বাংলায় বৃষ্টির কবিতা তালাশ করা আর মুড়ির বস্তায় বালু খোঁজা পার্থক্যরহিত। উভয়েই, বাংলা কবিতা এবং বিন্নি ও অন্যান্য ধানের মুড়ি কিংবা খৈ, যথাক্রমে বৃষ্টি ও বালি দিয়া বাঁধা আজন্ম। কবিতায় মেঘদূতম্ মশহুর বিধায় সেইটা আলাপকিতাবের বাইরে রাখবেন দয়া করে। দেখেন খেয়াল করে কেবল লিরিক এবং লিরিকপ্রতিম মহাধুনিক কবিতাকাণ্ড। সয়লাব বৃষ্টিভিশনে। এবং উপভোগ্যও, বলা বাহুল্য, তবে একেবারে তা-থৈ তা-থৈ নির্ঝঞ্ঝাট না বোধহয়। ম্যাড়মেড়ে রেইনপোয়েট্রিই হাজারেবিজারে ছড়ায়া আছে বেঙ্গলি লিট্রেচার ব্যেপে। সেগুলি নিশ্চয় পড়ে উঠতে পারলে খারাপ লাগবে না। আদৌ সম্ভব নয় রেইনকান্ট্রির সমস্ত বর্ষাব্যঞ্জিত কবিতা পাঠকব্যক্তির একজীবনের বৈঠকে পড়ে ওঠা। কাজেই বৃষ্টির শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি কিংবা কোনগুলা তা তো বলা সাধ্যাতীত। তবে পাঠকের অভিজ্ঞতায় যেগুলা এসেছে সেগুলা থেকে ইমপ্রিন্টেড কয়েকটার উল্লেখ হয়তো করতে পারেন কেউ। উল্লেখযোগ্য বর্ষাকাব্যের একটা অ্যান্থোলোজি নিশ্চয় হতে পারে।
একটা আরও সহজ উপায়ে বৃষ্টিঋদ্ধ কবিতার বৈশিষ্ট্যবহ সংকলন প্রস্তুত করা যায় অবশ্য; তদুপায়ে প্রস্তুতকৃতব্য সংকলন অবধারিতভাবেই হবে সংক্ষিপ্ত, তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত তো বটেই। কীভাবে? এ-যাবৎ যত কবিতায় বৃষ্টি ভিশ্যুয়ালাইজ্ করা হয়েছে সেগুলো মোটামুটি নির্দিষ্ট কতিপয় ডিকশন ফলো করেছে। এক হচ্ছে প্রেমাস্পদের শারীরিক-মানসিক নানান মোটিফের সঙ্গে বৃষ্টি সিম্বোলাইজ্ করে লেখা কাব্য, মোটা দাগে, অন্যদিকে কবির স্বীয় মনোজাগতিক পরিস্থিতির বৃষ্টিচিত্রকল্পিত উপস্থাপন। তবে এই দুইয়ের বাইরেও অন্যান্য অনেক ভাবে-ভাবান্তরেও কবিতা আছে বৈকি বৃষ্টির, শুধুই বৃষ্টির গুণকীর্তন করেও কবিতা আছে, বর্ষাবন্দনা আছে এন্তার বাংলা কাব্যসাহিত্যে। সেসব বলা বাহুল্য। তবে এখানে একটা কথা হচ্ছে কি যে, এই-যে বর্ষাবন্দনা বা বৃষ্টিস্তুতিকাব্য, এর মধ্যেও কবিতাপাঠক মনুষ্যমুরতি খুঁজে বের করবে; এখন কবি যতই জোর গলায় বলুন যে এইটা নিসর্গপ্রকৃতিপীরিতির কবিতা, পাঠক শুনবে কেন? সবসময় পাঠক তার নিজের অভিজ্ঞতায় একটা পাঠবস্তু গ্রহণ করে পার্সোনিফিকেশন্ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এর ব্যত্যয় দেখা যায় অল্পই। রইল বাকি বিমূর্তায়িত কবিতা। পাঠতত্ত্বের দোহাই, এবং পাঠক সাক্ষী, বিমূর্তায়ন মাত্রই মূর্তায়িত হবার অপেক্ষায় থাকে। দুনিয়ার সমস্ত বিমূর্ত কবিতা বা আরও সমস্ত শিল্পরূপ মূর্ত হয়েই ভোক্তার পেটে প্রবেশ করে। এছাড়া আর-কোনো দরোজা-জানালা নাই বিমূর্ত রচন/গ্রথন গলাধঃকরণের।
অপেক্ষাকৃত সহজ একটা উপায়ে শ্রেষ্ঠ/অশ্রেষ্ঠ নবভাবিত বৃষ্টির কবিতা বাছা যায়। এক ধরনের রিঅরিয়েন্টেশন প্রক্রিয়ায় এডিটিং চালিয়ে বেছে নেয়া যায় বৃষ্টির নবধারাজলের কবিতা। প্রাচীন কবিদেরেও রিইন্ট্রোডিউস্ করা যায় এইভাবে। যেমন ধরা যাক রবীন্দ্রনাথ, বা আরও অগ্রজ তথা সাংস্কৃতিক কালিদাস, মোটামুটিভাবে এরা বাদলিবৃষ্টিমেঘরইদের কবিতা লিখেই দিবালোকে খ্যাত ও প্রশংসিত। রবীন্দ্রনাথ তো প্রকৃতির কোনো ঋতুই বাদ রাখেন নাই, কথা সত্যি, কিন্তু পরিচিতিটা সাধারণ্যে অন্তত তার বর্ষার গান-কবিতাগুলোর জন্যই। এদের বাইরে যারা অন্যতর পরিচয়ে চিহ্নিত, নজরুল-জীবনানন্দের কথা উদাহরণত ধরা যাক, উনাদের কবিতা বাছাইবুছাই করে রেইনপোয়েম্স বাই অমুক অথবা বাদলির কবিতা বাই তমুক শীর্ষক সংকলন হতে পারে। দেখা যাবে তখন যে হেমন্তশীতের কবি কিংবা আদিগন্ত অবসাদ তথা অন্তর্গত রক্তের বিস্ময়বিষাদের কবি জীবনানন্দও অন্যমাত্রিক বর্ষার কবিতা লিখেছেন; অনুরূপ নজরুলও বিদ্রোহী চিহ্নায়ন থেকে একটা আলগ ঘরানার কবিপরিচয়ে নবজন্ম লভিবেন। একই তরিকায় রাহমান থেকে শুরু করে হালের মাসুদ খান ব্রাত্য রাইসু পর্যন্ত খুঁজে দেখা যেতে পারে একেকটি পৃথকতর সংকলনযোগ্য কবিতার বৃষ্টিতোড়া।
পাওয়া যাবে না তা নয়, পাওয়া যাবে, শ্রেষ্ঠ/অশ্রেষ্ঠ বাটখারাটা কবিতাবাছাইয়ের ক্ষেত্রে কাজের কিছুই নয় মনে রেখে খোঁজাখুঁজি চালানো অভিপ্রেত। জোর দেয়া যায় স্বাভাবিকতা আর অভিনবতার দিকে। স্বাভাবিকতা আর অভিনবতা দুইটা দুই বিপরীত বৈশিষ্ট্য মনে হলেও বৈপরীত্য আদতে নেই এদের মাঝখানে। যা-কিছু স্বভাবোৎসারিত, অভিনব হবার চান্স তা-কিছুর মধ্যে হামেশা না-হলেও প্রায়শ হাজির থাকবার কথা। আর কবিতা ফাইন্যালি বৃষ্টির মতোই, বৃষ্টির মতোই নয়, বৃষ্টিই আসলে। কবিতা যখন ঝরে, মুষলধারাতেই ঝরে, ভেজায়ে দেয় ঘাটমাঠ-বেইসমেন্ট-প্রাণপ্রান্তর। বুকে আগুন নিয়েও যখন অঝোরে কবিতাপাত হয়, বিষণ্ণতা-আক্রোশ নিয়েও যখন কবিতাপাত হয়, তখনও মুষলধারেই অগ্নিবৃষ্টি-বিষাদবৃষ্টিই হয়, পাল্টিয়ে দিয়ে যায় নীপবন আবাসিক এলাকার সুখী-স্থিতিশীল গুহাজীবন্ত মনুষ্য সকলকে।
ভেজাবেই। ভিজতেই হবে। অ্যান্টি-রেইন্ কোনো ড্রাগ কিংবা রেইনরোধক শক্তিশালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইহলোকের বেশিরভাগ পাপীতাপীর হাতে এখনও সরবরাহ হয় নাই। বৃষ্টিতেই সর্দিজ্বর তাদের, বৃষ্টিতেই ইলাজ্। পণ্ডিত ও পির-পুরোইতদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা হিসাবের হলেও হতে পারে। প্যারালাইজড পণ্ডিতি বৃষ্টিসিজনে রেইনকোট বা বর্ষাতি ব্যতিরেকে একটু গঞ্জের/কম্যুনিটির হাটে/মার্কেটে বেরোলে থেরাপি ফ্রি লাভ করতে পারবার কথা। বৃষ্টিফোঁটা সাংঘাতিক রেডিয়োঅ্যাক্টিভ রশ্মির কাজ করে শরীরে। ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল ম্যুভমেন্ট ত্বরাত্বিত হয়।
—জাহেদ আহমদ ২০১৩
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS