বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ :: মহাদেব সাহা

বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ :: মহাদেব সাহা

মা আমাকে বলেছিল — ‘যেখানেই থাকিস তুই
বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। পয়লা বোশেখ বড় ভালো দিন
এ-দিন ঘরের ছেলে বাইরে থাকতে নেই কভু, বছরের এই একটি দিনে
.                       আমি সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে দিই
ফুলজল, কে বলবে কী করে কার বছর কাটবে,
বন্যা, ঝড় কিংবা অগ্নিকাণ্ড কত-কী ঘটতে পারে, তোর তো কথাই নেই
মাসে মাসে সর্দিজ্বর, বুকব্যথা লেগেই আছে, বত্রিশ বছর বয়েস
নাগাদ এইসব চলবে তোর, জানিস খোকা, রাশিচক্র তোর ভীষণ খারাপ,
যেখানেই থাকবি তুই বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। সেদিন সকালে
উঠবি ঘুম থেকে, সময়মতো খাবিদাবি, ভালোয় ভালোয় কাটাবি দিনটা
যেন এমনি মঙ্গলমতো সারাটা বছর কাটে, তোকে না ছোঁয় কোনো
.                            ঝড়িঝাপ্টা, বিপদ-আপদ
আমি নিজ হাতে একশ-একটি বাতি জ্বালিয়ে পোড়াবো তোর
.                               সমস্ত বালাই।’

মা তোমার এসব কথা মনে আছে, এমনকি মনে আছে
বছরের শেষে ছুটিছাটায় বাড়ি গেলে পয়লা বোশেখ না কাটিয়ে তুমি
কিছুতেই আসতে দিতে না, বাড়ি থেকে বেরোবার সময়
আমার বুকের মধ্যে পুরে দিতে ‘ভালো থাক তুই’ শুধু এইটুকু
.                         বিশেষ সংবাদ, আমার
গন্তব্যে তুমি ছড়িয়ে দিতে দুর্ঘটনা-রোগ-শত্রুর উৎপাত থেকে
নিরাপত্তা, হায় এই
সংসারটা যদি মায়ের বুকের মতো স্বাস্থ্যবান হতো,
.                    তখন আমার বৈশাখগুলি
প্রাকৃতিক দুর্যোগে কাটত না এমন বিষণ্ণ;
এমন আমার বৈশাখ কাটে ধূলিঝড়ে জানালা-দরোজা সব
বন্ধ ঘরে অন্ধকার শবাধারে শুয়ে, মাথার সমস্ত চুল
কেটে নেয় ভয়ের বিশাল কাঁচি, সকালে খুলিতে বোলায় হাত মেসের
.                               গাড়ল বাবুর্চি এসে
দেয়ালে তাকিয়ে দেখি এমনি করে বছর বছর ক্যালেন্ডার পাল্টে যায়
আমার বয়স, গোঁফদাড়ি পুষ্ট হয়, কিছু কিছু পরিচয় ঘটে
তথ্যকেন্দ্রে বসে জেনে নিই দুচারটে নতুন খবর, আবার ঘসে-মেজে
উজ্জ্বল করি আমার নেমপ্লেট;

শোনো মা, তোমার সমস্ত কথা মনে আছে, বৈশাখে দোকানে হালখাতা
মহরৎ হতো, বাড়ির উঠোন ভরে খেতে দিতে কলাপাতায় ঘরের
মিষ্টান্ন, আমার জন্যে বানিয়ে রাখতে স্বস্তিক, মা তোমার হাতের দেয়া
স্বস্তিক আমি এমন লোভী দেখো নিঃশেষে খেয়ে বসে আছি, আমার মনের
স্বস্তি আমি আজ খেয়ে বসে আছি;
.             এখন আমার বছর কাটে বিদেশ-বিভূঁয়ে
নানা স্থানে, বেশিরভাগ হোটেলের ভাড়াটে কামরায়, কখনো কখনো পুলিশ-
.                                  ফাঁড়িতেও যাই
ইতস্তত ভবঘুরের মতো ঘুরি, ইদানীং সংবাদ সংগ্রহে
বড় বেশি ব্যস্ত থাকি, কেবল আমার সংবাদ আজ আমার
কাছে নিতান্ত অজ্ঞাত;

আমার বছর কাটে ধার-ঋণে, প্রত্যহ কিনি একেকটি দেশলাই বাকশো
আমিই বুঝি না কেন আজকাল এত বেশি দেশলাই কিনি আমি
হামেশাই বৈদ্যুতিক গোলযোগে জ্বালাতে হয় নিজের বারুদ
আমার এখন বুঝি ভালো লাগে প্রতিদিন নিজের করতলের গাঢ় অন্ধকারে
জ্বালাতে আগুন, কেননা এখন আমাকে বড় বেশি কষ্ট দেয় আমার
নিজের আঙুলগুলি, আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে ভীষণ আঁধার;
.                   এখন প্রায়শই মতবিরোধ, ঝগড়াঝাটি
করে কাটে আমার সময়, কোনোকিছুতেই দুঃখও পাইনে বড়, বুকের
ব্যথাটাও বোধ হয় না আজকাল আর, আমার বুকের ওপর দিয়ে ক্রমাগত
তুষারঝড় হয়ে গেছে, বুঝি ভূমিকম্পে মরে গেছে
বুকের সমস্ত শহরতলি;
.            মা তুমি বলেছিলে ‘পয়লা বোশেখে
বাড়ি আসবি তুই’, আমার মনে আছে — আমারও
ইচ্ছে করে পয়লা বোশেখ কাটাই বাড়িতে, প্রতি বছর মনে
করে রাখি সামনের বছর পয়লা বোশেখটা বাড়িতেই কাটিয়ে
আসব, খুব সকালে উঠে দেখব পয়লা বোশেখের সূর্যোদয়
দেখতে কেমন, কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে, ক্যালেন্ডার পাল্টে যায়, আমার
জীবনে আর আসে না যে পয়লা বোশেখ।

[কবিতাটা গানপারে রিপ্রিন্ট করা হলো কবির প্রথম কবিতাবই ‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস’ থেকে। এই বই দিয়েই বাংলাদেশের কবিতায় পাঠকপ্রিয় মহাদেব সাহা হাজির হন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে। এরপর এই বইয়ের পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়। — গানপার]

… …

COMMENTS

error: