পয়লা বাখান / রবির ‘পরব্রহ্ম’ : সাহেবগো রবি-বিস্মরণ ও ভিটগেনস্টাইনের রবিস্মরণ
আমাদের রবিকবি ইউরোপ-আমেরিকায় ব্যাপক ভ্রমণের সুবাদে তাদের জগৎ পালটানোর যজ্ঞ নিজের চোখে দেখার সুযোগ পাইছিল এই কথা ইতিহাসে লেখে। পশ্চিম গোলার্ধের দেশে-দেশে চলমান যজ্ঞের বিবরণ সফরনামা-চিঠিপত্র ও রকমারি লেখায় সে কমবেশি বয়ানও করছে। এখন অবশ্য মনে হয় সভ্যতার এই যজ্ঞ নিজে দেখার সুযোগ পাইলেও যজ্ঞটারে রবি সেই দর্শকের চোখ দিয়া দেখছে যে-দর্শক ঘটনার নিকটে অবস্থান করে কিন্তু চোখে দূরবীন দিয়া দূরের জিনিস নজর করতে বেশি ভালোবাসে। রবিকবির যজ্ঞদর্শন আমার কাছে সেইরকম এক ঘটনা মনে হইছে। বিলেত, রাশিয়া, রোমানিয়া কিংবা জার্মানিতে ঘুরঘুর করার দিনেও তাঁর চোখ আসলে সেসব দেশে ছিল না। বিলেত দেখতে গিয়া সনাতন ভারতবর্ষের অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-পুন্ড্র-রাঢ়-সূক্ষ্ম-হরিকেল-সমতট আর হালজামানার বাংলাদেশ ও ভারত তথা সমগ্র উপমহাদেশটারে নজর করছে জনমভর।
পাশ্চাত্য বা পশ্চিম-সাগরপারে সংঘটিত যজ্ঞ হইতে যে-আলোকধারা ঠিকরায় তার খানিক দীপ্তি ধার করার তাগিদ অবশ্য রবির মনে জীবিত ছিল, তবে সেইটা নিছক বৈষয়িক প্রয়োজনের খাতিরে এবং এর বেশি নেওয়ার ইচ্ছা তাঁরে কদাপি উতলা করে নাই। এই ফাঁকে স্মরণ করি :— পশ্চিমাদেশের বিশিষ্টজন ও আমপাবলিক টেগোর নামে পরিচিত লোকটারে কবি ইত্যাদির বদলে ইন্ডিয়া হইতে আগত সেইন্টরূপে ভাবতে মনে আরাম পাইছে। সে কেবল তাঁর দরবেশি জোব্বা ও দাড়ির কারণে ঘটছিল এমন কিন্তু না, ঘটনা সেখানে ঘটছে পশ্চিমের সাহেবমেমগো মনের জগতে চিরস্থায়ী ছবিখানার দৌলতে, — ভারতবর্ষ হইল গরিব নেটিভ আর নেংটি পিইন্ধা পাহাড়-জঙ্গল ও আদাড়বাদাড় ঘোরে এমন সাধু-ফকিরের দেশ। এইটা হইছে সেই দেশ গৌতম বুদ্ধ যেখানে একদিন জন্মগ্রহণ করছিলেন! তিনি দেহ রাখনের পর বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রমণরা সেই দেশে বেশিদিন টিকতে পারে নাই এবং দলে-দলে তিব্বত পাড়ি দিয়া চিনা মহাদেশ ও এর আশপাশে ছড়াইয়া পড়ছিল। মোটের ওপর একটা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ভূখণ্ড, লোকে সেখানে আদুল গায়ে থাকে আর প্যাগানগো মতো বিচিত্র দেবদেবতায় বিশ্বাস যায়, তাদের ঈশ্বর বইলা মানে। সেই দেশে এমনকি নিরাকার ঈশ্বরে ইমান রাখছে যে-মুসলমান তার লগে আরবদেশের মুসলমানের কোনও দাড়াদিশা পাওয়া যায় না এবং হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতের মধ্যে চুলাচুলি নিত্য ঘটে!
পশ্চিমতীরের লোকগো মনে ভারতবর্ষের এই কমন ছবিখানায় সত্যের ভাগ থাকলেও গো-চানার মতো মিথ্যার মিশেলও কম ঘটে নাই সেখানে। সমস্যা হইছে মিথ্যাটুকুন তাদের চোখে আঙুল দিয়া দেখানোর তাগিদ রবিকবিকে সেভাবে উতলা করে নাই। রবির ছিদ্র খুঁজতে যারা শহিদ হইতে প্রস্তুত সেই বুদ্ধিজীবীগো মধ্যে এই উপলক্ষে দেদার চুলকানির সূত্রপাত ঘটানো সহজ মনে হইলেও কেন সে উতলা হইতে পারে নাই সে-প্রশ্নের সদুত্তর মিলে না। পশ্চিমের সাহেবমেমগো চোখের সামনে ভারতবর্ষের সহি সুরত নিয়া রবির শক্ত পায়ে খাড়া হইতে না পারার কারণ ‘য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়েরি’ ইত্যাদির মধ্যে খানিকটা পাওয়া যায়। ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘পারস্যযাত্রী’, ‘ছিন্নপত্রাবলী’, ‘নৌকাডুবি’, ‘চোখের বালি’, ‘ঘরে-বাইরে’ ও ‘গোরা’ সহ প্রবন্ধ-নিবন্ধ-বক্তিমা এবং চিঠিপত্রের মধ্যেও পশ্চিমের জীবনধারায় কলবন্দি বা রবির ভাষায় ‘ছাঁচবন্দি মানুষ’ পয়দার যে-কারবার চলে সেইটার লগে বিরোধাভাস চাপা থাকে নাই। বহিগুলার যোগ-বিয়োগ থিকা এই বোধের তল মিলে :— ঘন-ঘন ইউরোপ-আমেরিকা সফর করলেও সাদা সাহেবমেমদের মনে আঁকা ভারতদেশের ছবি কিংবা তাদের দুনিয়াবি নিয়া মাথা ঘামানোর চাইতে নিজের মনের উপর দিয়া গড়াইয়া যাইতে দেওয়ার পক্ষে রবি সারাজীবন অটল ছিল। কচুপাতার উপরে বৃষ্টির পানি গড়াইয়া মাটিতে পড়ে এবং দু-এক ফোঁটা সেখানে টলমল করলেও বেশিখন থাকতে পারে না, রবির ঘটনা অনেকটা সেইর’ম ছিল।
সাহেবমেমগো দেশে কর্মের ক্ষুধা, বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞান আহরণের ক্ষুধা, সেইসঙ্গে উপভোগ্য উচ্ছলতা আর প্রাণশক্তি রবিকবির মনে ‘খুশি ও বেজার’ বোধ করার দ্বৈত উপলক্ষ নিয়া হাজির হইছিল। ভারতবর্ষের হাড়জিরজিরে স্থবির দশাখানের সঙ্গে সাহেবি দেশের তুলনা যখনই টানতে গেছে মনে দুখ জাইগা উঠছে, সেই দুখ যেইটা একজন মানুষকে স্বজাতির প্রতি ক্ষুব্ধ কইরা তোলে। বিচিত্র লেখা হইতে রবির সেই ক্ষোভের পরিচয় খুঁইজা বার করন কঠিন কিছু না। অন্যদিকে এইটা ভাইবা খুশি হইছে :— নিজের অতীত ঐশ্বর্য বিস্মৃত হওনের ফেরে ভারতবর্ষের লোকজন হাড়দুবলায় পরিণত হইলেও সাহেবমেমের অনুকরণে কাউয়ার ময়ূরপুচ্ছ ধারণের চাইতে এইরূপ নিস্তেজ থাকনটাই বরং তাদের জন্য মন্দের ভালো। সুতরাং যুবা বয়সে বিলেতফেরত রবিকবির স্যুট-কোট-টাই পিন্ধন এবং প্রৌঢ় ও বৃদ্ধকালে স্যুট-কোট-টাই শোভিত ভদ্রসমাজে ব্যাপক উঠবসের ঘটনা সত্ত্বেও এইটা বোধহয় অনুমান করা যায় শান্তিনিকেতনে পায়চারির সময় খ্রিস্টের একনিষ্ঠ সেবক ও শেষ দম অবধি রবির জীবনে অবিচ্ছেদ্য প্রিয় সখা চার্লস এন্ড্রুজ, ‘সভ্যতার সংকট’-এ যথার্থ ইংরেজ ও খ্রিস্টানরূপে যাঁর নামটি সে স্মরণ করে, সেই এন্ড্রুজকে কবি এই কথা কইতেও পারে :— When the chance of being to be better is worse than to be better, then let it go.
মোদ্দা কথা রবিমন ইউরোপ-আমেরিকার সাহেবমেমগো দুর্জন ও সজ্জনে ভাগ করে নিয়েছিল। সেই ভাগের একদিকে এন্ড্রুজরা অঢেল পরিমাণে ছিলেন, আবার জালিয়ানওয়ালাবাগ কাণ্ডের খুনি ডায়ারের মতো দুবৃত্তের কমতিও সেখানে ছিল না। এই দ্বি-মেরুর মধ্যে ভূবর্ষের হাজার বছরের সংস্কৃতির শিরশ্ছেদ ঘটানোর ঠেকা নেওয়ার কারণে সময় এই কবিরে দিয়া শান্তিনেকতনে কামলা খাটাইছিল। ওদিকে বৈষম্য সৃষ্টির পলিটিক্সে জেরবার মুসলমান সমাজ রবিকবির ‘হিন্দু সভ্যতা ও সদাচার’ নামক সিনটেক্সে ব্যাপক নাখোশ হওনের কারণে সেইটা পরিহারের জেদে তারা অটল হইছে, এহেন সংবাদ রবির মনোজগৎকে খুব বেশি বিচলিত করছে সে-প্রমাণ হাজারবিজারে মিলে না; — তো এই অজুহাতে ‘হিন্দুত্ববাদের পৃষ্ঠপোষক’ ছাপ্পায় রবিকে যারা কামান দাগাইতে চান এবং ‘রক্তের দাগ’টাগ এইসব মুইছা তাঁরে পড়তে বসেন, তাঁদের হয়ত স্মরণ থাকে না রবির কাছে ‘ভারতবর্ষ, ভারততীর্থ, আর্যতীর্থ’ ইত্যাদি সিনটেক্স হিন্দু বা মুসলমানে সিলবন্দি অচল কোনও মোহর ছিল না। রবির কাছে ভারতবর্ষ মানে হইছে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলবল নিয়া মাটি খুঁইড়া বিলুপ্ত যে-সভ্যতার নিদর্শন জগতের সামনে হাজির করেন সেই সভ্যতা এবং এর লগে বনবাদাড়-শহর-গ্রাম ও গ্রামান্তর-নিবাসী বিপুল জনগোষ্ঠীর বোঝা কান্ধে সচল অতিকায় একখান ভূখণ্ডের সমষ্টি। সেই সমষ্টিমধ্যে হাজারবিজার জাতি-গোষ্ঠীর সন্ধিবিচ্ছেদের তরঙ্গ থিকা যেসব স্ফুলিঙ্গ চারধারে যুগ-যুগ ধরে ছিটকাইয়া পড়ছে এর সবগুলা একত্র করলে ভারতবর্ষের গৌরব-উজ্জ্বল অতীতে ফেরত যাওন সম্ভব হইতেও পারে, মনের মধ্যে এই বিশ্বাস রবি কিন্তু জীবনভোর লালন করছে।
রবির মনোজগতে ভারতবর্ষ সেই তীর্থ হইয়া ওঠে যেখানে একদিন ‘মহাভারত’ সম্ভব হইছিল। তাঁর মনের বনেদে ‘মহাভারত’ ইতিহাস হইয়া কথা কয়, যার মধ্যে বেদ-উপনিষদ-গীতা-পুরাণ মায় জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব-কোরান-তুরান সকলই চমকায় বইলা সে একিন যায়। সুতরাং নবীন যুগের নবীন বাস্তবতায় মহাভারতকে নতুন ভাষা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা গেলে ভারতবর্ষ নতুন শক্তিতে জাইগা উঠতেও পারে। মানুষের মুখের বিচিত্র বুলি, আচার-সংস্কৃতির দিলবাহার, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইতে হয় এমনসব বিশ্বাস ও সংস্কারের তোড়ে স্রোতস্বিনী দেশটারে একতারায় বাইন্ধা রাখনের জিগরি আশায় রবি ফেরত যায় ‘হিন্দু’ নয় ‘সিন্ধু’ সভ্যতার তীরে! তাঁর ‘হিন্দুত্ববাদ’ নিয়া মামলা রজু করনের সময় এই জায়গাটি খেয়াল রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
রবির এই সিন্ধুতীরে ফেরত যাওয়ার রেস্ত ও রাহা নিয়া অবশ্য তর্ক হইতে পারে। কালান্তরের পরিভাষায় ‘সিন্ধস্থান’ হইতে ‘হিন্দুস্থান’-এ থিতু ভূবর্ষের মনবাহার ভাষা ও জনগোষ্ঠীকে হিন্দুত্ববাদ নামক জাতীয়তার ফাঁদে বন্দি রাখার মতলব সত্যি সেখানে ছিল কি না ইত্যাদি নিয়া কড়া আলাপ হইলে ক্ষতির কিছু নাই। সমস্যা হইছে সেই আলাপের ছলে রবিকবিকে যাঁরা ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলান তাঁদের মনে রাখা প্রয়োজন :— বৃহৎ এই ভারতবর্ষে ইতিহাসের নিয়মে মানুষ একদিন আরণ্যিক ছিল; অস্ট্রালোপিথেকাসের অংশভাক হোমো ইরেক্টাস ও হোমো হ্যাবিলিস ও তাদের দূর উত্তরপুরুষ হোমো স্যাপিয়েন্স পাহাড়-অরণ্যে শিকারি আদিবাসীরূপে এখানে দীর্ঘদিন তরঙ্গিত হইছিল; তারপর সিন্ধু-দ্রাবিড়-সুমেরিয় ও পশ্চিম ইউরোপ হইতে আগত যোদ্ধা মেধাবী আর্যদের সঙ্গে মিলন-সংঘাতের ঢেউ হইতে পৌত্তলিক সভ্যতার সংস্কৃতি এই দেশে যেমন বারবার ফেরত আসছে, ভাববাদের চরম পরাকাষ্ঠার যুগে সেই সভ্যতার নাভি হইতে পরব্রহ্মর অতুল ধারণাটি বিকশিত হওনের পথটাও কইরা নিতে পারছিল।
রবির স্বাদেশিকতা, স্বজাত্যবোধ, জাতীয়তা এবং এসবের যোগফল হইতে উদ্ভূত জীবনবোধের সঙ্গে এই পরব্রহ্মর যোগ নিবিড়। যুদ্ধ-মন্দা-মারি-দুর্ভিক্ষ-বিপ্লব আর স্বরাজ লাভের আন্দোলনে টালমাটাল বিশ্বে মানুষ ও মানবতার ওপর লোকের ক্রমাগতভাবে অবিশ্বাস এবং বিপরীতে ‘মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ’ টাইপের প্রশ্নবিদ্ধ শুদ্ধতায় অটল থাকার প্রেরণা রবি বোধহয় ‘পরব্রহ্ম’ থিকাই পায়। মনের মধ্যে যদিও দুঃখটা চাপা থাকে বৈদেশে ইয়েটস-পাউন্ড প্রমুখরা তাঁরে এখন আর গোনায় ধরে না। টিএস এলিয়টের ‘জার্নি অফ দ্য মেজাই’ তাঁর হাতের পরশে ‘তীর্থযাত্রী’ নাম নিয়া অনূদিত হইছে তো কী হইছে, এলিয়টের সময় নাই রবি হাতে নেওয়ার। আফসোস বুকে চাপা দিয়া রবি তাই বব ডিলানের অমোঘ পাথরখানার মতো গড়াইতে-গড়াইতে নিজের দেশে ফেরত যায়; সেই দেশ লোকে যেখানে তাঁরে বহুভাবে বন্দনা করার ছলে নিন্দা ও উপহাসের বাণ হানতে কসুর করে না! ডিলানের সময়ে যদি তাঁর জন্ম হইত অথবা বব ডিলানকে পাঠানো যাইত তাঁর সময়ে তবে নিজের দেশে ফিরনের এই জার্নিটা হয়ত রকগায়কের গানের কলির লগে অভিন্ন মনে হইত তাঁর কাছে! যেখানে, ডিলান চিৎকার দিয়া ডিরেকশনের কথা জানান দেয় :— ‘How does it feel, how does it feel? / To be on your own, with no direction home/ A complete unknown, like a rolling stone.
রবি তো সকলের মধ্যে ঘুরঘুর করেও নিজের মতো একলা আর একবগগা এক পাবলিকই থাকে জীবনভোর! সুতরাং সে যখন পশ্চিমের যজ্ঞদর্শন শেষে দেশে ফেরত যায় তখন কেন জানি তাঁর এই জার্নিটা বিশ্বাসযোগ্য হইয়া ওঠে না। মনে হয় জাহাজে করে আল্লাখাল্লা পরা এই-যে লোকটা বিদেশ হইতে বারবার ঘরে ফেরত আসে সে কী সত্যি নিজের ঘর খুঁইজা পায় যে-ঘরে তাঁর জন্য সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সে কখন ফিরবে! নাকি ফিরা যাওনের কোনও চিন্ বা নিশান নাই দেখে দিকভ্রষ্ট পথিক হয়ে নিজের মনের মধ্যে ‘গড অথবা গডো’-র মতো কাউরে সে খোঁজে অথবা সেই ঘরে ফেরত যাওনের চেষ্টা করে যেইটা সে আজোবধি খুঁইজা বাহির করতে পারে নাই!
রবির এই ঘরে ফিরনের খেই ধরে প্রশ্ন তাই ওঠে :— ‘বিজয়া’ অর্থাৎ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো বা এ-রকম দু-চারজন ব্যতিক্রম বাদ দিলে সেকালের রবিভক্ত সাদা সাহেবরা কি একালের ‘with no direction home’-র চক্করে দিশেহারা লোকটারে নিজের সোদর বলে চিনতে পারছিলেন? উত্তরটা যে সুবিধার হয় না সেইটা ইতিহাসের দিকে একপাক ফিরা তাকাইলে টের পাওয়া যায়। এলিয়টের কথাই ধরি, পশ্চিমে সভ্যতার যজ্ঞরে প’ড়ো জমি ঘোষণা দিয়া তিনি নিজের নিষ্ক্রমণ ঘটান খ্রিস্টে এবং অন্তিমে আইসা ভাবের আবেশে গীতার শ্লোক আওড়াইয়া জার্নির ইতি টানেন; এই বডিল্যাঙ্গুয়েজের কারণে বাহ্যত অঢেল বৈসাদৃশ্য থাকনের পরেও স্থানে-অস্থানে রবির সঙ্গে তাঁর সাদৃশ্য অপার মনে হইতে থাকে; যদিও ইতিহাসে লেখে এলিয়টের মনে রবিপাঠের আবেগ নাকি কখনও জাগে নাই! তাঁর The Dry Salvages কবিতাখানের মূল সুর তো এইটা ছিল, সময়ের লগে যা-কিছু তামাদি হইতে থাকে এবং সাগরে মিশে সাগরের ঢেউ তার অনেকখানি ফেরত দিয়া যায় বালুতটে; যদিও ‘এই অনেকখানি’ অবিকল সেই বস্তু না যা সে তামাদি হওনের আগে ছিল; সেইসঙ্গে এইটাও সত্য, ফেরত-আসা ‘এই অনেকখানি’ বিগত ‘সেই অনেকখানি’কে রিকল করার উপায় রূপে সাগরতটে বারবার আছাড় খাইয়া পড়ে। এই জায়গা থিকা সমুদয় বস্তপ্রকৃতির যাওয়া-আসার ছন্দটারে একঘেয়ে ছকে বাঁধাই করা ঘটনা মনে হইতে থাকে! কালের প্রবাহ সেখানে নির্ণায়ক হয় সে কী নিবে আর কারে ফেরত দেবে কোন রূপে :— ‘Time the destroyer is time the preserver.’
মোদ্দা কথা সেই টটোলজি :— জীবনসাগরের তীরে সব ধুয়েমুছে যায় এবং হয়ত যায় না; স্মৃতি ফেরত আসে এবং হয়ত-বা আসে না; আসা-যাওয়ার অনুভব শুধু মনে চিরজাগরূক থাকে; — কিছুই অবিকল আগের মতো না হইলেও বিগত সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে সেখানে; আর ‘বিগত’ নামক অভিজ্ঞতা কেউ-না-কেউ রিকল করে বইলা ঘটনাটা সম্ভবপর হইয়া ওঠে। স্মৃতি বা অতীত নামে কিছু নাই যতক্ষণ অবধি কেউ তাকে রিকল করছে! আধখাওয়া আপেল সাগরতটে পড়ে থাকে দেখে হৃদয়ে হাহাকার নিয়া কেউ হয়ত ভাবে :— এইটা আপেল হইলেও সেই আপেল না একদিন তিতা মনে হওনে পুরাটা খাইতে পারি নাই। আধখাওয়া আপেল তখন মনে-মনে গুনগুন করে গায় :— ‘তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি? / সকল খেলায় করবে খেলা এই-আমি। / নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে, / আসব যাব চিরদিনের সেই-আমি / আমায় তখন নাই-বা মনে রাখলে, / তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই-বা আমায় ডাকলে।’
‘পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে / কালের যাত্রায়।’ — এ-রকম একখান ঘোষণা দিয়া যে-লোক নিজেকে কালের খেলার পুতুল বলে আলবিদা জানায়, আধডুবন্ত বাতিল জাহাজের মরিচাধরা সামান রাখার কক্ষটা সাগরতট হইতে নজর-করা এলিয়টের লগে তাঁর বালের তফাত! এলিয়ট তবু সেই লোকটারে নজর করতে পারে না। সেই লোকের নিজেকে নিঃসঙ্গ বা একলা করার ধরন সে ধরতেই পারে না। গীতার শ্লোকের লেজ ধরে যে-মর্মে সে নিজে পৌঁছায় এর লগে রবিকবির মর্মের যোগ তাঁর আবেগে দোলা জাগায় না। ফতুর মানুষ আর অবসন্ন মানবতার ক্ষণে জীবনছুট বিফল এক আশাবাদী কবির সিলমোহরে অনায়াসে রবিকে সে উপেক্ষা করে যায়! এলিয়টের মনোভূমে অশরীরী ভূত হয়ে রবিকবির টেক্সটগুলা তখন অপঠিত চিহ্নের মতো পইড়া থাকে; যদিও সেই ভূত যে তাঁর কান্ধেও চাপছে সেইটা সে বিলকুল টের পায় না!
লেখকের টেক্সট হইছে বহু দেহধারী অশরীরী। জন্মের পর থিকা তার দেহের মধ্যে নতুন দেহ অবিরত জন্ম নিতে থাকে; হইতে পারে দেহগুলা জন্মের ক্ষণ হইতে সে বহন করে, যদিও লোকে সেইটা সেই সময় নজর করতে পারে না বা ব্যর্থ হয়। সময়ের পটপরিবর্তনে অতীতে চোখে পড়ে নাই এমন দেহগুলা টেক্সট হইতে একে-একে বাহির হইতে আরম্ভ করলে একখান ‘গীতাঞ্জলি’ তখন আটখান ‘গীতাঞ্জলি’ হওয়ার বিভ্রম নিয়া মনে অশরীরী অনুভূতি জাগ্রত করায়। এইটা হইছে টেক্সটের সার্থকতা। দেহ রাখনের পর একখান টেক্সট শ্যাওড়াগাছের ভূত যদি হইতে না পারে তবে তার জীবন বৃথা।
এলিয়টের মনোভূমে যে-রবিকবি কোনও একদিন ঢুকছিল অথবা ইহজীবনে ঢুকতে পারে নাই সেই রবি বহুদেহধারী প্রেতরূপে আবিভূর্ত হইতে না পারায় প’ড়ো জমির কবি তাঁরে টের পায় না। অগত্যা মরহুম ভূত রূপে রবি বিরাজ করে এলিয়টের বইয়ের তাক-এ এবং নীরবে তাঁর কান্ধে উইঠা নাচে; যদিও এলিয়ট সেই ভূতকে দেখতে পায় না! এইটা সত্য, সময়ের লগে টেক্সট দেহ রাখে; আবার এইটা মিথ্যা এ-কারণে জগতে বস্তু আসা-যাওয়ার নিয়ম মান্য করলে টেক্সটের মৃত্যু নাই। কোনও টেক্সট মরহুম হইতে পারে না; সে বড়জোর পুরাতন দেহের খোলস ছেড়ে নতুন দেহ নিয়া হাজির হইতে না পারার দুঃখে বহি বা পাণ্ডুলিপির বাঁধাই-করা ফ্রেমের মধ্যে গুমরায়! এমন টেক্সটও থাকে অটল ধৈর্য নিয়া নিজের সুদিন ফেরার অপেক্ষা করে; — সত্য বটে সেই দিন আসে যখন কেউ একজন তারে ঠিক নজর করে এবং ‘আমি ভূত দেখতে পাইছি’ বইলা চিক্কুর দিয়া ওঠে।
লেখকের টেক্সট কেমনে ভূত হয় ও নতুন করে ফেরত আসে সেইটা ধরার জন্য পাঠক ইচ্ছা করলে উমবার্তো একো-র দু-একখান বহি হাতে নিতে পারেন। এই লোক তাঁর জীবনে নিজের থিকা একটা অক্ষর লেখে নাই, সে যা লেখে সেইটা হইছে ভূতনামা। শত বা শকাব্দ বৎসর আগে তামাদি হইছে এমন কোনও টেক্সট তাঁর কান্ধে ভূত হইয়া চাপে। সে আবার এলিয়টের মতো না, ভূত সওয়ার হইছে টের পায় এবং সেই ভূতের দিশা পাইতে তার ঘরবাড়ির খবর নেয়। এই খবরগুলা সে আসলে লেখে। সাংবাদিক যেমন প্রতিবেদন লেখে, গোয়েন্দা যেমন খুনের তদন্ত করে, একো মৃত টেক্সটের মধ্যে বিরাজিত প্রত্নতাত্ত্বিক দেহগুলা হইতে এমন সব ঘটনা আর খবর টাইনা বার করে যা ওই সময় লোকে টের পায় নাই বা বুঝে নাই অথবা যা ঘটছিল তা একো এখন যে-চোখ দিয়া দেখে সেভাবে দেখার ক্লু খুঁইজা পায় নাই। যেমন ধরা যাক কোনও এক কালে কোনও এক গির্জা বা ক্যাথিড্রালে একাধিক মার্ডার হইছিল এবং যে বা যারা মার্ডারগুলা করছে তারা ক্লু রাইখা যাইতে বাধ্য, যদিও সেই সময় সেইটা কেউ বার করতে পারে নাই। ক্লু হয়ত কোনও দেরাজের আড়ালে অথবা সিন্দুকে লুকানো ছিল কিন্তু তখন তার খোঁজ কেউ পায় নাই অথবা এমনও হইতে পারে খোঁজ পাইছিল কিন্তু বিচিত্র কারণে খুনের আসল মোটিভ হাতে আসার পর সেইটা চেপে গেছে! এই না-পাওন অথবা চেপে যাওয়ার কারণে যে-স্পেস সেখানে থাইকা গেল সেইটা এই মুহূর্তে অশরীরী মনে হইলেও কাল কিংবা পরশু দেহধারী মানুষে রূপ নিতেও পারে। যে-কারণে টেক্সটের মৃত্যু নাই, চিরন্তন সত্য টেক্সট বইলা কিছু নাই, তবে রূপান্তর ও বি-নির্মাণ আছে।
গবেষণার ছলে আখ্যান লিখতে গিয়া একো সেই কাণ্ডটা সেখানে করে; মৃত সব টেক্সট যারা ইতোমধ্যে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের খোরাক হয়ে গ্রন্থাগার বা যাদুঘরে ঘুমায় সে এইগুলার পেছনে দেশবিদেশ ঘোরে এবং পছন্দের কোনও মৃত টেক্সট হইতে লুকানো স্পেসটা পুনরুদ্ধার করে যেইটা তখন চাপা দেওয়া হইছিল! স্পেসটা এতদিন পরে বাহির হওয়ার কারণে সত্যের ছবি পাল্টায় এবং এর লগে তাল দিয়া ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব অর্থাৎ মূল ঘটনাটা ঘিরে সেই সময় যা-কিছু ঘটছিল অর্থাৎ ভাষা-শব্দ-উপমা-উৎপ্রেক্ষার মধ্যে বন্দি মানুষ-সমাজ-পরিপার্শ্ব ও সময় নতুন টেক্সটে রূপান্তরিত হইতে থাকে। এমন না একো নতুন কিছু যোগ করছে সেখানে। ঘটনা যেভাবে ঘটছিল সেইটা তখনও ছিল কিন্তু লোকে রিড করতে না পারায় ভুল ধারণার উপরে পুলিশ মামলা ডিসমিস করছিল তখন। একো সেই ঘটনা বা খবরের ভিতরে ঢুকনের কারণে লুকানো সত্য বাহির হয়ে পড়ছে। কোনও একটা ঘটনা বা পাত্রপাত্রী বা সময়টারে পুনরায় রিড করতে হইলে যে-ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ সন্দেহ-অনুমান-চিন্তা-কল্পনায় শান দেওয়া লাগে একো সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে গমনের বিবরণ নিজের বহিতে লেখে এবং সেই বিবরণের ফলে আরেকখান টেক্সট ভবে জন্ম নেয়। এই টেক্সট অকালমৃত টেক্সটারে রিকল করার মাধ্যমে যেমন বর্তমানে প্রাসঙ্গিক করে, সেই সুবাদে এতদিন যা স্বতঃসিদ্ধ ছিল অর্থাৎ ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের বোধ, একো-র এই রিকলের মধ্য দিয়া সেইটা তখন চুরমার হয়ে যায়।
একো-র ‘দ্য নেইম অফ দ্য রৌজ’ বহিখানা এভাবে গবেষণা ও আখ্যানের মধ্য দিয়া গমনাগমনের মাধ্যমে ভাঙচুরের কামটা সারছিল। কবে তামাদি-হওয়া খুনের ঘটনার সুলুক করতে গিয়া যে-টেক্সটগুলা তাঁর সামনে আসে তারাই ‘রৌজ’ নামক আখ্যানের জন্য নির্বাচিত ক্যারেক্টারগো সে কীভাবে বাস্তবে মূর্ত করতে পারে তার হাতিয়ার হয় শেষতক, আর আখ্যানের জটিল কাহিনিছকে সে এই ক্যারেক্টারগো নিয়া ভাষার খেলাটা খেলে। খেলাটা উদ্দেশ্যমূলক হইয়া ওঠে যখন মধ্যযুগের রোমান চার্চের গোপন সব ছিদ্র দিয়া যেসব ভয়াবহ অজাচার ও অপরাধ সংঘটিত হইছিল সেই সময়, যা চাপা দেওনের চেষ্টা করা হইছিল তখন, তার সব নগ্নভাবে বাহির হইয়া পড়ে। এই নগ্নতা বাইবেলের জেনেসিস ও খ্রিস্টবাদের সিনটেক্সগুলাকে নানাভাবে প্রশ্ন করতে থাকে, যেইটা ‘রৌজ’-এর দার্শনিকি ভিত্তি হইলেও হইতে পারে।
মোদ্দা কথা একো একটা উপন্যাসই লিখে শেষতক যার মধ্যে থ্রিলারের আমেজ থাকে, কিন্তু পরিশেষে ‘রৌজ’ যা হইতে চায় সেইটা হইছে প্রত্নতত্ত্বে–পরিণত–হওয়া টেক্সটের পুনরুদ্ধার। জনৈক ধর্মযাজক ইতালিয় ভাষায় যে-বিবরণ লিখছিল সেইটা হইছে আদি টেক্সট। এই টেক্সট ফরাসিতে অনূদিত হয় এবং একাধিক ভার্শন সময়ের লগে তৈরি হইতে থাকে। আর্কাইভ্যাল টেক্সটগুলার মধ্যে সময়ের স্পেসগুলা বহমান বলে একো-র সেইটা না নিয়া উপায় থাকে না এবং সে-কারণে ‘রৌজ’ যতখানি নভেল বা উপন্যাস ততখানিই Hermeneutics বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞান; — এইটার স্বত্ব যতখানি একো-র ঠিক ততখানি সেই যাজক, অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারগোও বটে; একটা সম্মিলিত লিখনপ্রক্রিয়া যার বদৌলতে গ্রন্থাগারের গোপন কুঠুরি হইতে মধ্যযুগের ইতিহাস নতুন একখান চরিত্র নিয়া বর্তমানে প্রাসঙ্গিক হইতে থাকে।
পুরান টেক্সট নতুন করে লেখার প্রক্রিয়া হইছে ইনভেস্টিগেশন এবং এভাবে হয়ত সেইটা থিসিস; যার মধ্য দিয়া মৃত টেক্সটের ভিতরে সচল কিন্তু বন্দি ভূতগুলা দেহ ধারণ করে ও লোকে তাদের দেখতে পায়। রবিকবির দুর্দিনে পাউন্ড-এলিয়টরা এই কাজটা তখন করে উঠতে পারেন নাই। তো যা–ই হোক, বৈদেশে লেখকরা কুড়ির দশকের অন্ত্যভাগে পৌঁছে যখন মোটের উপরে রবি সম্পর্কে ফিলিংস হারাইতে শুরু করছেন তখন সেখানে ব্যতিক্রম হইয়া আসে একজন এবং তিনি লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন। ভিয়েনা সার্কেলের পাঠচক্রে বন্ধুগো সাক্ষাতে ‘ট্র্যাকটেটাস’ পাঠ ও এর সারবস্তু নিয়া বাতচিতের মৌহূর্তিক ক্ষণে রবিকবির কথা তাঁর ইয়াদ হয়; অথবা এভাবে কওন যায় :— উপায়ান্তর নাই বুঝে টেগোরকে সে ইয়াদ করতে বাধ্য হইছিল সেদিন।
ভিটগেনস্টাইনের সঙ্গে রবির কস্মিনকালে দেখাসাক্ষাৎ ঘটছিল এমন কথা ইতিহাস লেখে না। বাতচিত দূরে থাক, অস্ট্রিয়দেশি দার্শনিকের কাজের ধারা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল বইলা মনে হয় না। আমার অন্তত সে-খবর জানা নাই। অন্যদিকে ভিটগেনস্টাইনের ভাবজগতে রবি ছিল একখান ফুটনোট; অবহেলায় পইড়া থাকা সূত্র বা অনুচ্ছেদ; পাঠক হয়ত চকিত মুহূর্তে সেইটা নজর করে এবং পরক্ষণে ভুলে যায়। ভিটগেনস্টাইনের চিলেকোঠার দেরাজে অবহেলায় ঠেস দিয়া রবি পইড়া থাকে দীর্ঘকাল। অনুমান হয় গীতাঞ্জলিও সেখানে ওইভাবে পড়ে ছিল। মাঝেমধ্যে হয়ত হাতে নিয়া উল্টাইছে এবং পরে রাইখাও দিছে। ভিটগেনস্টাইনের জিগরি দোস্ত পল এ্যাঞ্জেলম্যান-র দেওয়া উপহার ‘রাজা’ (The King of the Dark Chamber) নাটকখানার দশা সেখানে ব্যতিক্রম হওনের কারণ ছিল না। ইতিহাসে লেখে বহিখানা কৌতূহল বশে সেদিন তাঁর হাতে উঠছিল। নাটকে টেগোর যে-ভাবনার অবতারণা ঘটায় প্রথমপাঠে সেইটা ‘বেশ’ (Interest Thought) মনে হইলেও তাঁর র্যাশনাল মাইন্ড সে-ভাবনার খেই তখন ধরতে পারে নাই। জিগরি দোস্তকে লেখা পত্রে ভিটগেনস্টাইন তাই কমেন্ট করে:-‘টেগোরের নাটক পাঠের পর মনে হইল জ্ঞান জিনিসটা বরফের বাক্স হইতে দুম কইরা বাহির হইছে একদিন।’ যদিও ফিরতি উত্তরে যোগ করছিল :— অনুবাদের কারণে হইতে পারে ভাবনা-উদ্দীপক মনে হওয়া সত্ত্বেও টেগোর তাঁর মধ্যে আবেগ জাগাইতে পারে নাই এবং এইটা ভালো লক্ষণ না।
ইতিহাস আরও লেখে ভিটগেনস্টাইন নিজের এই অনুভূতি থিকা পরে সরে আসছিলেন। আরেক জিগরি দোস্ত লুডভিগ হ্যানসেল-কে লেখা পত্রে জানাইতে দ্বিধা করে না টেগোরের ‘রাজা’ নাটকে ‘মহান কিছু একটা ঘটছে’ বইলা তাঁর মনে প্রত্যয় জাগছে। ভিটগেনস্টাইন কী হেন কারণে নিজের মত চেঞ্জ করছিল সে-ব্যাখ্যা এইসব ঘটনা যিনি লোকের নজরে নিয়া আসছেন সেই ভারতীয় গবেষক চারিথা হেরাথ নিশ্চিত করে বলতে পারেন নাই। ‘রাজা’ নিয়া ভিটগেনস্টাইনের মত পালটানোর কারণ খুঁজতে গিয়া হেরাথ অগত্যা নিজের অলোচনায় নাটকের থিমকে সামনে নিয়া আসছেন। তাঁর মতে যেসব ‘গোপন কুঠুরি’-র (Private Chamber) মধ্য দিয়া গমনাগমনের ফলে ভাষা বোধগম্য ও বোধের অগম্য উভয় মনে হইতে থাকে সেই জটিলতা টেগোরের নাটকে ধরা পড়ছে বুঝে ভিটগেনস্টাইন হয়ত পরে মত পালটাইছেন।
রবিকবির সংকেতের জগৎ নামে বিদিত এই নাটকে অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি রানি সুদর্শনা কস্মিনকালে চোখের দেখাও দেখে নাই এমন একখান রাজার সঙ্গে নিজেকে ডায়ালগে লিপ্ত হইতে দেখে। সে-রাজা আবার নাটকের শুরু থিকা শেষ অবধি অদৃশ্য, সূক্ষ্ম আর বায়বীয়ই থাকে। ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী যক্ষপুরীতে স্বেচ্ছাবন্দি রাজাকে উচ্ছল প্রাণশক্তির জোয়ারে ভাসিয়ে ঘরের বাইরে পা দিতে বাধ্য করেছিল। ‘রাজা’ নাটকে কুঠুরিবন্দি সুদর্শনা ঠাহর করতে পারে না সে আসলে কার লগে কথা কয়! গন্ধর্ব বা রাক্ষস মতে কে বা কারা তার বিবাহে ষড়যন্ত্রে করে! তার মনে সন্দেহ জাগে, যে-লোকটার খবর অন্ধকার কুঠুরির ভিতরে তার কাছে নিত্য পৌঁছায় এবং যার সুরতখান রূপেগুণে অতুল বইলা মনে বিশ্বাস জাগছে সেই লোক কী সত্যি সের’ম দেখতে? সুদর্শনা তাই নিজেকে জিগায় :— ‘রাজা’ কি সত্যি আমার লগে কথা কয় নাকি সে একখান মায়া?
অদৃশ্য ক্যারেক্টার হইয়া ‘রাজা’ নামের লোকটা কাহিনির লগে-লগে ঘুরে এবং তার সঙ্গে কুঠুরিবন্দি সুদর্শনাকে ঘুরতে বাধ্য করে। সময় যদিও আসে যখন অদৃশ্য অথবা বাস্তব সে-প্রতিমূর্তির লগে ডায়ালাগবাজির অভিজ্ঞতা সুদর্শনাকে শেখায় :— রূপরহস্যের অতুল চোরাটান দিয়া যারে সে দেহের বাঁধনে বাঁধতে চায় অথবা রূপের জোয়ারে ভাসিয়ে যে তার চিত্তে নিত্য আসে-যায় সে হয়ত সুদর্শনার দেহমনে জাগ্রত বিগ্রহ! যদি তা-ই হয় তাহলে তার জন্য নিজেকে রূপবতী ভাবনের দরকার নাই। ‘রাজা’ নামে লোকটাকে রূপবান ভাবাও অপ্রয়োজন। হৃদয়ে যে আপনা হইতে খেলে সে তার নিজের সহজতায় ‘অনুপম’। তাকে দেখার কি কাম? শুধু অনুভবে টের পাইলেই হয় :—
সুদর্শনা। প্রভু, যে আদর তুমি কেড়ে নিয়েছ সে আদর আর ফিরিয়ে দিয়ো না। আমি তোমার চরণের দাসী, আমাকে সেবার অধিকার দাও।
রাজা। আমাকে সইতে পারবে?
সুদর্শনা। পারব রাজা, পারব। আমার প্রমোদবনে, আমার রানীর ঘরে তোমাকে দেখতে চেয়েছিলুম বলেই তোমাকে এমন বিরূপ দেখেছিলুম-সেখানে তোমার দাসের অধিক দাসকেও তোমার চেয়ে চোখে সুন্দর ঠেকে। তোমাকে তেমন করে দেখবার তৃষ্ণা আমার একেবারে ঘুচে গেছে। তুমি সুন্দর নও প্রভু, সুন্দর নও, তুমি অনুপম।
রাজা। তোমারই মধ্যে আমার উপমা আছে।
সুদর্শনা। যদি থাকে তো সেও অনুপম। আমার মধ্যে তোমার প্রেম আছে, সেই প্রেমেই তোমার ছায়া পড়ে, সেইখানেই তুমি আপনার রূপ আপনি দেখতে পাও। সে আমার কিছুই নয়, সে তোমার। [রাজা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
অন্তর-বিগ্রহ রূপে সুদর্শনার চিত্তে চিরজাগরুক এই ‘রাজা’-ই হয়ত রবিকবির সেই ‘পরব্রহ্ম’ যার তালাশ সে করে জীবনভোর! ‘খেয়া’ কাব্যের ‘আগমন’ কবিতাটা লেখার সময় রবির মনে যার উদয় ঘটছিল :— ‘ওরে দুয়ার খুলে দে রে / বাজা শঙ্খ বাজা, / গভীর রাতে এসেছে আজ / আঁধার ঘরের রাজা। / বজ্রডাকে শূন্যতলে, / বিদ্যুতেরি ঝিলিক ঝলে, / ছিন্ন শয়ন টেনে এনে / আঙিনা তোর সাজা, / ঝড়ের সাথে হঠাৎ এল দুঃখ রাতের রাজা।’
ভাষার গোপন কুঠুরি দিয়া বাস্তবতার স্বরূপ মানুষের বোধ-অনুভবের জগতে কেমনে আসে-যায় এবং যুক্তির পক্ষে সেই বাস্তবতাটারে একাধারে অবোধ্য ও বোধগম্য করে, টেগোরের ‘রাজা’-র মধ্যে এর একখান প্রতিচ্ছবি ভিটগেনস্টাইন হঠাৎ আবিষ্কার করে বসে! একটা লোক জগৎ-সংসারকে নিজের দেহমনের চোখ দিয়া ততদূর অবধি দেখতে পাইছে বইলা একিন যাওয়া যায়, যতদূর অবধি তার ভাষা সে-জগতের বিবরণ দিতে পারে :— ‘The limit of my laguage is the limit of my world.’ বিবরণ যতটা সে দিতে পারছে এর সবটাই যুক্তির পক্ষে তাই বোধগম্য হওয়া উচিত। সুতরাং সেই বিবরণ নিয়া লোকের বাতচিত-যুক্তিতক্কো কিংবা স্বীকার-অস্বীকার যাওয়ার খেলাগুলা সেখানে বৈধ। ভিটগেনস্টাইনের বচনে এইটা হইছে Sensical এবং সে-কারণে ভাষার এই পরিধিকে র্যাশন্যাল বইলা সে মানে।
লোকটা নিজের দেহমনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়া যা দেখছে ও ফিল করছে সেইটা ভাষা দিয়া বর্ণিবার পারে নাই অথবা খেই হারাইছে, এমন ঘটনা যুক্তিতর্কের পক্ষে বোধগম্য স্বীকার যাওন মুশকিল। এই বিবরণটা তাই Nonsensical, অর্থাৎ যুক্তিবোধের বাইরে সক্রিয় এমন কিছু যা আপাতভাবে মিস্টিক বা মরমি হইতেও পারে। ভিটগেনস্টাইন এই মরমিত্বকে তাঁর দর্শনের জায়গা থিকা ইগনোর করে। অস্বীকার যায় এমন না, তবে ভাষা দিয়া বোধগম্য করা ও যুক্তি দিয়া বৈধ করা যেহেতু কসরতসাধ্য সেহেতু Meta Language বা ‘পরাভাষা’ হিসেবে এর বিচার হইতে পারে; যেমন ঈশ্বর কিংবা রবিকবির ‘পরব্রহ্ম’ ইত্যাদি। এই পরাভাষায় গমনের পর বাস্তব জগৎ সত্য না মিথ্যা ইত্যাদি যেমন প্রমাণ-অপ্রমাণ করা কঠিন হয়, আবার ‘পরাভাষা’ নিজ হইতে যে-ভাষার জন্ম দিয়া যায় সেইটা অন্যভাবে নিজেকে র্যাশনাল প্রমাণের স্পেস খুঁজতে থাকে এবং লোকের বোধ-অনুভবের পক্ষে Sensical হওয়ার কোশেশ করে। ভিটগেনস্টাইন পরাভাষার Sensical হওয়ার বিষয় নিয়া বেশি বাক্য খরচের পক্ষপাতি না, কারণ এইটা তাঁর ভাষাদর্শনের মূল প্রতিপাদ্যকে ডিনাই করে :— ‘Everything that can be thought at all can be thought clearly. Everything that can be said can be said clearly.’ অর্থাৎ সমুদয় যা-কিছু অন্তত ভাবা যাইতে পারে মনে হয় তা পরিষ্কার ভাবতে হবে। সমুদয় যা-কিছু ব্যক্ত করা যায় বইলা মনে হয় সেইটা পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত হইতে হবে।
‘পরাভাষা’ যে-কারণে ভিটগেনস্টাইনের কাছে সেই গোপন কক্ষ যেখানে গমনের পর ‘রাজা’ নাটকের সুদর্শনার মতো ভাষা নিজেকে অন্তরীণ হইতে দেখে এবং নিজের লগে অবোধ্য স্বরে বাতচিত করতে বাধ্য হয়। এই পরিস্থিতি যুক্তি ফাঁদিয়া মোকাবিলা করন যায় না। যুক্তির ভাষায় কথা কইতে গেলে সেইটা আরও দুর্বোধ্য ও মস্তিষ্কের যুক্তিকেন্দ্র হইতে আগত ভাষাবোধের সাপেক্ষে প্রহেলিকায় পরিণত হয়। সুতরাং মৌনব্রত অবলম্বন সেখানে উত্তম মনে হইতে থাকে :— ‘Whereof one cannot speak, thereof one must be silent.’ যে-অভিজ্ঞতার উপরে ভর করে লোকে কিছু কইতে চায় সেইটা যখন সে বুঝাইয়া কইতে পারে না তখন সেই লোক ও যে তার কথা শোনে দুজনের সেখানে অফ যাওন উচিত।
‘অফ যাওনের’ সূত্রে প্রশ্নটি ওঠে, ঘটনা যদি তা-ই হয় তবে কী কারণে রবিকবির ‘রাজা’ নিয়া ভিটগেনস্টাইন পরে এমন উচ্ছ্বসিত আওয়াজ করছিল? ভিয়েনা সার্কেলের দোস্তগো মধ্যে ‘ট্র্যাকটেটাস’ নিয়া বাতচিতের তুঙ্গ মুহূর্তে সে পকেট থিকা ‘গীতাঞ্জলি’ বাহির করে ও পড়তে থাকে, এবং পাঠ শেষ হইলে নীরবে সেখান থিকা প্রস্থান করে; — কিন্তু কেন? উত্তর হয়ত এই :
ভাষার মধ্য দিয়া একটা লোকের অভিজ্ঞতার বিবরণ পেশ শুধু বাস্তবে বিদ্যমান বা ঘটছে বইলা প্রতীয়মান হয় এমন জিনিসের যোগফল নাও হইতে পারে। বাস্তবে হয়ত সেই জিনিসটাই নাই, সেই ঘটনাটা ঘটে নাই, অথবা জিনিস ও ঘটনার রকমফের দুর্বোধ্য আকৃতি নিয়া ওই লোকের মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল এবং তারপর থিকা কথা বাহির করার চেষ্টায় আছে! সমস্যা হইল লোকটা সেই কথাগুলা সাজাইয়া-গোছাইয়া বলতে পারে নাই না অথবা বলতে গিয়া খেই হারানোর কারণে তারে এখন ভাষাহীন আহাম্মক বোধ হইতেছে। এমন হইতে পারে, উপায়ান্তর নাই দেখিয়া কল্পনার সাহায্যে ভাষার ‘গোপন কুঠুরি’–র মধ্যে যা ছিল অর্থাৎ তার বেবাক অনুভূতি বা কথাগুলা সে বমন করতে সক্ষম হইছে! সুদর্শনা যে-কাজটা করছে ‘রাজা’ নাটকে। এই বমনের মধ্য দিয়া জগৎ একখান ঘটনা রূপে বাকিগো নজরে প্রতিভাত হয়। ভাষা না থাকার মানে হইছে ‘স্ব-চেতনসত্তা’ (Conscious Self) মৃত আর ‘স্ব-চেতনসত্তা’ মৃত হওনের পর অস্তিত্বের জান্তব স্রোত অর্থাৎ ‘চৈতন্য বা চেতনা বা চেতনসত্তা’ (Awareness) ছাড়া কিছু জারি থাকে না।
অস্তিত্বের জান্তব স্রোত বা চেতনসত্তা হইছে সেই জগৎ যেখানে রবিকবির ‘রাজা’–র সুলুক হয়ত পাওয়া যায়। রাজা মেশিনের মতো সেখানে সক্রিয় থাকে। চেতনসত্তা হইছে অব্যক্তদশা, ভাষা যার বিবরণ দিবার পারে না। অব্যক্ত সেই স্রোতে সকলেই রাজা :— ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে— / নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?। / … রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান, / মোদের খাটো ক’রে রাখে নি কেউ কোনো অসত্যে— / নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে? / আমরা চলব আপন মতে, শেষে মিলব তাঁরি পথে, / মোরা মরব না কেউ বিফলতার বিষম আবর্তে— / নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?।’
এই রাজা শাশ্বত ও চিরবিদ্যমান আর সে-বিদ্যমানতাই তার ভাষা। চেতনসত্তার এই ‘পরাভাষা’ মানুষের বোধের জগতে কেমনে প্রবেশ করে সেই উদাহরণ হইয়া রবিকবির ‘রাজা’ ও ‘গীতাঞ্জলি’ একদিন ভিটগেনস্টাইনের দেহে প্রবেশ করতে সক্ষম হইছিল। নিজের দেরাজ থিকা সে রবিকবির ভূতগুলারে কান্ধে উঠায় এবং দোস্তগো লগে বাতচিতের ক্ষণে সেইগুলারে কান্ধ থিকা নামাইতে থাকে। বন্ধুগো হয়ত সে বুঝাইতে চায় :—
জটিলতার ফেরে ভাষার পরিধির লগে তাল দিয়া জগতের পরিধিটা বৃদ্ধি পায় এবং সে-কারণে এই পরিধির প্রকাশ-বিকাশ ইত্যাদি অনেকসময় যুক্তির অগম্য মনে হইলেও সেইটা হয়ত যুক্তিহীন না। এইটারে বড়জোর Nonsensical কওন যাইতে পারে; অর্থাৎ লোকটির স্নায়বিক বোধের জগৎ ভাষা দিয়া তারে ঠিকমতো কল্পনা-ব্যাখ্যা বা পরিষ্কারভাবে সবকিছু ব্যক্ত করাইতে পারে নাই। যদিও এতে এইটা প্রমাণ হয় না, এখন Nonsensical হওয়ার কারণে কাল সেই লোকটার কথাগুলা Sensical হইতে পারবে না। হইতেও পারে। টেগোর তাঁর ‘রাজা’-য় ঘটনাটা ঘটাইতে পারছিল। অন্ধকার কুঠুরিতে বইয়া সুদর্শনা নিজের কল্পনার জগতে যে-রাজা ও পাত্রপাত্রীগো নিয়া খেলা করে সেই খেলা শেষতক ‘পরব্রহ্ম’-র সঙ্গে তার বোঝাপড়ার স্বরূপ নিয়া যেহেতু প্রকাশ্য হইতে পারছে সেহেতু এইটা এখন বাস্তবতার অংশ একখান ঘটনাও বটে।
ভিটগেনস্টাইন হয়ত সে-কারণে ‘ট্র্যাকটেটাস’ আরম্ভ করে এই প্রবচন দিয়া :— ‘The world is the totality of facts, not of things.’ মিথ্যা নয়, ফ্যাক্টস-ই শেষতক ঘটনায় ভাষা পায় এবং ‘পরব্রহ্ম’-র মতো বায়বীয় পরাভাষাকে যুক্তির আয়তনে বৈধ হাজির করতে চায়। জগতে মিথ হইতে ধর্ম, আল্লা-ভগবান হইতে রবিকবির ‘পরব্রহ্ম’ মানুষের পৃথিবীতে নিজের Space দখল করে এবং বাস্তবতার উপাদানরূপে গণ্য হইতে থাকে। যে-কারণে পশ্চিমের পাউন্ড-এলিয়ট হইতে বাঘা সাহেবরা রবি সম্পর্কে নীরব হওনের পর এইটা বোধহয় কওন যায় :—
তাঁরা এই সেইন্টের ভাষাজগৎ উপরকাঠামো থিকা রিড করেন ও একসময় নিজেগো বাস্তবতায় সংঘটিত ঘটনাবলির সাপেক্ষে তাঁরে প্রীতি জানান; সময়ের লগে ঘটনার ধারা পাল্টাইতে থাকে এবং সে-রূপবদল তাঁদের চিন্তা ও ভাষাবোধের জগতে যে-পরিবর্তন ঘটায় সেইটার সাপেক্ষে রবিকবির লগে সংলাপে যাওনের রাস্তা তাঁদের কাছে ক্রমেই অগম্য ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হইতে থাকে; যেহেতু তাঁরা আদপে কখনওই রবির ভাষাজগৎ যেসব ফ্যাক্ট বা ঘটনাবলির ভিতর দিয়া গঠিত হইছিল অর্থাৎ ভারতীয় সেই কনটেক্সট-এর ভিত্তিকাঠামোয় ঢুকতেই পারেন নাই।
উনারা যে-কামটা করতে ব্যর্থ হইছিলেন বিধি ভিটগেনস্টাইনরে দিয়া সেই কাম ঠিক সারছে। ভিয়েনার দোস্তরা রবিপাঠের শেষে তাঁরে কয় :— ‘টেগোর পাঠ করতে গিয়া নিজের পায়ে তুমি কুড়াল মারছ বন্ধু। হের কবিতাগুলা তো ‘ট্র্যাকটেটাস’-এ যে-কথা তুমি বলতে চাইছ এর বিরুদ্ধে যায়।’ ভিটগেনস্টাইন কেন সেদিন উত্তর করে নাই সেইটা এই আলাপের পর পাঠকরা আশা করি ধরতে পারবেন। অনুমান করি, পাঠচক্র হইতে প্রস্থানের সময় সে এই কথা বিড়বিড় করতেও পারে :—
তোরা থাক তোদের বুঝ নিয়া। টেগোর আমি কেন টানছি সেইটা বোঝার সময় এখনও আসে নাই। আমার বহিখানা খালি অ্যানালিটিক্যাল ফিলসফির খোরাকি না। এই বহি ভাষার সাপেক্ষে জগতের সীমানা নিয়া কথা কওনের সময় ‘পরাভাষা’ বা মেটাল্যাঙ্গুয়েজটারেও রিড করে। লোকে একদিন এইটা ঠিক বুঝব।
যা-ই হোক, লম্বা এই প্রসঙ্গে আপাত ইতি দিয়া রবিকবির ‘পরব্রহ্ম’ নিয়া শুরুতে যা কইতে চাইছিলাম সেই মূল জায়গায় আবার ফিরি।
চলবে
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS