অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এক অন্তহীন সুরের স্মরণিকা

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এক অন্তহীন সুরের স্মরণিকা

ফ্রাঁসের পারি সিটিতে একটা কার-ক্র্যাশে একত্রিশ অগাস্ট উনিশশ’-সাতানব্বই প্রিন্সেস্ অফ ওয়েল্স্ ডায়ানা ইন্তেকাল করেন। রয়্যাল ফ্যামিলির আশপড়শি ছিলেন আগে থেকেই তারা, ডায়ানা ফ্রান্সিস স্পেন্সার এবং তাদের পরিবার, চার্লসের সঙ্গে বিবাহসূত্রে লেডি ডায়ানা রানিমার পুত্রবধু হলে স্পেন্সারফ্যামিলি নিকটাত্মীয় বড়কুটুম হয়ে ওঠে রাজপরিবারের। যদিও অচিরে ফ্যাসাদ বেঁধে যায় উভয় তরফে, স্নায়বিক কাজিয়া, সেই ফ্যাসাদের কুশীলব হিশেবে ফ্যামিলিদ্বয়ের অনেকের সঙ্গেই মিলমুহাব্বাত হয়ে যায় ন্যাংটোভুখা আমাদের অনেকেরই। তৃতীয় ওয়ার্ল্ডে ব্যাপক জনপ্রিয় রয়্যাল পরিবারের একজনকে বেছে নিতে বললে লোকে লেডি ডায়ানাকেই নেবে নো-ডাউট। কলোনিয়্যাল হ্যাঙোভারের উদ্গার যারা পানে-চুনে পেয়ে যান কথায় কথায়, এক্কেবারে মিছাও নয় সিম্পটম সেই অর্থে যে-অর্থে এক্কেবারে মিছা নয় ত্রিভুবনের কিচ্ছুটিই, সাধারণের ডায়ানাপ্রীতির মধ্যে হ্যাঙোভারের চেয়ে এলিমেন্টারি কিছু শর্ত খুঁজিয়া পাওয়া যায় যা মানুষের একেবারেই ইনেইট ন্যাচারের অংশ। স্ববিরোধী বিস্তর ব্যাপারস্যাপার ডায়ানাকাহিনিতে থাকলেও লোকে ভালোমন্দে মিলায়ে সকলি নিজের করে নিয়েছে। অ্যা থিং অফ বিউটি ইজ্ জয় ফরেভার; — কথাটা বাংলায় বিহারে উড়িষ্যায় ইংল্যান্ডে অ্যামেরিকায় ইক্যুয়্যালি প্রযোজ্য। ডায়ানার হাসিতে, ডায়ানার জেশ্চারে, ডায়ানার ভ্রুকুটিতে, ডায়ানার দৈনন্দিনতায় সাবলীল প্রবাহে লোকে ফেইরি টেইলের উপাদান যেমন পেয়েছে তেমনি পেয়েছে এক অনাস্বাদিত-অথচ-ইপ্সিত অনাড়ম্বর য়্যুনিভার্সাল শোভা। হার-হাইনেস্ ডায়ানা আজও হলিউডস্টারের যে-কারো তুলনায় টেন-টাইম্স্ সেলিব্রেটি। চিরদিনের খবর রাখি না, কালকে কে কোন অব্লিভিয়নে যেয়ে সেঁধোবে কে বলতে পারে, ডায়ানা তার দেহ রাখবার দ্বিদশক বাদেও লোকে তারে মনে রেখেছে, লেডি ডায়ানারে লোকে ভুলে নাই।

কিন্তু আমরা ডায়ানাকে স্মরণ করছি একটা গানের সূত্রে। লেডি ডায়ানাকে স্মরণ করা আর গানের সুর ও সংগীত স্মরণ করা আলাদা বাত নয়, একই প্রায়, বিউটি ইজ্ মেলোডি অ্যান্ড মেলোডি বিউটি। প্রিন্সেস ডায়ানার লেডিশিপ বাদ দিয়া আমাদের কাছে তিনি মিউজিকসূত্রে মেমোয়ারের পাতায় যুক্ত হচ্ছেন। রাজপাট ছেড়েছুঁড়ে, লেডিশিপ থুয়ে, বেরিয়ে এসেছিলেন ডায়ানা; আমরা জানি। কিন্তু মুক্তপঙ্খি জীবনে এসে ক্লেশে পড়েছেন বা অভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছেন এমন নয়, মিডিয়ার থ্রুতে আমরা দেখেছি তার স্বাধীন ইউফোরিয়া আর বিলাসের সাঁতার, ডিভোর্সকালে চড়া হারে ড্যামারেজ্ গুনে নিয়েছেন ঠিকই। প্রিন্সের পরকীয়াও প্রতিষ্ঠা পায় পাব্লিকের ট্যাক্সের পয়সায় পোষা রাজতন্ত্রের শৌখিন হেরিটেইজ্ বাঁচাইবার খেসারত হিশেবে। সেসব থাক। কথা হচ্ছে গান নিয়া।

ডায়ানাপ্রয়াণের পরেই ফিউনেরাল সার্ভিস অনুষ্ঠানে এই গানটা প্রথম ও অন্তিম পরিবেশিত হয়। ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড’ শীর্ষক গানটা এল্টন জন্ গেয়েছিলেন ওয়েস্টমিন্সটার-অ্যাবি ইয়ার্ডে সেই ফিউনেরাল প্রোগ্র্যামে। সেই-সময় বাংলাদেশে বিবিসি-সিএনএন দুইটাই ফ্রি চ্যানেল হিশেবে একটানা দুইবছর চালু ছিল। অন্ত্যেষ্টিসিরিমোনি ইয়াদ হবে আমাদের অনেকেরই আগাগোড়া। এল্টন জন্ পিয়্যানোতে বসে গেয়ে চলেছিলেন উদাত্ত সুরেলা তার গলায় ডায়ানাস্মারক গানটা। ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড ১৯৯৭’ গানটা নাইন্টিন সিক্সটিসেভেনের একটা গানেরই রিভাইসড ভার্শন। সকলেই জানেন যে মেরিলিন মানরো ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে স্যুইসাইড করেন এবং এল্টন জন্ ট্রিবিউট জানিয়ে একটা গান লেখেন ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড’, যে-গানের মুখপাতে এই লাইন পাওয়া যায় : “গ্যুডবাই নোর্মা জিন্”; বহুবছর বাদে এই গানটারই লিরিকে নেসেসারি চেইঞ্জেস্ এনে গড়ে ওঠে ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড ১৯৯৭’, যার মুখপাতে আছে “গ্যুডবাই ইংল্যান্ড’স্ রোজ্” লাইনটা। আলাদাভাবে এই দুইটা গানই শুনতে বেশ ভালো, সুন্দর, যদিও সমসুরের উভয়েই।

লিখেছেন এল্টন জন্ এবং বার্নি টপিন মিলে সামবায়িকভাবে। এল্টনের সঙ্গে রেগ্যুলার স্যংরাইটার হিশেবে কাজ করেন যারা, বার্নি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। নোর্মা জিন্ তথা মানরোকে নিয়া গানটাও বার্নিরই লিখিত, কো-রিটেন বাই এল্টন জন্। কথাচক্রে বার্নি ডায়ানাস্মারক গানটা কম্পোজের ব্যাপারে বলছিলেন, “যেন গোটা জাতিই গাইছে, এমন একটা ইম্প্রেশন রাখতে চেয়েছি গানটা লেখার সময় ইচ্ছে করেই। ঠিক ব্যক্তিক শ্রদ্ধা না-হয়ে যেন যুক্তরাজ্যের তথা সারাবিশ্বের মানুষের স্ট্যান্ডপয়েন্ট গানটায় থাকে, এইটা ভাবনার ভিতরে ছিল কম্পোজকালে। একদম গোড়ার পঙক্তিদ্বয় লিখতে হয়েছে একটু সময় নিয়ে, এরপর তরতরিয়ে এসে গেছে বাকি পঙক্তিনিচয় একদম জায়গামতো।” ১৯৬৭ সনের গানটায় মেরিলিনকে নিয়ে এল্টনের একেবারেই ইন্ডিভিজ্যুয়্যাল অনুভূতি লিরিকরূপায়িত হয়েছিল দেখতে পাই। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ওইটা মানরো নিয়া আপামর জনসাধারণের শ্রদ্ধাকাব্য হতে পেরেছিল বৈকি।

ফিউনেরালের সেই ইভেন্টে গেয়ে এল্টন জন্ ঘোষণা করেন এই গান তিনি জীবনে এরপরে আর-কোথাও কখনোই গাইবেন না। আমরা তার এই ঘোষণা জানতে পারি নিউজপেপার মারফতে। এরপর এতটা বছর গিয়েছে, এল্টন সত্যিই কোথাও গানটা পার্ফোর্ম করেন নাই। স্টেজে তো অবশ্যই না, স্টুডিয়োঅ্যালবামেও। ওই একবারই তিনি গেয়েছেন ডায়ানাস্মারক গানটা। যদিও নোর্মা জিন্ শীর্ষক অরিজিন্যাল ভার্শনটা পার্ফোর্ম করতে দেখা যাবে এরপরের অনেক অনুষ্ঠানে এল্টনকে, কিন্তু ডায়ানাস্মারক গানটা নেভার নৈব চ। বহু অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন গাইবার মোটা মোটা বায়নার। আমরা জানব যে এল্টন জন্ আর ডায়ানা স্পেন্সার উভয়েই ছিলেন পরস্পরের ভালো বন্ধু। সম্মানটা জন্ বন্ধুকে দেখিয়েছেন প্রতীকী হলেও প্রত্যক্ষ প্রত্যয়ে। এ পৃথিবী একবার পেয়েছিল তারে, এই রাঙা রাজকন্যাটারে এবং এই গানটারে, পায়নিকো আর।

যদিও ডায়ানাস্মারক গানটার লাইভ-রেকর্ড — যা আজকাল ইউটিউবে অ্যাভেইলেবল — এবং অরিজিন্যাল নোর্মা জিন্ দিয়া জন্ প্রচুর কামিয়েছেন সংগতভাবেই, কিন্তু ‘ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড ১৯৯৭’ দ্বিতীয়বার রিপ্রোডিউস করেন নাই। এই গানের লাইভ এবং অরিজিন্যাল ১৯৬৭ গানদ্বয় পৃথিবীর মিউজিকবিজনেসে সর্বকালের বিক্রয়তালিকার শীর্ষে এখনও অন্যতম।

যখন শুনি আমরা গানটা, ডায়ানাস্মারক হোক কিংবা নোর্মাস্মারক, আমরা কি লিরিকের ব্যাপারটা ভালোবেসে শুনি? ইংল্যান্ডগোলাপের জন্য রোদন আমাদেরে ব্যতিব্যস্ত করে? না, মনে হয় না তা করে। এর সুরে আমরা বাহিত হই, ভাসি, ভেসে যাই নয়নসরসিনীরে আমাদেরই কোনো হারানো প্রিয়জনের শোকে। এই সুরে একটু হলেও ফিরে পাই তারে, সেই আমাদের যার যার হারানো আপনজনটিরে, এর সুরে সন্তপ্ত হয়ে শুচি হই নিত্য যখনই শুনি ভীষণ মেলোডিয়াস এই টিউন।

diana

ক্যান্ডল ইন দ্য উইন্ড ১৯৯৭ : গ্যুডবাই ইংল্যান্ড’স্ রৌজ্

___________________________

লিখেছেন যৌথভাবে এল্টন জন্ এবং বার্নি টপিন
ভূমিকা ও বাংলায় তর্জমা : জাহেদ আহমদ

___________________________

বিদায় জানাই, বিদায় তোমায়, বিদায় হৃদয়গোলাপ
রইল তোমার চিহ্ন হৃদয়ে চিরতরে ধরে রাখা
সুহাসিনী তুমি স্নিগ্ধ প্রতিমা শারদীয় শুভছাপ
শোকতাপের এই নিরালোকে তুমি স্বপনপারের পাখা

আনিয়াছ তুমি দীর্ণ ভুবনে কেউ কভু যাহা আনে নাই
ফিসফিস সুরে গেয়ে গেছ তুমি জীর্ণের কানে যৌবন
ফুরায়েছে বেলা মাধবীর আয়ু অকালে গিয়াছে ফুরাই’
নিশার আকাশে দ্যাখো গ্রহতারা গাহিছে তোমারই কীর্তন

এখন বুঝেছি জীবন তোমার কেটেছে কেমন করে
যেমতি কাটায় মোমের শিখাটি ভীষণ রোষের ঝড়ে
হেন ঝঞ্ঝায় শিখার আলোক আগলেছ কত ক্লেশে
ব্যথার আঁধার ঘিরেছে তোমায় চারিদিক থেকে এসে

এইখানে এই পৃথিবীর পারে পায়ের চিহ্ন তোমার
এইখানে এই ব্যাপ্ত সবুজে তোমার হাসির রেশ
সময়ের আগে চলে গেছ তবু আলোটুকু অনিবার
রূপকথাটির মতো র’বে মম হৃদয়েতে অনিঃশেষ

অবশেষে সেই মমতার মুখ মিলাইল মহাশূন্যে
সেই হাসি সেই বীণাবাদিনীরে খুঁজে ফিরি জনারণ্যে
সেই আলো সেই নিমগ্ন সুর রাখিয়াছি সঞ্চয়ে
যেন আমাদের সন্ততিগণে বেজে ওঠে অন্বয়ে

কেঁদেও পাবো না ফিরিয়া তোমারে এই সত্যের ভারে
ভেসে যাই শোকে ব্যথালীন চোখে বেদনার পারাবারে
ব্যর্থ খুঁজিয়া হাজার উপায় ভাষার হাজার তন্ত্র
প্রকাশিব কোন কৌশলে এই চিরসুরভির মন্ত্র?

বিদায় জানাই, বিদায় তোমায়, বিদায় হৃদয়গোলাপ
রইল তোমার চিহ্ন হৃদয়ে চিরতরে ধরে রাখা
আমৃত্যু তুমি বিলিয়ে গিয়েছ হাসি ও হার্দ্য উত্তাপ
তোমার মুরতি হৃদয়দেয়ালে রোদনের রঙে আঁকা

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you