শহুরে ছাদে জীবন ভেঙে পড়ে, আজম খানের গলার খাঁজে || ইমরান ফিরদাউস

শহুরে ছাদে জীবন ভেঙে পড়ে, আজম খানের গলার খাঁজে || ইমরান ফিরদাউস

আজম খানের জীবনে কিছু পাবো না রে  গানটি ১৯৭৩-৭৪ সালে রেকর্ড করা। আজম খান ততদিনে পয়লা রেকর্ডেই সুপারহিট। বড়ভাই আলম খানের তদারকিতে ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’ ও ‘হাইকোর্টের মাজারে’ পাব্লিশ হয়ে গেছে ১৯৭২-এ। ১৯৭৩-এ সাপ্তাহিক বিচিত্রা কভার স্টোরি ছাপতেছে নুরা পাগলা এবং আজম খানকে হেডলাইন করে, বাই-লাইনে লিখতেছে ‘সংগীতে আধ্যাত্মিক প্রেরণা’। মারেফতি আছর যে ছিল তা সত্য দেখা যাচ্ছে ‘জীবনে কিছু পাবো না’ গীতেও।

এই গানের কথা ও সুর লেখা করেন গুরু ও তার বান্ধব ইশতিয়াক হোসেন একত্রে। মাত্র স্বাধীন বাংলাদেশের জমিনে খাড়ায়া হেঁড়ে গলায় রগড় করতেছেন, এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুঁড়ে, দাঁত-মুখ খিঁচে গাইতেছেন ‘জীবনে কিছু পাবো না … ভুলিনি সেই ভাবনা’!! ধরে নেন, নতুন দিনের শুরুতেই গুরু বুইঝা গেছেন যে, এই দিন হাতবদল হয়ে গেছে, স্বপ্নের ঘোরে পাশ ফেরার তালে। তাতে কী! স্বপ্ন তো আর মিথ্যা হইতে পারে না। ভুলে কেমনে যাবে নতুন দিনের ভাবনা, যা তিলে তিলে দানাদার ক্রিস্টালের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল স্টেনগানের ট্রিগার-টানা নিশানায়।

ড্রামসে ইদু, সাথে আরেক গিটারে নিলু, লিড গিটারে ইশতিয়াক হোসেনকে নিয়ে আজম খানের কথায় ও ইশতিয়াক হোসনের সুরে নির্মিত হয় এ-অঞ্চলের পয়লা দিকের অ্যাসিড-রক ঘরানার গান ‘জীবনে কিছু পাবো না রে’। পপ রিদম, অ্যাসিড রকের ডিস্টর্টেড ফাজি গমগমে বেইজ আর হার্ডরকের রিফ মিলিয়ে দারুণ অনবদ্য অথচ রাগী, স্বপ্নভঙ্গে বিক্ষুব্ধ এক গীতল পরিবেশনা হাজির করেন আজম খান।

থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের বারুদের গন্ধ দিয়ে কবিতা লেখা, বিপদনাশিনী মায়ের ছেলে কে.এন. ইসলামের ঝঙ্কার আর বাঙলার কৃষকফৌজের শহরে আইসা চাষা গালি খাওনের অপমানের জেদের বলকানো আবেগের আশ্চর্য কৌশল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই গানের গায়ে-গতরে।

‘জীবনে কিছু পাবো না রে’ শুধু রক মিউজিককেই ধারণ করেনি বরং স্থানীয় সময়, হালচাল এবং নাগরিক বিবমিষা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়তায় নিশান হয়ে পতপত করে উড়তে থাকে — বেহুদা খবরদারি করা সিস্টেমের মোলায়েম মাদারচোতদের চোপার সামনে।

গুরু আজম খানের এই দেমাগ কিন্তু পাকিস্তান আমল থেকেই অলোয়েজ চার্জিং মুডে থাকে। ‘ক্রান্তি’ শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান গায়া বেড়াইছেন জেলায় জেলায়, পুলিশের দাবড়ানি খাইছেন যখন-তখন। কিন্তু, পেট্রোল ঢেলে আগুন নেভানোর সংকল্প থেকে একপাও টলেননি কখনো।

উন্নয়নের দোজখে বাস করা অমানবিক জীবনের অধিকারীদের কাছে এই গান এখনো হইতে পারে একমাত্র পলিটিক্যাল অ্যান্থেম। মানুষের পরাজয় তথা গুম-খুন-ধর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জাতীয় সংগীত। সুবিধাবাদী দালালদের দৌড়ানির উপরে রাখনের মন্ত্র।

জয় গুরু! আজম খান!!!
সেলাম।

 

জীবনে কিছু পাবো না রে
কথা ও সুর : আজম খান ও ইশতিয়াক হোসেন

জীবনে কিছু পাবো না রে
ভুলিনি সেই ভাবনা

ফিরে এসো মোর কাছে
বলো আমারই থাকবে
আর কোনোদিন ফিরে যাবে না

চলে যেতে চাও অজানায়
একা যেও না
ভেবেশুনে করো কাজ
করে ভেবো না

না না ভেবে দেখো
একা একা যেও না
চলে যেতে চাও অজানায় …

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you