দুঃখের নিশি না হয় ভোর
শাওন মাসটা শুরু হলো শাঁ শাঁ বাতাস আর ঝিমধরা বৃষ্টি দিয়ে। মাইলের পর মাইল পাটক্ষেতের মাথায় কালচে-সবুজ ঢেউয়ের দুলুনি। মাঝে মাঝে আম-জাম-কাঁঠাল গাছের গহিনে ডুবে আছে মাটির দেওয়ালের উপর ছন কিংবা টিনের চালের বাড়িগুলা। সামনে কচুরিপানা ভরতি পাগার-ডোবা কিংবা টলটলা পানির পুকুর। পুকুরপারের আম-জাম, তালগাছ, খেজুরগাছের ডালে ডালে বৃষ্টি-বাতাসের দাপাদাপি। গাঙপারের বাঁশঝাড়গুলা কাদু-কালুদের মতো মহাআমুদে বাবরি দুলিয়ে শন শন রবে চিৎকার দিচ্ছে : ভালোকর্তা ভা, অ হারে হে…। ঘরে ঘরে কৃষক-কামলারা বালু দিয়ে সুপারি গাছের চ্যারটে কাইচ্চ্যা দা (হাত-দেড়েক লম্বা, পাতলা আর ক্ষুরের মতো ধারালো দা, যা দিয়ে পাট কাটা হয়) ঘষে চনচনে ধরালো করে রেডি হচ্ছে পাট কাটার জন্য। মাঠের পর মাঠ পাটের অরণ্যের মাঝে মাঝে নিচু বাইদাল জমি। আউশ ধান কাটা পতিত ক্ষেতগুলা এখন বৃষ্টিভাসা পানিতে সয়লাব। দূর থেকে দেখতে ভরা বিলের মতো লাগে। মাঝে মাঝে আকাশে যখন বিজলি গোখরা সাপের মতো ফাৎ করে ওঠে তখন পতিত ক্ষেতগুলার সাদা পানিতে বিজলির সেই চমক ভেংচি কাটে।
পাটক্ষেতের বাতরে বাতরে খরগোশের বাচ্চা কিংবা কাঁকড়ার খোঁজে ভেজা-চোরচোর চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে শিয়ালরা। ধান কেটে নেওয়া বাইদাল জমির পানিতে বসে চকচকে সোনাব্যাঙগুলা ডাকছে গ্যাঁকো গ্যাঁকো…। খেলা বিছানায় বসে বসেই তার শিথান-দিকের জানলার একটা ডালা খুলে বাইরে তাকায় : বৃষ্টি-বাতাসে সারা দুনিয়া মা-কালির মাথার আউলা চুলের মতো ঘোর হয়ে আছে। বাড়ির উঠান, পথঘাট আর পুবের বড় সড়ক, সবখানে থকথকে কাদা। বাতাসে আউশের পচা খড় আর পেঁক-পানির বিটকেলে গন্ধ। বাড়ির দক্ষিণের কলাছোপার পাশে গোবর রাখার মস্ত একটা গর্ত। কাচা গোবর আর বৃষ্টিভাসা পানি গড়িয়ে যাচ্ছে পাশের পাটক্ষেতে। সেদিক থেকে আসছে পাদের মতো বাজে গন্ধ।
মাঝে মাঝে এলোমেলো দমকা হাওয়া গাঙপারের ঘন জংলা থেকে ছুটিয়ে নিয়ে আসছে কেয়াফুলের সুবাস। খেলার মনে পড়ে যুবতী মেয়েলোকের কথা। মেয়েদের শরীরে ঠিক এইরকম একটা ঘ্রাণ আছে। তার বুকটা খামাখা মুচড়ায়, শরীরটা শিরশির করে। খেলা মনে মনে ভাবে, মেয়েলোকের ব্যাপারটাই আলাদা কিসিমের। সেই জগৎ তার কাছে ভোরের আবছা আলোর মতো মিঠা মিঠা আর অস্পষ্ট। তাবাদে খেলা গুনগুন করে একটা বিচ্ছেদের সুর তোলে।
বিষণ্ণ একটা দমকা হাওয়ায় খেলার মনটা ঝিমিয়ে পড়ে। সে পরীর দিকে তাকায়। পরী আর মাগীকুদ্দু গরুর জন্য পাটের দড়ি পাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে যখন টানা ঝড়বাদল শুরু হয়, ক্ষেত-খলার কামকাজ একদম বন্ধ হয়ে যায়। তবু গিরস্তদের ঘরে ঘরে খুঁটিনাটি নানান কাজ থাকে। তখন মাগীকুদ্দু খেলার কাছে চলে আসে। ফেনকচুর একটা বিশাল পাতা মাথার উপর ধরে নুয়ে নুয়ে এসে মাগীকুদ্দু হাজির হয়, — চাচি কৈ?
— ক্যাডা রে … কুদ্দু নাকি?
— হ চাচি।
— তর কতাই ভাবতাছিলাম। আইছস, ভালা অইছে। ব।
মাগীকুদ্দু শরীর-মাথা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বারান্দার কোনার দিকে চলে যায়। খেলার বাপের হুক্কা-তামাক সেইদিকেই। তারপর তামাক সাজবে। কুরুৎ কুরুৎ করে টানবে আর মুখ ভরতি সাদা সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে উদাস চোখে দুনিয়াটার তছর (রূপ) দেখবে। খেলার মা একবাটি গুড়-মুড়ি মাগীকুদ্দুর সামনে দিয়ে বলবে, — খৈ খায়া রান্দাঘরে (পাকঘরে) আইছ।
মাগীকুদ্দু ঘরে-বাইরে সব কাজে সমান দক্ষ। খৈ-মুড়ি-চিড়া ভাজা, ঢেঁকিতে ধানভানা সব, সব কাজে সে মেয়েদের চে একটুও কম যায় না। তাই বৃষ্টিবাদলার দিন গিরস্তের বাড়িতে তার কদর আরও বেশি।
আশপাশের দুই-তিন বাড়ির সব কিশোর রাখালরা মাগীকুদ্দুকে আজ ঘিরে বসেছে। তারা মাগীকুদ্দুর কিচ্ছার মুগ্ধ শ্রোতা। রাখালরা বিড়ির কাগজ কেটে কেটে টিনের একটা কৌটায় রাখছে। কেউ কেউ তামাকপাতা মালসার আগুনে সেঁকে, মড়মড় করে গুঁড়া করছে। এইসব খুঁটিনাটি কামের মাঝেও মাগীকুদ্দুর কিচ্ছা তারা কান পেতে শুনছে। আজকে মাগীকুদ্দু ‘আলমাছকুমার’-এর কিচ্ছা বলছে। ক্ষীরের লাসার মতো কাহিনির পরতে পরতে প্রেম-বিরহ ও গান। মাগীকুদ্দু গলা চিকন করে মেয়েলি সুরে রাজকন্যার বিচ্ছেদ গাইছে। বাইরে ব্যাঙগুলা ডাকছেই। খেলা জানে, তুলতুলে একটা স্ত্রী-ব্যাঙের পিঠে না-ওঠা তক ওদের জান ঠাণ্ডা হবে না। সে মনে মনে হাসে। এবার খেলা ঠাস করে জানালার ডালাটা বন্ধ করে দেয়। মাগীকুদ্দুর কিচ্ছায় এখন ভোররাত। সে বলছে, — তারপরেতে আলমাছকুমার নামিল সোনার পালঙ্ক হইতে / সারারাত নিদ নাহি ছিল তার নয়ানে / বিরহে সোনার বরন অঙ্গ তাহার হইয়াছে অঙ্গার … / ফুলবাগানের গাছে গাছে ডাকিছে পাখি / বহিছে বাতাস … রাজবাড়ির কার্নিশে কার্নিশে বসে কা কা রবে ডাকিছে কাক।
মাগীকুদ্দু আবার সুরে সুরে ভোরের বয়ান করে :
‘গাছে গাছে ডাকে কোলি-কাকেরাও
ছ্যাত কাউয়া ডাকিয়া বলে রাত্রি পোহাও রে … পোহাও …।’
কিচ্ছা বলার ফাঁকে ফাঁকে মাগীকুদ্দু মুঠিভরা ভাজা চিড়া মুখে চালান দেয়, কচ্ করে কাঁচামরিচে কামড় বসায়। বাটির কোনা থেকে চিমটি দিয়ে একটু লবণ নিয়ে হা-করে মুখে ছেড়ে দেয়। একটু ধিরিক ধরে মন দিয়ে চিবিয়ে নেয়। তাবাদে আবার শুরু করে।
দরজার মুখে দাঁড়িয়ে খেলা আকাশ দেখে। থমথমা কালো। কোথাও আলোর একটু কণাও নাই। মাঝেমাঝে অল্প সময়ের জন্য বৃষ্টি থামে। পা টিপে টিপে লোকজন এঘর-সেঘর করে। কেউ কেউ লোটা-বদনা নিয়ে গাঙপাড়ের জংলার দিকে চলে যায়। গোয়ালঘরের দিকে কামলারা খড়, পানি নিয়ে ছোটাছুটি করে। তাই দেখার জন্য বুঝি সূর্যটাও একটু উঁকি মারে। দক্ষিণ দিক থেকে কালো কালো অলম্বুশ মেঘ হু হু করে ছুটে আসে। ফের ঝমঝম করে শুরু হয় বৃষ্টি। চাষারা এই অবসরে গরুর দড়ি পাকায়, নাঙল-জোয়াল-কোদাল মেরামত করে। সেই তালে তারা নিজেরাও একটু জিরিয়ে নেয়। আলসেমিভরা এই ঝড়ো-বাদলায় তিনবেলা ভাতের ফাঁকে ফাঁকে চলে চালভাজা, চিড়াভাজা আর কাঁঠালের শুকনা বিচিভাজা খাওয়া। স্বচ্ছল চাষাদের ঘরে পিঠাও হয়। ভাপাপিঠা, চিতইপিঠা তার সাথে ঘন দুধ-চিনির ক্ষীর। খেলা একলাই তো আস্ত একবোল ক্ষীর হাপুত-হুপুত করে উড়িয়ে দেয়। বন্দি পাখির মতো খেলার মনটা আজ ছটফট করছে। সে কাঁধের লাল গামছাটা কোমরে কষে বাঁধে। স্যান্ডো গেঞ্জিটা কামড়ে ধরে আছে চকচকে শ্যামলা গতরটাকে। এই জেলখানা এখন অসহ্য। হাত নিশপিশ করে। শরীরে কামড় ওঠে। একটাকিছু করার জন্য সে মনে মনে পাগল হয়ে উঠেছে। তাই নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে একটা বিড়ি ধরিয়ে ফের বিছানায় উঠে বসে। মাগীকুদ্দুর কিচ্ছা চলছে। অনেক লম্বা কিচ্ছা। বহুবার শোনা জিনিস। তাই খেলা কাহিনিতে মন দেয় না। মাগীকুদ্দুকে ঘিরে বসে থাকা প্রায়-তরুণ-হয়ে-ওঠা রাখাল ছেলেগুলাকে সে দেখে। এদের জীবন বড় কষ্টের। খুব বেশি হলে বছরে বেতন পায় দশ টাকা। থাকা-খাওয়ার সাথে দুইটা লুঙ্গি আর একটা গামছাও বছর বছর পাবে। খেলার পস্ট মনে আছে ওই বয়সে সে প্রায়ই লুঙ্গি গাঙের ঘাটে রেখে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কতদিন শীতের সকালে বাজি ধরে, একহাঁড়ি খেজুরের রস খেয়ে জয়ের আনন্দে হো হো করে হেসে উঠেছে।
একটু উনিশ-বিশ হলেই গিরস্তদের কেউ কেউ গরুরাখালকে ঘরের বউয়ের মতো গুপ্পুর গুপ্পুর করে কিলায়। ওরা মার খেয়ে গোয়ালে কিংবা বিলপারে বসে কেঁদেটেদে আবার ফিরে আসে। কোথায় যাবে? বাপের ঘরে ভাত নাই। এক গিরস্তের কাম ছেড়ে আরেকটা কাম জোগাড় করা মুখের কথা না। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের কপালে দুইবেলা ভাত জোটে না। তাই অসহায় কুকুরছানার মতো ওরা আবার মনিবের বাড়িতেই ফিরে আসে।
খেলা নিজের অজান্তেই সবসময় আমোদের তালাশে থাকে। মর্দামির দৌড়ে সবার আগে থাকতে সে ভালোবাসে। গ্রামের সংসারীরা যাকে বলে হুজুগে তার ষোলআনাই খেলার কামে-কাজে বর্তমান। মানু মিয়ার মতো হিসাবি মানুষেরা আড়ালে আড়ালে মুখটিপে হাসে আর মনে মনে বলে, — তা না অইলে কী আর ঘাডু রাহে? বাপটা মরলেই বছর বছর জমি বেচব।
পাড়ার লোকজন বলাবলি করে, খেলা একটা পাগল।
ফাগুন মাস এলে খেলা মস্ত মস্ত চিলাঘুড্ডি বানায়। ঘুড্ডির ঠোঁটে বেঁধে দেয় পাঁচ-ছটা করে তালপাতার ধেনু। ধেনুর একটানা ভোঁ ভোঁ গুঞ্জনে গ্রামের নিথর বাতাস সজাগ হয়ে ওঠে।
খেলা আড়চোখে আরেকবার রাখাল ছেলেগুলাকে পরখ করে : হাড়গিলা গতর, তোষা পাটের মতো লালটিবরন চুল, গায়ের রং লাবণ্যহীন কুটকুটা কালো কিংবা ছাইবর্ণ। ওদের কেউ কেউ সারাবছর খুক খুক করে কাশে। কোনো-কোনোটা বেমারি মুরগির মতো। গতরের কোনো বাড়-বৃদ্ধি নাই। আমকাঠের তক্তার মতো খটখটা। বর্ষা এলে গরু নিয়ে কাদাপানির মাঝে ছুটতে ছুটতে ওদের পায়ের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে পচন ধরে। সন্ধ্যায় হাত-পা ধুয়ে, পায়ের আঙুলের ফাঁক শুকনা গামছা দিয়ে মুছেটুছে কুপিবাতির কেরোসিন লাগায়। ঘায়ে কেরোসিন লাগতেই মরিচের মতো জ্বালা শুরু হয়। সেই যন্ত্রণায় এইসব নাবালেগদের কারো কারো চোখ থেকে দরদর করে পানি ঝরতে থাকে।
খেলা মাথা ঝাড়া দিয়ে মন থেকে ধানের খড়কুটার মতো এইসব আবোল-তাবোল ঝেড়ে ফেলতে চায়। টিনের চালে বৃষ্টির একটানা ঝমঝম শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। খেলা সেদিকে মন দেয়। ঘরের জিনিসগুলার দিকে খামাখাই তাকিয়ে তাকিয়ে কীসব ভাবতে থাকে। মাটির দেওয়ালের মাঝারি ঘরটা নানান জিনিসে ঠাসা। উত্তরের কোনার দিকে তিরিশ বস্তা ধান। তার মা আধাশুকনা করে রেখে দিয়েছে। মেঘবাদলা উঠলে আরো দুই রোদ দিয়ে গোলায় তুলবে। এর মাঝেই খেলা তিনবস্তা সরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু দামেও ঠকেছে। লোকে বলে, — ‘চুরির মালের তিনাবস্থা।’
বাইরে বাতাসের বেগ কমে এসেছে। কিন্তু বৃষ্টি নামছে আরো তেড়েফুঁড়ে। আজ চারদিন খেলা ঘরে বসে। তার কী ঘরে মন টিকে? সে উঠে দাঁড়ায়। মাগীকুদ্দুকে বলে, — অহন দড়ি-পাকানি রাখ। দ্যাখ কিমুন বিষ্টি অইতাছে। পলো লইয়া দীঘিত্ নামলে খুব মাছ পড়ব।
রাখাল ছেলেগুলা বেজার মনে খেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিচ্ছাটা মাগীকুদ্দু খুব জমিয়েছিল। এখন ‘আলমাছকুমারকে’ ঘোড়াসমেত বনের মধ্যে রেখেই দিঘির ঠাণ্ডা পানিতে নামতে হবে! মাগীকুদ্দু রাখালদের মনের কথা বোঝে। তাই দড়ি-পাট ঠিকঠাক করতে করতে বলে, — কত কিচ্ছা হুনবে? কইয়্যামনে, আস্তা দিনডাইত পইড়া রইছে। অহন ধর্মজালের কাঠিগুলান মাচাঙ থাইক্যা নামা। লগে পলোডাও নাইমাইছ।
খেলা নেংটি কষে মাথায় তালপাতার মাথলা চাপিয়ে বাইরে পা ফেলে। আকাশভরা জমাট-কালো মেঘ, শাঁ শাঁ বৃষ্টি-বাতাস। তার মনে পড়ে কমলার বনবাসের কথা। এইরকম দিনে কমলাসুন্দরী একা ঘুরতে ঘুরতে মাঠের মধ্যে একটা গোয়ালঘরে আশ্রয় নিয়েছিল। খেলা মনে মনে ভাবে, আরেকদিন মাগীকুদ্দুকে দিয়ে ‘কমলাসুন্দরী’-র সেই কিচ্ছাটা গাওয়াতে হবে। ওই-যে কমলা কেন্দে কেন্দে বলে :
কানা মেঘ রে তুইন আমার ভাই,
একফোঁটা পানি দে সাইলের ভাত খাই।
সবার উঠানে উঠানে পচপচা কাদা। সাবধানে পা ফেলতে হয়। ভারী বৃষ্টির তোড়ে অংলা-জংলা থেকে ভকভক করে বাজে গন্ধ উঠছে। খেলা বাড়ির অন্য শরিকদেরকে ডেকে ডেকে বলে, — আইয়ো রে … পলো দ্যায়া দীঘিত মাছ ধরাম।
খেলার ডাকে বাড়ির অন্যসব তরুণরা হাঁকডাক পাড়তে পাড়তে পলো নিয়ে বেরিয়ে আসে। তবু খেলার মন থেকে কমলার কথা সরে না। বুকের ভিতর কেমন যেন ওমানো ওমানো কষ্ট। মাগীকুদ্দুর মুখে এইসব কিচ্ছা শুনতে শুনতে গ্রামের আর-দশজন তরুণের মতো তারও মনে কমলা, আলোমতি কিংবা কাজলরেখাদের আলাদা আলাদা চেহারা-গড়ন মনের গোপনে গড়ে উঠেছে। রাজার পুত্র, কুড়াশিকারি প্রদীপকুমার, হাওরের মৈষাল বন্ধু সবাই নিজ নিজ চেহারা-গতর নিয়ে যেন খেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই বেদনাবিধুর কমলার সুন্দর মুখটা আজ কিছুতেই খেলা ভুলতে পারে না। সে আবার কিচ্ছার কথা টেনে টেনে গায় :
কৈয়াম কৈয়াম প্রাণের কথা সভাজনের কাছে
অভাগী কমলার ভাগ্যে এত দুঃখ আছে।’
খেলার মা তালপাতার মাথলা মাথায় দিয়ে পাকঘর থেকে উত্তরের ঘরের বারান্দায় গিয়ে ওঠে। খেলার বাপ বারান্দায় বসে ঘণ্টাখানেক ধরে হুক্কা টানছে। বুড়ার ওঠার কোনো নামগন্ধ নাই। খেলার মা আঁচলে হাত-মুখ মুছে, তামার বাটায় পান সাজিয়ে বুড়ার পাশে গিয়ে পিঁড়ি পেতে বসে :
হ্যা অত তামুক খাইতাছে ক্যা?
খেলার মায়ের এই কথা বুড়া একটুও পাত্তা দেয় না। হুক্কার আওয়াজ সমান তালেই উঠছে। তাই খেলার মা ইশারা-ইঙ্গিত রেখে আসল আলাপে চলে যায়, — আমার পুত কি সারাজীবন ঘাডু লইয়া ঘুমাইব?
এই কথায় কাজ হয়। বুড়ার চোখ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সে হুক্কা রেখে পানের বাটার দিকে হাত বাড়ায়, — আমারে তর পুতে কৈছে?
বুড়ার খেউ খেউ আলাপে মা চমকে ওঠে। তার নড়বড়ে শরীর কাঁপে। প্রায় সারাটা জীবন খরচ করে সে একটা কথা শিখেছে, পুরুষ মানুষের সাথে ঘর-করা আর বাঘের সাথে বসত করা সমান কথা। কখন যে লাফ দিয়ে ঘাড় ধরবে তার কোনো ঠিক-বেঠিক নাই। মুখে পানটা জুত হয়ে আসতেই বুড়া ফের নতুন করে তামাক সাজে। মা পিটপিট করে বুড়ার সবটা খেয়াল করে। লোকটা তাকে সারাজীবন ভুগিয়েছে। এখন চুল-দাড়ির বারোআনাই সাদা। গোড়ার দিকের একটা দাঁতও পড়ে গেছে। কিন্তু এখনও গজারির থামের মতো টাইট শরীর। তালকাঠের কড়িবর্গার মতো হাত-পায়ে মোটা মোটা হাড়। কব্জির রগগুলা তেজি সাপের মতো সবসময় টানটান হয়ে থাকে। মাটিতে থপথপ পা ফেলে বুড়া এখনো শাঁ শাঁ করে হাঁটে। একটুতেই খেউ খেউ করে ওঠে। কিন্তু চড়চাপড় নিয়ে তেড়ে আসার স্বভাবটা অনেক কমে গেছে। তাবাদে একটা গুণও আছে, — যতই রাগ করুক, একটু পরেই শাইল ধানের ভাতের মতো নরম হয়ে আসবে। মনটা ভালো থাকলে খেলার মাকে বলবে, জানেইত্ত আজেবাজে কতা আমার সয় না। হ্যা এইসব আজাইড়্যা প্যাচাল পাড়ে ক্যা?
কিন্তু কোনটা যে আজেবাজে কথা আর কোনটা যে কামের কথা, সেটা তাদের দুজনের বিচারে চিরকালই দু-রকম দেখা গেছে। তাই খেলার মাকে সাহস করতেই হয়। সে তার কুঁচকানো চামড়ার খসখসা হাত দুইটা ময়লা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে ফের বলে, — তাইলে হ্যা আমার পুতেরে বিয়া করাইত না?
এবার আর বুড়া খেউ খেউ করে ওঠে না। নতুন করে সাজানো ছিলিমটায় লাল টকটকে জ্বলন্ত টিক্কাটা রেখে, বুড়োআঙুলে একটা ছোট চাপ দিয়ে, কল্কিটা হুঁকার নৈচায় (কাঠ দিয়ে বানানো হুঁকার নল) বসায়। তাবাদে কুরুৎ কুরুৎ করে টানতে শুরু করে। টানের সাথে হুঁক্কা থেকে তেঁতো পানি মুখে চলে আসে। বুড়া পুচ করে মুখের পানি ফেলে আচমকা খেলার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, — এক জিনিস ব্যাডা মানুষের বেশিদিন ভাল্লাগে না। দেখবে তর পুত একদিন এম্নি এম্নি ঘাডু ছাইড়া দিছে।
বুড়ার এই আলাপে খেলার মায়ের মরচে-পড়া চোখদুইটা ঝলক মারে। পিঁড়িটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। সংসারের কামে আর বয়সের চাপে কোমরটায় বাঁক ধরেছে, তাই দেহটা ঠিক সোজা না হয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে থাকে। এই অবস্থাতেই খেলার মা বুড়ার দিকে কড়া নজরে তাকায়। তার মনের ঝাঁঝ ছানিপড়া চোখদুইটা দিয়ে লকলক করে বেরিয়ে আসতে চাইলে সে খনখনা গলায় বলে, — অহনও ত হ্যা খিতিশ পালের বাড়ি ছাড়ছে না, তে তার পুত ঘাডু ছাড়ব এই কতা ক্যাডা বিশ্বাস করে?
খিতিশ পাল খেলার বাপের শিশুকালের দোস্ত। সারাজীবন একসাথে চলন-বলন, একসাথে মাখামাখি। সে খিতিশের বাড়ি যাবে না তো হাছুকলুর বাড়ি যাবে? তাবাদে খিতিশের বউ তাকে বড়দা বলে ডাকে। ছিঃ ছিঃ মানুষের কী রুচি! সাধে কী আর মানুষ কয় :
‘ক্যার লগে কি,
পান্তা ভাতে ঘি।’
রাগে কাঁপতে কাঁপতে বুড়া হাতের হুক্কাটা ঠাস করে রেখে, খেলার মায়ের মাথার দিকে মস্ত এক থাবা তুলে লাফ দেয়। বুড়ি দিশাবিশা না পেয়ে চট করে বসে পড়ে। এই জীবনে বুড়ির যা কল্পনাতেও আসেনি আজ সে তাই করে বসে : নাগালে আসতেই দুই হাতে খাবলা দিয়ে সে বুড়ার অণ্ডকোষ দুইটা চেপে ধরে, — সারাডা জীবন আমারে জ্বালাইছে, আউজক্যা এক্কেরে চ্যাটকাইয়া দ্যায়াম। দ্যাহি ক্যামনে হ্যা খিতিশের বৌয়ের কাছে যায়?
বুড়া ঘোঁ…ঘোঁ করে ঠাঠাপড়া মানুষের মতো চোখ-মুখ উল্টে কাতরে ওঠে, — ছাইড়া দ্যা, ছাইড়া দ্যা কইলাম, মইরা যাইয়াম ত…।
অঝোর ধরায় বৃষ্টি পড়ছে। একটুও বাতাস নাই, বিজলি নাই। শুধু অবিরল জলধারা আর বেফানা ব্যাঙগুলার গ্যাঁকোগ্যাঁকো। পুকুরের দিক থেকে ভেসে আসছে খেলাদের হুল্লোড়। মা পুবের জানালার সামনে বসে বেজার মনে এইসব দেখে। দেখতে দেখতে মায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কুঁচকানো চামড়ার ছোট ছোট হাতদুইটা অসহায়ভাবে কোলের ওপর পড়ে থাকে। পুকুরপারের তালগাছটার দিকে সে একমনে চেয়ে আছে। দুঃখী-এতিমের মতো গাছটা এখন একলা একলা বৃষ্টিতে ভিজছে!
বাড়ির সব কামলারা পলো নিয়ে বিরাট বড় পুকুরটায় নেমেছে। বৃষ্টি আর পলোর ছপাৎ ছপাৎ চাপে বড় বড় রুই-কাতল শূন্যে লাফিয়ে উঠছে। মাছের চকচকে শরীর বৃষ্টির ভেতর ঝিলিক দিতেই সবাই একসাথে জোহার দিয়ে ওঠে, — হৈই…অ…!
পুকুরের দক্ষিণ দিক থেকে সার বেঁধে খেলারা উত্তরপারের দিকে পলো বাইছে। মাগীকুদ্দু পুকুরের উত্তরপারে ধর্মজাল ফেলে পানির দিকে নিবিষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে। তার জালের পানিতে পাক উঠতেই দড়িতে খেঁচে টান দেয়। জালের আওয়াজ পেয়ে বিরাট একটা বাউশ শূন্যে লাফিয়ে ওঠে। খেলারা আবার জোর গলায় জোহার তুলে, — হৈই…অ…!
মাছটা শূন্যে ডিগবাজি খেতে খেতে ফের মাগীকুদ্দুর বিরাট জালে আছড়ে পড়ে। মাগীকুদ্দু ততক্ষণে জাল পারে তুলে ফেলেছে। খেলার মা জানালা দিয়ে দেখে, এই বড় বাউশ মাছটার রাজকীয় শরীর একফোঁটা বাতাসের অভাবে বারবার শূন্যে লাফিয়ে উঠছে!
চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ : আগের পর্ব
শেখ লুৎফর রচনারাশি
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ ৯ || শেখ লুৎফর - July 8, 2022
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৮ || শেখ লুৎফর - November 20, 2021
- চন্দ্রাবতীর পুত্রগণ :: পর্ব ৭ || শেখ লুৎফর - October 30, 2021
COMMENTS