ছন্নকালের ছিন্নকথা || আহমদ মিনহাজ

ছন্নকালের ছিন্নকথা || আহমদ মিনহাজ

মহাদুর্যোগের ক্ষণে কেমন আছেন আপনারা জানি না। আশা করি মারি ও সংক্রাম থেকে সুস্থ ও নিরাপদ রেখেছেন নিজেদেরকে। তাই যেন হয়, তাই যেন থাকেন সবসময়। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। মৃত্যুভয়ের কারণে নয়; সব মিলিয়ে যে-পরিস্থিতির মধ্যে আছি সেটার কথা ভেবে। কিছু করার ক্ষমতা নেই, একমাত্র দেখা ও লিখে যাওয়া ছাড়া! এ-রকম পরিবেশে মন স্থির করে লেখার কাজ চালিয়ে যাওয়া যদিও কঠিন!

মনের ভার থেকে হাল্কা হতে কম্পিউটারের সামনে বসেছিলাম। মারি নিয়ে হালফিল ভাবনাগুলো মাথায় ঘুরঘুর করছিল। মারি ও অণুজীবের সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে Laurie GarrettBernard Dixon-এর লেখাপত্র মাথার মধ্যে ঘূর্ণি তুলছিল। তার সঙ্গে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় অণুজীববিশেষজ্ঞ Jonathan Ball-এর সাম্প্রতিক গবেষণা আর Margaret Atwood-এর অলডাস হাক্সলিডিস্টোপিয়্যান নভেলBrave New World’ পাঠের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা নিবন্ধ, — সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে যাপন করছিলাম। চাপ পড়ছিল মনের ওপর। করোনা নিয়ে তথ্য ও বিশ্লেষণমূলক কিছু লিখব বলে বসে পড়েছিলাম। যদি চাপ কমানো যায় সে-আশায়। লেখাটি এক প্রকার শেষ করার পর বমনের অনুভূতি এত তীব্র হয়েছিল যে পরিমার্জনায় আর বসিনি। বিকল্প হিসেবে ‘দূরত্ব তিন ফুট’ নামের গদ্যভাষ্যটি জন্ম নিয়েছে দেখতে পেলাম। আজবই বটে!

লেখার পর মন হাল্কা হয়েছে এমনটি বলা যাচ্ছে না। কী লিখেছি, কী লেখা উচিত ছিল, দুঃসহ এই সময় লেখার উপযুক্ত কি না, তার কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। সে যা-ই হোক, লেখার পর কেন জানি ‘গানপার’-এর কথা মনে হলো; তাই লেখাটি পাঠালাম। ‘গানপার’-এর জন্য এই লেখাটি প্রাসঙ্গিক হয়তো না। সংগীতের খবর করার জোর পাচ্ছি না মনে। তবুও পাঠালাম। পড়ে দেখতে পারেন। যদি প্রাসঙ্গিক মনে হয়, যদি কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পান, তাহলে সাইটে তোলার অনুরোধ থাকল। যদিও অনুরোধ কেন করছি জানি না। যদি মনে হয় খাপ খাচ্ছে না তবে জানাবেন।

আসলে কোনোকিছুর অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। তার মধ্যেও অর্থ নির্মাণের চেষ্টা বদ্রিলারের কথা মনে করায়। ভদ্রলোক ঠিকই বুঝেছিলেন, চিন্তন ও শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষ যত বেশি অর্থ ও বিমূর্ততা তৈরির চেষ্টা করে, তত বেশি নিজেকে অনুলিপির বিপজ্জনক প্রান্তে ঠেলে দেয়। ততই অর্থহীন ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে জীবন। সেই জীবন সত্যিকারের জীবনের চেয়ে অধিক বাস্তব মনে হতে থাকে। বাস্তবতা আসলে অতিবাস্তবতার মাঝে বিলীন হয়। একটি অর্থের দুনিয়া, যাকে দিয়ে অর্থহীনতাকে বোঝার চেষ্টা করছে মানুষ। ওটা দিয়ে জীবনের মাপ খোঁজে সে। তাই যত অর্থ তত বিপদ। সে যাকগে, এছাড়া নিষ্ক্রান্তি কই?


শঙ্কা-জাগানিয়া কারোনা থেকে তাই খানিক দূরে সরে বইপাঠ, সিনেমা ও গানের মধ্যে ডুব দেবো ভাবছিলাম। যদিও সিনেমা ও সংগীতে কেন জানি মন বসছিল না। এর মধ্যে ইরফান খানের মুত্যুর খবরে মনটা আক্রান্ত হল বেশ!

কেমন যেন একঘেয়ে, শূন্য ও নিরর্থক মনে হচ্ছে সবকিছু! ভাবলাম বইয়ে ডুব দিলে হয়তো মন্দাভাব কাটবে। মির্চা এলিয়াদের ‘The Sacred and The Profane’-এর সঙ্গে শাহাব আহমেদের ‘What Is Isalm?’ বইয়ের সাংঘর্ষিক পঠনের মধ্যে চোখ এবং কানের পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছিল মানুষের আক্রান্ত হওয়া, সেরে ওঠা, মৃত্যুবরণ, লুক মন্টাগনিয়ার, HIV Conspiracy, ছদ্মবিজ্ঞান, করোনা-পরবর্তী মানুষের দিনকাল, বেঁচে থাকার অর্থনীতি সহ বিচিত্র হিংটিংছটের প্রবাহ!

তালগোল-পাকানো সেইসব প্রবাহ চকিত টুকে রাখছিলাম। কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই। ভেবেছিলাম জাভেদকে এসব নিয়ে দু-চার কথায় কিছু লিখব। লিখতে গিয়ে নিজের অজান্তে এই লেখাটি দাঁড়িয়ে গেল। ‘গানপার’-এ লেখাটি প্রাসঙ্গিক হলো কি না বলতে পারছি না। কতখানি সুবিচার করতে পারলাম প্রসঙ্গগুলোর আলোচনায়, সেটা মোটের ওপর নিজের কাছেও ঝাপসা।

‘চেতনার পালাবদল ও করোনা প্রসঙ্গ’ শিরোনামে দুই কিস্তির গদ্যভাষ্যটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও দীর্ঘ হয়ে গেল। এত বড় আকার ধারণ করবে ভাবিনি। এ-আমারই ব্যর্থতা — ছোট পরিসরে লেখার ক্ষমতা আজও অর্জিত হলো না! যদিও অনেকসময় ছোট পরিসরে অনেকবেশি বলে ফেলা যায়। প্রথম কিস্তিতে বিজ্ঞানী লুক মন্টাগনিয়ার ও তাঁকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্কের ওপর আলোকপাতের চেষ্টা করেছি। করোনাভাইরাসের উৎস ঘিরে বিজ্ঞান ও ছদ্মবিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব এই কিস্তির মূল সুর। খানিক প্রতিবেদনের ধাঁচে লেখা। গদ্য কতটা সাবলীল হলো বুঝতে পারছি না।

তবে মনে হয়েছে মাঝেমধ্যে এ-রকম বিষয় নিয়ে দু-চারকথা লেখার দায় এড়ানো যায় না। আমার কাছে পুরো কিস্তিটি খসড়া হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ-ধরনের বিষিয় নিয়ে লিখতে হলে আরও গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। সেই অর্থে এটি গভীর কোনও বিশ্লেষণী পাঠ নয়, বলতে পারেন চলমান সময়ের বিতর্কিত প্রেক্ষাপটকে প্রতিবেদনের ঢঙে ধরে রাখার চেষ্টা। পরে সময়-সুযোগ মতো আরও গভীর-কথনের প্রয়োজন হবে এবং তখন খসড়াটি চূড়ান্ত রূপ নিতেও পারে।

প্রথম কিস্তির সঙ্গে দ্বিতীয় কিস্তির সংযোগ ক্ষীণ মনে হলেও অন্যভাবে ওটারই প্রতিধ্বনি। মনের ভিতরে ওঠা বুদবুদের তাগিদে লেখা এবং এটুকু বলতে পারি লিখতে ভালো লেগেছে। এই কিস্তিটি পরিবেশবিজ্ঞানী জেমস লাভলকের গাইয়া হাইপোথিসিস পাঠের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বেরিয়ে এসেছে বলতে পারেন। যদিও অর্থনীতি এখানে বড়ে জায়গা জুড়ে বিস্তারিত হয়েছে। জেমস লাভলককে আমি সামান্য ছুঁয়ে গেছি। ইচ্ছে আছে গাইয়া নিয়ে পৃথক পরিসরে বিস্তারিত লেখার এবং সেটা ‘গানপার’-এ। গাইয়া সেটা দাবিও করে। আমি এখনও এর পাঠে সক্রিয় রয়েছি বিধায় আপাতত ছুঁয়ে গেছি, অধিক বিস্তারিত হইনি। এই কিস্তিটিও কষ্ট করে পড়ে দেখবেন। হয়তো মনের কোনও গোপন তন্ত্রীতে ঘা দিতেও পারে। যদি দিয়ে থাকে সেটা আমার জন্য প্রেরণা। না দিলেও বলবেন। নতুন করে ভাবব।


স্মরণ রাখা যাক, করোনা আউটব্রেকের গোড়ার দিকে দেশজোড়া লকডাউন পরিস্থিতিতে গেহে-অন্তরীণ অবস্থায় লেখকের সঙ্গে গানপারের উপর্যুপরি চিঠি চালাচালি হয় লেখা চেয়ে। মেনশন বাহুল্য, সংযোগের মাধ্যম ইমেইল। গানপারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে লেখক আহমদ মিনহাজ করোনা ক্রাইসিস ও তদুদ্ভুত দার্শনিক সঙ্কট ও ফোঁপরা-ফাঁপা মানবিকতা আর বিশ্বনৈতিকতা নিয়া গানপারেই লিখেছেন একাধিক লেখা। যা-হোক, এই নিবন্ধটা গানপারই ফিচার করছে, লেখকের সম্মতি নিয়েই, ইমেইলের কিছু কথামালা একত্রে বেঁধে এই নিবন্ধ, অতি ব্যক্তিগত কথাগুলো শুধু অমিট করা হয়েছে। এই সিরিজে লেখকের অন্যান্য কথাচক্র পাওয়া যাবে তাৎক্ষণিকা শিরোনামে গানপারের ফিচার করা আহমদ মিনহাজের নিবন্ধফোল্ডারে। — গানপার

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you