘সুমন ও অর্থহীন’ ব্যান্ডের (বর্তমানে কেবল ‘অর্থহীন’ নামে ব্যান্ডটাকে ম্যানিফেস্টেড দেখা যায়) ব্যাজবাবাখ্যাত সুমন বেশকিছু সুন্দর-সুষ্ঠু কম্পোজিশন উপহার দিয়েছেন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর বাইরে নিজের লিরিক্সে স্বকণ্ঠে গাইতে যেয়ে। এমনিতে সেগুলো উচ্ছ্বসিত হবার মতো সুর-উদ্ভাবনা বা গীতিকবিতা না-হলেও ওই সময়ের কন্টেক্সটে উল্লেখযোগ্য ছিল। সুমন যখন ‘সুমন ও অর্থহীন’ ব্যানারে অ্যালবাম রিলিজ্ শুরু করেন, তখন বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতে মিক্সড্ অ্যালবাম ইত্যাদির অপপ্রভাবে হোক কিংবা আর-কোনো কারণে চলছিল ধুমধাড়াক্কা খিচুড়ি লিরিক্স ও মিউজিকের মোচ্ছব। অন্যদিকে কলকাতাকেন্দ্রী মিউজিকে বেশ ভালো সুর ও কথাখচিত সংগীতের সুসময় এসেছিল সমনামী আরেকজনের কল্যাণে। এহেন সময়ে বাংলাদেশের সুমন মোটামুটি নিরিবিলি লিরিক্যাল্ কথাভাগে সুর বসিয়ে গিটারে টেনে টেনে যখন গাইতে শুরু করেন, অঞ্জনাচ্ছন্নতা বা কান্ট্রিমিউজিকের সরাসরি ছাপ সত্ত্বেও শুনতে মন্দ লাগত না। শান্ত-সমাহিত স্বরে এবং পরিমিত বাদ্যযোজনায় নিচু স্কেলে রেখে সুমনের গায়ন তখন অনেককে আশান্বিতও করেছিল নতুন মোড়ের মুখে দাঁড়াতে, উঠতি গাইয়েদের অনেকেই গিটার আর ড্রামস্ খানিকটা ভাবনাচিন্তা করে একটু রয়েসয়ে সামলেসুমলে আরও সৃজনী বিস্তার দিয়ে বাজাবার পথ ঢুঁড়তে শুরু করেছিলেন। পরের দশকে এসেই বিচিত্রবিস্তৃত ফলও ফলেছে এর, সো-ফার আমার অদূরদৃষ্টির দেখাদেখি দিয়া অনুমিত, অর্ণব ও অন্যান্য থরে-বিথরে বাংলাদেশের গানে বুদ্ধিদীপ্ত বৈচিত্র্যের হাওয়া লেগেছে ক্রমে।

এইখানে ডেনভার প্রসঙ্গে সুমনের একটা অ্যালবাম হাতে নিয়া আমরা কথা চালাতে চাইছি। নিজের মিউজিক-ক্যারিয়ারের রজত-জয়ন্তীলগ্নে সুমন একটা অ্যালবাম করেছিলেন, সোলো উদযোগের সঙ্গে এলিটা নামের এক শিল্পীকে ফিচার করা হয়েছিল সেই অ্যালবামে যিনি পরবর্তীকালে গেয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন, গোটা অ্যালবামটা ছিল ডেনভারের নয়টা গানের বঙ্গানুবাদের উপস্থাপন। বছর-বারো আগে, ২০০৫ সালে, অ্যালবামটা বেরিয়েছিল ‘জি সিরিজ্’ থেকে; অ্যালবাম মার্কেটিং করেছিল গীতাঞ্জলী। ইন্ ফ্যাক্ট, দশটা গান অ্যালবামে থাকলেও আদতে অ্যানি’স্ স্যং  গানটা দুইবার করা হয়েছিল; একবার সুমন-এলিটা রেগ্যুলার বিটে এবং অন্যবার টেম্পো পাল্টে জে-মিক্স। মন্দ হয় নাই গোটা ব্যাপারটা। আর মন্দ হয় নাই বলেই তো মনে আছে; এবং মন্দ হলে এখন এই কথাবার্তাও বলার দরকার হতো না। যা-হোক, অ্যালবামের টাইট্যল্ ‘মেঘের দেশে’ এবং উপশিরোনামায় ‘অ্যা ট্রিবিউট টু জন ডেনভার’ কথাটা কাভারমুখে লেখা রাখা ছিল। প্রত্যেকটা গানের সঙ্গে মূল ইংরেজি শিরোনাম ব্র্যাকেটে এবং বঙ্গানুবাদিত শিরোনাম বোল্ড হরফে ছাপানো হয়েছিল। সব-কয়টা গানের অনুবাদক সুমন। বাজিয়েছেন জেমস থেকে শুরু করে জুয়েল এবং আরও অনেকেই। গিটার্স, ড্রামস্, কিবোর্ডস্, পার্কাশন্ ইত্যাদি দিয়াই মিউজিকট্র্যাকগুলো যোজিত। সবই ঠিক আছে। এরপরও অস্বস্তির জায়গাটা ভারি ভুগিয়েছিল শ্রোতা হিশেবে আমাদেরে এবং আজও অভিজ্ঞতাটা ইয়াদ আছে। একটু পরেই বলছি সেইটা।

Megher Deshe by Arthahin

গানগুলো ছিল সর্বজনপ্রিয় কয়েকটার মধ্যে উল্লেখস্থানীয়; জন্ ডেনভারের শ্রোতা মাত্রেই লিরিকগুলো ওষ্ঠস্থ রাখেন। যথা — অ্যানি’স্ স্যং, লিভিং অন অ্যা জেটপ্লেন, টেইক মি হোম কান্ট্রিরোড, ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস, পোয়েমস প্রেয়ার্স অ্যান্ড প্রোমিজেস্, গার্ডেন স্যং, দিস্ ওল্ড গিটার, ফ্লাই অ্যাওয়ে, এবং পারহ্যাপ্স ল্যভ। সুমনের বঙ্গানুবাদে ডেনভার-মিউজিক শুনতে শুনতে একসময় খেয়াল হয়, আরে! একটা গানই যেন শুনছি ফিরে ফিরে! এইটা কেন হবে? ডেনভারের গানগুলো সিগ্নেচারমার্ক সত্ত্বেও তো মনে হয় না যে একঘেয়ে বা একটা গানই শুনছি, তাহলে এখানে এমন হচ্ছে কেন? ঘটনাটা মনে হয় সুমনের গায়কী-সীমাবদ্ধতার কারণে যতটা-না তারচেয়ে বেশি গানানুবাদের কারণেই। মিউজিকের অনুবাদ হয় না, ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবামের সুমন-কম্পোজিত সুর-কথানুবাদগুলো শুনে এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের হয়েছিল তখন। যদিও কথার অনুবাদ হতে পারে, হয় আকছার, যেমন কবিতার বিশ্বস্ত টেক্সট্যুয়াল ট্র্যান্সফর্ম/ট্র্যান্সল্যাশন্ হয়। বিশ্বস্ত যতই হোক, তবু অনুবাদে যা হারায় তা-ই কবিতা — আমরা জানি এবং তর্ক সত্ত্বেও তা মানি। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে বোধহয় ট্র্যান্সল্যাশনে কিছুই প্রায় থাকে না। আস্ত লোপাট হয়ে যায় ভাবের বা অনুভবের। ব্যাপারটা হয় তখন না-ঘরকা না-ঘাটকা।

গানের ছায়ানুসারে গান হতে পারে। গান ভেঙে গান হতে পারে। এই দুই প্রক্রিয়াই আসলে গানের বিশ্বস্ত সঞ্চারপ্রক্রিয়া। গান-টু-গান অনুবাদ আসলে হয় না। কাব্যানুবাদ বা গদ্যানুবাদ যদিও সম্ভব লিরিক্সের, কিন্তু সুরের-সংগীতের অনুবাদ! মনুষ্য অসাধ্য। অসুন্দরও। সুমনের ডেনভারগানের অনুবাদচেষ্টা ট্রিবিউট হিশেবে বেশ, সংগীত-অভিজ্ঞতার বিচারে এইটা যাচ্ছেতাই।

কিন্তু অন্যদিকে এই কথাটা তো সৌরালোকের মতো ট্রু যে দেশে দেশে গানের অনুবাদই হয় আসলে। দেশে দেশে, যুগে যুগে, কালে ও কালান্তরে। সেই প্রক্রিয়াটা লক্ষণীয়। সাইদুস সালেহীন সুমনের প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব না। ঠাকুরের প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব, কাজীর প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব, এবং সম্ভব কবীরের প্রক্রিয়ায়। এইখানে কবীর বলতে আমরা বলছি কবীর সুমন। বাংলা গানে একটা হাওয়া এনেছিলেন সুমন কোন প্রক্রিয়ায়, এইটা আমরা আজ পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারি বোধহয়। এই জিনিশটা কবীর সুমনের কাছ থেকে আমরা শিখে রাখতে পারি। জিন্দেগিভর যা-ই তিনি করেছেন সেসবের বড় অংশই ডিলান, ও অন্যান্য গং, তবু মনে হয় যেন তা আবহমান বাংলা!

কিন্তু শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবামটা আসলেই সুন্দর। ফর অ্যা চেইঞ্জ এমনটা আরও হতে পারে অন্যান্য মায়েস্ত্রোদের ক্ষেত্রে। যদিও অর্থহীনখ্যাত সুমন ইংরেজি গানের কথাগুলো সুরের সঙ্গে সংগতিবিধানে যেয়ে ল্যাবগ্যাবে করে ফেলেছেন, আপোস করতে করতে একেবারে নার্সারি শিক্ষার্থীর বাংলা করে ফেলেছেন, এবং শুনতে বেশ লাগলেও পড়ার অভিজ্ঞতা হয় ভীষণ বদখত। মূল গানের স্মার্টনেস্, মূল গানের মেলোডি, মূল গানের ইজি ইফেক্টিভনেস বাংলাগুলোর কথায় একদমই নিখোঁজ।

ফিতার যুগের ক্যাসেট তখন অন্তিমে। ফ্ল্যাপকথন থাকত ক্যাসেটগুলোর সঙ্গে। ‘মেঘের দেশে’ ক্যাসেটের খাপে ডেনভারের ৯টা গানের অনুবাদক সুমন যা বলেছিলেন, টুকে রাখি নিচে।

“অক্টোবর ১২, ১৯৯৭। তখন অনেক সকাল। টেলিফোনে একটি সংবাদ পেয়ে থমকে যাই। জন ডেনভার আর পৃথিবীতে নেই। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে ওঠে। যার গান আমার এই সংগীতজীবনে অসম্ভব রকমের ছায়া ফেলেছে, সেই মানুষটি আজ নেই। ব্যাপারটা কেমন জানি অবিশ্বাস্য লাগছিল। ডিসেম্বর ৩১, ২০০৩। জন ডেনভারের জন্মদিন। মনটা হঠাৎ করে খুব খারাপ হয়ে গেল। সবসময় একটা সুপ্ত বাসনা ছিল এই মানুষটার কিছু গান গাবো নিজের ভাষায়। তার গাওয়া আমার সবচেয়ে প্রিয় গান অ্যানি’স্ স্যং শুনতে শুনতে গানটা বাংলা করে ফেললাম। জি-সিরিজের কর্ণধার খালেদভাই গানটা শুনেই বলল, একটা ফ্যুল অ্যালবাম করে ফেলেন, আমি রিলিজ্ করে দেবো। কথাটা প্রথম যখন শুনলাম নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না! স্বপ্নটা হয়তো বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে! মাঝে বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকার কারণে আমার সংগীতচর্চা অনেকখানি থেমে যায়। মনের মাঝে তখন একটা কথা ঘুরপাক করত, আমার এই স্বপ্নটা হয়তো আর পূর্ণ হবে না। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় আবার পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়ে উঠলাম। পূর্ণ উদ্যমে নতুন করে শুরু করলাম জন ডেনভার ট্রিবিউট অ্যালবামের কাজ। আমার স্বপ্ন সার্থক হলো। পঁচিশ বছরের সংগীতজীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি (সুখ, দুঃখ বা কষ্ট)। আমার না-পাওয়ার কষ্টগুলো কিছুটা হলেও লাঘব হলো এই অ্যালবামটি প্রকাশের মাধ্যমে। অ্যালবামটি উৎসর্গ করছি জন ডেনভারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। আশা করি আমার এই প্রচেষ্টা জন ডেনভারের ভক্তদের ভালো লাগবে। যারা কখনো জন ডেনভারের গান শোনেননি তাদের কাছে একটা অনুরোধ, অরিজিন্যাল গানগুলো একবার শুনে দেখুন। হয়তো-বা নতুন করে সংগীতের দ্বার উন্মোচিত হবে আপনাদের মাঝে।”

লেখাটার নিচে দস্তখত-অন্তে প্রদত্ত তারিখ, অক্টোবর ২০০৫। বিমানপতনে ডেনভার ইন্তেকালের আট বছর পরের একদিন বাংলায় সুমনের জনকে পেয়েছিলাম আমরা। আজও অবসরে এর সাউন্ড ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে বেশ রিল্যাক্স করা যায় বৈকি। প্রিয় শিল্পীর স্মরণে এমন সংগীতাঞ্জলি বাংলায় যারা ডেনভারফ্যান তাদেরে স্পর্শ করেছিল। মুশকিলটা বা মজাটা হলো, শুভমুক্তির পরে ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবামটা পাক্কা বারো বছর পার করে ফেলেছে, এখন ওই অ্যালবামটা মনে করতে গেলে কেবল অ্যানির গান গুনগুনায় কানে। এছাড়াও যে-গানগুলো রয়েছে সেগুলো মনে পড়ে না কেন? সম্ভবত, হতে পারে এমন যে, অন্য গানগুলোতেও সুমন অবচেতনে অ্যানির গানের আদল বজায় রেখে রেন্ডার করেছেন, ফলে রেন্ডিশন ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও হয়েছে একটাই ইন ট্রু সেন্স।

প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you