মুক্তমঞ্চ কন্সার্ট হচ্ছে দেশে দেদার, এইটা অ্যাপ্রিশিয়্যাবল। গত বছর-দুই ধরে ব্যাপারটা লক্ষণীয়, ২০১৭ পুরাটাই ছিল কন্সার্টমুখরিত এবং ২০১৮ মধ্যভাগ পর্যন্ত। বহুকাল খোলা আসমানের তলায়, যারে বলে ওপেন-এয়ার, গানবাজনার অনুষ্ঠান প্রায় অ্যাবসেন্টই ছিল। মফস্বলে বা ডিভিশন্যাল ডিস্ট্রিক্ট শহরে তো ভাবাই যায় না, রাজধানীতেও হয়েছে কালেভদ্রে, ঢাকায় ইনডোর কন্সার্ট হয়েছে বটে। এমনকি ইনডোর কন্সার্টও হয় নাই দীর্ঘ দশকভর জেলাশাহরিক পরিমণ্ডলে। সিলেটে বেশকিছু জুজুর ভয় স্প্রেড করা থাকে কর্তৃপক্ষের, প্রোজেক্টরে সিনেমা দেখাইতে যেয়েও কর্তাবাবুদের পার্মিশন নিতে-পেতে এগারোবার পেছাতে হয়। এইভাবেই চলছিল। গত দুই কি তিন বছর ধরে বেশকিছু কন্সার্ট হয়েছে দেশে, এখন হচ্ছে নিয়মিতই। জিনিশটা আনন্দের। দুইটা আলাপসালাপ করা যায় এইখানে সেই নির্ধনিয়ার ধন আনন্দ নিয়া। আস্তেধীরে। লেটস্ স্টার্ট।
কন্সার্ট কখনো রবীন্দ্রনাথের হয় না, লালনের হয় না, কাজী নজরুলের হয় না। আজম খানের হয়, আইয়ুব বাচ্চুর হয়, মাকসুদের হয়, জেমসের হয়। কিংবা হতে পারে মেঘদলের, শিরোনামহীনের, সহজিয়ার, আর্টসেলের, নেমেসিসের, আর্বোভাইরাসের, চিৎকারের, মনোসরণীর বা দি নিউ সোনার বাংলা সার্কাসের। মানে, ব্যাপারটা প্রায়োগিক অলিখিত অভিধানে এমনই যে কন্সার্ট হয় ব্যান্ডের, কন্সার্ট হয় রকের, কন্সার্ট হয় মেটাল মিউজিকের। কিন্তু রবীন্দ্র কন্সার্ট, নজরুল কন্সার্ট, দ্বিজেন্দ্র কন্সার্ট, রজনীকান্ত কন্সার্ট, অতুল কন্সার্ট, লালন কন্সার্ট, রাধারমণ কন্সার্ট, হাসন কন্সার্ট এমনকি সুফি কন্সার্ট বা ফোক কন্সার্ট কখনো হয় বলিয়া কানে পশে না। করিম কন্সার্ট হতে পারত, শুনেছেন কখনও হয়েছে বলিয়া? রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠান হয়, নজরুলগীতি ও নজরুলসংগীতের অনুষ্ঠান, পঞ্চকবির গানের অনুষ্ঠান, পুরাতনী বাংলা গানের অনুষ্ঠান, চিরায়ত বাংলা গান ইত্যাদি জিনিশের অনুষ্ঠান হয়। এইগুলোকে অনুষ্ঠান না বলে কন্সার্ট বললে অসুবিধে হতো? ফোক ফেস্ট বা সুফি ফেস্ট না বলে, বা লোকসংগীতের উৎসব না বলে, এইগুলাকে যদি কন্সার্ট বলা হয় তো অসুবিধে কোথায়? লালনগীতির আসর হয়, হাসন রাজার গানের উৎসব হয়, কিন্তু কন্সার্ট বললে নিশ্চয় কিছু অসুবিধা দেখা দেয় আয়োজক সংস্কৃতিকর্তাদের। অসুবিধাটা কোথায় হয় কেউ বলতে পারে না। আন্দাজে এক-দুইটা কথা শুধু বলা যায় এখানে।
জেমসের কন্সার্ট বলা গেলেও রবীন্দ্রনাথের কন্সার্ট বলা যায় না বা বলা হয় না। আদবের খেলাপ হয় বললে? জেমসের বা তার গোত্রের গানবাজনা নারকীয়, আর রবীন্দ্রনাথের বা নজরুলের স্বর্গীয়। বোধহয় এমন একটা মাইন্ডসেট কাজ করে তাদের ভিতরে যে, যেখানে ক্যাওস হয় সেইটাকে কন্সার্ট বলবা; আর যেখানে ভাবগাম্ভীর্য হয়, আতর-আগর খুশবু যেইখানে, সেইটা অনুষ্ঠান। একটু তলার দিকে গেলে আসর। গানের আসর। গানের মজমা। গানের জলসা। আরেকটা আছে মেইফেল। ওইটা শাস্ত্রীয়, ওইটা মার্গীয়, ওইটা ঠাকুরের চেয়েও উচ্চাঙ্গ। কনফারেন্সও হয় মিউজিকের, কথাবলাবলির কনফারেন্স নয় কিন্তু, যেমন ডোভারলেইন মিউজিক কনফারেন্স। এদেশের বেঙ্গল সংস্কৃতি বিজনেসের গ্রুপ কনফারেন্স ব্যাপারটা খেয়াল করে নাই এখনও। করলেই স্টেডিয়াম ব্যুকিং দিয়ে দেবে, গ্যেট স্যেট গ্য!
অথচ কন্সার্ট তো হচ্ছে সেইটাই যেখানে সুরের-গায়নের-বাদনের ঐকতান রচিত হয়। ইংরেজি শব্দ। কনচার্তোও বলতে পারেন কেউ উচ্চাঙ্গ ভঙ্গিমায়। কিন্তু অনুষ্ঠান? অভ্যাসের বশে, যেন দায়ে ঠেকে, যেইটা না-করলে মুখ থাকে না সেইটা গাদাগুচ্ছের পয়সা খর্চে মনমরা দায়সারা করার নামই তো অনুষ্ঠান। সংগীতানুষ্ঠান। মনোজ্ঞ। বলা হয় আলোচনাসভার শেষে রয়েছে মনোজ্ঞ সঙ্গীতানুষ্ঠান, বলা হয় ইশকুলকলেজে এবং পাড়ায়-মহল্লায় এমনকি বিটিভিতে। যেমন জন্মদিনের, বিবাহের, খৎনার বা অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠান। ওইখানেও আনন্দ হয়, সেই আনন্দ অভ্যাসের আনন্দ। প্রথানন্দ। প্রথানুবর্তনের আনন্দ। অভ্যস্ত হয়ে গেলে বেআরাম লাগে না আন্দুধুন্দু মন্দটারেও। অভ্যাসের দাসানুদাস মানুষ। অনুষ্ঠানেরও? যুক্তি কি বলে? অ্যানিওয়ে।
যে-কথাটা পাড়বার অভিসন্ধি নিয়ে এই নিবন্ধের অবতারণা তা এ-ই যে, দেশে দেদার কন্সার্ট হচ্ছে এখন এইটা যেমন ঠিক তেমনি এইটাও ঠিক যে এই কন্সার্টগুলো যতটা-না সাংগীতিক গরজ থেকে আয়োজিত হয় তারচেয়ে ব্যবসায়িক প্রচারণাই দেখতে পাই বেশি। বিশাল স্টেজ এবং সেট-ডিজাইন, মোটাসোটা আলো ও পয়সায়-ভাসা নানাবিধ প্রযুক্তিকারিকুরি, কিংবদন্তি ব্যান্ডের স্টার সিঙ্গার বায়না করে এনে ধামাকা কন্সার্ট। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাজেন্সিগুলোর পয়সাপাতি বিস্তর আর্ন হচ্ছে, ব্যাপক না-হলেও প্রচারপোস্টার পড়ছে ব্যান্ডলিডারের মুখচ্ছবিসম্বলিত কন্সার্টক্যাচমেন্টস্ অ্যারিয়ার সীমিত ছোট্ট গণ্ডিতে, লোকসমাগমও হচ্ছে মন্দ না। আয়োজনের বহর যত দীর্ঘ, সংগীত পরিবেশনের কলেবর সেখানে ততই হ্রস্ব। মোদ্দা কথা, গান শুনতে গেলে এখন তো ঘরে বসে কিংবা বাসে-ট্রেনে-অটোতে যেতে যেতে এফএম রেডিয়ো অথবা ইউটিউবে ঢের আয়েশ করেই শোনা যায়। কিন্তু কন্সার্টে কেন যাবে লোকে? এত হুজ্জোৎ করে গেইটপাস জোগাড়পূর্বক কন্সার্টে লোকে যায় একটা ম্যাজিক আস্বাদিবার আশায়, যেইটা রেকর্ড শুনিয়া পাওয়া যায় না। জাদুটোনা কিছুই কি করতে দেখা যায় এখনকার কন্সার্টগুলোতে সেলেব শিল্পীদেরে? একটানে দৌড়ের উপর দিয়া আটটা থেকে এগারোটা গান গেয়ে সেলিব্রেটি শিল্পীটি বিদায় নেন। মাঝখানে যা হয়, সেখানে তামাশা হয় যত সংগীত হয় কি তত? জমায়েতে হাজির শ্রোতাদর্শকদের সংখ্যা হাজার-পাঁচ থেকে হাজার-পনেরো, অধিকাংশই শিল্পীর ভক্ত বলে তেমন উচ্চবাচ্যটা করে না তারা। বাজনার চেয়ে খাজনাটা হয়ে যায় বেশি। ফিন্যানশিয়্যাল অ্যাফোর্ডেবিলিটির ব্যাপার না আদৌ, লোকের জেবে ধরে নিচ্ছি বিস্তর কাঁচা টাকাকড়ি কিংবা প্ল্যাস্টিক কার্ড হয়েছে, হুজ্জোৎ-হাঙ্গামা আর ধকল সয়ে একটা কন্সার্টে যেয়ে লোকে মিনিমাম মিউজিক্যাল ক্যাথার্সিসের অভিজ্ঞতা নিয়া যদি ফিরত ঘরে তবে কথা ছিল না। তা তো হয় না কালেভদ্রেও। শুধু ধুম মাচালে শোর হয়, সেইটাও মুখস্থ শোর-শোরাব্বা। খালি বিগস্ক্রিন আর ব্যাকড্রপে স্পন্সর কর্পোরেটের বিজ্ঞাপনী ইশারায় বিনোদিত/বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফেরো ঘরে।
একটাকিছু উদাহরণ দিতে হবে? যেমন, ধরা যাক, দেশে এ-মুহূর্তে সবচেয়ে সফল মিউজিক্যাল স্টেজশো করেন জেমস্। নগরবাউল ব্যান্ডের ক্রেইজ্ দর্শকশ্রোতাদের মধ্যে এখন তুঙ্গ। মঞ্চে এখন মাতোয়ালা গানবাজনার পসরা নিয়া ব্যান্ডগুলোর মধ্যে জেমসের নগরবাউল নজিরভাঙা সাক্সেসফ্যুল সন্দেহাতীতভাবে। এহেন সফল জেমসকেও লক্ষ করা যায় আট থেকে এগারোটা পার্ফোর্ম্যান্স সেরে একঘণ্টার মধ্যে স্টেজ ছাড়তে। এবং সেই পরিবেশনাগুলোও মুখস্থ কয়েকটাতেই সীমায়িত। ইম্প্রোভাইজেশনের লীলা দেখাতে জেমসের জুড়ি নাই স্বীকার্য, তবে সেইটাও কন্সার্ট-টু-কন্সার্ট ইনস্যাপারেবল। অলমোস্ট একই জিনিশ। মনে হয় যেন হোমওয়ার্ক করা মাপা পার্ফোর্ম্যান্স। পরপর দু-দুটো কন্সার্টে এই নিবন্ধকার উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতা থেকে জেমসের ব্যাপারে এই রিমার্ক করছে। এছাড়া আরও যারা আছেন রেগ্যুলার কন্সার্ট করেন, যেমন আইয়ুব বাচ্চু প্রমুখ, উনারা মনে হয় ধরেই নেন যে দর্শকরা আসে তাদেরে দেখতে, নক্ষত্রের দিদার লভিতে, মিউজিক শুনতে কেউ আসে না ধরেই নিয়েছেন তারা।
তাইলে এই সিচ্যুয়েশন থেকে বেরোনো হবে কেমন করে? এত ঘটা করে ম্যারাপ বেঁধে অতিকায় কন্সার্ট আয়োজনের ফল যদি হয় সাকুল্যে এগারোটা গানের মুখস্থ পরিবেশনা, যারা নিত্য কন্সার্ট-যাতায়াতকারী তারা কি বেঁকে বসবে না আজ হোক বা কাল? একটা ছোট্ট জেলাশহরের ততোধিক ছোট সিটি কর্পোরেশন অ্যারিয়ায় জেমস্-বাচ্চুর মতো মিউজিশিয়্যানরা বছরে পাঁচবার শো-আপ্ করে গেলে ফ্যানবেইসের মধ্যে তাদের ইম্প্যাক্ট কমবে না বাড়বে? এমন অভিজ্ঞতা তো ওয়ান্স ইন অ্যা লাইফটাইম বা বড়জোর টুয়াইস্-থ্রাইস্ হবার কথা। অথচ ২০১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ মার্চ সময়-অধ্যায়ে জেমসকে এই সিলেট শহরে শো করে যেতে দেখা গেছে সাতবার। এত ফ্রিকোয়েন্টলি একই জায়গায় একই দর্শকশ্রোতার আসরে এভাবে শো-আপ করার পেছনে অর্থকড়ি রোজগারটাই মুখ্য। দরকার আছে সেইটার। যেহেতু অন্য কোনো উপায়ে এই শিল্পীরা আর্ন করতে পারছেন না, একই জিনিশ একই জায়গায় ফিরে ফিরে পুনরুৎপাদনপূর্বক উপার্জন করবেন না তো কী করবেন? তবে এর ফলে মিউজিকের প্রোগ্রেসটা ব্যাহত হয় কি না ভাবা দরকার। নয়া ব্যান্ডগুলো শো পায় কি না তা জেমস-বাচ্চুর মতো শিল্পী ভাববেন কেন? সময় থেমে থাকছে না। নারায়ণ যা দিচ্ছেন নগদে বেলাবেলি তা হাত পাতিয়া নাও। সংগীতের মামলা থাক পড়ে পেছনে।
এইসব অতিকায় ধামাকা কন্সার্ট হোক ঘনঘন অসুবিধা নাই, কিন্তু দরকার ছোট ছোট কন্সার্ট নিয়মিত ও প্রচুর পরিমাণে। সেখানে ছোটবৃত্তে শ্রোতার আনাগোনা থাকুক বছরভর ভিন্ন ভিন্ন ভেন্যুতে। এবং পার্ফোর্ম করুক ছোট ছোট দলগুলো, উঠতি ইম্যার্জিং সোলো আর্টিস্টরা গানবাজনায় মাতিয়ে তুলুক দেশমুলুক, সংগীতের সংসর্গ হোক সঙ সাজার সার্কাসতাঁবুর বাইরে। দেশে এখন সরকারি অর্থায়নেও কন্সার্ট হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দেশের বিভাগীয় শহরে এবং পর্যায়ক্রমে জেলাশহরগুলোতেও কন্সার্ট অর্গ্যানাইজ করবে শোনা যাচ্ছে। সেসব কন্সার্টে শাসক দলের নির্বাচনপূর্ব ঢোলডপ্কিশিঙা বাজানো হলেও জেমসের মতো সংগীতব্যক্তিত্বরা যাচ্ছেন ঘুরে ঘুরে। এইটা আলবৎ সুযোগ। এই সুযোগে দেশজোড়া সাংগীতিক-সাংস্কৃতিক নিস্তেজতা আর স্ট্যাটাস-ক্যু ধসিয়ে দেয়া যায়। এই যে বেশুমার মানুষ কন্সার্টে জড়ো হয়, এই জমায়েতটাকে টেইকেন ফর গ্র্যান্টেড নিয়া নিলে, যাচ্ছেতাই করে সাময়িক ধুমধাম ফুর্তিফার্তায় মিউজিশিয়্যানরা মজে গেলে কাল কি হবে? কালের ঘরে শনি আসবে। এই জিনিশটা যারা ভাবনায় নেবেন, তারা আগামী দিনের বাংলাদেশজ সংগীতের নতুন হরাইজন নির্মিতিতে স্মরণীয় রইবেন। শুধু সঙ দেখায়ে সার্কাসটেন্টে সমবেত লোকের সাপোর্ট হারালে একদিন ঘোর নিদান ঠেকানো যাবে না বোধহয়।
লেখা : মিল্টন মৃধা
… …
- অন্তরঙ্গ কবিচিত্র - January 28, 2021
- সঞ্জীব চৌধুরী : জীবনতথ্য - November 19, 2019
- বাঁশি ও বিচ্ছেদী - November 16, 2019
COMMENTS