কুমিল্লা থেকে বদলি হবার পর আমরা বাবার সাথে চলে আসি মাইজদীতে। এখানে এসে গার্লস স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম আমি। গুপ্তাঙ্ক থেকে স্কুলবাসে করে স্কুলে যেতাম। গুপ্তাঙ্কের গল্পটা অন্য কখনো শোনাব। ওখানে আরেকটা অধ্যায় রেখে এসেছি। নিমাই সন্ন্যাস, ললিতকলা গানের স্কুল এসব স্মৃতি ফিকে হয়নি কখনো।
যা বলছিলাম। স্কুলবাসে করে স্কুলে যাওয়ার ব্যাপারটা খুব মজা লাগত। আলীপুরের বাস কোনোভাবে মিস করলেই ড্রাইভারদাদুর রামধমক কপালে নিশ্চিত ছিল। সোনাপুরের বাসে উঠতাম খুব ভয়ে ভয়ে, চোরের মতো। গুপ্তাঙ্কের সামনে এসে বাসের গতি কমে এলে দাদু আর হেল্পারের বাক্যবাণ শুরু হতো। লজ্জায় কান্না পেয়ে যেত আমার।
এই নতুন স্কুলে প্রথম বছরটা আমি খুব চুপচাপ থেকেছি। কারো সাথে খুব-একটা মিশতাম না। দূর থেকে দেখতাম সবার ভাবভঙ্গি। কেউ কেউ মিশতে চাইত, কিন্তু আমার অতি ভদ্র আচরণে ওরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলত। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্টের পর নতুন ক্লাসে ক্লাসক্যাপ্টেন হবার সুযোগ পেলাম। তারপর ভাব হলো অন্য ক্লাসক্যাপ্টেনদের সাথে। কদিনের মধ্যেই ওরা বলল — তুই যে এত দুষ্টু, আগে তো বুঝিনি। বলা বাহুল্য এ-রকম স্বীকারোক্তি পরবর্তীতেও শুনেছি। আর প্রতিবারই মনে মনে হেসেছি।
তো এই স্কুলে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল রিখি। ও বরাবরই ফার্স্ট হতো সবকিছুতে। কী পরীক্ষায়, কী গানে। এখনও সে সবকিছুতে সেরা হয়ে আছে। আমাদের মধ্যমণি, আমাদের সবার প্রিয় রিখি। শুধু দুষ্টুমিতে স্কুলে সে আমার চেয়ে পিছিয়ে ছিল। ওর সাথে আমি শিক্ষাসপ্তাহে, রেডক্রিসেন্টের র্যালিতে যেতাম। স্কুলের দেয়ালিকা লেখার কথা মনে পড়ছে আজকাল। রিখির হাতের লেখা চমৎকার ছিল। মুক্তোদানার মতো হস্তাক্ষর। হাতের লেখার প্রতিযোগিতায় ওর সাথে কেউ পাল্লা দিতে পারেনি কখনো। বন্ধুর সঙ্গগুণে আমিও কিছুটা আহিত হয়েছিলাম।
কত কত স্মৃতি আমাদের! কারো সাথে দুটো কথা বেশি বললেই ঝগড়া হয়ে যেত, আড়ি হয়ে যেত ওর সাথে। আবার পরের দিনই ভাব। ভাব হলে একসাথে দুইটাকার ওভালটিন আইসক্রিম, বার্মিজ আচার কিনে খেতাম। আর ভাব না হলে কান্নার মতো মোক্ষম অস্ত্র তো রেডি থাকত। আমাদের কথা বন্ধ থাকলে টিচাররাও টের পেয়ে যেতেন।
ক্রিকেট খেলা নিয়ে বেশ মজার স্মৃতি আছে। মনে আছে তখন বিশ্বকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। আমরা তখন সপ্তম শ্রেণিতে। খেলা বুঝি বা না-বুঝি পরদিন ক্লাসরুমে তুমুল বিশ্লেষণ চলত আমাদের। টেন্ডুলকার, গাঙ্গুলি, হানসি ক্রনিয়ে, জ্যাক ক্যালিসদের পারফরম্যান্স নিয়ে খুব কোঁদল হতো। তাতে পুরো ক্লাস অনেকগুলো গ্রুপে ভাগ হয়ে যেত। এসবের রেশ থাকত পরের কয়েকদিন জুড়ে। বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে মাঝেমাঝে পাশের ক্লাস থেকে সিনিয়র বোনেরা এসে আমাদের সতর্ক করে যেত।
মাইজদীতে আমার আনন্দদিন শেষ হয়ে গেল হুট করে। ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষার পর বাবার বদলি হলো আবার। এবার আমাদের গন্তব্য কিশোরগঞ্জ। খুব মনখারাপ করে বিদায় নিলাম প্রিয় স্কুল থেকে। বন্ধুদের কথা দিলাম চিঠিতে যোগাযোগ রাখব।
রিখি সহ আরো অনেক বন্ধুর চিঠি পেতাম আলোরমেলায় ‘শাপলা’-র ঠিকানায়। আমিও উত্তর দিতাম সবার চিঠির। বাবার পিয়ন সেগুলো পোস্ট করে দিত। চিঠি মাঝেমাঝে ঠিকঠাক পৌঁছাত না। দুয়েকটা হারাত। তাই ক্যাম্পে যাবার খবরটা সময়মতো শেয়ার করতে পারিনি বন্ধুদের সাথে। ভালোই হয়েছিল তাতে। ক্যাম্পে গিয়ে রিখির সাথে আমার আচমকা দেখা হয়ে গেল। বোধহয় দেড় বা দুই বছর পর দেখা ওর সাথে। একটা দারুণ সারপ্রাইজ ছিল ওটা, পারুলআপার কারণে। উনি বাবা-মাকে রাজি না করালে ক্যাম্পে যাওয়াই হতো না আমার।
ক্যাম্পের দিনগুলি তাই এত এত আনন্দের ছিল। আমার জেলা বেশ ভালো পারফর্ম করল সবকিছুতে। আর মনে আছে রিখি রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম হয়েছিল সেবার। ভাবলে ভালো লাগে আমার মতো গানের সঙ্গ ছাড়েনি সে। বিভিন্ন টিভিচ্যানেলে ওর একক সংগীতানুষ্ঠান প্রচার হয় এখন। শুধু গান নয়, মনে আছে মেয়েটা ক্যাম্প থেকে আরো কী কী বিষয়ে যেন ঝোলাভর্তি করে পুরস্কার নিয়ে গিয়েছিল।
সেই রিখিকে আমি আরো একবার হারিয়ে ফেললাম। ঢাকায় গিয়ে নানাকারণে যোগাযোগ রইল না আমাদের। কলেজে পড়ালেখার চাপ ছিল অনেক। আমার ওই শহরটা ভালো লাগত না। পাঠ্যবই আর গল্পের বইতে মুখ গুঁজে নিয়ে রাখতাম পুরো সময়। আমাদের ল্যান্ডফোন বা মুঠোফোনও ছিল না। ঠিকানা বদলে গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। কারো সাথেই যোগাযোগ রইল না। সব মিলিয়ে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসবাস করতে শুরু করেছিলাম আমি।
মেডিকেলে ভর্তি হবার পর একবার জানতে পারি রিখি আইবিএতে পড়ছে। আমার ক্যাম্পাস থেকে এত কাছে আছে রিখি! তবু ওর সাথে যোগাযোগ হচ্ছিল না। গাজীপুরে শেষ দেখা। তারপর প্রায় আট বছর পর ওর সন্ধান পেলাম। তখন আমি মেডিকেলে ফিফথ ইয়ারে পড়ি। ফেসবুকে একদিন আইডি খুলে সবার আগে ওকে খুঁজে বের করলাম আমি। সেদিনের আনন্দটা রেডক্রিসেন্ট ক্যাম্পে দেখা হবার মতোই তীব্র ছিল। তারপর আমার এই বন্ধুটিকে আর হারাতে দিইনি কখনো।
আরো অনেক বন্ধুদের খুঁজে পেয়েছি ধীরে ধীরে। ছোটবেলার এসব বন্ধুরা এমন দামি হয়। ওদের হারাতে দিতে নেই। বেঁচে থাকলে একসাথে বড় হবার, তরুণ হবার, বুড়ো হবার আনন্দটা মিস করতে নেই।
প্রচ্ছদচিত্র : অসীম দাস
… …
- বনজুঁই ঘুমিও না ৮ || নিবেদিতা আইচ - August 25, 2020
- বনজুঁই ঘুমিও না ৬ || নিবেদিতা আইচ - July 25, 2020
- বনজুঁই ঘুমিও না ৫ || নিবেদিতা আইচ - July 14, 2020
COMMENTS