ঢাকাই ছবি : নিকট ও সাম্প্রতিক : জনরা ও বিবিধ আলাপ-২
শাকিবযুগে পৌঁছে ঢাকাই সিনেমার অচিহ্নিত প্রশ্নবোধকে পরিণত হওয়ার ঘটনা বাদ দিয়া অগত্যা আশি-নব্বইয়ের সন্ধিক্ষণে আরেকবার ফেরত যাই। প্রাক্তনদের জায়গা পূরণে চম্পা-দিতি-কাঞ্চন-রুবেল ও কতকক্ষেত্রে বাপ্পা রাজ সেই সময় দেখা দিলেন বটে কিন্তু পাবলিকের হলে গমনের অভ্যাসে ততদিনে গয়ংগচ্ছ ভাব দেখা দিয়াছে! মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো স্যাটেলাইট টিভিচ্যানেলে একতা কাপুরের সোপ অপেরার সঙ্গে হিন্দি সিনেমার নয়াতরঙ্গ পথের কাঁটায় পরিণত হয়েছিল। জহির রায়হান, এহতেশাম, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত, চাষী নজরুল ইসলাম, আমজাদ হোসেন, মনতাজুর রহমান আকবর, আব্দুস সামাদ, কাজী জহির, মিতা, শিবলী সাদিক, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আলমগীর কবীর আর একেএম জাহাঙ্গীর খানদের ক্যামেরাসৃষ্ট লিগ্যাসিতে ঘুণ ধরায় সিনেমাহলে কাটার মতো ছবির আকাল শুরু হয়। ষাট থেকে নব্বইয়ের পর্বান্তরে বাংলাদেশের সিনেভাষায় নয়াবাস্তবতার তরঙ্গ বলতে দর্শক জীবন থেকে নেয়া, সূর্য সংগ্রাম, সূর্য গ্রহণ, আলোর মিছিল, মেঘের অনেক রং, অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, আবার তোরা মানুষ হ, ওরা এগারো জন, হাঙর নদী গ্রেনেড, সারেং বউ, গোলাপি এখন ট্রেনে অথবা ভাত দে ঘরানার সিনেমাই বুঝত। এই জনরার বাইরে উত্তম-সুচিত্রার আবেশঘন রোমান্সের সঙ্গে পাল্লা দিয়া বানানো হারানো দিন, রাজধানীর বুকে, কখনো আসেনি, সুতরাং, স্বরলিপি, নীল আকাশের নীচে, অবুঝ মন আর বাংলা গল্প-উপন্যাসে ভর দিয়া দাঁড়ানো ছবিগুলা মধ্যবিত্ত নাগরিক দর্শককে হলে টানার কাম সেরেছে।
উপরোক্ত দুইখান জনরা বাদে খান আতার কামিয়াবির কথা বিশেষ স্মরণ হয়। গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মিত সুজন সখী তাঁকে ট্রেন্ডসেটারের মহিমা এনে দিয়াছিল। ছবিখানা গ্রামীণ যুবকের চরিত্র রূপায়ণে ফারুককে অপরিহার্যতা দানেও ভূমিকা রাখে। শহুরে বা গ্রামীণ সকল চরিত্রে সাবলীল নায়করাজ রাজ্জাকের স্টারডমে ফারুকের পৃথকযাত্রা তাঁকে রাজ্জাকের প্রতিযোগী করে তুললেও হাইপটা বেশি দিন স্থায়ী হয় নাই। গ্রামীণ জীবনধারায় বিদ্যমান পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমপিরিতি ও গ্রাম্য রাজনীতির ধারায় সুজন সখী নতুন মাত্রা যোগ করায় নব্বইয়ে এসে পুনরায় রিমেক হয়। সালমান-শাবনুরের কাস্টিংয়ে শাহ আলম কিরণ খান আতার সৃষ্টিকে পুনরায় নতুন করে জীবিত করেন। যতদূর জানি ছবিটি হলে রৈ রৈ করে দর্শক টেনেছিল। সালমান শাহের জন্য সুজন সখী বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমির খানের ছবির রিমেক কেয়ামত থেকে কেয়ামত সালমানের গায়ে শহুরে লাভারবয় ইমেজের ছাপ্পা ততদিনে অকাট্য করে তুলেছে। ইমেজটা ভেঙে বের হওয়ার সঙ্গে ফারুককে অতিক্রম করার ব্যাপার ছিল সেখানে। সালমানের সহজাত অভিনয়প্রতিভা আর ওদিকে শাবনুরের সঙ্গে কেমিস্ট্রি তখন কামে দিয়াছিল।
নব্বইয়ের স্টারডমে শহর বা গ্রামের ছটফটে প্রাণবন্ত নারীচরিত্রে শাবনুর অটোমেটিক চয়েস ছিলেন। সুজন সখীর কবরীকে রিমেকে তিনি অনেকটা ভুলতে বাধ্য করেন। শাবনুরের দেহভঙ্গি, অভিব্যক্তি ও নাচের মধ্যে যে-মোক্ষম এ্যানার্জি বাহির হয় নির্মাতারা তাকে বুভুক্ষের মতো ব্যবহারে দ্বিধা করেন নাই। দস্যি, চঞ্চলা, ছটফটে, অভিমানী ইত্যকায় সিনে অবিরাম ব্যবহৃত হওয়ার দোষে ভার্সাটাইল অভিনয়শিল্পীর যেসব গুণ সঙ্গে নিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু সেগুলা প্রমাণের সুযোগ কপালে জোটে নাই। সত্যজিৎ রায় ববিতাকে অশনি সংকেত-এ চয়েস করেছিলেন। ঋত্বিক তিতাস বানানোর সময় রোজি সামাদের সঙ্গে কবরীকে কাস্টিং করেন। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও গৌতম ঘোষ নিজেদের ছবিতে চম্পার ভিতরের ঘুমন্ত অভিনয়শক্তিকে বের করে এনেছিলেন। শাবনুরের ভাগ্যে সে-রকম কিছু জোটে নাই। ঢাকাই ছবির কারখানায় Most exploited actress-এর নাম নিলে তাঁর কথা আগে মনে পড়ে।
পরিচালক মতিন রহমান নারীর মন বা এই টাইপের নাম দিয়া একখানা সিনেমা সেই সময় রিলিজ করেছিলেন। বিয়ের ফুল ছবিতে রিয়াজ-শাবনুর জুটি হিট করায় মতিন এই ছবিতে তাদের আবার ফেরত আনলেন। সঙ্গে শাকিল খানও ছিল। বলাবাহুল্য ছবিটা হলে দারুণ কেটেছিল। দ্বৈত প্রেমের কাহানি। কবিতা লেখার বাতিকে আক্রান্ত রিয়াজ শাবনুরকে ভালোবাসে কিন্তু কবিসুলভ অ্যবসার্ড খাসলতের দোষে মনের কথা বলতে পারে না। শাকিল-রিয়াজ দুইজন দোস্ত হইলেও তাদের জীবনে শাবনুরের আগমন প্রেমের সুবাস নিয়ে হাজির হয়। দু-জনে তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। যদিও শাবনুরের হাবভাবে শাকিলের প্রতি টান ছবিতে গোপন থাকে না। ঘটনা টের পেয়ে রিয়াজ উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ক্ষোভ-হতাশা চাপা দিতে ব্যর্থ কবি এইবার বারে গিয়া ঢোকেন। তরল পানীয়ের প্রভাবে অভিভূত রিয়াজের কবিমনে তীব্র যৌন-আক্রোশের সঞ্চার ঘটান পরিচালক মতিন। তার মনে হইতে থাকে বারে সে ও শাবনূর ছাড়া কেউ নাই। প্রিয়কে না পাওয়ার হতাশায় দানবীয় আত্মনিগ্রহের সঙ্গে রিয়াজের কবিহৃদয়ে শাবনুরকে ধর্ষণের ইচ্ছা জাগ্রত হয়। জেমসের বিখ্যাত মীরাবাই-র জায়গায় শাবনুরকে সে বসায় এবং তীব্র কামনিগ্রহে তার দেহ জর্জরিত করতে থাকে। অতুল শক্তি দিয়া জেমস গানটি গাইতে থাকেন আর ওদিকে শাবনুরের দেহের কামঘন চোরাটানকে চাবুকের কশাঘাতে রক্তাক্ত করে রিয়াজ নিজের নিষ্ফল মনোবাসনা ও দানবীয় আত্মনিগ্রহ স্খলনে উন্মত্ত হয়।
এন্তার প্রেমের কবতে লিখেও প্রেমিকাকে প্রেমের সিগন্যাল জানাইতে ব্যর্থ রিয়াজের হয়ত মনে হয় বাস্তবে নাই-বা হলো, কল্পনায় শাবনুরের দেহকে নিজের পুরুষত্ব দিয়া ধ্বংস করতে হবে, অন্যথায় এই মোহটান থেকে তার মুক্তি নাই। দানবীয় যৌননিগ্রহ তার চাই যা আর কোনোদিন শাবনুরকে তার স্মৃতিতে জাগায়া তুলতে পারবে না। তার হাসি ও চোখের মণি থেকে ছিটকানো প্রেমের সুবাসকে কবর দিতে যা-কিছু সহযোগে ঈশ্বর এই নারীকে পুরুষের ভালোবাসার যোগ্য ও হাহাকারের কারণ করে গড়েছেন সেই কারণকে প্রহারে জর্জরিত করে তোলা জরুরি। বলাবাহুল্য, পেসিমিস্ট আত্মনিগ্রহ থেকে কবিকে উদ্ধার করতে পরিচালক আত্মত্যাগের দিকে মোড় ঘোরেন। এখন আর সবটা স্মরণ নাই, তবে যতদূর মনে পড়ে শাকিলকে বলি দিয়া পরিচালক রিয়াজের পাগলামির ইতি টেনেছিলেন বোধহয়।
বাংলা সিনেমায় অতিআবেগের বাড়াবাড়ি বিবেচনায় জেমসের মীরাবাই গানের মতিনকৃত দৃশ্যায়ন যৌন-সুড়সুড়ির দ্যোতক, তবে কবুল করা প্রয়োজন, জগৎ জুড়ে বিরাজিত পুরুষগণের মনের তারে বহমান আত্মনিগ্রহ ও ধর্ষণেচ্ছা কখন কোন ঘটনায় আচমকা বিস্ফারিত হবে সে-কথা স্বয়ং দেব-ন-জানন্তি। সুতরাং এই জায়গা হইতে মতিনের কোরিওগ্রাফিকে মন্দ বলা যাবে না। বেহুদা অতিনাটকীয়তা মাথায় পেইন ধরায় কিন্তু জেমসের গানের প্রভাবেও হইতে পারে শাবনুরের দেহ নিয়ে রিয়াজের তুলকালাম যৌনগূঢ়ৈষা বাংলা সিনেমার চিরাচরিত যৌনসুড়সুড়ির আবেদন মনে তীব্র করে না। অ্যাবসার্ড দৃশ্যায়নের সঙ্গে কোরিওগ্রাফির ধাক্কা সামাল দিতে পেরেশান দর্শকের কামবাই আপনা থেকে সেখানে নেতিয়ে আসে।
খেয়াল রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশের জনরুচির বৃত্তে একজন লারস ভন ট্রায়ার, সেইজুন সুজুকি, রাশ মেয়ার, তারানতিনো এখনো সম্ভব নয়। মেয়ারের দ্য ইমমোর্টাল মি. টিজ এন্ড ‘ন্যুড সিটিজ’, ট্রায়ারের নিম্ফোম্যানিয়াক, তারানতিনোর পাল্প ফিকশন এবং হলিউডের কারখানা হইতে প্রতিনিয়ত বেরিয়ে আসা এ-রকম অসংখ্য ছবি উপমহাদেশের আদলে রূপদান অবান্তর ঘটনাই বটে। সমাজে বহমান বিচিত্র যৌনসংস্কারকে আঘাত করার সিনেভাষায় গমন ঢাকা কিংবা উপমহাদেশের নির্মাতাদের জন্য এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণের শামিল। অপর্ণা সেনের পরমা, দীপা মেহতার ফায়ার, ঋতুপর্ণ ঘোষের চিত্রাঙ্গদা, গিরিশ কারনাডের উৎসব, অমিতাভ চক্রবর্তীর কসমিক সেক্স, অমিত সাক্সেনার জিসম, অনুরাগ বসুর মার্ডার, সৃজিত মুখার্জির নির্বাক কিংবা কিউ ওরফে কৌশিক মুখার্জির বিষ ও গাণ্ডু যৌনসংস্কৃতির বিচিত্র জালে বন্দি ও অবদমিত দর্শকের ভাবনার জগতে টোকা দেওয়ার চেষ্টায় নগণ্য নজির মাত্র। আত্মনিগ্রহ, স্বমেহন, ধর্ষণেচ্ছা ছাড়াও সমাজে বিরাজিত বিচিত্র যৌনবৈকল্যের নেপথ্যে সক্রিয় জটিলতাকে ভাষা দিতে কামিয়াব সিনেভাষা এখনো দিল্লি হনুজ দূর অস্ত (*দিল্লি এখনো বহুত দূর) প্রবচনের স্মারক।
বঙ্গ তথা উপমহাদেশের আমজনতা নিজের দেহমনে শিকড় ছড়ানো যৌনসংস্কৃতিকে যেভাবে সচরাচর নিরিখ করে থাকে এই ছবিগুলা তার যোগ্য প্রতিধ্বনি নয়। যৌনাচারকে কেন্দ্র করে শতেক ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারে জেরবার দর্শকমনে প্রতিঘাতস্বরূপ বিচিত্র অবদমন অহরহ পয়দা হয়ে থাকে। অবদমনগুলা আবার যৌনফ্যান্টাসির মাঝে নিগমন নিতে চেষ্টা করে। দ্বৈততাভারাতুর যৌনবোধের জগৎকে উন্মোচন করতে জানে এমন সিনেভাষার আকাল ঢাকা ও মোটা দাগে উপমহাদেশের ছবি তৈরির কারখানায় কমবেশি বিদ্যমান। স্বপ্নদোষ, হস্তমৈথুন, সমকাম, উভকাম, পরস্ত্রী সম্ভোগের বাসনা বা ধর্ষণেচ্ছা, কিশোরীমৈথুনমোহ, লুকিয়ে-চুরিয়ে নারীদেহকে নজর করার দুর্বার পিপাসা হইতে জন্ম নেওয়া ভয়েরিজম, এবং এ-রকম শতেক আকারের যৌনবাসনা ও বিকার ঘিরে সৃষ্ট নৈতিক দ্বন্দ্ব ও অবদমন পুরুষবাদী সংস্কৃতির পোক্ত বনেদে থিতু উপমহাদেশের জনমনকে নিত্য শাসন করে যায়। দীপা মেহতা বা অপর্ণা সেনদের ছবিতে বিষয়গুলা সাবজেক্ট হিসেবে উঠে আসলেও এর বার্তা অবধানের ধীশক্তি সিংহভাগ সিনেদর্শক রাখে কি না সেই সন্দেহ থেকে মুক্ত হওয়া খুবই দুষ্কর।
পরমা বা ফায়ার আলোচনার ঝড় তুললেও হলকাটতির ঘটনায় এ-কারণে পিছায়ে থাকে। নারী-সমকাম ও পরকীয়ার মতো স্পর্শকাতর ঘটনার চিত্রায়নে নারীকে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত করার পুরুষবাদী মানসিকতার দিকে মোক্ষম বাণ হানলেও তাঁদের ছবিতে পুরুষবাদ নিছক প্রতিপক্ষের অতিরিক্ত ভাষায় কথা বলতে অপারগ থাকে। নারীবাদী ছকে বোনা গল্পের সাহায্যে তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ইমেজগুলাই ছবিতে অবিরত অনুরণন তুলে যায়। উপমহাদেশের যৌনসংস্কৃতিতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষের মনে বিরাজিত যৌনাচারকে ঘিরে সক্রিয় বিচিত্র টাবুজাল ও ফ্যান্টাসির জগতে তার নিগমন তালাশে মরিয়া পুরুষবাদী সমাজের মনোসংকট ছবির দৃশ্যায়নে জীবিত করার ঘটনায় উনাদের ক্যামেরা বিরত থাকে। পুরুষবাদী মনোজগৎ দ্বারা শাসিত সমাজের দিকে অঙ্গুলিহেলনে অভ্যস্ত এইসব সিনেভাষা আজোবধি ম্যারি ওলস্টোনক্রাফট আর সিমন দ্য বোভোয়ারের মনোবিশ্বে দাঁড়ায়া দর্শকচেতনায় আঘাত হানতে আকুলান হয়। আমদর্শকের কাছে অগত্যা ছবিগুলা সেই বস্তু হয়ে ওঠে যেখানে রাখী গুলজারের পরপুরুষের সঙ্গে দেহমিলন অথবা শাবানা আজমী ও নন্দিতা দাশের নারী-সমকামের সিনগুলা সে বুভুক্ষের মতো নজর করে এবং নিজের ফ্যান্টাসি চরিতার্থে কামে লাগায়। সিনগুলার বাইরে যা-কিছু ঘটে সেগুলাকে সে যথারীতি ইগনোর করে ও ছবি শেষ হইতেই নিজের সংস্কারের গহ্বরে ফেরত যায়।
নারীর একখান দেহ আছে এবং সেই দেহের স্বত্বাধিকারী পুরুষ নয়; দেহখানা বিনিময়যোগ্য হইতে পারে একমাত্র ভালোবাসার শর্তে এবং তার বাইরে নয়; — যৌক্তিক এই বার্তা দীপা, অপর্ণারা ছবিতে উঠায়ে আনলেও দর্শকের তাতে থোড়াই যায় আসে। যাইত, যদি সিনেপর্দায় নারীদেহের স্বত্ব বিষয়ে পুরুষবাদী সংস্কারকে আঘাতের সঙ্গে ফ্যান্টাসিভারাতুর অবদমনের জগতে সচল সংকটকে তাঁরা দৃশ্যে তুলে ধরতেন। নারীর দেহমনের অধিকার নিয়ে জন্মলগ্ন হইতে সোচ্চার নারীবাদী ভাবনার পুরাতন ছকে বসে বানানো সিনেভাষার সাহায্যে পুরুষবাদী মনোবৈকল্যের সংক্রামে জর্জরিত সামাজিক নারী বা পুরুষকে আত্মসমালোচনায় গমনে প্ররোচিত করা ভীষণ শক্ত কাজ। দেহমনের স্বত্ব বুঝে নিতে অটল নারীর জীবনে পুরুষবাদী সংস্কৃতি অবিরত প্রতিপক্ষের রূপ ধারণ করে। এই সংস্কৃতিকে মিত্র ভাবা তার পক্ষে সম্ভব নয় আবার পরাভূত করতে গেলে সমকক্ষ হইতে হয়। সমকক্ষ হওয়ার ভাবনায় গমনের পর পুরুষবাদী সংস্কৃতির নেতিবাচক শক্তিগুলা নারী অকাতরে নিজ দেহমনে টানতে থাকে। স্বকীয় ছকে নারীর নারী হয়ে ওঠার সিনেভাষা এ-কারণে ঢাকা বা উপমহাদেশের ছবিতে আজো আনায়াস নয়!
ধরা যাক সে রেসলার বা পালোয়ান হইতে চায়। এখন সেটা হইতে গেলে পুরুষবাদী সংস্কৃতি পালোয়ানের যে-ভাষায় নিজেকে ব্যক্ত করে তার বাও রপ্ত করা ছাড়া বিকল্প পথে পালোয়ান হওয়ার সুযোগ বা সেরকম পরিবেশ নারীর জন্য থাকে না। পুরুষ এখানে যেসব সহিংসতা জন্ম দিয়া যায় নারী সেগুলাকে অকাতরে নিজ দেহে টানে! তার মনে ভাষা-সৃজনের এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন বা সংশয় জাগ্রত হয় না। কপিক্যাট-এর ভিতর দিয়া রূপান্তরিত ও কুস্তির রিংয়ে আবিভূর্ত নারী দিনের শেষে নারীদেহধারী পুরুষ বৈ অন্য কিছু নয়! আপাত দৃষ্টিতে একে প্রগতি ভাবতে মন চায়। আমির খানের দঙ্গল-এ গীতা পোগাতের কুস্তিগির হওয়া নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে প্রশংসনীয় অগ্রগতি বটে। নারীর পালোয়ান হইতে বাধা নাই এবং থাকা উচিত নয়, কিন্তু পালোয়ানের ভাষাকে কেন সেখানে পুরুষবাদের বয়ানে সৃষ্ট ভঙ্গিতেই সর্বদা কথা বলতে হবে? প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষণে অথবা তাকে কুস্তির প্যাঁচে ধরাশায়ী কিংবা সকল নিয়ম ভেঙে বেদম পিটুনি দেওয়ার মুহূর্তে সৃষ্ট সহিংসতাকে কেন মাচোম্যানের কায়দায় নারী পালোয়ানকে সবসময় ডেলিভারি দিতে হয়? নারী সংস্করণের উপযুক্ত ভাষা কি সেখানে জন্ম নিতে পারে না, যেটা নারীর দেহে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিরাজিত জৈবগুণকে পুরুষের ধাঁচে রূপান্তরিত না করেও তাকে পালোয়ান হিসেবে তুলে ধরতে সক্ষম? পালোয়ানগিরির স্বকীয় ভাষা সৃজনের ব্যাপারে নারীবাদী সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের ভাবিত হইতে দেখা যায় না।
রেসলিংয়ের রিংয়ে আবির্ভূত পালোয়ান নারীটি পুরুষের নিজ হস্তে তৈয়ার ফ্যান্টাসিতে রূপ নেয় ও পুরুষবাদী ভাবনায় থিতু দর্শককে বিনোদিত করে যায়। সে দেখতে এখন পুরুষের প্রায়। তার যৌনাবেদনে প্রকৃতিসৃষ্ট জৈবগুণ অবসন্ন বা সিনথেটিক। সে আর অনন্য শক্তি ও সৃজনে স্বকীয় যোনিধারী নারী নয় বরং পুরুষাঙ্গের অনুরূপ কিছুর উদাহরণ! পুরুষের অবিকল দেহের ওপর ভর করে ভালোবাসার পুরুষ অথবা নারী-সমকামী হইলে নারীতে সে উপগত হইতে চায়। তার দেহে যে-শক্তি এখন টগবগ করে সেখানে জৈব-কোমলতা ক্রমশ লোপ পাইতে থাকে নতুবা এই কোমলতাকে দুর্বলতা ভেবে সে তাকে নিজের দেহ হইতে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে। তাকে শেখানো হয়, পুরুষবাদী সমাজে নিজের সমকক্ষতা প্রমাণে বিষ দিয়া বিষ মোক্ষণ ছাড়া উপায় নাই। ঘায়েল করার ভাবনা নারীর মনোজগতে দৃঢ় হওয়ার ফলে পুরুষবাদী ভাবনাছকে নারীকে নতুন অঙ্গে সৃজনের বৈচিত্র্যে নয়া মাত্রা যোগ হয় কেবল!
এই নারী পালোয়ানকে নিজের পাল্টি হিসেবে ভেবে পুরুষ সুখ পায় ও তাকে জয় করতে অধিক কর্তৃত্ব বা শক্তি ফলায়। রেসলিংয়ের রিংয়ে নারী কুস্তিগির পুরুষের ডার্লিং বা বেইবি বা আদর করে ডাকা বিচ। তাকে জয় করতে এক পালোয়ান অন্য পালোয়ানকে বেদম পিটুনির ফন্দি আঁটে। নিজের দেহের জৈবগুণকে ক্রমাগত পুরুষদেহের জৈবগুণে বদলে নিতে থাকা রেসলার, বক্সার বা বডি-বিল্ডার নারী প্রগতির স্মারক হইলেও পুরুষবাদ সৃষ্ট শক্তিমত্তার জগতে নতুন বিনোদনের উপায়। তাকে স্বকীয়তা বর্জিত নকল পুরুষ বলে আখ্যা দিলে বোধহয় ভ্রম হয় না! নারী ও পুরুষ এই দ্বৈত রূপে পুরুষ পালোয়ান সে-নারীকে সম্ভোগ করে ও নিজের উভকামী বাসনা মিটায়। অপর্ণা সেনদের নারীবাদী ভাবনায় বোনা আপাত যৌক্তিক সিনেভাষাকে দর্শক এই সমস্ত কার্যকারণ দোষে সহজে ইগনোর করতে পারে ও নিজ সংস্কারে ফিরে যায়। প্রকৃতিসৃষ্ট সহজাত গুণ দেহে ধারণ করে নিজেকে পুরুষের সহগামী করে তোলার নারীবাদ কেমন হইতে পারে তার নাগল ধরতে দীপা, অপর্ণা প্রমুখদের ছায়াছবির তুলনায় জীববিজ্ঞানী ও চিত্রশিল্পী ডেসমন্ড মরিসের ছয় পর্বে বোনা টিভিডকুমেন্টারি দ্য হিউম্যান সেক্সেস বরং অধিক কামে দেয়।
যৌনাচারকে কেন্দ্র করে নৈতিক দ্বন্দ্ব মানবসমাজে বহুদিনের পুরানা ঘটনা। ওদিকে দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির উপায় তালাশে নেমে তাকে ফ্যান্টাসিঘন বিকারে অবমুক্ত করার ঘটনাও নতুন নয়। মনে রাখা ভালো, উপমহাদেশের দর্শকরা যৌনাচারে বিদ্যমান টাবুধ্বংসী দৃশ্য দেখার তিয়াসে সিনেমাহলে আদৌ গমন করে না। এই কালচার এখনো গড়ে ওঠে নাই। তারা বরং সেই সিনেমাটা দেখতে উন্মুখ থাকে যেটা ফ্যান্টাসির মোড়কে ঢাকা বিকারকে সরাসরি অবমুক্ত করতে জানে। বাস্তব নয় বরং তার মনমধ্যে পুঞ্জিভূত ভার্চুয়াল বা বায়বীয় পথে আবির্ভূত যৌনসংস্কৃতির স্মারক যে-নগ্নতা, তাকে পর্দায় দেখতে সে উতলা হয়। এই বায়বীয়তাকে সমাজ প্রকাশ্যে স্বীকার করে না কিন্তু লোকের মনের মণিকোঠায় ফ্যান্টাসি রূপে সে অধিক বাঙ্ময় আকার ধারণ করে। যারপরনাই ঢাকা তথা উপমহাদেশের সিনেপর্দায় যৌনতার উপকরণগুলা ফ্যান্টাসিঘন সিম্যুলেশনের সাহায্যে অবারিত করা ছাড়া নির্মাতার উপায় থাকে না।
বৃষ্টিধারায় নায়িকাকে সিক্ত করা। ঝর্ণা বা সাগরে তার উদ্দাম জলকেলি। স্নানাগারে তাকে সিক্ত হইতে পাঠানো। আঁখিপল্লব ও অধরের যৌথ সংগতে কামনাঘন বাসনার প্রকাশ। বাসররাতে কড়া অধররঞ্জকে রাঙানো ঠোঁটে কিংবদন্তির আপেলফলে কামড় বসানো অথবা দুধের গ্লাসে চুমুক দেওয়ার মুহূর্তে যৌনভারাতুর আবেশে নায়িকার রঙিন হয়ে ওঠা। আঁটসাঁট পোশাকে খাঁজভাঁজের প্রদর্শনী। নায়ককে ঘায়েল করতে দন্ত সহযোগে ঠোঁটে কামড়ানো ও কটাক্ষবাণ। ভিলেনের খপ্পরে ধর্ষিত হওয়ার ড্রামাটিক সিনে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের ঘটনাকে ফিরিয়ে আনার ছলে ছেড়ে দে শয়তান টাইপের ডায়ালগ সহ নায়িকার ছুটাছুটি ও ধ্বস্তাধ্বস্তি। নদী বা পুকুর ঘাটে গোপিনী সঙ্গে কৃষ্ণের লীলারঙ্গের আভাস জাগায়া তোলার মুহূর্তে নায়িকা রাধা ও সখীগণ সমাহারে নায়ক কৃষ্ণের যৌনাতুর ফিচলামি। নায়কের সঙ্গে নাচাগানার সিনে বক্ষদেশ ও নিতম্বের উত্তাল ঝাঁকি আর বেডসিনে পরস্পরের পদযুগল ঘর্ষণ … ঢাকাই ছবির অকাট্য ট্রেডমার্কগুলা সেই ফ্যান্টাসিকে অবারিত করে যা সমাজে বাস্তবে বিরাজ করে না কিন্তু দর্শকের মনে যৌনতার উপাচার রূপে তারা সদা জাগরুক থাকে!
সরাসরি নগ্নতা বা যৌনমিলনের দৃশ্যায়নে টাবুধ্বংসী ব্যাপার-স্যাপার থাকায় উপমহাদেশের দর্শক এইগুলা হয়ত দেখে কিন্তু দেহমনে অধিক জায়গা দিতে আকুলান হয় না। টাবুধ্বংসী নগ্নতার দৃশ্যায়নে তার ক্ষণিক যৌনমোক্ষণ হয় এবং ওই পর্যন্ত…! মূলত সে ফেরত যাইতে চায় সেইসব দৃশ্যে যেখানে নারী তার দেহকে গুপ্ত ছলনার ভাণ্ডার রূপে হাজির করে থাকে। এই ভাণ্ডারে স্নানদৃশ্য, বক্ষঝাঁকুনি, ক্লিভেজ বা স্তনের গিরিখাত বেয়ে নামা ঘামের ফোঁটা, ভিলেনের লোভাতুর চাহনি, ইঙ্গিতসূচক অশ্লীল বাক্য ও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে ছলকে ওঠা মুদ্রার স্থূল দৃশ্যায়ন ইত্যাদি তার মনে ঘাঁপটি মেরে থাকা অবদমিত বাসনাকে স্খলিত হইতে সাহায্য করে। সিনেপর্দায় নায়িকার নগ্নতা ও মিলনদৃশ্য সত্যজিৎ বা ঋতুপর্ণ কিংবা সৃজিত-কৌশিকরা যে-আঙ্গিকে ক্যামেরায় ধারণে প্ররোচনা বোধ করবেন, ঢাকাই ছবির কারখানায় বসে মালেক আফসারী, এফ. আই. মনিক বা সোহানুর রহমান সোহানের পক্ষে সেই তরিকায় ক্যামেরা সঞ্চালন অবাস্তব ঘটনা বৈকি!
বাস্তব জীবনে স্নানাগারের শাওয়ার হইতে নির্গত জলের ধারায় নায়িকা নিজেকে সিক্ত করেন কিন্তু ন্যাচারাল বাথ-এর এহেন দৃশ্যায়ন নির্মাতার কাছে অর্থহীন। দর্শকমনে যৌনাতুর আবেদন জাগায়া তোলার ক্ষমতা সে রাখে না। অন্যদিকে লিপিস্টিকরঞ্জিত জলসিক্ত অধর ও বক্ষযুগলের গিরিখাত বেয়ে নামতে থাকা জলের ধারার সঙ্গে নায়িকার বক্ষযুগলের আলোড়নে যৌনতার অকল্পনীয় বিস্ফার ঘটে, কেননা ঘটনাটি এখানে বাস্তব নয়। নায়িকার দেহ তখন আর জৈবদেহের অধীন নয়। ওটা এখন ফ্যান্টাসিঘন কামাচারের উপাদানে রূপ নিয়াছে! প্রসাধনচর্চিত অধর ও জলসিক্ত বসন ভেদ করে দৃশ্যমান দেহের প্রতিটি ভাঁজ সেখানে গোপন রহস্যের দ্যোতক! নগ্ন হওয়ার পরিবর্তে নগ্নতার ভানে নিঃস্ব রমণীদেহ অগত্যা দর্শকের কল্পনায় বিস্ময়ের খনিতে রূপায়িত হয়। বাস্তবের নায়িকাদেহে বিস্ময় যতটা-না বিরাজে তার অধিক এক বিদ্যমানতার কল্পনায় বিভোর দর্শক নায়িকাকে সম্ভোগ করে চলে। ঢাকাই ছবির নগ্নতা অথবা নারীদেহের তথাকথিত অশ্লীল চিত্রায়ন বাস্তবে যেসব কাল্পনিক উপাচার সহযোগে হস্তমৈথুনে নিয়োজিত ব্যক্তি নিজের স্খলনবাসনা মিটায় তার সমতুল বলা চলে।
স্নানের স্বাভাবিক নিয়মে নায়িকাকে নগ্ন করতে পরিচালক এখানে মোটেও ইচ্ছুক নয়, তাকে ততখানি নগ্ন করা হয়েছে যতখানি হইলে নগ্নতা ব্যাপারখানাকে অতিকল্পনার আরকে ডোবানো স্খলনসুখের উপকরণ ভাবা যায়। অর্ধ-অবারিত চিহ্নে যেসব বাসনাঘন ফ্যান্টাসির রাজত্ব চলে সেটা শিক্ষিতজনের কাছে অবসিন বা অশ্লীল গণ্য হইতে পারে, তবে ঢাকাই ছবির দর্শকের মনোজগৎ একে শ্লীল ভেবে নিজের অবদমিত কল্পনার মোক্ষণ ঘটায়। অবাস্তব এইসব স্থূলতা একমাত্র যা যৌন-অবদমনের কঠোর ঘেরায়তনে বন্দি মনকে বাস্তবাতীত বাস্তবতায় বিহার করানোর ক্ষমতা রাখে। ঢাকাই ছবির নির্মাতা ও দর্শকের যৌনসুখ যাপনের এমনধারা পদ্ধতিকে সংবেদি থিসিস আকারে পাঠ যাওয়া ব্যতীত বাংলা সিনেগল্পে নারীদেহের উপস্থাপনা বা দৃশ্যায়নে যুগপ্লাবী পালাবদল আকাশকুসুম কল্পনার শামিল।
যৌনবৈকল্যের নেপথ্যে সচল মনস্তাত্ত্বিক বাখান দেখতে বসে দর্শকের বিবমিষায় উপনীত হওয়া অথবা বনিআদমের দেহের শিরা-উপশিরায় বহমান প্রবৃত্তির সারসত্য লহমায় অনুভব করে আতুর বোধ করার সিনেভাষার জন্য বঙ্গ তথা ভারতবর্ষ এখনো প্রস্তুত নয়। তো এই জায়গা থেকে কাজী মতিনের নারীর মন ছবিখানার নাম পুনরায় নিতে হয়। ছবি হলে কাটলেও মীরাবাই গানের পটভূমিকায় রিয়াজ-শাবনূরের উত্তাল কামাচার দর্শক সেই সময় নিতে পারে নাই। রাখঢাকের মাঝে কাপড় উতরানোর সংস্কৃতির কথা ভাবলে মতিনকে অবশ্য মারহাবা দেওয়াই উচিত। মীরাবাইকে বাংলাদেশের জনরুচির সামনে তিনি ফ্যান্টাসিঘন ইরোটিক অঙ্গে হাজির করার চেষ্টা করেছিলেন। ঢাকাই ফিল্মের দৃশ্যায়নের ধারা বিচারে একটাই খুঁত ছিল সেখানে, — মরমে ইরোটিক হতে ব্যগ্র থাকলেও তথাকথিত অশ্লীলতা বা ভালগার বোধ করার অনুভবকে সেখানে খতম করা যায় নাই। মতিন এই জিনিসটা ঘটাইতে পারলে মীরাবাইয়ের দৃশ্যায়ন অন্য মাত্রায় উপনীত হইত।
নারীর মন ছবিতে শাবনুর আবারো প্রমাণ করেছিলেন বাংলার পরিচালককুল তার দেহের বিউটি কতভাবে কী কামিয়াবি ঘটাইতে জানে সেই জায়গাটা আবিষ্কার করতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়াছিলেন। জনরুচির প্রিয় শাবনুরের সঙ্গে মানায় এমতো ইমেজের অবিরাম উপস্থাপনা ভার্সাটাইল একখান দেহকে নিঃস্ব হইতে বাধ্য করেছিল। ওপার বাংলা থেকে ঋতুপর্ণাকে হায়ার করার বদলে শাবনূরকে দিয়া ইরোটিক জনরার সূত্রপাত ঘটানো যাইত এবং কাটপিসের যুগে প্রবেশের প্রাক-মুহূর্তে সেরকম পরিবেশ তৈরি কঠিন হইলেও অকল্পনীয় ছিল না। এখনো সম্ভব, তবে বিয়ে-থা করে সংসারী শাবনুরকে দিয়া সে-কাজ আর হওয়ার নয়। নুসরাত ফারিয়াকে হয়ত পরিচালক ভাবতে পারেন। তাঁর মধ্যে সেই যৌনাবেদন বিরাজ করে যা মীরাবাইয়ের সিনেমাটিক এক্সপোজারের জন্য জরুরি।
জেমসের গানের ভাব কী-ছিল-না-ছিল সেটা এখানে গুরুত্ব বহন করে না। সিনেমায় গানকে নতুন আঙ্গিকে বি-নির্মাণ শেষ কথা। অনুরাগ কাশ্যপ দেব-ডির সিনেভাষায় অরিজিনাল দেবদাসকে থোড়াই তোয়াক্কা করেছেন। যে-সময়ে বসে তিনি শরৎচন্দ্র থেকে থিম ধার করলেন সেই সময়ে ত্রিভুজ প্রেমের কাহানিকে বিচিত্র মাত্রায় ভাবা যাইতে পারে এবং ভাবা উচিত বটে। অন্যথায় প্রথা বিলোপকারী সিনেভাষার নবতরঙ্গ জাগ্রত হয় না। নব্বইয়ের পরিচালকরা এইসব কতটা কী ভেবেছেন সে ঈশ্বর জানেন! তামিল ছবির কাটপিসে ব্যস্ত আর পরে ময়ূরীর স্থূল বক্ষ ও কোমর দোলানো বেঢপ নৃত্যের তোড়ে সকল সম্ভাবনা নির্বাপিত হয়াছিল।
নব্বই এমনকি বাণিজ্যসফল লোককাহিনি ও রূপকথা নির্ভর ফ্যান্টাসির জনরায় নবতরঙ্গ আনতে বিফল হয়। ষাটের মধ্যভাগে পরিচালক সালাউদ্দিনের রূপবানকে দিয়া এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বাংলা সিনেভাষার সবেধন নীলমণি লিগ্যাসিটি নব্বইয়ে বেদের মেয়ে জোসনায় হল গরম করে তুললেও সালাউদ্দিনের রূপবান থেকে এই নির্মাণে পৃথক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। তোজাম্মেল হক বকুলের হাত ধরে দর্শকের হলমুখী হওয়ার আকস্মিক ঘটনাকে হুমায়ুন আজাদ তখন শূন্য নেতৃত্বের দেশে রুচির দুর্ভিক্ষ বলে স্বমহিম তাচ্ছিল্যে খারিজ করেছিলেন মনে পড়ে। কিন্তু তাতে কার কী যায় আসে! রূপবান, বিজয়িনী সোনাভান-এর পরে বেদের মেয়ে জোসনা ছিল তৃতীয় বিস্ফার যেটি সিনেমায় লোককাহিনি ও ফ্যান্টাসির দর্শকচাহিদার পালে পুনরায় ঢেউ দিয়াছিল। রূপবান-এর কাহিনি তার স্বকৃত পরাবাস্তব যৌনগূঢ়ৈষায় অতুল বিস্ময়ের স্মারক হইলেও নব্বইয়ে এর উপস্থাপনা লোককাহিনির হুবহু ছকে যদি ঘটে তবে সেটা সাহিত্যের নকলি আর নকলি হওয়ার পেছনে ক্যামেরা খাটিয়ে লাভ কি? প্রশ্নটা কেন জানি ঢাকাই চলচ্চিত্রে সাহিত্য-আহরিত সিনেমার ক্ষেত্রে সমালোচকরা পারতপক্ষে তুলতেই চান না।
হুমায়ূন আহমেদ একের-পর-এক ছবি তৈরি করেছিলেন। তাঁর ছবিগুলা দেখতে বসলে ছবি আর টিভিনাটকে তফাত ধরা কঠিন হয়। খর্চা বাঁচাইতে লারস ভন ট্রায়ার থিয়েটারের ছকে সেট বানিয়ে ডগভিল জন্ম দিয়াছিলেন। ছবির মূল কাহিনি নৈরাশ্যপ্রবণ হইলেও পোয়েটিক সংলাপ আর কাজ-কারবারে মোড়ানো ছিল। অথচ ছবিটা দেখার সময় কার বাপের সাধ্যি বলে যে এইটা সিনেমা নয়! সিনেভাষা তৈরি কারিগরি ঘটনা। ক্যামেরা, সম্পাদনা, সেট নির্মাণ, অভিনয়, সংলাপ থেকে শুরু করে সবটাই নিজস্ব শৈল্পিক ভাষায় কথা কইতে অধীর থাকে। শিল্পটা রপ্ত না হওয়া অবধি সেখানে গমন অনুচিত। হুমায়ূন সাহিত্যে অতুল কীর্তির অধিকারী হইতে পারেন কিন্তু সিনেমায় সেই কামিয়াবি ঘটাইতে পারেন নাই। গল্প বা দু-একখানা মধুর সংগীত সিনেমার শেষ কথা নয়। শিল্পটি তার চরিত্র ও মেজাজে সমবায়ী, যেখানে সকল উপাদানের রসায়ন থেকে সিনেভাষা জন্ম নিয়ে থাকে। হলকাটতি ছবি তার বাইরে নয়। কেন নয় সেটা দক্ষিণী ছবির দিকে এক নজর তাকালে টের পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মায়েস্ত্রো-ঘরানায় নির্মিত ছবিগুলা (*তাদের শতেক সীমাবদ্ধতা ও হলে দর্শক টানতে শোচনীয় ব্যর্থতা সত্ত্বেও) বাদ দিলে চলচ্চিত্রের সমবায়ী ভাষা সৃষ্টির নজির এক্ষেত্রে বিশেষ চোখে পড়ে না।
সমবায়ী প্রয়াস হইতে সৃষ্ট সিনেভাষার ক্ষেত্রে এইবেলা আলমগীর কবিরের নাম বোধহয় স্মরণ করা জরুর। প্রখর সিনেমাজ্ঞানের বদৌলতে ওপরে বর্ণিত জনরাগুলার বাইরে পৃথক ধারা কবির গড়ে নিয়েছিলেন। ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকত ইত্যাদির দৃশ্যায়ন থেকে শুরু করে প্লটিংয়ে বাংলা সিনেমার জন্য নতুন খোরাক ছিল। সমালোচকের ব্যাপক শংসা পেলেও কবিরের ছবি হলে অতটা কাটেনি। মধ্যবর্তী পথ তিনি বেছে নিয়াছিলেন। চিত্রনাট্য বুদ্ধিদীপ্ত ছিল। দৃশ্যায়নে সিনেমার ভাষাকে অনায়াসে পড়া যায়। সংগীত সুরেলা আর অন্তবর্তী। সব মিলিয়ে শিল্পের দায় পূরণে নিরঙ্কুশ নিবেদিত নয় আবার শিল্পকে ছেড়েও যায়নি। আলমগীর কবির নিজস্ব ধারা অধিকৃত করলেও পরে কেউ আর তাকে আগায়া নেওয়ার কথা ভাবে নাই।
আশির দশকের সূচনা বা মধ্যপর্বেও হইতে পারে, অ্যাকশন মুভিকে গতি দিতে ইবনে মিজান, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, দেওয়ান নজরুলরা দেশি লোককাহিনি, ফ্যান্টাসি আর ভিনদেশি বিশেষ করে মরু-অঞ্চলের প্রেম কাহানির তুফান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। লাইলি-মজুন, শিরি-ফরহাদের অমর প্রেমগাথার সঙ্গে তাল দিয়া ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি / …ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি’ জন্ম নিয়াছিল। দর্শককে হলে আটকে রাখতে দেশ ছেড়ে ভিনদেশে গমনে ব্যস্ত এইসব ছবির জাত বুঝতে সেকালের সিনেসাংবাদিকরা তার নাম দিলেন পোশাকি ছবি বা এই টাইপের কিছু। বাংলার আদর্শ গৃহবধূ শাবানা হল গরম করতে নিজের খোলস ছেড়ে বানজারান-এ খানিক বেরিয়ে এলেন। সুদর্শন নায়ক ওয়াসিম ও মাহমুদ কলির সঙ্গে দ্য রেইন খ্যাত নায়িকা অলিভিয়া এই জনরার ছবিতে বিশেষ ঘটনা ছিলেন। বোল্ডসিনে অভিনয়ের সাহস অলিভিয়ার মধ্যে সহজাত ছিল। এই ধারার দৃশ্যে অবশ্য সাহস একমাত্র শর্ত নয়, ইরোটিক যৌনাবেদন বহাইতে পারে সে-রকম গুণ নায়িকাদেহে থাকা চাই। অলিভিয়ার মধ্যে গুণগুলা সশরীর হাজির থাকলেও পোশাকি ছবির নির্মাতারা সৃজনভাবনায় দীন হওয়ার ফলে ঢাকাই সিনেপর্দায় তাঁর বিউটি অধিক দিন স্থিতি লাভ করে নাই।
পোশাকি ছবির ক্ষেত্রে অলিভিয়ার গেটআপ তাঁর দেহে সক্রিয় যৌনাবেদনের সঙ্গে সমতার পরিবর্তে বৈপরীত্যের জন্ম দিয়াছিল। বলিসিনেমায় রাজ কাপুর বা ফিরোজ খান জিনাত আমানের যৌনাবেদনকে পর্দায় ভাষা দিতে গেটআপে বদল নিয়ে আসেন। ঢাকাই ছবিতে অতটা বোল্ড হওয়া সম্ভবপর ছিল না, তবে অন্যভাবে উপস্থাপন করা যাইত। অলিভিয়ার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে নাই। পোশাকির পাশাপাশি স্পাই থ্রিলার জনরার ছবিতে তাঁকে ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও ওই ধারায় ছবি তৈরির রেওয়াজ সত্তর বা অশিতে ব্যাপক ছিল না। অলিভিয়ার অনুরূপ ঘটনা তাঁর সমসাময়িক নূতন আর নব্বইয়ে দেখা দেওয়া নায়িকা কেয়ার বেলায় ঘটেছিল। নির্মাতাদের সৃজনদৈন্যের কারণে নূতন ও কেয়ার বলিসুলভ বোল্ড বিউটিকে সিনেপর্দায় ভাষা দেওয়া সম্ভব হয় নাই। কেয়া পরে বিস্মৃত নায়িকার তালিকায় স্থান করে নিয়াছিলেন আর নূতন সহনায়িকার চরিত্রে লম্বা সময় জারি থাকার পর নব্বইয়ে এসে মায়ের ভূমিকায় স্থির হইতে থাকেন। পোশাকি ছবি নির্মাণের ধারাটি সম্ভবত আশির মধ্য থেকে শেষভাগ জুড়ে হলে রাজত্ব করে এবং নব্বইয়ে এসে জেল্লা হারায়।
ওদিকে গোলাপী এখন ট্রেনে সত্যজিৎ রায়ের চোখে ভালো ছবির শংসা কুড়ালেও তাকে নতুন সময়পরিধির মাঝে স্থাপনের ভাষা বাংলাদেশের পরিচালকরা খুঁজে বের করতে পারেন নাই। প্রাক্তনরা যে-দর্শকে ভর করে এতদিন বাজিমাত করেছিলেন সেই দর্শক ততদিনে বাংলা সিনেমা দেখতে হলে যাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে বসেছে। নব্বইয়ে নাইম-শাবনাজের ক্ষণিক উত্থান শেষে সালমান শাহ-র জুড়ি মৌসুমী-শাবনুর-পপি-পূর্ণিমা কিংবা এটিএম শামসুজ্জামান ও রাজীবকে সাইডলাইনে ঠেলে দিয়ে হুমায়ুন ফরিদীর আবির্ভাব স্মরণীয় ঘটনা হইলেও সালমান লিগ্যাসির অকাল মৃত্যু বাংলাদেশের ছবির জন্য ধাক্কা ছিল। ইন্ড্রাস্টিকে একা টানতে পারে এমন একখান নায়কের অকালবোধনের পর বাংলা সিনেমার ময়ূরীযুগে পা রাখা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
আমিন খান, ওমর সানি আর ওদিকে রুবেলের কুংফু-কারাতে নির্ভর অ্যাকশন হিরোর ইমেজ দর্শক কাটলেও সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল না। শহীদুল হক খোকন, রুবেল ও হুমায়ুন ফরিদীর রসায়নে নতুন জনরা সৃষ্টির সম্ভাবনা উঁকি দিয়া গেলেও খোকনের স্ট্রাগল ততদিনে হিন্দি-তামিল রিমেকের দাপটে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বিশ্বপ্রেমিক, পালাবি কোথায়, ভণ্ড, ম্যাডাম ফুলি-র মতো ছবির প্লটিং থেকে আরম্ভ করে সিনেমা বানানোর কৌশলে স্বকীয়তা ছিল। খোকন এই প্রজন্মে একমাত্র নির্মাতা যাঁর ছবিতে কাহিনির সঙ্গে ক্যামেরা সঞ্চালনা, সংলাপ ও অভিনয়ে ভারসাম্য ধরে রাখার চেষ্টা চোখে পড়ত। তামিল-মালায়ালাম ছবিতে দর্শক এখন থ্রিলার ধাঁচে যে-জিনিসগুলা দেখে তার কিছু আদিবীজ খোকনের ছবিতে নয়ের দশকে স্বচ্ছন্দে ভাষা পেয়েছিল। খোকন ভিন্ন ধারার প্রণেতা হলেও আজোবধি বাংলাদেশের সিনেকুলে অচিহ্নিত ও আন্ডাররেটেড। খোকনের পথে পরবর্তী নির্মাতারা হাঁটার চেষ্টাও করেন নাই। মালায়ালাম ভাষায় নির্মিত দৃশ্যম-এর মতো ছবির জন্ম খোকনঘরানায় নির্মিত সিনেভাষার হাত ধরে অবাস্তব ঘটনা ছিল না, যা হয়ত দর্শককে বিনোদিত করার সঙ্গে সু-অভিনয় আর শক্তিশালী সামাজিক বার্তা রেখে যায়।
খোকনের বাইরে মান্না ও ডিপজলকে নিয়ে কাজী হায়াৎ আর উত্তম আকাশের ছবিগুলা বোধহয় গণ্য ব্যতিক্রম। মধ্যবিত্ত দর্শক হলে নাই দেখে বাংলাদেশের সিনেমা চিরকাল যে-দর্শকের খুঁটির জোরে মূলত চলে সেই বিপুল খেটে খাওয়া শ্রমজীবী জনতার ভিতরের আওয়াজকে হায়াৎ ও আকাশ তাঁদের অ্যাকশনধর্মী সিনেভাষার উপজীব্য করেছিলেন। শহরকেন্দ্রিক, গ্রামীণ, পোশাকি, ফ্যান্টাসি ইত্যাদি ছেড়ে এই দুই পরিচালকের হাত ধরে বাংলাদেশ রাগী সিনেমার বৃত্তে প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। মান্নার ব্যাডবয় ইমেজ সত্তরের দশকের অমিতাভ বচ্চন কিংবা কলকাতার নায়কের কপিক্যাট হইতে চায় নাই। পর্দায় তিনি আক্ষরিক অর্থেই রাগী আবেগের বিস্ফার ঘটিয়েছিলেন। নব্বই দশকি রাজনৈতিক পালাবদলের তোড়ে বঙ্গীয় জনপদে বাস্তব হয়ে ওঠা মানুষের ভিতরের জৈবক্ষোভকে এই ছবিগুলা বমন করতে পেরেছিল।
ডিপজলের উগ্র সন্ত্রাসের সঙ্গে টক্কর দিয়ে সিনেপর্দায় বিস্ফারিত এ্যাংরি মেলোড্রামার সামাজিক তাৎপর্য সুগভীর হলেও মান্নাকে আজো কেউ সেই জায়গা থেকে পাঠের দায় বোধ করে নাই। একমাত্র নায়ক যে কিনা সালমান শাহ-র লাভারবয় ইমেজের বিপরীতে প্রতিনায়কের ইমেজে নিজেকে মহার্ঘ করে তুলতে পেরেছিল। মান্নার ছবি স্বকীয় ছিল। সংলাপ আওড়ানোর ধরনে নিজস্ব ব্যক্তিত্ব টের পাইতে দর্শকের অসুবিধা হয় না। অভিব্যক্তি হইতে সেই মেলোড্রামা ফেটে বাহির হয় যেটা প্রচণ্ডভাবে অবদমিত সমাজে আটক দর্শকের নিজের চাওয়া। চিৎকারের মধ্যে যেসব হুঙ্কার ও হাহাকার একত্রে বিরাজে তারা ছবির ইমোশনকে দর্শকের ভিতরে জন্মের মতো সেঁধিয়ে দিতে সাহায্য করে। মান্নার অভিনয় হয়ত অতিঅভিনয়; কিন্তু যে-দর্শকের জন্য তিনি নিবেদিত তাদেরকে অতিঅভিনয় ছাড়া ঘায়েল করা মুশকিল ছিল। বাংলা সিনেমায় উচ্চ স্বরবিক্ষেপ যাত্রার সহগ। কারিগরি সমস্যার কারণেও অভিনেতারা উচ্চস্বরে সংলাপ ঝাড়েন। সিনেহলের সাউন্ড সিস্টেম এতটাই বেহালা যে এছাড়া হলের দর্শকের কানে শব্দ পৌঁছানো কঠিন। তারেক মাসুদ একবার সিনেহলের খোঁজখবর করতে বাংলাদেশ চষে বেরিয়েছিলেন। তাঁর বিবরণ হইতে জানা যায় এমন সিনেহল বঙ্গে বিরাজ করে যেগুলা ঈদের সময় ছাড়া মূলত আলুর গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হইতে থাকে!
মান্নার অতি-নাটকীয় কণ্ঠস্বর সেইসব দর্শকের জন্য মাদকীয় ছিল যে এই সম্মোহনে বাস করতে ভালোবাসে এবং তার মনে হইতে থাকে অতঃপর পালানোর পথ নাই। মান্না যখন ডিপজলকে দেখে নেবে বলেছে তখন তাকে দেখেই ছাড়বে। দর্শকের নিজের কতজনকে দেখে নিতে ইচ্ছা হয় কিন্তু সাধ্যে কুলায় না। অগত্যা সিনেমার রুপালি পর্দায় মিথ্যা স্বপ্নের জাল বুনে মান্নাকে সে আইডল করে তোলে। গঁদারের ভাষা ধার করে বলা যায় এই জিনিসটা ভীষণরকম পলিটিক্যাল এবং মান্না দেশের কৃমিকীট-দংশনে অসুস্থ রাজনীতির জন্য ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট। রাগী এক রবিনহুড পর্দায় আবিভূর্ত যে কিনা সামাজিক চুক্তির শোভনতা পরোয়া করছে না এবং আইন নিজের হাতে তুলে নিয়াছে! মান্না সেই সর্বহারা যে তার নীতির সঙ্গে আপসের যাওয়ার বদলে সন্ত্রাসকে সরব করে তুলতে স্বস্তি পায়। এই ধারার ছবির মধ্যে সস্তা অতিরঞ্জনের বাড়াবাড়ি থাকলেও অন্তরালে বহমান আবেশে খাঁটি উত্তাপ ছিল। তেজি, জুম্মন কসাই, আম্মাজান ইত্যাদি ছবির ধারায় সৃষ্ট সহিংসতার পরিচর্যা হয়ত বঙ্গে নতুন জনরার ছবিকে বাস্তব করে তুলতেও পারত, যা সাম্প্রতিক চোরাবালি, ঢাকা এ্যাটাক, নবাব ইত্যাদির মধ্যে মিলে না। শাকিব খান বা আরেফিন শুভ ডায়ালগ ঝাড়েন ঠিকই, তবে সেগুলা পানসে ও ন্যাতানো, দর্শককে চেতিয়ে তোলার হিম্মত রাখে না। সেই বারুদটা এখন আর নাই যা রাগী সিনেমা থেকে ছিটকে বের হওয়া ভালগার এ্যাপ্রোচকে দর্শকের ভিতরে সেঁধিয়ে দিতে জানে।
বম্বের প্রসঙ্গ আরেকবার তাই ওঠে। সর্বশেষ ড্রিম প্রজেক্ট জিরো ছবিতে নিজে জিরো হওয়ার পর শাহরুখ খান সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে পরের প্রজেক্টে আগ বাড়ার কামে মগ্ন আছেন শোনা যায়। ছবি রিলিজের পর শাহরুখ ম্যাজিক আরেকবার জ্বলে উঠতেও পারে, কিন্তু তাঁর এই সাফল্য বা ব্যর্থতায় বলি সিনেকারখানার অধিক যায় আসে কি? মনে হয় না। শাহরুখ যদি সফল হয়েও থাকেন আর পাঁচটা সফল ছবির ঘটনা থেকে তাঁকে পৃথক ভাবার চল ইন্ড্রাস্টিতে এখন আর অমোঘ নয়। ওয়ান ম্যান আর্মির ছকে শাহরুখ-সালমান নিজের গল্প যদি ভেবে থাকেন তাঁদের লিজেন্ডারি এ্যাপিলের কারণে খানিক ব্যবসা টানবে কিন্তু পরেরটা মুখ থুবড়ে পড়বে এটা নিশ্চিত। নতুন প্রজন্মের বলিপরিচালকরা তিন খানের চাইতে বরং একক তারকার ওপর ভর না করেই হলে কাটে অথবা ওটিটিতে দর্শক টানে এমন কাস্টিংয়ে অধিক আগ্রহ বোধ করেন।
একক তারকা দিয়া মুভি টানতে হলে সিনেকাহিনির গল্পে নতুনত্ব আর অ্যাকশন ছবি হলে মারপিটের সিনে অভিনব ব্যাপার-স্যাপার থাকা চাই। রজনীকান্ত বা মোহনলালকে এই জিনিসখানা আজো অমলিন রেখেছে। মোহনলালের পুলিমুরুগান-এর গল্প আহামরি কিছু নয় কিন্তু অ্যাকশন সিনারি মৌলিকত্বে ভরপুর হওয়ায় দর্শককে স্রেফ বসায়া রাখে। মালায়লাম রাজাধিরাজের বয়স ষাটের উপরে চলে! দেখে বোঝার উপায় নাই। প্রেমপিরিতির সিনে পরিচালকরা তাঁর বয়স ও পর্দা-উপস্থিতির সঙ্গে মানায় সেই অঙ্গে নায়িকা বাছেন। বঙ্গকন্যা কমলিনী মুখার্জি মোহনলালের অর্ধেক বয়সী হইলেও পর্দায় তাকে উপস্থাপনের ক্ষণে মোহনলালের সঙ্গে মানায় সেই অঙ্গে মেকআপ ও লুকের কাম পরিচালক ভেবে রাখেন। সে-তুলনায় দাবাংয়ের সালমানকে এখন বুইড়া লাগে। হাঁটুর বয়সী নায়িকা নিয়ে রংঢংয়ে তাঁর ডিনামিকস ফতুর হওয়ার পথে। ঢাকাই মুভির দিকপালরা এইসব হিসাব-নিকাশে অভ্যস্ত নন বলে মনে হয়!
তো এইসব ভজকটে বাংলা বিনোদন সিনেমা গঙ্গাযাত্রা করে দেখে হলে গিয়ে ছবি দেখার রুচি মরতে শুরু করেছিল। সেইসঙ্গে শহরের চারধার ঘিরে ছড়িয়ে থাকা হলগুলা অধমের চিত্তে স্মৃতিকাতরতায় ক্রমশ নিঃস্ব ও দীর্ণ হইতে থাকে। বড়ো ভাইদের মুখে শুনেছি তাদের সময়ে ইংরেজি মারকাটারি ছবি দেখতে চাইলে লোকে রংমহলে ভিড় করত। ষাট-সত্তর দশকের পুরাটা জুড়ে যে-রংমহলের গল্প তাদের জবানে শুনেছি সে আর আশি থেকে নব্বইয়ে এসে দেখেছি বলে ইয়াদ হয় না। ইতালীয় নির্মাতারা ততদিনে হলিউড দাবড়ে বেড়াতে শুরু করছেন। ফেলিনি, ডি সিকা থেকে শুরু করে সের্গিও লিওনি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপ্পোলা, মার্টিন স্কোরসেজির মতো একঝাঁক সিনেকার হলিউডকে নতুন সিনেভাষায় রঙিন করছেন দিবারাতি। মনে রাখতেই হচ্ছে, সোফিয়া লরেন, ক্যাথরিন দানিউব, ব্রিজিত বার্দো, মার্চেল্লো মাস্ত্রোয়ানি, মার্লন ব্র্যান্ডো আর ক্লিন্ট ইস্টউডদের যুগ চলে তখন। সুদূর বাংলাদেশের মফস্বল শহর সে-ঢেউয়ের বাইরে থাকেনি। ডি সিকা-র টু ওম্যান ও দ্য সানফ্লাওয়ার, কাপ্পোলার দ্য গুড দ্য বেড এন্ড দ্য আগলি কিংবা ধরা যাক লিওনির গডফাদার এই শহরে মাসের-পর-মাস চলেছে! দর্শক শহরের যুবাগণ থেকে শুরু করে দিনমজুর…মোটের ওপর সকল শ্রেণিকে ছবিগুলা হলে টেনে এনেছিল।
আমাদের বালেগ হওয়ার দিনক্ষণে লিওনির ছবিখানা ফের রংমহলে উঠেছিল। রদ্দিকালের প্রজেক্টরের সঙ্গে তাল দিয়া বৈদ্যুতিক পাখার ধ্যাড়ধেড়ে গুঞ্জন, বিড়ি-সিগারেটের ধোঁয়ায় গুলজার হলে ব্যাপক সিটিবাজির মধ্যে ঠোঁটে সিগার ঝুলিয়ে ক্লিট ইস্টউড তখন ডায়ালগ ঝাড়ছে, — বুঝলা মিয়া, দুনিয়ায় দুই কিসিমের আদমি আছে। তাগো একদল কান্ধে বন্দুক নিয়া ঘুরে আর একদল নিজের কব্বর খুঁড়ে। কাউবয় টাইপের ছবিতে লিওনি নতুন কায়দাবাজির আমদানি ঘটানোয় ছবিখানা দুনিয়াজোড়া ভূকম্পন সৃষ্টি করেছিল। কাউবয় ছবির ভারতীয় ফর্মুলা তামিল-তেলুগু ভাষায় একসময় রমরম বাজার পেয়েছিল। লিওনি ও ইস্টউড জুটির রসায়ন সেখানে প্রভাববিস্তারী অবদান রেখেছিল শোনা যায়। সিল্ক স্মিতার জীবনকাহানির ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ডার্টি পিকচার-এ পরিচালক এই দিকটায় ফোকাস করেছিলেন। পাঠকরা ইচ্ছে করলে নজর করতে পারেন।
ওদিকে হিন্দি ছবির কাহিনি আর ক্যাবেরা নতর্কীর ঘুঙ্ঘুটে বাঁধা বাংলাদেশে ঘোড়ার ওপর চড়ে নায়কের দৌড়বাজি ও ডায়ালগ ঝাড়ার কায়দায় মার্কিনি কাউবয় প্রভাব রাখার কসরত করলেও দেওয়ান নজরুলের বক্স অফিস কাঁপানো আসামী হাজির ছাড়া ওয়েস্টার্ন ধাঁচে ছবি নির্মাণে ঢাকাই সিনেমা সফল হইতে পারে নাই। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তবে সত্তরের গোড়ায় তামিল পরিচালক এম কারনানের হাত ধরে ভারতীয় সিনেপাড়ায় কাউবয় ঘরানার ছবির অনুপ্রবেশ ঘটিয়াছিল। ডেকোইটি (Dacoity) অর্থাৎ ডাকুনির্ভর কাহানিছকে গাঁথা ওয়েস্টার্ন জনরার ধারায় শোলে সেই সময় বিস্ফার ঘটায়। শোলে অবশ্য পিওর ওয়েস্টার্ন মুভি ছিল না। এই জনরার ডাকু ও মশালা (Curry) অঙ্গে দৃষ্ট কতক লক্ষণের কারণে রমেশ সিপ্পির ছবিখানা কাউবয়ের মহিমা পায়। হয়ত সেই অনুপ্রেরণা দেওয়ান নজরুলকে আসামী হাজির নির্মাণের ভাবনায় উতলা করেছিল।
প্রভু দেবার মুক্কালা মুক্কাবেলা লায়লা গানখানা এখন স্ট্রিট ড্যান্স হিসেবে নতুন অঙ্গে ফিউশন করা হইলেও আদতে ডাকু ধারার গান হিসেবে দক্ষিণে ঝড় তুলেছিল। ডাকু ও মশালা বাদে ওয়েস্টার্ন জনরার বিচিত্র প্রবাহে বঙ্গ তথা উপমহাদেশের সিনেভাষার অবদান যৎসামান্য। এই ধারার ছবির জন্য যে-মেজাজ দরকার হয়, দেশকালে বিদ্যমান সংস্কৃতির সঙ্গে তাল রেখে গল্পকে প্রাসঙ্গিক করা লাগে, চোখা সংলাপ আর বন্দুকবাজির অভিনব কায়দা ইত্যাদি মাছেভাতে সুবোধ বাঙালির জন্য গুরুপাক ছিল। যারপরনাই সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন সিরিজের ব্যাপক পাঠপ্রিয়তার মাঝে সে ক্রমশ নিঃশেষ হইতে থাকে। সেইসঙ্গে দেওয়ান নজরুলের ছবিতে কাউবয়ের বাঙ্গাল সংস্করণ ওয়াসিম ও জসিম পরে পোশাকি ছবির গতানুগতিক প্লটিংয়ে ঢিসুম ইয়া ঢিসুম মার্কা মারপিটে লিপ্ত থেকে নিজের ক্যারিয়ারকে আগাইয়া নিতে থাকেন।
মান্নার কথায় আরেকবার ফিরি। তাঁর প্রায়ণের সঙ্গে ঢাকাই সিনেমার রাগী সিনেভাষায় বাঁক নেওয়ার ধারায় ধস নেমেছিল। কেউ এই দিব্যি দেয় নাই যে ঢাকার চলচ্চিত্রশিল্পে প্যারালাল সিনেমার ধাঁচে অ্যালবার্ট পিন্টো কা গোসসা কিউ আতি হ্যায় টাইপের সিনেভাষা বয়ান করতে হবে। সাঈদ মির্জা আক্তারের রাগী সিনেভাষা বয়নের পদ্ধতি ঢাকাই সিনেমায় সৃজনের দায় যাঁরা সেই সময় কান্ধে নিয়াছিলেন তাঁরা (*বিনয়ের সঙ্গে বলি…) সে-পরীক্ষায় ডাহা ফেল মারেন। কাজী হায়াৎ, উত্তম আকাশ, ডিপজল ও মান্নার রসায়নে রাগী সিনেমার যে-ধারাকে শক্ত পাটাতনে দাঁড় করানো সম্ভব ছিল মান্নার অস্তাচলে গমনের সঙ্গে তার নির্বিষ হওয়ার ঘটনা পীড়াদায়ক বটে! কাজী হায়াৎ দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে বের করতে পারলেন না যে তার অতিআবেগসুলভ খিস্তিবহুল অঙ্গবিক্ষেপের সঙ্গে মর্মভেদী সংলাপবাণে হলে তুফান এনে দিতে পারে।
অগত্যা, ময়ুরী আর কাটপিস মিলেঝুলে ঢাকাই ছবি সেই জায়গায় পৌঁছাতে থাকে যেখানে পপি-মৌসুমী-শাবনুর-পূর্ণিমা-নিপুণ সকলেই কমবেশি ব্যাপক হারে কাপড়া উতড়াতে শুরু করেন। লক্ষ্য একটাই ছিল, তবু দর্শক যদি হলে ফেরে আর বাংলা সিনেমার সুদিন ফেরত আসে। মনে পড়ে যায়, মৌসুমীর কাপড় উতড়ানোর দৃশ্য দেখতে নন্দিতা বা অবকাশ-এ হাজির ছিলাম। ছবিটি সম্ভবত পরাধীন বা এই টাইপের কিছু ছিল। বাথরুম সংয়ে রুবেল ও মৌসুমীর ব্যাপক লদকালদকি শুরু হইতে সিটির জোয়ার উঠেছিল হলে। দর্শক মোটা দাগে খেটে খাওয়া মানুষ আর যুবাগণ। মনে হইল পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে আমরা সকলে মিলে পৌঁছে গিয়াছি, যেখান থেকে এই শিল্পকে দু-ফোঁটা চোখের জলে গুডবাই বলে দেওয়া যায়।
সিনেভাষার সাতকাহন : আগের পর্ব
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS