সাহিত্যমেলা নিয়া দু-চার কথা || আহমদ মিনহাজ

সাহিত্যমেলা নিয়া দু-চার কথা || আহমদ মিনহাজ

মহামান্য সরকার বাহাদুর আয়োজিত বিভাগীয় সাহিত্যমেলা বয়কটের বিষয়বস্তু নিয়া গানপার সঞ্চালকের প্রারম্ভিক কথাবার্তা (*অবজার্ভেশনও বলা যাইতে পারে।) পড়ে ভাল্লাগসে। স্বল্প পরিসরে সলিড কথাগুলাই সঞ্চালক সেখানে বলার চেষ্টা করসেন। মেলায় শরিক না থাকার কারণ জানিয়ে সোশ্যাল সাইটে যারা বিবৃতি দিসেন পরিশিষ্টে এর সংযোজন ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। অনুষ্ঠানে যোগদান ও বয়কটকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ক্যাচালের বাইরে বসে ঘটনার মাহাত্ম্য যারা নিরিখ করতে আগ্রহী তাদের জন্য এইটা কাজে দিবে মনে করি। আওয়ামী-বিএনপির গৎবাঁধা ফ্রেমের ভিত্রে বসে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকার বাহাদুরের ওজন মাপতে অভ্যস্ত আমরা যদি ক্ষণিকের জন্য ওই বাটখারাকে ইগনোর করি, আপামর সাধারণের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিনামা হাতে দেশ পরিচালনার যন্ত্রপাতি বা অ্যাপারেটাসের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের দিকে একবার ফিরা তাকাই, মোদ্দা কথা গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য বুঝাইতে দূর আম্রিকায় বসে লিংকন সায়েব বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল-র বুলি যেসব কারণবশত একদিন ঝাড়ছিলেন, সেরকম কোনো জায়গা হইতে রাষ্ট্র-সরকার-প্রতিষ্ঠানের মতো গুরুভার ব্যাপারগুলাকে সক্রিয় সত্তা বইলা বিবেচনা করি, সেক্ষেত্রে সরকারের প্রতিটা কাজ ও সিদ্ধান্তের ভালোমন্দ বিষয়ে আলাপ জারি থাকা উচিত। সাহিত্যমেলা বয়কটের পক্ষে সোচ্চার লেখকগণ যে-আলাপটা সকলের সামনে নিয়া আসছেন সেখানে যুক্তি ও প্রতিবাদ একত্রে মিশছে মনে হয়। উক্ত কারণে আলাপটাকে এমনি-এমনি যাইতে দেওয়ার চেয়ে তার সারবত্তা নিয়া ভাবনা করা সমীচীন মনে হইতেসে।

সাহিত্যমেলায় শরিক না থাকার সিদ্ধান্তে অটল লেখকগণের বক্তব্য বা তার সতর্ক পাঠ হইতে বেশ বোঝা গেল জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আয়োজিত সরকারি মেলায় স্থানীয় পর্যায়ে সক্রিয় লেখকের হৃষ্টপুষ্ট অংশকে ইগনোর করা হইসে। উপেক্ষার ধরনটা সেক্ষেত্রে অনেকের আত্মঅভিমানে মারাত্মক আঘাত দিয়া বসছে। অপমানবোধের পারদ তরতর করে উপ্রে উঠসে তাতে। উপ্রে উঠার মাত্রা মনে হইতেসে নিছক রস-পরিহাস আর হেসে উড়িয়ে দেওয়ার অবস্থায় দাঁড়ায়া নাই। পয়দাসূত্রে নিজেকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারব্যবস্থার শরিক বইলা কেউ যদি গণ্য করে, যদি সে ভাবে,—শতেক আপত্তি-অসন্তোষ বিদ্যমান থাকার পরেও স্রেফ মোদের সরব-নীরব সম্মতিকে পুঁজি করে সরকার ধরায় টিকে আছেন, সাধারণের দেখভাল ও জানমালের সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন এই ওয়াদার উপ্রে যার সকল চালিয়াতি সমাজে অব্যাহত আছে, এখন চালিয়াতির মধ্যে ওয়াদা পূরণ ও বরখেলাপের ভাগ কতখানি ইত্যাদি ঠাহর করতে সরকারের প্রতিটা অ্যাকশনের হিসাব রাখা প্রয়োজন। সাহিত্যমেলা বয়কটে একাট্টা লেখকরা বিস্মরণের গর্ভে বিলীন হইতে থাকা কথাখান ফের সকলকে ইয়াদ করতে বাধ্য করলেন বলা যায়। এদিক হইতে বিবেচনা করলে একখান থ্যাঙ্কুথাম্বস প্রতিবাদী লেখকগণের পাওনা হয়।

কথা তো ঠিক, রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার বাইরে যে-বেচারা আদম যুগ-যুগ ধরে অবস্থান করতেসে তার নাদান দিলের ওপর সরকারি অ্যাকশনের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নগণ্য নয়। সরকার বাহাদুরের যত কাজকারবার, জনকল্যাণের জপমালা হাতে গদিতে বসে বিতিকিচ্ছ কাণ্ডকারখানা, এখন এগুলার আসর থলি হাতে বাজারে ঢুকলে পষ্ট মালুম হয়। ম্যাঙ্গোপিপলের জীবনের কোনাকুনচিতে সরকার প্রণীত কীর্তিকলাপ দাগ রাইখা যায়, যাইতেই থাকে। পাবলিকের দঙ্গলে নিজেকে কেউকেটা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে অভ্যস্ত লেখকসমাজের সঙ্গে পিরিত বাড়ানোর নামে একটা সাহিত্যমেলা অথবা ছাতামাথা যে-কাজ সরকার করুক, তার এইসব কাণ্ডকাহিনি উক্ত সমাজের পশ্চাদদেশ মারার আকাম সারতেসে কি-না সেদিকপানে চোখকান খোলা রাখাকে ইমানি দায়িত্ব গণ্য করা যাইতে পারে। সংক্ষুব্ধ লেখককুল মনে হয় এই যুক্তি থেকে মেলা আয়োজনের ঠিকাদারবৃন্দের উপ্রে নাখোশ হইসেন।

জেলা প্রশাসন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি আর উনাদের পেয়ারা কতিপয় স্থানীয় লেখক মিলেঝুলে মনোপলি পিরিতরসে মজলেও বাকি লেখকদের সেখানে বেইল নাই দেখে চোরা আফসোস ও হাহাকার মনে হয় তৈয়ার হইসে সেখানে। প্রতিবাদপত্রের কতক জায়গায় মনোবেদনটা গোপন থাকে নাই। এবং সেক্ষেত্রে মেলার অন্যতম আয়োজক বাংলা একাডেমির গাফিলতিকে সরাসরি অ্যাটাক না করে তার লোকাল এজেন্ট বা পেয়ারাগ্যাং যাই বলি না কেন, এরকম একখানা অনামা লেখকগোষ্ঠীকে (*উনাদের ভাষায় সিন্ডিকেট) সকল নষ্টের গোড়া ঠাউরে নিজের গোস্বা ঝাড়ছেন তারা। যেখানে তারা লিখসেন :

তৃণমূল পর্যায়ের সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই আয়োজনে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, গবেষণা ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি সমন্বয়কের ভূমিকায় থাকলেও আমরা বুঝতে পারি, বাংলা একাডেমির তরফে সিলেটে (স্থানীয় পর্যায়ে) কর্তৃপক্ষের বাইরে থেকে যারা ইতঃপূর্বে লেখকদের সঙ্গে সমন্বয়ের ভূমিকায় ছিলেন, তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন কর্তৃপক্ষের আড়ালে এযাবৎ (ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীস্বার্থে) যেনতেন ভাবেই করেছেন। এইসব বিষয়ে সুপারভিশন/মনিটরিং কী রকম, তা নিয়ে সিংহভাগ লেখক-সংস্কৃতিকর্মী ধোঁয়াশায় রয়েছেন। আয়োজনে ‘তৃণমূল কথাটার ব্যবহার শুধু কাগজে-কলমেই আছে, আর আছে একটা গোষ্ঠীর মধ্যে।

বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে কোট-আনকোট এই যে বেনিফিট অব ডাউট লেখকরা দিয়া দিলেন, এইটা অদ্য উনাদের প্রতিবাদ ও বয়কটের স্পিরিটকে অনেকখানি ম্লান করল মনে হইতেসে। উদ্ধৃত বক্তব্যে রাষ্ট্রযন্ত্রে কয়েদ একাডেমিকে আলাভোলা গোছের মাল ভাবার খায়েশ জাগে মনে! একাডেমি অবশ্য মোটেও সেরকম কিছু না। সরকারের হয়ে হরবখত শত কিসিমের পলিটিক্স তারে সামল দিতে হয়। একাডেমিকে আপাতদৃষ্টে স্বাধীন মনে হইতে পারে কিন্তু বেচারা কার্যত পরাধীন! রুশোর অমর উক্তিটা খানিক এদিক-ওদিক করে বলা যায়, বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান পায়ে বেড়ি-শিকল পরে রাষ্ট্রের গর্ভ হইতে ভূমিষ্ট হয়। ডাণ্ডাবেড়ি পরিহিত এই শিশু পরাধীনতাকে নিজের স্বাধীনতা বইলা একরার যায় সেখানে। এমন একখান আজিব কিসিমের জীবকে বেনিফিট অব ডাউট দেওনের কিছু থাকে কি? রাষ্ট্র তারে রাজনৈতিক সত্তা রূপে প্রসব করে, যেখানে তার একটাই এজেন্ডা,—গদিনশিন সরকার বাহাদুরকে সাহিত্য ও সংস্কৃতিবান্ধব বইলা লোকের সম্মুখে প্রচার করা। বয়কটে গমনকারী লেখকসমাজ একাডেমির এই রাজনীতিটা ক্যান ধরতে পারলেন না সে-কথা ভেবে অবাক যাইতেসি! ধরতেই যদি পারতেন তবে কতিপয় লোকাল এজেন্ট ওরফে সিন্ডিকেট ওরফে পেয়ারাগ্যাংয়ের হাতে সে জিম্মি বইলা দাগানোর চেষ্টা করতেন না। বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান হইতেসে এমতো ক্ষমতার প্রতীক যারে জিম্মি করা যায় না, উলটা নিজে জিম্মি হইতে হয়। সে জিম্মি করে লেখককে;—ওইসব লেখক যারা কোনো-না-কোনো স্বার্থের টানে, হইতে পারে স্বেচ্ছায় নতুবা অনিচ্ছায় নিজের পশ্চাদদেশ তার কাছে উন্মুক্ত করতে তৈয়ার থাকেন।

সাহিত্যমেলা জাতীয় অনুষ্ঠানে শরিক থাকার প্রশ্নে বাংলা একাডেমির ভূমিকা যথাবিহিত পলিটিক্যাল। সিলেট নগরে যারা তার হয়ে সরকারের উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবেন সেই লোকগুলার খবর নিতে সে ভুল করে নাই। মনিটরিং/সুপারভিশনেও ত্রুটি ঘটেনি একরতি। পুরা ঘটনাই মিউচুয়্যাল ছিল! এর মধ্যে বোঝাপড়া, লেনদেন ও পিরিতরসের সবটাই মওজুদ থেকেছে বা আগামীতেও থাকবে। প্রতিবাদপত্রে জিনিসটা ভুলভাবে অ্যাড্রেস করায় সন্দিহান ব্যক্তি লেখকগণের আসলি মতলব কি ছিল সেইটা নিয়া প্রশ্ন তোলার হক রাখেন। এতটা নাইভ হইলে প্রতিবাদ কি জমে? উলটা নিজের পশ্চাদদেশ খোয়া যাওয়ার সম্ভাবনা প্রকট হয়!

এমতো আকাট সারল্য সত্ত্বেও স্থানীয় লেখকগোষ্ঠীর সাহিত্যমেলা বয়কট দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে তাৎপর্য রাখে। আর কিছু না হোক উনাদের সাহসকে সকলের কুর্নিশ করা উচিত। সাহিত্যমেলা টাইপের ঘটনা নিয়া কেলেঙ্কারি যদিও নতুন কিছু না এই দেশে। অতীত থেকে আজ অবধি এতবার ঘটসে যে এইটারে বয়কট করতে ভাবাভাবির ঠেকা পড়ে না। আওয়ামী সরকারের আমলে ঘটার কারণে হয়তো সকলে নড়েচড়ে বসছেন। ইনফ্যাক্ট, দেশের সাহিত্যিক সমাজ ইদানিং যেভাবে সব ঠিক হ্যায় মার্কা কুম্ভকর্ণের নিদে বিভোর, তার মধ্যে ঝাঁকুনিটা সকলের অন্তরে বেশ লাড়া দিসে। কথা মিথ্যা না, রাষ্ট্রযন্ত্রে সক্রিয় সরকার যদি সাহিত্যমেলা গোছের পাবলিক ইভেন্ট করার খায়েশ করেন সেক্ষেত্রে বাছাই লেখকের সঙ্গে একলা পিরিতে মজে থাকাটারে সুবুদ্ধির পরিচয় বলা যাবে না। পিরিত যদি করতে হয় তবে হাবিগুষ্টি যত লেখক সিলেটে ছিলেন উনাদের তালিকা তৈয়ার ও একে-একে সকলের সঙ্গে সহবাসের সোহাগ বজায় রাখতে পারলে উদ্দেশ্য অধিক সিদ্ধ হইত মনে হয়। সরকার বাহাদুরের ইমেজকে গ্লোরিফাই করতে এমনধারা কমন পিরিত মাঝেমধ্যে জরুরি হয়। আড়ালের পলিটিক্স ঠিক জায়গায় কদম ফেলে তখন। ভোটের বছরে একাডেমির এই পলিগ্যামি ওরফে বহু পরদারগমন দরকারি ছিল। সেদিকপানে ধাবিত না হওয়ার কারণে সরকার বাহাদুর পাবলিককে ভীষণ লাভ করেন টাইপের বুলি ও তার সত্যতায় অকপট শির ঝোঁকানোর মোমেন্ট তৈরি হইতে গিয়াও তৈরি হয় নাই। চান্সটা এইবেলা বোধ করি একাডেমি হেলায় হারাইলেন।

.   .   .

সরকারের সঙ্গে পাবলিকের আশনাই রিপল অ্যাফেক্ট-র মতো সমাজে প্রভাব রাইখা যায়। সরকার ঘটনা ঘটায়। তার প্রতিক্রিয়ায় দশটা ঘটনা জন্ম নেয়। ঘটনাগুলা এভাবে একটা ক্যাওস খতম না হইতে আরেকটায় গিয়া পড়ে। কখনো-সখনো ক্যাওস-র জুমলায় সরকারকে খাবি খাইতেও দেখে লোকজন। তার এক-একটা সিদ্ধান্ত হইতে অগুন্তি ক্ষত বা জখম জন্ম নিলেও অন্যদিকে মলম দিয়া উক্ত ক্ষত উপশমের কসরতে ভরপুর ফানি মোমেন্ট আকসার তৈরি হইতে থাকে। সাহিত্যমেলা নিয়া সাম্প্রতিক কাণ্ডকে তার একটা ধরা যাইতে পারে।

বয়কটের কারণে সরকারি আয়োজনটা নিয়া ফানি মোমেন্ট তৈয়ার হইলেও জরুরি একখান সওয়ালকে সেখানে গায়েব মনে হইতেসে। অগ্নিমূল্যের বাজারে গুচ্ছের টাকা খর্চা করে সাহিত্যমেলার ডামাডোল কি পরিহার করা যাইত না? প্রশ্নটি তোলা উচিত ছিল মনে করি। সমস্যা একটাই সেখানে, অতীতে যারা এইসব বেমাক্কা প্রশ্নসহ জাতির কাছে হাজিরা দিতে দ্বিধা করতেন না তারা কেউ আর বেঁচে নাই। উত্তরসূরিদের কাছে এইসব ঘটনা নিতান্ত গতানুগতিক বইলা আজকাল বিবেচিত হয়। এতটাই গতানুগতিক যে প্রশ্ন তোলার স্পেসে গমনের ইচ্ছা তাদের মনে জাগে না। অনুসন্ধানী ও দুর্বিনীত সাংবাদিকতা বহু বছর যাবত দেশ হইতে নিখোঁজ! অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার নাগাল পাওয়া দায় হইতেসে! ছফা কিংবা আজাদের মতো ঠোঁটকাটা বুদ্ধিজীবীরা ধরাধাম ত্যাগ করসেন আগেই। স্পষ্টবাক ছফা বা আজাদের জায়গা নিতে পারে এমন বাপের বেটার আকাল স্বীকার না গিয়া উপায় নাই। মনোটোনাস আওয়ামী মওসুমে জীবন যে-কারণে খামবিনিময়ে পরিতুষ্ট হইতে আকুল! টেকা পাখির খোয়াবরঙিন এক জগতে সকলে ঢুকে পড়তে মরিয়া এখন! একটাই জপ সেথা চলে দিবানিশি : ও টেকা ও পাখি তুমি/উইড়া উইড়া আসো/উইড়া-উইড়া আইসা তুমি/আমার ডালে বসো। কাজেই গুচ্ছের টাকা খর্চার যৌক্তিকতা নিয়া ভুরু কুঁচকানোর লোক, ধাম কইরা মুখের উপ্রে কথা বলার লোক, ধরা যাইতে পারে, দেশে অদ্য মরহুম!

খর্চার প্রসঙ্গ যদি বাদ দেই, মেলাটেলা করে মাননীয় সরকার বাহাদুর সাহিত্যের কী উপকার সাধন করতেসেনে (?);—এমতো প্রশ্নের সদুত্তর দানে সরকারে সক্রিয় আমলাগণকে উত্যক্ত করার সুযোগ প্রতিবাদে উদীপ্ত লেখকদের ছিল। মেলায় যারা যোগ দিতে সদয় সম্মতি দান করসেন, পেপারটেপার পড়বেন বইলা কাগজ-কলম নিয়া বসছেন নিরালায়, দূর হইতে টেকা পাখিটারে উইড়া উইড়া আসতেও দেখতেসেন বেশ, আলোচনাসভায় কী বলবেন তার আঁক কষতেসেন মনে, স্বরচিত পদ্যখানা রেডি রাখসেন মঞ্চে ঝাড়বেন বইলা…, উনাদের এইসব মেহনতে সাহিত্যের উপকার, উন্নতির কতটা কী তার বিষয়ে দু-চারখানা প্রশ্ন ঠোকা বোধ করি মন্দ হইত না। মেলার মঞ্চে প্রবন্ধ, কবিতা পাঠ কিংবা আলোচনায় মশহগুল হইতে আকুল এই লেখকগণের বিব্রত চোখমুখ দেখতে পাওয়ায় সুখ কিন্তু ম্যালা! এতে আর কোনো উপকার না হইলেও টেকা পাখির রিলে রেসে পরাভূতদের মনে আরাম জুটত খানিক। মেলা বয়কটে শরিক হিসেবে অদ্য যাদেরকে মোরা ঠার করতে পারতেসি। মেলায় যাওয়া বা না যাওয়ার চাইতে এইটা ঢের গুরুতর ছিল। পরিতাপের বিষয় হইতেসে বয়কটে একাট্টা লেখকগণের প্রতিবাদপত্রে সেরকম কিছু উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই!

জনগণের ট্যাক্সের টাকায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্থানীয় পর্যায়ে সক্রিয় লেখককে সম্পৃক্ত না করার ব্যাপারে উনাদের সংক্ষোভ ও মনোবেদন মুখ ব্যাদান করলেও ক্ষোভ প্রকাশের ধরনটাকে খণ্ডিত ভাবতে মন বাধ্য বোধ করতেসে। ডলার সংকট, সবিরাম লোডশেডিং, মূল্যস্ফিতি, দলবাজি, গুমখুন ও চুরিচামারির সঙ্গে আমলা নামক জনবিচ্ছিন্ন কামলাদের দাপটে নাজেহাল সরকারের সাহিত্যমেলা আয়োজনের যৌক্তিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মেজাজ বয়কটে অনড় লেখকদের প্রতিবাদে প্রকট হইতে পারাটা সংগত ছিল যদিও! উনাদের প্রতিবাদকে কুর্নিশ জানাইতে বা সেখানে শরিক থাকতে সমস্যা নাই, তবে প্রতিবাদ করতে গিয়া সরকারকে তারা যেভাবে মাইলেজ দিলেন সেইটা গভীরভাবে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।

আমলা ভারাক্রান্ত সরকারি আয়োজনটা হয়তো এক কিলোমিটার যাইত। জ্বালানির অভাবে অতঃপর বইসা পড়ত সে। প্রতিবাদে শরিক লেখকগণ তারে অধিক যাওয়ার শক্তি যোগান দিলেন মনে হয়। বার্তাটা তারা দিয়া দিলেন : তুমি বাপু অনেক আকাম-কুকাম করতেসো জানি! সরকারকে গদিতে রাখার জরুরত আর ওদিকে ভোটের বছরে বৈতরণী পার হইতে আরো আকাম তুমি সামনে করবে সেইটা আবালও বোঝে। আকাম-কুকামে ভরপুর কাণ্ডকলাপকে মোরা যেহেতু ছাড়পত্র দিয়াই দিসি, এবে মেলায় মোদের না ডাকার কারণ জানতে চাই! বিবৃতিতে ক্ষোভের পারদ চড়া থাকলেও সরকারের আসল উদ্দেশ্যের দিকে প্রশ্নবাণ হানার মামলায় লেখকগোষ্ঠীর বরফশীতল নীরবতা আশ্চর্যজনক! গায়ে রাজনীতির রং লাগার ভয়ে সকলে কমবেশি সকাতর ছিলেন মনে হয়। সাহিত্যমেলাটা স্বয়ং সরকারযন্ত্র হইতে ভূমিষ্ট এক রাজনীতি, এর নেপথ্যে ভোটের বৈতরণী থেকে আরম্ভ করে পদলেহী সুশীল জড়ো করে ইন্টেলেকচুয়াল উইং জন্মদানের নানান মতলব সক্রিয়, বিষয়গুলা ঠিকঠাক নজর আন্দাজ করলেও না করার ভান প্রতিবাদপত্রে কানে বাজে।

সরকারের উদ্দেশ্যকে সমসাময়িক পরিস্থিতির নিরিখে সামনে আনায় ঝুঁকি অবশ্য প্রচুর। তার অনুসারীগণ সেক্ষেত্রে বয়কটে অটল লেখকগণকে সরকারবিরোধী শক্তির চর হইতে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ ইত্যাদি নানা অভিধায় ট্যাগাইতে পারেন। ডিজটাল সিকিউরিট অ্যাক্ট-র ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে হাজতে চালান করা বিচিত্র না। আর এইটা তো জানা কথা, হাজত এক খতরনাক জায়গা! রোদ্দূর রায়ের মতো বেয়াদব মুখবাজ অবধি স্বীকার করসেন সম্প্রতি,—সরকারি সিস্টেমকে মুখে ডাণ্ডাপেটা করতে না পারলে মনে হয় মগজে সুনামি চলতেসে, এতটাই অসহ্য এই ব্যবস্থা, কিন্তু পরিণামে জেলহাজতের হুজ্জোত সহ্য করা যে-কারো জন্য খতরনাক! সরকারের আসলি মতলবকে সাইডলাইনে রেখে ফোঁপরা মানঅভিমান নিয়া বিবাদে জারি থাকাটা বরং সেক্ষেত্রে নিরাপদ।

এই যে মূল উদ্দেশ্যটারে প্রশ্ন করার মনোবলে খামতি, এইটা নিয়া বাহাসে গমনের পরিবেশ সৃষ্টির ঘাটতি, সরকারকে সোজাসাপটা জিগাইতে না পারা, এইসব অগুন্তি ‘খামতি, ঘাটতি ও না পারা’ প্রমাণ করে লেখকরা সুইটি-কিউটি থাকার বিদ্যা ভালোই রপ্ত করতে শিখছেন। কুশলতার সহিত চুপ থাকার মন্ত্র লবজ করতে নিজেকে বাধ্য কইরা তুলসেন তারা। আমলাতন্ত্রে ঠেকনা দিয়া দাঁড়ানো রাষ্টযন্ত্র ও সরকারব্যবস্থার শত অনাসৃষ্টি বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার মতো কলমের জোর তাই ক্ষীণ। এরশাদ শাহীর পতনের পর হইতে চাপা ভয়ের একটা সংস্কৃতি দেশে জন্ম নিতে থাকে। খালেদা জামানায় ওইটা প্রবল ছিল। হাসিনা জামানাও তথৈবচ। কালের গতিতে সংস্কৃতিটা পরিপক্ক হওয়ার কারণে এর প্রভাব, অভিঘাত লেখক-দেহমনে গভীর ছাপ ফেলতে শুরু করসে। বয়কটকাণ্ড যারে পুনরপি সামনে নিয়া আসছে। মেলা বয়কটের কারণ ভানতে বসে লেখকরা যে-বক্তব্য ওরফে স্টেটমেন্ট রাখসেন, এখন এইটাকে কেউ যদি মেলায় চান্স পাওয়া না পাওয়া নিয়া মুলামুলি বইলা ভাবে, বেচারাকে সেক্ষেত্রে নাদান বইলা ধমকানো মুশকিল হয়। সংক্ষুব্ধরা বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারসেন বইলা একিন যাইতে পারি নাই। প্রতিবাদপত্রে লিপিবদ্ধ ভাষা বা ড্রাফটিং দেখে বরং এই ভাব মনে প্রকট হয়, এইটা বোধহয় ক্ষুব্ধ লেখকগণের সঙ্গে আলাপে গমনের মাইলেজ সরকারকে দিয়া দিতেসে। আয়োজকরা সেই সুবাদে দুঃখ প্রকাশিবার মওকা পাইবেন। সবাইকে দাওয়াতপত্র বিলি করা ও মান-অভিমান ভুলে মেলায় যোগদানের প্রস্তাব যদি দিয়া বসেন তাইলে আশ্চর্যের কিছু নাই।

.   .   .

পলিটিক্স ম্যাটারস;—দেশে এই ফ্রেজখানার জেল্লা এরশাদ শাহীর রাজপাট খতম হওয়ার দিন থেকে ক্রমশ নিভতে আরম্ভ করসিল। আওয়ামীযুগে সে কোমায় গমন করসে। হাসিনা সরকারের ভালোমন্দ নিয়া ঘরে-বাইরে হাউকাউ প্রবল কিন্তু ভয়ানক আমলা নিয়ন্ত্রিত সরকারব্যবস্থার দেহে যেসব বিমার একে-একে দৃশ্যমান হইতেসে, এখন এই বিমারগুলাকে নিজে চিনতে পারা ও লোকজনকে চিনতে সাহায্য করার কাজে দেশের সাহিত্যিক মহল তথা বুদ্ধিজাহানকে পঙ্গু ছাড়া অন্য কিছু ভাবা কঠিন। পঙ্গুত্বটা অদ্য ফাঁদে পরিণত হইতেসে। গদি ধরে রাখতে আওয়ামী সরকার বিকল্প রাজনীতির সকল সম্ভাবনাকে সর্বাগ্রে গলা টিপে হত্যা করসেন। পিনাকী ভটচায উনাদের জন্য আদৌ কোনো সমস্যা না অথচ ওই লোকের চেয়ে ঢের বুদ্ধিকুশল ও শ্লীল লোকজন মাথাব্যথার কারণ বইলা বিবেচিত হয়। যার অর্থ হইল কোনো প্রকার বিকল্প রাজনীতির ভাবনা এলাউ করার প্রশ্নে উনারা ভয়ানক কঞ্জুস। দেশের নপুংসক ও জনজাতির জন্য উপদ্রব বিবেচিত বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলার মাজাভাঙা আলাপ-সালাপ আর চরম সুবিধাবাদী অ্যাক্টিভিজমের পাল্টি আওয়ামী ঘরানার অ্যাক্টিভিজম গত দেড় দশক ধরে শাখের করাতের নিচে জনগণকে বলি দিতেসে অবিরত। এখান হইতে সরকারকে সরাসরি প্রশ্নবিদ্ধ করার গণতন্ত্রকে গায়েব করা হইতেসে বেমালুম। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার পরিবর্তে কতিপয় ফোঁপরা প্রসঙ্গ দিয়া মুলামুলির প্রবণতা বাড়তে থাকায় ওইটা প্রকারান্তরে সরকারকে মাইলেজ দিয়া যাইতেসে।

সরকারি যে-কোনো উদ্যোগ রাজনৈতিক বার্তা ও তাৎপর্য বহন করে। তাৎপর্যটারে যদি সর্বাগ্রে সন্দেহ করা না যায়, এর ইতিনেতি নিয়া প্রশ্ন উঠানো মুমকিন না হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিবাদ উলটা সরকারকে অধিক চতুর হইতে ও নিজের শক্তিকে সংহত করতে সাহায্য করে। পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের মওকা তার জন্য অবারিত হয় তখন। বয়কটে একাট্টা লেখকরা এরকম একখানা স্পেস ক্রিয়েট করলেন মনে হইতেসে। মেলাকাণ্ডের প্রতিবাদ যৌক্তিক ও ন্যায্য হইলেও অ্যাক্টিভিজম জাহিরের পদ্ধতিটা খুব যে বিবেচনাপ্রসূত পথে আগাইসে সেইটা বলা যাবে না। নীরবতা ও উপেক্ষার মধ্য দিয়া প্রতিবাদ বরং ভালো ছিল। এরকম কত কাণ্ডই তো বালেগ হওয়ার দিনকাল থেকে উলটা রাজার দেশে মোরা দেখে আসতেসি। আরেকখানা কাণ্ড না-হয় যুক্ত হইত স্মৃতির মণিকোঠায়। এমনধারা কাণ্ডের প্রতিবাদে সাহিত্যিক তৎপরতা কাজ দিতে পারে যদি তার মধ্যে সুতীব্র রাজনীতিসচেতনার বারুদ থাকে, অন্যথায় প্রতিবাদ ছিনতাই হওয়া ছাড়াও সৎ উদ্দেশ্যটা বিকৃতিবিকারে বিনষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাইকা যায়। সংক্ষুব্ধ লেখককুল এদিকটা বিবেচনায় নিলে ভালো করতেন।

আগেই বলসি, প্রতিবাদপত্রের ভাষা কতক ক্ষেত্রে স্ববিরোধী। উনারা যেমন এই প্রশ্নটা তুলসেন, যৌক্তিকভাবেই তুলসেন, বোঝার সুবিধার্থে উদ্ধৃতি দেই বরং :

এই আয়োজনে প্রকৃত অর্থে তৃণমূলের লেখক কারা, এর কোনও ব্যাখ্যা বা উত্তর আছে কি?’ পরের পয়েন্টে বক্তব্য আসতেছে, ‘কোনও বিশেষ গোষ্ঠীর সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষাকারী হলেই কি তৃণমূলপর্যায়ের লেখক হওয়া যায়? প্রকৃত অর্থে এই আয়োজনে তৃণমূলের লেখকরা উপেক্ষিত।

কী সর্বনাশা ব্যাপার! প্রথম পয়েন্টে তৃণমূল নিয়া যৌক্তিক প্রশ্ন তারা তুলসিলেন। পরের পয়েন্টে তৃণমূলের লেখকরা উপেক্ষিত বলার মধ্য দিয়া সরকার বাহাদুরের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ আমলাদের উর্বর মস্তিষ্ক হইতে পয়দা তৃণমূল অভিধাকে প্রকারান্তরে নিজেরা সাদরে কবুল করলেন! মাইনা নিলেন, জাতপাত প্রথায় কবলিত ভারতে বিরাজিত উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ, সমাজ-ইতিহাসের ধারায় আবিভূর্ত উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ, রাজনীতি আর এনজিওর ময়দানে দাগানো সুবিধাভোগী ও প্রান্তিক-তৃণমূল ইত্যাদির মতো লেখকসমাজও উচ্চ-নিচ তথা আশরাফ-আতরাফে বিভক্ত। আজব বটে!

রাজধানী হইতে যারা আয়োজনে যোগ দিবেন এবং স্থানীয় যারা আমন্ত্রিত উনারা হইলেন আশরাফ আর বাদবাকিরা আতরাফ। এই আতরাফ হইতেসে গ্রাম্য বা মফস্বলী। অজপাড়াগাঁর সাহিত্যসংঘে ঘোরাফিরা করে তার দিন কাটে। কেউ তারে পুছে না ও পোছার প্রয়োজন মনে করে না। লোকটারে এইববেলা সত্বর দুস্থতোষণ প্রকল্পের আওতায় আনার ভাবনা হইতে আমলারা অভিনব সাহিত্যমেলার আয়োজন করতে যাইতেসেন! এর মধ্য দিয়া উনাদের এলিটঅহং হয়তো পরিতোষ লাভ করে। এমনধারা স্ববিরোধিতা অগত্যা মেলা বয়কটে সোচ্চার লেখকগণের সারল্য নতুবা রাজনীতির প্যাঁচপয়জারে অনাগ্রহী সত্তাকে নাঙ্গা করে যায়। উনারা রাষ্ট্র ও তার বিবিধ সহকারী অঙ্গে সক্রিয় বোঝাবুঝি, লেনদেন আর ঘষাটাঘষটির মতো গুরুতর ঘটনা হইতে যেসব প্রতিক্রিয়া সমাজে অবিরত জন্ম নিতে থাকে তার ব্যাপারে হয় নিষ্পাপ নয়তো জেনেবুঝে জ্ঞানপাপী। বয়কটে সংহত লেখকগণের প্রতি সকল সহানুভূতি এবং প্রতিবাদে শরিক থাকার মুচলেকায় দস্তখত করা সত্ত্বেও কথাখান বলতে হইতেসে বলে দুঃখিত। বিবৃতিতে পরিষ্কার আসা উচিত ছিল, লেখার শক্তিমত্তা বা গুণাগুণ বিবেচনায় বনসাই কিংবা বটবৃক্ষতুল্য লেখক হয়তো ভাবা যায় কিন্তু তৃণমূল কভু নয়। রাজধানী লেখক যেমন লেখক, গ্রাম ও মফস্বলের নিরালা কোঠায় বসে যে-লোক কলম ঘষে তার পরিচয় একটাই সেখানে,—সে একজন লেখক। লেখার শানমান নিয়া অহরহ তর্ক বা তুলনা চলতে পারে কিন্তু বংশপরিচয় অকৃত্রিম, আর সেইটা হলো, মসিচালনার জোরে এনারা সকলে লেখক।

তবে হ্যাঁ, সংক্ষুব্ধ লেখকগণের বিবৃতিতে নিজেকে প্রকারান্তরে তৃণমূল বইলা স্বীকার যাওয়ার ভালো দিকটা এইবার বিবেচনা করা উচিত। সমাজে হরকিসিমের বৈষম্য আর বিভাজন নতুন কিছু না। লেখকরা ভিনগ্রহের হইতে যাবেন কোন দুঃখে? এইটা তো সত্য, সাহিত্যের রাজনীতিতে সক্রিয় কলিগরা রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারব্যবস্থার সঙ্গে সহবাসের রাজনীতিতে কামিয়াবি হাসিল করায় এলিটবৃত্তে বিরাজ করতেসেন। নিজের পণ্যমূল্য তারা ভালো বোঝেন। নিজেকে বিক্রয়যোগ্য আকারে উপস্থাপনের কায়দা-কানুনের সবটাই বেশ ভালো মতন কবজা করসেন তারা। পুঁজির রমরমা মওসুমে এইটা কোনো অপরাধ হইতে পারে না। মডেলের মতো মার্জারছন্দে কোমরে ঢেউ তুলে তারা যদি সাহিত্যমেলায় হাজির থাকেন তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার কারণ নাই। ইনফ্যাক্ট, নিজেকে সেল করতে না পারলে লিখেটিখে লোকের নেকনজর আদায় করা কঠিন। এইটা এক গভীর রাজনীতি এবং সেদিক হইতে সিলেট কিংবা দেশের এলিটবৃত্তে সক্রিয় লেখকরা রাজনৈতিক। উনারা পলিটিক্যালি কনশাস আর সেইটা সমাজে উনাদের ইমেজকে বিরাট করে তুলসে। পক্ষান্তরে অনুরূপ রাজনীতি রপ্ত করতে অপুটগণ বেশক গরিব ও প্রান্তিক;—সত্যটা মাইনা নেওয়া ভালো হয়তো। কলমে শক্তি থাকতে পারে কিন্তু নিজেকে সেল করতে না জানলে সবটাই বেফায়াদা। নির্মম এই বাস্তবতা, রিয়েলিটি মিররে নিজের মুখখানা দেখার ঘটনা জাতির নিকট বোধগম্য করে তোলায় সংক্ষুব্ধ লেখকগণকে মারহাবায় অভিনন্দিত করা যাইতেই পারে।

প্রতিবাদপত্রে আরেকখানা প্রমাদ মনে করি উত্তেজনার তোড়ে লেখকগণ খেয়াল করেন নাই। আমলাবাহক আয়োজনটা চরিত্রের দিক দিয়া নারীবিদ্বেষী। মিসোজিনিস্ট। আয়োজকরা কি সেক্ষেত্রে সমকামী? হইতেও পারে। সিলেট অঞ্চলের এলিট লেখকবৃত্তে একটাও নারী লেখক উনারা খুঁজে পান নাই। যদি পাইতেন তা হইলে দাওয়াতপত্রে নামধাম নিশ্চয় দেখা যাইত। লেখক পরিচয়টা লিঙ্গনিরপেক্ষ গণ্য হইতে পারে কিন্তু লেখা নয়। নারীর চোখ দিয়া তার নিজের জীবন ও সমাজকে বীক্ষণের সঙ্গে পুরুষের চোখ দিয়া উক্ত বিষয়কে দেখার ঘটনায় বিলক্ষণ তফাত থাকে। সামাজিক বাস্তবতার জায়গা হইতে তফাতটা মূল্য রাখে বৈকি। এর মধ্য দিয়া নারী এবং পুরুষের পরস্পরকে অবলোকন করার বহুমাত্রিক উপাদান মোরা মুফতে লাভ করি। সাহিত্যকে ওইটা ঋদ্ধ করে যায়। তো একটাও নারী লেখক খুঁইজা না পাওয়ার আজব ঘটনা প্রতিবাদপত্রে প্রাসঙ্গিক করা যাইত বোধহয়।

.   .   .

যাই হোক, বড়ো কথা এই যে, অনেকদিন পর একটা ইস্যুতে কিছু লেখক প্রতিবাদ করসেন। রাজনৈতিক বোধশক্তির ঘাটতি পীড়াদায়ক এবং ক্ষেত্রবিশেষ শিশুতোষ মনে হইলেও প্রতিবাদটা গানপার-সঞ্চালক নথিভুক্ত করে কামের কাম করসেন বলা যায়। সময়ের সঙ্গে এর ভ্যালু জাতি বুঝবে একদিন। দেশে অদ্য যে-পরিস্থিতি সেখানে নজরুলের বিদ্রোহী কিংবা মোহাম্মদ রফিকের সব শালা কবি হতে চায় টাইপের ক্ষোভ উগড়ানো সহজ নয়। মোদি সরকারকে ধুয়ে দেওয়া ছোকরা আমির আজিজ, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের হাম দেখেঙ্গে আর খোদ ফয়েজ কর্তৃক আওয়ামী শায়ের বা জনতার কবি খেতাবে ভূষিত হাবিব জালিবের মতো অ্যাক্টিভিজমে গমন করা অতি সুকঠিন। উর্দু ভাষায় শের থুড়ি নজম রচনা ও তাকে অহরহ গানে রূপ দিতে পারঙ্গম জালিব মিলিটারি আর ইসলামি মিল্লাতের মাখামাখির ফলস্বরূপ ক্রমিক অধঃপতনে দিশেহারা পাকিস্তানের শাসককুলের উপ্রে ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। দস্তুর-র পঙক্তিমালা তাঁকে অমরত্ব দান করসিল আগেই। তো এই জালিব একবার জেনারেল জিয়া-উল-হকের উদভুট্টি কাণ্ডে চরম বিরক্ত হয়ে একখান নজম জনসমক্ষে পাঠ করসিলেন। নজম-র পয়লা দুচরণ মারাত্মক ছিল। অকুতোভয় জালিব জিয়াকে টার্গেট করে সেখানে বলতেসেন : ‘হুকমারান হো গায়া কামিনে লোগ/খাক মে মিল গায়া নাগিনে লোগ।’ ইংরেজি ভাষান্তরে এর অর্থ সোজাসরল। জালিব বলতে চাইতেসেন পাকিস্তানের আওয়াম বা জনগণকে এখন কমিন কিসিমের লোকজনের হুকুমে চলতে হইতেসে আর ওদিকে ভালো লোকগুলা মাটিতে মিশে যাচ্ছে। এমনধারা সাচ্চা প্রতিবাদের জায়গায় আমরা সম্ভবত দাঁড়ায়া নাই এখন।

পাকিস্তানে যেইটা দশকের-পর-দশক ধরে চলে বাংলাদেশে একই কারবার বালেগ হওয়ার দিন থেকে মোরা দেখে আসতেছি। পরিতাপ এই যে, একদা তবু দেখে আসার ব্যাপারটা নিয়া হায়দারি হাঁক মোটের ওপর জারি ছিল সমাজে। এখন আর ওসবের বালাই নাই। যদি থাকত তবে সাহিত্যমেলা বয়কটের তাৎপর্য নিয়া অনেকে সোচ্চার কলম ঘষতেন। এর সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা বিশ্লেষণ করা হইত। ঝাঁকুনিটা মোড় নিত জৈব বুদ্ধিজীবীতায়, কেবল যার মধ্য দিয়া লেখক সকল অবরোধের বাইরে গমন করে ও হাবিব জালিবের মতো সাচ্চা দিলে নিজের প্রতিবাদে জারি থাকতে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ায়। রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে ভিখ মাগা কিংবা তার সঙ্গে মান-অভিমান-আবদারে গমনের ঠেকা সে কদাপি বোধ করে না। সে হইসে দর্শক আর তার কলম তেজি শমসের। ঘাটতিটা এবে সংক্ষুব্ধ লেখকগণের সাহিত্যমেলা বয়কটের সুবাদে মনে পীড়া দিয়া যাইতেসে।

.   .   .

রাষ্ট্র ও সরকার তো আসলে বিমূর্ত ধারণা হয়! আমরা ভাইবা নিতে থাকি বিমূর্ত এই জগতে যারা প্রবেশ করবে বাদবাকি লোকজনের জানমালের নিরাপত্তা আর আকারে-প্রকারে যত ঝামেলা সমাজে চলে সেগুলার সুরাহা তারাই করবে। এই জায়গা হইতে উনারা হইতেসে লিডার আর মোরা ফলোয়ার। বেশ একখান কাল্ট টাইপের ব্যাপার আর কি! নিজের হুজ্জোত এইবেলা আমরা যাদের ঘাড়ে চাপাই, প্রশ্ন উঠতে পারে, এগুলা ঘাড়ে নিয়া তাদের ক্যায়া ফায়দা! ফায়দা এই যে, দায়িত্বটা ঘাড়ে বহনের পর থেকে অন্য মানুষে তারা রূপান্তরিত হইতে থাকেন। গ্রেগর সামসার মতো পোকায় রূপান্তর লাভের পরিবর্তে একটা বেহশতি জেওর টাইপের রূপান্তরের ভিত্রে তাগো ঢুকতে দেখা যায় তখন। আমরা সকলে মিলে যে-শক্তি ধারণ করি সেইটা এইবেলা তাদের দেহে পাচার হয়। এই শক্তির নাম হইতে পারে রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধান, গদি, সিংহাসন, লিডার, দেশনায়ক, জাতির পিতা ইত্যাদি আরো কত কী! সঙ্গে গুচ্ছের ধারণা সাকার হয় সেখানে। ভোট দানের অধিকার, সংসদ, আমলা নামের ঝামেলা, পিটাইতে ওস্তাদ পুলিশ, জলপাই রংয়ের উর্দি পরিহিত মিলিটারি, বাককুশল সুশীল, কবি-লেখক ইত্যাদি জীবগণ ক্রমপ্রকাশ্য হইতে থাকেন, নিরাকার হইতে সাকার দেহ নিয়া তারা সকলে প্রতিষ্ঠানে সমাধি লাভ করেন। সকলের মিলনে যে-জিনিসখান জন্ম নেয় তার নাম হইসে ক্ষমতা;—পাওয়ার! ক্ষমতা নামধারী বস্তুটারে গহনা বা জেওরের সঙ্গে তুলনা করা যাইতে পারে। আলংকারিক হইলেও চোখে ধাঁধা লাগানোর মতো শক্তি ধরে সে। মোট কথা, নিজের জানমালের নিরাপাত্তা আর নিজেগো মধ্যে চলতে থাকা ঝামেলা মিটমাট করতে না পেরে এই যে কতিপয় লোকজনকে সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে বলি বা তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করি, আমাদের এই ম্যান্ডেট দানের পন্থাটার মধ্যে সকল ক্যাচাল নিহিত। কথাখান প্রতিবাদপত্রের সূত্রে স্মরণ হইতেসে বৈকি!

কতিপয়রা এবে সুরক্ষা বা ঝামেলার সুরাহা করতে পারুক বা না পারুক, মোদের দেহ হইতে নির্গত শক্তির জেল্লায় তারা এক-একজন সুপারম্যান হয়ে আকাশ-বাতাস-পাতালে উড়তে থাকে। গদিতে বসে যখন ইচ্ছা তখন! যেমন ইচ্ছা তেমন! যেখানে একবার বসতে পারলে বারবার বসার সাধ জাগে। পাছা আর উঠাইতে ইচ্ছা করে না। এই অর্থে মোরা সামাজিক জীব নিজ পায়ে নিজেরা কুড়াল মারি। যাকে মোরা শক্তিমান করে তুলতেসি সে আর মোদের চেনা লোক থাকে না। তার সঙ্গে কুটুম্বিতা বদলাইতে থাকে। নিজের লোক হয়েও তাকে দূরের ভাবা ছাড়া উপায় থাকে না। রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট ইত্যাদির উপ্রে যতই মোদের হক আছে বইলা ভাবি ততই ঘটনা ঘোলাটে হইতে থাকে। যে-লোক এইসব ব্যাপারে ঢুকে পড়সে সে আর মোদের কেউ না, কস্মিনকালে হবেও না, এরকম ভাবতে না পারলে বিপদ ও বিড়ম্বনা দুটাই বাড়ে। ভাবতে যদি পারি তাইলে তার কাছে প্রত্যাশা থাকে না। প্রত্যাশা না থাকার কারণে সকল মামলা সেখানেই ডিসমিস হয়। প্রতিবাদপত্র পাঠের সুবাদে কথাখান ইয়াদ রাখা জরুর মানি।

প্রত্যাশা না থাকার সুবিধা অশেষ। আমরা এখন বাইরে দাঁড়াইয়া রাষ্ট্র-সরকার ও বিবিধ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমাহারে তৈরি ক্ষমতাত্রিভুজের বিচিত্র কাণ্ড বা রংঢং নজর করতে পারি। আমাদের নিশ্চুপ থাকাটা তার সর্বনাশের কারণ হইতে থাকে ক্রমশ। সে তখন সত্বর মাত্রা ছাড়ায়। অত্যাচারের সকল সীমা-সরহদ্দ সহসা অতিক্রম করে বসে এবং পরিশেষে মোদের হাতে খতম হওয়ার কাল ঘনায়। এইটাও এক ধরনের রাজনীতি। লেখকের জন্য কাজের। লিখে সমাজটমাজ পালটানো যায় না। তবে হ্যাঁ, সমাজটারে সকল ক্যাওসের মধ্যে বসে বেশ নিরিখ করা যায়। তার আদিঅন্ত তদন্ত ও খবর করা সহজ মনে হইতে থাকে। মানুষের কাছে বার্তা, সচেতনা ইত্যাদিও মনে হয় পৌঁছানো যায় তাতে। লেখকের কাজ এর বেশি নয়। ওইটুকু এলেম তার। তার মানে কি এই সে কখনো প্রতিবাদ করবে না? ঘরের কোণে বইসা খালি নদী-ফুল-মেঘ-পাখি-নারী নিয়া বুলি কপচাবে? না, ঘটনা বিলকুল উলটা সেখানে। প্রতিবাদ অবশ্যই করবে। পাঁচজন যেভাবে করে সেভাবে করবে। কথা একটাই, প্রতিবাদে উত্তাল হওয়ার প্রতি পলে নিজের রাজনৈতিক সত্তাকে জাগাইতে না পারলে সকলই গরল ভেল! লেখকের কাজ এই জায়গা হইতে নিরিখ করলে দ্বৈত বলা যায়। প্রয়োজনে প্রতিবাদী আর ওদিকে সারাখন বিকল্পের সন্ধানে সকাতর এক সত্তাই হইতেসে তার পরিচয়। বিকল্প হইসে একমাত্র আয়ুধ যেইটা তারে প্রচলিত প্রথা ও পরিতোষকে বোঝাই সমাজকে নিরলস বীক্ষণ ও বিবরণের শক্তি দিতে পারে। সংক্ষুব্ধ লেখকরা আশা করি এই সমীকরণ জেনেবুঝে আজ ও আগামীর কঠিন যজ্ঞে শামিল থাকবেন। অন্যথায় উনাদের প্রতিবাদ দিন কয়েক বাদ ফানুসের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাইতে দেখব মোরা আর রাষ্ট্র তখনো বোঝাই থাকবে কমিনা  লোকজনে!


প্রশাসনের সাহিত্যমেলা আয়োজন ও বয়কটকারীদের অবস্থানপত্র
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS