আমি গানের লোক না। ন্যূনতম কোনো তাত্ত্বিক জ্ঞান আমার নাই গান বিষয়ে, এই স্বীকারোক্তি দিয়ে শুরু করলে ভালো হয়। পরে লাভ আছে। আক্রান্তের বেদনা তাতে থাকে না।
প্রতিটা সময়য়ের একটা চালু ধারা থাকে; সেই ধারায় সব গাইয়ে গান বাঁধে, যন্ত্র বাজায় সাধারণত। যেমন ধরা যায়, যে-সময় আব্বাস উদ্দীন গান গাইতে এল তখন বাংলা গান আমি, তুমি, প্রেম, প্রকৃতি, দেশপ্রেম, ভাব-ভাবালুতায় ভারাক্রান্ত। প্রেমিক প্রেমিকারে চায়, চাঁদের আলোয় আড়ালে, গুনগুনিয়ে। যাকে আমরা গান বলে জানতাম, সেই শিক্ষিত বাংলা গানের ঘরানার ধারাবাহিকতায় যৌনতার বাতাস লাগে নাই তখনও। ভালোবাসা মানে লাভ, লাভমেকিং না। চালুধারার চাপে কেউ এমন গান শিক্ষিতের দরবারে গায় নাই। ফকিরি গান সেই সময়ে মূলধারায় ছিল না বলেই মনে হয়, সঠিক করে বলতে পারি না। মানে আমি তোমারে চাই, চাই মানে চাই এই কথা আর নাই। প্লেটোনিক কাজকারবার ছিল, যদিও প্লেটো আমাদের কেউ না। ইংরেজরা শাসন আর অস্ত্র শুধু আনে নাই, ভিক্টোরীয় নীতিনৈতিকতাও আমাদের শিক্ষিত সমাজকে দিয়েছে। সো গানে আমরা রাণীর মতো শালীন ভাবসম্পন্ন ছিলাম বহুদিন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ কোন সর্বনাশের আশায় আমাদের মনকে বসিয়ে রাখে তা তো বোঝাই যায় ।
কিন্তু সুর ছিল আমাদের। সুর বদলায় না। কথা বদলায়, যন্ত্র বদলায়, ভাব বদলায়, গায়কী বদলায়। সেই নাবালক স্বর্ণযুগে আব্বাস উদ্দীন বাংলা গানরে একটু গোঁফ-দাড়ি দিলো। এই গান শিক্ষিত ভোক্তা একটু অন্যভাবে নিলো। নজরুলে এসে যেমনে চাইতে হয় তেমনি চাইলো পরস্পরকে। গানে একটু সাবালক প্রেমিক হলো। এই যে বাংলাগানে একটা সাহস চলে এল, লজ্জার ভাঙনে একটা ভাসান এল। চালু প্রেমের বোধটাকে, ভিক্টোরীয় ভালোবাসাটাকে, প্রকৃতি আর ভাবটাকে ভাঙার মাধ্যমেই নতুন গানের শুরু হলো। কারার ঐ লোহ কপাটে বাঁধ ভেঙে দাও সন্ধি হলো। দুটোই বিদ্রোহ, নতুন ফর্ম।
সমাজে যখন পরিবর্তন ধরে তখন তা যৌনচেতনা দিয়ে শুরু হয়। আর এই হাওয়া, বিষহাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ে। তো শুধু যৌনবোধের পরিবর্তন হয় নাই, সাথে সাথে গানের চেতনাটাই নতুনভাবে তৈরি হলো। এই যে আলাদাভাবে গাইতে চাওয়া, সুর আর কথার বিশেষত্ব বাংলা গানরে নতুনভাবে তৈরি করে নিলো। শ্রোতার কান ও মন দুইটাই তৈরি হলো। নতুন মন আর কান আপনিই তৈরি হয় গানে। কথা সুর আর বাদ্যের শ্রবণ, গায়কী দেখা যায় যেন; অনুভব-অনুভূতি মনের গভীর মগজের সাথে প্রোথিত। গান হলো মাদকের মতো। কানে খায়, চোখে দেখে, মগজে মাদকাক্রান্ত হয়। ভালো গান আপনিই স্থান নেয় সমাজে। আর গানের ভালোটা কি, সেটাই প্রশ্ন। সেইটাই ভালো গান যেইটা আপনারে নতুর মাদকতা দেয়, আবেশিত করে। যেহেতু কোনো একক মাধ্যম গান না। কথা সুর বাদ্য আর গায়কীর সম্মেলন। এই সম্মেলনপ্রক্রিয়া নিখুঁত হলেই ভালো গান হয়। রবীন্দ্রনাথ, লালন, পাঁচ কবি, আব্বাস, নজরুল, সুমন, মহীনের ঘোড়াগুলি, লেনন, মেটালিকা ইত্যাদি এই নিখুঁতেই গড়ে ওঠা।
সমকালীন সংগীতধারার বাইরে নতুন ইন্দ্রিয়ানুভূতি নিয়ে যখন আবহমানতার ধারাবাহিকতায় সংগীত সিন্থেসিস্ হয়, তখনই ভালো গান তৈরি সম্ভব। তৎকালীন চিন্তাধারার বাইরে আবহমানতার ধারাবাহিকতায় আব্বাস বা নজরুলের সাবালকত্ব। এই ধারাবাহিকতার কারণেই হয়তো সে-সময় গানগুলো শ্রোতাদের দুলিয়েছে। সাদরে গৃহীত হয়েছে। নতুন সৃষ্টি এসেছে।
আমরা তো আর সেই উত্তর-রাবীন্দ্রিক হাওয়ায় নাই, রাণীর নীতি কবরে। জীবন এখানে অন্য রকম। সময় পাল্টে গেছে। তবে আবহমানতার জীবিত কান তো আমাদের আছেই। কান তো ধারাবাহিকতায় তৈরি। তারপরও অধিকাংশ বাংলাগান পাল্টায় নাই হরেদরে। বদলের ডাক শোনার হৃদয় সবার থাকে না। বাংলা গানের স্ট্যান্ডার্ডটা সর্বদা ব্যতিক্রমী। আমাদের গানের অ্যাভারেজ কোনো মাপ নাই। সো রবীন্দ্রধারাবাহিকতায় আপনি আর কাউকে পাবেন না। বা নজরুলের পর আর কোনো গানের মিথ নাই। যা আছে তা বিলো-দ্য-অ্যাভারেজ। কিছু ব্যতিক্রম আছে নাকি? সুমন! সো, আমাদের মূল গানের ধারা এখনও নাবালকত্বটারেই লেখে, গায়, শ্রোতা শুনতে বাধ্য হয়। পুঁজিবাজারে যেহেতু সাবস্টিটিউট নাই, ভিন্ন পছন্দের উপায় নাই সো বাংলা গানের শাসনদণ্ড তিন বা চারজনের হাতে।
অর্ণব কেন ভালো লাগে? কারণ দুইটা ‘বিকল্প’। এক. অর্ণবের বিকল্প নাই। দুই. আমাদের এছাড়া আপাতত কোনো বিকল্প নাই। আর যে-গান অর্ণব লেখে, যন্ত্র বাজায়, গায় তা গতানুগতিকতার বাইরে – তা তো সত্য। চলমান গানশিল্পব্যবস্থার বাইরে তিনি, তবে ধারাবাহিকতার কেন্দ্রহীনতায় নয়। ফলে, এই গান ভাবে নতুন। অথচ মনে হবে কোথাও যেন আগে শুনেছেন। এবং এজন্যই আরও শুনতে চায় কান। মানে কথায় নুতন, সুরে ফিউশনিস্ট, ধারায় আবহমান – এই মিলে অর্ণব। আবহমানতাকে রক্ষা করতেই তিনি ফিউশনিস্ট।
যে-সুরগুলো প্রচলিত তার উপরই অর্ণব কথা সাজিয়েছে এবং বাদ্যযন্ত্রটা বাজিয়েছে। প্রবহমান সুরটার মধ্যে সময়টাকেই বসানো লিরিকলেখক-গাইয়ের কাজ। তার লিরিক অতি কাব্য-আক্রান্ত। গানের শ্রোতা গানটাই শুনতে চায়। গানের কথাকে আলাদাভাবে কাব্যিক বললে তো গানটা তার সংগীতময়তা হারায়। সুমনের ‘বুকের ভেতর বৃষ্টি পড়ে’ বা ‘একলা হতে চাইছে আকাশ’ – এগুলো তো কাব্য না, গানই। অর্ণবের কথার যে ভাঙা ভাঙা আপাত-জটিল লিরিক তা তো আমাদের শোনার কথা না সেই অভ্যস্ততা থেকে। তবে শুনি সুরটার জন্যই। সো, তার গান কেমন কেমন লাগে, ভালোও লাগে, চেনা-চেনাও লাগে। ‘যেমন করে গাইছে আকাশ, তেমনি করে গাও গো’ – মৌলিক ধারাবাহিকতা নিয়েই অর্ণব। এটাই শিল্পীর আবিষ্কার, টেকনিক, নৈপুণ্য। এইখান থেকে নতুন গানের সূচনা হতে পারে।
কবিতা যত-না দ্রুত পাল্টায় গান ঠিক ততটা আস্তে বদলায়। সেজন্যই রবিঠাকুরের কবিতায় যত-না লোকের আগ্রহ তার থেকে তার গানের কাঙাল অনেক বেশি। এইসমস্ত গানের সেন্সিটিভিটির মাপ কাব্যমাধ্যমে মাপার কোনো সুযোগ নাই। গান মানে গান। সংগীতকে এতটা চিরকালীন ভাষায় রচিত হতে হয়, অলঙ্কারটা পরাতে হয় আবহমানতার সুরের ফুলের।
সো, বাংলাগানের পাদটীকায় অর্ণবের স্থান ছোট অক্ষরেই লেখা থাকবে যদি-না লিরিকটা গানের ভাষায় লিখিত হয়।
লেখাটা মার্চ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে একবার প্রকাশিত হয়। ‘লাল জীপের ডায়েরী’ ওয়েবম্যাগে এইটা অ্যাভেইল করা যেত আগে। যেহেতু লালজিপ সঞ্চালনলুপ্ত অধুনা, গানপারে এইটা আপ্লোডের উদ্যোগ নেয়া। ভাগ্যচক্রে লেখকের অনাপত্তি আদায় করা সম্ভব হয়েছে ওভার ফোন। — গানপার
… …
- কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব - February 15, 2020
- মুখোমুখি গুন্টার গ্রাস || মৃদুল মাহবুব - January 6, 2020
- হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব - December 15, 2019
COMMENTS