সিনেভাষার সাতকাহন ১ || আহমদ মিনহাজ

সিনেভাষার সাতকাহন ১ || আহমদ মিনহাজ


‘আসা যাওয়ার মাঝে’ : সংলাপহীন ভালোবাসার গল্প


মনে-মনে ভাবি কথার মালায় গাঁথা সংলাপ দিয়ে সবটা কি বোঝানো যেত, গল্পখানা কি বলে ফেলা সম্ভব ছিল, যেমনটি আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত আসা যাওয়ার মাঝে  নামের মুভিখানায় একুনে প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে বলে গেলেন! প্রারম্ভিকায় একমিনিটের খবরপাঠ, শাহরিক জীবনে গুঞ্জরিত কোলাহল, মাঝেসাঝে পথ ভুলে চলে আসা দু-চারখানা বাক্য, আঙুরবালা ও গীতা দত্তের রেকর্ডে গীত গানের কলি আর আবহসংগীতের দায় পূরণে বিসমিল্লাহ খানের সানাই-ঝঙ্কার … শাব্দিক এই অভিজ্ঞতা বাদ দিলে ছবিতে বোনা কাহিনির পুরোটাই নির্বাক! সংলাপমুখর দৃশ্যায়নের অভ্যাস থেকে হঠাৎ নির্বাকে ফেরত যাওয়ার ঘটনা যুগের মতিগতি ও দর্শকের ছবি দেখার অভ্যাসের কথা চিন্তা করলে খানিক অভিনব মানতে হয়। নীরবতার ভিতর দিয়ে সংলাপে গমনের প্রয়াস অগত্যা তার এই নতুনত্বের গুণে আলোচনার যোগ্য হয়ে ওঠে।

সবাক চলচ্চিত্র অর্থাৎ সিনেপর্দায় কথার রাজত্ব শুরু হওয়ার দিন থেকে সংলাপনির্ভর অভিনয়ের যে-ধারা জন্ম নিয়েছিল তার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ইতিহাস প্রায় শতবর্ষী হতে চলেছে। সাইলেন্ট থেকে টকিজ-এ সিনেমাশিল্পের পালাবদলের কথা ভাবলে সংলাপবর্জিত অভিনয়ের যুগে ফেরত যাওয়া চ্যালেঞ্জিং ছিল। মৌনতায় ভাস্বর দৃশ্যচিত্র সেখানে ভাষার একমাত্র জোগানদার। দর্শকের কাছে ভাষাটিকে তুলে ধরার সঙ্গে তাকে শেষ অবধি টেনে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। নাটকে বা সিনেমায় সংলাপে ভর দিয়ে কাহিনিছকে গাঁথা চরিত্রের দাবিদাওয়া পূরণ সুকঠিন হলেও অভিনয়শিল্পীর জীবনে ওটা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে উল্টোরথের সওয়ারি বিক্রম যে-কাহিনি পর্দায় বুনতে চেয়েছেন সেখানে ক্যামেরার সামনে বোবা থেকে পরিচালকের আবদার মিটানোয় ঝক্কি ছিল। স্বস্তির দিক হচ্ছে প্রোটাগনিস্ট  ঋত্বিক চক্রবর্তী ও বাসবদত্তা চ্যাটার্জির সঞ্চালনা সেক্ষেত্রে দৃষ্টিকটু ও বেমানান ঠেকেনি। সংলাপহীন দৃশ্যপ্রবাহে দর্শকের আগ্রহ ধরে রাখতে অভিনয়শিল্পীর কাছে পরিচালক সচরাচর যেমনটি আশা করেন সেটি মিটানোর কাজে দুজনে ভালোই উতরে গেলেন মনে হচ্ছে।

সংলাপবর্জিত দৃশ্যায়নে ভর করে সময়-সময় জীবনের আধুরি কাহানি  বলে ফেলা যায়; — দামি এই উপলব্ধি লম্বা সময় ধরে সবাক চলচ্চিত্রে অভ্যস্ত দর্শককে পরিচালক বিক্রম বোধহয় আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন! জীবনের আসা যাওয়ার মাঝে  কত শত কাহিনি জন্ম নিচ্ছে প্রতিদিন! বৈচিত্র্যে বিপুলা সেইসব কাহিনি থেকে একফালি উঠিয়ে আনতে শব্দের পরিবর্তে দৃশ্যকে পরিচালক ক্যামেরায় আরাধ্য করে নিয়েছিলেন। প্রয়াসটি অভিনব হওয়ার দোষে আপনা থেকে মনে কৌতূহল জাগায়। সিনেমা ব্যয়বহুল শিল্প। একটি ছবি বাজারে ছাড়ার প্রক্রিয়া সেখানে লগ্নি ও মুনাফার ছকে বাঁধা থাকে। পণ্যায়নের যুগবিশ্বে খরচের বিরাট ধাক্কা সামলে বেচারা পরিচালকের পক্ষে শিল্পভাবনায় কতটা সুস্থির থাকা সম্ভব সেই তর্ক সিনেমাধ্যমের গোড়া থেকে চলে আসছে। বিক্রমের ছবি দেখার ক্ষণে প্রশ্নটি ফিরে-ফিরে মনে উঁকি দিয়েছিল বটে।

শিল্পের দেনা মিটিয়ে সিনেমা দিয়ে ব্যবসা করার প্রসঙ্গ যেহেতু উঠেছে মৃণাল সেনের ভাবনাটি এইবেলা স্মরণ করা আশা করি বেমানান হবে না। পরিচালকের ক্যামেরায় বোনা ছবিকে মৃণাল বাণিজ্যিক ভাবতে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তাঁর মতে এর বাইরে সিনেমার কোনো সংজ্ঞা, গোত্র ও অভিধা হয় না। টাকা যিনি খাটাচ্ছেন তাকে মূলধন ফেরত দেওয়ার সঙ্গে লাভের উপায় করে দিতে হবে; — ব্যয়বহুল শিল্পমাধ্যমের এটা হলো শেষ কথা। সিরিয়াস ফিল্মের খেতাব ঘাড়ে করে দেশবিদেশ করলেও নিজের শিল্পভাবনায় মেইনস্ট্রিম, আর্টহাউজ, প্যারালাল, অফবিট, ইনডিপেন্ডেন্ট  ইত্যাদি ঢেরা কেটে সিনেমার জাতকুল বিচারে তাঁর মনের বিশেষ সায় ছিল না। সিনেমা হয় ‘ভালো’ কিছু হয়ে উঠবে নয়তো ‘খারাপ’ হবে, এই বিশ্বাস বুকে ধরে তিনি ছবি বানাতেন। শিল্পগুণে নতুন, অভিনব ও সময়-প্রাসঙ্গিক সিনেমাকে ‘ভালো’ বলে স্বীকার যাওয়া আর বস্তাপচা প্লট ও জোর করে বিনোদনের চেষ্টায় ফতুর ছবিকে ‘খারাপ’ বলা ছাড়া বিকল্প পন্থায় সিনেমার ভালোমন্দ বিচারে মৃণালের মতি ছিল না। ব্যক্তিরুচির সঙ্গে সমাজ-সচেতনা ও দায়বোধ মিটানোয় অগ্রণী ছবির কামিয়াবি যাচাইয়ের প্রেরণা তাঁকে জীবনভোর তাড়া করে ফিরেছে। লগ্নি তুলে আনার ব্যাপারে সিনেনির্মাতার রুচি ও দায়বোধ জটিল যেসব চক্করে বিপথগামী হয় সেগুলো নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন থাকলেও এ-কথা সত্য নিজের বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে মৃণাল সেন ছবি বানিয়ে গিয়েছেন।

এখানে তাঁর ভাবনা ও বিচারপদ্ধতি নিয়ে তর্ক বা আপত্তির জায়গা হয়তো থাকে, কিন্তু পুঁজি বিনিয়োগের জটিল হিসাব-কিতাবে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যুদ্ধে রুচি বিসর্জন না দিয়েও সিনেমা বানানো সম্ভব সে-প্রমাণ মৃণালের ছবিতে দুর্লভ নয়। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-তপন সিংহ ও তাঁদের প্রেরণায় পরে যাঁরা উপমহাদেশে ছবি বানিয়েছেন তার সবকটা শিল্পসফল ও কালোত্তীর্ণ হয়েছে এমন নয়। বাণিজ্যসফল বলারও উপায় নেই। শিল্পমানের দিক থেকে নানা ফাঁকফোকর সেখানে রয়েছে এবং সেটি অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ছবি বানানোর বিচিত্র জটিলতা সত্ত্বেও ছবিগুলোর বড়ো গুণ হচ্ছে নিছক আঁতলামি বা ব্যবসার ধান্ধা থেকে বানানো মাল তারা হতে চায়নি। রুচি, সচেতনা ও দায়বোধের রসায়ন থেকে ক্যামেরায় ছবিগুলোর জন্ম হয়েছিল। কাহিনি বয়নের ধারায় উৎকট বিচ্ছেদ তাই খুব একটা চোখে পড়ে না। ক্যামেরা বাবাজি নিছক ধারণযন্ত্রে স্থির না থেকে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেন সেখানে। কাহিনির লেজ ধরে পরিচালকের মনোসংকেত অনুমান করে নিতেও দর্শককে গাড্ডায় পড়তে হয় না। অভিনয়শিল্পীর কুশলতাও মনে বেশ ছাপ রেখে যায়। সর্বোপরি, এই দায়বোধ সেখানে কমবেশি ঠিকরে পড়ে যার কল্যাণে ছবিগুলোকে দেশকালে সচল মানব-সংসারের প্রতিবিম্ব ভাবতে দর্শকমন দ্বিধায় ভোগেনি।

‘ভালো’ ছবি বলে নাম কিনতে এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন রয়েছে কি? উপমহাদেশের ভাষাবৈচিত্র্যের ভাণ্ডারে এ-রকম অসংখ্য ‘ভালো’ ছবি যোগ করার সংকল্পে উদ্দীপ্ত নির্মাতারা গেল শতকের পাঁচের দশক থেকে আজোবধি খেটে মরলেন তাঁরা সংখ্যায় প্লাবন হয়ে উঠতে পারেননি আর আফসোসটা সেখানেই! ‘ভালো’ ছবির সংখ্যা অবশ্য কোনো দেশেই ব্যাপক ছিল না। ইরানকে হয়তো খানিক ব্যতিহার ভাবা যায়। ‘ভালো’ ছবির সংখ্যা গুনতে বসলে দেশটির নাম সকলের ওপরে থাকা উচিত। একটা-দুটো শিল্পসফল (*এবং বাণিজ্যবিফল) কালজয়ী ছবির জন্ম দিয়ে ফতুর হওয়ার চেয়ে শত-শত ‘ভালো’ ছবির জন্ম হচ্ছে সেই বিরল ঘটনা যেটি সমাজের রুচি ও গ্রহণক্ষমতাকে নতুনভাবে নবায়িত করে যায়। ইরানের সিনেমায় ঘটনাটি একসময় বেশ দুর্বার হয়ে উঠেছিল।

ফর্মুলা ছবি উৎপাদনের কারখানা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদে তথাকথিত মুক্ত চলচ্চিত্র বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার ভাবনা পৃথিবীর সকল দেশে এখন কমবেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতবর্ষ তার বাইরে নয়। নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন, ডিজনি ইত্যাদির হাত ধরে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের আবির্ভাব ছবি তৈরি ও বিপণনের নতুন ক্ষেত্র বা সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছে। সেইসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, নিজের স্বাধীন ভাবনা ও শিল্পবোধে দাঁড়িয়ে ছবি করতে আগ্রহী পরিচালকের পৃষ্ঠপোষকতা নেটফ্লিক্স জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে হওয়ার নয়। ইচ্ছে থাকলেও তার পক্ষে সেই চরিত্র ধারণ দুরূহ যাকে সাহারা ভেবে শিল্পী নিজের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতাকে সিনেপর্দায় ভাষা দিতে উতলা হয়। অনলাইনে ছবি চালিয়ে ব্যবসা জমানোর ক্ষেত্রে নেটফ্লিক্সের মতো প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পুঁজিবাদী চরিত্র রয়েছে। সিনেমা বানানো ও বিপণনের প্রচলিত ধারার সঙ্গে সেখানে তাকে সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটতে হয়। সুতরাং নেটফ্লিক্স ওই সমস্ত ছবি ও পরিচালকের প্ল্যাটফর্ম হতে চাইবে যারা দর্শকরুচির ব্যারোমিটার বুঝে ছবি বানাতে পারঙ্গম।

শিল্পমানের পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রশ্নে ওটিটির আবেদন এখানে সিনেমা রিলিজের প্রচলিত মাধ্যমগুলো থেকে বিশেষ ভিন্ন নয়। উদাহরণ সহকারে বিষয়টি খোলাসা করা যেতে পারে। লক্ষ করলে দেখা যায় বিচিত্র সব সিনেমার মাঝে দর্শক অনেকদিন ধরে থ্রিলার ধাঁচের ছবি বেশি পছন্দ করছেন। খ্রিলারের আদিবীজ আলফ্রেড হিচককের থ্রিল ও সাসপেন্সভরা দৃশ্যায়নের জগতে জন্ম নিলেও সে কিন্তু এখন আর হিচককের যুগে পড়ে নেই। সময়ের সঙ্গে থ্রিল-সাসপেন্সের দৃশ্যায়নে পালাবদল ঘটেছে। সিনেপর্দায় সাইকো, ভার্টিগো  বা দ্য বার্ডসকে অবমুক্ত করতে যেয়ে দর্শকরুচির সঙ্গে আপসের ভাবনায় হিচকককে তখন বিব্রত হতে হয়নি। নতুন রুচির সিনেমায় তাদের অভ্যস্ত করানোর বিষয়টি বরং তাঁকে উতলা করেছিল। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। নেটফ্লিক্স বা আমাজন থ্রিলার ঘরানার সেই ছবির পেছনে টাকা ঢালে যেটি দর্শকের বিনোদিত হওয়ার পিয়াসকে জখম না-করেই বানানো সম্ভব। এই জায়গা থেকে ভাবলে প্রতিদ্বন্দ্বী হলিউড বা বলিউডের কারখানায় উৎপাদিত ছবি তৈরির সূত্র ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে তার বিশেষ ফারাক নেই।

ফর্মুলা ছবির বাজার সেকালে যেমন রমরমা ছিল একালেও মোটের ওপর তাই রয়েছে। হল-সিনেপ্লেক্সকে হটিয়ে ওটিটির রমরমা আবির্ভাবের পর থেকে ছবির কাহিনি-দৃশ্যায়ন-অভিনয়ে নতুন গতি ও চটক যোগ হলেও সূত্র কিন্তু বিশেষ পাল্টায়নি। এর মানে অবশ্য এই নয় ফর্মূলা ছবি থেকে ‘ভালো’ কিছু কখনো বেরিয়ে আসেনি বা আসবে না। ছবি বানানোর প্রচলিত পদ্ধতিতে বিচিত্র সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও থ্রিলার আঙ্গিকে একাধিক ‘ভালো’ ছবি অতীতে জন্ম নিয়েছিল অথবা এখনো জোকার-এর মতো ছবি সেখান থেকে দুম করে বেরিয়ে আসে। মার্কিনি সমাজের গভীর ক্ষতে হাত দেওয়ার ছলে আত্মমেহনের ফাঁদবন্দি মানববিশ্বকে সে তুলে ধরে এবং সেখানে রূপান্তর এনে দিতে সহিংসতা ও নৈরাজ্যের প্রাসঙ্গিকতাকে আবারো মনে করিয়ে যায়। বাণিজ্যসফল ছবির সূত্রগুলোকে তা-বলে পরিচালক টড ফিলিপস অবহেলা করেননি। তাঁর কৃতিত্ব এখানে যে সূত্রগুলোর সঙ্গে নিজের শিল্পভাবনার স্বকীয়তাকে তিনি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন। হলিউড ঘরানার ছবিতে সচরাচর যেমন থাকে তার উপস্থিতি জোকার-এ প্রকট হলেও দর্শকের মনে যে-বার্তা পরিচালক গেঁথে দিতে উন্মুখ ছিলেন সেখানে ছন্দপতন ঘটেনি। ছবি নির্মাণের প্রচল ধারা বিবেচনায় ঘটনাটি তাৎপর্য বহন করে।

মঙ্গা  অর্থাৎ কমিকস থেকে সৃষ্ট অ্যানিমেশন মুভির হাত ধরে সহিংসতার শিল্পরূপ জাপানের চলচ্চিত্রে নবতরঙ্গের জন্ম দিয়েছিল। হায়াও মিয়াজাকি, সেইজুন সুজুকি, তাকাশি মিকি, সিওন সোনো, তাকাশি কিতানো ধাঁচের পরিচালকের হাত ধরে সে-তরঙ্গের প্রভাব হলিউডে আছড়ে পড়তে সময় লাগেনি। কমিকস থেকে অনুপ্রাণিত জোকার-এর অনুবীজ হয়তো সেখান থেকে নিজের প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছিল। কাহিনির গতানুগতিকতা যে-কারণে ছবির মূল বার্তাকে নিঃস্ব করতে পারেনি। সংলাপ রচনায় মুন্সিয়ানা, সহিংসতা ও নৈরাজ্যের দৃশ্যায়নে কামিয়াবি, আর হোয়াকিন ফিনিক্সের দানবীয় অভিনয়শক্তির মিলন ঘটায় সহিংসতার মনোদার্শনিক অভিঘাতকে পুনর্জীবিত ও নবায়ন করতে ছবির পরিচালককে বেগ পেতে হয়নি। মার্কিন সমাজের জন্য অস্বস্তিকর বার্তা বহন করায় ছবির প্রচার ও বিপণন প্রথম দিকে বাধার সম্মুখীন হলে ওটিটি ভরসাস্থলে পরিণত হয়। ছবির শিল্প ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে পড়তে পারায় টড ফিলিপসের ছবিখানাকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে নেটফ্লিক্স  দু-বার ভাবেনি। মুক্ত সিনেমার জন্য ঘটনাটি উপকারী হলেও সামগ্রিক বিচারে একে ব্যতিক্রম ভাবাই সংগত। ‘ভালো’ ছবির প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার যেসব দর্শন বিশ্বের সিনেমাকারগণ যুগ-যুগ ধরে লালন করেছেন নেটফ্লিক্স  বা অ্যামাজনকে দিয়ে সেটি বাস্তবায়িত হওয়ার নয়। সিনেমাশিল্পের ভাষাকে যেসব পরিচালক প্রতি দশক অন্তে স্বকীয়তা দান করেছেন (*বা করছেন) তাঁদের সিনেভাষার ধারণ ও প্রচারে নেটফ্লিক্স নির্ভরযোগ্য কোনো মাধ্যম নয়। বাণিজ্যসফলতার বিচারে এই প্ল্যাটফর্মে তাঁরা হয় অনুপস্থিত থাকতে বাধ্য হন নতুবা সে তাঁদেরকে তুলে ধরতে ইচ্ছুক নয়।

অন্যদিকে বিকল্প হিসেবে ছোট আয়তনের ওটিটি প্লাটফর্মে ছবি চালিয়ে লগ্নি উঠানো পরিচালকের পক্ষে দুরূহ। স্বল্প বাজেটে শিল্প ও বাণিজ্যসফল ছবি তৈরির ধারায় ইরানি ছবির গুরুত্ব এখানে এসে ভাবনার খোরাক হয়। বিশ্ব জুড়ে একটি দর্শকশ্রেণি সে গড়ে নিতে পেরেছিল যাকে ভরসা করে ‘ভালো’ ছবি বানানোর লড়াইয়ে টিকে থাকা সম্ভব। বিধিনিষেধের কঠিন কালাকানুন পায়ে দলে ইরানের সিনেনির্মাতারা স্বদেশ ও বিদেশে সেই পরিবেশের জন্ম দিয়েছিলেন যেখানে শিল্প ও বাণিজ্যের দেবী পাশাপাশি হাঁটার শক্তি রাখে। ডেনমার্কে ডগমা-95  কিংবা ভারতবর্ষে প্যারালাল সিনেমা  আন্দোলনের যুগে স্বল্প বাজেটে ভালো ছবি বানানোর ভাবনাকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে এইসব ভাবনায় ভাটা পড়লেও ছবি বানানোর প্রচলিত ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার পরিসরটি মনে হচ্ছে এখনো সংকীর্ণ। সিনেবাজারে সেই সমবায়ী ব্যবস্থার জন্ম হয়নি যেখানে সারা বিশ্বের সৃষ্টিশীল পরিচালকদের শিল্পভাবনাকে ধারণ করার ক্ষমতায় অনন্য নেটফ্লিক্স জন্ম নিতে পারে। সেরকম বিপুল দর্শক আজো তৈরি হয়নি যার ওপর ভরসা করে নিজের অস্তিত্ব সে টিকিয়ে রাখতে পারবে। সিনেমা কীভাবে সমবায়ী ঘটনায় পরিণত হয়, সকল সুর একত্রে জুড়তে না পারলে পরিচালকের ভাবনা ও পেশাদারিত্ব কেন হরিষে বিষাদে মোড় নেয় সেই গল্প ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফো তাঁর লা ন্যুই আমেরিকানায় (আমেরিকার রজনী) বলার চেষ্টা করেছিলেন। বাণিজ্যসফল ‘ভালো’ ছবি বলতে সিনেমার এই সমবায়ী শক্তিকে মৃণাল বুঝে নিয়েছিলেন মনে হয়। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রশিল্পে যেটি আজো কোমর সোজা করে দাঁড়াতেই পারেনি!

মৃণাল সেন ও সহযোদ্ধারা নিজ শর্তের মাপে বাণিজ্যসফল ছবিই বানাতে চেয়েছেন। তাঁদের বানানো ছবির সঙ্গে হলিউড-নলিউড কিংবা বলি-টলি-ঢালির কারখানায় ফি-বছর জন্ম নেওয়া হিট নয়তো ফ্লপ ছবির ফারাক মূলত রুচি ও জীবনবোধের কারণে অমোঘ হয়েছিল। আমজনতার রুচি ও পছন্দের দোহাই দিয়ে নিজের শিল্পভাবনার গঙ্গাযাত্রাকে মেনে নিতে তাঁদের বুকে লেগেছে। লগ্নি উঠিয়ে আনার তাগিদে অগত্যা দেশের বদলে বিদেশে ছবি রিলিজ বা সেখানে দিনের-পর-দিন আটক থাকতে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন। সত্যজিতের পথের পাঁচালী  কলকাতার চেয়ে মার্কিন দেশের হলগুলোয় বেশি কেটেছিল। কাহিনি এবং সংগীত-আয়োজনে পরিপূর্ণ ভারতীয় ছবি হলেও জলসাঘর  পারিবাসীর হৃদয়কে অধিক অভিভূত করেছিল বলে শোনা যায়। বাংলাদেশে সূর্য দীঘল বাড়ি  যেমন আনোয়ার হোসেনের চমৎকার ক্যামেরা সঞ্চালন সত্ত্বেও দেশের হলে কাটেনি। অন্যদিকে মেঘে ঢাকা তারা  বাদ দিলে ছন্নছাড়া ঋত্বিকের কোনো ছবিই বাঙালি ও ভারতীয় দর্শকের মনে সংবেদনের ঢেউ বহাতে পারেনি। উত্তম-সুচিত্রায় মজে থাকা বাঙালি অযান্ত্রিক, কোমলগান্ধার, সুবর্ণরেখা, নাগরিক  কিংবা শিশুতোষ বাড়ি থেকে পালিয়ের জগতে গুঞ্জরিত আদ্যপ্রতিমা বা মাদার আর্কিটাইপে  অভিভূত এক শিল্পীর সর্বস্ব হারানোর আত্মবীক্ষণে শামিল হওয়ার দায় বোধ করেনি।

রাজনৈতিক ভাবনার গলদ থেকে সৃষ্ট যত মনোবিরোধ ও টানাপোড়েন দেশভাগকে উপমহাদেশে বাস্তব ঘটনায় পরিণত করেছিল তাকে পাশ কাটিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে শরিক হতে উদগ্রীব বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শক ঋত্বিকের ছবি থেকে একপ্রকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। বাষট্টি সালে বানানো সুবর্ণরেখা  হুজুগে মত্ত বাঙালিকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল একটি জাতির ক্রমশ নিঃস্ব হওয়ার নেপথ্যে সক্রিয় বজ্র ও অশনির ভয়াল চেহারা তারা হয় স্বচক্ষে দেখে নাই নতুবা একে ভুলে থাকার ভান করছে। তাদের দেখে মনে হয় তারা ‘যুদ্ধ দেখে নাই। মন্বন্তর দেখে নাই। দাঙ্গা দেখে নাই। দেশভাগ দেখে নাই।’ এ-কথা মিথ্যে নয়, সুবর্ণরেখায় বিচ্ছুরিত ঋত্বিক-বচনের সারবত্তা বাঙালি নাগরিক মধ্যবিত্ত জোর করে হলেও ভুলে থাকতে মরিয়া ছিল। উত্তম-সুচিত্রার জমাট রসায়নে সৃষ্ট রোমান্সে তার মোহ তখন তুঙ্গে উঠেছে। এই তোড়ে ঋত্বিকের ‘ভালো’ ছবি বানানোর জেদ বক্স অফিসে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছিল। সুহাসিনী সুচিত্রা সেন স্বয়ং ঋত্বিকভক্ত ছিলেন। খেয়ালি এই পরিচালককে ভীষণ সম্মান করতেন। যদিও ঋত্বিকের বক্স অফিসে ডুবে মরার নেপথ্যে মহানায়িকা গণ্য কারণে পরিণত হয়েছিলেন। উত্তমের সঙ্গে তাঁর পর্দা-উপস্থিতির সাফল্যে বিবশ বাঙালির কাছে ঋত্বিকের মতো পরিচালকদের আবেদন অগত্যা গুরুত্ব হারিয়েছিল।

ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে আয়োজিত স্মরণসভায় সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্যটি এই প্রসঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন। রায় সেদিন অকপটে স্বীকার গিয়েছিলেন, তাঁদের প্রজন্মের সিনেমাকারদের মধ্যে ঋত্বিক একমাত্র ব্যতিক্রম যাঁর ওপর বম্বে সিনেমার প্রভাব পড়েনি। হিন্দিবলয়ের বাইরে বসে ছবি বানানোর ঝুঁকি ঋত্বিককে আবেগপ্রবণ বাঙাল করে তুলেছিল। তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা ও অবস্থানকেও এটি স্পষ্ট করে। অন্যদিকে এই ঝুঁকি তাঁর ছবিকে যে-চারিত্র্য দিয়েছিল বাঙালি নিজেকে সেখানে একীভূত ভাবতে পারেনি। তাঁর অতীত ও সমকালবীক্ষণ অথবা আদ্যপ্রতিমার সিনেমাটিক উপস্থাপনের ভাবনায় সক্রিয় যে-জগৎ ঝিলিক দিয়ে যায় তাকে ধারণের আবেগ বাঙালি সিনেদর্শকের জীবনে অস্ত যেতে শুরু করেছিল। তারা বরং দৃশ্যায়নের সেই জগৎকে পর্দায় গুঞ্জরিত দেখতে উন্মুখ হয়েছে যেটি বম্বেয় বানানো ছবির মতো রাংতা দিয়ে মোড়ানো, যার সত্যমিথ্যা ও বাস্তবতা নিয়ে তাকে আর না ভাবলেও চলছে। সুখ-দুঃখের গল্পে বোনা এই জগতে প্রবেশের পর তার দেহমনের ক্ষতগুলো বাস্তবিক সেরে না উঠলেও তাৎক্ষণিক স্বপ্নাবেশের তোড়ে সকল ব্যথা ও যন্ত্রণার উপশম ঘটে! মনে হয় ক্ষতগুলো বুঝি আর নেই! স্বপ্নাবেশগ্রস্ত এই অনুভবের জোয়ারে ঋত্বিকের ভাবতে বাধ্য করানোর গল্পে মোড়ানো মেলোড্রামার ভার বহনের শক্তি বাঙালি দর্শককুলে বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না।

বাঙালি সিনেদর্শকের মনোজগতে উত্তম-সুচিত্রা ম্যাজিক কাজ করার পেছনে বম্বের সিনেজগৎ থেকে ভেসে আসা স্বপ্নপ্রতিমার  স্বকীয়করণে (*মতান্তরে বাঙালিকরণও বলা যায়) সেকালের পরিচালকদের সাফল্য চূড়াস্পর্শী ছিল। স্বপ্নাবেশঘন এই জগতে যুদ্ধ থেকেও নেই। দাঙ্গা ঘটেও ঘটে নাই। মন্বন্তর বলে কিছু আর নেই। আত্মপরিচয়ের শতেক সংজ্ঞা বা দ্বন্দ্ব নিয়ে বিষাদ-হাহাকার ও গভীর ভাবনায় বিদীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন আপনা থেকে নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারায়। বাস্তবতার কঙ্কালকে এখানে মনোরম মেদমাংসে ঢেকে ফেলা যায় এবং এর ওপর ভর করে উপমহাদেশে সিনেমাশিল্প শেষতক বেঁচে থাকে। উত্তম-সুচিত্রা ছিলেন বাঙালির স্বপ্নপ্রতিমা, যেখানে ডুব দিয়ে নিজের সকল গ্লানির ভার খালাস করতে সে ব্যাকুল থেকেছে।

ঋত্বিকের ছবি তো সেই রেলগাড়ির গল্প শোনায় যেটি দ্রুত ছুটতে-ছুটতে হঠাৎ থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল! থামা ছাড়া তার উপায় ছিল না, যেহেতু সামনে আগানোর সকল পথ সাতচল্লিশে এসে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়! ধু-ধু শূন্যতায় নিকষ কালো গহ্বর ছাড়া কিছু আর সেখানে পড়ে ছিল না। সত্যটি মেনে নিতে বাঙালির মনে লেগেছে। ঋত্বিক ঘটক থেকে মুখ ফিরিয়ে হারানো সুর-এর গানের কলির মাঝে সকল হারানোর ব্যথা সে ভুলে থাকতে চেয়েছিল! ‘এই পথ যদি না শেষ হয় / তবে কেমন হতো তুমি বলো তো? / যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয় / তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?’ — স্বপ্নিল এই আবেশ ও শিহরণের কাছে ঋত্বিকের পথ শেষ হওয়ার গল্পরা হার মেনে নিতে বাধ্য ছিল।

আশির দশকের মধ্যভাগে সম্ভবত ফিল্মফেয়ার  ম্যাগাজিনের সঙ্গে বাতচিতের ক্ষণে রাজ কাপুর স্বপ্নাবেশে দর্শককে ডুবিয়ে রাখতে পারার কামিয়াবিকে সিনেমা নামে চিহ্নিত করেছিলেন। রাম তেরি গঙ্গা মইলি  তখন সদ্য রিলিজ করতে যাচ্ছে অথবা ততদিনে রিলিজ করেছে। কাপুর সাহেব তাঁর স্বভাবসুলভ যৌনপ্রতিমার ভিয়েন মিশিয়ে বানানো ছবিটি দিয়ে পুনরায় বক্স অফিস বাজিমাত করেছিলেন। সত্তরের গোড়ায় নির্মিত ববি  ছবিতে স্বল্পবসনা তরুণী ডিম্পল কাপাডিয়ার নিষ্পাপ যৌন-আবেদন দর্শকের মনে ঝড় বহিয়েছিল। শ্রেণি-ব্যবধানকে কলা দেখিয়ে ঋষি ও ডিম্পলের রোমাঞ্চঘন অবুঝ ভালোবাসার ফ্যান্টাসি হলে দারুণ কেটেছিল। ‘বাহার সে কোই অন্দর আ না সাকে / অন্দর সে কোই বাহার না জা সাকে / সুচো কাভি অ্যায়সা হো তো ক্যায়া হো / হাম তুম এক কামরেমে বন্ধ হো / আওর চাবি খো যায়।’ — লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে পরিবেশিত গীতকলির মধ্যে নিষিদ্ধ যৌনসুখ উপভোগের ক্ষুধা কাপুর আরেকবার উসকে দিয়েছিলেন।

উপমহাদেশের দর্শকমনে কুমারী যৌনপ্রতীক  সম্ভোগের স্বপ্নাতুর মনোবাসনাকে ববি  ন্যাংটো করে দিয়েছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিল নবোকভের ললিতা্  আর ফ্রয়েডীয় মাতৃগূঢ়ৈষার সঙ্গে ভারতীয় পৌরাণিক আবহে সচল যৌনাবেদনের মিথস্ক্রিয়া ভারতীয় দর্শক পর্দায় দেখতে ভালোবাসে। বাস্তবে একে অবসিন  বলে নাকচ করলেও ভারতীয় পুরাণবিশ্বে কুমারী ও জননী যেসব যৌনাবেদন নিত্য বহন করে সিনেপর্দায় এর বিস্ফার তাকে অধরা সুখ গ্রহণের শিহরনে উতলা করে। সে অবিরত মনুসংহিতায় বিচরণ করে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে কামসূত্র শৃঙ্গারে  নিজেকে শিশ্নাতুর করার স্বপ্নও সমানে তাকে কাতর রাখে। কুমারী ও আদ্যশক্তির যৌনপ্রতীকে  কেন্দ্রীভূত বিচিত্র আবেশ তার মনোজগৎকে বন্দি করার সঙ্গে মুক্তির উসকানিও দিয়ে যায়। ভারতীয় যৌন-মনস্তত্ত্বের দ্বান্দ্বিক এই চরিত্রকে কাপুর সাহেব বাণিজ্যসফল ছবি বানানোর চাবি করে নিয়েছিলেন।

রাম তেরি গঙ্গা মইলি-তে মন্দাকিনী নামে নতুন এক হিরোইন নিয়ে তিনি হাজির হলেন। ববির ডিম্পল পশ্চিমা ধাঁচে স্বল্পবসনা হলেও মন্দাকিনীর বেলায় ঘটনা ভিন্ন ছিল। ভারতীয় পৌরাণিক বিশ্বে পরিচালক ফেরত গিয়েছিলেন। রম্ভা-উর্বশী-শকুন্তলার প্রত্নপ্রতিমা রূপে মন্দাকিনী পর্দায় স্বল্পবসনা হলেন। স্বচ্ছ পোশাকে গঙ্গাস্নানের সঙ্গে স্তন উন্মুক্ত করে শিশুকে দুগ্ধপানও করালেন। শিশুটিকে সেখানে ভগবান রামের প্রতীকী বিগ্রহ রূপে হাজির করা হলো! মাতৃশক্তিকে যৌনপ্রতিমার আদলে প্রয়োগ করার কৌশলে কাপুর কোনো ফাঁক রাখেননি।

মন্দাকিনীর নারীত্বে মাতা ও কুমারীর মিশ্রণ ঘটানো হয়েছিল। নিষ্পাপ সৌন্দর্যের উপমা হয়ে পর্দায় বিচরণের ক্ষণে তার কুমারীত্ব ও মাতৃত্ব নিজেকে অবারিত করার সঙ্গে দর্শকমনে যৌন-উসকানির ঝড় বহায়। উপমহাদেশের সেন্সরবোর্ড ও রুচিবাগিশ দর্শককুল ভারতীয় মাতৃশক্তির এমনধারা উপস্থাপনকে প্রত্যাখ্যানের ভান করলেও স্বপাবেশ থেকে সৃষ্ট যৌনগূঢ়ৈষায় দিওয়ানা হতে উতলা ছিলেন। ভারতের মতো রক্ষণশীল সমাজে সিনেপর্দায় এহেন Controversial Obscenity-র কারণ জানতে চেয়ে ফিল্মফেয়ার  পরিচালককে প্রশ্নবাণ ছুড়েছিল। কাপুর সাহেব স্মিত হেসে জবাব দিয়েছিলেন, — আমি ভাই স্বপ্নের সওদাগর। সিনেমায় স্বপ্ন ফেরি করি, বাস্তবতাকে যে-স্বপ্ন মিথ্যে প্রমাণ করে।

উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে মাদার আর্কিটাইপ -এ সক্রিয় সংবেদনকে ধারণের প্রশ্নে ঋত্বিক ও রাজ কাপুর বলাবাহুল্য বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়েছিলেন। মেঘে ঢাকা তারায় নীতা, সুবর্ণরেখার সীতা কিংবা কোমলগান্ধার-এ অনুসূয়ার মাঝে শিকড় ছড়ানো আদ্যপ্রতিমাকে যৌনগূঢ়ৈষার প্রতীক রূপে দর্শকের কাছে হাজির করার মেজাজ ঋত্বিকের ছিল না। তাদের নারীত্বের প্রতি অঙ্গে সহজাতভাবে বহমান যৌনাবেদনে গভীর ক্ষত ও পরাজয়কে তিনি মূর্ত হতে দেখেছিলেন। চিরন্তন মাতৃশক্তির প্রতীক নারীগণের দেহ আর তাদের নিজের নয় অথবা এমন এক গন্তব্যের পানে তারা ছুটতে বাধ্য হচ্ছে যাকে চাইলেও নিরোধ করা সম্ভব নয়। সুবর্ণরেখার চিত্রনাট্যে তীরের মতো ছোড়া সংলাপ চুয়াত্তর সালে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো-য় ঋত্বিক নিজের জবানে পুনরায় ফেরত এনেছিলেন। পরিস্থিতি তাতে পাল্টায়নি। বাঙালি পণ করেছিল নিজের গঙ্গাযাত্রার ইতিহাসকে ঘিরে যতো স্মৃতিকাতর বিষাদ বঙ্গে ঢেউ তুলে তার একটিও সে আর মনে ঠাঁই দেবে না। বাষট্টির সুবর্ণরেখাকে দর্শকের জন্য উন্মুক্ত করতে ঋত্বিকের তিন বছর লেগেছিল। ছবিটি হলে মুক্তি পায় পঁয়ষট্টি সালে। অগ্নিযুগের সারথি আদর্শচ্যুত বন্ধু হরপ্রসাদকে বিদ্রুপবাণে জখম করার ক্ষণে ঈশ্বর তাকে কলকাতায় ঘুরিয়ে আনার অনুরোধ করে, ‘…তুমি আমাকে কলকাতায় নিয়া যাবা? কলকাতায় এখন মজা, সে যে কী বীভৎস মজা!’ মজাটা বীভৎস হতে পারে কিন্তু বাঙালি ততদিনে আত্মমেহনে নিজের সুখ খুঁজে নেওয়ার সংকল্পে অনড় হয়েছে। ঋত্বিকের কী সাধ্য তাকে ফেরায়!

নকশাল তারুণ্যের বিপ্লবী তেজকে সালাম জানাতে মনে দ্বিধা না থাকলেও ভারতবর্ষের ফিরে-ফিরে ভারতমাতার প্রত্নপ্রতীকে পরিণতি লাভের ইতিহাস সংবেদি মন নিয়ে উপলব্ধি করতে অক্ষম তারুণ্যকে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের মতো ব্যর্থ ভাবা তাঁর জন্য অনিবার্য ছিল। ব্যর্থতার ইতিহাসে নিজেকে গলাপচা বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিনিধি ছাড়া অন্য পরিচয়ে পরিচিত করানো সমান মুশকিল মনে হতে থাকে। সিনেমায় নয়াবাস্তবতার অগ্রদূত ভিত্তোরিও ডি সিকা অথবা সিনেপর্দায় কাহিনি বয়নের কারিগরি মাত্রায় পালাবদল আনতে মরিয়া নভেল ভোগ (*নবতরঙ্গ) আন্দোলনে সক্রিয় বুনুয়েলদের মতো ঋত্বিকও সেই ছবি বানাতে চেয়েছিলেন যেটি দেশের মানুষকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার প্রেরণায় জাগিয়ে তুলবে। গণনাট্যের কলরব থেকে বেরিয়ে ক্যামেরা হাতে নেওয়ার পেছনে এটি ছিল বড়ো কারণ। ক্যামেরায় ডিপ ফোকাসিং-এর দিকপাল জঁ রেনোয়ার ধ্রুপদিছন্দে বোনা কাহিনিচিত্রের প্রভাব থেকে বেরিয়ে সিনেমার নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির ভাবনায় গঁদার-ব্রেসন-ত্রুফো-বুনুয়েলরা তখন খেপে উঠেছেন। এর দার্শনিক তাৎপর্য ও কারিগরি মাত্রায় নতুনত্বের বিষয়টি অন্যদের মতো ঋত্বিককেও ভাবিয়ে তুলেছিল। ছবির দৃশ্যায়নে নিজের অভিরুচি ও প্রয়োজন অনুসারে ওইসব সিনেমাটিক মন্তাজ  তিনি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তা-বলে গল্প বয়নের ভারতীয় তরিকা ছেড়ে পশ্চিমে পাড়ি দেওয়ার কথা ভাবেননি। এই জায়গায় তিনি বা মৃণাল ও পরবর্তী সকল পরিচালক কমবেশি সত্যজিতের সহগামী।

কাহিনির পারম্পরিক সংযোগ ভারতীয় সাহিত্যের প্রাণ। সেই প্রাণবস্তুর ভিতর থেকে বিচ্ছুরিত সাহিত্যিক আবেদনকে নবতরঙ্গের স্রোতে বিসর্জন দেওয়ার ঘটনায় সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-তপন সিংহ ও তাঁদের অনুবর্তী নির্মাতারা আজো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। ইউরোপ-আমেরিকায় সৃষ্ট আর্টহাউজ ফিল্ম-এর সঙ্গে প্রাচ্যবিশ্বে বানানো ছবির গুণগত পার্থক্য এক্ষেত্রে বোধহয় অমোচনীয়। ক্যামেরার শতেক কারিকুরি সত্ত্বেও প্রাচ্যভূমিতে বসে বানানো ছবির বয়ান সাহিত্যসঙ্গে বাড়তে অভ্যস্ত এবং সেখান থেকে সিনেমার নিজস্ব প্রাণবীজ আহরণের দায় সে এড়াতে পারে না। পার্থ্যকটা শ্বেতাঙ্গবিশ্বের তাবড় কুলীন দর্শক-সমালোচক কতটা ধরতে পারেন সেটি ভাবনার বিষয়।

সেইসঙ্গে (*অন্তত ঋত্বিকের বেলায়) মেলোড্রামার প্রসঙ্গটি ওঠে। সিনেবোদ্ধারা সচরাচর একে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত বটে! সাইট এন্ড সাউন্ড  যখন সর্বকালের সেরা ছবির তালিকা করতে বসে সেখানে মেঘে ঢাকা তারা  সেরা একশোয় ঢুকতে পারে না; দুইশোর কোঠা ছাড়িয়ে তবে তার জায়গা জোটে! কারণটি এই বিচারবোধের ওপর হয়তো দাঁড়িয়ে থাকে যেখানে পশ্চিমের সায়েবমেমরা উপমহাদেশের ছবি দেখতে বসে মেলোড্রামায় খানিক বিরক্তই বোধ করেন। হতে পারে আর্টহাউজ ফিল্ম-এর ইউরোপসৃষ্ট বৈশিষ্ট্য মাথায় নিয়ে ছবিগুলোকে তাঁরা দেখেন, যেখানে গল্পবয়নের ভারতীয় ধরনকে তাঁদের কাছে অচল আর অচেনা মনে হতে থাকে। এখন উপমহাদেশের জীবনধারা যদি বিবেচনা করি তাহলে ওই মেলোড্রামা পরিহার করে বানানো ছবি আর্টফিল্ম  হয়তো হয় কিন্তু সর্বাঙ্গীন অর্থে সেটি ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধিত্ব করে না। যুদ্ধ, দেশভাগ, মন্বন্তর, দাঙ্গায় এখানকার মানুষের অনিকেত হয়ে পড়া ও তাকে ভুলে থাকার কসরত পটপ্রবাহ বিবেচনায় মেলোড্রামার দিকে মোড় নিয়েছিল। মেলোড্রামা প্রভাবিত পালাবদল থেকে যে-খোঁয়ারি জন্ম নিয়েছিল তাকে অনুভব করতে না পারলে ঋত্বিকের ছবিতে সচল ভাবাবেগের তল পাওয়া কঠিন হয়। ইউরোপসৃষ্ট সিনেভাষার সাহায্যে এর অনুবাদ মনে হয় না সম্ভব।

ভারতীয় ছবি কদাপি ফরাসি ধাঁচে আর্টহাউজ ফিল্ম  হওয়ার যজ্ঞে শামিল হতে ব্যাকুল বোধ করেনি। ওই ধাঁচে ফেলে তার আলোচনা ও মূল্য নিরূপণ তাই নিরর্থক। এমনকি সত্যজিৎ এমনধারা আলোচনায় অস্বস্তি বোধ করতেন, যার প্রমাণ তাঁর বিষয় চলচ্চিত্র  ও অন্যান্য লেখাপত্রে মিলে। উপমহাদেশে ‘ভালো’ ছবি বানানোর যজ্ঞে ইউরোপের প্রভাবের কথা যদি উঠে সেক্ষেত্রে ইতালিয় চলচ্চিত্রকারদের নাম স্মরণ করা অনিবার্য হয়। কাহিনির অখণ্ড প্রবাহে বিচ্ছেদ না টেনে সিনেমার স্বকীয় ভাষা নির্মাণে ডি সিকা, ফেলিনি, আন্তোনিওনির কুশলতা একসময় এখানে গভীর ছাপ ফেলতে শুরু করেছিল। ব্যতিহার রূপে রেনোয়া, বার্গম্যান, তারকোভস্কি ও জাপানি সিনেমার অগ্রপথিক ওজো-কুরোশাওয়ার প্রভাব গভীর ছিল। উনারা বিশ্ব জুড়ে ‘ভালো’ সিনেমা বানাতে মরিয়া নির্মাতাদের জন্য বিরাট প্রেরণা ছিলেন। উপমহাদেশ সেখানে ব্যতিক্রম নয়। সে যাহোক, ইউরোপীয় ঘরানায় সৃষ্ট আর্টফিল্ম  নয় বরং সোজাসাপ্টা ‘ভালো’ ছবি বানানোর সংকল্পই ছিল ঋত্বিকের বীজমন্ত্র। সেই ছবি তিনি বানাতে চেয়েছিলেন যেটি অন্ততপক্ষে বাঙালি নাগরিক মধ্যবিত্তকে মনে করিয়ে দেবে সে কোনো শিকড়ছিন্ন সত্তা নয়, তার জাতিসত্তার প্রতি অঙ্গে ভারতবর্ষ বিরাজ করে, যেটি আবার বহুরূপী দ্বান্দ্বিক বিক্ষোভে তাকে অহরহ গড়েভাঙে ও এভাবে স্বকীয় (*এবং বাঙালি) করে তোলে; — মনের গহিনে আবেগটি গভীর না হলে মার্ক্স-লেলিন-মাও-স্তালিন কপচে সমাজ পাল্টানোর মন্ত্র বীভৎস মজায় নিজেকে নিঃস্ব করে যায়।

ঋত্বিকের দুর্ভাগ্য সত্যজিৎ-মৃণাল কিংবা পরবর্তী নির্মাতাকুলের মতো তাঁর ছবি পরিষ্কার সার্কিট  পায়নি। তিনি ছিলেন খ্যাপা দুর্বাসা। তাঁর বাঙালিয়ানায় প্রতি অঙ্গে লেগে থাকা প্যাশনকে ধারণের ক্ষমতা বঙ্গবাসীর ছিল না। বুদ্ধিজীবী হিসেবে জৈবস্বভাবী বা অর্গানিক  ছিলেন। ঋত্বিকের জীবনসঙ্গী সুরমা ঘটক তিক্তমধুর অভিজ্ঞতায় পারাপারের ক্ষণে সেটি মর্ম দিয়ে অনুভব করেছেন। সিলেটের জল-হাওয়ায় মানুষ করিমগঞ্জের সন্তান নাট্যজন খালেদ চৌধুরীর স্মৃতিচারণায় এর আঁচ টের পাওয়া যায়। কোনো-এক সাক্ষাৎকারে খালেদ জানিয়েছিলেন মেঘে ঢাকা তারার আগে লোকগায়ক রনেন রায়চৌধুরীর সঙ্গে ঋত্বিকের পরিচয় নিবিড় ছিল না। খালেদের সুবাদে দুজনের মোলাকাত ঘটে। প্রারম্ভিক আলাপে গান শোনানোর অনুরোধ ঠুকে বসেন ঋত্বিক। দুর্বিন শাহ-র ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’ গানখানা রনেন সেদিন গেয়েছিলেন। গান চলাকালে খালেদ খেয়াল করেন শিল্পীকে সম্বোধনের ক্ষণে ঋত্বিক নতুন মোড় নিয়েছেন। ‘আপনি আজ্ঞা’ দিয়ে আলাপচারিতা শুরু হলেও সেটা ততক্ষণে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’-য়ে নাবতে শুরু করেছিল। গানের শেষে রনেনকে বুকে জড়িয়ে ধরার সময় তাঁকে ‘শালা’ বলে ডাক ছাড়তে ঋত্বিকের তখন একটুও অস্বস্তি হচ্ছে না! মানুষকে কাছে টানার এই ক্ষমতা তাঁর জাত চিনিয়ে দেয়। লোকের সঙ্গে ভাও-ভণিতা করে কথা বলার বান্দা তিনি ছিলেন না এবং ওসবের পরোয়া করতেন না।

‘আপনি থেকে তুমি হয়ে শালা’-য় নামার মধ্যে উষ্ণতার আরাম ছিল এবং রনেন সেটি ধরতে পেরেছিলেন। ঋত্বিকের জন্য সেই গানখানা তিনি সঙ্গে নিয়েছিলেন যার মধ্যে বাংলাদেশের ঘ্রাণ তখনো অমলিন ছিল। জৈবস্বভাবী এই বুদ্ধিজীবীতা একাধারে মর্মভেদী ও ব্যতিক্রম হওয়ার ফলে সহজে কেউ তাঁর সামনে পড়তে চাইত না। কারণ এই জৈবতা গভীরভাবে পলিটিক্যাল ও অস্বস্তিকর ছিল। ঋত্বিকের স্মরণসভায় সত্যজিৎ রায় সংক্ষেপে দু-চার কথা বলেছিলেন। রায়বাবুর কথা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি খ্যাপা দুর্বাসার মনোযন্ত্রণা ও জীবনবোধের খবর তিনি অল্পই রাখতেন। ঋত্বিক তাঁকে টেনে নিয়ে নিজের একখানা সিনেমা দেখিয়েছিলেন এবং পরে পাকচক্রে খান-দুয়েক দেখেছিলেন; — আপাত নিরীহ এই তথ্যের মাঝে ঔদাসীন্য ও তাচ্ছিল্যের সুর কানে খট করে বাজে। মন তখন বুঝে নেয় নিজের জীবন, শিল্পভাবনা ও দায়বোধের বিপরীত প্রান্তে সচল বাস্তবতার সঙ্গে লড়াইয়ের গুরুভার বহনে ক্লান্ত পাড় মাতাল ঋত্বিকের ভগ্নস্বাস্থ্যের আড়ালে লেলিহান অগ্নিশিখা অথবা কুখ্যাত প্যাশনের তীব্রতা সত্যজিতের অধিক সহ্য হয়নি। শ্রেণিকরণের সেই বর্গে দুজনে দাঁড়িয়েছিলেন যেখানে সত্যজিৎ নিজের প্রখর ব্যক্তিত্বের ধারে জলসাঘর-এর ছবি বিশ্বাসের ন্যায় বনেদি ও অভিজাত। পক্ষান্তরে ঋত্বিক বুদ্ধিজীবীতায় অতুল হলেও স্বভাবে কাদামাটিছানা ছন্নছাড়া বালক যেন! বাঙালির মধ্যবিত্তপনাকে দিবানিশি চাবুকপেটা করলেও নাগরিক মধ্যবিত্তের সঙ্গে তাঁর উঠবস শেষ হওয়ার ছিল না। মধ্যবিত্তের হাজারটা আপস, ভান ও ক্ষয়িষ্ণুতাকে গালিগালাজ করার মুহূর্তে একে ছাড়তে গিয়ে তাঁর বুকে বেঁধেছে। যেখানে থাকার ইচ্ছে নেই সেখানে অবিরত বিলং করার টানাপোড়েন ঋত্বিকের জীবনে অবিচ্ছেদ্য নিয়তিতে পরিণত হয়েছিল।

Cinema is director’s media; — বাজারে চালু প্রবচন সত্যজিতের ছবি বানানোর প্রতি ধাপে সত্য হয়ে ফোটে। শুটিং অথবা ইউনিটের লোকজনের সঙ্গে মোলাকাত আর মেলামেশার ধারা থেকে শুরু করে লাঞ্চ কিংবা ডিনারে তাঁর সহজাত আভিজাত্য আপনা থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে। ঋত্বিকে ওসবের বালাই চোখে পড়ে না। ক্যামেরায় চোখ রাখার ক্ষণে ডিসিপ্লিন  মানলেও এসবের বাইরে চিরকালের ছন্নছাড়া। শিডিউলজটে আটকানো সুপ্রিয়া দেবীকে তাঁর আজকেই লাগবে। ভোররাত্তিরে ভাঙাচোরা গাড়ি হাঁকিয়ে শুটিং ইউনিটে তাঁকে হাজির করতে ছোটেন। সুপ্রিয়ার তখন ত্রাহি অবস্থা হলেও এই পাগলামিকে ‘না, পারবো না গো। জানোই তো শিডিউল মিলাতে পারছি না।’ — ইত্যাদি বাহানায় পাশ কাটানোর উপায় থাকে না। টেক শেষ হলে শিশুর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া ঋত্বিকের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে লজেঞ্চুস। ওটা বাড়িয়ে দিয়েছেন সুপ্রিয়ার দিকে, — ‘দারুণ করেছিস রে! নে চকোলেট খা।’ সুপ্রিয়া দেবীর বরাতে জানা হয়ে যায় প্রতিবার টেক শেষ হতে ঋত্বিক তাঁর হাতে একখানা চকোলেট ধরিয়ে দিতেন। মা যেমন শিশুকে দিয়ে থাকে আর কী! তিতাস একটি নদীর নাম  করতে বাংলাদেশে এলেন। এফডিসিতে তখন ঝকঝকে সব ক্যামেরা বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছে। নেড়েচড়ে দেখার পর পরিচিত সেই খিস্তি, — ‘শালারা, এমন যন্তর হেলায় ফেলে রেখেছে! ওটা দিয়ে সিনেমায় বিপ্লব ঘটানো যেতো।’ তো এহেন জীবনশিল্পীর মূল্যায়নে সত্যজিতের বক্তব্যে সেই ব্যাপারখানা সেদিন অনুপস্থিত ছিল যার কল্যাণে খ্যাপাটে এই লোককে ভারতীয় সিনেমায় আনপ্যারালাল  ও বিরল বলে কুর্নিশ ঠুকতে মন বাধ্য থাকে।

না কুর্নিশ, না আফসোস! জমিদার যেমন আপনা খেয়ালে মাঝেমধ্যে গুণধারী প্রজাকে স্তোকবাক্যে সম্ভাষিত করে, সত্যজিৎ রায়ের গমগমে কণ্ঠ ও প্রখর ব্যক্তিত্ব থেকে সে-রকম এক আওয়াজ কেবল সেদিন বেরিয়ে এসেছিল। ওদিকে রায়বাবুর প্রিয় তীর্থভূমি ফ্রান্সে গঁদার ও ত্রুফো হাতে হাত মিলিয়ে সিনেমার খোলনলচে পাল্টে দিচ্ছিলেন। ‘ভালো’ সিনেমা নামানোর যজ্ঞে গঁদারের ব্রেদলেস-এর চিত্রনাট্য ত্রুফোর সৃষ্টি। মেঘে ঢাকা তারা-র চিত্র্যনাট্য অবশ্য মৃণাল সেন লিখেছিলেন। দুজনে তখন সেই স্ট্রাগলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন যার ইতিহাস মৃণাল নিজের জবানে লিখে রেখে গিয়েছেন। সত্যজিৎ ততদিনে বিশ্বের ডাকসাইটে সিনেমাকারদের ভুবনে জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কেন জানি তাঁর মনেই হলো না পাগলা ঋত্বিকের ছবিগুলোকে একবারের জন্য হলেও বাইরে ঘুরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা দরকারি। অস্বস্তি? অনীহা? মানসিক দূরত্ব? শ্রেণিবৈপরীত্য? ভয়? নাকি ঈর্ষা? ঠিক কোনটা? সে এখন কেবল ঈশ্বর জানেন। দুই মহারথীর কেউ আর বেঁচে নেই। বাংলায় এসব নিয়ে লোকে ঘাঁটতে চায় না। দেবতাপূজার দেশে লোকনিন্দা সমানে চলে কিন্তু একবার কেউ দেবতা বনে গেলে তাকে কেউ ঘাঁটতে চায় না। গঁদার ও ঋত্বিকভক্ত সুবিমল মিশ্র সত্যজিৎকে পছন্দ করে উঠতে পারেননি। তাঁর লেখায় সত্যজিতের প্রতি বিরাগ বিদ্বেষের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। ঘটনাটি দৃষ্টিকটু ও কতকক্ষেত্রে হাস্যকর হলেও সুবিমলের ক্ষোভ নেহায়েত অযৌক্তিক ছিল না। ‘ভালো’ ছবির লড়াইয়ে শরিক নির্মাতাদের মানসিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা তাঁর ক্ষোভের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছিল এমন ভাবার শক্ত কারণ রয়েছে।

সে-যা-হোক, মৃণাল সেনের কথায় আবার ফেরা যাক। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, বস্তাপচা বিনোদনের ধ্যাড়ধেড়ে সূত্র মেনে জনতা জনার্দনের গাঁট কাটার চেয়ে মৃণাল যে-পন্থায় ‘ভালো’ ছবির জাত বিচার করতেন সেটি ঢের উত্তম ছিল। জনতাকে হিট-সুপারহিট-ব্লকব্লাস্টার গিলানোর হিসাবি ভাবনা থেকে সিনেমা বানানোর চেয়ে দেশবিদেশে বিদ্যমান দর্শকের ছোট্ট পরিসরকে তিনি আরাধ্য করে নিয়েছিলেন, যেখানে নিজের ভাবনা ও বক্তব্য অন্ততপক্ষে পৌঁছানো যাবে বলে তাঁর মনে হয়েছিল। জনতা গিলতে পারলে বড়ো ভালো ছিল কিন্তু গিলছে না দেখে আপসের রাস্তায় হাঁটা শুরু করলে একসময় সেটি ধান্ধাবাজির দিকে মোড় নেয়। সিনেমা নামের শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম তখন নিজের শক্তি হারিয়ে চিনুয়া আচেবে-র ভাষায় ‘গন্ধমাখানো কুত্তার গু’-য়ে পরিণত হয়। গ্ল্যামারের ছটা সেখানে থাকে তবে দিনের শেষে বুঝতে বাকি থাকে না সুগন্ধ সরবরাহ করতে নেমে হল-সিনেপ্লেক্স আর ওটিটি প্লাটফর্মে সিনেনির্মাতা শেষতক গু  সাপ্লাইয়ের ব্যবসায় করেটরে খাওয়ার সিদ্ধান্তকে কবুল করে নিয়েছেন।

জনতা গু  গিলছে আর পরিচালক অকাতরে সাপ্লাই দিয়ে চলেছেন! মাঝখান দিয়ে লগ্নিকারকের জেব থেকে গুয়ের ভাণ্ড উপচে পড়ছে। গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ। যেন পিয়ের পাওলো পাসোলিনির সালো : পায়ুকামের একশো কুড়ি দিন-এর মহড়া চলছে সবখানে। মোটের ওপর এরকম পরিবেশ হচ্ছে সেই ফাঁদ যেখানে একটি ‘ভালো’ সিনেমার কপালে মেইনস্ট্রিম, কমার্শিয়াল, আর্টহাউজ, প্যারালাল, অফবিট, ইনডিপেন্ডেন্ট  তকমা পরিয়ে ছবি ও তার নির্মাতাকে জনতার নাগালের বাইরে নেওয়ার বন্দোবস্ত বা সেই ব্যবস্থাটি জারি রাখা হয়। ঋত্বিকের ‘ভাবো, ভাবাটা প্র্যাকটিস করো’ কিংবা ‘সিনেমার প্রেমে আমি পড়িনি মশাই, কাল যদি এরচেয়ে ভালো মাধ্যম পাই সিনেমাকে লাথি মেরে চলে যাব।’ — এইসব কথার আঘাতে সমাজের অণ্ডকোষ মোচড় দিয়ে ওঠে না। অগত্যা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ঋত্বিকবন্দনা বৃথা বহে পবনে। ঋত্বিক মারা যাওয়ার পর শক্তি লিখেছিলেন, ‘…উপদ্রুত বাংলাদেশ, আর কেউ নেই যে কড়কাবে / বিদ্যুচ্চাবুকে এই মধ্যবিত্তি, সম্পদ, সন্তোষ / মানুষের। তুমি গেছো, স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে / পোড়া পাথরের মতো পড়ে আছো বাংলাদেশে, পাশে / ঋত্বিক, তোমার জন্যে তুচ্ছ কবি আর্তনাদ করে।’ [ঋত্বিক, তোমার জন্য / শক্তি চট্টোপাধ্যায়]

লম্বা ভণিতা শেষে আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের ছবিখানায় ফেরত যাওয়া প্রয়োজন। মৃণালের কথা যদি স্বীকার যাই সেক্ষেত্রে বিক্রম ভালো কিছু ঘটানোর সংকল্পে সেই ঝুঁকি নিয়েছেন যার ওপর ভর করে উপমহাদেশের সিনেমা মাঝেমধ্যে নিয়মের ব্যতিক্রম ছবির জন্ম দিয়ে যায়। মুনাফা তার কপালে জোটে না। লগ্নি উঠি-উঠি করেও উঠতে চায় না। সরকারি অনুদান হলে তবু পোষানো যায় কিন্তু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের গাঁট থেকে টাকা বেরিয়ে এলে পরিচালকের রাতের ঘুম হারাম হয়। শেষবেলা সব মাঠে মারা যায় যদি সংবৎসর দুনিয়া জোড়া ছবি প্রদশর্নীর যেসব মহড়া চলে সেখানে প্রবেশের সুবাদে দু-চারখানা পুরস্কার বাগাতে বিফল হয়। শিল্পের জন্য বিপত্তিকর এইসব হ্যাপা সামলে লেগে থাকার দম ধরে রাখা মেহনতের কাজ। বিক্রমের বেলায় লগ্নি কীভাবে জুটেছিল সে আর জানার সুযোগ হয়নি। ক্যামেরায় বোনা সংলাপ-বর্জিত ছবিখানা ভেনিস থেকে শুরু করে গণ্যমান্য উৎসবে পুরস্কারের সঙ্গে দর্শক-সমালোচকের বাহবা কুড়িয়েছে বলে শুনেছি। প্রথম ছবিতে জাতীয় পুরস্কার ও স্বর্ণকমল  বড়ো ঘটনা। পরিচালকের ওপর এহেন স্বীকৃতি চাপ তৈরি করে। তো সেটি সামাল দিয়ে বিক্রম ‘জোনাকি’ নামে দ্বিতীয় ছবি নিয়ে এসেছেন আঠারোয়। এখনো দেখা হয়নি বলে সে-আলোচনায় যাব না। বড়ো কথা, মৃণালচিহ্নিত মশলাদার কিংবা আঁতলামিভরা অজস্র ‘খারাপ’ ছবির ভিড়ে যেসব দর্শক ইউটিউবে ছবিটিকে নজর করলেন তাদেরকে নিরাশ হতে হয়নি। পরিচালককে সাধুবাদের বন্যায় ভাসাতে তারা তাই ইতস্তত বোধ করেননি। আসা যাওয়ার মাঝে-র কাহানি  জগৎ-সংসারে বিরাজিত ছাপোষা মধ্যবিত্ত দর্শকের অপরিচিত না হওয়ার কারণে বিক্রম সম্ভবত এ-যাত্রা পার পেয়ে গেলেন। ছবির গল্পের সঙ্গে সংযোগ দর্শকের কাছে ততখানি অবিচ্ছেদ্য মনে হয়েছে যতখানি নিজের হাতের তালুকে তারা অবিচ্ছেদ্য বলে জানেন।

বিক্রমকে এই জায়গা থেকে তাই ব্যর্থ বলার উপায় থাকছে না। ছবির ইংরেজি নামকরণ The Labour of Love-এ গুঞ্জরিত ইশারা দর্শক ভালোই পড়তে পেরেছেন বলা যায়। ইউটিউবের মন্তব্য বিভাগের প্রতি ছত্রে নিজের জীবনের সঙ্গে গল্পখানাকে জুড়ে নিতে ও তার ভাষান্তরের কাজে তাদের স্বতঃস্বফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো ঘটনা। ব্যতিক্রম নির্মিতির ঝুঁকি যিনি নিলেন তার জন্য এই প্রাপ্তি পুরস্কার দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। নেটাগরিক আমজনতার বিপুল অংশ থেকে যেসব দর্শক পরিচালকের প্রয়াসকে নজর করেছেন তাদের কারণে বাংলা সিনেমা্য় নতুন ভাবনা ও আঙ্গিকে ছবি নির্মাণের সাহস (*অন্তত ওপার বাংলায় এবং যৎকিঞ্চিৎ হলেও বাংলাদেশে) পরিচালকরা এখনো ধরে রেখেছেন। সংলাপ বিবর্জিত দৃশ্যায়নের ভিতর দিয়ে গল্প বলে যাওয়ার পরিকল্পনায় পরিচালককে সফল মানতেই হচ্ছে।

জীবনে বিচিত্র ঘটনারাশির সঙ্গে কথার সংযোগ অনিবার্য হলেও মানবসংসারে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই ঘিরে যত কাহিনি প্রাত্যহিক জন্ম নিয়ে থাকে, ওইসব কাহিনির প্রতি পরতে যত অনুভব নিতিনব  ঠিকরায়, সংলাপহীন নীরবতায় তারা কী করে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে সেটি উপলব্ধির খাতিরে দর্শকের ছবিটি দেখা প্রয়োজন। সংসারের চাকায় বাঁধা এক দম্পতির গল্প বিক্রম তাঁর ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। তরুণ দম্পতির জীবনছক ক্যামেরায় ধরে রাখার মুহূর্তে দিবা থেকে নিশি অবধি নগর কলকাতায় বিচিত্র যেসব গুঞ্জন ও কোলাহলের তরঙ্গ বহে সেগুলোকে সংলাপের বিকল্প রূপে তিনি ছবিতে জুড়ে নিয়েছেন। দু-চারখানা গানের কলি আর আবহসংগীত যেখানে ফিলারের দায় পূরণ করে যায়। এর বাইরে দম্পতি যথারীতি মৌন থাকে। অনুযোগহীন চিত্তে দুজনে মিলে সংসারের দায় মিটায়। এ-যেন গীতার বহুশ্রুত বাণীর উপমা! সখা অর্জুনকে কর্মফলের স্বরূপ বোঝানোর ক্ষণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যেসব কথা বলেছিলেন বিক্রমের পাত্র-পাত্রীরা শ্রীকৃষ্ণ-বচনের উপমা হয়ে ঘরবাহির করে। উপমাটিকে দর্শক চক্ষু দিয়ে যেমন নজর করে, তার মনের গহিনে নীরবে এর অনুবাদ চলতেই থাকে। একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর কাজের সঙ্গে সেঁটে থাকা দম্পতিকে দেখার অভিজ্ঞতা দর্শকমনে হয়তো খানিক বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে যায়। কর্ম ও কর্মফলের অন্তিম ভবিতব্য সে তখন মনে-মনে আওরায় :—

নিজের ধর্ম ও স্বভাব অনুসারে করে খাওয়ার অধিকার সকলের রয়েছে কিন্তু তা-বলে তুমি নিজেকে এর অধিকারিক ভাবতে যেও না। তোমার কপালে যা জুটেছে তার কথা ভেবে মনস্তাপে ভোগে ফল নেই। নিজেকে এর হেতু ভাবাটাও অনুচিত। আবার নিজে হেতু নও বুঝে কর্মে অনাসক্তি ও স্বভাবের বিপরীত আচরণ মনকে বিক্ষুব্ধ করে। বরং মেনে নাও, — করে খাওয়ার জন্য তুমি সংসারে রয়েছো কিন্তু ফলের জন্য নও। ফলের আশা সকল সময় সুখের হয় না। অথবা তোমার জন্য সুখের হলেও অন্যের জীবনে সেটি দুঃখ বয়ে আনতে পারে। সুতরাং ‘মা ফলেষু কদাচন।’ ফলের আশায় উতলা না হয়ে করে খাও। ভালোমন্দ যাই ঘটুক জীবনে তাকে মেনে নিয়ে স্বভাবের অনুগামী হও ও কর্মে লিপ্ত থাকো। জগতে কর্ম একমাত্র সত্য, বাকিটা মায়া।

সংসার যাপনের একঘেয়ে ছকে বাঁধাই বিক্রমের দম্পতিকে গীতার দ্বন্দ্ব-সমাসের উপমায় বিচরণ করতে দেখে দর্শকমনে কৌতুক ও প্রশান্তি দুটো একসঙ্গে বহে। ক্যামেরার সামনে সচল দম্পতির প্রাত্যহিক খুঁটিনাটির সঙ্গে তাল দিয়ে গল্পটা সহজ ছন্দে তরতর করে আগায়। দৃশ্যায়নের এহেন শক্তি কোনো লেখকের পক্ষে কতটা আঁকা সম্ভব কে জানে! যদিও ক্যামেরা হাতে আগুয়ান পরিচালককে এখানে স্বচ্ছন্দ মনে হয়েছে। ফরাসি চলচ্চিত্রে নবতরঙ্গের অন্যতম কাণ্ডারি গঁদার সিনেমার নিজস্ব ভাষা সৃষ্টির ব্যাপারে পরিচালককে সচেতন হওয়ার বার্তা জীবনভোর দিয়ে এসেছেন। তাঁর মতে সিনেপর্দায় আঙ্গিক-বিপর্যয় ঘটানোর প্রয়োজনে পরিচালক সাহিত্য থেকে ধার নেবেন। দৃশ্যায়নের ধারায় সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার বিকৃতিকে সেখানে অকাট্য করা জরুরি। লোকে যেন বুঝতে পারে সে এখন জনৈক পরিচালক ও তার দলবল মিলে বানানো সমবায়ী সৃষ্টিকে পাঠ করতে বসেছে! কাগজ-কলম হাতে নিয়ে যে-লোকটি গল্প ফাঁদে এবং সেটি কিতাব হয়ে মানুষের হাতে পৌঁছায়, ওই লোক ও তার ব্যবহৃত মাধ্যমের কথা স্মরণ রাখার প্রথাকে এখানে বাতিল করা প্রয়োজন। সিনেমা কেবল ব্যক্তি পরিচালকের একার সৃষ্টি নয় বরং ক্যামেরা থেকে কলাকুশলী মিলেঝুলে তার ভাষা পর্দায় নিজেকে তুলে ধরে। সুতরাং সেখানে বিপর্যাস না ঘটা অবধি সিনেমার পক্ষে নিজের গল্প বলে যাওয়া আখেরে সম্ভব নয়।

সিনেভাষা সৃষ্টির এইসব তরিকা নিয়ে গঁদারকাণ্ডের পক্ষে-বিপক্ষে বিস্তর বাদ-বিসম্বাদ অতীতে ঘটেছিল বা এখনো মাঝেমধ্যে তর্কটা চাগার দিয়ে ওঠে। চলচ্চিত্রে আদিযুগের কারিগর আইজেনস্টাইন, পুদোভকিন, ড্রেয়ার বা ফ্রিৎজ ল্যাং আপনা থেকে সেখানে অনিবার্য গণ্য হয়ে থাকেন। ওদিকে ইতালিয় নির্মাতা আন্তোনিওনি, ফরাসি বুনুয়েল বা হিরোশিমা মন আমুর-এ (Hiroshima my love) আলাইন রজনাইস, পোয়েটিক সিনেমার কারিগর তারকোভস্কি, বেলা টার ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, কতক ক্ষেত্রে মালায়ালম সিনেমার পথিকৃৎ আদুর গোপালকৃষ্ণন, জি. অরবিন্দন বা শাজি এন. কারুন, জাপানে কুরোশাওয়া, তাইওয়ানের এডওয়ার্ড ইয়াং কিংবা তুরস্কে নুরি বিলজে সেইলান প্রমুখের ক্যামেরাবাজির মধ্যে নিজস্ব ভাষাপ্রকরণ সৃষ্টির খোঁজ মিলে বৈকি। বিক্রম ওসবের বাইরে বসে ছবিটি বানালেও দৃশ্যায়নের ভিতর দিয়ে যে-ধারাবিবরণী সেখানে চলে এবং তার উপস্থাপনকৌশল প্রকারান্তরে গঁদারের ভাবনাকে শক্তি দিয়ে যায়। সংলাপ-বমনে বিরত থাকার পরেও সিনেমার ভাষা কী করে স্বকীয়তা লাভ করে তার হদিশ পেতে এই নির্মিতিটি বোধহয় একের অধিক দেখে ফেলা যায়।

নির্বাক সিনেমার যুগবিশ্বে জোয়ান অব আর্ককে শূলে চড়ানোর ঘটনা নিয়ে বানানো কার্ল থিওডোর ড্রেয়ারের জোয়ান অব আর্কের দিব্যাবেশ (The Passion of Joan of Arc) ছবিটির কথা এইবেলা স্মরণ করা বোধহয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। শতবছর ধরে চলমান যুদ্ধে সেকালের ফ্রান্সকে ইংল্যান্ডের খপ্পর থেকে উদ্ধারের জন্য ঈশ্বর সরল-আনপড় এক কৃষককন্যার ওপর নিজের বিভূতিসঞ্চার ঘটিয়েছেন। যিশুর প্রতিনিধি রূপে তাকে তিনি বেছে নিয়েছেন। ফরাসি সৈন্যদের নেতৃত্ব দানের গুরুভার নিতে তাকে আদিষ্ট হতে বলছেন। অকল্পনীয় দিব্যাবেশের পাল্লায় পড়া জোয়ান সেকালের ফরাসি আমজনতার মনে আত্মবিশ্বাসের জোয়ার এনে দিয়েছিল। জনতা ততদিনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সর্বহারা কৃষককন্যার পক্ষেই কেবল ইংরেজ ও স্বদেশী চাটুকারদের হাতে সৃষ্ট অরাজকতা থেকে ফরাসিদের উদ্ধার করা সম্ভব। জোয়ানের উত্থান ঠেকাতে ইংরেজ ও ফরাসি যাজকরা অগত্যা একজোট হয়। তাকে শূলে চড়ানোর কম্মো সারতে আদালতে যেসব মিথ্যাচারের মহড়া সেদিন ঘটেছিল ড্রেয়ার সেই ইতিহাসকে ছবির আরাধ্য করে নিয়েছিলেন। প্রায় শতবর্ষী ছবিটি ফিরে দেখতে গিয়ে মনে হলো গুণীজনের কথা মিথ্যে নয়! নির্বাক ছবি কতটা ক্ষুরধার হতে পারে দর্শকের সেটি টের পেতে বিলম্ব হয় না। সিনেমার আদিযুগে কারিগরি বিষয়গুলো নিয়ে ড্রেয়ারকে বিস্তর খাটতে হয়েছিল। চলচ্চিত্রে শব্দ সংযোজনের সাফল্য অর্জিত হওয়ার পর থেকে সংলাপে ভর করে কাহিনি ও দৃশ্যায়নের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের ধারা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একে-একে অসংখ্য সার্থক ও কালজয়ী চলচ্চিত্র বিশ্ব জন্ম নিতে দেখেছে। তথাপি আইনজেনস্টাইনের মতো ড্রেয়ারের ছবিখানাও অনতিক্রম্য হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে এবং যুগপ্রাসঙ্গিক টেক্সটে পরিণত হয়। এটি সেই ছবি যার আবেদন বোধহয় আজো অমলিন!

সময়ের ধারায় উত্তম শিল্পবস্তুর আবেদন নিস্তেজ হয়ে আসে, তবু এমন সৃষ্টি সেখানে দু-চারটা থাকে যারা সময়ের সঙ্গে মৃত হওয়ার পরিবর্তে অধিক যুগ-প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ড্রেয়ারের ক্যামেরায় ধারণকৃত জোয়ান সেই গোত্রে পড়ে। দর্শক এখন মাতৃভাষায় তৈরি ছবি দেখার সময় মূলত সংলাপে কান খাড়া রাখে। ভিনভাষী ছবির বেলায় এক চোখ সাবটাইটেলে  রেখে অন্য চোখ দিয়ে কাহিনি ও তার দৃশ্যায়নকে সে নজর করে। সংলাপ ও সাবটাইটেল, অভিনয়শিল্পীর অঙ্গবিক্ষেপ আর অভিব্যক্তি, কাহিনিপটে সংযুক্ত আবহসঙ্গীত এবং নাচাগানা … বিচিত্র অনুষঙ্গে নিজের চোখকান খাড়া রাখার ঝামেলায় সেই অবসর এখন আর কপালে জোটে না যার সাহায্যে ক্যামেরার টেক্সট হয়ে ওঠার ঘটনাকে আলাদাভাবে নজর করা ও সে-নিয়ে ভাবনায় বুঁদ হওয়া যায়। ড্রেয়ারের নির্বাক যুগের ছবিতে অভিজ্ঞতাটি ঘটে! কাহিনি ও অভিনয় ছাড়াও সেট-নির্মাণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্যামেরার খোদকারি দ্রষ্টব্য ঘটনা রূপে দর্শকের চোখে গেঁথে যায়। ছবিটা নির্বাক কিন্তু ক্যামেরা যে-কাহিনিকে ধারণ করে সেখানে বলার সুযোগ থাকে না ‘গল্প ঝুলে পড়ছে’, ‘বোরিং’ অথবা ‘টানটান নয়’ ইত্যাদি। দেড়ঘণ্টার দৃশ্যায়নে অতিরঞ্জিত বা অপ্রাসঙ্গিক সিন  ড্রেয়ারের ছবিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। নির্বাক যুগে বানানো চার্লি চ্যাপলিনের ছবি দেখলে দর্শকমনে রসের ফল্গুধারা বহে। হাসতে-হাসতে নিজের অগোচরে তার চোখ জলেও ভরে ওঠে। ড্রেয়ারের ট্রাজিকরসে ভরা ছবি চ্যাপলিনের অতুলনীয় ডিনামিকস  থেকে পৃথক হলেও দর্শককে বসে থাকতে বাধ্য করে।

সাক্ষ্য ও জেরা গ্রহণের জন্য আদালত এবং জোয়ানের মুখ দিয়ে জোর করে মিথ্যা বিবৃতি আদায়ে নির্যাতনকক্ষ ড্রেয়ার নিপুণ হস্তে তৈরি করেছিলেন। তাঁর তৈরি সেট  মধ্যযুগে কারবারখানা কীভাবে ঘটানো হতো সেই ছবি দর্শকের চোখের সামনে জীবিত করায়। শব্দ ও আবহসংগীত সংযোজনের সুযোগ তখন ছিল না। জেরার পুরো সময় যাজকদের কানাকানি ও জোয়ানের সঙ্গে বাতচিতের সিনগুলো তিনি সযত্নে ক্যামেরায় ধরেছিলেন। জেরার ধরন, বিদ্রূপ-উপহাস ও ভয় প্রদর্শন, বিব্রত কিংবা ক্ষুব্ধ হওয়া ইত্যাদি অভিব্যক্তি ধরে রাখতে ছবিতে অবিরত ক্লোজ শট  ব্যবহার করেছিলেন। ক্লোজ শট-এর এই লাগাতার প্রয়োগ সত্ত্বেও ছবিটি বোরিং হয়ে ওঠেনি! একালের আদালতকেন্দ্রিক সিনেদৃশ্যকে ক্যামেরা যখন ধারণ করে সেখানে সংলাপের দিকে দর্শকের কান মূলত খাড়া থাকে। পরিচালক শট  কীভাবে নিয়েছেন অর্থাৎ জেরা চলার সময় বাদি ও বিবাদীর অভিব্যক্তি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা সিনেমাটোগ্রাফি কেন জানি চোখের ফাঁক দিয়ে গলে যায়! সংলাপকে দর্শক টেক্সট হিসেবে নজর ভরে দেখে ও শোনে, যদিও সংলাপ আওড়ানোর সময় স্ক্রিনে  অভিনেতা নিজেকে কতখানি ধ্বংস করেছে এবং সেটি ধরে রাখতে পরিচালক ক্যামেরাকে কীভাবে খাটালেন ইত্যাদি ভাবনা তাকে উতলা ও স্তব্ধ করে না।

একালের বেশিরভাগ সিনেমায় এমনধারা ঘটনার দৃশ্যায়ন মনে মিসিং টেক্সট-এর অনুভূতি তীব্র করে। চিত্রনাট্যে সংলাপের অধিক্য থাকায় অভিনয়শিল্পীর অঙ্গবিক্ষেপ ও সেখান থেকে ছলকানো মনোসংকেত দর্শক প্রায়শ খেয়াল করে উঠতে পারে না। অথবা এইসব ধরে রাখতে ক্যামেরার উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগের প্রসঙ্গটি সেখানে অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হয়। সমালোচকরা হয়তো এখনো এইসব নজর করেন কিন্তু সাধারণ দর্শক কতটা কী খেয়াল করছেন সেটি ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সিনেমা দেখে কি লাভ যদি সংলাপ শ্রবণ ও ভুলে যাওয়ার মধ্যে তার ইতি ঘটে? কি লাভ যদি সংলাপকে দৃশ্যায়নের যোগ্য করার ক্ষণে কাহিনির প্রতি অঙ্গে বিজড়িত খুঁটিনাটি নতুন ভাষার জন্ম দিতে বেকুব হয়ে পড়ে?

নির্বাক যুগের ছবিতে অভিনয়শিল্পকে রক্ত-মাংসে অনুভবযোগ্য মনে হতো। অভিনেতা সেখানে চ্যাপলিন বা ড্রেয়ারের ফলকনেত্তি যে-কেউ হতে পারেন। সবাক যুগের ছবিতে সংলাপের সঙ্গে দৃশ্যায়ন ও অভিনয়ের সংযোগ অনেক সময় খাপছাড়া ঠেকে, আর সেটি পুষিয়ে নিতে বুঝি চালিয়াতির প্রবণতা বাড়ছে! তথাকথিত আর্টহাউজ ফিল্ম-এ ঘটনাটি একভাবে ঘটে, মশলা সিনেমায় সেটি আবার অন্যভাবে ঘটানো হয়। আর্টহাউজ ফিল্ম-এ তালছাড়া ধীরগতির ক্যামেরা সঞ্চালন যেমন হাই তুলতে বাধ্য করে, ওদিকে তামিল টাইপের মারমার কাটকাট দ্রুতগতিও সমান বিরক্তি বা মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সিনেমা যদি জগৎ-সংসারের কাহানি হয়ে থাকে তবে সিনেমাটিক এক্সপোজার-এ গতির ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। সুষম গতির সিনেমা টেক্সটরূপে পাঠের সুখ মনে বহায়। গণ্ডায়-গণ্ডায় ছবি বানিয়ে কি লাভ যদি দর্শক সেগুলো দেখার পরে বেমালুম ভুল মেরে যায়?

বিক্রমের ছবি এইসব কথা ভাবলে মনে স্বস্তি জাগায়। প্রায় দেড় ঘণ্টার ফ্রেমে বাঁধাই ছবিতে পরিচালকের ক্যামেরা প্রক্ষেপণকে ধীরগতির মনে হয়নি। আবার অনাবশ্যক জোরেও ছোটেনি। সুতরাং হাই তোলা ও বিরক্ত বোধ করার সুযোগ দর্শক বিশেষ পায় না। গল্পটি ক্যামেরায় ধারণের স্বার্থে বাস্তবিক যেটুকু গতি দরকারি ছিল তিনি নিজেকে সেখানে সীমাবদ্ধ রাখায় আসা যাওয়ার মাঝে-কে ‘ভালো’ ছবি ভাবতে আপত্তির কারণ থাকে না।

এই আঙ্গিক-কুশলতায় সুস্থির থাকার কারণে বিক্রমের ছবিটি চোখের জন্য পীড়াদায়ক অভিজ্ঞতা হয়নি। সেইসঙ্গে সত্যটি খোলাসা হয়, — সংসারযাপনের ছকে প্রতিদিন ঘর-বাহির করলেও ছবির দম্পতি নিজেদের মধ্যে নীরব বোঝাপড়া ও সন্ধিটা সেরে ফেলেছে! ছাপোষা নাগরিক জীবনের গ্লানি দুজনকে তাই নাগালে পায় না। তারা বুঝে নিয়েছে জীবনকে এভাবে যাপন করতে হবে। কোটি জনতা শহরে দাম্পত্যটা এভাবে প্রত্যহ যাপন করছে। চরৈবতির মন্ত্রকে সহজাত ভাবতে পারলে ছাপোষা পরিশ্রমী জীবনকে মানুষের পক্ষে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। নিজের ওপর হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ার প্রলোভনকে সেখানে সুযোগ দেওয়া যাবে না, এছাড়া নৈরাশ্যের চাপ ঠেকিয়ে রাখা কঠিন। বেঁচে থাকার লড়াই ধ্যানের শামিল। একঘেয়ে ছকে ধ্যানস্থ দম্পতির জীবনে সেই ফাঁকখানি তবু আসে যেখানে পৌঁছানোর পর দর্শক প্রেমের সুবাস টের পায়। বিক্রম মূলত সেটি দেখাবেন বলে ছবিখানা বানিয়েছেন।

নুতন অঙ্গে প্রেমের গল্প ফাঁদার এই দিকটি দর্শকের পড়তে ভুল হয়নি। স্বামী ছাপাকলের কাজ সেরে সকালে বাড়ি ফিরে আর ওদিকে স্ত্রী কাজে বেরিয়ে যাবে বলে নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে; — ছবির অন্তভাগের দৃশ্যায়নে কাহিনি পরমক্ষণে পৌঁছায়। দর্শক টের পায় ওরা দুজন প্রেমের টানে বাঁধা। সংসারের চাকায় কলুর বলদ হয়ে ঘুরলেও সক্কালবেলায় দুজনের ক্ষণিক সাক্ষাতে ক্লান্তি ও তিক্ততা যে-কারণে জায়গা করে নিতে পারে না। পরস্পরের প্রতি মৌন অনুরাগের রেশ সেখানে তরঙ্গ তুলে যায়। ধ্যাড়ধেড়ে জীবনের রিলে রেসে জয়ী হওয়ার দৌড়ে লিপ্ত হলেও জীবনের চৌহদ্দিতে গ্লানি বা তিক্ততার অনুপ্রবেশকে তারা স্থান দিতে ইচ্ছুক নয়; — এই বার্তার জোরে ছবিখানা একাধারে ভারতীয়, মরমি ও বিশ্বজনীন বলে নিজেকে দাবি করতেই পারে। প্রতিকূল যুগবিশ্বে ইতিবাচক মনোসংকেতকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা শক্ত কাজ হলেও দর্শকমনে বিক্রম সেটি গেঁথে দিতে পেরেছেন। ঋত্বিক চক্রবর্তী ও বাসবদত্তা চ্যাটার্জির জীবনে নীরবে বহমান প্রেমের সুবাস অগত্যা ছবির অন্তে এসে ভীষণ দামি মনে হতে থাকে।

ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে ঋত্বিকের চোখেমুখে মৃদু হাসির সঙ্গে সরল বিস্ময় খেলা করে! বহুদিন পর প্রিয়জনকে দেখতে পেলে যে-বিস্ময় মানুষের মনকে স্নিগ্ধ ও নির্ভার করে ছবিতে তার হাসিখানা সেরকম বটে! বাবসদত্তাকে সে বহুদিন পর দেখছে! — ঋত্বিকের বিস্ময়াতুর হাসি এই বার্তাটি জানিয়ে দিতে উদগ্রীব থাকে। কাজ শেষে ঘরে ফেরার এইসব মুহূর্ত তাদের জীবনে রোজকার ঘটনা। স্ত্রীকে এভাবে দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা সেখানে নতুন কিছু নয়। ঋত্বিকের সেটি জানা থাকলেও তাকে অনেকদিন পর দেখছে এমতো এক অনুভব নিজ হৃদয়ে সে জমা রাখে বলেই মনে হয়েছে। তার জীবনশক্তি ওই অনুভশক্তির জোরে হয়তো প্রতিদিন সতেজ হয়ে ওঠে!

চা পানের ক্ষণে স্বামী-স্ত্রীর নীরবতা মনকে মেদুর করে যায়; আর, স্ত্রীর শাড়িকে সেফটিপিন দিয়ে ব্লাউজে গেঁথে দেওয়ার মুহূর্তে বাসবদত্তার লাজুক-নরোম হাসির ছটায় দুজনের বোঝাপড়া ও সন্ধি নীরবে কথা কয়ে ওঠে।  তাদের মনের তারে বিরাম নেওয়ার ভাবনা হয়তো খেলে যায়। কোথাও ঘুরে আসার কল্পনায় মন উদাস হয়ে ওঠে। কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে বনভূমিঘেরা টিলায় তারা তখন বেরিয়ে পড়ে। সকালের নরোম রোদে টিলার একচিলতে সমতলে রাখা পালঙ্কে ঋত্বিকের কাঁধে মাথা রেখে বাসবদত্তা চুপচাপ বসে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কাজে বের হওয়ার সময় হয়েছে দেখে ঝটপট উঠেও পড়ে। উপসংহারের কল্পদৃশ্যটি ছবির প্রাণভোমরা। কুরোশাওয়ার ড্রিমস  ছবির দৃশ্যায়ন চকিত চোখে ভাসে। চেরিফুলে রঙিন বনানী সেখানে কুঠারের আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিন্তু অবুঝ বালকের মনে চেরির আগমনে পুষ্পিত বসন্তের ছবি বেঁচে থাকে। বালকের মনের বসন্তে চেরি অবিরত ফুল ফোটায় আর তাকে মিথ্যা ভাবা দর্শকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিক্রমের সিনেমাটিক মন্তাজটি সে-রকম। সকল শ্রান্তি ও অবসাদ হরণের আয়ুধ যেন সেখানে লুকিয়ে থাকে! এর নাম হয়তো প্রেম। এর নাম মায়া এবং এটি হয়তো ভালোবাসা। বিক্রমের গল্পের দম্পতি সেখানে একে-অন্যের চিরজন্মের মিতে।

ছবির সমাপ্তিদৃশ্যে বাসবদত্তা কাজে বেরিয়ে গেলে বিসমিল্লাহ খানের সানাই আবহে ডুকরে ওঠে। ঋত্বিক যেন চাইছে না সে বেরিয়ে যাক কিন্তু না গিয়ে উপায় নেই। বুঝতে বাকি থাকে না খাটুনিভরা ছাপোষা জীবনের সঙ্গে তাল দিয়ে একে অন্যকে ভালোবেসে যাওয়ার মন্ত্র তারা রপ্ত করে নিয়েছে। সুদিনের অপেক্ষায় পরস্পরকে সহ্য করতে শিখেছে। দায়িত্বের বোঝা বয়ে চলার যান্ত্রিকতা তাদের মনকে পিষে মারতে পারেনি। একে অন্যকে অনুভব করার দম যন্ত্রজীবনের ছক থেকে দুজনে ছেকে নিচ্ছে প্রতিদিন। ছাপোষা জীবন মানে নিঃশেষ হওয়ার গল্প নয়; — ইতিবাচক বার্তাটি ছবির পরিচালক কী করে জানি সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন! নগর কলকাতা ও তার একঘেয়ে খাটুনির জগৎ গল্পের চরিত্রদের পরাভূত করতে পারেনি। এই দম্পতির প্রেম ব্লাউজে আটকানো সেফটিপিনে বাঁধা। এর নাম সন্ধি। এর নাম বোঝাপড়া।  মানুষের জীবনের উঠানে ভালোবাসার সহজ এই গভীরতা ক্রমশ জাদুঘরে নির্বাসিত হলো বলে।

হাঙ্গেরির প্রণম্য পরিচালক বেলা টার-এর ছবির জগতে নীরবতাকে মহার্ঘ হতে দেখেছি। নুরি বিলজে সেইলান কিংবা ফিলিপাইনদেশি লাভ ডায়াজে মৌনতার গুঞ্জন স্থানকালপাত্র বুঝে মহিমান্বিত চরিত্র ধারণ করেছেন। জীবনের খাটুনি ও একঘেয়ে লয়তালকে বেলা টার ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন এইটে ধরিয়ে দিতে, — মানুষের জীবনে বলার মতো বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট নেই, সুতরাং যত কম বলে নীরব থাকা যায় জীবন তাতেই সহনীয় হয়। যা-হোক, সে অন্য অভিজ্ঞতা। বঙ্গসন্তান বিক্রম ভিন্ন পথে মোড় নিয়েছেন। বক্তব্য রাখার চেষ্টা তিনি করেননি। এই অনুভব শুধু মনে সুবেদি হয়ে বহে যার কথা সমরেশ বসু তাঁর টানাপোড়েন আখ্যানে অন্য প্রাসঙ্গিকতায় উচ্চারণ করেছিলেন: — ‘জীবনটা বুনা হইচ্যে, টানা ভরণায় বুনা হইচ্যে। জীবন বুনা কর।’ বিক্রমের সিনেকাহানি দেখতে বসে বসুর কথাগুলো কানে খট করে তরঙ্গ তুলে মাত্র বিদায় নিলো!


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you