চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৪ || শেখ লুৎফর

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ১৪ || শেখ লুৎফর

পুত্রগণের ঈদ


আজ ঈদ। গোসলটোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে সবাই ঈদগাহের দিকে আসছে। মাগীকুদ্দুর ঘুম ভাঙে সেই ভোরে। যত দেরিতেই বিছানায় যাক-না কেন তালুকদারবাড়ির মসজিদের মাইকে ফজরের আজান পড়তেই তার ঘুম ভেঙে যায়। তখন সে শুয়ে-শুয়েই কানখাড়া করে খোদার দুনিয়াটা বুঝতে চেষ্টা করে। নিঝুম পৃথিবীরও একটা ভাষা আছে। শিশির পতনের শব্দ, বৃষ্টির শব্দ, লিল্লিড় করে বয়ে যাওয়া বাতাসের তান কিংবা কালাই পাথারের ডাহুকের গান শুনতে শুনতে সে একটা বিড়ি ধরায়। বিড়িটা শেষ হতেই তার পায়খানার তলব হয়। তারপর বিলপারের ঘাট থেকে ঘুরে এসে ঘর আর ছোট্ট উঠানটা ঝাড়ু দিতে দিতেই চারদিক আবছা আলোতে আলোকিত হয়ে ওঠে। তখন সে বদনাভরা পানি, ব্লেড আর ছোট্ট আয়নাটা নিয়ে দাড়ি কাটতে বসে। এটা তার বহু বছরের অভ্যাস। আজ ঈদের দিন বলে গুড় দিয়ে হাতে-ঘষা সেমাইও সে রান্না করেছে। কাল রাতেই নিজের ঘরের সবচে বড় হাঁসাটা সে বেঁধে রেখেছিল। সেইটাও জবাই করে ছোট ছোট জামআলু দিয়ে রান্না করতে করতে সুরুজটা ঝলমল করে উঠে পড়ে। তারপর বিলের ঘাটে বসে ক্ষার দিয়ে গোসলও করেছে মনমতো। সখিন করে চোখে দিয়েছে সুরমা আর একটু তুলা আতরে ভিজিয়ে কানের কটায় গুঁজে দিতেই মাগীকুদ্দুর মনটা বিলের ডাহুক পাখির মতো গেয়ে ওঠে :

সখি হে,
আজও না বুঝিলাম তর রীতি
কী হবে কেঁদে কেঁদে,
অল্প বয়সে ভাঙিলে যে পিরিতি।

কদিন আগেই অঘুনি ধান কাটা হয়েছে। গ্রামের মানুষের খোরাকির টানাটানি নাই বললেই চলে। সবাই হাসিমুখে ঈদগাহের ময়দানে হাজির। শুধু আঙ্কুর নাই। সে বহু বছর ঈদের নামাজে আসে না। নামাজের সময়টা দোকানের গদিতে গুম হয়ে বসে থাকে আর বিড়ি টানে।

আল-বাত বেয়ে বেয়ে তিন গ্রামের মানুষজন এখনও আসছে। ইমাম সাহেব মেহেরাবের দুই নম্বর সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আতরমাখা দাড়িতে আঙুল দিয়ে খিলাল করছে। দানবকালুর কী মনে হয় খোদাই জানে। সে ঘোড়ামোবারক, অহাকালু আর মালেককে বলে, — ল দ্যাহি আঙ্কুর কী করে।

দানবকালু আজ একটা শার্ট গায়ে দিয়েছে। চৈদ্দ-পনেরো বছর আগে বিয়ের সময় সে এইটা কিনেছিল। এখন আর গতরে ঢুকতে চায় না। এর মাঝে চারবার কলেরা হানা দিয়েছে। মানুষও মরেছে অনেক। দুইবার বসন্ত রোগে যত মানুষ মরেছে তারচে বহুগুণ মানুষের মুখে, গতরে খাউদা খাউদা দাগের কুৎসিত চিহ্ন রেখে গেছে। আর গেছে তিনটা বন্যা। সবশেষ বন্যাটা ছিল নুহের বানের মতো। সেই গজবে আঘুনি ধানের চৌদ্দ আনাই নষ্ট হয়েছে। তাই বন্যার মাসখানেক পরেই শুরু হয় ভয়াবহ এক আকাল! সেইবার দানবকালুর পরিবার শুধু জঙ্গলের কচু আর বিলের শালুকসিদ্ধ খেয়ে বেঁচেছিল উনিশদিন। রক্তআমাশয়ে ভুগে ভুগে তার ছোট মেয়েটা মরে গেছিল।

এইসব গজবের পরেও দানবকালুর বুক-পিঠ চওড়া হয়েছে কমপক্ষে বারো আঙুল। হাতের পাঞ্জাদুইটা শালকাঠের মুগুরের মতো। তাই শার্টটা তাকে অনেক জবরদস্তি করে গায়ে দিতে হয়েছে। দুই ঈদের দিন ছাড়া দানবকালুর শার্টের দরকার পড়ে না। সারাদিন কাটে মানুষের জমিনে। ঘোর সন্ধ্যা-সময় পরের জমিন থেকে উঠে ছুটতে হয় বাজারের দিকে। জমিনের মালিককে গিয়ে ধরতে হয় ধান কিংবা পাটের মহালে। সে ধান-পাট বিক্রিবাট্টা শেষে-না তাদের বেতনটা দিবে। জমিন থেকে উঠে, হাত-পা ধুয়ে হাফহাতা গেঞ্জিটা গায়ে দিয়ে, গামছাটা কাঁধে নিলে আর শার্টের দরকার কী?

তাবাদে এই এত্ত ছোট একটা শার্ট বিরাট পুরুষ দানবকালুর পিঠ-পেট কামড়ে ধরেছে। হয়তো এই জন্যই কতক্ষণ পর পর তাকে পিঠ চুলকাতে হয়। দানবকালু পেট-পিঠ চুলকাতে চুলকাতেই অহাকালুদের নিয়ে মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোনার দিকে হাঁটে। সেদিকে আঙ্কুরের দোকান। তারা চারজন এসে আঙ্কুরকে চেপে ধরে, — অ আঙ্কুর, এইবার কিন্তুক ঈদের মাডে যাইতে অইব।
বিরক্তিতে আঙ্কুরের ছোট কপালটা কুঁচকে ওঠে, — এইডা তর মামুরবাড়ির আবদার নাকি?
আঙ্কুরের কথায় কেউ কান দেয় না। মালেক-ঘোড়ামোবারকরা নাছোড়, — এইবারে ঈদের মাডে যাইতেই অইব কইলাম।
আমি তর খাই, না তর কতায় হাগি? — এই কথা বলে আঙ্কুরের কঠিন খোমার তার নাজুক ঘাড়গর্দনায় মোরগের মতো একটা বাঁক তোলে। দানবকালু এগিয়ে আসে, — যত কতাই কছস না, এইবার কিন্তুক ঈদের মাডে যাইতেই অইব।

আঙ্কুর দানবকালুর দিকে তাকায়; বহু বছর আগে কেনা শার্টটা দানবকালুর বিশাল গতরটাকে এখন ব্লাউজের মতো কামড়ে ধরেছে দেখে সে হেসে ফেলে, — এই শালা দ্যাহি তার বউয়ের ব্লাউজ গায়ে দ্যায়া আইছে!

আঙ্কুরের এই কথায় খুব হাসাহাসি হয়। আশকারা পেয়ে দানবকালু আঙ্কুরকে একটা শিশুর মতো পাথাইল-কোলে করে ঈদের মাঠের দিকে চলতে থাকে।

ঘোড়ামোবারক আমোদের চোটে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে একটা ডায়ালগ দিয়ে বসে, — গীতিকবি আঙ্কুরভাইয়ের আগমনে আজ চেমননগরের রাজদরবার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে!

ঘোড়ামোবারকের ডায়ালগের পিঠে আর কেউ সামিল হয় না।

রাগে মুখ কালো করে আঙ্কুর সবার মাঝে চুপচাপ বসে থাকে। নামাজের সময়ও সে একই ভাবে বসে থাকে। আল্ল-খোদা ও তার ইবাদতের আনুষ্ঠানিকতায় আঙ্কুরের বিশ্বাস খুব সুবিধার না। চারপাশের লোকগুলান ঠায় দাঁড়িয়ে উঠবস করল, রুকু ও সেজদা দিলো, যেমন করে তারা বাতর ভেঙে পাশের ক্ষেতের পানি চুরি করে নিজের ক্ষেতে নিয়ে আসে।

আঙ্কুর পিটপিট করে সবাইকে দেখে। সে জানে, এই লোকগুলান এম্নি এম্নি মিছা কথা বলে, নির্বিকার মনে অন্যের ক্ষতি করে। পাশের জমির বাতর কেটে কেটে তিন বছরে একহাত জমিন নিজের জমিনে মিশিয়ে দেয়। তাই তাদের ইবাদত আর খোদাভীতি তার কাছে হাস্যকর লাগে।

মোনাজাতের সময় ইমামসাহেব খুব কান্নাকাটি শুরু করলে আশপাশে পুরানা আমাশয়ে কিংবা কফে-বাতে ভুগতে থাকা বুড়াদের কেউ কেউ মরণের ভয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। দেখাদেখি ঘোড়মোবারকও নাক টেনে টেনে রোদন শুরু করে, — খোদা তুমি একটা যুইত কৈর‌্যা দ্যাও। আমগর অহাকালুর একটা ব্যবস্তা কর। অহাকালুর অস্ত্র (লিঙ্গ) রাখবার একটা পিছলা জাগার ব্যবস্থা কর। অর্থাৎ বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও খোদা।

এই রোদনে চারপাশের চ্যাংড়াদের মাঝে হাসির দুম পড়ে যায়। তিন গেরামের একমাত্র ঈদগাহ। তাই মাঠে হাজারখানেক মানুষ। সবাই নাকে-চোখে পানি নিয়ে ইমামের পিছে পিছে আমিন! আমিন! করতে করতে ফানাফিল্লা।

নোয়াখালী থেকে বড়হুজুর এসেছে। বছরের দুই ঈদেই তিনি আসেন। তাই কেউ কেউ এই ফাঁকমতো নিজের মনের আবেগ-আল্লাদ, আরস্তিগিরস্তি সহ সংসারজীবনের নানান ঝক্কিঝামেলারও একটা সহজ নিস্পত্তি চেয়ে ইমাম সাহেবের মাধ্যমে খোদার কাছে লম্বা লম্বা দরখাস্ত পাঠাচ্ছে। এই যখন মাঠের অবস্থা তখন কে কার খবর রাখে? তাই ঘোড়ামোবারকের দেখাদেখি মালেকও ইমামের সাথে খোদা খোদা করে একটা ফরিয়াদ নিয়ে লুটিয়ে পড়ে, — আল্লা, আল্লা গো… অ আমার আল্লা, তুমি গরিবের নিগাবান, এই অভাগার কোনো চাওয়া নাই। আমি নিজের লাইগ্গ্যা কান্দি না। আমি কান্তাছি গীতিকবি আঙ্কুরভাইয়ের লাইগ্যা। তুমি ত জানো আল্লা, আঙ্কুর ভাইয়ের তুমি কত বড় একটা কামান দিছ। সাতগেরামে এই রহম জিনিস একটাও নাই। এমুন বিশিষ্ট একটা জিনিস জষ্ঠিমাসের খরানে যুগের পর যুগ শুকাইতাছে। তার একটা ব্যবস্তা কর খোদা… অধম গরিবের এই একখান মাত্র দরখাস্ত; আঙ্কুরভাইয়ের লাইগ্যা একটা নরম-গরম জাগার ব্যবস্তা কর…।

কান্নায় ডুকরে-ওঠা মালেকের সবটা মোনাজাত আঙ্কুর খুব মন দিয়ে শোনে। শুনতে তার একটুও খারাপ লাগছে না। মালেক তো তার মনের কথাটাই বলছে। খোদার মর্জিতে তামাম দুনিয়া চলে। তাকে ল্যাংড়া-লোলা করে দুনিয়াতে পাঠাইছে সত্য কিন্তু তারে যে জিনিস দিছে এইরহম জিনিস খোদা কয়জনরে দ্যায়?

মোনাজাতটা যে আঙ্কুরের মনমতো হয়েছে দানবকালুও এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিল। মাগীকুদ্দুর কথাও বলতে হয়। সে তো মালেকের প্রত্যেকটা ফরিয়াদের সাথে জোরে জোরে ‘আমিন! আমিন!’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। দলের কর্তা মানু মিয়া ছাড়া সবাই তো আঙ্কুরের মহাভক্ত। সবাই আঙ্কুরের ভালো চায়। তারা যে-স্তরের মানুষ, যে-ভাষায় কথা কয়, ভাবে, স্বপ্ন দেখে, সেই ভাষা দিয়ে তারা খোদার কাছে মিনতি করবে এইটাই তো সত্য। তাবাদে আঙ্কুরের লেখা গান দিয়েই তো তারা মঞ্চে দর্শকের হৃদয় জয় করে। তাই দলের সবাই আঙ্কুরকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে। অই-যে অহাকালুটা। যে-মানুষটা একটা পাত্রীর অভাবে বিয়ে করতে পারছে না দশ বছর ধরে। সে-ও তো আজ নিজের কথা বাদ দিয়ে আঙ্কুরের জন্য কাঁদতে কাঁদতে দুইচোখ ভিজিয়ে ফেলেছে।

এতকিছুর পরও আঙ্কুরের বিচারে মোনাজাতটার সবকিছু ঠিক থাকলেও মালেকের জবানটা ভালো না। সে খুব নিকৃষ্ট ভাষায় খোদার কাছে আর্জিটা পেশ করেছে। খোদা তার খোদাগিরি নিয়ে ইচ্ছামতো থাকুক। কিন্তু মালেকের কোনো রুচি নাই। আঙ্কুর নীরবে বিবেচনা করে স্থির করে, আর যা-ই হোক মালেককে এই টাইমে আশকারা দেওয়া ঠিক হবে না। আশপাশের ছোট-বড় সবার সামনে ভালো একটা জিনিসকে মালেক বড় নোংরা করে দিয়েছে।

ভাবতে ভাবতেই আঙ্কুর হাতে লাঠিটা তুলে নেয়। মাইকে ইমাম সাহেবের কান্না আর নাকটানার শব্দ এখন প্রবলতর। সেই ফরৎ ফরৎ শব্দের সাথে চ্যাংড়াদের হাসি কতক্ষণ টিকে? মরণের ভয় বলে একটা জিনিস আছে! সে কলেরার জীবানুর মতো মিনিটে মানুষের হৃদয় ঘায়েল করে ফেলে।

আঙ্কুর মাথাটা একটু সোজা করে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মালেকের পিঠে হাতের লাঠি দিয়ে দুম দুম কয়টা বসিয়ে দেয়। চ্যাংড়ারা এবার আরও জোরে হেসে ওঠে। কেউ কেউ হাসিতে ঢলে পড়লেও দু’হাতে মোনাজাত ধরে রাখে যাতে খোদার রহমত পানির মতো দুই হাতের ফাঁক দিয়ে ফসকে না যায়। আশপাশে কয়েকজন আধাবুড়াও হাসি চেপে রাখার জন্য খুব ভারিক্কি চালে ‘আমিন! আমিন!’ বলে কঁকিয়ে ওঠে। তারা রোদনের তালে তালে মাথা নুইয়ে সামনে-পিছে গতর দুলায়।

খৈল্লাকলুর দ্বিতীয় স্ত্রীর ছোট ছেলেটার বয়স মাত্র তিন বছর। সে আঙ্কুরদের সারির দুই সারি পিছে বসে মোনাজাত করছে। তার বাঁ হাতটা কপাল বরাবর মোনাজাতে ব্যস্ত। আর ডান হাতটা পাছায়। সে মনের সুখে তার পাছার বিখাউজ চুলকাচ্ছে। প্রায় উলঙ্গ আর কালো কুতকুতা পোলাটা নাকের সর্দি-হিঙ্গাইসে ডুবে যাচ্ছে সেই দিকে কারো খেয়াল নাই।

তাবাদে মোনাজাত শেষ হয়। সবাই যার যার বাড়িমুখো হাঁটা দেয়। এখন গিয়ে তারা আরেকদফা সেমাই খাবে। সেমাই মানে আতপ চালের গুঁড়ার খামি দিয়ে হাতে ঘষে ঘষে বানানো সেমাই। আখের লাল গুড় দিয়ে রান্না করা হাতে-ঘষা সেমাই কাদু-কালুরা পেট ভরে গিলে এসেছে। আবার আছরের সময় গিয়ে মুরগির গোস্তের ঝুলভাত দিয়ে পেট বোঝাই করবে। দুপুরের খানাটা একটু দেরি করে খেলে রাতে আর খেতে হবে না। দুই ঈদ ছাড়া বছরে আর কোনোদিন তাদের ঘরে গোস্ত রান্না হয় না। বছরে মাত্র এই দুইটাদিন…। তাই ঘরণীরা ছালুনে ঝাল আর ঝোল দুইটাই ইচ্ছামতো দেয়। ছোটরা হা-হু করে আর থালা ভরে ভরে ভাত লয়। ঈদের দিন দানবকালুর ঘরে একবেলাতেই আড়াই সের চালের ভাত লাগে।

অহাকালুরা ঘাপুরঘুপুর গপ্পো করতে করতে সব-ক’টা এসে আঙ্কুরের দোকানে ঢোকে। আঙ্কুর পাশে লাঠিটা রেখে গদিতে গিয়ে চুপ করে বসে। দশ বছর বয়সেও মায়ের কোল ছিল বিকলাঙ্গ আঙ্কুরের পৃথিবী। সে নিজের হাতে একমুঠ ভাতও খেতে পারত না। হাগা-মুতা-গোসল-খাওয়া সহ সবকিছু মায়ের হাতেই। মাঝে মাঝে তার বাপ বিরক্ত হয়ে তার মাকে বলত, — এই ইন্দুরটারে খালপারে ফালায়া থুইয়্যা।

তাবাদে দিনে দিনে অচল আঙ্কুর তার বাপের দুই চোখের বিষ হয়ে যায়। গাছে উঠতে পারে না বলে ইচ্ছা থাকলেও গলায় দড়ি দিতে পারল না। বিষ খেয়ে জীবন শেষ করতে পারল না একটু বিষ জোগাড়ের অভাবে। তাদের বাংলাঘরে নোয়াখালীর এক হুজুর থাকত। টাইমে টাইমে মসজিদে আজান দেয়, নামাজ পাড়ায়। আর সারাদিন খালি পান খায়। হুজুর তাকে অনেক দিনের চেষ্টায় লিখতে-পড়তে শিখিয়েছিল। তখন থেকেই অচল আঙ্কুর হাতের কাছে একটা ছেঁড়া পাতা পেলেও বানান করে করে পড়তে চেষ্টা করে। যখন তার বুকের ছোট্ট গর্তটায় মোটা মোটা বারো-চৌদ্দটা লোম গজায়, মাঝে মাঝে স্বপ্নদোষ হওয়া শুরু হয়, তখন তার বাপ একদিন তাকে খুব গালিগালাজ করে, কিল-লাথি মারে। বাপের কিল-লাথি খেয়ে আঙ্কুর যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল আর বাপের ঘরে ফিরে যায়নি।

আজ এই দোকানটাই তার বাড়ি আর কাদু-কালুরা তার ঘরের স্বজন। অবস্থাগুণে মায়ের পেটের ভাইয়ের চে বেশি। আজ ঈদ। তার বন্ধুরা সব তার ঘরে এসেছে। সে কী দিয়ে তাদেরকে সমাদর করবে? তাই সে মমতাজ বিড়ির একটা নতুন বান্ডিল ছিঁড়ে কাদু-কালুদের সামনে রাখে। বান্ডিল থেকে একটা বিড়ি তুলে নিতে নিতে মাগীকুদ্দু বলে, — গফুর বাদশা গানের বাইনা আইয়ে না ক্যায়া?
এইমাত্র ধরানো বিড়িটাতে লম্বা একটা টান দিয়ে মালেক বলে, — বাইনা আইয়ে, কর্তা বাইনা রাহে না।

মালেকের এই কথায় উপস্থিত সকলে আচান্নক হয়। আঘুনি ধানকাটা শেষ। ভাতের চিন্তা নাই। মাঠে গিরস্তের জমিনে কাম নাই। এখন পালাগানের ভরা মৌসুম। হালকা শীতের এই লম্বা লম্বা রাতগুলা রঙ্গমঞ্চ ধাপায়া বেড়ানোর কথা। অথচ প্রায় এক মাস ধরে কোনো বায়না নাই!

রাজারূপী কাদুর হাসিভরা মুখটা দপ করে নিভে যায়। দুঃখে অহাকালুর নষ্ট চোখের কেতুরটা কাঁপতে থাকে। দানবকালু সহজে অবাক হয় না। বায়না আসে কিন্তু কর্তা বায়না রাখে না! এই আচান্নক কথায় আজ দানবকালুর মহিষের মতো চ্যাপটা নাকটা ফুলে ওঠে, — মানু মিয়া আমগরে ভাতেও মারব, আঁতেও মারব। মরাকার্তিকে ধান আনছিলাম দেড়মুন, আঘুন মাসে আদায় করল আড়াইমুন।
রাজারূপী কাদুর চোখ ছলছল করে, — আমি আর দল করতাম না। বয়সও নাই, পরানে সুখও নাই।

এইকথায় সকলের নজর কাদুর দিকে ফেরে। কথাটা শুনে বুঝি কাদুর গতরের হাড়গুলা জোড়া ছেড়ে দিয়েছে, বয়স বেড়ে গেছে দশ বছর এইমতো অসাড় ভঙ্গিতে সে বিড়ি টানে। অহাকালু কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। সে ঘোড়ামোবারককে ভয় পায়। নানান দিক থেকে ঘোড়া মানু মিয়ার কাছে একমতো বন্দি। ক্রীতদাসেরও অধম। ঘোড়ামোবারক চুরির মাল মানু মিয়ার কাছে গচ্ছিত রাখে। তাবাদে মানু মিয়ার কাছেই পানির দামে বিক্রি করে। তাই ঘোড়ামোবারক-মানু মিয়া পেটে পেটে এক। কঠিন কিছু বললে আজ রাতেই গিয়ে তার নামে লাগাবে। মালেকের কথা ভিন্ন। ঘোড়ামোবারকের সাথে তার শিশুকালের দুস্তি। সে মানু মিয়ার বিষয়ে দুই কথা বেশি বললেও ঘোড়া গিয়ে মানু মিয়ার কানভারী করবে না। এইসব বিবেচনায় গফুর বাদশা পালাগানের বিষয়ে আর কোনো আলাপ জমে না, আবার কেউই উঠেও যায় না। কবরতুল্য দোকানকোঠায় তারা পরস্পর গতর ঘেঁষাঘেঁষি করে বিড়ি টানতে টানতে নীরব হাহাকারে ঘরের বাতাস ভারী করে তুলছে ।

চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you