ফাহাম আব্দুস সালামের ‘বাংলাদেশ এক্সপ্লেইনড’ শীর্ষক ইউটিউব-কথামালায় শুরুর দিকে আগ্রহ বোধ করলেও পরে সে আর বজায় থাকেনি। ভদ্রলোক সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। এর আগে তাঁর নাম কি শুনেছি? মনে হয় না। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও ইসলামচর্চার খোঁজ নিতে গিয়ে তাঁর ইউটিউবকন্টেন্টে চোখ পড়েছিল। কৌতূহল থেকে লিংকে ঢুকেছিলাম। ‘বাংলাদেশে ইসলাম ও সেকুলারিজমের সংঘাত কোথায়?’ শিরোনামের ভিডিওক্লিপটি সম্ভবত প্রথম শোনা হয়েছিল। পরে ইন্টারেস্টিং মনে হওয়ায় বাকিগুলো শুনেছি। ‘বাংলাদেশ এক্সপ্লেইনড’ — ভদ্রলোকের এই ঘোষণার মধ্যে দেশের হাড়মাস চিনে ফেলার ভঙ্গিটি বেশ মনে ধরেছিল। বাংলাদেশ নিয়ে জীবনভোর হাজার প্যারা ও কনফিউশনে ভোগায় কেউ তাকে নিঃসংকোচে ‘এক্সপ্লেইনড’ ঘোষণা দিচ্ছে দেখলে মনে ধাক্কা লাগে! অগত্যা ফাহাম সাহেবের ভিডিওগুলো একে-একে শোনা হলো। নিজের মতামত রাখার সময় তাঁর বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশকে তিনি ‘এক্সপ্লেইন’ করতে বসেন নাই বরং এক্সপোজড বা ন্যাংটা করার বাসনায় ইউটিউবে হাজির হয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলের সেটি ছিল বড়ো কারণ।
বাংলাদেশের ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে শাণিত বিদ্রুপ আজকাল খুব-একটা চোখে পড়ে না। আহমদ ছফা ও হুমায়ুন আজাদ গত হওয়ার পর বিগত একদশক ধরে বিদ্রুপ মানে সেফুদা-র খিস্তি নয়তো বিচিত্র ম্যানিক ডিজওর্ডারে ভোগা প্রগতিপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীলের পুন্ মারামারি! সেফুদার অ্যাবিউজিভ ‘শব্দবোমা’ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে ট্রল ও রোস্টেড ভিডিওর যে-সংস্কৃতি বাঙালি পয়দা করেছে সেখানে ডিপজল, সেফুদা, হিরো আলম, শামীম ওসমান, তাহেরি আঙ্কেল থেকে শুরু করে আরো অনেকে জাতির মস্তিষ্কে ট্রেডমার্কের মহিমা লাভ করেছেন। তাহেরি হুজুরের জিকিরবাজি নিয়ে ‘আজাইরা লিমিটেড’-এর ব্যানারে প্রত্যয় হিরণ ও পোলাপানরা মিলে যে-গানগুলো বেঁধেছিল সেখানে এইসব ট্রলড সেলেব নিজের কীর্তি ও সংলাপ সহ ডকুমেন্টেড হয়েছেন বলা যায়। বিচ্ছু পোলাপানদের মগজ থেকে বের হওয়া ‘বসেন বসেন’ বা ‘ঢেলে দেই’-র মতো সংগীত-আয়োজনের উপকারি দিক হচ্ছে দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের হালত ও খাসলত বুঝতে বুদ্ধিজীবীর ভারিক্কি বচনের চেয়ে পোলাপানরা বরং ভালো কাজে দেয়। অ্যাট লিস্ট, দেশের মান্যগণ্য লোকজনকে চ্যাংড়ারা কেন অনার করতে চায় না অথবা অনার পাওয়ার হক উনারা রাখেন কি-না সেই প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসে।
রাষ্ট্রসংঘ যখন নানান অজুহাতে পাবলিককে অ্যাবিউজ করে তখন সেখানে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্ম অবধারিত হয়। তিন দশকে যেসব সাংস্কৃতিক উপজাত বাংলাদেশে পয়দা হয়েছে সেফুদা সহ বাদবাকিরা হচ্ছেন তার ফসল। মধ্য-নব্বই থেকে শূন্য দশক অবধি সিনেপর্দায় ডিপজলকে দিয়ে উপজাতগুলা পয়দা হইতে শুরু করে আর এখন সেফুদার যুগে পৌঁছে সেটি পূর্ণতা লাভ করেছে। অবদমিত সমাজে বিচিত্র উপায়ে ফাকড্ জনগণ সেইসব বুলি আশা করে যেগুলো নিছক বুলির মাঝে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে স্বয়ংক্রিয় শিশ্নে রূপ নিতে পারে, যেন যারা তাকে ছলেবলে ঠাপিয়েই যাচ্ছে তাদের ওপর শোধ তোলা যায়। সুতরাং বাঙালি কালচারে ডিপজল থেকে সেফুদা হয়ে হিরো আলমের উত্থান অবধারিত ছিল। আবদ্ধ ও ভারসাম্যহীন সমাজে এইসব সাংস্কৃতিক উপজাতের উত্তর-আধুনিক তাৎপর্য অন্বেষণ হয়তো-বা সম্ভব; তবে মোদ্দা কথাটি নিতান্ত সরল, — স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ দাসত্বের শ্রেণিকরণ থেকে বের হতে না-পারায় অবদমনের উদ্ভট বিস্ফার ছাড়া নিজেকে প্রকাশের কোনো বিকল্প তার জন্য আপাতত খোলা নেই।
‘মদ খা মানুষ হবি’, ‘আমারে দেখে হিংসে হয়?’, ‘আমার মতো হইতে চাস?’, ‘গরিব বাঙালি আমি কি খাই দেখ’, ‘তোর গুষ্ঠিরে চুদি’ ইত্যাদি সেফুবচনে নিহিত খিস্তির ঝাঁঝ আবালবৃদ্ধবণিতা বাঙালিকে নিজের সুরত দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। একটি স্পেস যেটি অন্যভাবে পাওয়ার উপায় বাংলাদেশের সমাজে এখন আর অবশিষ্ট নেই। সেফুবচনে প্রবেশের পর বাংলার আমজনতা টের পায় কে-বা-কাহারা চুপিসারে তার ওপর বহুকাল ধরে উপগত হয়ে চলেছে, যাদের সঙ্গে তার যৌনপীড়নভারাতুর রমণ যেন শেষ হওয়ার নয়! রতিনিঃস্ব জনতার মনে প্রতারিত ও ধর্ষিত হওয়ার যে-বোধ সেফুর খিস্তি জাগিয়ে তোলে সেই প্রভাবে তার হয়তো সেফু হইতে ইচ্ছা হয়! হাসি, অশ্লীলতা আর বিনোদনের সীমানা পেরিয়ে বাঙালি জনমনে সেফুদা নামের লোকটি মূর্তিমান উপদ্রব হয়ে রাজ করতে থাকে। তাঁকে অকাট্য ভাবা ছাড়া বাংলাদেশের জনগণ ও তার শাসকবৃন্দ বা সুশীল সমাজের চরিত্র নির্ণয় কেন যেন দুরূহ মনে হইতে থাকে। বাঙালি মনে-মনে ভাবে, ‘এই গালিগুলা আমারো দিতে ইচ্ছা করে তবে সেই হ্যাডম নাই যে গালি দিতে পারি। সেফু আর কিছু পারুক বা না-পারুক খিস্তি ঠিকমতো ঝাড়তে পারে!’ ঘটনা মিথ্যে নয়, খিস্তি ছাড়া তৃতীয় কোনো বুলি/সংলাপ উৎপাদনের হ্যাডম বহুকাল হয়ে গেল বাঙালির জীবন থেকে একপ্রকার নিখোঁজ রয়েছে!
উন্নয়নের জোয়ারে টলমল দেশে যারা এখন ভাবেন মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরে তামাদি হয়েছে তাদের ভুলটা বোধহয় এইখানে ঘটে যায়। ওটা শেষ হয়নি বরং বলা ভালো এখনো শুরু হয় নাই। নয় মাস ধরে যা ঘটেছে সেটি প্রস্তুতিকাল মাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে তবে শেষের প্রশ্ন আসে! শুরু যেখানে হয় নাই সেখানে শেষ হওয়ার প্রশ্ন আসে কী করে? প্রস্তুতিকালের বৃত্ত ভেঙে জাতি কবে একাত্তরটা শুরু করতে পারবে অথবা আদৌ পারবে কি-না সেই প্রেডিকশন এখন দেওয়ার উপায় নাই। শোধ ও প্রতিশোধের খেলা থেকে নিষ্কৃতি না-জোটায় বাংলাদেশের জনগণের আমল-খাসলত আর ভূত-ভবিষ্যৎকে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে রেখে আলোচনা অথবা সে-রকম ডিসকোর্স পয়দা করা মেহনতের কাজ। কারণ জাতি এবং তার ভাগ্যবিধাতারা এমনধারা আলোচনার জন্য এখনো প্রস্তুত ‘নহেন’!
সে-যা-হোক, ফাহাম আব্দুস সালামকে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে জাতির ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তায় গমন করতে দেখে মন খানিক ফুরফুরা হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী-বিএনপি-হেফাজত রঙ্গ, বাংলার ওয়াজি হুজুরদের তামাশা আর ওদিকে সেফুদা ও হিরো আলমের লাগাতার ভাঁড়ামির মনোটনি থেকে জাতিকে তিনি খানিক রিলিফ দিতে পেরেছেন মনে হয়। ইন ফ্যাক্ট, ওপার বাংলার চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের তুলনায় তাঁর বক্তব্য কানে অনেক বেশি আর্টিকুলেটেড শোনায়। কথাগুলোর মধ্যে গোঁজামিল থাকলেও ওজন বিচারে হাওয়াই মিঠাই নয়। ধারালো বা সোজা কথায় ‘ইস্মার্ট’। ঠাসবুনোট গ্রন্থনার কারণে তিনি ‘কী বলিতে চাহেন’ সেটি তাই ধরতে পারা যায়। বক্তব্যে লুকোছাপা না-থাকার কারণে সহমত এবং একইসঙ্গে সন্দেহ বা প্রশ্ন তোলার স্পেস নিয়ে মাথার কেশ ছিঁড়তে হয় না।
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য ও ফাহাম আব্দুস সালামকে পাশাপাশি দাঁড় করালে দুই বঙ্গের জনমনে সক্রিয় মিলন ও বিচ্ছেদের জায়গা খানিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ তো মিথ্যে নয়, রক্তসূত্রে সোদর হলেও ঐতিহাসিক বিবর্তনের চোরাটানে উভয় বঙ্গের বাঙালিয়ানায় প্রভেদ ঘটে গিয়েছে, যারপরনাই বাঙালির স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয় সন্ধানের প্রবণতা এখন আর অতীতবৃত্তে দাঁড়িয়ে নেই। সাম্প্রতিক হিন্দুত্ববাদী জাগরণের ঢেউ দানবীয় রূপ ধারণ করায় ওপার বাংলার বাঙালি জনজীবনে উত্তর-ভারত থেকে আগত সংস্কৃতির চাষাবাদ প্রবল হয়ে উঠতে চলেছে মনে হয়। আত্মপরিচয়ের মামলায় উগ্র হিন্দুত্ববাদ থেকে ভূমিষ্ট সাংস্কৃতিক উপকরণের জোয়ার ঠেকানো সেখানকার বাঙালির জন্য বড়ো সমস্যা। বাঙালিয়ানার কুললক্ষণ বিচারে ওপার বাংলার বাঙালি সর্বভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে এমনিতেই বাধ্য, এর পাশাপাশি হিন্দু জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অংশ উগ্র হিন্দুত্ববাদী স্রোতধারায় শামিল হওয়ার প্রবণতায় ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন সে-কথা বোধহয় বলা যায়!
উক্ত সাংস্কৃতিক বোধির বাইরে জনমনে বাঙালিয়ানার আরেকটি পরিচয় কালের ধারায় স্থায়িত্ব লাভ করেছে। স্থানীয় ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির ঢেউয়ে ধর্ম থেকে উৎসারিত উপাদানকে সাংস্কৃতিক উপজাতের অধিক গুরুত্ব প্রদানে সে কখনো আগ্রহ বোধ করেনি এবং নিজের জীবনচর্যায় একে সেভাবেই জায়গা দিতে চেষ্টা করে। ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথাচার থেকে ভূমিষ্ট সাংস্কৃতিক পরিচয়কে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে বাঙালি জীবনে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার অনুপ্রবেশ রূপে বাঙালিয়ানার এই ধারাটি সবসময় বিবেচনা করে এসেছে এবং তার সে-প্রত্যয়ে আজো ছেদ পড়েনি। একটি সেকুলার মাইন্ডফ্রেম সেখানে ভূমিকা রাখে তাতে সন্দেহ নাই।
ওপার বাংলায় তিন দশকের বামপন্থী শাসনে গুরুতর ভুলত্রুটি ও অমার্জনীয় পদস্খলন থাকলেও সর্বভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির চাপ থেকে বেরিয়ে বাঙালিয়ানাকে সর্বজনীন চেহারা প্রদানের চেষ্টায় তাদের ভূমিকা মোটামুটি ইতিবাচক ছিল। যদিও সংখ্যালঘু মুসলমান আর প্রান্তিক হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন বা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের রাজনৈতিক অঙ্গিকারকে কখনো স্বচ্ছ মনে হয়নি। নন্দীগ্রামের ঘটনা বা এই সুযোগে পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান তাই একপ্রকার অনিবার্য ছিল। বাম, বিজেপি ও কংগ্রেসকে রোখার মতলবে হিন্দু মধ্যবিত্ত আর মুসলমান ভোটের ব্যবহারে মমতা ব্যানার্জি নতুন কৌশলের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর এই কৌশল ওপার বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সঠিক মনে হলেও সেকুলার মাইন্ডফ্রেমের আদি চরিত্রের সর্বনাশ ঘটিয়েছে বলে অনেকে মত দিয়ে থাকেন। মসনদের খেলবাজি বাঙালিয়ানার চরিত্র নির্ধারণে চিরকাল যুগান্তকারী প্রভাব রেখেছে এবং আজো ব্যতিক্রম নেই। যে-কারণে মমতা ম্যাজিকের বড়ো চাবি মুসলমান ভোটব্যাংকে ফাটল ধরানো আর ওদিকে বিজেপির মোকাবিলায় দিশেহারা সেকুলার রাজনীতির নিশানবাহক কংগ্রেস ও সাম্যবাদী বামরা ফুরফুরা শরিফের আলেম পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে এবারের বিধানসভার নির্বাচনে জোট বাঁধতে দ্বিধায় ভোগেনি! আব্বাস সিদ্দিকী ফায়দা তুলে নিলেও বাম এবং কংগ্রেসের যে উপকার হয়নি সেটি নির্বাচন পরবর্তী ফলাফলেই স্পষ্ট!
কংগ্রেস ও বামপন্থার এই অধঃপতন বঙ্গে বিজেপির শক্তি বাড়িয়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে বৈকি। তৃণমূলের বিজয় নরেন্দ্র মোদির অশ্বমেধযজ্ঞে আপাতত লাগাম পরিয়েছে সত্য, তবে সামনের নির্বাচনে হিন্দু জনমনে বিজেপির প্রভাব দুর্বার হয়ে উঠার সম্ভাবনা দূর হয়ে যায়নি। বঙ্গে বাম ঘরানায় বিদ্যমান সেকুলার রাজনীতি কেরালার থেকে এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে সে আর না-বললেও চলে। এতকিছু সত্ত্বেও বাঙালির লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক-এর জায়গাটি অন্তত ওপার বাংলায় মোটের ওপর নির্দিষ্ট চরিত্র ধারণ করে বলা যায়। এই চোরা হাহাকার অবশ্য গোঁড়া থেকে সেখানে বিদ্যমান, — প্রাদেশিক স্রোতধারায় উৎসারিত ভাষা ও সংস্কৃতি বেনোজলের মতো বাঙালির আঙিনায় ঢুকে পড়েছে এবং এর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ইতিহাসকে সঙ্গী করে বাঙালি থাকার সবক তাকে পুরা করতে হচ্ছে!
বাংলাদেশের বাঙালি সেদিক থেকে ভিন্ন প্রকৃতির বাঙালিয়ানায় নিজেকে কেন্দ্রীভূত রাখতে বাধ্য হয়েছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক রূপে স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয়ের জায়গাজমি বুঝে নেওয়ার পালা সে এখনো শেষ করতে পারেনি। বুঝে ওঠার প্রক্রিয়াটি এখানে তাই পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক। আত্মপরিচয়ের নিশানা স্থির করার কাজে বাংলাদেশের আমজনতা নিশ্চিত সুরাহায় পৌঁছাতে পারছে না। প্রাচীন ইতিহাস থেকে সেদিন অবধি প্রবাহিত বাঙালিয়ানার অতীত সূত্রগুলো দেশের জনমনে আজো স্মৃতিকাতর তরঙ্গ বহায়। অন্যদিকে ঐতিহাসিক কালপর্বে ইসলামকে কবুল করার ফলে যেসব আচারব্যাভারের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে সেগুলোকে একত্র করে মুসলমান বাঙালির সংজ্ঞায় নিজের আত্মপরিচয়কে অকাট্য করার দাবি আজকাল ঘনঘন ওঠে। আবার, বাংলাদেশী নাগরিক পরিচয়ের মধ্যে বাঙালি মুসলমানকে দ্রবীভূত করার ভাবনাও সেখানে পেইন ওঠায়। ত্রিভূজ এই ছকে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বা পাহাড়িদের জায়গা দিতে হলে বাঙালি ও বাংলাদেশী মিলে যে দ্বৈত পরিচয় তাকে কীভাবে পড়তে পারলে সকলের ন্যায্য হিস্যা সেখানে নিশ্চিত হয় সেই ডিসকোর্সটি আজো গড়ে ওঠে নাই। যারপরনাই ওপার বাংলার বাঙালির চেয়ে বাংলাদেশের বাঙালির আত্মপরিচয়ের সমস্যাটি অধিক জটিল এবং এখন অবধি অমীমাংসিত ঘূর্ণি রূপে পাবলিক স্ফিয়ারে সে বিদ্যমান। চন্দ্রিল ভট্টাচার্য যেখান থেকে সরাসরি বাঙালি ও বাঙালিয়ানাকে রিলেট করেন একজন ফাহাম আব্দুস সালামের পক্ষে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে শুরু করা বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কলকাতা মহানগর পেরিয়ে যে-বাঙালিকে ওপার বাংলায় এখনো দেখা যায় চন্দ্রিলের বাঙালি বাখানে তার স্বরূপ কেন জানি ফুটে ওঠে না! তিনি হয়তো ইচ্ছে করে একে পাশ কাটিয়ে যান। চন্দ্রিল বাবু বাককুশল হলেও তাঁর বাকচাতুর্য কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালির রঙ্গরসভরা স্মৃতিকাতর বন্দনার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নতুন সংজ্ঞা, উপমা ও সামগ্রিকতায় বাঙালি সমাজের ব্যাখ্যা কদাচিৎ তুলে ধরতে আগ্রহ বোধ করে। যারপরনাই তাঁর বাঙালি ও বাঙালিয়ানার ধরতাইকে অপূর্ণ, খণ্ডিত বা শ্রেণিবদ্ধ ভাবার কারণ রয়েছে। চন্দ্রিলের কথামালায় সচল বাঙালি সামগ্রিক বাঙালিয়ানার প্রতিধ্বনি নয়, এই কথাটি বোধহয় আর না-ভাবলেও চলে। শহুরে ভদ্দরনোকদের হাতে গড়া আর্বানাইজড বাঙালিয়ানার প্রতিনিধিত্ব করতে আগ্রহী সে, যাকে এখন উগ্র হিন্দুত্বের সঙ্গে প্রাদেশিক ও বৈশ্বিক সংস্কৃতির চাপ আমলে নিয়ে নিজের অতীত ও বর্তমানকে সংজ্ঞায়িত করার কসরতে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।
চন্দ্রিলের জন্য ঘটনাটি একদিক থেকে সু্বিধার বটে! তাঁর লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে বাঙালি ও বাঙালিয়ানা হচ্ছে কেন্দ্রীভূত ঘটনা। কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করে এই বাঙালিয়ানা একসময় জনসংস্কৃতির বৃত্ত গড়ে তুলেছিল। দুই বাংলা মিলিয়ে জনসংস্কৃতির যত চিহ্ন রয়েছে সেগুলোর রূপান্তর ও বি-নির্মাণ সেখানে একদা ঘটেছিল বলে গুণীজনরা মতামত দিয়ে থাকেন। যারপরনাই শহুরে এই বাঙালিয়ানাকে জাতধর্মবর্ণ ছাপিয়ে যাওয়া বাঙালিত্বের প্রতীক ভেবে অনেকে সুখ পান। মাছের ঝোল, রসগোল্লা, কপালে লাল টিপের সঙ্গে তাল দিয়ে কাবাব ও বিরিয়ানির চল, ঘটি আর বাঙালকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিচিত্র সাংস্কৃতিক আচার-অভ্যাস ও তাদের মধ্যকার স্মৃতিকাতর সংঘাত, উত্তর কলকাতায় বিরাজিত জমিদারি স্থাপনার ভগ্নাবশেষ, এক টুকরো হাওড়া ব্রিজ, কফি হাউজ ও কলেজ স্ট্রিট, গড়ের মাঠ বা ময়দানের চৌহদ্দিকে ঘিরে সম্প্রসারিত ঐতিহাসিক স্থাপনা, দুর্গোৎসব বা শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান আর মোহামেডান, পার্ক স্ট্রিট ও কালীঘাট, আর জাকারিয়া স্ট্রিটকে ঘিরে সচল উর্দুভাষী বাঙালির জগৎ … প্রতিটি চিহ্ন নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখে বাঙালিয়ানার স্মারকে পরিণত হয় এবং সেকুলার ইমেজারির সুখ মনে বহায়! বলাবাহুল্য ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত কলকাতার শিক্ষিত জনসমাজ একে বাঙালিয়ানা ভেবে আরাম পায় এবং সাহিত্যে, গানে বা সিনেমায় প্রমোট করে যায়। যদিও এর অন্তরালে কলকাতার বাইরে পড়ে থাকা একখণ্ড বীরভূম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পশ্চিম দিনাজপুর, নদীয়া বা মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক জনসংস্কৃতি সেখানে নিজের ঠাঁই খুঁজতে গিয়ে উল্টো বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। তারা সেখানে অবহেলে পড়ে থাকে নয়তো বুদ্ধিজীবীর বাতেল্লার খোরাকি হয়, বেশি হলে সাবঅল্টার্ন কালচারের প্রতীক রূপে দেশবিদেশের সেমিনারে ঘোরে!
চন্দ্রিলের বাঙালি-বাখানে অগত্যা সামগ্রিকতার সন্ধান মিলে না। বঙ্গে হিন্দু ও মুসলমান সমস্যা বা তাদের বাঙালিয়ানা চর্চার ধারা নিয়ে তাঁকে কথা কেন না জুড়লেও চলছে সেই ভাবনাটি এই সংগীতকারের বাঙালিকথনে উহ্যই থেকে যায়! তিনি একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং তাঁর ফ্রেমওয়ার্কটি সেক্ষেত্রে বেঙ্গল রেনেসাঁর উপজাত হিসেবে সৃষ্ট যে-বাঙালিয়ানা কলকাতা মহানগরের চরিত্র গড়ে দিয়েছিল তার মধ্যে সমগ্র ওপার বাংলার বাঙালিকে নবীকরণ করে অথবা সেখানে একীভূত ভাবতে চায়। বাঁকুড়া-বীরভূম-মুর্শিদাবাদ সেই একীভূতকরণের অংশ হয়ে চন্দ্রিলের চেতনায় দোল খায়। সুতরাং তাঁকে আলাদা করে হিন্দু বা মুসলমানের বাঙালি হওয়ার গল্প না জুড়লেও চলছে বলে তিনি হয়তো ভাবেন!
ফাহাম আব্দুস সালামের ক্ষেত্রে ঘটনা জটিল। তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় চন্দ্রিলের মতো তিনিও লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক-এ বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় ও করণীয় নির্ধারণে আগ্রহী। সাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয়ে মুদ্রিত বৈশিষ্ট্যের সাপেক্ষে বাঙালিয়ানাকে যাচাই বা সংজ্ঞায়িত করার ভাবনা তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে। বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত এই বাঙালিয়ানার বনেদ রচনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণের আচারব্যাভারকে কলকাতা বা ওপার বাংলা প্রভাবিত স্মৃতিকাতর পিছুটান থেকে পৃথক করার প্রয়োজনীয়তা স্বাভাবিক কারণে সেখানে অন্তিম হয়ে ওঠে। চন্দ্রিলের সঙ্গে ফাহামের তফাৎ এই জায়গায় যৌক্তিক ঠেকলেও কেন জানি সন্দেহজনক হয়ে ওঠে। কেন? — সেই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পাঠককে তাঁর কন্টেন্টগুলো মনোযোগ সহকারে শ্রবণের অনুরোধ করি। বাকচাতুর্যের আড়ালে এখানে যে-খেলাটি তিনি খেলেন সেটি নতুন কিছু নয়, ফরহাদ মজহার বা সলিমুল্লাহ খানরা প্রায় তিন দশক ধরে এটি চালিয়ে নিচ্ছেন এবং ফাহামকে তাঁদের উত্তরসূরি ভাবার কারণ রয়েছে।
তথাপি বাঙালি নিয়ে বাকপটুতার খেলায় ফাহাম আব্দুস সালাম মনে আরাম বহায়, যেহেতু চন্দ্রিলের বক্তব্য অহরহ যেসব ফাঁকা জায়গা রেখে যায় ফাহামের বক্তব্য সেখানে আর কিছু-না-হোক ওইসব শূন্যস্থান অথবা বাঙালির সামগ্রিক আয়তনকে রিকভারির চেষ্টা করে। বাঙালির কুললক্ষণ ব্যাখ্যায় নেমে চন্দ্রিলকে বাংলাদেশ ও তার বাঙালিয়ানাকে বিশেষ গুরুত্ব না-দিলেও চলছে। পৃথক রা্ষ্ট্র হওয়ার কারণে বাংলাদেশের বাঙালিরা এখন তাঁর ভাবনার আধারবীজ রূপে অবধারিত নয়। দেশভাগের কারণে বাংলার বিচ্ছেদ ঋত্বিক ঘটককে সেই সময় খেপিয়ে তুলেছিল। আজকের চন্দ্রিল ভটচাযের কাছে ঋত্বিকের আবেগ গভীর গুরুত্ব বা প্রাসঙ্গিকতা রাখে না। ফাহাম আব্দুস সালামের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেহতর জটিল। বাঙালি, বাঙালি মুসলমান ও বাংলাদেশীর ত্রিভুজে বিচরণ করতে বাধ্য হওয়ার কারণে আত্মপরিচয়ের নিশানা ঠিক করতে নেমে তাঁকে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ বা ঋত্বিক থেকে শুরু করে হিন্দু সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবিতার দ্বারা প্রভাবিত বাঙালিয়ানাকে ডিনাই করা কেন জরুরি সেইসব নিয়ে ভাবতে হয়। ফাহামের বক্তব্যকে এই সমস্যার জায়গা থেকে পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
মোটা দাগে তাঁর ভাবনা অযৌক্তিক এমন নয়। পুরান ঢাকার নবাবি সংস্কৃতির উপজাত অথবা ধরা যাক ব্রিটিশ আমলে চারিয়ে ওঠা বনেদি মুসলমানের যে-অংশটি ইরান-তুরান-খোরাসান বা সুলতানি-মোঘল ও সুবে বাংলার ছাপতিলক বহন করে বাঙাল বনেছে বলে দাবি করে, যাদের লিঙ্গুয়াল কনটেক্সট বাংলার চেয়ে উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতির ছাপকে আপন করে নিয়েছিল ও আজো সেই উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, যেখানে বেঙ্গল রেনেসাঁ কর্তৃক চিহ্নিত বাঙালিয়ানার লক্ষণ প্রবেশের পথ পায়নি, বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে এখন তাদেরকে যদি দণ্ডমুণ্ডে বাঙালি গণ্য করতে হয় সেক্ষেত্রে তারা যে-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে স্বকীয় বা মহিম হয়েছেন তাকে বাংলাদেশের জীবনস্রোতে অঙ্গীভূত বিবেচনা করা অনিবার্য হয়ে ওঠে। এছাড়া বাংলাদেশে এই মুহূর্তে সচল বাঙালিয়ানার বৈচিত্র্য ও সামগ্রিকতা কেন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
মোহাম্মদপুরে ঠাঁই নেওয়া বিহারিরা পঞ্চাশ বছর পার করেও নিজেকে পাকিস্তান বাদে অন্য কোনো সংজ্ঞায় দাগাতে আগ্রহ বোধ করেনি। বাংলাদেশী রমণীদের সাদিসুদা করলেও জন্মসূত্রে পাওয়া দেশকে অবিকল্প ভাবার মজ্জাগত প্রবণতা বা মুখের বুলি ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখার চেষ্টায় বিহারিদের মধ্যে বিশেষ পালাবদল আজো ঘটেনি। তো লোকালিটির এই চেতনাকে স্বীকার করে বিহারি জনস্রোতকে যদি বাঙালিয়ানার বৃন্তভুক্ত বিবেচনা করতে হয় তাহলে এর ফ্রেমওয়ার্কটি কেমন হবে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। তদুপরি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে বাঙালিয়ানার সংজ্ঞা ফ্রেমওয়ার্কে কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে সেটি ভাবনার বিষয়। তার চরিত্র কি সেকুলার হবে সেখানে? নাকি ইসলামি? অথবা অন্য কিছু? অতীতসূত্রে পাওয়া বাঙালিত্বের স্মারককে জায়গা দেওয়ার সুযোগ সেখানে থাকবে কি? স্মারকগুলোকে কি রাখা জরুরি? কাটছাট করা সমীচীন? অথবা বাদ দেওয়াই ভালো? — প্রশ্নের মীমাংসায় ফাহাম নিজের বক্তব্য তুলে ধরলেও সেগুলো কেন জানি পুরোনো সংকীর্ণতার খোপে গিয়ে ঢুকছে মনে হয়! পাকিস্তানি জামানায় বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের নিশানা খোঁজার তাড়না থেকে উৎসারিত বক্তব্য বা কর্মকাণ্ডে সংকীর্ণতার খোপে ঢোকার প্রবণতা কমবেশি সুলভ ছিল। ফাহামের বক্তব্য পুরাতন সেই স্মৃতিকে টোকা দিয়ে যায় বৈকি!
চন্দ্রিলের মতো ফাহাম আব্দুস সালামও সুপারফিশিয়াল বা ভাসা-ভাসা কথাবার্তায় কাম সারেন মনে হচ্ছে, তবে এটা কবুল, — আর্টিকুলেশন চন্দ্রিলের তুলনায় জবরদস্ত হওয়ার কারণে তাঁর ঘোরপ্যাঁচ লাগানো কতাবার্তার উদ্দেশ্য সহজে মালুম হতে চায় না। চন্দ্রিলকে একবার শোনা হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার না শুনলে হানি ঘটেছে এমনটি আজো মনে হয় নাই, ফাহাম আব্দুস সালামের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় তো বটেই, প্রয়োজনে একাধিকবার শ্রবণ বেশক হয়ে ওঠে। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে জাতিকে সুশৃঙ্খল ছন্দে বাঁধার তরিকায় তাঁর মতলবি বচনের সরহদ্দ কার কামলা খাটছে সেটি এছাড়া ধরা দিয়েও দিতে চায় না। এই বাংলাদেশীর কন্টেন্ট পাঠ/শ্রবণের সময় বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি।
…
ইউটিউবে ভিউয়ার্স পাওয়ার ক্ষেত্রে কন্টেন্টের উপস্থাপনা বড়ো বিষয়। কাজটি কে কীভাবে সারছেন তার ওপর দর্শকের আগ্রহ নির্ভর করে। ফাহাম আব্দুস সালামের বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে সেই জিনিস রয়েছে যেটি তাঁকে শুনতে বাধ্য করায়। বক্তব্য রাখার ক্ষণে অভিব্যক্তি দর্শক খেয়াল করতে বাধ্য হয়। হাসিখানা আনকমন ও সিগনিফিকেন্ট! বিদ্রুপমাখা কথাগুলোকে এই হাসি সম্ভবত আরেকটু আই ক্যাচিং বা নজরকাড়া করতে ভূমিকা রাখে। কথার মাঝখানে মিলি সেকেন্ডের যে-পৌজটা তিনি নিয়ে নেন অথবা তাকানোর কায়দা এবং সেখান থেকে বক্তব্যে ফেরত যাওয়ার ভঙ্গি … ফেশিয়াল এই এক্সপোজার বা মুখাভিনয় হচ্ছে তুরুপের তাস; সরঞ্জামগুলো তাঁকে আত্মবিশ্বাস যোগায় আর দর্শক বাকি সব ভুলে তাঁর ওপর ক্রাশ খায়। যারপরনাই তাঁর কনফিডেন্ট বাংলাদেশ-ব্যাখ্যার সারবত্তা যাচাইয়ের পরিবর্তে বিনাপ্রশ্নে একে সত্য/সঠিক মেনে নিতে তাকে দু-বার ভাবতে হয় না। সে যেন বাধ্য সায় দিতে, — ‘লোকটার কথায় যুক্তি আছে! কথা যেগুলা বলছে সেগুলা মিছে নয়।’ গুছিয়ে কথা বলতে পারা আর্ট হয়ে থাকলে ফাহাম আব্দুস সালাম সেখানে তরক্কি দাবি করতেই পারেন।
দশ থেকে কুড়ি মিনেটের বক্তব্যে যেসব এক্সপোজার তিনি দিয়ে থাকেন সেগুলো তাঁর জন্য হয়তো স্বাভাবিক! তিনি হয়তো এভাবে লোকের সঙ্গে কথা বলে অভ্যস্ত। হতে পারে শিল্পটা তিনি রপ্ত করেছেন। ঘটনা যেমন হোক, কথা বলার এই আর্ট তাঁর বক্তব্যকে মৌখিক অভিব্যক্তির সঙ্গে সমাপতিত বা সিঙ্ক্রোনাইজ করায়। প্রচলিত ভাষায় একে কি সম্মোহন ভাবা যায়? দেরিদার ভাষায় বলতে হয়, কথা বলা ও লেখার মাঝখানে দূরত্ব নামের যে-ব্যাপারখানা সচরাচর বিরাজিত থাকে অর্থাৎ মধ্যবর্তী পরিসরটি এই সমাপতন অর্থাৎ সিঙ্ক্রোনাইজেশনের কারণে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না-হলেও বক্তা ও বক্তব্যকে একীভূত ঘটনায় পরিণত করে। বক্তা এবং তার বিবৃতি দুটো পৃথক ঘটনা হলেও তাদেরকে পৃথক ভাবার পথটি সেখানে রুদ্ধ হয়ে আসে। এই অনুমান তাই অসংগত নয়, — ইউটিউবে হাজির হয়ে নিজের মুখে যে-কথাগুলো ফাহাম আব্দুস সালাম ডেলিভার দিলেন, এর সঙ্গে ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’ শিরোনামে যে-কিতাব তিনি লিখেছেন, তাদের মধ্যে তফাৎ নগণ্য হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিতাবখানা এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে আন্দাজ করি বক্তাসুলভ পোশ্চার বা অঙ্গবিক্ষেপের ছাপ সেখানে প্রবল থাকা অবান্তর নয়, বরং স্বাভাবিক হওয়ারই কথা।
এটা ঠিক, ফাহামের কিতাবে সেই চিহ্নগুলো পাওয়া সম্ভব নয় যেগুলো তিনি বক্তা হিসেবে গলার স্বর, বাচনভঙ্গি, হাসি, মিলিসেকেন্ডের বিরতি ও তাকানোর ভঙ্গি দিয়ে অনায়াসে ডেলিভারি দিচ্ছেন, এবং কিতাবে মুদ্রিত বচনে পাঠকের পক্ষে উক্ত পোশ্চারের অনুরণন আন্দাজ করা কঠিন নয়। যদি সে-রকম হয় তাহলে বলতে হবে বাংলা শব্দচয়নে ইংরেজির পাঞ্চিং মিশিয়ে যে-টেক্সট তিনি ইউটিউবে পয়দা করে থাকেন অথবা লোকের সঙ্গে বাতচিতের সময় প্রয়োগ করেন, তার একটি সমাপতন কিতাবে ঘটার কথা। যদি না হয় তাহলে বলতে হবে মুখে যা বলছেন সেটি তাঁর প্যাশন বা আবেগজনিত আতিশয্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে কানে ঝড় তোলার সঙ্গে কথাগুলোয় বিশ্বাস স্থাপন করতে দর্শককে প্রভাবিত করছে। এই প্রভাবে বশীভূত হওয়ার কারণে ফাহামের বক্তব্যে যুক্তির ফাঁকফোকর থাকলেও সেগুলোকে যাচাই করার ভাবনা তাদের মনে উদয় হয় না।
ফাহাম আব্দুস সালামের বক্তব্য শ্রবণের ক্ষণে বিষয়বস্তু ছাপিয়ে বক্তার মুখের অভিব্যক্তি দর্শকের প্যাশনকে অধিক আকৃষ্ট এবং হয়তো-বা সম্মোহিত রাখে। যারপরনাই বক্তার কথা শ্রবণ ও তাঁকে দর্শনের প্রতিক্রিয়ায় দর্শক নিচে যেসব মন্তব্য রেখে যায় এর সিংহভাগ তাঁর গুছিয়ে কথা বলা ও হাসিকে দ্রষ্টব্য করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বক্তা নিজের বক্তব্যে যে-অর্থগুলো পয়দা করলেন সেগুলোর গুণ বিচারের দিকে তাদেরকে মনোযোগী হতে দেখা যায় না। অগত্যা বক্তার বক্তব্যের সারবত্তা থেকে সৃষ্ট কোনো ন্যারেটিভ দর্শকের মন্তব্য থেকে উদ্ধারের সুযোগ থাকে না। যে-ঘটনাটি সেখানে ঘটে সেটি হলো দর্শকের নিরঙ্কুশ সহমত, ‘তিনি যা কইছেন তার ষোলআনা ঠিক কইছেন।’ কেন ‘ঠিক কইছেন’ বা কী কারণে ষোলআনায় একআনা হইলেও গোঁজামিল থাকতে পারে এবং যাকে রিড করতে পারলে তাঁর বক্তব্যের মোটিভ বোঝা যায় … পরিতাপের বিষয় হচ্ছে সে-রকম প্রতিসন্দর্ভ বা কাউন্টার ডিসকোর্স তৈরির সম্ভাবনা এখানে মাঠে মারা যায়।
কাউন্টার ডিসকোর্সের জন্ম না-হওয়াটা যারা এই ভদ্রলোকের বাংলাদেশ বিষয়ক কথাবার্তা শুনতে লিংকে ঢোকেন তাদের জাত চিনিয়ে দেয়। ঘটনাটি বুঝিয়ে দেয় ফাহাম আব্দুস সালামের ভিউয়ার্সরা সেই ন্যারেটিভের আশায় তাঁর বক্তব্যকে শর্তহীন মেনে নিচ্ছে যেটি আওয়ামী শাসনের প্রতি তাদের বিরক্তি ও প্রত্যাখ্যানকে বৈধ বা যৌক্তিক করার ক্ষমতা রাখে। দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রগতিশীলতা ও সেকুলার বাংলাদেশের পক্ষের লোকজনের প্রতি দর্শকের ব্যক্তিগত নাপসন্দ মনোভাব বা বিতৃষ্ণার আগুনে ঘি ঢালার ক্ষেত্রেও এটি সহায়তা করে। দর্শক ফাহামের ন্যারেটিভকে প্রশ্নহীন বৈধতা দান করে, যেহেতু বাংলাদেশের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে ইসলামি শাসন কায়েমের ভাবনা কেন অবান্তর নয় সেই যুক্তিকে তিনি ব্যাখ্যাগ্রাহ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে পেরেছেন; বিষয়টি অন্যদিক থেকে দেখলে দর্শকের মনে জাগরূক বাসনার সহযোগী বটে!
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিকাশ-বিবর্তনের ইতিহাসে বিগত ও বর্তমান প্রজন্মকে ঢালাওভাবে ‘ইনকম্পিটেন্ট’ অভিধায় চিহ্নিত করে ফাহাম যে-বক্তব্যটি (দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?) রাখেন তার পেছনে যুক্তি এবং সারবত্তা থাকলেও সরলীকরণ নেই এমনটি বলা যাবে না। দর্শককে এই সরলীকরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না! উল্টো ‘রাজাকারে কয় কি?’ ব্যানার সেঁটে তাঁর ভিডিওক্লিপ শেয়ার করার মাঝে তারা আত্মতৃপ্তি খোঁজেন। রাজাকারের প্রচলিত অর্থায়ন নিয়ে দর্শকের ব্যক্তিগত আপত্তির সঙ্গে ফাহামের বাংলাদেশ বিষয়ক বক্তব্য এখানে হয়তো বিলকুল মিলে যায়। রাজাকার শব্দের প্রচলিত অর্থায়নের অসংগতি তুলে ধরা আর একাত্তর বা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এর চরিত্র বদলের ঐতিহাসিক কার্যকারণ উপলব্ধি করা এক কথা নয়। ফাহামের বাংলাদেশ ভাবনায় বিষয়টি উপেক্ষিত হওয়ার ফলে রাজাকার শব্দকে বাঙালির অভিধান থেকে মুছে দিতে তৎপর যে-ধারাটি (*এবং হয়তো দর্শকের বৃহৎ অংশ বুঝে বা না-বুঝে এর সপক্ষে হল্লা মাচান।) বাংলাদেশে জাঁকিয়ে বসেছে ফাহাম চমৎকারভাবে তার সেবা করে যান।
অগত্যা, ফাহামের ‘ইনকম্পিটেন্ট প্রজন্ম’-র ব্যাখ্যায় দর্শক সেই কওমের পক্ষে নিজের সমর্থন জোরালো করার রসদ খুঁজে পায় যে-কওমটি বিগত বা সাম্প্রতিক প্রজন্মের ‘ইনকম্পিট্যান্স’ থেকে সৃষ্ট দেশপ্রেম, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও সেকুলার চেতনা, পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা, শহিদ মিনার, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হিন্দুয়ানি অথবা ব্রাহ্মণ্যবাদী আচারব্যাভার বলে কথিত ঐতিহ্যকে রহিত কিংবা কাটছাট করার দাবি নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সক্রিয় রয়েছে। ফাহামের বক্তব্যকে এক্ষেত্রে দর্শক উক্ত কওমের সপক্ষে শক্ত ওকালতি হিসেবে গণ্য করে। তার মনের গহিনে লালিত বাঙালি চেতনার মুসলমানি সংস্করণকে দেশের সকল নাগরিকের জন্য অকাট্য করে তোলার স্বপ্নকে এটি হয়তো রঙিন করে যায়। উল্লেখিত বিষয়গুলোর সঙ্গে একজন ব্যক্তির মুসলমান থাকা বা না-থাকার সম্পর্ক কতখানি সেটি বক্তার বয়ানে অনুক্তই থাকে। ইসলামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও দর্শনগত সারবস্তুতে নিহিত দ্বান্দ্বিকতার বিচারে ব্রাহ্মণ্যবাদী আচার নামে কথিত চিহ্নগুলো সত্যিই সে-রকম কি না সেই ব্যাখ্যাটি তুলে ধরার তাগিদ তাঁর কথায় আভাসিত হয় না। ইসলামি দীনের ভিত্তি রূপে স্বীকৃত কোরান ‘মুসলমান’ বলতে কী বুঝিয়ে থাকে অথবা মুসলমানি প্রথাচারকে সেখানে কীভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এর কোনো আভাস/ব্যাখ্যা/বিশ্লেষণ তিনি ক্লিয়ার করেন না। এইসব লঘুতা ঢাকতে যে-বাকচাতুর্যের আশ্রয় ফাহাম নিয়ে থাকেন দর্শক মূলত এর ওপর ক্রাশ খায়।
বাঙালি মুসলমানের বাঙালিয়ানা-চর্চার দীর্ঘ ইতিহাসে ঐতিহ্যবাহিত অযুত উপাদান ইসলামের সঙ্গে কতটা কী সাংঘর্ষিক তা গভীরভাবে যাচাইয়ের পরিবর্তে ফাহাম প্রভাবিত বচনে আকৃষ্ট দর্শক একে সোজা খারিজ করে বসে! স্বাভাবিক! যেহেতু কোরান বর্ণিত মুসলমানের সংজ্ঞা, তার জীবনাচার ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান সম্পর্কে দর্শকের নিজস্ব জ্ঞানের পরিধি পরের মুখে ঝাল খাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়; যেখানে দর্শক ও বক্তা ফাহাম আব্দুস সালাম দুজনে অভিন্ন আকার ধারণ করেন। সর্বোপরি দর্শক সেই ন্যারেটিভের জন্য তাঁর বক্তব্যকে শর্তহীন বৈধতা দান করে যেটি বাঙালি জাতিসত্তার স্বকীয়তা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সরাসরি বাঙালি মুসলমানের বিকাশ-বিবর্তনের ইতিহাসবিন্দু ছাড়া তৃতীয় পন্থায় কেউ ব্যাখ্যা করে উঠতে চাইছে দেখলে সপাটে তাকে নাকচ করতে জানে। মানে দাঁড়াচ্ছে, ফাহাম আব্দুস সালাম যে-ন্যারেটিভ নিয়ে ইউটিউবে (*এবং হয়তো কিতাবে) হাজির হয়েছেন সেটি বাঙালিমানসে বিষবৃক্ষ রূপে প্রেথিত ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতিকে পরিহাস করার ছলে মোল্লাবাদী সংস্কৃতি গ্রহণের বার্তা সংগোপনে রেখে যায়, যার সঙ্গে কোরান প্রণীত ও নির্ধারিত ইসলামের সম্পর্ক বা সহযোগ নিতান্ত গৌণ। তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে দর্শকের বাহবাস্তুতির বহর দেখে বেশ বোঝা যায়, ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির বিষবলয় থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যাকুল হলেও বাংলাদেশের শিক্ষিত আমজনতা মোল্লাবাদী বিষবলয়কে নিজের জন্য সুখকর বিকল্প বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। এখানে বাংলাদেশের মুসলমান জনতার বৃহৎ অংশের সঙ্গে ওপার বাংলার বিজেপি প্রভাবিত বাঙালি জনতার মিল চোখে পড়ে।
ফাহাম আব্দুস সালামের ভালো দিক হয়তো এই ভদ্রলোক তাঁর বক্তব্যে অকপট। আবারও বলি, তরুণ প্রজন্মের বাঙালিকে তাদের ময়মুরব্বিদের প্রত্যাখ্যান করে সামনে আগানোর যে-আহ্বান তিনি রাখেন সেটি অযৌক্তিক নয়। দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাচর্চায় গলতি বা অসংগতির সমালোচনাকে যুগ-প্রাসঙ্গিক মানতে হয়। সেকুলার, ডেমোক্রেটিক অথবা ইসলামিক ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে বাঙালি তার পসন্দ অনুসারে যাকে বেছে নিতে চাইছে সেটি যেন লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে বাঁধা পড়ে, — তাঁর এই উপদেশখানা সারবত্তা বহন করে। সোজা কথায় বক্তব্যের বাহ্যিক স্বরের সঙ্গে সহমতের সুযোগ অবশ্যই রয়েছে, তবে জাতি-রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক বিকাশ-বিবর্তন এবং তার সঙ্গে অন্য জাতি-রাষ্ট্রের তফাত বিশ্লেষণ শেষে যে-ফ্রেমওয়ার্কটি দাঁড় করানো হয়তো সম্ভব ছিল, পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে ফাহামের স্যাটায়ারঘন বাংলাদেশ-ব্যাখ্যায় এহেন ভাবনায় গমনের পরিসর অবশিষ্ট থাকে না! তাঁর কথা শুনে মনে হয় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের উচিত এখন থেকে মুসলমান বাঙালির আবাসভূমি রূপে বাংলাদেশকে দাগানো; তার ইতিহাসকে কেবল ভারতবর্ষে মুসলমান শাসনের কালপর্বে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক অভ্যাস, চিন্তাধারা বা চেতনার আলোয় পাঠ করা; এবং প্রয়োজনে সেই স্মারকগুলোকে অকাতরে কচুকাটা করা যেগুলো তার ঐতিহাসিক বিবর্তনের জটিল পর্বে সে রক্তে ধারণ করেছিল, যেগুলোর রেশ তার জীবনে এখনো বিচিত্র উপায়ে বহমান। ফাহাম আব্দুস সালামের বাংলাদেশব্যাখ্যায় অগত্যা এই সত্যটি নিদারুণ তাচ্ছিল্যের খোরাক হয়, — বাঙালির আত্মপরিচয় সন্ধানের ইতিহাস কদাপি একমাত্রিক ছিল না বরং যুগ-কাল ও দেশাচার বিচারে সেটি সদা বহুমাত্রিক থাকতে চেয়েছে এবং থেকেছেও :—
এই বাঙালি হাজার বছরের রক্তসংকর থেকে জাত সংস্কৃতির চিহ্ন দেহে ধারণ করে বাঙালি হয়েছে। অতঃপর ইতিহাসের ধারায় ইসলামকে কবুল করে বাঙালি মুসলমান রূপে নিজের সাংস্কৃতিক বিকাশে নতুন মাত্রা সে যোগ করেছিল। অতঃপর শত-হাজার বছরের গোলামি খাটার পর শেখ মুজিবুর রহমানের যুগে এসে স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নতুন পরিচয়ে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে যায়। বাংলাদেশ জন্ম না নিলে ফাহাম আব্দুস সালামের পক্ষে বৈদেশে ক্যান্সার ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা আর ইউটিউবে এসে নাটুকে কায়দায় নতুন প্রজন্মের নিজেকে ‘এতিম’ ভাবার উপদেশ খয়রাতের সুযোগ কপালে জুটত কি-না সন্দেহ।
মুজিবরের নেতৃত্বে যে-বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল সেখানে চোর-ডাকু-ছ্যাচড়া উৎপাদনে পারঙ্গম প্রজন্ম গুচ্ছে-গুচ্ছে পয়দা হয়েছে সে-কথা মিথ্যে নয়। স্বাধীনতায় নিহিত ফিলসফির রস আস্বাদনের ক্ষেত্রে দেশের জনগণ আজো ভুখানাঙ্গা এবং তাকে ঘিরে ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। দেশপ্রেম, প্রগতিশীলতা, সেকুলারিজম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখানে যারা ধারণ করে তাদের বৃহদাংশ আকাট মূর্খ এবং আওয়ামী ঘরানার রাজনীতির কুফল থেকে সৃষ্ট, — এই দাবি যদি কেউ করে থাকেন একে চট করে পাগলের প্রলাপ ভাবার কারণ দেখি না। সেইসঙ্গে কথাখান ধ্রুব সত্য, — জাতিকে স্বাধীন করার যজ্ঞে না নামলে মুজিবকে হয়তো রাতের আঁধারে সপরিবার নিকাশ হতে হয় না। তাঁর ভুলটি ঐতিহাসিক ছিল বৈকি! এই প্রমাদের সুযোগে রাতের আাঁধারে মসনদ দখলকারী খুনি জেনারেলরা বাংলাদেশে পালে-পালে জন্ম নিয়েছিল। তাঁদের সঙ্গে সেইসব অপশক্তি দাপটে ফিরে এসেছিল যারা এই দেশের জন্ম হোক এটা চায়নি এবং জন্ম যেন না হয় সেজন্য ইসলামকে বেয়োনেট রূপে ব্যবহার করেছে (*ও এখনো করে চলেছে); যেটি স্বয়ং এই দীন যে-আসমানি কিতাবের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরিষ্কার বরখেলাফ।
পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় বাংলাদেশের সো-কল্ড সেকুলারদের ভণ্ডামিকে জুতাপেটা করার ক্ষণে ফাহাম আব্দুস সালামের কনফিডেন্ট বাংলাদেশ-ব্যাখ্যা সত্যটি বিস্মৃত হয়, — নিজেকে এতিম ভেবে নতুন সমাজ সৃষ্টি কিংবা আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নামা যায় না; যতক্ষণ না ইতিহাসের ধারায় সৃষ্ট সংঘাতগুলোকে একটি জাতি বিচিত্র ডিসকোর্সের ভিতর দিয়ে পাঠ করতে সক্ষম হচ্ছে। এইসব ডিসকোর্স থেকে নিষ্কাশিত অর্থের আলোয় নিজের নিশানা ঠিক করা সেখানে তার দায়িত্ব; যেটি হয়তো যথার্থ স্বাধীনতার আস্বাদ লাভে তাকে সাহায্য করতেও পারে।
বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর হালত নিয়ে ভাবনার ক্ষেত্রে বিবেচনাটি তাই সর্বাগ্রে জরুরি, — দুর্ভাগা এই জাতি বিস্ময়করভাবে সমৃদ্ধ এক মাল্টিক্লাস ও মাল্টিকালচার ইতিহাসের উত্তরাধিকারী! পৃথিবীর বহু জাতিরাষ্ট্র থেকে তার জাতিসত্তার বিবর্তন ও সাংস্কৃতিক আত্মীকরণের ইতিহাস ভিন্ন প্রকৃতির। পশ্চিমা সভ্যতায় সংঘটিত জাতিরাষ্ট্রের বিবর্তন ও সেই সুবাদে সৃষ্ট ফ্রেমওয়ার্কের আলোয় বাঙালি জাতিসত্তার আত্মীকরণের প্রবণতা বা এর ইতিহাস ব্যাখ্যা এখানে খুব একটা কাজে দেয় না। এমনকি প্রাচ্যে বিরাজিত জাতিরাষ্ট্রের বিবর্তনের সঙ্গে তার নিবিড় মিল নেই। ইউরোপীয় ধাঁচের ফ্রেমওয়ার্কের প্রয়োগ এ-দেশের জাতিগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণে সামগ্রিকভাবে প্রাসঙ্গিক নয়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোয় ইসলামি জীবনাচার প্রতিষ্ঠার বাহানায় সালাফি বা ওয়াহিবি ফ্রেমওয়ার্কে সচল মুসলিম উম্মাহর চেতনা ধার করে বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা ও সেখানে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানোর খায়েশে ফতোয়া দানের প্রবণতা অবান্তর হতে বাধ্য। এইসব প্লুরালিটির সর্তক পাঠ ও অনুশীলন ছাড়া তথাকথিত সরলরৈখিক পন্থায় লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির ভাবনায় গমন হাস্যকর বৈকি! দুঃখিত ফাহাম আব্দুস সালাম, আপনার বক্তব্যে ঢক্কনিনাদ থাকলেও সারবত্তা মনে হচ্ছে ততটাই শূন্যগর্ভ!
…
বিচিত্র ঘাত-সংঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে বিবর্তিত বাঙালি জাতি মন চাইলেই ধা করে মুসলমানি যুগ থেকে নিজের শুরুটা দেখতে অক্ষম। আর্য ‘মহাভারত’ নির্ধারিত ‘রাক্ষস’ অথবা হিন্দু বা বৌদ্ধ বংশজাত হওয়ার নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাস থেকে মনপসন্দ একটিকে বেছে নিয়ে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করা তার জন্য গর্হিত কাজ। সে হচ্ছে সংকরায়িত সংস্কৃতির উত্তরাধিকার। এটি তার সামগ্রিক বাঙালিয়ানায় আজো প্রতিফলিত, যেখানে মাছের ঝোল ও বিরিয়ানির মাঝে প্রভেদ করার উপায় নেই। ধর্মীয় ইমান-আমল-আকিদা অনুসরণের প্রশ্নে সে হয়তো হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অথবা মুসলমান এবং সে-কারণে ধর্মীয় বিশ্বাসের উপজাত হিসেবে সৃষ্ট সংস্কৃতির গুরুভার বহনে বাধ্য; অনুরূপভাবে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সম্প্রদায় রূপে অন্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে তার মিলন, বিচ্ছেদ ও সংঘাত থেকে জন্ম নেওয়া সাংস্কৃতিক উপজাত তাকে পৃথক মাত্রা দান করেছে এবং মাত্রাটি সেখানে তার জীবনাচারের অংশ বটে; সুতরাং মুসলমানিত্বের দোহাই দিয়ে একে ছেটে ফেলা তার পক্ষে সহজ নয়। যারপরনাই ফাহাম আব্দুস সালামের ইউটিউব ন্যারেটিভ বাইরে থেকে ঠিকঠাক ও তাৎক্ষণিক শ্রবণে মনকাড়া ঠেকলেও ভদ্রলোক উপরিস্তর বা সুপারফিশিয়াল বাতচিত দিয়ে বাজিমাত করতে চাইছেন এমতো সন্দেহ তাঁর বক্তব্যের (*দ্রষ্টব্য : বাংলাদেশে ইসলাম ও সেকুলারিজমের সংঘাত কোথায়?) ক্রিটিক্যাল রিডিংয়ের পর মনে তীব্র হয়ে জাগে। কেন জাগে সেটি ধরিয়ে দিতে উপসংহারে অন্তত কয়েকটি প্রসঙ্গ ছুঁয়ে যেতে চাই :—
- বাঙালির মুক্তবুদ্ধি ও সেকুলারচর্চায় লোকদেখানো ভ্রান্তি, গোঁজামিল বা বিরক্তির যথেষ্ট কারণ রয়েছে তাতে সন্দেহের কারণ নেই। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সেকুলারিজমের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে বলে ফাহাম তাঁর বক্তব্যে নিজে উল্লেখ করেছেন। এর দার্শনিক তাৎপর্য উপলব্ধি ও অনুশীলনে বাঙালি যে বিলকুল আনপড় সেটি তাঁর কথাবার্তা থেকে পড়ে নেওয়া যায়। দুঃখের বিষয় হলো প্রকৃত সেকুলারিজম বলতে কী বোঝায় সে-ব্যাপারে একটি শব্দও তিনি খরচ করেননি! যারপরনাই সেকুলারিজম নিয়ে তাঁর নিজস্ব ধ্যানধারণার ব্যাপারে জাতি অজ্ঞই থেকে যায়! কেবল এই পরিহাসটুকু ছাড়া, — বাঙালি না-বুঝেই সেকুলার হইতে বা তারে শো করতে চায়।
- স্বকীয়তা ও আত্মপরিচয় সন্ধানে বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির পন্থা ফাহাম তাঁর বক্তব্যে উদাহরণ সহকারে ব্যাখ্যা করেছেন। ইমান-আমল-আকিদার আলোয় দেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী কোন সংস্কৃতিকে গ্রহণ ও বর্জন করবে সেই ইশারা বাঙালি সেকুলারগণের বাঙালিয়ানা-চর্চার ধারা নিয়ে পরিহাস করার ক্ষণে তিনি দিয়েছেন বৈকি। বাঙালি মুসলমান সর্বদা হিন্দুস্থানী মুসলমানের (*এক্ষেত্রে সমগ্র উত্তর ভারত ও পাকিস্তান জুড়ে বিরাজিত মুসলমানি সংস্কৃতিকে তিনি বোধহয় মিন্ করতে চেয়েছেন) কৃষ্টিকে নিজ দেহে অঙ্গীভূত করতে চেয়েছে, এই দাবির সপক্ষে যেসব উদাহরণ তিনি পেশ করেছেন সেটি একরৈখিক। এ-কথা সত্য, বাংলাদেশের মুসলিম আমজনতার প্রাত্যহিক জীবনাচারে বাদশাহী শাসনের ফলাফল থেকে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ছাপ কালের ধারায় ব্যাপক হয়েছে। মুখের বুলি, পোশাক-আশাক, পোলাও-কাবাব-বিরিয়ানি থেকে শুরু করে কাসিদা-গজল-কাওয়ালির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে সেখানে নিঃসংকোচে সে আপন করে নিয়েছে। বিপরীতে এও সত্য, তথাকথিত হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির স্মারকগুলোকে তা-বলে বর্জন বা কাটছাট করেনি। বাংলার লোকায়ত ও শিক্ষিতজনের সাংস্কৃতিক ধারায় উভয়ের রসায়ন যে-মাত্রায় ঘটেছে তাকে কেবল ‘বাঙালি সর্বদা হিন্দুস্থানী মুসলমান হতে চেয়েছে’ … এহেন একপেশে ব্যাখ্যা দিয়ে প্রমাণ করা যেমন নামুমকিন, — নাজায়েজও বটে।
বাংলার অভিজাত মুসলমান জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে বাঙালি মুসলমানের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপনের ফাহামকৃত প্রচেষ্টাকে অগত্যা খণ্ডিত বলা ছাড়া উপায় থাকে না। অভিজাত মুসলমান সমাজ অর্থাৎ কাজী ইমদাদুল হকের ‘আবদুল্লাহ’ উপন্যাসে বর্ণিত আশরাফগণ মুসলমানি সংস্কৃতি অনুশীলনের প্রশ্নে যে-ধারার সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে অভ্যস্ত ছিলেন, সেটি বাঙালিত্বের একটি দিক হতে পারে এবং তাকে কেন বাঙালিয়ানার চর্চায় সংযোজন রূপে বিবচেনা করা প্রয়োজন সে-কথাগুলো রচনার প্রারম্ভিকায় বলেছি। এই বৃত্তের বাইরে অবস্থিত বাঙালির বৃহৎ অংশ উক্ত সংস্কৃতির সঙ্গে হাজার বছর ধরে বহমান বিচিত্র সাংস্কৃতিক বিক্ষেপকে নিজ অঙ্গে জুড়ে সংকর চরিত্র ধারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেনি। সংকর এই কৃষ্টিকে অস্বীকার বা বাতিল করে বাঙালি মুসলমানকে একরৈখিক সংজ্ঞায় দাগানোর সুযোগ বোধহয় নেই। মাছের ঝোল ও দধি-মিষ্টির সঙ্গে নবাবি খানাপিনা, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাউলা আর লোকায়ত সংগীতের বর্ণাঢ্য পরম্পরা, রাধাকৃষ্ণ লীলায় উচ্ছ্রিত রসের সঙ্গে হামদ-নাত-গজল-কাওয়ালি গলেমিশে সৃজিত সংস্কৃতির মধ্যে বাঙালির মূলধারাটি প্রোথিত। স্বভাবের দিক থেকে এই বাঙলিয়ানা একইসঙ্গে ধর্ম-অনুরাগী ও ধর্ম-নিরপেক্ষ; সাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয়ের বাহক হওয়া সত্ত্বেও অসাম্প্রদায়িক; মরমি বা আধ্যাত্মিক চেতনায় সমৃদ্ধ হলেও কেবল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে অনিচ্ছুক; এবং, আঞ্চলিক ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে ধারণ করে বৈশ্বিক ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত প্রভাবকে নিজের আঞ্চলিকতায় খাপ খাওয়ানোর চেষ্টায় গ্রামে ও নগরে আজো বহমান। বাঙালিয়নার আলোচনায় বিষয়টি সম্ভবত মনে রাখা জরুরি।
দ্বৈতরূপে অদ্বৈত সাংস্কৃতিক বিক্ষেপকে অগত্যা প্রাচ্য কিংবা প্রতিচ্যে বিদ্যমান লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে দেগে নিয়ে ব্যাখ্যা করা বা তার চরিত্র নিরূপণ অতিশয় দুরূহ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পে বর্ণিত লোকটির ন্যায় ‘আয়াতুল কুরসি’ পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বাঁশঝাড় পার হয়ে যাওয়ার মতো সহজ ঘটনা এ নয়; যেমনটি ফাহাম তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরার মাধ্যমে দর্শককে ধোঁকা দিতে চেয়েছেন। ফ্রেমওয়ার্কটি সেখানে এমন হওয়া চাই যেটি আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে ধর্মীয় ভাবধারায় নিহিত অবিমিশ্র সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে উক্ত ভাবধারার উপজাত রূপে সৃষ্ট মিশ্র উপাদানকেও স্থান করে দিতে সক্ষম, যেখানে জাতি নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্বকীয়তায় জারি থাকার পরেও মিশ্র উপাদান থেকে জাত সংস্কৃতিতে কীভাবে শামিল থাকতে পারে সেটি বিবেচনার জায়গা বরাদ্দ থাকা চাই।
বেঙ্গল রেনেসাঁ প্রভাবিত ব্রাহ্মণ্যবাদী বাঙালি সংস্কৃতি কাজটি সেকালে (*এবং একালেও) সমাধা করে উঠতে পারেনি। মোল্লাবাদীর পক্ষেও কাজটি করা কঠিন। ফাহামকে স্বয়ং আক্ষেপ করতে দেখি, — (*জাকির নায়েক গং) প্রভাবিত মুসলমানরা এখন ইসলামের আমল-আকিদা সম্পর্কে অতীত প্রজন্মের চেয়ে বেশি জ্ঞান রাখলেও অতীতে গড়পড়তা মুসলমানের স্বভাবে ‘সহিষ্ণুতা’ ও ‘গ্রেস’-এর কমতি ছিল না, যেটি এখন বিলীন হওয়ার পথে। কেন তার উত্তর বাঙালির স্বভাবকে একরৈখিক ফ্রেমওয়ার্কে দাগানোর মাঝে খোঁজ করলে মিলে বৈকি। বলাবাহুল্য সেখানে মুসলমান এবং সেকুলার উভয়েই বিস্তর ঝুটঝামেলা আজোবধি পয়দা করে চলেছেন! সব জেনবুঝে ফাহাম তাঁর বক্তব্যে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদী’ সংস্কৃতির বাহক সেকুলার বাঙালিকে একহাত নিলেও নিজে স্বয়ং সেই ভাবনার পরিপোষক সেটি বুঝিয়ে দিতে বাকি রাখেননি। মরমে তিনি ওই ধারার পরিপোষক। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকল্প খুঁজতে নেমে ‘মোল্লাবাদী’ ফ্রেমওয়ার্কে বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ের সমাধান তিনি দেখতে পাচ্ছেন বলে মনে করার কারণ রয়েছে বৈকি।
- সাদা শাড়ির সঙ্গে কপালে লাল টিপ সেঁটে যে-বাঙালি ললনা নিজেকে সেকুলার প্রমাণে হিন্দুর উৎসবে অংশ নিচ্ছে তাকে কেন ‘কাফিরুন’ বলা যাবে না সেটি ভেবে তাঁর নাকি খুব হাসি পায়, — কথাটি তিনি অকপটেই বলেছেন। এখন কাউকে ‘কাফির/কাফিরুন’ আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে বক্তার নিজস্ব ধারণার উৎস সম্পর্কে জাতিকে তিনি অজ্ঞই রাখেন! অগত্যা মনে সন্দেহ দানা বাঁধে :—
ইতিহাসে যুগান্তকারী প্রভাব রাখা ‘কাফির’ শব্দের অর্থ ও মাত্রাগত তাৎপর্য সম্পর্কে তিনি জেনেবুঝে কথা বলছেন তো? ‘কাফির’ সম্পর্কিত ধারণা লাভের ক্ষেত্রে তাঁর উৎস ঠিক কী? কোরানের নিবিড় পাঠ থেকে কি শব্দটির অর্থ ও তাৎপর্য বিষয়ে তাঁর বোধোদয় ঘটেছিল? হাদিসশাস্ত্র পাঠের পর কে ‘কাফির’ আর কে নয় সেই জ্ঞান কি তাঁর আকলে ধরা দিয়েছে? ইসলামি ঘরানায় বিদ্যমান গুণীজনদের বইপত্তর কি এ-ব্যাপারে তাঁর সহায় ছিল? অথবা উপমহাদেশে রৈ-রৈ করে যে-ইসলামের আগমন একদিন ঘটেছিল, সেই আগমনগাথা পাঠের সুবাদে ‘কাফির’ সম্পর্কে তিনি সম্যক বুঝদারি লাভ করেছেন? নাকি আবাল্য বাপদাদা ও মাওলভির মুখে শুনে-শুনে ‘কাফির’ শব্দে নিহিত ইমেজারি তাঁর মগজে চিরস্থায়ী রূপ নিয়েছিল? জাকির নায়েক ও ইয়াসির কাদিরের বাকপটু বয়ান কি তাঁকে এই জ্ঞানে জ্ঞানী ‘করিয়াছে’?
প্রশ্নগুলো এ-কারণে তোলা, যে-উপমার ছলে ‘কাফির/কাফিরুন’ শব্দের প্রয়োগ তিনি ঘটালেন সেখান থেকে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না তাঁর ইসলাম ও ইসলামি জীবনাচার সংক্রান্ত ধ্যানধারণা যথেষ্ট গোলমেলে এবং কাণ্ডজ্ঞানরহিত। বাজারকাটতি ইসলামিক ধ্যানধারণা থেকে সৃষ্ট সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার বাইরে উক্ত বিষয়ে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির জগৎটি এখনো প্রাগৈতিহাসিক; সেখানে ইসলামের মৌল ভিত্তি কোরানের আলো পড়েনি এবং ভাবনায় কোনো বিবর্তন সে-কারণে ঘটেনি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই কোরান তিনি পাঠ করেছেন এবং সেক্ষেত্রে আসমানি কিতাব ‘কাফির’ সম্পর্কে যেসব বয়ান রেখে যায় তার সঙ্গে বাদবাকি বয়ানের মিলঝুল যাচাই করে নিয়েছিলেন তো? কোনো প্রভেদ কি চোখে পড়েনি? মনে প্রশ্নের ঝড় কি একবারও ‘বহেনি’? ‘কাফির/কাফিরুন’ ইত্যাদির যে-ইতিহাস কোরান স্বয়ং বর্ণনা করে যায়, যে-ফ্রেমওয়ার্কে এর সংজ্ঞা ও পরিধি নির্ধারণ করে, এর কিছুই কি তাঁর নজরে পড়েনি? ফাহামের বক্তব্য শ্রবণের ক্ষণে এসবের কোনো মালুম ঘটে না। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপজাত রূপে সৃষ্ট ‘কাফির’ সম্পর্কিত যেসব ধ্যানধারণা ও প্রথাচার (*জাফর সোবহানের বিদুষী মাতামহির আত্মজীবনীর উদাহরণ টানতে গিয়ে জেনানা মহলে পর্দা করা ও বেগম রোকেয়ার যুগে বিচরণ করেও উক্ত বিষয়ে মাতামহির নিরুদ্বেগ থাকার ঘটনাটি এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়) মুসলিম বিশ্বে বহু যুগ ধরে চালু রয়েছে তার প্রত্যেকটি কোরানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও আপত্তিজনক। কেন সেই ব্যাখ্যা করতে বসলে এই রচনায় কুলাবে না। এ-সম্পর্কে অধমের যৎসামান্য উপলব্ধি পাঠক গানপার-এ ‘ইসলামবীক্ষণ : একটি পুনর্বিবেচনা’ শীর্ষক রচনায় খুঁজে নিতে পারেন।
ফাহাম আব্দুস সালামের প্রতি অনুরোধ থাকবে, কাউকে ‘কাফির’ বলার আগে কোরান খুলে শব্দটির সারবত্তা ও গভীরতা আগে যাচাই করেন, তারপর না-হয় বইলেন। যে-ইসলামি সংস্কৃতিকে আপনি বাঙালি মুসলমানের জন্য বৈধতা দানে ব্যাকুল হয়েছেন তার চৌদ্দ আনার সঙ্গে স্বয়ং স্রষ্টা কর্তৃক কোরানে নির্ধারিত ইসলামি জীবনাচারের বিশেষ মিল পড়ে না। বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত ইসলামি প্রথাচার, জাতীয়তাবাদ, উম্মাহচেতনা এবং এসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক উপজাত কতটা কোরান প্রসূত আর কতখানি ইসলামের প্রাতিষ্ঠানিক বিবর্তন ও দেশাচারের ফলাফল সেই বিবেচনার পথকে যুগ-যুগ ধরে রুদ্ধ করা হয়েছে। আলেম-ওলামা ও ইংরেজি শিক্ষিত বিদ্বানরা কিতাবের অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় নিজের সংস্কারকে অব্যাহতভাবে চাপিয়ে ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু আমজনতার জন্য একে অকাট্য করে তোলার মতলবি কাজ-কারবারে বরাবর সক্রিয় ছিলেন বা এখনো রয়েছেন। যারপরনাই কোরানকে আসমানি বিশ্বাসে স্থির মৃত এক টেক্সট বলে ভ্রম হয়! লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের বাখান গাইতে বসে ফাহাম সেটি বিস্মৃত হলেন দেখে মনে বিস্ময় ও কৌতুক জাগে বটে!
নির্দিষ্ট অর্থে স্থির পাঠ্যবস্তু হচ্ছে এমতো নীরবতা যেখানে তাকে মৃত মতে হতে থাকে। মিশরদেশি বিদ্বান নসর হামিদ আবু জায়েদের ভাষ্য ধার করে হয়তো বলা যায়, ‘মুসহাফ’ বা নীরব পাঠ্যবস্তু রূপে গণ্য হতে পৃথিবীতে কোরানের আগমন ঘটেনি। গায়ে ‘আসমানি কিতাব’র লেবেল সেঁটে তার প্রথাসিদ্ধ পাঠ, তেলাওয়াত বা ব্যাখ্যা হচ্ছে সেই ফাঁদ যেটি তাকে ‘মুসহাফ’ হতে বাধ্য করেছে। সৃষ্টিজগতের অনুরূপ প্রাণবন্ত ঘটনা হওয়ার কারণে কোরানের ব্যাখ্যায় প্রচলিত প্রথার আশ্রয় গ্রহণ সকল সময় সমীচীন নয়। প্রথাসিদ্ধ পাঠপরম্পরায় দাঁড়িয়ে কোরানচর্চার বদলে যুগ-প্রাসঙ্গিক ভাবনার দীপ্তিতে ভাস্বর ডিসকোর্সে গমন করে তার পাঠ বরং অধিক জরুরি সেখানে। কোরানকে তাই তাক-এ তুলে না রেখে লাইন-বাই-লাইন পাঠ করা প্রয়োজন। ‘মুসহাফ’-এর বৃত্তে বন্দি কিতাব নয় বরং সময়-প্রাসঙ্গিক ডিসকোর্সে সচল কোরানের পক্ষেই কেবল ন্যায্য ধর্মানুশীলনের আবেদন মানুষের অন্তরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। বলাবাহুল্য, জাকির নায়েক বা ইয়াসির কাদির (*সে তাঁরা যত বড়ো এলেমদার হয়ে থাকুন না কেন) এখানে খুব একটা কামের না, যেহেতু তাঁদের কোরান ব্যাখ্যার পদ্ধতি নিয়ে গুণীজনে দ্বিমত ও আপত্তি রয়েছে, যার খোঁজ পেতে কাণ্ডজ্ঞানের সঙ্গে গ্যুগল আর ইউটিউব বোধহয় আপাতত যথেষ্ট।
মুসলমানি দীন ও তার আচারব্যাভারের সারবত্তা বোঝার একমাত্র চাবি হচ্ছে পাঠকের অবধানশক্তি, বিবেচনাবোধ ও প্রখর কাণ্ডজ্ঞান, যেগুলো স্রষ্টা তাকে নিয়ামত রূপে দান করেছেন। বাদশাহি বা নবাবি সূত্রে নির্ধারিত মুসলমানি আচার বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এখানে নির্ধারক কোনো শর্ত নয় যে এগুলোকে ইসলাম (*সর্বোপরি কোরান) কর্তৃক নির্ধারিত মুসলমানি প্রথাচার বলে মেনে নিতে হবে। এগুলো দেশ ও যুগাচার প্রণীত সাংস্কৃতিক উপজাত এবং জাতমধর্মবর্ণ নিরপেক্ষ অর্থাৎ হিন্দুয়ানি বা মুসলমানি রূপে অকাট্য নয়, বরং যে-কেউ চাইলে নিজের জীবনধারায় এইসব সাংস্কৃতিক উপজাতকে অঙ্গীভূত করতেই পারে।
ইন্টেলেকচুয়্যাল সারমনের আবডালে ফাহাম আব্দুস সালাম বিস্তর যেসব গোঁজামিল রেখে যান সেগুলোর ক্রিটিক্যাল রিডিং এ-কারণে জরুরি। তাঁর বয়ানে যুক্তির ফটকাবাজি থাকায় একে সন্দেহজনক ভাবার কারণ আপনা থেকে অনিবার্য হয়। বাঙালির দেশপ্রেম, প্রগতিশীলতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সেকুলারিজম নিয়ে বিরক্তির যথেষ্ট কারণ থাকলেও এগুলোকে পরিহাস করার সময় যে-ডিসকোর্স তিনি হাজির করেন সেটি প্রকারান্তরে আহমদ ছফা, ফরহাদ মজহার ও সলিমুল্লাহ খানের বৃত্তেই নিজেকে বন্দি রাখে কি-না সে-আলোচনাটি প্রাসঙ্গিকতা রাখে। যদিও তাঁর কিতাব পাঠের আগে এহেন আলোচনায় গমন সমীচীন মনে করি না।
বাংলাদেশকে ‘এক্সপ্লেইনড’ করতে যেয়ে ফাহাম তর্ক উসকে দিয়েছেন এবং সেটি তাঁকে শ্রবণ (*ও দর্শনের) লাভের দিক। তাঁর অনুরক্তরা যদি সেদিকে গমন করেন তাহলে জাতির আত্মপরিচয় ও লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের ভাবনায় নতুন অনুষঙ্গ যোগ করা সম্ভব, অন্যথায় এই বাকচাতুর্য তোতাপাখির বুলি, আপাতদৃষ্টিকে ‘চমকদার’ হলেও দিন শেষে খতরনাক বলেই মনে হচ্ছে। তাঁকে তাই প্রশ্নবিদ্ধ ও সন্দেহ করার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। বাঙালির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে বিজড়িত সকল টেক্সটকে সন্দেহ করা জরুরি, অন্যথায় সেই ডিসকোর্সের জন্ম সম্ভব হয় না যেটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে বাঁধাই থাকলেও স্বভাবের দিক থেকে উন্মুক্ত। জাতীয় জীবনের সমুদয় প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে খোলামেলা বাহাসের হিম্মত সে রাখে এবং পরিসরটি নিজের মধ্যে ধারণ ও লালন করতে জানে। বাংলাদেশে বাঙালি জাতিসত্তার জীবনে এরকম একটি অভিসন্দর্ভ এখনো অনুপস্থিত হলেও এর কোনো বিকল্প নেই।
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS