জেনারেলের জীবন ও কবিতা

জেনারেলের জীবন ও কবিতা

কবিতা লিখতে বসলেই নাকি মামলার কথা মনে পড়ে এইচ এম এরশাদের। তবু উনি বাঙালি জাতির দিকে তাকিয়ে, সম্প্রতি একটা বসন্তের কবিতা যে লিখতে পেরেছেন অন্তত, সেটা কম সৌভাগ্যের নয় আমাদের জন্যে।

খুব জটিল ধরনের একটা মামলা মাথায় নিয়ে কাব্যচর্চা, কম কথা না।

উনি ফেসবুকে এসে যদি কবিতা স্ট্যাটাস দিতেন, কত না আনন্দ হতো আমাদের। আমরা লাইক করতে পারতাম। কমেন্টও নিশ্চই। শেয়ার তো বটেই।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সংক্ষেপে লেজেহুমু এরশাদ, বহুগুণে গুণান্বিতা সাইজের লোক। কবি, মিউজিশিয়্যান, লিরিসিস্ট, লেফটেনেন্ট জেনারেল এবং সর্বোপরি প্রেসিডেন্ট। অন্যান্য অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক পরিচয় রয়েছে উনার। মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, এন্ডলেস আইডেন্টিটির ধারক ও বাহক উনি, রঙিন রূপবান, সঙ্গিন-উঁচানো সৈন্যসিপাই, হিউ হেফনারের চেয়েও বড় ইন্ডাস্ট্রির প্লেবয়, পরপ্রাণহন্তারক, পরস্বলুণ্ঠক, পরস্ত্রীকিডন্যাপার, ডেমোক্রেসিকিলার, খরিদযোগ্য পোলিটিশিয়্যান, উল্টিপাল্টিবাজ, আঁটকুরা, কাম সারিয়া সটকে পড়ার গোসাঁই, পিরের হিরাপান্নাখনি, জিন্দেগিভর থাইল্যান্ডে-যেয়ে-ম্যাস্যাজ-নেয়া চামড়াকুঞ্চন-লুকানো নওজোয়ান, ভেষজে-অঙ্গ-উত্থানো প্রশ্নবিদ্ধ মর্দ, গল্ফকোর্সের হোয়াইট-হাফপ্যান্ট-পরিয়া-ঘুরে-বেড়ানো রোমিওমুখো প্রভৃতি পৃথক কিছু পরিচয়ে তিনি বিখ্যাতি লভেছেন সিন্স হিজ পিক ডেইজ। অন্তত উনারে এইভাবেই পোর্টে করা হয়ে এসেছে আমাদের সামনে। তবে এই সমস্তকিছুর পরেও, অবাক ব্যাপার, কবি পরিচয়টাও উনি আঁকড়াইয়া ধরিয়া রাখতে চেয়েছেন সবসময়। হেন কবি-অভীপ্সা লালন করবার পেছনে হেতু কি, এত পাওয়ার্ফ্যুল একটা মানুষ কবিও হইতে চাইবে কেন, খোঁজতালাশ করে দেখতে পারলে মন্দ হয় না। এইভাবে, বিশেষত কবিভাবে, পরিচিত হয়ে উঠতে চাইবার পিছনে যে-একটা কাঙালপনা, এইটা দারুণ ইন্ট্রেস্টিং লাগে আমার কাছে। যেমন কৌতুককর অর্থে ইন্ট্রেস্টিং, তেমনি সিরিয়াস অর্থে।

এমনিতে দেখবেন যে সমাজে কবি পরিচয়্টার ভ্যালু বিশেষ নাই, শিক্ষাদীক্ষা কাউরে তো বলে না যে কবি হও, কিছুকাল আগেও তবু কবিজীবনী রিডিং দিবার একটা তাগিদ সীমিত পরিসরে হইলেও অভিভাবকরা তাদের সন্তানদিগেরে দিতেন, অধুনা তা-ও তো দেখি না। কবি পরিচয়টা আদৌ সমাজের পাতে দেবার মতো কোনো পরিচয়ই নয়। সমাজ কবিকে গ্রাহ্য মনে করে না। হাসি-তামাশা-ঠাট্টা-ইয়ার্কি ইত্যাদি নানানকিছুই করে, কিন্তু কবিকে সেইভাবে গ্রাহ্য করে না; ‘প্রধান কবি’ হইলে অবশ্য অন্য গণিত, অন্য অঙ্ক। সমাজে এক-আধজন প্রধান কবির দরকার সর্বদা হাজির। প্রধান কবিকে সমাজ তার নিজের কাজে লাগাইতে পারে, নিজের মঞ্চে তুলিয়া মাইক্রোফোনে মর্সিয়া মাতম করাইতে পারে নিজের পক্ষে, এবং প্রধান কবি যথাসাধ্য সমাজেরে সমঝিয়া চলেন।

সচরাচর কবিকে সমাজ সহজে নিজের মাপমতো-দরোজা-দিয়া বানানো ঘরে ঢুকাইতে পারে না। অ্যাট-লিস্ট আগে পারত না। ঠাকুরঘরে ঢুকে পুরোতের যোগসাজশে কলা-পায়েস খেয়ে বেরিয়ে পুরোতকীর্তি-ঠাকুরকীর্তি কিচ্ছু বাদ রাখে না ফাঁসাইতে, এমনই বেখাপ্পা এই কবি মালটা। তাই বোধহয় প্লেটো প্রমুখ দুনিয়া-বানানেওয়ালারা তাদের দুনিয়া থেকে কবিকে দূর-দূর তাড়িয়ে রেখেছেন, যদিও প্রধান কবি হিশেবে প্লেটো মশাই নিজেরে রেখে দিয়েছেন উচ্চাসনে — এইটা আজকের যে-কোনো কবিই প্রমাণ করে দিতে পারেন। যা-ই-হোক, এরশাদের আমলে সেইভাবে কেউ প্রধান কবি স্বীকৃতি জুটাইতে পারেন নাই লক্ষ করা যাবে। এরশাদ নিজেই হয়তো ওই পদাভিষিক্ত করে রেখেছিলেন নিজেরে। এবং প্রধান কবি বনিবার রাস্তায় ভিত্তিশর্ত পূরণ করেছিলেন তিনি, এইটা আমরা তো দেখেইছি, দেখি নাই কি? পূরণকৃত শর্তটি হচ্ছে, একটা স্তাবকবৃত্ত গঠন ও শক্তপোক্তকরণ, এরশাদ বাংলার ও বিহারের ও উড়িষ্যার ও বিউটি বোর্ডিং ও ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের মশহুর অনেক কবির স্তুতিঋদ্ধ সঙ্গ ও সঙ্গম লভিয়াছেন, পার্চেজ করেছেন অনেক অভিনেতানেত্রী শিল্পীচিত্রীকলাকারুকুশলী নায়িকাগায়িকাবাদিকাবাদক গজলঠুম্রিনজরুলগীতিপার্ফোর্মার। এরশাদ এই কায়দায় নিজের কবি-শিল্পানুরক্তাক্ত পরিচয়টাকে পরিপুষ্টি যুগিয়েছেন, যুগিয়ে এসেছেন, সবসময়। দেশের-বিদেশের কবিদের নিয়ে সভা করেছেন, সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন লটবহর নিয়ে, বিটিভিতে পথকলিগীত সম্প্রচার হয়েছে তার নামে। এইসব দেখেছি শৈশবে।

টেড হিউজ এসেছিলেন একবার এরশাদের কবিতার দাওয়াত খাইতে। খেয়ে গিয়েছিলেন, কবিতা লিখেছিলেন রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে, সুন্দরবন ও নৌভ্রমণের ছবি ছাপা হয়েছিল তখনকার বাংলা দৈনিকের পয়লা পাতায়। টেড হিউজ অবশ্য প্লাথ-আত্মহননের অভিযোগ  স্কন্ধে নিয়া তখনকার কবিসমাজে একটু মুখচোরা হাঁটাহাঁটি করছিলেন। যদিও অনেক পরে, বেশ ডাঙ্গর হয়ে, অ্যানিম্যাল পোয়েট হিশেবে টেডের সিদ্ধি বুঝতে পারব, গুণকীর্তন শুরু করব আমরা তার কবিতার জীবজন্তুরাজ্যের। পড়ব টেডের কাক সিরিজ, ইত্যাদি। কিন্তু তখন পর্যন্ত টেডকে স্রেফ ব্রিটেনরাজসভার একজন লরিয়েট পোয়েট হিশেবেই জানতাম। তো, বলা যায়, এরশাদ বাংলাকবিতার সুন্দরবন ও  খালনালানদী দিয়া আন্তর্জাতিকতা আমন্ত্রণপূর্বক জিয়াফত আয়োজন করিয়াছেন ও মেজবান হিশেবে মশহুর তারিফ জুটিয়েছেন। মহান এরশাদ, নিজে হয়তো কবি হইতে যায়া কাউয়া হয়েছেন, তবে তারে দোহন করতে পেরেছেন কতিপয় প্যুওর-গাই পোয়েট, এইটা একটা রিজয়েসিং ব্যাপার হয়েছে যা-হোক ইতিহাসে। পয়সা কে যোগাইলো, গৌরি সেন বা রাজস্ব, হোয়াটেভার।

উনি নিজে নিশ্চয় চান নাই, কিন্তু উনার আমলে কয়েকটা ব্যাপার ঘটেছিল যা সত্যি সত্যি মহান। বস্তুত উনার বানরবৃত্তির কারণেই কিন্তু পুরো সময়টা আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল, মহান হয়ে উঠেছিল, বললে বেশি বলা হয় না। বানরের লেজের দিকটা, মানে লেজে আগুন লাগিয়ে বানর তাড়ানোর সময়টা, আমি পিচ্চি ছিলাম যদিও, মনে করতে পারি ক্লিয়ারলি। একইসঙ্গে ভালো ও খারাপ দুই ঘটনাই ঘটেছে এই সময়ে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে। একদিকে মোহন স্লোগ্যানের বান বইয়ে দিয়েছিলেন একদঙ্গল কবি, অন্যদিকে এহেন কবিতাকে-স্লোগ্যান-বানানো দুষ্কর্মপ্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় একদল তরুণ কবিতাকে ফের কবিতার দিকে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কবিতা নিয়া নানান ধান্দামান্দামূলক পরিষদ, উল্টা পরিষদ, পাল্টা পরিষদ, মিছিল, ডেমন্সট্রেশন, সভা-সমাবেশ, আবৃত্তিবিপ্লব ইত্যাদির ফলে একটা ভালো সময় এসেছিল তখনকার লিটলম্যাগ ম্যুভমেন্টের ক্ষেত্রে। অ্যান্টি-এস্টাব্লিশমেন্ট বিষয়ক গলা তখন উঁচুতে। বেশ ভালো কর্মকাণ্ড হয়েছে তখন। গলাবাজি কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেছিল, যদিও, অস্বাভাবিক নয়। অ্যানিওয়ে। এরশাদের সময়ে, বলা হয়ে থাকে, একজন-দুইজন নয় একপাল আমলা ও অন্যান্য দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থশ্রেণির কর্মবাহক বাপে-পুতে মিলে সচিবালয় থেকে উপজেলা কমপ্লেক্স জুড়ে ধুমিয়ে কবিতা লিখে চলেছিলেন। সত্যি-মিথ্যা জানি না, তবে এই নিয়া নানান কথাবার্তা চালু গত দুই-তিন দশক জুড়ে। এখনও সম্ভবত এরশাদের এই প্রকল্পের আদলটি ব্যবহৃত হয়ে চলেছে সচিব-করণিক কবিদের ভিতরে, এবং এর সাক্সেসরেইটও খুব হাই, যেই হারে ম্যাজিস্ট্রেট-ইউএনও-সচিব প্রভৃতি বিভিন্ন পদায়িত কবিদের রমরমা আমরা বাজারে দেখি তাতে এরশাদের ডিজাইনকৃত প্রোজেক্টের প্রশংসা করতেই হয়।

এরশাদ ফেনোমেনার ফলে বাংলাদেশের কবিতাশিল্প বহুবিধভাবে উপকৃত হয়েছে। এরশাদের ডেব্যু কবিতাবই ভীষণ এক্সপেন্সিভ কাগজে ছাপা হয়েছিল। বইটার নাম ভুলে গেছি। তখন ইশকুলের ছোট কেলাশে পড়তাম, বইনাম ভুলে গেলেও বইয়ের সুরত মনে পড়ে এখনো। সহসা আমাদের ছোটচাচা, আমরা তারে কাকা ডাকি, একখানা দারুণ সুন্দর বই নিয়া রাত্তিরে বাড়ি ফেরেন। বইখানা আসামাত্র বাড়ির পরিবেশ অত্যন্ত মুখর হয়ে ওঠে। এবং কাকা তখন স্বতঃপ্রণোদিত প্রোমো প্রচার করেন তাৎক্ষণিক। বলেন, বইখানা কবিতার, দেশের প্রেসিডেন্ট লিখেছেন এই বই, এই বই ছাপা হয়েছে টাকশাল থেকে স্পেশাল কাগজ মেশিনে ঢুকিয়ে। এর কিছুদিনের মধ্যে এই বইখানা আমাদের ইশকুলের স্যারেদের হাতেও দেখতে পাই। তারাও কেউ পড়ে শোনান নাই একটাও কবিতা, সকলের মুখে মুখে কেবল টাকশাল আর কাগজের তারিফ। বলাবলি হচ্ছিল, বইটা নাকি পাঁচশ টাকা ছাপা হয় যেই কাগজে, সেই একই কাগজে ছাপানো হয়েছে। দেশের প্রেসিডেন্টের বই বলিয়া কথা! বাপ রে বাপ! বলা বাহুল্য, তখনকার বাংলাদেশে সর্বোচ্চ কাগুজে মুদ্রামান ছিল ওই পাঁচশ টাকার নোট।

অনেক পরে, কিন্তু খুব বেশিদিন পরে নয়, এক আশি-দশকী ইঞ্জিনিয়ার কবির প্রথম কবিতাবই ছাপা হয় অলমোস্ট একই কাগজে, একই এক্সপেন্সিভ-এলিগ্যান্ট কায়দায়। তখন আমরা হাইস্কুলে মাঝামাঝি। সেই কবিও, অচিরে জানতে পারি, সরকার বাহাদুরের ঘরের চাকুরে। এই কবি অবশ্য কবিতা ভালো লেখেন, জেন্যুইন কবিই বলা যায়, কিন্তু পয়লা বইয়ের দেহবল্লরী দেখিয়া তারে এরশাদ বলিয়া ভ্রম হয়েছিল বৈকি। কিন্তু ততদিনে আমরা কবিতা খাইতে শুরু করে দিয়েছি। কবিতাখাদক হয়ে গেলে যা হয়, এমনকি এরশাদও কবিতা ভালো রান্না করতে পারলে ঠিকই পাতে তোলা যায় এবং জিভেও রোচানো যায়। এরশাদ কবিতা রান্না আদৌ করতে পেরেছেন কি না, সেই জিজ্ঞাসা আপাতত সরিয়ে রাখছি। কিন্তু এলিয়টের সঙ্গে এরশাদের নামগত ধ্বনিদ্যোতনায় মিল দেখতে পেয়ে শেষদিককার স্কুলক্লাসে আমরা আমোদিত হয়েছি। টিএস এলিয়ট এবং এইচএম এরশাদ। তবে এখন মনে হয় সেই দিন আর নাই যে এলিয়ট ও এরশাদের কবিতাকেন্দ্রী মিল-বেমিল দেখিয়ে কেউ মুনাজেরায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হবেন, কেননা রাজক্ষমতা গিয়াছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। কে আর মাগ্না মাদারগাছের গোড়ায় ইরিগেইট করতে যায়?

কিন্তু কবিপরিচয় লভিবারে এরশাদের এমনধারা কাঙালপনা কেন, এই প্রশ্নের তো সুরাহা আভি বাকি হ্যায়। এইটা এমন এক সওয়াল, এর জওয়াব অনুসন্ধানে নামলে একটা দার্শনিক অভিসন্দর্ভ হয়ে উঠবে শেষমেশ অনুসন্ধানলব্ধ ফলাফল। কবি হইবার কাঙালপনা বাঙালি মাত্রেই বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথের আমলে ব্যাপারটা প্রকাশিত হইত নগ্নভাবে, তখন লোকে অতটা স্মার্ট ছিল না বলেই, কিংবা তখন ক্যালানে ক্যাবলাকান্ত হইয়া থাকাটাই ছিল স্মার্টনেস। হয়তো। বর্তমানকালে এইটা প্রকাশিত হয় একটু কমপ্লিকেইটেড ওয়েতে। এখন যতই আপনি গোপন রাখেন না কেন কবিখায়েশ, গোপনতার ভিতর দিয়াই ব্যাপারটা দিবালোকে ওপেন হয়ে পড়ে। দেখা যাবে কবিকে নিয়া হাসি-তামাশা ইত্যাদি জনসমাজে বিরাজ করছে, ফেসবুকে বেতালা ট্রল ইত্যাদি, কিংবা কবিকে তার সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক কাজেকর্মে ঠকানো ও কোণঠাসা করিয়া রাখা বা রিকগ্নিশন না দেয়া এইগুলো প্রত্যক্ষ লক্ষণ এক্ষেত্রে। এইসব ঘটে কেন, খোঁজ করা যাইতে পারে একটু গুছিয়ে বসে। একটা কারণ চটজলদি ভাবা যাইতে পারে এভাবে যে, কবি-না-হইতে-পারা লোকজন কবিকে এনভি/ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখছে। এইটা আনুমানিক বলা হইল। কবি জিনিশটা কি, কে কবি, এর একটা উত্তর জানতে পারলে ব্যাপারটা খানিক সহজ হয় ভাবতে। শবদে শবদে বিবাহ সংঘটনকারী ইত্যাদি মধুসংজ্ঞা বাদ রেখে যদি এইভাবে ভাবি যে, পার্ফেকশনিস্ট মাত্রেই ইন-অ্যা-সেন্স কবি। পার্ফেকশন মানেই সুন্দর/সৌন্দর্য। সুন্দর নিয়া কারবার যার, তারেই তো লোকে কবি বলবে। এখন ধরেন বীভৎস তৈয়ার করলেন আপনি, সেইটাও যদি ইফেক্টিভলি করতে পারেন, তবেই আপনি কবিধর্ম পালন করলেন বলা যাবে। মারণবোমা বানাইলেন, মনে করা যাক, অথবা নারকীয় শব্দদূষণের খেলনা ভুবুজেলা, কামের বেলায় দেখা গেল ফুট্টুশ, তাইলেই আপনি কবি হইতে পারলেন না। গাবর লোকজন ছাড়া, গদাইলস্কর গোবরগণেশ ছাড়া, যার যার কাজের ক্ষেত্রে সে সে কবি এবং অন্য সকলের ঈর্ষাপাত্র। কবিতা খালি লিখলেই কবি, ফিল্ম বানাইলে বা পাটের জেনেটিক্স নিয়া ভালো উদ্ভাবন করলে সে কবি নয়, এমন ধ্যানজ্ঞান থেকে বেরোনো দরকার তো! সুতরাং কবি সে-ই, —  যে নিজের কাজটাকে একটা আল্টিমেইট উচ্চতায় নিয়া যাইতে চেষ্টা করে এবং পারে। এখন সমাজে গাবর আর গোবরগণেশের শতকরা হার বের করা নিয়া জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রোজেক্ট ডিজাইন করতে পারে।

এমন না যে এরশাদ কোনো-এককালে প্রেসিডেন্ট ছিলেন বলেই শুধু পোয়েট হিশেবে লোকে তারে মেনে নিতে পারছে না। দুনিয়ায় ক্ষমতাকাঠামোর কেন্দ্রে থেকে শাসনকারী বহু লোক কবি হইতে পেরেছেন, শক্তিশালী সর্বসাধারণেরও স্বীকৃতি পেয়েছেন, এমন নজির ঢের রয়েছে। অ্যামেরিকার ওয়াশিংটন-লিঙ্কন, অথবা আরেকদিকে লেনিন বা মাও জে দং, চে গেবারা বা এইদিককার এম.কে গাঁধি কিংবা নেহরু প্রমুখের রাষ্ট্র পরিচালনার পাশাপাশি তাদের লেখাকর্মের সঙ্গেও তো পরিচিত আমরা। আমলেও তো নিয়া থাকি সেইসব। এরা তো হলেন রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় থেকে লেখক। অন্যদিকে লেখালেখি ক্যারিয়ারে সফল হয়ে রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া-চালনায় নিযুক্ত হওয়া লেখকও রয়েছেন তো অনেক, যেমন রয়েছেন ব্যুরোক্র্যাটদের মধ্যেও সফলকাম কবি-লেখক। অক্টাভিয়ো পাজ বা সাঁ জ্যঁ প্যার্স বা হিমেনেথ প্রমুখ কবিরা তো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ববাহক হয়েও উন্নত কবিতা রাখিয়া যাইতে পেরেছেন জগতের দরবারে। নেরুদার কথা ভাবা যেতে পারে। এরশাদের কবিযশলোলুপ সত্তা কেন ও কোন দোষে কল্কে পাইল না সংসারে, এ বড় আক্ষেপের ও একইসঙ্গে গভীর চিন্তার ব্যাপারও বটে। এইটা নিয়া ভাবনাচিন্তা আমলা কবিদের মহাকালিক সাস্টেইনিবিলিটির ব্যাপারটাও অ্যাড্রেস করতে পারে।

এরশাদ মামলাক্লান্ত, ফলে লেখা তার ব্যাঘাতপ্রাপ্ত ইত্যাদি বায়নাক্কা নিয়া ভাবা যাক একটু। দুনিয়ায় এমন কবি কি একজনও বিছড়াইয়া বাইর করা যাবে যিনি মামলাবিহীন মাকাল ফল? কবি যত বেশি মামলাব্যস্ত হইবেন, কবিতা ততই হবে ইঙ্গিতঘন ও বহুতলীয়। জীবন্ত কবিতা মানেই বিচিত্র মামলার সুষম সন্নিবেশ। কবিরা আবহমান কাল হইতেই জেল-জুলুম সয়েছেন, প্রথার ও প্রশাসনের পীড়ন ও অন্য নানাবিধ বাধার শিকার হয়েছেন, কবিতা তাতে হয়েছে অধিকতর গুণ ও ব্যঞ্জনাসম্পন্ন। শুধু এরশাদের বেলায় কেন অন্যথা হবে, এইটা মাথায় ঢোকে না। কাজেই এরশাদের কবিতাকাজ থেকে একটু চয়ন করা দরকার উনার ক্ষেত্রে কেন এমন হচ্ছে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে। সেইটা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না টেক্নিক্যাল কতিপয় ডিফিকাল্টির কারণে। এক হইল যে, একটা শব্দই তার কাব্যে এপার-ওপার জুড়িয়া বিরাজ করতে দেখা যায়, এর বাইরে দোসরা কোনো শব্দ বিশেষ চোখে আমার অন্তত পড়ল না, লাঙ্গল আর লাঙ্গল আর লাঙ্গল। অসুবিধার কিছুই ছিল না, কারণ শব্দের পুনরাবৃত্তি দিয়াও কবি মুক্তারাজ্য গড়িয়া তুলতে পারেন বলেই তো দেখি আমরা। মামলা প্যাঁচ খাইলে খেয়েছে অন্য জায়গায়। এই লাঙ্গল শব্দটা এরশাদে কেবল লাঙ্গল শব্দরূপেই রহিয়া যায়, এর কোনো চিত্ররূপায়ন ঘটতে দেখা যায় না আর। লাঙ্গলের কোনো মন্তাজও অ্যাবসেন্ট এই প্রয়োগে। এমনকি শিশ্নপরায়ণ হিশেবে খ্যাতকীর্ত এরশাদের লাঙ্গল প্রতীকটা যদি তার কাব্যে একটাবারও কমন ওইদিকের কোনো ইশারা যোগাইত, তবু মানিয়া নেওয়া যাইত। বঙ্গীয় চিন্তার অন্যতমা আদি ভগিনী সংস্কৃতে তো প্রতীকটা তা-ই। কিন্তু এরশাদে এই জিনিশটা কেন ও কীভাবে-যে মিসিং হইল, পরিতাপের ব্যাপার।

এরশাদের কবিতাবই তো দেশের মার্কেটে সুলভ নয়, ইদানীংকার রকমারি ডট কম প্রভৃতি সার্ভিসপ্রোভাইডারদের দ্বারস্থ হই নাই অবশ্য। আমি নিশ্চিত না সেখানে পাওয়া যাবে কি না। কী মনে করে যেন গ্যুগল সার্চইঞ্জিনে যেয়ে জাতীয় পার্টির অফিশিয়্যাল ওয়েবসাইট লিখিয়া পাত্তা লাগাইলাম। লাঙ্গুলে পতাকা আর লাল-সবুজ পতাকা দুইপাশে পতপত উড়াইবার পরপরই শুরু হয়েছে এরশাদের লাগাতার কবিতাসম্ভার। মনোরম ব্যাপার। কোনো পোলিটিক্যাল পার্টির অফিশিয়্যাল ওয়েবপেইজে এহেন অবলোকন অভিজ্ঞতায় এই প্রথম। হোয়াটেভার। সেখানে যেয়ে যে-কেউ কবিতানুরাগী পড়ে দেখতে পারেন এরশাদকবিতা।

আফটার অল্ একজন কবি, বিঘোষিত অথবা স্বঘোষিত যেম্নেই হোক, তদুপরি মামলাজর্জর, বোধ করি অপরাপর কবিদের জন্যে ব্যাপারটা বিব্রতকর। তবে মুশকিল হলো, উনার যা আমলনামা, মানে ক্যারিয়ারের এসিআর, তাতে উনার মামলাদায়মুক্তির জন্য অপর কবিরা পাশে যেয়ে দাঁড়াইলে ব্যাপারটা হবে কবিতাহানিকর, কেননা কবিতার মর্মে তো ওই ‘ইতিহাসচেতনা’ আর ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’ ইত্যাদি ঝামেলা, তা মামলাভাগ্যবহ স্বঘোষিত কবি এরশাদ তো জানবার কথা না, জানলে এট্টু দিশা ঠিক রাখিয়া যাপিতেন জীবন ও কবিতা। আবার অন্যদিকে এই ‘ডাকের মামু’ পল্লিবন্ধুর কবিতার পক্ষে দাঁড়াইলে সেই কবির আম তো যাবেই, ছালাটাও রইবে না। মানে এরশাদপক্ষাবলম্বী কবির কবিতাকল্পনালতা খামোশ তো হইবেই, ইতিহাসও তো ছাড়িয়া কহিবে না। তা, ডন জিয়োভান্নি ওর্ফে ডন জুয়ান তো আর-যা-ই-হোক কবি ছিল না, তা সে হইতে চায়ও নাই, কিংবা চাইলেই কবি হইতে পারে কি না কেউ, কবি হওয়া ব্যাপারটা আদৌ সত্যি সত্যি ঘটে কি না কারো লাইফটাইমে, এইসব নিয়া আলাদা ভাবা যাইতে পারে। হেটেরোসেকশুয়্যালিটি নিশানবর্দার হওয়া খারাপ না হয়তো, তবে এর সঙ্গে পোয়েটিক ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল ট্যালেন্ট হইবার খায়েশ যুক্ত হইলে যে-একটা ফার্স ক্রিয়েট হয়, এহেন ভজকট অবস্থার ডাকনাম হুমু এরশাদ।

অবশ্য এরশাদের কবিখ্যাতি না-লভিবার পিছনে একটা ব্যাপার এখন মনে পড়ছে। এইটা কয়েক বছর আগে এরশাদের সর্বশেষ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও অধুনা এক্স স্পাউস বিদিশার অটোবায়োগ্র্যাফিক একটা বই পড়ে জেনেছিলাম। উনি, মানে এরশাদ, নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিশেবেই ভাবতে ভালোবাসেন আজও। পতনের পঁচিশ বছর পরেও উনার আশেপাশের লোকজন, যথা পার্টিপিপল অথবা খানসামা প্রভৃতি, ভুলক্রমে কেউ অন্য কিছু সম্বোধন করে না মিস্টার প্রেসিডেন্ট ছাড়া। তাতে প্রেসিডেন্ট (পতিত) কূপিত হন বেজায়। এমনকি বিদেশি ডেলিগেটদেরেও উনি অফার করেন তারে মিস্টার প্রেসিডেন্ট সম্বোধিতে। এইটা না-হইলে এদ্দিনে এরশাদ ডাকের-কবি হইলেও হইয়া উঠিতে পারিতেন। হয়তো উনারে দেশিরা ডাকত কবিসাহেব, বিদেশিরা মিস্টার পোয়েট।

তবু দুঃখ হয়, এরশাদের কবিতা নিয়া আলোচনা আজও সম্ভব হইয়া উঠল না, এমনকি যে-দেশে কাবিখা-কাবিটা(কাজের বিনিময়ে খাদ্য, কাজের বিনিময়ে টাকা) প্রকল্প হয়, যেইদেশে আবিখা (আলোচনার বিনিময়ে খানাপিনা) নামের কোনো প্রোজেক্ট জনসমক্ষে না-থাকিলেও খাওন-খোরপোষের বিনিময়ে কবিতালোচনা নাকি সচল শুনতে পাওয়া যায়, সেইদেশে পঞ্চবার্ষিক ইলেকশন-বিজনেসে ক্রোড়পতি এরশাদ কেন এইখাতে একটা ফান্ড ডিক্লেয়ার করছেন না, জানা যাচ্ছে না। কামরুল হাসান, দি  গ্রেইট পেইন্টার, নিজেকে যিনি পটুয়া বলতেন, একটা আলোচনা অবশ্য করেছিলেন। খুবই দুর্ধর্ষ ও দূরদর্শী কাব্যালোচনা সেইটা, এরশাদের সামগ্রিক জীবন ও কাব্যদর্শন সেই আলোচনায় অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠভাবে বিধৃত হয়েছে, এবং অবাক ব্যাপার যে, মাত্র একশব্দের সেই আলোচনা, তবু কী তীক্ষ্ণ তার ব্যাপ্তি! আলোচনাটা এ-ই : ‘বিশ্ববেহায়া’! লিখেছিলেন তিনি, “দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে”, এইটে একটা কাগজে-পেন্সিলে এঁকেছিলেন তিনি, এবং এরশাদবিরোধী এক প্রতিবাদমঞ্চে বসে, এবং সেইখানেই তিনি অসুস্থ বোধ করেন এবং তাকে ক্লিনিক্যালাইজড করা হয়, এইটা ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দকালীন ঘটনা। কামরুল হাসান ওই বছর ২ ফেব্রুয়ারি মৃতের জগতে চলে যান। এরশাদশাহির পতন ঘটে নভেম্বর বা ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে। এইসব অবশ্য কবিতালোচনায় তেমন জরুরি ইনফর্মেশন নয়।

ভেরি রিসেন্টলি একটা আলোচনা অবশ্য হয়েছে এরশাদকাব্যের বিভিন্ন দিকদিগন্তর নিয়া, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় হয়ে-যাওয়া সার্ক লিটারারি ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধনী অধিবেশনে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চাসীন আলোচক কর্তৃক প্রদত্ত সেই আলোচনার একটা প্রতিবেদন সমস্ত বং-ইং দৈনিক পত্রিকাগুলোতে এসেছে। বাংলা ভার্শনটা খুঁজিয়া পাই নাই। আলোচক আমাদের মহামান্য প্রাইম মিনিস্টার শেখ হাসিনা, যিনি নিজে একজন গদ্যকার ও কথাশিল্পী, বাজারে তারও বই রয়েছে, একজোড়া রচনাসমগ্র বেরিয়েছে বছর-দুয়েক আগে হাশেম খানের প্রচ্ছদে। আলোচনা-প্রতিবেদনটি বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর থেকে একাংশ সংযুক্ত করছি এইখানে :

Prime Minister Sheikh Hasina has spoken highly of the natural beauty of Bangladesh.

She said even a military dictator had tried his hand at poetry under the influence of nature’s beauty.

Speaking at the inaugural session of SAARC Literature Festival in Dhaka on Thursday, the Prime Minister said: “Bangladesh is a country of wonderful natural beauty. One devoid of poetical talent can be poet here; one without the talent of a writer can be a writer.”

“There is hardly anyone in this country who does not write a poem during one’s student life. The influence of nature is so strong that even a military dictator becomes a poet. He starts writing poems.”

Of the two military dictators in the country – General Ziaur Rahman and General HM Ershad – the latter has fame as a poet.

Ershad is now the Special Envoy of the Prime Minister.

[রিপোর্টের হেডলাইন ‘Hasina pokes fun at Ershad poems’, পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনটা প্রাপ্তির জন্য দ্রষ্টব্য এই লিঙ্ক : http://bdnews24.com/bangladesh/2014/02/27/hasina-pokes-fun-at-ershad-poems]

এইবার কিছু তথ্য তুলিয়া রাখা যাক এইখানে। এরশাদের পোলিটিক্যাল অ্যান্ড্ প্রেস্ সেক্রেটারি সুনীল শুভ রায়ের মুখবাহিত হইয়া জানা যায় যে, এগারো সংখ্যক কবিতাগ্রন্থ রয়েছে এই সাবেক স্বৈরক্রীড়নকের, যদিও ওগুলোর প্রাপ্তিস্থান জানা যায় নাই। বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ‘কনক প্রদীপ জ্বালো’, ‘কারাগারের নিঃসঙ্গ দিনগুলো’, ‘জীবন ও সন্ধ্যাতারা’, ‘এক পৃথিবী আগামী দিনের জন্য’, ‘নবান্নে সুখের ঘ্রাণ’, ‘ইতিহাসের মাটির ঢেলা চিত্র’ প্রভৃতি। ১১ কবিতাবই একসঙ্গ-একত্র করে একটা ঢাউস গতরের কবিতাসমগ্রও রয়েছে তার, যেমন থাকে অপরাপর কবিদের।

[রচনাশীর্ষস্থ কোটেশন বা এপিগ্র্যাফটা ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে কবি মজনু শাহ-র ফেসবুকটাইমলাইন থেকে নেয়া। আর এই রচনাটাও তখনই লিখিত হয়েছিল, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে, ভুলে গেছি এমন কোনো-একটা কারণে এরশাদরে নিয়া ব্যাপক ট্রল হয়েছিল। অবশ্য এরশাদ নিয়া ট্রল করা বাংলাদেশের ইতিহাসে ফেসবুকযুগের আগে থেকেই চলছে গত তিন দশক ধরে।  — লেখক]

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you