মাসানোবু ফুকুওকা : এক তৃণখণ্ডের প্রতিরোধ || আহমদ মিনহাজ

মাসানোবু ফুকুওকা : এক তৃণখণ্ডের প্রতিরোধ || আহমদ মিনহাজ

শেয়ার করুন:

…ফসল ঘরে তুলতে বাহাদুর সাজার প্রয়োজন নেই। আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যেও না। সকল ভার প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দাও। সময় হলে দেখবে খেত ফসলে ভরে উঠেছে।

প্রকৃতির শরণাপন্ন হয়ে জমিতে ফসল ফলানোর পথিকৃৎ মাসানোবু ফুকুওকার কথাগুলো কবি মণীন্দ্র গুপ্তের সুবাদে পুনরায় স্মৃতিতে জেগে উঠল। মনোবেদনার ভার লাঘব করতে কবি তাঁকে স্মরণ করেছেন প্রীতি ও ভালোবাসায়। অক্ষয় মালবেরি-র রচয়িতা জীবনভোর চেয়েছেন, মানুষের প্রতি মানুষের মনোযোগ একটু কমুক; চারপাশে যা-কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তাদের দিকে বরং মনোযোগ আরেকটু বাড়ুক। মানুষের সঙ্গে অন্যরাও সমান জায়গা করে নিক সেখানে। কবির এই আকাঙ্ক্ষার পেছনে গাঢ় বেদনা রয়েছে। এমন এক আকালে আমাদের বসবাস যেখানে মানুষের ভিড় ঠেলে অন্য কিছু নজর করা কঠিন। মানুষ নামের দুপেয়ে জীবের ক্যারিকেচার দেখে দিন কাবার হয়। তাকে নিয়ে বকুনির তাণ্ডবে কান বধির হয়ে আসে। নারকীয় হট্টগোলে সয়লাব নগরে মানুষ ছাড়া বাদবাকিরা যেন অপ্রাসঙ্গিক! মণীন্দ্র গুপ্তের গদ্য ও কবিতায় আক্ষেপটি তীব্র বটে! কোনো এক নাগরিক সন্ধ্যায় তারা দেখবেন বলে কবি আকাশ পানে নিষ্পলক তাকিয়েছিলেন। অতিকায় ভালুকের মতো গুটলি পাকানো সপ্তর্ষিমণ্ডল, লেজ টানটান করে পা ছড়িয়ে বসা কুকর শাবক সাইরাস অথবা যে-তারাটি নিরলে মিটিমিট জ্বলছে তাকে দেখার তেষ্টায় প্রাণ ছটফট করছিল। আফসোস! আকাশে একটি তারাও কবি সেদিন দেখতে পাননি। মনে বড়ো খেদ জন্ম নিয়েছিল। কাগজে খসখস করে লিখেছিলেন :

পৃথিবীকে যারা ময়লা করে, ভেঙেচুরে বিকৃত করে, নিজের ভোগের জন্য অন্যের চেয়ে বেশি জিনিস নেয় তারাই বিধর্মী।…পয়গম্বর যখন বলেন, দুজনের খাদ্য তিনজনে খেতে পারে, তিনজনের খাদ্য চারজনে খেতে পারে, তখন আমি পয়গম্বরের চেলা। যিশু যখন বলেন, সঞ্চয় কোরো না, পাখিরা পরের দিনের জন্য কিছু জমায় না, অথচ দেখ, সদাপ্রভু তাদের অভুক্ত রাখেন না, তখন আমি যিশুর অনুগামী। মহম্মদ ও যিশু কথিত এই জীবনে যারা বিশ্বাস করে না তারা বিধর্মী।… মানুষ যে পরম প্রাণী, এই মিথ্যে কথাটা এবার ভোল। একজন মানুষ, একজন বাঘ, একজন ছাগল, একজন উচ্চিংড়ে—সবারই সমান অধিকার। নোয়ার নৌকায় সবাই জায়গা পেয়েছিল। গ্রন্থে ‘আব্রহ্মস্তম্ব’ কথাটা এক নিঃশ্বাসেই উচ্চারিত। ব্রহ্ম মানে ব্রহ্ম, আর স্তম্ব মানে ঘাস।

মানুষ তার কারসাজি অনেক দেখিয়েছে—পৃথিবীকে গর্ত করে তেল বার করেছে, গ্যাস বার করেছে, ধাতু বার করেছে, এখন বার করছে জল। নদীস্রোতে বাঁধ দিয়ে নদীকে শুকিয়ে দিয়েছে। ঘন মেঘে আচ্ছন্ন বৃষ্টিবনাঞ্চলে গাছ কেটে কেটে মেঘকে উড়িয়ে দিয়েছে। মাটির নিচে, মাটিতে এবং আকাশে তিন থাক শহর বানিয়েছে। হাউই চেপে চাঁদে গিয়ে সেখানে হেঁটেচলে দেখে এসেছে। মানুষ এখন দৈত্য বা জাদুকরের ভূমিকা নিয়েছে। সে আর মানুষ নেই।… সন্ধ্যা হয়। বসে আছি। আকাশে একটিও তারা দেখা যায় না। [দ্রষ্টব্য : সন্ধ্যা হয়। বসে আছি; গদ্যসংগ্রহ-২, মণীন্দ্র গুপ্ত]

কবির আক্ষেপ পাঠ করতে-করতে ভাবছি, চারপাশে যা-কিছু ছিল বা কায়ক্লেশে টিকে আছে, তার কোনোকিছু এখন আর সেভাবে দেখা হয়ে ওঠে না! ধূলিধূসর শহরে নিয়ম করে সূর্য ওঠে এবং ডোবে। সঙ্গে তাল দিয়ে হাঁটতে থাকা রাত্রিচাঁদ নির্ভুল নিয়মে শীর্ণ থেকে পূর্ণ ও পুনরায় শীর্ণ হয়। মেঘ সরে গেলে লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে আসা একলা তারাটি বাদবাকি তারাদের থেকে দূরে সাঁঝবাতির মতো জ্বলে। শিকারকে ঠোঁটে তুলে নিতে পুঞ্জ-পুঞ্জ মেঘের ভিতর ঢুকে পড়া চিল দক্ষ বায়ুসেনার মতো মাটিতে নেমে আসে। মসজিদের উঁচু গম্বুজে দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো কাক কা কা রবে নিজের অস্তিত্ব রাষ্ট্র করে প্রাণপণ। ব্যস্ত সড়কে পাঁচিলঘেরা ভবনের ছাদে মাঝেমধ্যে মহাকালের চেয়ে ধূসর বানরদলে চোখ আটকে যায়। খাবারের সন্ধানে ওরা লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে। পায়দল নয় শকটে চেপে শহরের প্রধান সড়ক পার হওয়ার মুহূর্তে দুপাশ জুড়ে ছড়ানো রেইনট্রির সারি হন্যে হয়ে খুঁজি। গাছগুলো মরহুমের তালিকায় উঠে গেছে! উন্নয়নের মাশুল দিতে সড়কটি মরুভূমি! সন্ধ্যা গাঢ় হলে রেইনট্রির গাঢ় সবুজ পাতাদের আপনা থেকে বুজে যেতে দেখেছি। অবেলায় তাদের ঘুমে ঢলে পড়ার দৃশ্য দেখে হাসি পেত খুব! গাছগুলোর বয়স্ক শাখায় রাত্রিচর প্যাঁচাকে এভাবে কতদিন দৈবজ্ঞ ওরাকলের মতো চোখ বুজে ঝিমুতে দেখেছি। এসবের কিছু আর বেঁচে নেই! নির্ঘুম সড়ক ন্যাড়া কৃপাণ হয়ে রাত জাগে। স্রোতের মতো যান ও জনতার সারি মানুষের কথা বলতে-বলতে তার ওপর বয়ে যায়!

কথাগুলো লিখতে-লিখতে মনে হলো মানুষের এখন নিজেকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবা কঠিন। কত হাঙ্গামাই না বেচারাকে সইতে হচ্ছে প্রতিদিন! বাজারে আগুন। দোকান-রেস্তোরাঁ-বিপণিবিতান থেকে শুরু করে ওয়াকওয়ে বা পার্কেও একদণ্ড দাঁড়াবার জো নেই। ভিখারিহাত নিমেষে ঘিরে ধরবে। বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন, ব্রিজের নিচের খুপড়ি আর ফুটপাতে ভিখারি, পাগল ও গাঁজাখোরের ভিড়। চোখেমুখে বুনো জিঘাংসা নিয়ে শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা টহল দিয়ে বেড়ায়। মশকবাহিনীর পরোয়া না করে ফুটপাত ও রেলস্টেশনে মড়ার মতো পড়ে থাকে। যে-মানুষগুলোর কারণে তারা ভিখারি ও পাগল তাদেরকে গলা টিপে খুন করতে পারলে বেশ হতো;—উদ্ভট ভাবনাটি মাঝেমধ্যে ঘাড়ে ভূত হয়ে নাচে।

সদাগরি অফিসের এক কেরানিকে নিয়ে অনেকদিন আগে একটি গল্প লিখেছিলাম। তোতা নামে তাকে চিনত সবাই। লোকটি সাদাসিধে। বিয়ে থা করে সংসারী হলেও ওপরে উঠার খিদের স্রোতে গা ভাসাতে নাচার। অপুট হাতে দু-এক ছত্র পদ্য লেখে মাঝেমধ্যে। বলার মতো কোনো গুণ নেই যে মানুষ তাকে পুছবে। তুচ্ছ লোকটি তার মতো দেখতে কিছু মানুষের ফন্দিফিকির সইতে না পেরে পাগল হয়ে গিয়েছিল। বাজার তখন আরেকবার ওপরে চড়েছে। মানুষ চোখেমুখে সর্ষে ফুল দেখছিল। সুন্দর এক সকালে তোতার বউ বাজারের থলে হাতে ধরিয়ে দিলে বোমার মতো ফেটে পড়েছিল সে। বউকে শুনিয়ে জীবনের প্রথম ও শেষ ভাষণটি দিয়েছিল ছড়ার ছন্দে। জীবনজটিলতার চাপে মাথার তার ছিড়ে যাওয়া তোতা আর কবি মণীন্দ্র গুপ্তের আকাশে তারা দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ, দুটো ঘটনার মধ্যে সাক্ষাৎ সংযোগ নেই, তবু কেন জানি পাগল তোতা ও সংক্ষুব্ধ কবিকে অবিচ্ছেদ্য ভাবতে ইচ্ছে করে। তারা দুজন পথ ভুলে এমন এক পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছেন যেখানে অন্ধ, বধির, ভিখারি ও পাগল হওয়া ছাড়া গতি নেই!

মানুষের হাতে গড়া সভ্যতা বড়োই আজব! কতিপয় মানুষের ফন্দিফিকির সইতে না পেরে তোতার মতো লোক সেখানে আচম্বিত উন্মাদ হয়ে যায়। কতিপয় নামে দাগানো লোকগুলো মনে হচ্ছে অন্যরকম। নামে মানুষ হলেও কামে সকলের থেকে আলাদা। সমাজে তাদের প্রভাব ও মহিমাকে গায়েবি ভাবতে লোকে যে-কারণে বাধ্য হয়। মানুষের ভেক ধরে সমাজে উঠবস করলেও তারা আসলে মানুষ নয়। পঞ্চইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় এরকম ইবলিস হলেও হতে পারে। ঈশ্বরের সঙ্গে টক্কর লড়তে সেয়ানা আদি ইবলিস আজ আর বেঁচে আছে কি-না জানি না, কিন্তু পঞ্চভূতে গড়া ইবলিস তার থেকে অনেক বেশি টেটন! এই ইবলিসের হাতে থাকে সংবিধান। কে কীভাবে চলবে তার সংবিধান। কারা কী দেখতে পারবে বা পারবে না, কে কী শুনবে ও শোনা বারণ, সেই সংবিধান। তাকে সহ্য করা কঠিন। উপেক্ষা সুকঠিন। মহামহিম ইবলিসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ কবি মনের খেদ জুড়াতে বুঝি মাসানোবু ফুকুওকার নামখানা সেদিন স্মরণ করেছিলেন। আকাশে তারার অনুপস্থিতির কারণ ভাবতে বসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছিলেন। সংক্ষুব্ধ কবি অগত্যা লিখেই ফেললেন :

…বুড়ো ফুকুওকা আমার মনের কথা বলেছেন। ঈশপের গল্পে আছে—একদা ব্যাঙেরা ঈশ্বরের কাছে একজন রাজা চাইলে তিনি একটি গাছের গুঁড়ি পাঠিয়ে দিলেন। ব্যাঙেরা নির্বাক গুঁড়িটিকে নিয়ে মজামস্করা করতে লাগল, এবং ঈশ্বরের কাছে আরেকটি রাজার মতো রাজা প্রার্থনা করল। এবার ঈশ্বর একটি সারস পাঠালেন। সারস চঞ্চুর আঘাতে ব্যাঙদের যমালয়ে পাঠাল।

 এই গল্পটা বলে ফুকুওকা জিজ্ঞেস করছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী করার জন্যে কী রকমের লোক বেছে নেওয়া উচিত?’…‘একটি নির্বাক গাছের গুঁড়ি’, নিজেই উত্তর দিচ্ছেন ফুকুওকা।…জাপানি হয়েও ফুকুওকা উন্নতির বিরুদ্ধে, সমৃদ্ধির বিপক্ষে। ‘আপনাকে উন্নতি করতে হবে কেন? আর্থিক সমৃদ্ধি যদি ৫% থেকে ১০% বাড়ে সুখও কি তবে দ্বিগুণ হবে? বৃদ্ধির হার 0% হলে ক্ষতি কি? [দ্রষ্টব্য : পরবাসী, কুড়ানী ও দারুমা সান; গদ্যসংগ্রহ-১, মণীন্দ্র গুপ্ত]

সমৃদ্ধি বাড়লে ভোগের বৈচিত্র্য ও সক্ষমতা দুটোই বাড়ে;—অর্থবিজ্ঞানে কথাটি চিরন্তন হলেও এতে করে সুখ বাড়ে সেই নিশ্চয়তা কোনো মনীষী আজো দিতে পারেননি। উল্টোটা বরং সত্য দেখছে সবাই। সমৃদ্ধির সঙ্গে তাল দিয়ে মাটির ওপর-নিচের সবকিছু নিকাশ হচ্ছে। বরাত জোরে যেগুলো টিকে গেছে তাদের সহজাত গুণ আর বজায় থাকেনি। মাটি ফুঁড়ে উদগত বৃক্ষ দূর অতীতে মাথা উঁচু করে নিজের অধিকার জাহির করত, উন্নতির সোপাণে আরোহনের দিন থেকে তাদের কপাল পুড়েছে। অভাব পুষিয়ে নিতে মাটিতে ক্ষতিকর দোআঁশলা বৃক্ষ জন্মানোর ধুম সর্বত্র। সবুজ বিপ্লব বলতে লোকে একেই বুঝে এখন! আটশো কোটি মানুষে গিজগিজ ধরণীতে খাদ্য ও বাসস্থানের বিপুল খিদে মিটাতে গিয়ে বনাঞ্চল একে-একে উধাও প্রায়! মানবদেহের চাহিদাও আর ন্যূনতম বা নির্দিষ্ট নেই। পণ্য ও উপযোগকে চরম মুনাফার শিকলে বাঁধার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। নিত্যনতুন উপযোগ তৈরির দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছেন মানুষের মতো দেখতে ইবলিস। চাহিদা, উপযোগ, উৎপাদন ও বিপণনের চতুর্মুখী চাপে ধরাশয়ী কয়েক লক্ষ প্রজাতি। আরো কয়েক লক্ষ ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে। সংখ্যাটি কোনোভাবে পূরণ হওয়ার নয়!

জংলী জীব-জানোয়ার, আকাশ ও ডাঙায় দেদার চরে বেড়ানো পাখপাখালি আর ধরায় জীবনের সূচনালগ্ন থেকে নদী-সমুদ্র-জলাশয়ে সাঁতার কাটতে অভ্যস্ত মাছের ঝাঁক মানুষের খাই খাই স্বভাবের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বিলোপ হলো বলে। বিলুপ্তি ঠেকাতে খামারভিত্তিক চাষাবাদের পত্তন ঘটিয়েছেন নামানুষ-এ পরিণত মহামহিম ইবলিসগণ। জ্বালানির বাড়বাড়ন্ত চাহিদা নিশ্চিত করতে মাটির তল খুঁড়ে তারা তুলে আনছেন তেল-গ্যাস ও রকমারি খনিজ। থাক-থাক মাটির বুকে জীবাশ্মে পরিণত খনিজের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে আকাশে কার্বন ও মিথেনের ঘন স্তর জমেছে। স্তরটি সহনীয় মাত্রার চেয়ে অধিক হওয়ার কারণে পরিবেশ ব্যবস্থায় বিপত্তি ধারণার চেয়ে দ্রুত গতিতে চরম হচ্ছে। গনগনে চুল্লি ওই দিবাকর, পৃথিবীর আলোয় পৃথিবীকে জোছনা বিলানো চাঁদ আর অগুন্তি নক্ষত্রঠাসা মহাকাশের সবটাই মসিবর্ণ কুয়াশাচাদরে ঢাকা। জল-মাটি-হাওয়া, নদী-মেঘ-পাখপাখালির কিছুই আর ঠিকঠাক দেখার উপায় নেই!

কিছুদিন আগে প্রয়াত পরিবেশবিজ্ঞানী জেমস লাভলক ধরিত্রীকে গ্রিক দেবী গাইয়ার উপমায় ভাবতে ভালোবাসতেন। তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনায় গাইয়া ছিলেন স্বমহিম দেবী। নিজ দেহের ক্ষত সারিয়ে তোলার দাওয়াই যার ভাণ্ডারে সদা মজুত থাকে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতা থেকে যে-কিতাবগুলো লাভলক লিখে গিয়েছেন সেগুলোর সারকথা একবার স্মরণ করা প্রয়োজন। লাভলকের প্রতিপাদ্যটি ছিল এরকম :

ধরিত্রী নিষ্ক্রিয়, নিরাসক্ত, নিরাবেগ অথবা অংশত সক্রিয় ধারণা নয়। তাকে সক্রিয়, সজাগ সত্তা হিসেবে মানুষের ভাবা উচিত। তিনি দেবী। প্রাণবাণ ভারসাম্যে নিজেকে স্বয়ংক্রিয় রেখেছেন। মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে তার যত ক্ষতি ও বিনষ্টি ঘটে সেগুলো ঠেকানোর ক্ষমতা তার রয়েছে। উচ্চমাত্রার বিকরণ ঘটাতে সক্ষম পারমাণবিক যুদ্ধে মানব প্রজাতি ভবিষ্যতে বিলীন হতে পারে কিন্তু দেবীর বিনাশ ঘটবে না। পরমাণু যুদ্ধের কারণে যে-ধ্বংসলীলা ও ক্ষতি সাধিত হবে সেটি সামলে ওঠা, নিজেকে মেরামত ও আগের অবস্থায় ফিরতে বছর দশেক সময় তার জন্য যথেষ্ট।

বিচিত্র রংয়ের বাহারে বর্ণিল দেবী সকল অবস্থায় ভারসাম্য বজায় রাখাকে আয়ুধ বলে মানেন। এই যেমন, বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ একুশ পর্যন্ত সহনীয়। বাইশ থেকে ছাব্বিশ ও তার অধিক হলে যখন-তখন দাবানল ঠেকানো যাবে না। সৃষ্টির আদি দিনগুলোয় কার্বনের সহনীয় চাদরে দেবী নিজেকে ঢেকে নিয়েছিলেন। উষ্ণতাটুকু ছাড়া প্রাণের বিকাশ সম্ভব ছিল না। সুতরাং দেবীর গর্ভ থেকে বেরিয়ে যে-মানুষ এখন তাকে লুণ্ঠন করছে, তার গায়ে অজস্র ক্ষত ও পুঁজ সৃষ্টি করে চলেছে, এই মানুষকে পুনরায় নিজের গর্ভে গিলে নেওয়া ও সেখানে বন্দি থাকতে বাধ্য করা তার জন্য কঠিন নয়। দেবীর দেহ থেকে ক্ষত ও পুঁজ একদিন মুছে যাবে কিন্তু তার গর্ভে অবরুদ্ধ মানুষ অনুপম এই সুন্দরকে দেখার সুযোগ পাবে না!

লাভলক সারকথায় যেদিকে ইঙ্গিত করেছেন তার খেই ধরে বলতে হয়, কুয়াশা যত ঘন হচ্ছে সারল্যে পৌঁছানোর রাস্তা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে। মাসানোবু ফুকুওকার প্রবাদপ্রতিম উপলব্ধির কাছে পৌঁছানোর পথ সরু হচ্ছে দিন-দিন। একটি তুচ্ছ তৃণখণ্ডে সকলের জন্য পরম কল্যাণ ও বিপ্লব তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। আধুনিক কৃষিবিদ্যার মারণবিষ প্রতিরোধের উপায় খুঁজতে তৃণখণ্ড ছিল তাঁর শেষ ভরসা। দ্য ওয়ান স্ট্র রেভোলিউশন-এ (The One Straw Revolution) মানুষ তাকে বলতে শুনেছিল, সমাজে যারা নেতার আসনে বসে রয়েছেন, সকল ব্যাপারে তাদের নাক গলানো বরদাস্ত করা সত্যি কঠিন। নেতা হিসেবে তাদের ভূমিকা অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন। তারা ততটুকু সক্রিয় থাকলেই চলবে যতটুকু না হলে নয়। অন্যথায় মতলববাজ মাতবরে পৃথিবী ছেয়ে যাবে। চাহিদাকে সহনীয় পরিসীমায় আটকে রাখা সম্ভব হবে না। চাহিদা যদি নিরন্তর বাড়তে থাকে তাহলে পৃথিবীকে বিচিত্র উপায়ে ভক্ষণের প্রথা যেসব লোকের দোহাই দিয়ে অমোঘ করা হয়েছে, অর্থাৎ ভোগলিপ্সু হতে বাধ্য এই মানুষগুলোকে মতলববাজ মাতবরের দল আজদাহার মতো গিলে খাবে!


গায়ে মানে না আপনি মোড়লের ভূমিকায় কিছু লোক সমাজে রাজত্ব করছে, তাদের উৎপাত থেকে রেহাই পেতে আধুনিক কৃষিবিজ্ঞানে দীক্ষিত মাসানোবু ফুকুওকা সব ছেড়েছুড়ে পরমা প্রকৃতির কোলে ফিরেছিলেন। পশ্চিমের শেখানো বাড়তি ফলনশীল কৃষিবিজ্ঞানে তাঁর সন্দেহ ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল। আধুনিক কৃষিবিদ্যার হাতে সৃষ্ট খেত-খামার ছেড়ে তিনি ফেরত গেলেন চাষাবাদহীন সভ্যতায়। আবাদি না হয়ে অনাবাদি থাকার পথ ধরলেন এইবেলা। অধুনা বিজ্ঞানের একটি শাখা যেমন এই অভিমত রাখছেন, মানুষের কারণে বিলুপ্ত বনাঞ্চল বা জলাশয়কে ফিরিয়ে আনতে হলে পরমা প্রকৃতির বুকে বন ও জলাশয় কীভাবে সৃষ্টি হয় সেটি বোঝা প্রয়োজন। সংবেদি মন নিয়ে পর্যবেক্ষণ ছাড়া কাজটি সম্ভব নয়। প্রকৃতি কীভাবে নিজেকে সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে সেটি অনুসরণের ক্ষণে নিজেকে সবজান্তা ভাবার খাসলত মানুষকে ছাড়তে হবে। রামকৃষ্ণ পরমহংসের মতো দাসভাব-এ আত্মস্থ থাকা এক্ষেত্রে শ্রেয়তর। মানুষকে অনেকটা তাঁর মতো করে ভাবতে হবে…

হে মা পরমা প্রকৃতি, আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী। তোমাকে নিজের বিদ্যা দিয়ে বাজাই, তার সাধ্য নাই। এবে থেকে মনের সকল অহং ঘুচে গিয়েছে। নয়নভরে দেখছি কীভাবে তুমি বনে সুর তুলছ। কোন বীণার গুণে বিচিত্র প্রাণের লহরি বয়ে চলেছে ঘনবৃক্ষে ছাওয়া বনবীথিকায়।

প্রকৃতির থেকে বিদ্যা ধার করার প্রতি পদে বিনয়ভাব-এ আনত থাকা জরুরি। তৃণখণ্ডে বিপ্লবের বীজ দেখতে পাওয়ার সৃষ্টিশীল ক্ষমতায় গরিয়ান ফুকুওকা এই বিনয় ও দাসভাবকে সঙ্গী করে নিজের জন্মস্থান এহিমেতে (Ehime) নতুন করে চাষাবাদ শুরু করেছিলেন। তাঁর প্রাকৃতিক কৃষিপদ্ধতির কবিসুলভ মনোজ্ঞ বিবরণ মণীন্দ্র গুপ্ত নিজের লেখায় দিয়েছেন। জেন (Zen) মতবাদে উৎকীর্ণ জীবনবেদের অনুসারী সন্ত কৃষকের কিতাব, প্রকৃতিনির্ভর চাষাবাদের কাহিনি নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র ও কথালাপ, তাঁর কৃষিরাজ্য সফর করতে আসা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার সবটাই এখন অন্তর্জালে সুলভ। আগ্রহীজন ইচ্ছে করলে সেখানে ঘুরান দিয়ে আসতে পারেন।

প্রকৃতিনির্ভর চাষাবাদের মূলমন্ত্র হচ্ছে পরমা প্রকৃতির দেহে সক্রিয় আন্তঃসম্পর্ক উপলব্ধির পাশাপাশি নিজ থেকে কিছু করতে না যাওয়া। ফুকুওকা যাকে ডু-নাথিং ফার্মিং (Do-Nothing Farming) নামে চিহ্নিত করেছিলেন। দ্য ওয়ান-স্ট্র রেভোলিউশন নামে অনূদিত কিতাবে চাষাবাদের অভিনব তরিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া ও এ-ব্যাপারে বিচিত্র অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন। কিতাবটিকে আধুনিক কৃষিবিদ্যায় দীক্ষিত একজন মানুষের উপলব্ধি, বীক্ষণ, ভাবনার জগতে পালাবদল ও গভীর আত্মদর্শন হিসেবে পাঠ করা উচিত। চাষাবাদের নামে নিজে ওস্তাদি না খাটানো হচ্ছে এর সারকথা। নিচে তার কিছু নমুনা দাখিল করছি। প্রাকৃতিক চাষাবাদের কতিপয় বেদবাক্য যেন-বা সকলকে মনে রাখতে বলছেন মাসানোবু ফুকুওকা :

ফসলি জমিতে লাঙল-ট্রাক্টর ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কোদাল দিয়ে মাটিকে খানিক ওলোট-পালোট করে বীজ ছিটিয়ে দাও। মাটি চষার বাকি কাজ কেঁচো করবে। সময় হলে বৃষ্টিতে নরোম হয়ে আসা মাটি ফুঁড়ে দানাদার শস্যের অঙ্কুরোদ্গম প্রকৃতির আপন নিয়মে ঘটবে সেখানে।

রাসায়নিক সার ব্যবহার করা যাবে না। খড়, লতাপাতা ও গোবর পচে তৈরি জৈবসার মাটিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান নিশ্চিত করবে। মাটিতে খড় পচানোর প্রাকৃতিক নিয়ম ও যথাযথ সময়ের হিসাব রাখা কৃষকের একমাত্র কাজ। খড় পোড়ানো বিড়ম্বনা ডেকে আনতে পারে। শস্যবীজ ছিটানোর মওসুম ঘনিয়ে আসার ছয় মাস আগে খড় পচানো শুরু করলে মাটি প্রাকৃতিক নিয়মে সরস হয়ে উঠবে।

আগাছা পরিষ্কারে নেমে তাকে জড়সু্দ্ধ উপড়ে আনা বারণ। ছেটে দিতে পারো কিন্তু শেকড়শুদ্ধ তুলতে যেও না। প্রাকৃতিক নিয়মে ফসল ফলানো একটি সামগ্রিক ঘটনা আর সেখানে আগাছার গুরুত্ব রয়েছে। জড়শুদ্ধ আগাছা নিধনে সেটি ব্যাহত হয় আর ভালো ফসলের সম্ভাবনা মাঠেই মারা যায়।

পোকামাকড় নিধনে কীটনাশক ছিটানো হারাম। প্রকৃতির নিয়মে বাড়ন্ত শস্যখেতে প্রচুর উপকারী পোকামাকড়ের সমাবেশ ঘটে থাকে, যারা অন্যদিকে ক্ষতিকর পোকামাকড়কে সাবাড় করে। কীটনাশকের ব্যবহারে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ক্ষতিকর পোকামাকড় মারতে যেয়ে উপকারী কীটপতঙ্গ দলেবলে সাবাড় হয় তখন।

সেইসব উদ্ভিদ ও গাছগাছালি সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞান থাকা আবশ্যক যারা পরাগায়ণ থেকে শুরু করে শস্যখেত রক্ষায় ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখে। ওইসব গাছগাছালির ক্ষতি করা যাবে না।

বৃষ্টির মওসুমে জমিতে বাঁধ দিয়ে সাময়িক সময়ের জন্য জল সঞ্চয় করা যেতে পারে। সময় হলে জমানো জল জমিতে ছেড়ে দিতে হবে।

ফসল তোলার পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতির নির্বিচার প্রয়োগে লাগাম টানতে হবে। আদিবাসীরা যেভাবে ফসল ঘরে তুলে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।

মোদ্দা কথা ফসলে ভরভরন্ত খেতের প্রধান শর্ত হচ্ছে পরমা প্রকৃতির বুকে অণুজীব থেকে শুরু করে যা-কিছু সক্রিয় সেগুলোকে পাখির চোখে নিরিখ করা ও সেই অনুসারে চাষাবাদে মন লাগানো। ডু-নাথিং ফার্মিং-র ওটা হচ্ছে মূলমন্ত্র। নিজের কিতাবে ফুকুওকা লিখেছেন :

আমি উল্টা পথ ধরেছিলাম। চাষাবাদের তোফা, সহজাত উপায়কে নিশান করেছি, আমার কাজকে যেটি কঠিন না করে সহজ করবে। ‘এইটা না করলে কী হয়? ওইটা যদি না করি তাহলে কেমন হয়?’—আমার ভাবনা ওরকম ছিল। অবেশেষে আমি এই মতে উপনীত হই,—লাঙ্গল দিয়ে মাটি চষা, সার ছিটানো, জৈবসার তৈরি, কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। আপনি যখন এই অবস্থায় পৌঁছে যাবেন তখন চাষাবাদের কাজে সত্যিই লাগবে এরকম সামান্য জিনিস পড়ে থাকে। [দ্রষ্টব্য : The One Straw Revolution by Masanobu Fukuoka, 1978; PDF Edition; ভাষান্তর : লেখককৃত]

প্রায় শতবর্ষী ফুকুওকা জীবদ্দশায় নিজের কৃষিপদ্ধতি নিয়ে দেশ-বিদেশে বিস্তর কথাবার্তা বলেছেন। জমি থেকে গোলায় ফসল তোলার প্রাকৃতিক রহস্য শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে বুঝিয়ে দিতে কৃপণতা করেননি। ফসল ঘরে তোলা, তার বণ্টন ও ব্যবহারকে জেনসুলভ জীবনের ছাঁচে গড়েপিটে নিয়েছিলেন। প্রযুক্তির ব্যবহারে ফুকুওকা ছিলেন সতর্ক ও হিসাবী। যতখানি নিলে প্রাকৃতিক চাষাবাদে বিপত্তি ঘটবে না ঠিক ততটুকু নিয়েছেন। জেন ভাবাদর্শে বাঁধাই কৃষি পদ্ধতিতে রাষ্ট্র বা সরকার বাহাদুরের বিশেষ করণীয় কিছু নেই। রকমারি পণ্যের অন্তহীন শৃঙ্খলে মানুষকে যারা আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে, বিপুল মুনাফার লোভে পরমা প্রকৃতির জৈবশৃঙ্খলাকে তছনছ করে বাড়তি শস্য উৎপাদনে যারা মরিয়া, যাদের শেখানো পদ্ধতির জোয়াল টানতে গিয়ে মানব প্রজাতি মালিক ও ক্রীতদাসে দুফাঁক হয়েছে, বুড্ডা ফুকুওকার গড়া কৃষিরাজ্যে এই লোকগুলো অচল মালের সমতুল। তাঁর কৃষিদর্শনের বিশ্বায়ন এনারা সংগত কারণে চাইবেন না। ফুকুওকার সেটি জানা ছিল বিধায় ঈশপের গল্পে বর্ণিত কাষ্ঠখণ্ডের উপমা টেনেছেন। সমাজ যদি নিজের উপকার চায় তাহলে লোকগুলোকে কাঠের গুঁড়ি করে রাখাই ভালো। সামাজিক চুক্তির দুর্বলতায় তারা যদি সারসে নিজেকে রূপান্তরিত করে সেক্ষেত্রে সমাজটি আর আস্ত থাকবে না, তাদের চঞ্চুর আঘাতে একে-একে সকলই সাবাড় হবে।


বিশ্ব জুড়ে আলোচিত হওয়া সত্ত্বেও মাসানোবু ফুকুওকার কৃষিভাবনা কেন ব্যাপকতা পায়নি তার একশো একটা কারণ রয়েছে। এটি ব্যাপকতা লাভ করলে জমি, বীজ, সার, গবাদি পশু ও কৃষি যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সমগ্র খামার ব্যবস্থা বোধ করি ধসে পড়ত! মালিক, কৃষিশ্রমিক, মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া আর ক্রেতা-বিক্রেতাকে নিয়ে সুগঠিত বাজার ও বিপণন বেকারার হতো তখন। পণ্যায়ন ও মুনাফাচক্রের স্বীকৃত ছক আজকের মতো খুশহাল থাকত বলে বিশ্বাস হয় না। সরকার বাহাদুরের ছায়ায় হাজারো আকাম সারতে তৎপর ইবলিস আর ওদিকে বিপুল জনতাসমাজের মধ্যে এসপার-ওসপার রফায় আসার প্রয়োজন অন্তিম হয়ে উঠত। সে যাই হোক, বাস্তবে ওসবের কোনোটাই ঘটেনি। বড়ো কারণটি সম্ভবত এখানে যে, মানবসমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে যত ছক কষা হয়েছে তার একটিও ফুকুওকার কৃষিদর্শনের সঙ্গে মানিয়ে চলার উপযুক্ত ছিল না।

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রগতির পুরোটাই মানবকেন্দ্রিক। ইউরোপ মহাদেশে সংঘটিত আলোকায়ন-র (Enlightenment) সুবাদে প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্ভরতা টলে উঠেছিল। আবিষ্কার ও উন্মোচনের নামে তাকে জয় করার বার্তা এর প্রতি অঙ্গে তখন ঠিকরে পড়ছে। প্রকৃতি নয় বরং মানুষের অসীম সম্ভাবনাকে আলোকায়ন-এ অবশ্যম্ভাবী করে তোলা হয়েছিল। প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা ও ব্যবহারের প্রশ্নে মার্টিন হাইডেগার আবিষ্কার (Discover) শব্দটিকে যথার্থ বলে মানতেন। তাঁর মতে নদীর ওপরে সেতু তৈরির জন্য যা-কিছু দরকারি তার সমস্তই প্রকৃতির মধ্যে লুকিয়ে ছিল। মানুষ যখন সেটি আবিষ্কার করল তখন থেকে নদীর ওপর সেতু তুলতে বাধা থাকল না। জানতে পারার ঘটনাকে যারপরনাই উদ্ভাবন (Invention) বলে জাহির করার চেয়ে আবিষ্কার ভাবাটাই যুক্তি সহনীয়। জ্ঞান ও আলোকায়ন-র মতো ঘটনা কেবল এই পথে সকল আধিপত্যবাদী ধারণার প্রকোপ থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম।

ইউরোপীয় সমাজে দেখা দেওয়া আলোকায়ন সেক্ষেত্রে বিপরীত পথে মোড় নিয়েছিল মানতে হয়। উদ্ভাবক-র (Inventor) তকমায় মানুষের সকল আবিষ্কারকে রঙিন করতে সে উতলা ছিল। প্রকৃতির বিচিত্র সম্ভাবনাকে আবিষ্কার ও তাকে মানুষের কাজে লাগানো, আর ওদিকে উদ্ভাবনের নামে তার খোলনলচে পাল্টে দেওয়া এক জিনিস নয়। দ্য কোয়েশ্চন কনসার্নিং টেকনোলজির (The Question Concerning Technology) বয়ানে প্রসঙ্গটির ওপর হাইডেগার আলো ফেলেছিলেন। ইউরোপ মহাদেশ তথা পশ্চিমবিশ্বে আলোকায়ন পুরোনো ধ্যান-ধারণা বাতিল করে জ্ঞানের নতুন তরঙ্গ নিয়ে হাজির হয়েছিল। হাইডেগার সেটি অস্বীকার করেছেন এমন নয় কিন্তু এর মানবকেন্দ্রিক কাঠামোয় ঘনীভূত ক্ষমতায়ন ও আধিপত্যবাদকে মেনে নিতে তাঁর মন সায় দেয়নি। সত্তার (Being) আবির্ভাব ও প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা লাভের ক্ষেত্রে এমতো বয়ানকে অন্তরায় বলেই মনে করছিলেন তিনি। আলোকায়ন সৃষ্ট বয়ানবিশ্বের গহিনে সক্রিয় ক্ষমতা ও আধিপত্যকে মিশেল ফুকোও একইভাবে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলেন। তাঁদের ব্যাখ্যা মোটের ওপর যৌক্তিক হলেও ইউরোপ বা সামগ্রিক অর্থে পশ্চিমের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এর পরোয়া করেছে বলে প্রত্যয় হয় না।

প্রকৃতিনির্ভরতাকে মানুষের অসীম সম্ভাবনার পথে অন্তরায় ও নিয়তিবাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ ভাবতে অভ্যস্ত চিন্তনকাঠামোকে কুর্নিশ ঠোকা মাসানোবু ফুকুওকার জন্য অবান্তর ছিল। তাঁর প্রকৃতিবীক্ষণ থেকে আহরিত ভাবনার সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। আলোকায়ন ও অনতি পরবর্তী জ্ঞানবিশ্ব প্রকৃতিকে যন্ত্র হিসেবে ভাবতে স্বস্তি বোধ করেছে। যন্ত্রটিকে কব্জা করার ফন্দিফিকিরে মানুষের বিজয় ও উৎকর্ষ নিহিত বলে মনে হয়েছে তার। ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক কালপর্ব জুড়ে বিস্তৃত জ্ঞানবিশ্ব যারপরনাই দেকার্তীয় পন্থায় প্রকৃতি নামক যন্ত্রের ব্যবচ্ছেদে নিজের সকল শক্তি ক্ষয় করছিল। সামগ্রিক/সর্বজনীন সত্তা রূপে একে গণ্য করার কথা ভুলেও ভাবেনি!

প্রকৃতিকে জটিল কলকব্জায় মোড়ানো ঘড়ি ভাবার প্রস্তাবনা নিঃসন্দেহে অভিনব ছিল। ঘড়ি বলে কিছুর বাস্তব অস্তিত্বকে যদিও পশ্চিমের জ্ঞানকেন্দ্র কখনো স্বীকার করেনি। পৃথক কলকব্জা একসঙ্গে জুড়ে যে-যন্ত্রটি গড়ে উঠেছে সেটি মানুষকে ঘড়ির ধারণা দিয়ে থাকে;—এই মতে অটল থাকার প্রবণতা সেখানে মজ্জাগত। ঘড়ি সদৃশ প্রকৃতি কীভাবে কাজ করে তার কিনারা করতে বিমূর্ত ধারণার পেছনে ছুটে ফায়দা নেই। প্রকৃতিতে সক্রিয় কলকব্জাগুলোকে বরং দ্রষ্টব্য করা উচিত। কলকব্জা কেমন করে তাকে সচল রাখছে সেটি বোঝা গেলে প্রকৃতিকে ঠাহর করার পথ সুগম হয়। প্রকৃতিদেহে বিন্যস্ত অংশগুলোকে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধির প্রশ্নে পশ্চিমের জ্ঞানকেন্দ্র যে-কারণে অধিক মাত্রায় বিজ্ঞাননির্ভর করেছে নিজেকে। দেকার্তীয় ঘড়িতত্ত্বে সে মোটের ওপর আজো স্থির বৈকি!

উক্ত পন্থা প্রকৃতির রহস্য মোচনে প্রযুক্ত হওয়ার ফলে পরমা প্রকৃতির মতো ভাববাদী ধারণার সারবত্তা পরখ করার ঠেকা পশ্চিমের জ্ঞানকেন্দ্র আমলে নেয়নি। একে উল্টো হোলিস্টিক (Holistic) ও ছদ্মজ্ঞানের পরিপোষক চিহ্নিত করার প্রথাটি সেখানে আজো বহমান। কেন বহমান তার হদিশ পেতে দ্য তাও অভ ফিজিক্স-র (The Tao of Physics) রচয়িতা ফ্রিটজফ কাপরার মাইন্ডওয়ার্ক কিতাবটি পাঠক হাতে নিতে পারেন। এর থেকে নির্মিত ছবিখানাও দেখা যেতে পারে। মাসানোবু ফুকুওকার প্রতিরোধ মূলত এখান থেকে গতি লাভ করেছিল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, প্রকৃতি নিছক ঘড়িতুল্য কিছু নয়। তার কলকব্জা সমগ্রের অংশ। নিজের কাজ প্রতিটি অঙ্গ নির্ভুল ছন্দে সমাধা করলেও তারা অবিচ্ছেদ্য। একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত। একটি অঙ্গকে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি করতে বসে অন্য অঙ্গগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যথায় আন্তঃসম্পর্কের চরিত্র পুরোদস্তুর বুঝে ওঠা কঠিন হয়। জমিতে ছিটানো বীজের সঙ্গে যেমন পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ক ধরতে না পারলে এর নিট লাভ-ক্ষতির কিছুই সম্যক ঠাহর হয় না।

ফুকুওকার জ্ঞান অর্জনের পন্থা ও একে কাজে লাগিয়ে মাঠে ফসল ফলানোর কাহিনি বরং ঈশ্বর সম্পর্কিত ভাবনার সঙ্গে খানিক মিলে যায়। ঈশ্বরকে সমগ্র সৃষ্টির সারাৎসার বিবেচনা করলে একরকম অনুভব হয়, সমগ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবলে অন্য অনুভব মনে জাগে। প্রথম অনুভবে তিনি ব্রহ্ম ও সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে সক্রিয়। দ্বিতীয় অনুভবে প্রায় মানবসুলভ পন্থায় সক্রিয়। দুটোকে যোগ করতে না পারলে ঈশ্বর সম্পর্কিত ধারণা পূর্ণতা পায় না। প্রকৃতি সেরকম। ফুকুওকা মনে করেন, মানুষ এই গূঢ় সত্য উপলব্ধিতে ব্যর্থ হয়েছে। সে ভাবে, প্রকৃতিকে আলাদা করে জানাবোঝার কিছু নেই। বিজ্ঞানের আতশকাচে তাকে ব্যাখ্যা করা কঠিন কিছু নয়। সমগ্র প্রকৃতি-র মতো বিমূর্ত ধারণার পেছনে না ছুটে তার এক-একটি অঙ্গ অর্থাৎ জটিল কলকব্জার ওপর বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের জ্ঞান থাকা বরং জরুরি গণ্য হওয়া উচিত। পণ্য উৎপাদন ও চাহিদা পূরণে যখন যেটি দরকার সেটি বের করে আনা এতে সহজ হবে। ফুকুওকার বয়ান আধুনিক জ্ঞানবিশ্বের এমতো ধারণার সঙ্গে প্রতিরোধমূলক। তাঁর কাছে পরমা প্রকৃতি বিস্ময়ের খনি। এর প্রতিটি অঙ্গের পৃথক ব্যবচ্ছেদ ও অনুসরণ খণ্ডিত জ্ঞানের জন্ম দিয়ে থাকে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। প্রকৃতি বা মানুষ কারোই এতে উপকার হয় না। অ্যানাটমিটি অচল ও অপ্রাসঙ্গিক। নিজের কিতাবে সন্ত কৃষক লিখেছেন :

যে-বস্তুটি সমগ্র থেকে পৃথক প্রতীয়মান হচ্ছে সেটি প্রকৃত বস্তু নয়।…বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান হাসিল করেছেন এমন লোকজন দল বেঁধে একটি ধানের ছড়াকে পর্যবেক্ষণ করেন। কীটপতঙ্গের মাধ্যমে ছড়ানো বালাইয়ের ব্যাপারে কীটবিশেষজ্ঞ কীটের পাল্লায় পড়ে কী কী ক্ষতি হয়েছে সেদিকে মনোনিবেশ করেন, উদ্ভিদের পুষ্টি বিষয়ক বিশেষজ্ঞের উদ্ভিদ কতটা কী সবল কেবল সেদিকপানেই নজর। বিষয়টি এখন অনিবার্য বটে। [দ্রষ্টব্য : The One Straw Revolution by Masanobu Fukuoka, 1978; PDF Edition; ভাষান্তর : লেখককৃত]

এরকম গুবলেটের পাল্লায় ফুকুওকার কৃষিদর্শন হোঁচট খাবে এটি স্বাভাবিক। সব জেনেবুঝে তিনি বিকল্প পথে মোড় নিয়েছিলেন। নতুন কৃষিদর্শনে নিজেকে পরখ করতে একে-একে সব ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। যুবা বয়সের অর্জিত বিদ্যা, মোটা বেতনের কৃষিবিদ হওয়ার প্রলোভন, ডাকাবুকো লোকজনের কাতারে শামিল হওয়ার হাতছানি, সব ছেড়েছুড়ে বন্ধুর পথকে সাথী করেছিলেন। মানুষ প্রকৃতির বিস্ময় নয়। শ্রেষ্ঠও নয়। পরমা প্রকৃতির জটিল শাখা-প্রশাখায় লটকে থাকা আশ্চর্য এক ফুল মাত্র! ততক্ষণ সুন্দর ও মনোহর যতক্ষণ পরমা প্রকৃতির মধ্যে ফুল হয়ে ঝুলতে থাকে। সেখান থেকে ঝরে পড়লে বিষধর সাপের চেয়ে ভয়ানক হয় সে। সন্ত ও শয়তান হওয়ার ক্ষমতা দিয়ে ঈশ্বর তাকে ধরায় পাঠিয়েছেন। উৎস থেকে বিস্মৃত হওয়ার কারণে যাকে এখন ডানাভাঙা পাখির মতো বিপন্ন দেখায়! নিজের অভিজ্ঞতা শোনাতে বসে ফুকুওকা কথাটি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন : Natural farming is gentle and easy and indicates a return to the source of farming. A single step away from the source can only lead one astray.

শতেক হট্টগোলে তাঁর বাণীর মাহাত্ম্য কানে প্রবেশ করার পথ আপাতত অবরুদ্ধ মানতে হচ্ছে। যেরকম খনার বচনের অমোঘ উপযোগিতা আধুনিক চাষাবাদের চাপে অদ্য ম্রিয়মান। তথাপি, ব্যতিক্রম প্রজ্ঞার নিশান হয়ে মাসানোবু ফুকুওকার কৃষিসভ্যতা আজো জাপানে টিকে আছে। যুদ্ধ-অতিমারি আর জলবায়ু পরিবর্তনের বিপুল চাপে দিশেহারা মানুষের পৃথিবীতে প্রতিরোধের স্মারক হয়ে আলো জ্বালছে অবিরাম। জাপান থেকে হাজার মাইল দূরে গায়ক কফিল আহমেদ যেমন তাঁর গানের কলিতে প্রতিরোধের অনলটি বহন করেছেন। নাভিশ্বাস চাপে মাথা নত না করার সবক মানুষকে মনে করিয়ে দিতে গেয়েছেন গলা খুলে :

পাখা ঝাপটায়ে পাখা ঝাপটায়ে
ডাকি লাল মোরগের ডাকটা!
মাথা নত না করা
মাথা নত না করা
মাথা নত না করা
মাসানোবো ফুকোওকা!

ফুকুওকা এখানেই বিজয়ী! বৈরী মানুষে ভরপুর বিশ্বে এমন এক সভ্যতা তিনি রেখে গিয়েছেন যেখানে প্রকৃতি তার নিজস্ব ছন্দে বহে। ঝর্না থেকে জল সংগ্রহ করে কৃষক। বিজ্ঞ প্রাচীনার মতো কেঁচোরা মাটি খুঁড়ে অবিরাম। বালাইনাশক পতঙ্গের ঝাঁক পাহারা দেয় ফসলের খেত। তাদের সংখ্যা এতটাই বেশি যে ক্ষতিকর পতঙ্গ টিকতে পারে না। পাখির কলরোল সেখানে নিত্য ঘটনা। ফুলে ছাওয়া টিলায় উড়ে ভ্রমর। সন্ধ্যা যথারীতি নির্জনতা সঙ্গে করে নামে। আকাশ পানে তাকাতে বাধা ও প্রতিবন্ধক নেই। কবি মণীন্দ্র গুপ্তকে সুখ দিতে কুকুরকুণ্ডলী হয়ে জ্বলজ্বল করে তারা। বয়সভারে জীর্ণ ফুকুওকা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আজো নামেন। তার সাদা দাড়ি প্রতিরোধের নিশান হয়ে বাতাসে উড়ে তখন!


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি 

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you