নন্দলাল || সৈয়দ মুজতবা আলী

নন্দলাল || সৈয়দ মুজতবা আলী

তুর্কী-নাচন নাচেন নন্দবাবু
চতুর্দ্দিকে ছেলেরা সব কাবু।
তুলির গুত্তা ডাইনে মারেন, মারেন কভু বাঁয়ে
ঘাড় বাঁকিয়ে, গোঁফ পাকিয়ে, দাঁড়িয়ে একপায়ে।
অষ্টপ্রহর চর্কীবাজী কীর্তি-মন্দিরে
ছেলেরা সব নন্দলালকে ঘিরে
মাছি যেমন পাকা আমের চতুর্দিকে ফিরে।

হচ্ছে ‘নটীর পূজা’
রানীর সঙ্গে হল নটীর পূজা নিয়ে যুঝা।
বরাঙ্গনা ভিক্ষু নটীর নৃত্যচ্ছন্দ ধূপ —
তুলির আগুন পরশ পেয়ে নিল আবার সেই অপরূপ-রূপ
— বহু যুগের পরে —
চৈত্যভবন ভরে।

গানের আসর পারা
— সন্ধ্যাকাশে ফোটে যেন তারার পরে তারা —
হেথায় সেতার কাঁপে ভীরু, হোথায় বীণার মীড়
আধফোটা গুঞ্জরণের ভিড়
তার পিছনে মৃদু করুণ-বাঁশি
গুমগুমিয়ে থেকে থেকে উঠছে ভেসে খোল-মৃদঙ্গের হাসি।

এ যেন সুন্দরী —
প্রথমেতে নীলাম্বরী পরি,
সর্ব অঙ্গে জড়ায় যেন অলঙ্কারের জাল; —
তিলোত্তমা গড়েন নন্দলাল।
চিত্রপটে কিন্তু নটী ফেলে অলঙ্কার
শুনি যেন বলে চিত্রকার, —
“তথাগতের দয়ায় যেন তেমনি ঘুচে তোমা সবার সকল অহঙ্কার।”

সাদামাটার রক্তবিহীন ঠোঁটে
লজ্জা সোহাগ ফোটে,
পাংশু দেয়াল আনন্দে লাল নন্দলালের লালে
তুলির চুমো যেই না খেলো গালে।।*

* শ্রীযুক্ত নন্দলাল বসুর বরদারাজ্যের ‘কীর্তি-মন্দিরে’ রবীন্দ্রনাথের নটীর পূজার ফ্রেস্কো ছবি আঁকিবার সময় লেখক কর্তৃক এক বান্ধবীকে আসিয়া দেখিবার জন্য নিমন্ত্রণপত্র।


‘নন্দলাল’ শীর্ষক এই রচনাটা আমরা আলীর রচনাবলির প্রথম খণ্ড থেকে নিতেসি। ‘সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী’ (প্রথম খণ্ড) মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড  কর্তৃক ভাদ্র ১৩৮১ বঙ্গাব্দে শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট কলিকাতা থেকে পাব্লিশড। চতুর্থ মুদ্রণ হয় বৈশাখ ১৩৯৩ বঙ্গাব্দে। এই খণ্ডটা প্রকাশিত রচনার, বলা তো অবশ্যই বাহুল্য। ‘পঞ্চতন্ত্র’ সমাদৃত হবার পরে লেখক ‘ময়ূরকণ্ঠী’ নামে সমধর্মী আরেকটা বই সংকলিত করতে উদ্যোগী হন, জানাচ্ছেন উক্ত বইয়েরই ভূমিকায়। মোটমাট তিনটা বই নিয়াই প্রথম খণ্ডটা আঁটানো, প্রোক্ত দুই বই ছাড়াও রয়েছে ‘দ্বন্দ্বমধুর’, আর রয়েছে সম্পাদক গং থেকে গজেন্দ্রনাথ মিত্রের ভূমিকা, প্রমথনাথ বিশীর মূল্যাঙ্কন ও সৈয়দ মূর্তাজা আলীর কলমে লেখকজীবনী। প্রায় চারশ পৃষ্ঠার ঢাউশ ভলিয়্যুম।

নন্দলাল বসুকে নিয়া আলীর রচনাটা বইয়ের মধ্যে ‘নন্দলালের দেওয়াল-ছবি’ শিরোনামে লভ্য। পুনর্প্রকাশের সময় শিরোনাম খানিকটা ক্যাচি করে নেয়া গেল। কবিতার আঙ্গিকে লেখাটা আনন্দ দ্যায় এমনিতেই, অনেক ইঙ্গিত চট করে ধরতে না-পারলেও। সৈয়দ মুজতবা আলী তো আর কবি হিশেবে মশহুর হন নাই। কাজেই, বাংলাদেশের তরুণ কবিরা নিশ্চয় আলীর এই কাব্যটুকরাটা নিয়া ফেসবুকে নৃশংস ট্রল করতে নামবেন না। আর এইটা লেখা হয়েছে কেন, পাদটীকায় আলী নিজেই অ্যাস্টেরিক্স দিয়া তা বলে দিতেসেন। নিমন্ত্রিত সেই বান্ধবীটিরে দেখতেও মন চায়, আজও, এত ধূসর দশকের পর দশক পেরোনোর পরেও। বন্ধু ও বান্ধবীরা, আলবৎ, চিরকমনীয়।

আরেকটু তথ্য যোগ করি। পদ্যে লেখা এই পিসটাকে ফেলনা ভাবব না আমরা। কারণ, খোদ আলী এইটাকে ভ্যালু দিতেসেন। নইলে বইয়ের একদম শুরুতে এর স্থান সংকুলান হতো? ‘ময়ূরকণ্ঠী’ সংকলনের দ্বিতীয় রচনা এইটা। শুরু হয়েছে ‘গুরুদেব’ রচনায়, তারপরেই এইটা, মানে ‘নন্দলালের দেওয়াল-ছবি’। আর, যা বলবার, বানান হুবহু অবিকল রচনাবলিতে যেমন আছে তেমন।

প্রকাশিত মুজতবারচনারাশির এই চারশত-প্রায় পৃষ্ঠার বইটি সম্পাদনায় গজেন্দ্রকুমার মিত্র সহ চারজনের একটা প্যানেল কাজ করেছে এবং তাদের তরফ থেকে একটা ভালো কলেবরের সম্পাদকীয় বইয়ের শুরুতে সেঁটে দেয়া আছে। আর, আরেকটা কথা এ-ই যে, কেবল এইটাই নন্দলাল বসু নিয়া আলীর একমাত্র রচনা নয়; তাঁর রচনাবলি সংকলনের পরবর্তী খণ্ডগুলায় নন্দলালকেন্দ্রী অনেক রচনা রয়েছে যেইগুলা পাঠ-অপরিহার্য ও চমকপ্রদ রসজারিত। পুনর্পাঠের ক্ষেত্রে এই রচনাটাই বেছে নেয়ার কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদনা নাই স্বীকার্য। পুনর্পাঠের একটি নিয়মিত না-হলেও অনিয়মিত প্রচেষ্টা গানপার থেকে চেষ্টা থাকে করবার, এইটা তারই ধারাবাহিকতা। — গানপার

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you