রবিকবির পরব্রহ্ম ২ || আহমদ মিনহাজ

রবিকবির পরব্রহ্ম ২ || আহমদ মিনহাজ

দুসরা বাখান : মানবিক বনাম পলিটিক্যাল রবি; আমহিন্দুর ‘পরব্রহ্ম’ : সগুণ-নির্গুণে কাটাকুটির খেইল
‘পরব্রহ্ম’ রবিকবির ‘জীবনদেবতা’ এবং তাঁর আদি বা প্রথম সত্তাও বটে। মনে রাখা দরকারি, বিগ্রহ ও প্রতিমা-উপাসনার বাহানায় ‘পরব্রহ্ম’য় নিজেকে শরিক রাখনের পন্থা রবি তাঁর অন্তরের অন্তস্থল থিকা কদাপি স্বীকার যাইতে পারে নাই। ভূবর্ষে হোমড়াচোমড়া হইতে দলিত বা প্রান্তিক নির্বিশেষ প্রতিমা-উপাসনার মধ্য দিয়া নিরাকারে গমনাগমনে অভ্যস্ত। ভারতীয় হিন্দুত্বের ওইটা হাজার বছরের ধারা। যে-কারণে বেদ-উপনিষদ-গীতা ছাপাইয়া পুরাণ আর মনু-র বিধান হিন্দুত্বের মূলমন্ত্র হইছে সেখানে। ‘পরব্রহ্ম’ তো অতিকায় ভাবের জিনিস! জগতের কার্যকারণ রূপে ব্রহ্মকে যে-ব্যক্তি ভাবতে পারে তার দেহমনে তখন এই বোধ জন্ম লয় :—

সে-মানুষটা ব্রহ্মের মধ্যে বিরাজিত এবং ব্রহ্ম স্বয়ং বিরাজিত তার নিজের মধ্যে। সাকার এই দেহ হইছে রূপের খনি যার মধ্য দিয়া ব্রহ্ম নিজেকে নজর করান; আবার দেহ বিনষ্ট হওয়ার পরে সদা সক্রিয় কিন্তু আকাঙ্ক্ষাশূন্য নিরাকার জগতে জীবের গতি হয় এবং সেই নিরাকার ব্রহ্ম-ই হন বটে।

হেগেল তাঁর ‘যুক্তির বিজ্ঞান’ বহিতে নিখিল নাস্তির (Ultimate Nothingness) জগৎ হইতে অস্তিত্বের আগমন কেমনে ঘটে সেই সুলুক করছিলেন। তাঁর সে-সুলুকের লগে ব্রহ্ম মৃদু হইলেও সাদৃশ্য ধরে এইটা বোধহয় ভাবা যায়। বিগ ব্যাং অর্থাৎ বৃহৎ বিস্ফোরণ ঘটার পর নাস্তিসদৃশ শক্তিপুঞ্জের বোঝা নিয়া সম্প্রসারিত মহাবিশ্ব অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্ব এবং অস্তিত্ব থিকা অনস্তিত্ব-এ গমনাগমনের খেলা কী করে জারি রাখে ইত্যাদি নিয়া অধুনা পদার্থ ও মহাকাশ বিজ্ঞান যেসব কাহানি গায় তার লগে বেদের ব্রহ্মসূত্র মাঝেমধ্যে অভিন্ন ভ্রম হয়। ভারতীয় বৈদিক চিহ্নসূত্র যেমন এই ধারণা জাগায় :— জীবের অর্থাৎ দেহধারী সত্তার বিনাশ অনিবার্য হইলেও জীবনের বিনাশ নাই! জীবন হইতেছে সেই চেতনসত্তা যা জান্তব স্রোতের মতো অন্তহীন ও সক্রিয় থাকে সর্বক্ষণ।

ভারতীয় বৈদিক দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ মাধবাচার্যের ‘ব্রহ্মসূত্র’ নিয়া ব্যাখ্যা বা তফসির হয়ত সে-কারণে পরব্রহ্মকে গণিতের ‘শূন্য’ (০) সংখ্যা দিয়া ব্যাখ্যা করতে আগ্রহী হইছিল। ‘শূন্য’ সংখ্যাটারে মৌলিক ও অবিভাজ্য সংখ্যা যেমন ১, ৩, ৫ ইত্যাদির মতো নির্দিষ্ট গাণিতিক মান বা কোয়ান্টিটির সাপেক্ষে ভাবা সম্ভব হয় না। তথাপি অবিভাজ্য সংখ্যার লগে ‘শূন্য’ সংখ্যাটির সংযোগ হইতে নতুন গাণিতিক মান বা ভ্যালু (যেমন যৌগিক সংখ্যা) এমনকি অসীম মূলদ-এ (যেমন পাই) পৌঁছান সম্ভব। ‘শূন্য’ সেখানে নিজ হইতে কোনও গাণিতিক মান সৃষ্টি করে না কিন্তু ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবক হইয়া নতুন মান সৃষ্টিতে নিজের ভূমিকা রাইখা যায়।

যে নিজে কোনও ভ্যালু সৃষ্টি করে না অথচ রিয়েল নাম্বারগুলার (১ থেকে ৯) যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ হইতে নতুন ভ্যালু সৃষ্টির খেলা যারে ছাড়া সম্ভব না সেই ‘শূন্য’ মাধবার্যের তফসিরে ‘পরব্রহ্ম’-র দ্যোতক হইয়া উঁকি মারে। ‘শূন্য’ হইছে গণিতের সেই সংখ্যা যার গাণিতিক মান বা ভ্যালু ঠিক কত হইতে পারে সেটার কিনারা কেউ আজও করতে পারে নাই এবং মাধবাচার্য যেহেতু চালাক আছিলেন তিনি এই গণিতের ‘শূন্য’ দিয়া ‘পরব্রহ্ম’ কেমন হইতে পারে সেইটা লোকের নজর করান। যদিও তাঁর দ্বৈতবাদ ‘পরব্রহ্ম’কে কেন নিরাকার ভাবে না এবং পৌরাণিক ভগবান বিষ্ণু হইতে শুরু করে জীবের দেহ গত হওয়ার পর স্বর্গ-নরক ইত্যাদির প্রাসঙ্গিকতা বৈধ বলতে চায় সেইটা ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং এই আলোচনায় আপাতত অপ্রাসঙ্গিক।

বিখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্কর প্রমাণ করছিল ‘শূন্য’ দিয়ে কোনো সংখ্যাকে ভাগ করলে তার ফলাফল ‘শূন্য’ না হয়ে ইনফিনিট বা অসীম হবে; এমনকি গুণ করলেও ফলাফল অনুরূপ হওনের কথা। সরল গণিত জ্ঞানে আমরা জানি ‘শূন্য’ দিয়া সংখ্যাকে গুণ-ভাগ করলে ফলাফল শূন্যই আসে; এখন রিয়েল নাম্বারগো মতো নির্দিষ্ট কোনও মান না থাকনে গণিত এই শূন্যকে ‘কিছু নাই’-র পরিবর্তে Infinite Probability-র জায়গা থিকা পড়ে এবং অনির্দিষ্ট হইতে অসীম মান সৃষ্টির কামলা খাটায়। উপনিষদের ব্রহ্ম ঠিক এই জায়গা হইতে শূন্যের দ্যোতক বইলা বিদিত হইছেনলজিকটা হইল ‘পরব্রহ্ম’-র স্বরূপ অজানা ও অনির্দিষ্ট হওনের ফলে তার কোনও ভ্যালু বা মান নির্ণয় সম্ভব নয়। সগুণ বা দেহধারী জিনিসের মান সম্ভব হইলেও সগুণ যখন নিগুর্ণে বিলীন হইতে থাকে তখন তার মান অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চিত হইয়া ওঠে। সে তাই গণিতের ‘শূন্য’; কোনও মান নাই কিন্তু অসীম, চিরন্তন ও একক ‘চেতনাসত্তা’ রূপে জগতে যারে বিদ্যমান ভাবা যায়

মাধবাচার্যের তফসির এই যুক্তির উপরে ভর করে গৌতম বুদ্ধের নির্বাণকে যারা ‘শূন্যবাদ’ অর্থাৎ নিখিল নাস্তির মধ্যে দেহের গমন ইত্যাদি অভিধায় দাগাইতে চান তাঁদের লগে তর্ক জুড়ে। তাঁর মতে বুদ্ধ ‘শূন্য’ বলতে মোটেও নাস্তি বা কিছু নাই ইত্যাদির মধ্যে দেহের সমাধি মিন করেন নাই। ‘নাই অথবা নাস্তি’র মধ্যে দেহ অর্থাৎ কায়ার সমাধি লাভের অর্থ হইছে নির্গুণ সে-সচলতায় তার অবস্থান যে-কিনা গণিতের ‘শূন্য’ সংখ্যার মতো ক্যাটালিস্ট বা প্রভাবকে পরিণত হয় এবং সেই রূপে জগতে সক্রিয় থাকে; সোজাকথা সাকার বা সগুণাত্মক দেহের ‘শূন্য’-এ গমন মানে ‘নাস্তি’র মধ্যে নির্গমন নয়, সে নিরাকার বা নির্গুণ এক জগতের অংশ যার কোনও জন্ম-মৃত্যু-বিনাশ ঘটনের চান্স নাই। নিরাকার এই জগৎ হইতেই দেহধারী সাকার জগৎখানের উৎপত্তি ঘটে এবং বিলয় সে-জগতেই হয়। এই নিরাকারকে ‘নাস্তি’ বা ‘শূন্য’কে সেই ‘নাস্তি’র দ্যোতক বইলা ধ্যান করলে সত্তা কেমনে অস্তিত্ব লাভ করে ও অনস্তিত্বে অদৃশ্য হওনের পর তার কী গতি হয় সেই ধাঁধার উত্তর জটিল হইয়া উঠতে থাকে।

মাধবাচর্যের ‘শূন্য’ হইছে বিজ্ঞানের ধাঁধার দার্শনিক বাখান:-শক্তির অসীম ঘনীভূত পুঞ্জে পরিণত হওনের আগে মহাবিশ্ব কোন অবস্থায় ছিল? বিগ ব্যাংয়ে পৌঁছানোর জন্য সে কি কোনও এক পর্যায়ে প্রসারণ থেকে সঙ্কুচিত হইতে শুরু করছিল? মহাবিশ্বকে যদি মাধবাচার্যের ‘শূন্য’ বইলা ভাবি তাইলে বিজ্ঞানের হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্নগুলার আপাত সুরাহা ঘটান যায়। অথবা সে-মহাবিশ্বকে যদি হাইডেগারের Beginingles beginnings of ‘beings’ যে-কিনা যুক্তি-অনুমান ইত্যাদির মধ্য দিয়া মাপা ইতিহাসছকের (Historiological) বাইরের ইতিহাসে (Historicity) নিজেকে সক্রিয় রাখছে সেই জায়গা থিকা দেখলে মহাবিশ্বের কোনও উৎপত্তি বা বিনাশ নাই এইটা মানতেই হয়।

এই মহাবিশ্বের লয়-বিলয়-শুরু-সমাপ্তি কিছু নাই। সে একটা ‘শূন্য’ কিন্তু সচল ‘পরব্রহ্ম’ রূপে চিরকাল ধরে বিদ্যমান জগতে। চিরবিদ্যমানতার এই উপলব্ধির চক্কর হইতে ওশো রজনীশ একদিন উক্তিটি করছিল :— ‘I am actually present in the absent.’ অর্থাৎ দেহধারী জীব রূপে যে-জগতে সে এখন উপস্থিত সেইটা তার স্থূল রূপ বা কায়া; দেহ বিনাশের পরে এই জগতে সে থাকে কিন্তু তখন তাঁরে আর একখান মানুষ বইলা চিনা যায় না; এই না-মানুষটা হইছে তার ‘সূক্ষ্ম’ রূপ এবং সেটাই নির্গুণ। ‘পরব্রহ্ম’ উপলব্ধির অন্যতম সারকথা ওশোর উক্তির মধ্যে চিরায়ত রূপ পাইছে বলা যায়।

বৈদান্তিক ব্রহ্মের সৃষ্টি ও বিনাশ নাই বইলা দেহধারী জীব অনিত্য অতিক্রম করে নিত্য বা চিরন্তন-এ অটল হইতে পারে। সাকার ও সগুণ রূপে জগতে লীলাখেলা করার পর মানুষের দেহ ক্ষয় হইতে থাকে এবং নির্গুণ দশায় তার গমন ঘটে। নির্গুণ হইছে সেই অবস্থা যেইটা চিরন্তন কাল থিকা বিদ্যমান থাকার কারণে কালাতীত; সে ছিল, সে আছে এবং ভবিষ্যতে না-থাকনের কারণ নাই সুতরাং নশ্বর রূপের জগৎ ব্রহ্মকে নজর করানো সত্ত্বেও ওইটা হইছে মায়া। রূপের বিলোপ ঘটার পরে যে-অবস্থায় তার দেহের বিলয় ঘটবে সেইটা নিত্য বা ‘পরব্রহ্ম’। দৈহিক অস্তিত্বের অবসান মানে হইছে ‘পরব্রহ্ম’-এ সমাধি লাভ করে অদ্বৈত বা অভেদ রূপ ধারণ। ‘পরব্রহ্ম’ থিকা পুনরায় সে অনিত্য বা ক্ষণস্থায়ী রূপের জগতে নতুন চেহারা নিয়া ফিরা আসতেও পারে এবং ভারতীয় কনেটেক্সটে সেই জিনিসটাই পুনর্জন্ম-র সারকথা। কোন রূপ নিয়া সে ফিরবে বলা মুশকিল হইলেও গাছ-পাথর-পাথি থিকা গরু-ছাগল-মহিষ কিংবা তাগো জুড়ি মানুষ জীবনানন্দের ‘শঙ্খচিল’ হইয়া সে ফিরতেই পারে; তবে ফেরাটা হুবহু হওনের চান্স কম। সর্বোপরি ফিরনের ঘটনা নির্ভর করে ‘পরব্রহ্ম’-এ তার দেহের গতি কেমনে ঘটব তার উপরে। অবশ্য যে-লোক এই খেলাটা বুঝে ফেলছে সে ফেরত আসার বদলে সেখানে অটল থাকতেই চায়, বুদ্ধ যেমন চাইছিল একদিন :—

আমি ফিরব না রে, ফিরব না আর, ফিরব না রে— / এমন হাওয়ার মুখে ভাসল তরী, / কূলে ভিড়ব না আর, ভিড়ব না রে॥ / ছড়িয়ে গেছে সুতো ছিঁড়ে, তাই খুঁটে আজ মরব কি রে— / এখন ভাঙা ঘরের কুড়িয়ে খুঁটি / বেড়া ঘিরব না আর, ঘিরব না রে॥ / ঘাটের রশি গেছে কেটে, কাঁদব কি তাই বক্ষ ফেটে— / এখন পালের রশি ধরব কষি, / এ রশি ছিঁড়ব না আর ছিঁড়ব না রে! [গীতবিতান : ৩৩]

বিজ্ঞান যেমন এখন অনুমান করে, সলিড ম্যাটারের সূক্ষ্মতম রূপ অর্থাৎ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণার (Particle) সমাবেশে গঠিত একখান দেহধারী মানুষ দেহ রাখনের পর তার রূপময় সেই দেহ ভাঙতে শুরু করে। কণারা তখন দেহখাঁচা থিকা মুক্তি লাভের আনন্দে যেমন খুশি ধায়। ছুটাছুটির ক্ষণে তারা আরও সূক্ষ্ম থিকা সূক্ষ্ম-এ রূপ নিতেও পারে। সূক্ষ্ম রূপে গ্যাসের সাগরে বায়বীয় পরিণতি বরণের চান্স যেমন ষোলআনা থাকে সেখানে, আবার তাদের মতো দেখতে কণাগো লগে মিতালি পাতিয়ে নতুন বস্তু বা ম্যাটার তৈরির খেলায় অংশ নিলেও নিতে পারেসুতরাং ওয়ান ফাইন মর্নিংয়ে দেহ রাখনের পর এই আমি বা আপনি যদি কারও বাড়ির ধারে জিনিয়া কিংবা গোলাপ ফুল রূপে ফুইটা উঠি তাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। পুনর্জন্মের এইটা হইছে মূল কথা এবং পাপপুণ্য বা ইত্যাদি নিয়া মানুষ আরও যা যা কয় সেইগুলা মনোরম পুরাণ ও জল্পনা। যে-কারণে ওশো রজনীশ চোখ বোজনের আগে নিজের এপিটাফে লিখতে পারছিল : — ‘এই লোক কদাপি ধরায় জন্মগ্রহণ করে নাই, সে মারাও যায় নাই, পৃথিবী নামক এই গ্রহে কিছুদিনের জন্য একপাক ঘুরান দিয়া গেছে।’

তো এইরকম জটিল একখান ব্রহ্মভাব মনে নিয়া কাউরে ঈশ্বর-ভগবান-আল্লা বইলা ভাবা ও ভক্তিভরে পেন্নাম যাওয়া মুশকিল। আচার-উপাসনার ক্ষুধা মিটানো সেইখানে অর্থহীন বোধ হইতে থাকে। যে-কারণে বেদে আচারসর্বস্ব যাগযজ্ঞের অঢেল বিবরণ থাকলেও উপনিষদে পৌঁছানোর পর সেইগুলা হাওয়া হইতে শুরু করে এবং শঙ্কারাচার্য, মাধবাচার্য ও রামানুজ-র ব্যাখ্যাবিজ্ঞান অর্থাৎ তফসিরে পৌঁছানোর পর যাগযজ্ঞ রূপ নেয় মেডিটেশন বা অনুধ্যানে। এই ব্রহ্ম নির্গুণ না হইলে জগতের মৌলিক কারণ হওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। নির্গুণ হওয়ার কারণে এরে না যায় দহন, না যায় ছেদন, না কেউ নিশ্চিত করতে পারে তার মরণ। ‘গীতা’য় অর্জুনের নিকট ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ বইলা শ্রী কৃষ্ণ শাশ্বত আত্মার যে-মেটাফর তুইলা ধরে সেইটা ‘পরব্রহ্ম’ ছাড়া অন্যকিছু নয়। এমন একখান ব্রহ্ম নিয়া তাই ভাবুক হওয়া যায়, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে পুরস্কার ও তিরস্কার আশা করে যে-মানুষ তার পক্ষে এরকম একখান ‘বেহুদা’র কাছে কিছু আশা করা বৃথা। ‘বেহুদা’ উলটা তারেই কইব :— ‘তুই তো নিজেই ব্রহ্ম রে! যা চাওনের নিজের কাছে চাইবি। যা করার নিজের আকলে করবি। যা তোর পাওয়ার কথা ছিল সেইটা নিজ কর্মের দোষগুণে তুই পাবি। কর্মফলের এইটা হইছে সারকথা, বাকিটা মিছা।’ মনে রাখন প্রয়োজন এই কর্মফল বোঝানোর তাগিদ থিকা ভূবর্ষে একদিন ‘মহাভারত’-র উৎপত্তি হইছিল।

ঘোর সংসাররণে মজে থাকার কারণে যে-লোকটারে এখন অবিদ্যায় নাগ পাইছে তার জন্য ‘পরব্রহ্ম’ তাই বোধের অতীত একখান প্রহেলিকা। এই আজিবরে দেখা যায় না। ঠাহর করতে গেলে বিস্তর কাঠখড় পোহাইতে হয়! যদি নিজের দেহরে ‘ব্রহ্ম’ কইতে মন চায় তবে সেইটা উপলব্ধি করার জন্য যোগধ্যানে দেহ ক্ষয় করা লাগে। বিগ্রহের উছিলায় পাওয়া যায় না এমন নয়। শ্রী রামকৃষ্ণ কালীর উপাসনায় মজে তারে পাইছিল বইলা লোকে কয়। কিন্তু সেইখানে বিগ্রহ উপলক্ষ মাত্র ছিল। ভক্তির ছলে রামকৃষ্ণ ধ্যানে মগ্ন হয় এবং একসময় ব্রহ্মকে কালী অর্থাৎ মহাকালের উপমা হইয়া যে রাজ করে জগতে সেই মহাকালকে নিজের মধ্যে সাকার দেখতে পায়। এর জন্য তাঁরে অবশ্য সংসার ছাড়তে হইছিল।

জগতে সকল মানুষ সংসার ছেড়ে ধ্যানে ঢুকলে কে কারে খাওয়ায়! বুদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রমণগো লালনপালনের ভার একসময় বোঝা হইয়া উঠছিল দেশের জন্য। সুতরাং ভারতীয় আমজনতার হিন্দুত্ব পরব্রহ্মর লগে নিজের ফয়সালা ঘটানোর জন্য অন্য পথে হাঁটে। জনতা এই আজিবকে সুলুক করে বিগ্রহের মাঝে; আজিবের রকমফের ঘটায় ‘ব্রহ্ম বা শূন্য পুরাণ’-এ। এবং এভাবে পৌরাণিক ভগবান, দেবদেবী, অসুর-দানব হইতে শুরু করে স্বর্গ-নরকসহ তামাম মহাজগৎখানা সেখানে সুলভ কইরা তোলে কালের ধারায়। মাধাবাচার্য এই বিষয়টা ধরতে পারছিল বইলা ‘দ্বৈতবাদ’-র তফসিরে ভগবান বিষ্ণুকে পরব্রহ্মর উপমায় স্মারক করে তুলছিল।

সূক্ষ্মরূপে যে-‘পরব্রহ্ম’ জীবের স্ব-চেতনসত্তা দিয়া অনুভবের অগম্য, স্থূলরূপে সে হয়ত সেই জীবের স্ব-চেতনসত্তায় ‘ভগবান’ রূপে ধরা দেয়। বিষ্ণু-র স্থূলরূপ হইছে তার ভগবান নামক সত্তা। রামানুজের ‘দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ যেমন বিদ্যমান জগৎ কেন সত্য এবং মায়া নহে সেই বাখান দিতে গিয়া স্থূল এই দশাটারে পরব্রহ্মর ‘বিকার’ হইতে উৎপন্ন বইলা ঠাউরায় এবং তাঁর এই যুক্তি পরব্রহ্মর স্থূল রূপ হিসেবে পৌরাণিক ভগবান বিষ্ণুকে বৈধ করতে মাধাবাচার্যকে হয়ত সাহায্য করে! বিজ্ঞানে অনেকদিন ধরে এই হাইপোথিসিস নিয়া জোর তর্ক হয় : — পদার্থ অবিরত বিভাজিত হওনের পর এমন দশায় পৌঁছায় কিনা যেখানে আর বিভাজন ঘটা সম্ভব না; তো পদার্থের অভিবাজ্য দশাটারে যদি তার মৌল অবস্থা অর্থাৎ সূক্ষ্ম তন্তু বা স্ট্রিংয়ের মতো একটা কিছু ধরন যায় যে-কিনা মৃদু শক্তি বা এনার্জি নিজের মধ্যে তখনও বহন করে এবং সমদশায় পতিত স্ট্রিংগো লগে মিলনের কারণে পুনরায় পদার্থের আবির্ভাব হইতে থাকে, সেক্ষেত্রে পদার্থের এই সূক্ষ্ম ও অবিভাজ্য দশাই হয়ত জগৎসৃষ্টি বা তার রূপান্তর-পরিবর্তনের গণ্য কারণ। অর্থাৎ মৌল এই কোয়ান্টাম দশায় কণা-বিভাজন (Particle Division) সম্ভব নহে বলে দশাটা নিজে ‘অবিকার’ থাকে কিন্তু প্রভাবক বা ক্যাটালিস্ট রূপে সক্রিয় থাকনের ফেরে পদার্থে গঠিত জগৎ সৃষ্টি সম্ভব হয়। স্ট্রিং থিয়োরির মধ্যে এরকম একটা ভাব কিন্তু অনেকদিন ধরে তর্কের খোরাক হইয়া আছে, যদিও এই থিয়োরি নিয়া পক্ষে-বিপক্ষে আপত্তির অন্ত নাই।

তো সে যা-ই হোক, বাদ্রায়নের ‘ব্রহ্মসূত্র’ যে-ব্রহ্মের খবর করে, শঙ্কারাচার্য-রামানুজ ও মাধবাচার্য সেই সূত্রে ব্রহ্ম নিয়া যে-তফসির বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের জন্ম দেয়, বিশুদ্ধ ভাবনার কোরকে সুষমামণ্ডিত সেই ‘পরব্রহ্ম’ ভারতীয় আমজনতার জন্য গুরুপাক হইয়া উঠায় অগত্যা তারা ফেরত যায় বেদ পূর্ব মিথোলজির জগতে এবং সেখান থিকা সম্ভব-অসম্ভব সব প্রতিমা উঠায় আর তাদের লগে ‘ভগবান’ ও ‘পরব্রহ্ম’ একাকার করার পাগলামি চলতেই থাকে। এই উপাসনারীতির চূড়ায় ‘পরব্রহ্ম’ নামমাত্র বিরাজ করেন। চূড়ার মধ্যভাগে পৌরাণিক ভগবান ও তাদের জীবরূপী অবতারগো লীলাখেলা, সেইসঙ্গে দেবদেবী-ঋষি-মুনি-যোগীরা আইসা জোটে। তলায় অশুভ শক্তির প্রতীক অসুর-দানব থিকা ভগবান ও দেবতার প্রতিনিধি রূপে বিদিত পশু-পক্ষী-সাধু-সন্ন্যাসী এমনকি শক্তিসাধক কাপালিক অবধি বিস্তৃত এক জগতের ঝকমারি নিয়া ভারতীয় আমজনতা বৈদিক পরব্রহ্মর লগে নিজের ডায়ালগ সারে। যার অর্থ হইল তারা বৈদান্তিক হিন্দু ধর্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানের ওজন অকপটে স্বীকার যায়, তবে গুরুভার মনে হওয়ার কারণে বা সেখানে প্রবেশের শতেক ঝকমারি থাকায় পৌত্তলিক উপাসনার চিনগুলা দিয়া ব্রহ্ম ও বেদজ্ঞানের সেই জগৎকে লঘু আর সরস করতেই থাকে।  

লঘু কিন্তু ভক্তিরসে ঠাসা সে-বাখানে ভগবান শিব বাঘছাল পরে শ্মশানমশানে ঘোরে আর গাজাভাং খাওনের দোষে বউ উমা ওরফে পাবর্তী ওরফে দুর্গার ঝাড়ি খায়। কৃষ্ণ তাঁর রাধামামী ও সখিগো লগে নদীপারে লটরপটরের সরস কামবাইয়ে হাবুডুবু খাইতে থাকে এবং আমজনতার হৃদয়ে কানহাইয়া-কানাই-কালা-কানু রূপে ভক্তি ও আমোদের উপকরণ হইয়া ওঠে। এইটা হইছে ভক্তির সেই সরস রূপ যে-রসে মজে ভক্ত নিজে যারে ভগবান ঠাউরায় তারেই আবার কৌতুকছলে গালি দিয়া বসে :— ‘মা তুই জলে না যাইও / মা-ই-হে কলঙ্কিনী রাধা / কদমগাছে উঠিয়াছে কানু হারামজাদা / মা তুই জলে না যাইও।’ গানের ছলে ভক্ত এই গালিটা দিতে পারে কারণ গাছের মগডালে রাধামামীর লগে মিলনআকুল ভাগ্নে কানাই তো আর কেউ না, সে হইছে চিরন্তন পুরুষ-প্রকৃতি যার মধ্য দিয়া ভক্তের হৃদয়ে ‘পরব্রহ্ম’ ধরা দেন। সৈয়দ শাহনুর যেমন উলটাগানের তোড়ে রাধাকৃষ্ণ জুড়ির বন্দনা করছিল একদিন! এই জুড়ি পুরুষ-প্রকৃতির রঙ্গ ও মিলনের লীলা হয়ে তাঁর চেতনায় ঘাই তুলছিল। অদ্বৈত সৃষ্টি কার দোষে দ্বৈত এবং কীসের ফেরে পুনরায় অদ্বৈত হয় সেইটা বোঝানোর জন্য রাধার লগে কৃষ্ণের রসাল পরকীয়ারে সে উপায় ঠাউরায়। গানের কলির ছলে কইয়া বসে :— ‘আমি তোর মামীরে ভাইগ্না, তুই আমার জামাই / মামী-ভাইগ্না প্রেম করিলে আখেরে ভালাই।’

স্মৃতি প্রতারণা না করলে উলটাগানের ছন্দে বাঁধা পদবন্ধ সৈয়দ শাহনূরের নামেই চলে বলে জানি। মোস্তাক আহমাদ দীন আরও ভালো বলতে পারবেন এ-সম্পর্কে। সে যাই হোক, শাহনূর বা শাহনূর-ভাবিক যে-লোক এই পদ বান্ধে সে আসলে ইঙ্গিত রাইখা যায়, — পুরুষ-প্রকৃতির মিলনদোষে যেমন মানুষের উৎপত্তি ও সম্পর্কের সামাজিকতা তৈরি হয়, সেই মিলনের ফেরে তারা আবার বিলীন হয় সুফিভাবে মাথা মোড়ানো শাহনূর বা শাহনূর-ভাবিক সেই পদকারের ‘আল্লা’ অথবা বৈষ্ণবভাবে বিভোর রাধারমণের ‘পরব্রহ্ম’-র জগতে। শাহনূরের কাছে সে হইছে ‘নূর, তেজল্লি, জেল্লা, পাকপানি’-র দ্যোতক। রাধারমণের সিনটেক্সে তার বিচরণ ঘটছে ‘জল’-এ। সেই ‘জল’ যার থিকা সমুদয় জগতের উৎপত্তি হইছিল একদিন। এই জলের সাগরে ভাসা অণ্ডরূপী ব্রহ্মা ‘বিগ ব্যাং’-র উপমা রূপে নিজেকে সেখানে ফাটায়। আবার এই জল কুলনাশী প্লাবনে গ্রাস করে চরাচর। সৃষ্টি দ্বৈত না হলে অদ্বৈত কেমনে হবে? সুতরাং রাধারমণ দ্বিরুক্তির ছলে একদিকে রাধাকে জলে যাইতে নিষেধ করে, অন্যদিকে সে নিজে তারে প্ররোচিত করে জলে নামতে! রাধা যদি জলে না যায় তবে মিলন হবে না, আর মিলন না হলে সৃষ্টির লীলা খতম হওয়া রুখনের দ্বিতীয় কোনও উপায় নাই ভবে। সুতরাং তাঁরে গাইতেই হয় : — ‘জলে যাইও না গো রাই / আইজ কালিয়ার জলে যাওয়ার জাতের বিচার নাই।’ এই জাতপাতহীন মিলন হইছে ‘পরব্রহ্ম’, যার মধ্যে নারীপুরুষ সকলই বিলীন গানের ছলে রাধারমণ আভাস দিয়া যায় : — ‘মায়ে পিন্দইন লালন-নীলন বইনে পিন্দইন শাড়ি, / শ্রীমতি রাধিকায় পিন্দইন কৃষ্ণ নীলাম্বরী।’

এইটা হলো বৈদিক পরব্রহ্মর সেই Hermeneutics বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞান বা তফসির যা লোকায়ত ভারতবর্ষের সাধু-ফকির-দরবেশ-বাউল সারা দেশ জুড়ে অকাতরে সৃষ্টি করছিল একদিন। পরব্রহ্মর আরেকখান স্থূল এসেন্স অবশ্য সৃষ্টি করে ভূবর্ষের অগণিত আমজনতা বা আমহিন্দু এবং নিজেগো ঘর-সংসারে সে-এসেন্স লালন করে মিথোলজির মহিমায়। সেই মহিমায় সাধুসন্ত বা ধর্মগুরু মাত্র নহে, স্বয়ং রবিকবি থিকা শচিন টেন্ডুলকার এমনকি মুসলমান নজরুল হইতে শাহরুখ খানের ছবি দেয়ালে লটকাইয়া আমহিন্দু তাগো মালা পরায়, ভক্তিটক্তি দেয় কিংবা পীর-ফকিরের মাজারে মানত করে ইত্যাদি। ভক্তির এই রূপ দেখে নাক সিটকানোর কিছু নাই আসলে! এর মধ্যে বৈদিক সূক্তের মর্মকথা অর্থাৎ ‘সগুণ দেহধারী জীব স্ব-কর্মদোষে ক্ষুদ্র বা মহান হয়’, এই ভাষ্যটার একপ্রকার বি-নির্মাণ ঘটায় পাবলিক। বেদের ভারী কথা আমহিন্দু নিজের বিষয়াসক্ত সংসারী মন দিয়া আচ্ছামতো ইন্টারপ্রেট করে এবং ‘পরব্রহ্ম’কে নিজের হৃদয়-কুঠুরিতে অবচেতনে কাছে টানে।

রবিকবি থিকা শাখরুখ খান এঁনারা নিজকর্মগুণে যে-উচ্চতায় আসীন হইছেন সেই উচ্চতাটারে ভক্তি জানানোর মধ্যে আমহিন্দু এই মানুষগুলাকে ভগবানের আসনে বসায়, তাদের মধ্যে ব্রহ্মগুণের ছায়া ও আশিস দেখে। তারা হয়ত ভাবে পরম ঈশ্বরের আশীর্বাদ ছাড়া এই লোকগুলা এমন বিরাট হয় কী প্রকারে! বেদজ্ঞর বিচারে এইটা পাতকি বা অনুচিত কাজ হইলেও এর মধ্যে ভালোবাসার যে-স্ফুরণ সেইটা উপেক্ষা করা মুশকিল। ‘পরব্রহ্ম’ সেই উচ্চতা হয় যারে নিজের মধ্যে অনুভবের ক্ষমতা গড়পড়তা হিন্দুর থাকে না, সুতরাং ব্রহ্মকে তারা সাকার মানুষের জগতে খুঁজে, সেইসব মানুষ যারা কর্মের মধ্য দিয়া নিজেকে জগতে অতুল করে তুলছেন। এইটা মিথের একপ্রকার নবায়নও বটে! জিহাদের উদ্দেশে শ্রী ভূমি শ্রীহট্টে গমন করলেন যে-শাহজালাল এই নবায়নের জেরে তাঁর মাজারে হিন্দুগো নিত্য আনাগোনা চলে প্রতিদিন। এইভাবে বিচিত্র পথ ও স্বরূপে ভারতবর্ষের আমহিন্দু বৈদান্তিক পরব্রহ্মর নিষ্কাশন ঘটায় বইলা হিন্দুত্ব এক জটিল অতল, যার খেই মিলা ভার। রবিকবি এই বিষয়গুলা মাথায় নিয়া পরব্রহ্মর বৈদিক ব্যাখ্যায় দিওয়ানা ছিল সে-কথাখান আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

আমহিন্দুর বহুরৈখিক প্রথা-আচার-বিশ্বাস হইতে উচ্ছল স্রোতের মতো নির্গত এই সংস্কৃতি রবির চিত্তে দোলা দিলেও, আবারও রিপিট করি, হিন্দুত্বের নিশান হিসেবে এরে স্বীকার যাইতে সে সম্মত হয় নাই। ‘পরব্রহ্ম’ তাঁরে বিগ্রহ হইতে বিগ্রহবিহীন নিরাকারে বিলীন হওয়ার সুযোগ দেওনের দিগদারি এই ছিল যে, — বৈদান্তিক আর্যরা ভারতবর্ষে বিলক্ষণ রূপে প্রতিভাত হওনের আগে যে-সভ্যতার অস্তিত্ব ইতিহাস লিখে এবং রাখালদাস সেইটা মাটির গভীর হইতে রিকভারি করেন, ব্যাপক আগ্রহ সত্ত্বেও রবি কখনও সেখানে ফেরত যাইতে পারে নাই। তাঁর মনের জগতে আর্য ও আর্য-পূর্ববর্তী ভারতীয় সভ্যতার কাটাকাটি অমোচনীয় হইয়া উঠছিল। এর ফলে নিচুতলার মানুষের প্রতি দরদি হওয়া সত্ত্বেও সেই সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব সেভাবে মিটে নাই। এক-ঈশ্বরে বিশ্বাসের আদি প্রবক্তা পারস্যনিবাসী জরথুস্ত্র নিয়া রবির বাখানে এর ইশারা পাই। পারস্যভ্রমণের দিনগুলায় জরথুস্ত্র সম্পর্কে দুকথা বলার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হইছিল। ‘জরথুস্ত্রের দিব্যসংগীত’ (The Divine Songs of Zarathushtra) নামক সেই বক্তিমায় রবিকবির প্রারম্ভিক বয়ান অধমের অপুট হাতের ভাষান্তরে এইখানে স্মরণ করা যাইতে পারে :

পারস্যবাসীর ইতিহাসে সমুদয় অপূর্ব ঘটনার মধ্যে জরথুস্ত্র প্রণীত ধর্মীয় সংস্কার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি তিনি সেই প্রথম মানুষ ধর্মকে যিনি সুস্পষ্ট নৈতিক-চরিত্র ও নিশানা উপহার দিয়াছিলেন এবং সেই সময়ে অদ্বৈত ঈশ্বরে বিশ্বাসের বাণীটি প্রচার করিয়াছেন, যে-বাণী সদাচারকে সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ রূপে গণ্য করিতে বাস্তবতার চিরন্তন ভিত্তির প্রতি আবেদন রাখিয়াছিল। আদিম প্রকৃতির সকল ধর্ম বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের বেড়াজালে মানুষকে বাঁধিয়া রাখিতে সচেষ্ট হয়। সন্দেহ নাই, সত্য-মিথ্যার রাজ্য নিয়া কুহেলিকা তৈরি করিবার ক্ষেত্রে উহাদের সম্মোহক প্রভাব রহিয়াছে; যদিও অনুজ্জ্বল সেইসব দীপ্তি হইতে যে-ছায়াবাজির জন্ম হয় মানুষকে সেটি বিপথগামী করিয়া তোলে। পথপ্রদর্শক নবিগণের মধ্যে জরথুস্ত্র সর্বাধিক মহান ছিলেন, মানুষকে তিনি মুক্তির পথ দেখাইয়াছেন, নৈতিক বাছ-বিচারের স্বাধীনতা উপহার দিয়াছেন, অর্থহীন বিধিনিষেধ সমূহের অন্ধ আনুগত্য হইতে মুক্তি দিয়াছেন, বেদি ও তীর্থস্থানের প্রকোপ হইতে উহাদের স্বাধীন করিয়াছেন, — যা আমাদের উপাসনারীতিকে ধ্যানমগ্ন-আরাধনার শুদ্ধ কৌমার্য হইতে বহু দূরের বস্তু করিয়া তোলে। [The Divine Songs of Zarathushtra by Rabindranath Tagore; The Gathas The Hymns of Zarathushtra : Compiled by D. J. Irani]

সিন্ধু সভ্যতার তীরে ফলবান সভ্যতার অতুল উৎকর্ষে মুগ্ধ হইলেও এবং ভারতবাসীর সদাচারের যাত্রা সেখান থিকা শুরু ইত্যাদি কাহানি গাইলেও ‘পরব্রহ্ম’-এ পোঁতা নিশানা ছিল রবির সেই হিন্দুত্ব, আর্যগো হাতে গড়া বৈদান্তিক ব্যাখ্যাবিজ্ঞানের হাত ধরে একদা যার যাত্রা শুরু হইছিল। এ-কারণে রবি সেই দূরের গ্রহ যে-বজরায় বসে পূর্ববঙ্গের খবর করতে বাধ্য হয়। তাঁর রাডারে বঙ্গের যে-ছবি ধরা পড়ে প্রতিভার গুণে সে-ছবি সাহিত্যে অতুল হইছে। যদিও অতুল সেই সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের মুসলমান প্রজারা প্রবেশের পথ পায় নাই। রবির জন্য এইটা হয়ত সঠিক ছিল, যে-জীবনের অন্তঃপুরে প্রবেশের সুযোগ তাঁর ঘটে নাই অথবা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ জীবনধারায় আচার-উপাসনার সঙ্গে তাঁর মানসিক বিরোধ যা সেখানে প্রবেশ যাইতে তাঁরে বাধা দেয়, সেই জীবনকে সাহিত্যে ব্যবচ্ছেদ করা থিকা সে সযত্নে বিরত থাকে।

এটা সত্য, রবিমনের অসীম উদ্বেগ ও দরদ ওই মানুষগুলার জন্য থাকে কিন্তু সাহিত্যের বয়ানে তারা চিয়ায়ত মানবিক আর মূর্তিমান সামাজিক সমস্যার উপকরণ হিসেবেই কেবল ভাষা পায়। অন্তরালে তাদের নিয়া যারা খেলে ও খেলায়, তলস্তয়ের লেখনিতে যাদের মুখব্যাদান করতে দেখে পাঠক, রবির কাছে সেই জগতের ছবি আশা করা দুরাশা মনে হইতে থাকে। তাঁর ‘পরব্রহ্ম’ বা আবু সয়ীদ আইয়ুব কথিত ‘জীবনদেবতা’ ভূবর্ষের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষ যারে ‘আল্লা, ভগবান’ ইত্যাদি নামে পেন্নাম ঠোকে এর লগে বিলক্ষণ তফাত রাইখা আগায়। ফলে রবির ‘পরব্রহ্ম’-র সঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের আল্লা-ভগবানের নীরব দূরত্ব নিজের জনগোষ্ঠী থিকা ক্রমশ দূরগামী ও নিঃসঙ্গ হইতে তাঁরে বাধ্যও করে!

রবিকবির ‘গল্পগুচ্ছ’-এ পূর্ববঙ্গ অতুল হইয়া আসে ঠিকই, কিন্তু বঙ্গদেহের শরীরে বিরাজিত আমআদমির আচার-বিশ্বাস-সংস্কৃতির সঙ্গে ভদ্রলোকগো আচার-বিশ্বাস-সংস্কৃতির দূরত্ব বা বিরোধ সেখানে অস্পষ্ট, গৌণ আর নিখোঁজ বইলা সন্দেহ জাগে! রবিগল্পে এইসব মানুষের চিন্ চিরন্তন মানবিক আবেদনের ছকে আবর্তিত হওয়ার কারণে পাঠকের কাছে সে-মানুষটি হিন্দু-নাকি-মুসলমান, ভদ্রলোক-না-ছোটলোক, বুর্জোয়া-না-‘সব’হারা ইত্যাদি তুলনা গৌণ মনে হইতে থাকে। পাঠককে এইসব দ্বন্দ্বের বাইরে নিয়া যাওনের ফলে রবির পক্ষে পোস্টমাস্টার, শাস্তি, অতিথি, কাবুলিওয়ালা, নষ্টনীড়, স্ত্রী’র পত্র, মেঘ ও রৌদ্র, ক্ষুধিত পাষাণ, ল্যাবরেটরি, মধ্যবর্তিনী, ছুটি, হৈমন্তী, মুসলমানীর গল্প কিংবা একরাত্রি-র মতো হৃদয়দ্রব ও চিরকালীন কাহিনির বয়ান সহজ হইয়া ওঠে।

মনে রাখন প্রয়োজন, রবি তাঁর লেখার বিষয়আশয় ইত্যদির প্রশ্নে ভারতীয় বাঙাল কিংবা লোকাল হইলেও তাঁর লেখায় সে-লোকালিটি একটা সিগনেচার মাত্র হয়, হৃদকমলে বিরাজিত ‘চিরন্তন মানবিক অনুভূতি’ প্রকাশের খাতিরে লোকালিটিকে সে ব্যবহার করে সেই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য যেখানে পূর্ববঙ্গ, বাঙালি বা হিন্দু ইত্যাদির দেহ ভেদ করে চিরকালের মানুষ নজরে আসে। শেক্সপিয়ারের সাহিত্য রবির কাছে অতুল মনে হইছিল এবং সেইটা এ-জন্য নয় এর মধ্যে ইংরেজ তথা ইউরোপ মহাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি-ইতিহাসের সুলুক পাওন যায়! রবির কাছে শেক্সপিয়ার অতুল কারণ তাঁর লেখনি মানবআত্মা ও মানবস্বভাবের সেই চিহ্নগুলা ধরতে সহায় হয় যার কোনও দেশকাল বা গণ্ডি নাই। রবি তাঁর নিজের লেখনির মধ্যে বিষয়টি আজীবন ধরে রাখার চেষ্টা করছে। তাঁর টেক্সট যে-কারণে পলিটিক্যাল কনটেক্সট বিচারে সবিশেষ মূল্যবান হইতে পারে না। সেই টেক্সটের মধ্য দিয়া ভারতবর্ষের জাতিবৈরী পরিবেশ ও কাল-কালান্তরে বহিরাগতদের সঙ্গে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিরোধ-সংঘাত ও মিলন হইতে যে-দ্বন্দ্ব উতলায় সেইটা পাঠে বিশেষ সুবিধা মিলে না। তা সে যতই ‘নৌকাডুবি’, ‘ঘরে-বাইরে’, ‘গোরা’ কিংবা প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও বক্তিমায় হাঁকডাক দিক-না-কেন, এইগুলা ঠিক সেই বস্তু নয় যার আশ্রয়ে রবিকবিকে বঙ্গভাগ ও মুসলমানের মনোজগৎপাঠে উদ্দেশ্যমূলকভাবে নীরব এই অভিযোগের আওতায় বিশ্লেষণের জন্য মারাত্মক একখান টেক্সট গণ্য করা যাইতে পারে।

রবি আমমুসলমানের জগৎ ও স্বার্থ নিয়া উচ্চবাচ্য করে নাই, ভালো কথা, আমহিন্দুর প্রাধিকার নিয়া কতটা কী ভাবছে সেইটা মনে হয় আগে খবর করা উচিত। রাষ্ট্র-দেশ-সমাজ এবং এইসব কাঠামোর মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের ঘুরপাক খাওনের জটিলতা রবির লেখায় অনবরত যাওয়া-আসা করছে কিন্তু এই কাঠামোগুলা সিগনিফিকেন্ট হইয়া উঠনের বদলে রবিকৃত মানবিক অম্লযানের সাগরে হাবুডুবু খাইতে থাকে। ঈশ্বর ও প্রকৃতির মধ্যে মানুষের অবস্থান, এক মানুষের হৃদয়ের লগে অন্য মানুষের হৃদয়ের যোগ, জন্ম-মৃত্যু-মিলন-বিচ্ছেদ-বিরহ আর মনোদৈহিক চোরাটান ইত্যাদি রবিকে যতটা মাতোয়ালা ও অনন্য করে সেই তুলনায় মানুষকে রাজনৈতিকভাবে নির্ধারণকারী কাঠামো ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর বাখান পানসে ঠেকে মনে

কাঠামো ও সামাজিক সংস্কারের সমালোচনা, জাতীয় জীবনে বদ্ধ-জীর্ণ দশা থিকা মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এই বিষয়গুলা নিয়া রবির বাতচিত অনন্য হইতে থাকে যেখানে সে ‘রক্তকরবী’, ‘তাসের দেশ’ বা ‘ডাকঘর’-র ছকে সকল প্রকার অবরুদ্ধতা হইতে সমগ্র মানবাত্মার মুক্তিসাধনের গান গায়। হিউম্যানিজম একটি বিতর্কিত প্রসঙ্গ হইতে পারে কিন্তু রবি সে-প্রসঙ্গটারে ‘আরব্য রজনী’-র অতিকায় দৈত্যের মতো ধারণ ও গলাধঃকরণ করে। সেই দৈত্যকে দেখার পর জাতির ভবিষ্যৎ নিয়া সে কী চিন্তা করছে, দেশভাগ বা হিন্দু-মুসলমানে সমস্যা নিয়া কোথায় কী-বলছে-না-বলছে এইগুলা মাথায় থাকে না।

রবিকে তবু যারা পলিটিক্সের আতশকাচে মাপতে ইচ্ছা করেন তাদের জন্য দিগদারি হইছে রবির মানবিক-অম্লযান থিকা সৃষ্ট চরিত্ররা সেখানে অবিরত হানা দেয় ও ঝামেলা পাকায়। পোস্টমাস্টারের ‘রতন’, মিনির ‘কাবুলিওয়ালা’, ডাকঘরের ‘অমল’, রক্তকরবীর ‘নন্দিনী’, শাস্তির ‘চন্দরা’, নষ্টনীড়ের ‘চারু’, যোগাযোগের ‘কুমুদিনী’, শেষের কবিতা-র ‘লাবণ্য’ এবং এরকম আরও হাজারবিজার ক্যারেক্টারে গিজগিজ রবিকবির সংসারে ব্যক্তিজীবনের সহজ কিন্তু জটিল দৈহিক অনুভবের স্রোত এতটাই অতিকায় হইতে থাকে যে বাদবাকি সেই স্রোতেই তলায়! হিন্দু বা মুসলমান এইসব সাইনোলজির বাইরে নিষ্ক্রান্ত ক্যারেক্টারগুলা এক-একখান জ্বলজ্যান্ত মানবাত্মা, বহুবিধ পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাছকের কাঠামোয় বন্দি হওনের শাস্তি ভোগ করে জীবনভোর। যে-কারণে রবির ‘গোরা’র থিকা একখান ‘শেষের কবিতা’ বা ‘রক্তকরবী’ বা ‘ডাকঘর’ কিংবা ‘ইচ্ছাপূরণ’ নামের সেই মজাদার গল্পখান আমি হাজারবার পড়তে রাজি; কারণ মানবতার দুর্দিন ও পতনের ক্ষণে রবি সেই ফ্যান্টাসি নিয়া আসে যেখানে মন অনেককিছু হারানোর নস্টালজিয়ায় কাতর হইতে পারে।

রবিকবির ‘পরব্রহ্ম’ ইত্যাদি মাথাধরানো জটিলতার আরও গভীরে ডুব দেওয়ার আগে এই কথাখান কবুল করি আগেভাগে :— জানি অনেকে আপত্তি জানাইবেন, উচ্চহাস্যও কপালে জুটিতে পারে, তারপরেও বলি অধমের কাছে রবির রাজনৈতিক অবস্থান তাঁর সাহিত্যের সাপেক্ষে দায়সারা বইলাই মনে হইছে। হিন্দুকে বর্ণনা দেওয়ার ক্ষণে হিন্দুত্ব-র জটিল অনুষঙ্গ সেখানে ঝাপসা হইয়া আসে। মুসলমানের কথা লিখতে বসলে তাদের চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি কনটেক্সট অবিরত উহ্য ও বিলুপ্তির আকৃতি নিতে থাকে। তাঁর রচনায় সেইসব মুখ দ্রষ্টব্য হয় যারা মানুষের বংশগতি ও সমাজ-সংস্কৃতির মধ্য দিয়া প্রবাহিত চিরন্তন মানবিক অনভূতির স্মারক। এবং সেখানে ‘গল্পগুচ্ছ’ মহান কীর্তি। এর যে-কোনও একটি নামাইতে পারলে লেখকের জন্ম ধন্য হয়; সেখানে ‘গল্পগুচ্ছ’ পুরাটাই মানবিক অম্লযানের খনি! নিজের জনপদ ও মানুষগুলারে চিরকালের সুখদুঃখে গাঁথা মানুষের অংশ বইলা ভাবতে ও বুকে টানতে যা পাঠককে সাহায্য করে।

রবির কবিতার লগে মামলা সেভাবেই হয়। এখনও এই কবিতাগুলা রূপময়তায়, সহজছন্দে বহমান অনুভূতির সাবলীলতায়, মন্ময়ভাবের আবেশ জাগানিয়া আবহময়তায় এবং দ্বিরুক্তির চতুর প্রয়োগে অন্তত এই অধমের কাছে একাধারে মেটাফরিক্যাল ও মেটাফিজিক্যাল। জীবনের সবকিছু কমবেশি ‘সঞ্চয়িতা’-র মধ্যে পাওন যায়। সুখ-দুঃখ, অনুরাগ-বিরাগ, আশা-নিরাশা, বিরহ-বিষাদ, কৌতুক-রঙ্গরস, দেশ-জাতি-সমাজ, ঋতুরঙ্গ ও নদী-পাখি-মেঘ-আকাশের লগে মানমবমনের চিরন্তন যোগ, একাকীত্ব তো অতিকায় রূপে আছেই সেখানে, আর সবচেয়ে প্রবল হইয়া আছে দুর্নিবার শিশুমনের সেই মাতৃ-অনুভব যা মানুষ এখন নিজের ত্বকের ভিতরে রবির মতো ফিল করতে পারে না আর; তাঁর মতো কইতে পারে না :— ‘মাকে আমার পড়ে না মনে। / শুধু কখন খেলতে গিয়ে / হঠাৎ অকারণে / একটা কী সুর গুনগুনিয়ে / কানে আমার বাজে, / মায়ের কথা মিলায় যেন / আমার খেলার মাঝে। / মা বুঝি গান গাইত, আমার / দোলনা ঠেলে ঠেলে; / মা গিয়েছে, যেতে যেতে/গানটি গেছে ফেলে। / মাকে আমার পড়ে না মনে।’

জনান্তিকে কই করোনাকালের দুর্দিনে রবির এই কবিতাখান ফিরে পড়তে বিষাদে গিয়ে বুক ভার হইয়া উঠছিল নিজের মায়ের কথা স্মরণ করে। মা এখনও জীবিত এবং বড়ভাইয়ের লগে থাকেন। করোনার উৎপাত শুরু হওনের পর থিকা তারে দেখতে যাইতে পারি না। কথা হয় ফোনে কিন্তু তাতে কি আর দেখার আশ মিটে! জীবিকার তাগিদে বাইরে যেহেতু মানুষের লগে ঘুরিফিরি মনে ভয় কাজ করে দেখতে গিয়া মা যদি কোনওভাবে আক্রান্ত হয় আমি হয়ত সেইটা নিতে পারব না। মা অতি নিকটে থাকনের পরেও রবির সেই সহজ দ্বিরুক্তির মতো আমার দেহের কোষে স্মৃতি হইয়া ঘুম যায়। মাঝেমধ্যে মনে হয় তার চেহারা মনে করতে পারতেছি না। সে কি সেই মা আছে যার কাছে গিয়া বসতে পারলে হৃদয় জুড়ায়! নাকি জীবিত থাকনের পরেও মা ইতোমধ্যে মৃত সেই টেক্সট হইয়া উঠছে যারে এই দেহকোষে আমি অনেকদিন ধরে জমা করছি পরে স্মরণ করার জন্য! ভিডিওকলে তারে দেখতে ভয় হয়। আমার দেহকোষে যে-মা নিত্য ঘুম যায় ও জেগে ওঠে এবং ছেলেবেলার সেই দিনগুলার মতো আমারে ডাকে আর স্কুলে যাইতে কয়, ভিডিওকলে যারে দেখব সে কি সেই মা নাকি অন্য কেউ! আমি তো এই মায়ের খবর জানি যারে জীবনভোর শুধু ‘নামের নেশায়’ মা বইলা ডাক পাড়ছি — ‘শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে, / বলতে পারে এই সুখেতেই মায়ের নাম সে বলে।।’ তার লগে আবার কীসের দীন-দুনিয়ার লেনাদেনা। সে মা, ব্যাস এইটাই যথেষ্ট! তো এই অনুভূতি আমারে অসাড় রাখে বইলা মারে দেখতে যাই না আর মা যেন সত্যিকারের রক্তমাংসের মা থিকা স্মৃতির মধ্যে জীবিত হইতেই থাকে, যারে মনে পড়ে না কিন্তু সে রবির সহজ দ্বিরুক্তির মতো চিরকাল মনে জাইগা থাকে :— Mother is the eternal dream of that nightmare which you cannot reach and eventually cannot forget. আমি সত্যি জানি না রবি চিরকালের সতেজ কিন্তু বিষাদে আর্দ্র যে-মাকে ফুসফুসে টানতে বাধ্য করে তার তুল্য কোনও অনুভব হয় কিনা জগতে।

তো এই জায়গা থিকা রবির কবিতারে যখন পড়ি তখন অনেক কিছুই গৌণ মনে হয়। সাহিত্যের প্রতি বাঁকে যেসব সংজ্ঞা জন্ম নিয়া থাকে এবং ওইসব সংজ্ঞা একজন কবির কবিতাকে প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক অভিধায় ভাগ অথবা বাতিল করে যায়, এই জিনিসটা সংকীর্ণ দেশ-কাল-বিশ্বের ততধিক সংকীর্ণ পরিধিতে বসে যে-কবি কবিতা লিখে অনন্য হইছেন তাঁর কবিতার গুণ বিচারে প্রয়োজনীয় হইলেও হইতে পারে, কিন্তু রবিকবি যে-সামগ্রিকতার জায়গায় বসে কবিতা লিখে সেখানে এই ভাগাভাগির মধ্যে তাঁরে আঁটানো যায় কি না সেইটা ভাবা উচিত। রবির কবিতা তাঁর পাঠককে মানবিক অনুভূতির যে-স্রোতের ভিতর দিয়া যাইতে বাধ্য করে সেখানে কবিতার যুগ-বিভাজন কিংবা আধুনিক-উত্তরাধুনিক-পরাধুনিক ইত্যকায় ভেদবিচারগুলা তাঁরে ধরতে সহায়তা করে বইলা মনে হয় না।

যে-রসের বিচারে কালিদাস ধ্রুপদি গণ্য হইতে থাকেন, মধুসূদন-রবি কিংবা নজরুলও নিজের যুগ অতিক্রম করে সকল যুগের জন্য প্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে ধ্রুপদি বিবেচিত হইতেই পারেন। মানবসংসারে যত আকারে-প্রকারে লোকে হৃদয়ের চর্চা করে তার ভলো-মন্দ সকল ছিদ্রে যে-লোক কান পাতছে তাঁর কবিতাযাত্রাটারে ফ্রেমের বাইরে নিয়া যাওনের সময় বোধহয় হইছে। একালের যে-কবি নিজের সময়ের লগে রবিকবির ভাষা, সংবেদন ইত্যাদি খাপ খায় না দেখে তাঁরে তাচ্ছিল্য যায়, না-পড়াটা বাহাদুরি ভাবে, কিংবা উপেক্ষার শেল হানে, সে-কবি এলিয়টের যুগে লোকে যেভাবে কাব্যবিচার করত সেখান থিকা অধিক আগায় নাই। রবিকবির মরা টেক্সটগুলা কখন কেমনে তার ঘাড়ে ভূত হয়ে নাচে সেইটা সে ধরতে শিখে নাই। জিনিসটা খিয়াল করা প্রয়োজন।

রবি রোমান্টিক নাকি মিস্টিক, মডার্ন না পোস্টমডার্ন, নাকি মেটামডার্ন এইসব বিবেচনা মানবজীবনের সমুদয় অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা ধারণের লক্ষ্যে সহজ স্রোতে বইতে থাকা এই কাব্যপ্রবাহের বিচারে গৌণ হইতে বাধ্য। সহজ একটা উদাহরণ এখানে দেয়া যাইতে পারে :— ‘পুরাতন ভৃত্য’ নামের পপুলার কবিতাখান রবি যেখানে কেষ্ট-র ছবি আঁকে সেইটা হয়ত এখন আর ফিরা পড়তে মন উঠে না; সময়ের লগে কবিতা লিখনের কলাকৌশলে যেসব নতুন ভঙ্গি যোগ হইছে এবং কবিতাপাঠের অনুভবে ব্যাপক চেঞ্জ নিয়া আসছে তার প্রভাবে রঙ্গ থিকা বিষাদে গমনকারী কেষ্ট-র ছবিখানের লগে কমিউনিকেট করার জোশ পাঠক এখন আর পায় না; যদিও একুশ শতকে এমন লোক সংসারে বিরাজ করে রবিকবির কেষ্ট হইতে সেই লোকটারে আলাদা করা সত্যিই কঠিন! লোকটা হয়ত ঘরে বউয়ের ঝাড়ি খায়, অফিসে বস তারে আচ্ছামতো ঝাড়ে, মাছের বাজারে মাছবিক্রেতা চান্সে ঝাড়ে, সোজাকথা কলুর বলদ এই লোকটা ঝাড়ি ও অন্যের সন্দেহের কারণে দৌড়ের উপরেই সারাক্ষণ থাকে এবং কেষ্ট থিকা নিজেকে পৃথক ভাবনের দিন তার জীবনে কখনও আসে না:-‘ভূতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর— / যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্ট বেটাই চোর।’ তো সেই কেষ্ট যে-Contextual নিয়া রবির কবিতায় একদিন ঢুকছিল এবং আপাতভাবে মরা টেক্সট রূপে সঞ্চয়িতায় সে ঘুম যায়, সেই কেষ্ট কাল-পরশু-তরশু অন্য কবির হাতে নবজীবন পাবে না সেই গ্যারান্টি কিন্তুক নাই।

মানবসংসারে রবিঘরানার যেসব কবি আছেন তাঁদের কাব্যবিচার পাঠক যেভাবেই করেন তার সবগুলা তাই বৈধ এবং সমভাবে অবৈধ বিবেচিত হইতে বাধ্য। যে-লোক কবিতাগুলা লিখছে সে মানবসংসারে বিদ্যমান যত ‘সুর ও অ-সুর’ নিত্য বাজে তার সকল ছিদ্রে সজাগ কান পাতছিল এবং নিজের অনুভবের মধ্যে সেগুলা ধারণের জন্য জীবন তামা করছে :— এই জায়গাটা বিবেচনায় নিয়া পাঠক যদি লোকটারে পড়তে পারেন তবে তাঁর বিচার সেখানে আপনা থিকা বৈধ হয়। তিনি হয়ত রবিকবির সেই কবিতাগুলা নিজের ঝুলিতে ভরেন যেগুলা প্রেম-বিরহ-বিষাদের তরঙ্গে মন আর্দ্র করায়, যেখানে প্রকৃতি ও জীবন-প্রকৃতির যোগ অভিন্ন আওয়াজে মরমে পশে, যেগুলার মধ্যে জাতীয় বা সামাজিক সমস্যাটারে এখনও প্রাসঙ্গিক বইলা বোধ হইতে থাকে, যেখানে সীমার মাঝে অসীমের সুর কানে খট করে লাগে, কিংবা সেইসব কবিতা যারা তাদের আপাত নিস্তেজ সুরত নিয়াও সমকালের লগে সংযুক্তির যোগ মনে জাগ্রত করায়; এবং সেই অনুভবগুলা যা পাঠকের ত্বক হয়ত এখন আর ফিল কইরা উঠতে পারে না কিন্তু তীব্র এক স্মৃতিকাতরাতায় তার মনের দখলটা নিয়া নেয়; — সমুদয় এই অনুভবের যোগফল হইতে পারে সে-‘সঞ্চয়িতা’ যা রবিকবি স্বয়ং নিজে এবং পরে যাঁরা এই সংকলন আরও শতবার সম্পাদনা করছেন তাঁরা কে কী বলছেন সেইটায় কান না দিয়া নিজের শুদ্ধ অনুভবের সাহায্যে পাঠ যাইতে কয়।   

রবিকবির ‘সঞ্চয়িতা’-র নতুন কোনও ভার্শন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। নতুন সংকলনের জন্য যিনি রবির কবিতা বাছাই করতে বসছেন তাঁর ‘অনুভবশক্তি’ সেখানে অমোঘ হওন দরকারি; যেহেতু রবিকবিতা নামক এই টেক্সটগুলা এখন আর নিছক কবিতার মধ্যে নাই, কবিতার বাতিল বা স্বীকৃত অথবা অদ্য-উদ্ভাবিত কোনও কাঠামোর মধ্যেই নাই, এইগুলা হইছে সেই জিনিস যা যুগ বা সময়ের ফ্রেমে মানব-সংসারের লগে আলাপ সারলেও তার ব্যাপকতা ও সমগ্রতার কারণে সকল যুগের লগে কোনও-না-কোনও উপায়ে সংযুক্ত হওনের সক্ষমতা রাখে। সুতরাং একখান ‘সঞ্চয়িতা’ যদি নতুন করে সম্পাদনা করতে হয় সেখানে কাব্যগ্রন্থ ও কবিতার কালানুক্রমিক ধারা কিংবা প্রতিটি বই হইতে কিছু-না-কিছু কবিতা বাছাই করা ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্ব রাখে বইলা মনে হয় না। গুরুত্বপূর্ণ হইছে রবিকবির রচনাধারা থিকা অনুভূতিগুলা বাছাই ও আলাদা করা এবং সেই অনুসারে সেখানে নতুন পর্বভাগ হইতে পারে :— যেমন ‘প্রেম’, ‘মিলন ও বিরহ’, ‘সাধনা ও আরাধনা’, ‘মরণ’, ‘প্রকৃতি ও ঋতুরঙ্গ’, ‘শিশুমন’, ‘সংসাররঙ্গ’, ‘দেশ ও বৈদেশ’, ‘বিগত ও সমকাল’ ইত্যকায় যত অনুভব রবিকবিকে পাঠের সময় সংকলকের মনের লগে সংযোগ তৈরি করে ও তাঁরে প্ররোচিত করায় সেখান থিকা তিনি বাছাই ও পর্ব অনুসারে বিন্যস্ত করতে পারেন।

রবিকবির কবিতা সংকলনের ক্ষণে প্রতিটি বই ধরে কবিতা বাছাইয়ের ট্রেন্ড থিকা বোধহয় ছুটি নেওন দরকারি। প্রয়োজন হইলে একটা বইয়ের সবগুলা নিতে হইতে পারে এবং সেইগুলা পর্ব বুঝে সেখানে জায়গা নিবে; আবার আস্ত একখান বই থিকা হয়ত দু-চারটার বেশি নেওয়া সম্ভব নাও হইতে পারে বা পুরাটাই বাদ দেওন দরকার হইতে পারে। বইয়ের কোনও কাঠামোগত বিন্যাস অনুসরণের প্রয়োজন অন্তত রবিকবিতার ক্ষেত্রে এখন আর প্রাসঙ্গিক বইলা একিন হয় না। অনুভবের তরঙ্গে যা উঠবে সেইটার সাহায্যে বইয়ের ক্রনোলজি (রবি নিজে যেইটা সেই সময় করছিল বা পরে আরও অনেকে সেইটা মাথায় নিয়া কমবেশি করছেন) সংকলক সেখানে ইগনোর যাইতে পারেন; এই যুক্তিতে যে, — নিজের পাঠঅনুভবের লগে প্রতারণা করতে চাননি বইলা কবিকৃত ক্রনোলজি থিকা তিনি এক্সিট নিয়া নিছেন। যেমন ধরা যাক মরণের ফিলিংসগুলা সেই সংকলক একাধিক বই থিকা চয়ন করে ‘মরণ’ নামক পর্বে স্থান দিতে পারেন। পাঠের সময় পাঠক এই জার্নিটা মানে রবিকবির ‘মরণযাত্রা’ যদি নিজের ত্বকের মধ্যে ফিল করতে চায় সেক্ষেত্রে ‘মরণ’-পর্বে ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত কবিতাগুলা তারে সেই স্রোতের মধ্যে নিয়া ফেলবে। এই স্রোতযাত্রার কারণে রবির ‘মরণ’ সংক্রান্ত বাকপ্রতিমাগুলা তার নিজের অনুভবের মধ্যে সেই উপলব্ধির জোয়ার আনতে পারে যেখান থিকা হয় সে ‘ডিসগাস্টিং বা বেরিং’ বইলা এক্সিট নিবে নতুবা এর মধ্যেই ডুবে মরবে। অথবা ধরা যাক তার হয়ত রবিকবির কবিতায় রঙ্গ-তামাশা দেখার সাধ জাগছে। অসুবিধা নাই, ‘সংসাররঙ্গ’-এ সে ঘুরান দিয়া আসতেই পারে এবং সমভাবে সেইটারে নিজের অনুভবের সাপেক্ষে গ্রহণ-বর্জন করতেও বাধা নাই।

পর্বের মধ্যে বিন্যস্ত এই ধারাবাহিক পাঠের মধ্য দিয়া টেক্সট পাঠকের কাছে চ্যালেঞ্জিং হইতে থাকে। ‘প্রেম’ কিংবা ‘মরণ’ পর্বে সাজানো কবিতার মধ্যে টানা গমনের চাপ তাকে মনোটনির দিকে নিয়া যায় এবং রবিকবির ‘প্রেম’ বা ‘মরণ’ বিষয়ক সমুদয় অনুভব একঘেয়ে এই জার্নির ধকল সহ্য করনের পর ত্বকে স্থায়ী হইয়া উঠতেও পারে। রবিকৃত এবং অন্যদের সংকলিত ‘সঞ্চয়িতা’র সংস্করণগুলা কবিতার ক্রনোলজির দোষে ‘নির্দিষ্ট কোনও একটা অনুভবের’ মধ্যে লম্বা জার্নির ধকল সহ্য করতে পাঠককে প্ররোচিত করতে পারে না। পাঠক এক খাবলা ‘সোনার তরী’, আধ খাবলা ‘খেয়া’ কিংবা দুই খাবলা ‘গীতাঞ্জলি’র মধ্যে প্রেম, মরণ, ঈশ্বর ইত্যাদি অনুভ করতে-করতে নিজের জার্নিটা সারে এবং আরামে ঘুম যায়। প্রসঙ্গ বিচারে অন্য সমস্যা থাকলেও হুমায়ুন আজাদের সংকলনটা বরং পাঠককে সেই টানা জার্নির অভিজ্ঞতা কিছুটা হইলেও প্রদান করে। আজাদ রবিকবির অনুভূতির মধ্যে ‘মানবিক অম্লযান’ যে কবিতাগুলায় বহুল পরিমাণে বিরাজমান বা তাঁকে পাঠের সময় আর্দ্র করছে সেইগুলা নিয়া সংকলনটারে সাজাইছেন। এর লাভের দিকটা এখানে, পাঠক অনুভূতিপ্রবাহের তরঙ্গে গিয়া ঢোকে এবং সেই প্রবাহের কমপ্লিট রিডিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়া একসময় এক্সিট করে সেখান থিকা। রবির মতো কবিসত্তার লগে সফর করতে এই জিনিসটা কাজে দেয় এবং এটাই হওন উচিত।

রবি নিজে ‘গীতবিতান’-এ ‘পূজা’ পর্যায়ের গান যে-ছকে বিন্যস্ত করছিল সেইটা পাঠের সময় পাঠকের মনে টানা জার্নির অনুভবটা হয় এবং ধকল শেষে ‘পরব্রহ্ম’ নিয়া তাঁর ডায়ালগের ধরন নিজের অনুভবের সাহায্যে সে তখন ধরতে পারে; যদিও রবির অন্যান্য গান ও কবিতায় এই বিন্যাসটা রক্ষিত হয় নাই। তো ‘পূজা’ পর্যায়ের রবিকৃত বিন্যাসের আদলে তাঁর গান ও কবিতা নামক টেক্সটগুলার নতুন বিন্যাস হইতে পারে, যার উদ্দেশ্য পাঠককে ‘যে কোনও একটা অনুভবের মধ্যে’ টানা গমনের চাপ সহ্য করার অভিজ্ঞতার দিকে যাইতে বাধ্য করা; যেন সে এই রবিজার্নির ধকলটা টের পায় এবং গমন শেষে রবির কবিতাস্রোতে দাগানো অনুভবটারে সামগ্রিকভাবে নিজের দেহের ভিতরে জাগ্রত অথবা মৃত হইছে বইলা টের পায়।

উমবার্তো একো এই কামটাই ‘রৌজ’-এ করছিল। দেরাজের বিবরণে লম্বা সময় সে জারি থাকে এবং পাঠককে সেই বিবরণের মধ্য দিয়া জার্নিটা করায়। এই মনোটনি অন্যদিক থিকা দেরাজকে পাঠকের স্মৃতিতে অচ্ছেদ্য হইতে বাধ্য করে। সে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়, একঘেয়েমি তারে পাইয়া বসে, কিন্তু দেরাজটারে মন থিকা মুছতে পারে না। বঙ্গে দেবেশ রায়ের গল্প-আখ্যানে এই ঘটনাখান কিন্তু ঘটে। যদিও দেবেশ সবসময় তালজ্ঞান বজায় রাখতে না পারায় পাঠক দ্রুত এক্সিট নিয়া নেয়। ক্লান্ত বা বোরিং ফিল করার স্তর পার হওনের পর যে-অনুভবে রসে তার অটল হওনের কথা সেইটা দেবেশে সবসময় জারি থাকে না। রবিকবির সংসারে এক-একটা অনুভূতি নিয়া যেহেতু অনেকগুলা কবিতা আছে সেখান থিকা সংকলকের মনের লগে যেগুলার যোগ অচ্ছেদ্য হইতে পারছে সেগুলা পর্বের মধ্য দিয়া বিন্যস্ত করলে অভিঘাত খারাপ হওনের কিছু নাই। তাই কই :—

বঙ্গে পাঠ এখনও প্লেজার বইলা গণ্য হয়। যদিও পাঠ আদৌ কোনও প্লেজার না! পাঠ হইছে নিজের ত্বকের ভিতরে সেই অস্বস্তির নাম যেইটা পাঠককে ক্লান্ত করায়, অস্বস্তির দিকে তারে ঠেলতে থাকে, তার পাছায় চুলকানির বেগ উঠায়, সে সম্মোহিত হইতে বাধ্য হয়, হয়ত ঘন ঘন হাই তুলনের পর আবার সেই পাঠেই ফেরত যায় অথবা এক্সিট নেওয়ার ক্ষণে ফের গিয়া ঢোকে; এবং এভাবে একসময় জার্নিটা শেষ হইলে তার মনে হয় নিজেকে এখন যদিও শূন্য বা রিক্ত মনে হইতেছে তবে জার্নিটা দরকারি ছিল। এরকম জার্নির মধ্য দিয়া মরা টেক্সট নতুন জীবন ফিরা পায়। সম্পাদনা বা সংকলন সেই জিনিস যেইটা টেক্সটকে গার্ডেনিং করবে তারে রেইপ করার জন্য

এইটা ছাড়া রবিকবির কবিতার লগে নতুন যুগের সহবত ও আলাপ মনে হয় না সম্ভব। সত্য-মিথ্যা জানি না তবে ইতিহাসে একখান কথা চালু আছে শেক্সপিয়ার নাকি গ্যোটের রুচিতে সহ্য হয় নাই। তাঁর মনে হইছিল লোকটা ভারী কিছু কথা কইলেও খুনাখুনি আর ষড়যন্ত্রের বাখান গাইতে গিয়া মাথা ধরায়। সমস্যাটা সেখানে শেক্সপিয়ারের ছিল না বরং গ্যোটে তাঁকে ছকের বাইরে গিয়া পড়তে পারে নাই। যদিও গ্যোটের ‘বিশ্বসাহিত্য’ নামক ধারণার মধ্যে শেক্সপিয়ারে প্রতিসরিত হইতেই থাকে যা তাঁর নজর ফাঁকি দিয়া যায়! গ্যোটের এই ব্যর্থতায় শেক্সপিয়ারের অঙ্গহানি ঘটে নাই বরং ক্ষতি যা হওনের সেইটা গ্যোটের হইছিল। টেক্সটের মিসরিডিং রথি-মহারথিগো বেলায়ও ঘটতে পারে এবং গ্যোটের বেলায় সেটা ঘটছিল হয়ত-বা।

জগতে উৎপল দত্তের মতো লোকও অবশ্য বিরাজ করেন! শেক্সপিয়ারের সাহিত্যকে সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও সামন্তবাদী পুঁজিবাদের ধরতাই বোঝার মোক্ষম টেক্সট বইলা মার্ক করতে যাঁর অসুবিধা হয় নাই। উৎপলের ‘শেক্সপিয়ারের সমাজচেতনা’ উপাদেয় বহি। শেক্সপিয়ার মানেই রবিকথিত ‘মানুষের চিরায়ত স্বরূপ সেখানে ধরা পড়িয়াছে’ — সেকালে বাঙালি সমাজে প্রায় স্বতসিদ্ধ হইয়া উঠা ধারণার বাইরে গিয়া উৎপল মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থিকা শেক্সপিয়ারকে নতুনভাবে প্রাসঙ্গিক করছিলেন। রবির ক্ষেত্রেও পাঠ-বিবেচনা বহুভাবে হইতে পারে এবং হওয়া উচিত। যে-লোকটা লোকালিটির স্মারকের মধ্যে বসে গ্লোবালিটির চিনগুলায় নিজেকে অবিরত সংযুক্ত করায় তাঁর আবেদন সময়ের গতিতে উঠানামা করতে পারে কিন্তু কখনও নিঃশেষ হইতে পারে না। রবিকবির কবিতার লগে মনের যোগ ঘটাইতে এই জায়গাটা খিয়াল করা প্রয়োজন।

তো যা-ই হোক এইসব বিচিত্র পন্থায় মানবিক অম্লযানের প্রাচুর্যসৃষ্টির মধ্য দিয়া রবি তাঁর মনের দুঃখ হয়ত প্রশমিত করে খানিক :— শিক্ষা ও সদাচার রপ্ত করনের অভাবে পরব্রহ্মর অতুল উৎকর্ষে জাতির উত্তরণ ঘটে নাই, তবু, বহুবিধ সংকীর্ণতার অন্ধকূপে কাল যাপন সত্ত্বেও তাদের সরল হৃদয়ে যে-মানুষ চমকায় সেই মানুষগুলারে উপেক্ষার সাধ্য কোনও লেখকের নাই। রবির কারিশমা হইছে বজরা থিকা নজর করলেও কিংবা ওইসব সরল হৃদয় মানুষের সঙ্গে আকাশপাতাল দূরত্ব থাকলেও তাদের সে কখনও অচ্ছুৎ ভাবে নাই। তাঁর পক্ষে শরৎ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, সতীনাথ, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অমিয়ভূষণ বা দেবেশ রায় কিংবা ছোটলোকের যৌনবিকারের জগৎ উন্মোচনে দড় মানিক ও জগদীশ গুপ্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ছোটলোকদের মধ্যেও চিরন্তন যে-মানুষ চমকায় সেই আবিষ্কারে ত্রুটি ঘটে নাই।

রবির মানবিক বোধির এই দিকটা অন্যভাবে হুমায়ূন আহেমেদে পুনরায় ঝিলিক দিয়া উঠছিল বইলা হয়ত আমজনতা তাঁরে অন্তরের গভীরে এখন লালন করে। তবে হুমায়ুনে সেই অতুল বৈভব ও বিচিত্রতা নাই যেইটা রবিপাঠে অমোঘ হইতেই থাকে। যে-কারণে হয়ত তাঁর পূর্ববঙ্গ কিংবা নগর কলকাতার শ্রীহীন জীবনের ছকে প্যাঁচখাওয়া মানুষগুলারে অনায়াসে আপন ভাবতে পাঠক বাধ্য হয়। পশ্চিমের সাহেবমেমদের কাছে এই রবি কতখানি অনূদিত হইছিলেন এবং হয়ে থাকলে তাঁরা সেইটা কতখানি ধরতে পারছিলেন সে-দিকটা মনে হয় বিবেচনার সময় হইছে। এই সিগনেচার রবির প্রাণশক্তি এবং সেখানে তাঁরে পড়তে আরাম। এর বেশি যারা খোঁজেন তাদের হয়ত মানুষটারে বাদ দিয়া আগানো উত্তম।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you