জেনারেল, মানুষ জীবটি বেশ কাজের
সে উড়তে ওস্তাদ, সে মারতেও ওস্তাদ।
কিন্তু তার একটি গলদ :
সে ভাবতেও পারে
[জেনারেল / ব্রেটল্ট ব্রেখট ।। অনুবাদ : বিষ্ণু দে]
ইউজিন ব্রেটল্ট ফ্রেডরিক ব্রেখট (১৮৯৮-১৯৫৬) কবি, গল্পকার, নাট্যকার; তবে তার সবচেয়ে বড় অবদান বিশ্বনাট্যে নতুন ভাবনার সংযোজন। খ্রিস্টপূর্ব অ্যারিস্টটলীয় নাট্যভাবনার বিপরীতে নতুন নাট্যরীতির জনক হিসেবেই শুধু নয়, সারাবিশ্বের শ্রেণিশোষণের বিরুদ্ধে ব্রেখট (Bertolt Brecht) একজন বিপ্লবী নাট্যতাত্ত্বিক। তার প্রণীত ফেরফ্রেমডেন, গ্যাসটুস এবং সর্বোপরি এপিক থিয়েটার এখন পর্যন্ত নাট্যতত্ত্বে সর্বাধিক আলোচিত।
তবে ব্রেখটকে শুধুমাত্র নাট্যতাত্ত্বিক বলা ঠিক হবে না, কেননা তার নাট্যচিন্তা ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উৎসারিত। তা সত্ত্বেও তাকে কালোত্তীর্ণ নাট্যকার বলা হয়। তার নাটকের প্রধান উপজীব্য ভালো-মন্দের লড়াই। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই মন্দের নিকট ভালোর পরাজয় ঘটে। এরই মধ্যে থেকেও তিনি মানুষের ইমোশন এবং ইন্সটিঙ্কটের মধ্যকার ভারসাম্য তুলে ধরেন। এ কারণেই ব্রেখটের জন্মের শতবছর পরেও তাকে আজকের মানুষই মনে করা হয়।
শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এই নাট্যকার ১৮৯৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জন্মেছেন দক্ষিণ জার্মানির আগুস্তবার্গ শহরে। বাবা ছিলেন এক ক্যাথলিক দোকানী। কিন্তু তিনি দীক্ষিত হয়েছেন প্রোটেস্ট্যান্ট মায়ের ব্যাপ্টিস্ট ধর্মমতে। বুর্জোয়া শিক্ষার মাধ্যমেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছে। চারবছরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শেষ করে পদার্পণ করেন কনিগলিচেস রিয়্যালজিমনেসিয়ামে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তার পরবর্তী জীবনের পথটা তৈরি হয়েছিল।
ষোলো বছর বয়সে (১৯১৪ সনে) তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতা এবং থিয়েটারের প্রতি অনুরক্ত হবার আগেই তিনি মেডিক্যাল সায়েন্স নিয়ে অধ্যয়নের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মিউনিখের ল্যুডভিগ ম্যাক্সিমিলিঅন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হবার পর ১৯১৮ সালে যোগ দেন আগুস্তবার্গ মিলিটারি হাসপাতালে। সেখানেই তিনি প্রথম মুখোমুখি হন সরাসরি মানবযন্ত্রণার।
বেভারিয়ান বিপ্লব চলাকালে তিনি তার প্রথম নাটক ‘বাল’ লেখেন। এটি ছিল হান্স জেস্ট-এর নাটক ‘দ্য লোনলি ওয়ান’-এর ছায়া অবলম্বনে রচিত। ১৯১৯ সালে তার যাত্রা শুরু হয় কম্যুনিজমের সাথে। বিভিন্ন কারণে এ-সময় থেকেই তিনি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হচ্ছিলেন পড়াশোনা থেকে। ১৯২১ সালে একইসাথে ত্যাগ করেন পড়াশোনা এবং শুরু করেন নাট্যসমালোচনা। এ-সময় তিনি বেভারিয়ান লোকজ ধারার সাথে পরিচিত হন এবং নিজের ব্যাঞ্জো সহযোগে রচনা করেন বেশ-কয়টি ব্যালাড। ১৯২১ সালে প্রথম ছোটগল্পটি প্রকাশ হবার পরই তার নাম বার্লিনে ছড়িয়ে পড়ে। পরের বছর ব্রেখট বিয়ে করেন অভিনয়শিল্পী মেরিয়ান জোফকে। সে-বছরই ক্লেইস্ট পুরস্কার লাভ করেন নাটকের জন্য।
১৯২৪-এর বসন্তে ব্রেখট (Bertolt Brecht) মঞ্চায়ন করেন ‘অ্যাডোয়ার্ড দ্য সেকেন্ড’। সে-বছর শরতে চলে আসেন বার্লিনে। ১৯৭২ সালে তার তিনটি নাটক এবং একগুচ্ছ কবিতা পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। বার্লিনে বসবাসের পর থেকেই তার নাট্যজীবনের বিকাশ ঘটে প্রবলভাবে। তৎকালে খ্যাতনামা নাট্যপরিচালক আরউইন পিস্কাটর তাকে উদ্বুদ্ধ করেন এপিক থিয়েটারের কন্সেপ্ট নির্মাণে। একই সময়ে তিনি বেশ-কয়টি মিউজিক্যাল প্লে সৃষ্টি করেন। ক্রমে তার আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটে। ১৯২৮ সালে তিনি তার বিখ্যাত ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’ সৃষ্টি করেন।
১৯৩০ সালে তিনি তার প্রথম কম্যুনিস্ট নাটক ‘দ্য মেজার্স টেকেন’ মঞ্চায়ন করেন। সে-বছর তার তৃতীয় সন্তান মারিয়া বারবারা জন্মায়। তিনি হান্স ইস্লারের সাথে বিতর্কিত চলচ্চিত্র ‘স্কুলে ওযাম্পে’ নির্মাণ করেন। এটি ১৯৩২ সালে রিলিজ হবার পরই ব্যান্ হয়ে যায়।
নাজিদের উত্থানের পরপর তিনি পরিবার সহ প্যারিস চলে আসেন। সেখানে তিনি বেশ-কয়টি নাটক মঞ্চায়ন করেন। ১৯৩৫ সালের ৮ জুন তার জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। সে-বছরই নিউইয়র্কে তার ‘মাদার’ নাটকের মঞ্চায়ন হয়।
এরপর তিনি ইউরোপের বেশ-কয়টি দেশ ভ্রমণ করে পাড়ি জমান আমেরিকাতে। সেখানে তার নাটকের কম্যার্শিয়্যাল শো-এর আয়োজন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি আবার নিজ দেশ জার্মানিতে চলে আসেন। তিনি নিজের নাট্যদল গঠন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব-জার্মান জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
ক্রমশ সমগ্র ইউরোপে তার প্রবল জনপ্রিয়তা হয়। সারাবিশ্ব তার নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারণ করে। এই মহান শিল্পীর মৃত্যু ঘটে ১৯৫৬ সালের ১৪ অগাস্ট করোনারি ক্রম্বসিসে।
ব্রেখট জার্মান নাট্যকার হলেও তিনি নাটক লিখেছেন সব সময় এবং সব দেশের মানুষের জন্য, যে-কারণে আজকের বাংলাদেশেও তার নাটকের কদর এত বেশি। এর মধ্যে প্রথমেই আসে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ এবং ‘গ্যালিলিও’। আসাদুজ্জামান নূরের অনুবাদ এবং পরিচালনায় ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ আমাদের মঞ্চের অন্যতম জনপ্রিয় নাটক। আবদুস সেলিম অনূদিত এবং আতাউর রহমান নির্দেশিত ‘গ্যালিলিও’ নাট্যামোদী মহলে আলোড়ন তুলেছিল।
১৯৯১ সালে আইটিআই ঢাকায় নাট্য-উৎসব উদযাপন করে। সেখানে জার্মান পরিচালক ফ্রিৎস্ বেনেভিৎস্ ‘লোক সমান লোক’ নাটক মঞ্চায়ন করেন। নাটকটি সবার মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এছাড়া বহুরূপী ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’-র বাংলা নাট্যরূপ ‘তিন পয়সার পালা’ মঞ্চায়ন করে। এর অনুবাদক অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। নাগরিক নাট্যাঙ্গনও একই নাটকের মঞ্চায়ন করেছে ‘জনতার রঙ্গশালা’ নামে। ব্যতিক্রম নাট্য সম্প্রদায় উপস্থাপন করে ‘বিধি ও ব্যতিক্রম’। ঢাকা থিয়েটার ব্রেখটের নাটক ‘ধূর্ত উঁই’ উপস্থাপন করে হুমায়ূন ফরিদীর পরিচালনায়। ‘সৎ মানুষের খোঁজে’ নাটকেও ব্রেখটের সার্থক উপস্থাপনা করেছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। নাট্যচক্র করেছে ‘ককেশিয়ান চক সার্কেল’।
প্রতিবেদনকারী : জিনাত জাহান ।। মুম রহমান
[সংগৃহীত রচনাটার উৎস ঢাকা থেকে প্রকাশিত ১৯৯৮ ফেব্রুয়ারি ২য় বর্ষ ১৯ সংখ্যা আনন্দভুবন]
… …
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
- আর্কের হাসান ও নব্বইয়ের বাংলা গান - January 23, 2025
- শাহ আবদুল করিম : জন্মের শতক পেরিয়ে আরও একটা আস্ত দশক || ইলিয়াস কমল - January 20, 2025
COMMENTS