থার্ড

থার্ড

এইটা সত্যি একটা বড় সমস্যা। আমি আগে ভাবতাম এরা একপ্রকার প্রতিবন্ধী, কিন্তু আজকাল তা আর মনে হয় না। আসলে এরা এখন আর অসহায় কিছু বা কারো করুণামুখাপেক্ষী কিছু নয়, বরং একটা আলাদা প্রিভিলেজ-পাওয়া জনগোষ্ঠী বলেই মনে হয় আমার। আমি দেখেছি যে, বিশেষ চাহিদাওয়ালা কিছু লোক ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই তো এদেরকে খুব মানবিক মায়ার দৃষ্টিতে দেখে, এবং কেউ যাতে এদেরে না-ঘাঁটায় সেই দিকে খেয়াল রাখি তো যথাসাধ্য আমরা সবাই। কিন্তু কালক্রমে এই সামাজিক মায়া দিয়া এদেরে তো আর সামলানো যাবেও না মনে হয়। ব্যাপারটা বিড়ম্বনা বা অস্বস্তির গণ্ডি পেরিয়ে এখন প্রায়শ আমাদের জন্য লাঞ্ছনা বা হেনস্থার কারণ হয়ে উঠছে। বিশেষভাবেই আপনি যখন আপনার স্ত্রী কিংবা বন্ধুবান্ধবী নিয়া ঘুরতে বেরিয়েছেন, তখন এই অত্যাচার টের পাবেন। আপনি নিজেকে তখন অবলা অসহায় জীব ছাড়া আর-কিছুই ভাবতে পারবেন না। আমি যদ্দুর জানি, এরা আদি থেকেই নিজেদের মধ্যে একটা পৃথক ব্যবস্থাধীনে সংঘবদ্ধ, উপরন্তু এখন এরা আমাদের অ্যারিয়া-স্পেসিফিক মেইনস্ট্রিম পলিটিক্স ও পাওয়ারস্ট্রাকচার দ্বারা ব্যবহৃত ও মদদপুষ্ট হচ্ছেন। ফলে এইটা এখন অন্য শেইপ নিতে চলেছে, একসময় আমরা আমাদের সামাজিক মায়া দিয়া সামলাইতে পারলেও এখন সেইটা আর সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাপারটা আবার খুব সেন্সিটিভ তো, ফলে এই নিয়া ভাবতে হবে সেইভাবেই, কিন্তু কেউ যখন ভাবতে বসবেন, তখন যেন নাগরিক ভোগান্তিটাও মনে রাখেন, আচরণবিধি ও আবাসননীতি তো সবারই থাকা দরকার। আমরা এইরকম ক্ষেত্রে কেবল রাষ্ট্রীয় ও বুদ্ধিজৈবিক করুণা বর্ষণ করে এই হিজড়া আইডেন্টিটির মানুষগোষ্ঠীর জন্য কতিপয় সুবিধা বাড়িয়েই কিংবা খানিক সুবিধা কমিয়েই যেন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সমাপন না-করি। যা-হোক, এ-বাবতের ভোগান্তি তো কমবেশ অনেককেই পোহাতে হয় হামেশা। তা, এতক্ষণ তো বললাম সমাজের বিশেষ একটি আর্থসাংগঠনিক অবস্থানে থাকা ‘তৃতীয় লিঙ্গের’ মানুষগোষ্ঠী নিয়ে। তৃতীয় লিঙ্গ বলে সম্বোধন অগত্যা, সহজ সনাক্তকরণের স্বার্থে, না-হলে এইভাবে তৃতীয়  বলাটা কিন্তু অনাপত্তিকর নয়। সেক্ষেত্রে প্রথম  ও দ্বিতীয়  নিয়া ঘাপলা বাঁধে। কে প্রথম, কেইবা দ্বিতীয়, প্রশ্নাতীত থাকবার কথা নয়। এবং প্রশ্ন ওঠে। কেইট মিলেট থেকে ঋণ নিয়ে এ-বাবতে বেশকিছু চৈতন্য তৈরি করে দিয়ে গেছেন হুমায়ুন আজাদ। ভুলিনি নিশ্চয় আমরা। নারী কী দ্বিতীয় লিঙ্গ  তবে! এবং প্রথম  পুরুষ! ইত্যাদি তর্ক টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে এসেছে জোরালোভাবে আমাদের সামনে এবং দিশারী দিগন্ত তৈয়ার করে দিয়ে গেছে। সে-যাক। উপরতলার সোসাইটিতে এইধারা শারীরসংস্থানিক ভিন্নজৈবিকতার মানুষ যাদেরকে দেখেছি আমরা, তারা কিন্তু মোটেও অবলা নন। হতে পারে যে তারা বিহেভিয়্যারাল অ্যাটিচ্যুডের বিচারে মেইনস্ট্রিম নারীপুরুষের চেয়ে একটু অথবা অনেকখানি আলাদা। তাই বলে তাদের কোনো ফ্যাকাল্টি-যে একইঞ্চি কম কর্মক্ষম, এমনটা প্রমাণ তো করা যাবে না। আর আমরা তো জানিই যে, আমরা যা, তা আমরা কতটুকু আমাদের নিজেদের ইচ্ছেয় আর কতটুকু সমাজের ইচ্ছেয়, এইটা একটা বড় ও বিকট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে রয়েছে সবসময়। একদম সম্প্রতি একটা ব্যাপার আমার মধ্যে ঘোরের মতো চক্কর দিচ্ছে, ব্যাপারটা সদ্যপ্রয়াত ম্যুভিনির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ বিষয়ক, যিনি নিজের জীবন ও যাপন ও তাঁর কাজ সবকিছুর মিশেলে আমাদের সামনে একটা স্টেইটমেন্ট রেখে গেছেন, যেইটা খামোশ করে রাখবার মতো পাওয়ারফুল। এমনিতে আমরা যাদেরে হিজড়া বলি, বা তৃতীয় লিঙ্গ, রিসেন্ট একটা বাংলাদেশি  সিনেমায় যেমন বলা হয়েছে কমন জেন্ডার, এদের একটা প্রেজেন্স আমরা আমাদের চলচ্চিত্রে দেখতে পাই সীমিত ও খণ্ডিত রূপে, বেশ-কয়েকটা — হাতে-গোনা — পূর্ণাঙ্গ ফিচার ফিল্ম হয়েছে — এবং আমি নিজে দেখেছি — বাংলায় ও হিন্দিতে — যেগুলো আপত্তিকরভাবে বিকৃত ও অতিনাটকীয়। এইসব সিনেমার কোনো-কোনোটাতে প্যাথোস পুরতে যেয়ে দরদি নির্মাতা সিনেমাটা বানায়ে ফেলেছেন বাস্তববর্জিত জবরজং মাছের মায়ের কান্না বা এনজিওবিপ্লব। রক্তমাংসের জলজ্যান্ত এই মানুষগুলোকে করুণাসাগর বঙ্গবাসী কিংবা হিন্দিভাষী কোনো সিনেমায় শিরদাঁড়া নিয়া দাঁড়াইতে দেখা যায় নাই। লিখিত সাহিত্যেও তথৈবচ। মনে পড়ে এককালে বাংলাবাজার দৈনিকে ধারাবাহিক উপন্যাস পড়েছিলাম খুশবন্ত সিং প্রণীত ‘দিল্লী’, খুব আপত্তিকর মনে হয়েছিল বর্ণনাভঙ্গির সরসতা সত্ত্বেও, ট্রিটমেন্ট ছিল আমার দৃষ্টিতে ত্রুটিবহুল। ফিকশনে, তা হোক উপন্যাসে বা চলচ্চিত্রে, এই মানুষগুলো হয় সম্ভোগ চরিতার্থ করার আইটেম হয়ে হাজির হয়, কিংবা আসে কীটপতঙ্গের ন্যায় ল্যাবগ্যাবে করুণাকামী ঈশ্বরের এক্সপেরিমেন্ট হয়ে। একটা উপন্যাস মনে পড়ছে, ‘ব্রহ্মভার্গবপুরাণ’, উজ্জ্বল ব্যতিক্রম যেটি, রিটেন বাই কমল চক্রবর্তী। সিনেমায় বিস্ময়করভাবে একটা আলাদা বিশ্বের জন্ম দিয়ে গেছেন এই ভোগমত্ত বলিউড-হলিউড হুড়োহুড়ির দুনিয়ায় ঋতুপর্ণ ঘোষ। অবাক হয়ে ভাবি আমি, ঋতুপর্ণ না-জন্মালে এই বিশেষ ব্যাপারটা ল্যাবিরিন্থ মনে করে রেখে দিতাম চিন্তার আড়ালে, পাশ কাটায়ে যেতাম এই প্রসঙ্গ হয়তো, সংবেদন দিয়ে এইটা ভাবার বদলে হয়তো এনজিওমার্কা বুঝদারি স্লোগ্যান জপে সটকে পড়তাম সেমিনার সেরে। ঋতুপর্ণের বিশেষত দুইটা সিনেমা যথা ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ দেখার পর থেকে আমি রোজ ভাবছি এই ব্যাপারটা নিয়া আমার নিজের একটা বুঝসমুজ সবার সঙ্গে ভাগ করা দরকার, সিনেমাদ্বয় এবং ঋতুপর্ণের সমস্ত কাজকর্ম টেক্সট হিশেবে সামনে রেখে আমার নিজের একটা বোঝাপড়া ও ঋতুপ্রণাম। সহসা হয়তো পেরে উঠব না, কিন্তু রোজকার কাজের মাঝে কান্নাধারার দোলার মতো এই নিয়া একটা লেখা বানাবার অস্থিরতা আমায় তাড়িয়ে বেড়ায়। যা-কিছু দেখছি, যা-কিছু শুনছি, যা-কিছু অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে হররোজ, সবকিছু ভাষা দিয়া আরেকবার বানায়া যাইতে মন চায়, পেন্নাম ঠুকে যেতে চায় হৃদয় সবকিছুরে একবার। মুরদ অল্প, অথচ সাধ সীমাহীন। মুশকিল। — জাহেদ আহমদ ২০১৩


বিচিত্র গদ্যের গানপার 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you