টিপসই? সিগ্নেচার? মনে হয়। সিম্স টু বি। স্প্রিংটাইমেই সিগ্নেচার লভ্য ক্যুকো ও কবির। বই থেকে শুরু করে খই-বাতাসা বাণিজ্যেরও মরশুম বসন্ত। কোকিল ডাকুক বা খামোশ থাকুক, বসন্তে ফেব্রুয়ারি এসে জাগ্রত হয় দ্বারে, শোনা যায় তারস্বরে কবিদের কুহু। বইলিখনে-বইপড়নে দ্যায় মন বুড়ো খোকাখুকু। বসন্ত বটে এক উন্মাদনার ঋতু। অবশ্য প্রকৃতিস্থিত (প্রকৃতিস্থ/অপ্রকৃতিস্থ) অন্য-অন্য সমস্ত ঘরানার ক্রিয়েটিভদের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটানোর মতো। বসন্তে তারাও হন কমবেশি দোলায়িত। পদকর্তা বাউল শাহ আবদুল করিমের ক্ষেত্রে তো, বলা বাহুল্য, অত্যাবশ্য; তদ্রুপ রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের ক্ষেত্রেও। রবিন-করিম পরপর দুইটা বাক্যে এবং এথা হাইফেনে এনে বসানোটারে কেউ যদি ধৃষ্টতা ভাবেন তবে এই নিবন্ধ উনার খাদ্যতালিকায় অ্যাডযোগ্য নয়কো। কোনোকিছুই, কোনো রচনাই, নির্বিশেষ অডিয়েন্সের জন্য নয়। বিশেষের বেসাতি ব্যতিরেকে এই পৃথ্বীধামে কে কবে রচিয়াছে কিছু?
বসন্তবাতাসেই নিজের সইসাবুদ রেখে যান মহাজনেরা; তা অবশ্য অন্য বসন্ত, অন্য বাতাস, অন্য সইসাবুদ। দুনিয়াবি জমিজিরেতের দলিলে বা মাঠপর্চায় যে-সিগ্নেচার, যে-টিপছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট, সৃজনী টিপসই/সিগ্নেচার ঠিক তা না। সাক্ষরতা কার্যক্রমে যেয়ে এই সিগ্নেচার রপ্ত হয় না। আঙুলের বুড়িটিপে কালি মাখানোও জরুরি নয় এই টিপসই দিতে যেয়ে। এবং এই বসন্তও কবির/শিল্পীর মর্জিমহলের বসন্ত। ধুম বর্ষায় কিংবা ব্যাপক শীতেও কবির মর্জিস্প্রিং ধরাধামে ব্যাপ্ত হয়ে দেখা দিতে পারে, দেখা দেয়ও। ‘রোদনভরা বসন্ত’ পরিস্থিতিটা তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপকতর সত্য। ‘পোনামাছের ঝাঁক’ — বলতেন যেমন লালন সাঁইজি নিজের বান্ধা গান/পদগুলোকে — আশ মিটিয়ে ধরতে না-পারাজনিত রোদন। না-মিটিতে আশা, যায় ভেঙে খেলা।
ভাঙার আগে, বিভিন্ন পর্যায়ের বিরতিফোকরে, যে-বসন্তসম্ভার আমরা পাই তাদের সৃষ্টিবিচ্ছুরিত, তাতে দেড়-দুইমাসের মর্ত্যভৌগোলিক বসন্তঋতুর সঙ্গে এক্সট্রা ইউনিক্নেস্ যুক্ত হয় দেদার সুধামাধুর্যমণ্ডিত। যুক্ত করেন প্রত্যেকেই তারা পার্থিব বসন্তের সঙ্গে একটা একটা করে দিন, একটা একটা রাত্রি, একেকটা পালক ও পরাগ, ফলে বসন্ত হয়ে ওঠে অবারিত অগাধ। সই শুধু অঙ্গুলিপ্রিন্ট থাকে না আর, সই শব্দটা তাদের স্পন্সরিঙের কারণে ব্যাপ্তি বাড়ায় মিনিঙের, সই শব্দটা সামনে এনে দাঁড় করায় একে একে সমার্থ বৈচিত্র্যবর্ণাঢ্য শব্দগুচ্ছ — সখা, বন্ধু, দোসর, মিতে, প্রেয়, সখি … ইত্যাদি। স্ত্রীলিঙ্গার্থেই ‘সই’ শব্দটা চালু অত্র অঞ্চলে, এই ভাষায়, স্ট্যান্ডার্ড বাংলার মধ্যযুগে কবিসাহিত্যিকেরা করেছেন এর দেদার ব্যবহার। সখা নারী-পুরুষ উভয়েই হতে পারে, সই নির্দিষ্ট প্রয়োগে নারীই। শ্রীহট্ট অঞ্চলের, সিলেটের, লোকায়তিক পদকর্তারা তাদিগের গানে-কবিতায় এই টার্ম সম্বোধন পদ হিশেবে ব্যাপক ব্যবহার করেছেন। রাধারমণ-হাসন সকলেই ‘সই’ সম্বোধনে প্রেয় জনমনিষ্যিরে ডেকেছেন। করিমও। মনে পড়বেই রাধারমণ দত্ত — “জলে গিয়াছিলাম সই / কালা কাজলের পাখি দেইখ্যা আইলাম কই” … ইত্যাদি লিরিকে এই ল্যান্ড লতানো। সই। সিলেটে গ্রামীণ লোক্যাল ডায়লেক্টে, মেয়েমহলেই বিশেষত, ‘বৈনারি’ বলিয়া আরেকটা টার্ম আছে এক্ষেত্রে ব্যবহার্য। বৈনারি মানে বন্ধুতা। পুরুষমহলে এইটা হয়ে যায় ‘ইয়ারানা’। আগে হতো, সইয়ালা বা ইয়ারানা, আজকাল তো সর্বত্র সবকিছুই ফ্রেন্ডশিপ। রবিলিট্রেচারেও সই পাই কি? ইয়াব্বড় রবিরচনাবলি বিছড়াইয়া দেখবে কে! এমন ইয়াদ হয় যে রবিলিট্রেচারেও সই পেয়েছি। “চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরসুন্দর হে প্রিয়!” সই এবং বসন্ত সর্বদা বাতাসে স্প্রে করতে থাকে বেঁচে-থাকার প্রাণনা আর জীবনসুরভি। জীবন রঙিন হয় তিনশচৌষট্টি দিনের প্যাঁচপয়জার সত্ত্বেও বসন্তসংগীতে, বসন্তকবিতায়, বসন্তের সুরে ও সুরায়।
এসএ করিম উড়িয়েছিলেন একটা গান আমাদের এই বিবস্ত্র লোহালক্কড়ধস্ত অর্ধনগুরে নীলিমায়; — একটা নয়, ইনডিড, একের-পর-এক — এসএ করিমের সমস্ত সুরে ও কথায় এই উড়ান তথা ফ্লাইট লভ্য। হু’জ্ হাওয়েভার দিস্ এসএ করিম? বি লিবেরাল্, ড্যুড! শাহ আবদুল করিম। বহুদ্দিন আগে, ১৯১৬ সনে, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ধলআশ্রম গ্রামে জন্ম। পরে অবশ্য ঠাঁইনাড়া হয়ে এসে থিতু হন উজানধল গ্রামে। গান গাইতেন। সুর ভাঁজতেন। নিজের সুর। নিজের গান। কথা আর সুরে বেঁধে গেছেন গান শত শত। ছোটবেলায় মিস্টার এসএ করিমকে শো করতে দেখেছি সিলেট সিটিহার্টের স্ট্রিটসাইড শহিদমিনারলগ্ন মুক্ত-প্রতিবাদের মঞ্চে। এরশাদষণ্ডামির আমলে। সেই স্মৃতি ভিন্ন কোনো জন্মে ফের মন থেকে টেনে তোলা যাবে। এখন না, থাক এবেলা, গান গাই বরং। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে, ফ্যাকাশে এই নির্জ্যোৎস্না রাতে, এসএ করিমের একটা গান গাই ঝিঁঝিপোকার ন্যায় বিনবিনে গলায়। আজ সব গান ছেড়ে একখানি স্প্রিংস্যং গাই তার, সই গো, বসন্তবাতাসে …
বসন্তবাতাসে সই গো বসন্তবাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলবাগানে নানান বর্ণের ফুল
ফুলের গন্ধে মনানন্দে ভ্রমরা আকুল
বন্ধুর বাড়ি ফুলের টঙ্গি বাড়ির পূর্বধারে
সেথায় বসে বাজায় বাঁশি মন নিলো তার সুরে
মন নিলো তার বাঁশির গানে রূপে নিলো আঁখি
তাই তো পাগল আবদুল করিম আশায় চেয়ে থাকি
সই গো বসন্তবাতাসে … বসন্তবাতাসে …
বসন্তবাতাসে সই গো বসন্তবাতাসে …
ট্যাগোরের চেয়ে ছোট উনি, কবি হিশেবে, পঞ্চাশ বছরের ছোট। জুনিয়র; অত্যুক্তি হয় না চিরজুনিয়র বললেও। রবিট্যাগোর বা আরএন ট্যাগোর বোধহয় এসএ করিমের সিনিয়র। অবশ্যই সিনিয়র। পঞ্চাশ বছরের সিনিয়র। বয়োজ্যেষ্ঠ। আরএন ট্যাগোরের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপনের বছর-দুইয়ের মধ্যে এসএ করিমের জন্মশতবর্ষ। উদযাপনের প্রস্তুতিও হয়েছে বেশ, হয়েছে উদযাপিতও, করিম-জন্মশতবর্ষ, উনার জন্মজেলায় এবং তৎসংলগ্ন ঊনশাহরিক সিলেট এলাকায়। রাষ্ট্রীয়ভাবে, কিংবা বাংলাদেশ-ভারতীয় কোনো মৈত্রীট্রিটির আওতায়, এসএ করিমের জন্মোৎসব হলো না। হায়! ট্যাগোরজন্ম-সার্ধশত হয়েছিল উভয় রাষ্ট্রীয় উদযোগে একবছর টানা। আক্ষেপ করি না, তাছাড়া আমরা ট্যাগোর বা করিম কারোরই নামে চালানো কোনো ফ্যানক্লাবের মেম্বারও না; — না ট্যাগোরের, না করিমের — কারোরই লঙ্গরখানায় খিচুড়ি-হালুয়ার হিস্যা পাইতে লাইন বসাই নাই আমরা। আমাদের ধান্দা গান শোনা, তা যে-কোনো প্রকারেণ, বা তামশা দেখা। গানশোনা হামেশা না-হলেও পুষিয়ে যায় তামশা দেখে। এসএ করিমের সেঞ্চুরি সেলিব্রেশন উপলক্ষ্যে অ্যাট-লিস্ট দুই-তিনটা তামশা দেখা হয়েছে। — গানটান যা-কিছু শোনার তা বোধহয় জিন্দেগিতে এরই মধ্যে শোনা সারা হয়ে গেছে। এখন আর গান শোনার আশা করাই দুরাশা।
তা, এত হতাশ্বাসের কথা কেন প্রচার করছি জানতে চাইবেন না? কারণ, করিমের জন্মশতবর্ষ পটভূমিকায় একই শহরে — সিলেটে — দুটো অনুষ্ঠান হয়ে গেল সংলগ্ন। দু-দুটো অনুষ্ঠানে — একটা ১৫ ফেব্রু এবং অন্যটা ১৯ ফেব্রু — সুদূর-ভারত-হইতে-আগত শিল্পীরা পার্ফোর্ম করে গেলেন। খবর পাক্কা। প্রথমোক্ত অনুষ্ঠানে মৌসুমী ভৌমিক এবং দ্বিতীয়োক্ত অনুষ্ঠানে ‘দোহার’ ব্যান্ডের শিল্পীরা গাইলেন। মৌসুমী অবশ্য গাহেন নাই, কহেন; উনি গাইবেন না তা আগেভাগে বলেই এসেছিলেন শোনা গেল, ‘ট্যক’ দেবেন শুধু, ফোক্লোর এক্সপ্লোরিং আলাপ, যদিও অর্গ্যানাইজার তথা আয়োজনের অধিকারী মশাই রীতিমতো মঞ্চে একখানি সিনই ক্রিয়েট করলেন সুপরিসর প্রেক্ষাগারপূর্ণ দর্শক-সমবেতদিগের সামনে। ক্যাওস্ হলো একটা হাল্কাপাৎলা। আসনপিঁড়ি দর্শকেরা গানাগ্রহী, ন্যাচারালিই তারা আওয়াজ করছিল হট্টগোলে মৌসুমীর গান শোনার আব্দার জানিয়ে; ন্যাচারালি আওয়াজটা এক-সময় আয়োজক মশাইয়ের কানের পানে ব্লেইম আকারেই উড়িয়া যায় এবং সইতে না-পেরে আয়োজক ব্যক্তিটি বিলা হয়ে ওঠেন এবং উনার বিলা ভাবটা মাইক্রোফোনে আড়াল থাকে না। তাছাড়া দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটা সরকারি অর্থায়নে হয়েছিল বিধায় ধামাকা ব্যাপক এবং সেই ব্যাপকতার অভিঘাতে নেতিবাচকভাবেই পয়লা তরফের আয়োজক ঝাল ঝেড়েছিলেন জনসমক্ষে। এমনকি করিমচর্চার সঙ্গে ভুঁইফোঁড়দের উপদ্রব নিয়া আয়োজনাধিকারীর উষ্মা পাব্লিকলি উদাম হয়ে পড়ে। কেউ অবশ্য উল্টা জানতে চায় নাই উনার কাছে যে এহেন কথিত করিমচর্চার অথোরিটিটার হদিস পাওয়া যাবে কোথায় যেয়ে। এবং করিমের সুরের শুদ্ধতা, বাণীর শুদ্ধতা ইত্যাদি নিয়াও উনার ক্রোধান্বিত উদ্বেগ গোপন থাকে না। পাব্লিকের বুঝতে বাকি থাকে না যদিও যে এই-সমস্ত অথোরিট্যারিয়ান বক্তব্যের নিশানা বা টার্গেট সরকার বাহাদুরের পয়সায় আয়োজিত দোসরা আয়োজক তরফ, যাদের অনুষ্ঠান হয় স্টেডিয়ামজোড়া মানুষের সমাগম নিয়া দিন-তিনেকের ব্যবধানে যেখানে কালচারের জেলাভিত্তিক বিবিধ কমান্ডার ছাড়াও মন্ত্রীমিনিস্টার আর মাশ্টরমুশ্টরদের জমায়েত লক্ষ করা যায়। একটা করে উৎসবস্মরণিকা পুস্তক প্রকাশ করেছিল উভয়েই পৃথকভাবে, সেই দুই পুস্তিকার মধ্যে পয়লা আয়োজকের প্রোডাকশন হয়েছে এনাফ মানসম্মত এবং দোসরা আয়োজক তাদের মোটা টাকার গরমে অ্যারেঞ্জড অনুষ্ঠানটির মতো পুস্তিকা ছাপাইতে যেয়েও মোটামাথা ব্লান্ডার করেছে। এন্তার বানানভ্রান্তি আর তথ্যবিভ্রাটে মেমেন্টোটা আমাদিগেরে তাজ্জব করেছে। কে দেখে এইগুলা, কাউরে দেখার টাইমই নাই কারো, আমরা তামিশকির শুধু মজা দেখি এইসব কর্তৃপক্ষমানসিকতার লোকলস্করদিগের। করিম নিয়া যার যার মুহাব্বাত তার তার কাছেই দিনশেষে থেকে যায়। ইন্তেকালের পরে গেল কয়েক বছর ধরে এসএ করিম নিয়া সিলেটের আঞ্চলিক শিল্পসাহিত্য সেবায়েতদের সোল্লাস স্মরণবহর হা হয়ে দেখিয়াই যাইতে হয় খালি। দেখিয়া যাইতে হয় বেরঙঢঙের বিরাটবপু বইছাপানি।
ইয়াং মিউজিকপ্র্যাক্টিশনার্স, ইয়াং মিউজিশিয়্যান্স, ইয়াং মিউজিকলাভার্স — যারা আজকাল নানাভাবেই মিউজিকযাপন করছে, এইটা খালিচোখেই দেখা যায়, — এদেরে তো গণনাতেই নেই না আমরা। মানি যে অ্যামেচারিশ ইনিশিয়েটিভই বেশি। কিন্তু উদযাপনের মাত্রাটা মাথায় রাখলে ব্যাপারটা আগের কালের কিচ্ছুটির সঙ্গেই তুলনীয় হতে পারে না। ব্যাপারটা অতুলনীয়। বহুভাবে, ব্যাপক বৈচিত্র্যে, এখন ফিউশন হচ্ছে দেদারসে একেকটা গানের একেকটা মিউজিকপিসের। সবসময় অ্যাপ্রিশিয়েবল হচ্ছে এমন নয়। কিন্তু হচ্ছে। এই হওয়াটাকে অ্যাক্নোলেজ করে নিয়ে বাকি কথা চালাতে হবে। সেলিব্রেশনটা ইম্পোর্ট্যান্ট। সেলিব্রেশনটাই সিগ্নিফিক্যান্ট এইখানে। এই গানের মজমায়। এইসব কোনোদিকেই ভ্রুক্ষেপ না-করে অ্যাইনশিয়েন্ট মিউজিকম্যারিনাররা ‘ভাবের শুদ্ধতা’ আর ‘সুরের শুদ্ধতা’ লইয়া কাউয়াক্যাঁচক্যাঁচ করিয়া যায় আজও, হয় নাই … গেল গেল … রসাতলে যায় শিল্পসাহিত্য … এইসব মুখস্থ কথায় চিল্লাইয়া আসমান ফাটায় তারা, এই বাংলায়।
কিন্তু অনুষ্ঠানদ্বয় কেমন হয়েছিল অন্তিমে? যেহেতু সুদূর সংস্কৃতিদেশ হইতে এসেছিলেন দুনো অনুষ্ঠানেই শিল্পীমণ্ডলী, দিশি জিনিশে আয়োজকদিগের আস্থা যেহেতু কম, কাজেই অনুষ্ঠান মনোজ্ঞ তথা সাফল্যমণ্ডিত না-হয়ে উপায় আছে? এসএ করিমের গানগুলো বিদেশী ভাষার মতো সন্তর্পণে না-গাইলে রেস্পেক্টের ঘাটতি হয় কি না, তা জানি না। দাঁতচাপা গায়কী দিয়া ঠাকুরের গান পরিবেশনের ন্যায় আজকাল করিমের মতো উদাত্ত কণ্ঠ-কথার গানবাদ্যিও যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য বজায় রাখিয়া গাইবার আব্দার আমাদের কানে আসে হামেশা। তার উপর দিয়া আছে শহুরে সংস্কৃতিসিপাহসালারদের ‘শুদ্ধসুর’ ধরিয়া গাইবার আজগুবি বায়নাক্কা। হাওয়েভার, আমরা গাইলে তো সুধীসমাজ ড্রামসবিটে নাসিকা সিঁটকাতে সিঁটকাতে বেঘোরে অক্কা যাবেন। অতএব গাওয়াইতে হবে এন্ডিয়ান দিয়া। তাতে সংস্কৃতিরও সুরক্ষা হয়, বাইপ্রোডাক্ট হিশেবে সমাধা হয় সিপাহসালারদের দেখানোপনাটা। বাংলাদেশের ললিতকলার বিকাশ? কবে এবং কে চেয়েছে এইটা? ভারতীয়দের কাছ থেকেই চিরদিন শিখিয়া যাইব আমরা। আজীবন শিখনের এই শিক্ষার্থীজীবন আমাদের ইহজন্মে আর ফুরাবে না।
গান গাইবার কালে ‘সুরের শুদ্ধতা’ আর ‘ভাবের শুদ্ধতা’ লইয়া প্রাচীন পণ্ডিতম্মণ্যদের যে-ক্যাওস্, সেইটা অ্যাড্রেস্ করে করিম-উৎসবে আগত অতিথি শিল্পী-ও-সংগীতগবেষক মৌসুমী ভৌমিক বলেন, — “একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় — শুদ্ধভাবে গান গাওয়া, আর ভুলভাবে গাওয়া। গানের শুদ্ধতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কোনটা-যে শুদ্ধ তা আমি ঠিক বুঝি না। কোনভাবে গাওয়াকে আমরা শুদ্ধ বলব? কতটা সরে গেলে তাকে বিচ্যুত বলব? অনেকভাবেই মানুষ গান গায়। একেকজন একেককভাবে গায়। তাতে তো অসুবিধার কিছু নেই।” নিশ্চয় আয়োজকদের কারো-কারো মনঃপূত হয় নাই বিবৃতিটা। মানুষ কিন্তু মৌসুমী ভৌমিকের স্ট্যান্ডটাকেই হৃদয় দিয়া লালন করে। প্র্যাক্টিক্যালি মানুষ গানটাকে নিজেরই করে নেয়। যে-যার মতো করিয়া গানটাই গাইতে চায়, গায়, পাণ্ডিত্যে পিঠ ফিরাইয়া রয়। এর মধ্যে এইসব বিশুদ্ধতার বাতচিতে সাধারণেরে চুপসাইয়া দেয়া হয়। এমনিতেই গানবাজনায় দেশবাসীর দরদ যতটা আমরা দাবি করি, আমরা মানে যারা সাংস্কৃতিক বলিয়া জাহির করতে চাই নিজেদেরে, ক্লেইমটা ডাহা মিথ্যাই। বিদেশের গান লোকে ব্যাপক শুনলেও দেশভাষার গানবাজনা আজকাল আর আগের ন্যায় বিগলিত শ্রদ্ধায় নিতেছে না। কাভার ভার্শনগুলো যতটা আনবাড়ি থেকে নিতেছে, যেটুকু স্বতঃস্ফূর্ততায়, বিশেষভাবেই ইংরেজি, এখনকার ইয়াং জেন্, আব্দুল হাকিমের বঙ্গভাষা কাব্যের শিক্ষা ডিনাই করে, মাতৃভাষার গানটা দাঁত-না-দেখানো ধর্মগম্ভীর সোহবতের সাথ না-গাইলে গেল তলায়ে ক্ল্যাসিক বঙ্গ বলিয়া হাঁউকাউ শুরু হইয়া যায়; — খাইয়া কাম নাই এইসব নিরানন্দ ধর্মসংগীত গাইবার কসরতে বেফায়দা টাইম কিল্ করে আজকের রসেবশে-থাকা তারুণ্য। থোয় ভিজাইয়া তারা বাংলা বুড়া-আংলাদের গানাবাজানা। গায় কাজেই ইংরেজি রক্-ন্-রল্ কিংবা হ্যাভিমেটাল গানা। তারপরও নগরবন্দর ব্যাপিয়া কালের মন্দিরা না-বাজাইয়া বাংলার ষাঁড়েরা বাজায় বেধুরা পাণ্ডিত্যপনা।
সিলেটের করিম-উৎসবে, সরকারবাহাদুরের ফান্ড ব্যতিরেকে আয়োজিত অনুষ্ঠানটায়, বলতে যেয়ে মৌসুমী ভৌমিক আরও বলেন — “রবিঠাকুরেরও গানে তো কোনটা বিশুদ্ধ তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। বাউল পদকর্তাদের গানের ক্ষেত্রে তো সেটা আরো অসম্ভব। বাউলরাও তো অনেকসময় একটা গান অনেকভাবে গেয়ে থাকে। একটা গানের ৪/৫টা ভার্শন থাকে। যে যেমন করেই গাক এই গানগুলো টিকে থাক।” কথাগুলো দোস্তবখশিদের সান্ধ্য গুলতানির আসরে আমরাও বলিয়া থাকি হামেশা। আমাদের তো মঞ্চ নাই, মাইক নাই, ইনভিটেশনও নাই উৎসবে-মোচ্ছবে। যেন মৌসুমী ভৌমিক আমাদের হয়েই কথাগুলো ঠসাদের কানে প্রেরিলেন। ঠসারা কি ইস্তফা দেবে এইবার পাণ্ডিত্যপয়মালিতে? উই ডাউট।
মৌসুমীর ঔদার্য কতদূর পর্যন্ত, রিগ্যার্ডিং এই ইশ্যু, শোনা যাক আরেকটু। করিমের এবং অন্যান্য অনেকের গানে ব্যবহৃত ভণিতা বা চারণকবির নামস্বাক্ষরিত পঙক্তিটা আজকালকার ‘মডার্ন’ পার্ফোর্মাররা, বিশেষত কলকাতার পার্ফোর্মাররা, তাদের রিমেইড ফিউশন ভার্শনে ত্যাগ করছেন, এই অভিযোগ আছে মূলপ্রেমিক পণ্ডিতদিগের মধ্যে। এ-প্রসঙ্গে মৌসুমী ভৌমিক বোল্ডলি রিপ্লায়েড, “অনেক গান তার লেখককে ছাপিয়ে যায়। যে-গান শিল্পীকে ছাপিয়ে যায় সেটাই স্থায়িত্ব পায়। রবিঠাকুরের গানে তো কোনো ভণিতা নেই। তাই বলে কি রবিঠাকুরের গান টিকে থাকেনি? আমার মা শাহ আবদুল করিমের আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম — এই গানটা জানেন। কিন্তু গানটি কে লিখেছেন তা জানেন না। কিন্তু করিমের গান তো তাঁর কাছেও পৌঁছেছে!” এই কথাগুলো, মৌসুমী-উবাচ কথাগুলো, নয়া বাংলার গানভাবুকদের দিশা দেবে একটু হলেও। ওইদিনের মৌসুমীস্পিচের একটা সংক্ষিপ্ত ডক্যুমেন্টেশন পাওয়া যাবে ডেইলি-নিউজপোর্ট্যালে, এবং কিছুটা হলেও অর্গ্যানাইজার মশাইয়ের গোস্বা হইবার কারণ আঁচ করা যাবে, সেই পত্রিকার রিপোর্টলিঙ্কটা (লিঙ্ক) আমরা যদি ক্লিক করি একবার।
উল্লেখ করতে হয়, দ্বিতীয়োক্ত করিম-উৎসবে এসেছিল ‘দোহার’ শীর্ষক গানদল; এবং দলের অধিকারী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য প্রোক্ত পত্রিকার প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এই ভণিতাপদ গিলে ফেলা প্রসঙ্গে মৌসুমী ভৌমিকের প্রাগুক্ত বক্তব্যের বিপরীত অবস্থান নেন, বলেন — “গানের ভণিতা ব্যবহার না করাটা অপরাধ। করিমের গান গাইতে হলে তাঁর ভণিতা সহ গাইতে হবে। তাঁর কথায় গাইতে হবে। … রবীন্দ্রনাথের গানও তো একটা দীর্ঘসময় কথা পাল্টে গাওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আগে করিমের আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম গান ভণিতা ছাড়া গাওয়া হতো, লোকে জানতই না এটা কার গান। এখন লোকে জানে এবং ভণিতা-সহই গায়।” একই প্রতিবেদনে দেখা যাবে এর আগে কালিকা আরও বলেছেন, “লোককবিরা তো মুখে মুখে গান ছড়িয়ে দেন। একটা গান মানুষের মুখ থেকে মুখে যেতে যেতে তার চরিত্র খানিকটা বদলায়। করিমের গান যদিও লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে তবু তাঁর গানের মূল বাহন তো হচ্ছে মুখ। তাছাড়া লিখিত গানেরও একাধিক ভার্শন আছে। একেকটায় একেক রকম শব্দের ব্যবহার আছে। তবে দুয়েকটা শব্দ এদিক-ওদিক হলে মারাত্মক কোনো ইন্দ্রপতনও ঘটে না। তাঁর গানের ভাবদর্শনটা হচ্ছে মূল কথা।” তার মানে, কালিকাও কন্ট্রোল্ড একটা স্বাধীনতা, গাইয়ের/শিল্পীর মোটামুটি সীমায়িত একটা স্বাধীনতা, মানছেন বৈকি। রিপোর্টলিঙ্কটা ( লিঙ্ক) খানিক ঘুরে আসতে পারি আমরা।
আরে, এত ডরাইবার কি আছে? এই যুগে কিছুই হারাবে না, হারাবার কথা না, হারায় যদি তো ভাবতে হবে এর থাকার দরকারই ছিল না। আর, এ-যুগে কেন, কোনো যুগেই কিচ্ছু হারায় না আখেরে, ফেরে কোনো-না-কোনো ফর্মে, ফেরে ব্যেটার ফর্মে। অ্যাট-লিস্ট ব্ল্যাকবিবরে তো রইবেই! স্টিফেন হকিং যদি সত্য বলিয়া মানেন, তো হকিঙের নাতিপুতিদের উপর ভরসা রাখতে পারেন না? আর, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেখানে মরিয়া প্রমাণ করিতেও হতে পারে যে সে মরে নাই। কাজেই ‘অরিজিন্যাল’ লুপ্ত হইয়া যাওয়া বা ‘অথেন্টিক’ অবলুপ্ত হইবার আশঙ্কা আদৌ ধোপে টেকে না। আর, অরিজিন্যালের, অথেন্টিসিটির, বাড়ি কোথায় বাবা? আল্লা-রসুলের কথার বার্তাজনিত অথেন্টিসিটি নিয়া কাজিয়াফ্যাসাদ-খুনাখুনি হেরিয়াও আমাদিগের তাসির হয় না।
আজেবাজে কথা রেখে এইবার ভালো ভালো কথাগুলো বলি। মিউজিশিয়্যান্ শাহ আবদুল করিমের ‘বসন্তবাতাসে সই গো’ শুনলেই তড়াক করে ট্যাগোরের একটা কবিতা পাশাপাশি স্মৃতি ঠেলে উথলে উঠে আসে। ‘এক গাঁয়ে’ সেই কবিতার নাম। ‘ক্ষণিকা’ নামের কবিতাবইয়ের অন্তর্গত। কবিতাখানি নিম্নলিখিত :
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক।
তাহার দুটি পালন-করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া
কোলের ’পরে নিই তাহারে তুলে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে —
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।।
দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি,
মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক —
তাদের বনের অনেক মধুমাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক।
তাদের ঘাটে পূজার জবামালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে,
তাদের পাড়ার কুসুম-ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে —
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।।
আমাদের এই গ্রামের গলি-’পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন,
তাদের খেতে যখন তিসি ধরে
মোদের খেতে তখন ফোটে শণ।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে।
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণধারা,
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে —
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।।
দুইটা রচনাই আপনাকে এই রিয়্যালিটিদীর্ণ দৈনন্দিনতা থেকে এক অন্য অমল ভুবনে নিয়ে যেতে চায়। সেখানকার বিষাদ, সেখানকার বিলাসব্যসন, সমস্তই ইউনিক্। ওই জীবনের ভাগীদার ছিলেন একদা আপনিও। প্রত্যেকেই ছিলাম আমরা। আজ আর নাই। কিন্তু আমরা থাকি ঠিকই ‘একটি গাঁয়ে’, একবাতাসে, এভারগোল্ডেন্ বসন্তে, ভোমরাটার গান-গাওয়াজাত গুনগুনানিতে, এই গানটা এবং এই কবিতাটা গাইবার সময়। সেই আমাদের বাছুর-বয়স, কাফ-ল্যভ, অনন্ত বসন্তদিন … চোখে চোখ রেখে সেই ইন্টার্মিডিয়েট-অভিজ্ঞতায় দৃষ্টিবিহীন …
অনেক তো হলো বকবক, বসন্তপ্রশ্রয়ে, হবে আরও হয়তো-বা আরেক বসন্তে, ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবার ভয় দেখায় যদি শুধু তোমার পাড়ার ফোককালচারদাদারা, প্রিয় রঞ্জনা, আমি আর আসব না তাইলে। এইটাও তো বসন্তেরই, স্প্রিংস্যং এইটাও, কোনো-এক মাতাল সমীরণে এইটাও সঙ্গ দিয়েছিল আমাদিগেরে, এই কথাটি মনে রেখো, তোমারটাই খালি রিয়্যাল শ্যুগার আর আমরাটা ভুষিমাল, ডোন্ স্যে দ্যাট স্যুয়িটহার্ট, সোনা, হানি, ঈশ্বরের মাচানতলায় গানের সীমা-সরহদ্দি নাই, আইজ্ঞা, “পাড়ায় ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবো / বলেছে পাড়ার দাদারা / অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই / রঞ্জনা, আমি আর আসব না” … তা, তোমার বিশু পাগলার ম্যাচিয়্যুর শুদ্ধ উচ্চারণের রবীন্দ্রসংগীতে কেন ভুলিয়া যাও রঞ্জনের কৈশোরবিদীর্ণ অবলা বাণীর ঘনযামিনীগুলো? বসন্ত জাগ্রত তব দ্বারে, নতুন বাংলা গানবুদ্ধিবিবেচনার এই আগ্নেয় বসন্তে, এবে স্বীকারিয়া যাও করিম-রবিনের কাঁখের কাছটায় ক্যাবলাকান্তের কলালুপ্ত গানটাও! “উদাসীন থেকো না, সাড়া দাও!” বলো, “সুর চায় তোমাকে, আমাকেও চাই তার / আমাদের মনে রঙ মিলে যাক দুনিয়ার …
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে… - December 12, 2024
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
COMMENTS