লিঙ্কিন পার্ক : পার্সোনাল অডিসি || শফিউল জয়

লিঙ্কিন পার্ক : পার্সোনাল অডিসি || শফিউল জয়

চেস্টার বেনিংটনের মৃত্যু পুরাতন সময়ের কথা মনে করায়া দেয়। মনে করায়া দিতে পারে টিনসময়গুলা পার হয়ে জীবনটাকে দেখতেছি অন্য চোখ দিয়ে। অথচ সেই বয়ঃসন্ধিকালীন প্যাশন একগাছা ম্রিয়মাণ শোক নিয়া হাজির হলো চেস্টারের আত্মহত্যায়। চেস্টারের আত্মহত্যা সমসাময়িক পপ কালচারের Inkedchester2_LIহাওয়ায় ওড়ানো চুলের কালো পতাকা। পোশাকের মতো, ফ্যাশন স্টেইটমেন্টের মতো  ক্রমাগত যেসকল গায়ক/বাজনাদারদের বদলায়া/এড়ায়া আরেক ধাপের দিকে আগায়া গেছি/যাচ্ছি  তাদের আদিগুরুর নিশান লিঙ্কিন পার্ক।  ফ্যাশন স্টেইটমেন্ট বলে বিপাকে পড়তে পারি বহুবিধ, তবে সেটাই বলতে চাই। সাহিত্যপাড়ার আলাভোলা টিকিদার ব্রাহ্মণ সমালোচক আর টঙের দোকানে থুথু ওড়ানো অনুগামীদের বলার থাকে অনেক কিছুই। গায়ের জোরে সমালোচনা চলে। আর টেম্পু চলে সিএনজিতে। যার যার পথ চলাতেই আনন্দ।

অনুভবের আন্তরিকতার দোহাই স্পষ্ট কোনো যুক্তিবিদ্যায় দাঁড়ায় না। যার মাল তার তার। তাই ওই রাস্তা থেকে কাটি। মূলত লিঙ্কিন পার্ককে টিনেইজ সম্পর্কের ইমারতের ঠিকাদার বলাটা জুতসই। ওহ! তুমি লিঙ্কিন পার্ক শুনো নাই? ম্যান! প্রচ্ছন্ন এক ধরনের অবজ্ঞা ছিল জবাবে। অনেকেই ভাবতে পারে লিঙ্কিন পার্কের শ্রোতারা শ্রেণীসংরক্ষিত নির্দিষ্ট একটা গণ্ডি থেকে প্রকাশিত। উত্তম। অতি উত্তম পর্যবেক্ষণ। তাতে কী? তারপরেও নিজের ফিরা আসা পূর্বতন অনুরাগকে অস্বীকার করার তো রাস্তা খুঁজে পাই নাই।  এরপর তো ভালোলাগার  কত ব্যান্ডই হারায়া গেছে যাদের দিকে ফিরাও তাকানো হয় নাই। বহু আছে যাদের প্রতি ভালোলাগার কারণে পরবর্তীতে বিব্রত লাগছে টিনসুলভ আচরণে।

chester3কিন্তু  লিঙ্কিন পার্ককে নিয়া তেমনটা লাগে নাই : এক মুহূর্তের জন্যেও না। বরং একসময় আমি/আমরা যা ছিলাম তা-ই ছিল লিঙ্কিন পার্ক — এই স্বীকারোক্তিটার তীব্রতা আছে। কেননা যেহেতু  নাই অন্য অনেক ব্যান্ডের জন্যেই — গান্স অ্যান্ড রোজেস যেমন। স্ল্যাশ প্রিয় গিটারিস্ট ছিল কী না স্মরণে আনতে পারি না তবে অলটার ব্রিজ- মার্ক ট্রিমন্টি, ক্রিড, লাইফহাউজ, হাল্কাপাতলা ডিস্টার্বড, দূর থেকে ইউকিউবাসঃ সম্ভবত লিঙ্কিন পার্কের পরবর্তী অংশটায় তাহারাই। মনেও আসতেছে না সব নাম, মেলা কান্ডকারখানা। এক ধরনের সাংগীতিক সাযুজ্য লক্ষণীয় যাকে জনরা বলা যায় আলগোছে, কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সংগীত আর্লি টিনের বিবেচনায়, কিছুটা এখনো।  এবং লিঙ্কিন পার্ক টিনঅভিসারে তারা দিছিল ন্যু মেটালের ঝামটা, গতিবিদ্যার র‍্যাপ, দূরাগত ইন্ডির পশলা হাওয়া।  যে যেভাবে পারে হয়তো তাদের পারিপার্শ্বিকতা ঠিক করে নিছে লিঙ্কিন পার্ককে কেবলা ধরেই। ভরকেন্দ্রের হিশাবে।

কথাপ্রসঙ্গে বলা চলে লিঙ্কিন পার্ক ছিল ব্যান্ডদল যাদের বহুমুখিতা অন্য বেশকিছু ব্যান্ডকে দূরে ঠেলে দিছে, কিছু ব্যান্ডকে আনছে কাছে। লিম্প বিজকিট শোনার আগ্রহ হয় নাই কারণ লিঙ্কিন পার্কের পাশে ক্লীশে লাগতো তখন — যদিও শক্ত মতামত খাঁড়ায় নাই ভিতরে ভিতরে (আহ! কী সুখকর দিনমান!)। বাংলাদেশি ব্যান্ড রাইভালস আর্টসেল আর ব্ল্যাকের মাঝখান দিয়া ব্ল্যাক যে অলিতে গলিতে স্বপনসুরের ঘোরে দিওয়ানা করে রাখছিল তার কারণটা কি ছিল ব্র্যাড ডেলসনের ইম্প্রোভাইজড সলো দেয়ার অপারগতা/অক্ষমতা/অনিচ্ছা? রব বর্ডনের চিজি ড্রামিং?  নির্ভানাকে বলা যায় সেই সময়কারই শোনা। নির্ভানা হারায়া যাওয়ার পর ফিরা ফিরা বারবার আসছে নানা মহিমায়। এবং এই আসা-যাওয়ার যাত্রাপথের ফিরিস্তিতেই বুঝতে পারছিলাম নির্ভানাকে যতটা সিম্পল মনে হয়, নির্ভানার ঘটনাটা ততটা সহজবোধ্য নহে। নির্ভানার সাউন্ড যতটা সিম্পল, ততটাই মেলোমাখা। এলপি’র ‘লিভ আউট অল দ্যা রেস্ট’-এর মতো কান্নামাখা চিৎকার আছে নির্ভানায়।

সাংগীতিক শ্রবণযাত্রার পরিসরে একে একে এরপরে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পার্ল জ্যাম (আহ! পার্ল জ্যাম!), সাউন্ডগার্ডেন, স্টোন টেম্পল পাইলটস, অ্যালিস ইন চেইন্স, স্নো প্যাট্রল, কিংস অফ লিওন, অডিওস্লেইভ, রেডিওহেড, ওয়েসিস, আরএইসসিপি প্রভৃতি ব্যান্ডেরা। কলেজ লাইফের গণ্ডি ছাড়াইতে না ছাড়াইতেই এইসব আসাকে সহজতর করছিল গজায়া-ওঠা শ্রবণশক্তি।  লিঙ্কিন পার্কের হাত ধরে দলগুলার আগমন সহজাত ছিল অনেকের কাছেই — অন্তত স্বীয় অভিজ্ঞতার বিচারে। ব্যান্ড সংগীতের কানেক্টিভিটির গল্প প্রচণ্ডতম ব্যক্তিগত। গান অ্যালবাম ধরে ধরে শোনার বিষয় — সেটা প্রথমবোধনের কালে পিঙ্ক ফ্লয়েড, যেপেলিনের বিচ্ছিন্ন ট্র্যাক শোনা হইতো। ওই ‘কামিং ব্যাক টু লাইফ’ আর ‘হাই হোপ্স’, ‘উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার’, ‘কমোর্টেম্বলি নাম্ব’ … এর বাইরে যে পিঙ্ক ফ্লয়েড আছে তা কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও মর্মে তাদের স্থান তখনো হয় নাই। রেবেলিয়াস ফ্লয়েড ঘুরপাক খাচ্ছিল গিল্মৌরের মিষ্টিমধুর সলোতে। তাতে অনুযোগ ছিল না। অ্যালবাম কনসেপ্টটা মাথায় ঢোকার পর অবিশ্রান্তধারায় যেসকল ব্যান্ড শোনা হইছে, তাতে ফ্লয়েড, যেপেলিনের আগমন অনেক পরের ঘটনা। এবং বিচ্ছিন্নভাবে গান শোনাকে এখন আর শ্রবণঅভিজ্ঞতার মর্যাদা দিতে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা করে না বলেই লিঙ্কিন পার্ক। এর মধ্যে সর্বগ্রাসীভাবে আসছে রেডিওহেড দুইবার। এবং বেশ বড়সড় হয়া যাওয়ার পর  রেডিওহেড পার্ট টু হিট করলে লাগছিল একটা ঘটনা দাঁড়াল তাহলে, ব্রেইকথ্রু!  তারপর দিন যায়, রেডিওহেডের বাঁধন আলগা হয়া আসে, আসতেছে … অন্য দশা শুরু হয়া গেছে। সেই দশা উহ্যই থাকুক।

দ্বিতীয় দশার ভিতর দিয়াও টেম্পু চালাইছে লিঙ্কিন পার্ক। টেম্পু চলতে চলতে সচেতন হয়া যাইতেছি। বলতেছি ক্লাস নাইন-টেনের কথা।

chester4লিঙ্কিন পার্ক অস্পষ্ট হওয়া শুরু করতেছে। তবুও টেম্পু চালাইতেছে লিঙ্কিন পার্ক। চায়ের দোকানের আড্ডা, গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া, প্রথম চুমা, পটে পাফ আর লিঙ্কিন পার্কের বিদায়ী ইশতেহার রচনা  তৎসমকালীন পপ কালচারের সমান্তরাল ঘটনাবলি। এখনকার টিনরা কী শোনে? নিশ্চিতভাবেই লিঙ্কিন পার্ক না। ভরকেন্দ্র বদলায়া যাওয়া পুঁজিবাদী ইন্ডাস্ট্রির অনুমেয় ঘটনা। তজ্জন্যে লিঙ্কিন পার্কের ক্ষণস্থায়ীত্বই লিঙ্কিন পার্কের চালিকাশক্তি। ‘স্পাইডারম্যান ওয়ান’ দুইহাজারদুই-এর ‘স্পাইডারম্যান’ আর ‘দ্যা অ্যামেইজিং স্পাইডারম্যান’ দুইহাজারবারোর ‘স্পাইডারম্যান’ হতে পারে নাই।

তারপর বহুদিন খোঁজা হয় নাই পার্কদের — সাম্প্রতিককালে দেখছিলাম ‘স্টোন টেম্পল পাইলটস’-এর সাথে কাজ করতেছে চেস্টার। দেখে ভালো লাগছিল। দেখলাম ক্রিস কর্নেলের সাথে ‘ক্রলিং’ গাইতেছে চেস্টার। আত্মঘাতী ক্রিসের সমীপে আত্মঘাতী বন্ধুতার নিবেদন ছিল চেস্টারের।

আর্লি পিউবার্টি থেকে মিড পিউবার্টি সময়টা পর্যন্ত লিঙ্কিন পার্কের মতো প্রভাবগ্রাসী গানের দল কেউ ছিল না যাপনে এবং সদ্য পঁচিশের ব্যক্তিগত যে-কয়টা দশা পার করে দাঁড়ায়া আছি (অথবা জীবনটাই একটা দশা মাত্র। সমগ্র বাংলাদেশ পাঁচ টনের অধিক কিছু নিতে পারে নাই। জীবনের ইলাস্টিসিটি যদিও নিতে পারে, তাতে মাত্রাধিক প্যানা) — আচারের দিক থেকে সেই বয়ঃসন্ধিকালীন আবেদনে লিঙ্কিন পার্ক দাঁড়ায়া ছিল এক তুলনাহীনার মতো। একটা ফেনোমেনা। শ্রোতা হিশাবে একটু ‘জাতে’ ওঠার দাবি করার আশ্বস্ততায় বুঝলাম রব বর্ডন আসলে আহামরি কোনো ড্রামার ছিল না, না-ছিল ব্র্যাড ডেলসন কোনো মাইরি গিটারিস্ট।  বুঝতেই হতো — এই-ই নিয়তি। কিন্তু  অকপট জবানবন্দী — সাউন্ডের বেসিক টেইস্টের টুইস্টটা দিছে লিঙ্কিন পার্ক। হাইব্রিড থিওরি, মিটিওরা, রিয়্যানিমেশনের পর অল্ট অ্যালবামটা — ‘মিনিটস টু মিডনাইট’। ‘মিনিটস টু মিডনাইট’ আমার লিঙ্কিন পার্ক সাউন্ডের ম্যাগ্নাম ওপাস। এর মাধ্যমেই লিঙ্কিন পার্ক বুঝায়া দিছিল আমারে নিজেদের শহিদ ক’রে — বয়ঃসন্ধিকালের উদ্বর্তন থেকে বের হয়া একদিন পশ্চিমা মিডল ক্লাস শাদাদের অপসংস্কৃতিকে এতটা আপ্নায়া নিবো।

সূচনাপর্ব বাদে শাদামাটা ভাষায় — লিঙ্কিন পার্কের এই অডিসির নাবিক চেস্টার বেনিংটন! এরপরে আরও র’ দিকে মুভ করা গেছে — কিন্তু, যেই কারণে লিঙ্কিন পার্ক অভিজ্ঞতায় আসছিল বলে ভালো লাগা কাজ করে — তার আদ্যোপান্তে টেক্সাস লাইভের চিৎকাররত চেস্টার বেনিংটন!

chester.jpg

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you