ভূমিকম্পপ্রবণ হিশেবে যে-কয়টা অ্যারিয়া বাংলাদেশে থ্রেট হয়া আছে এর মধ্যে সিলেট একটি। সিলেটে সকাল থেকে এ-পর্যন্ত (২৯ মে ২০২১ সকাল থেকে বেলা দুইটা/আড়াইটা পর্যন্ত) কয়েকবার ভূকম্পন অনুভূত হলো। সংবাদপত্রের ভাষা এইগুলা — ‘ভূকম্পন অনুভূত হলো/হয়েছে’ ইত্যাদি। কিন্তু সকাল থেকে বেলা আড়াইটার মধ্যে যদি তিন/চার/পাঁচবার মাটি কেঁপে ওঠে, কেমন লাগে বলেন তো? ‘উপর্যুপরি ভূমিকম্প’ বলে কী সম্ভব এর সিকিভাগ ভয়ালতা বোঝানো? সংবাদপত্রের অকেজো-অচলা ভাষায় এইগুলা প্রকাশ করা যায়? যায় না। খালি নিজের হাত নিজে কামড়ানোর মতো চণ্ড ক্রোধ হয় প্রতিবার ভূমিকম্পের সময়। সিলেটে যে-টিলাগুলারে আমরা আবাল্য জেনে এসেছি পৃথিবীর পেরেক, — আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ঘরবাড়ি ছিল টিলার উপর বা টিলা ঘেঁষে, গোটা সিলেট তো বলা বাহুল্য, আমি বলতেসি সিলেট শহরের কথা, আর হাজার হাজার মাইল জলাভূমি যেইগুলারে আপনারা হাওর-বাওড়-বিল ইত্যাদি নামে চেনেন — সমস্ত উধাও, উধাও, উধাও! গত দুইদশকেই সিলেট হয়ে গেছে বেশরম বিল্ডিং আর বলদামির অঞ্চল। অথচ সিলেটে এই তিন-চাইর দশক আগ পর্যন্ত ঘরবাড়ি নির্মাণপ্যাটার্নটাই ছিল আলাদা। আসাম প্যাটার্ন, শিলং প্যাটার্ন, দার্জিলিং প্যাটার্ন — এই তিনটার মধ্যেই ময়মুরব্বিরা সিলেটের বাড়িঘর দরদালান বানাইসেন। মডার্ন ইমারতপ্রকৌশলীদের হাতে পড়েই কী সিলেটের অবস্থা আরও ফ্রেজাইল আরও নাজুক হয়ে উঠল? পুকুর হাপিশ, হাওর হাওয়া, গাঙ উধাও। গত দশবছর ধরে দেখতেসি, রোজগারঘরে যেতে-আসতে হয় আমায় যে-বাইপাস রোড দিয়া তা সেনাবাহিনীর সুবিশাল দানবীয় নয়া স্থাপনায় হাজার হাজার হেক্টর অক্যুপাই করা। কতশত বিলিয়ন মাছ আর পানির উদ্ভিদ আর গাছ আর মেছোবাঘ আর বেজি চিরতরে বিলীন হয়ে গেল তা নিয়া কানতেসি না, ভাবতেসি যে এই বিশাল অ্যারিয়া মাটি দিয়া ভরাইতে যেয়ে সেনামণিরা, আমাদের সোনার টুকরা সেনামণিরা, কয় বিলিয়ন টন টিলামাটি ইউজ করসে, কেউ প্রতিবেদন করে নাই। রিভার ড্রেজিং করে যেমন মাটি নিসে তারা, বাদ দেয় নাই সমতল এবং টিলা। কিন্তু আমি রোজ যাতায়াতপথে দেখতেসি নিত্যনয়া লালমাটি/টিলামাটি লরি-কে-লরি এসে নামতেসে আজও। দশবছরেও পুরা হয় নাই বিল্ডিং কন্সট্রাকশন, চলবে আরও দশ-বিশ-ত্রিশ। গত বেস্পতিবারেও দেখসি বিশাল অ্যারিয়া রাতারাতি টিলামাটিতে ছেয়ে ফেলা হয়েছে। রাতারাতি মানে রাতারাতিই, ওভারনাইট। যদিও ব্যক্তিপর্যায়ে ঘরবাড়ি নির্মাণে টিলামাটি ইউজ করার ট্রেন্ড অভাবিতরকমে কমে এসেছে। এখন শুরু হয়েছে পরিবেশধ্বংসী প্রাতিষ্ঠানিক রাহাজানি। এই জানুয়ারিতে গেসিলাম সুনামগঞ্জের কয়েকটা উপজেলায়। দেখে হতভম্ব হয়ে গেসি কী বিকট উন্নয়ন চলতেসে সেখানে সর্বত্র! সমস্ত হাওর হয়ে যাচ্ছে মেডিক্যাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেনারেল তরিকার বিশ্ববিদ্যালয়, সায়েন্স অ্যান্ড টেক্নো বিশ্ববিদ্যালয়, লেদার টেক্নো বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক-স্বাদেশিক বিমানবন্দর … সীমাহীন বেশুমার এই প্রশংসনীয় উন্নয়নগুলা হইতেসে তো হাওরের গতর ভরাট করেই। চিরজীবী হতেসেন মন্ত্রীমহোদয়। এলাকাবাসীও খুশি নিজস্ব সয়সম্পত্তি পেয়ে। এইসবের কন্সিক্যুয়েন্সেস্ তো থাকবেই, টুকটাক আর্থক্যুয়েইক তো হবেই। কিছুদিন আগে নেপালে যেমন হইসিল, আমরা দেখসি, দফায় দফায় মিনিটে মিনিটে ভেঙে-পড়া দালান আর মানুষের মৃত্যু ও হাহাজারি। সিলেটে ভূমিকম্প ব্যাপারটারে ‘বৈছাল’ নামে ডাকে সবাই। সিলেটে যারা জন্মেসে, তারা প্রায় সবাই কবেকার বড়-বৈছালের গল্প শুনে বড় হয়েসে। এইগুলা ইয়াদ হইতেসে। তেমনি সিলেটে সাততলা বিল্ডিং বানানো যাবে না, শাহজালাল নিষেধ করে গেসেন — এই মর্মে যেই নিষেধাজ্ঞা আমরা বংশপরম্পরায় মেনে এসেছি, তার কারণ তো কোনো অজ্ঞাত আদিভৌতিক ব্যাপার নয়, তার কারণ এর সয়েলের নাজুকতা। লাস্ট দুই ডিকেইডে সিলেটে চব্বিশতলা দালান বানানোর হিড়িক পড়ে গেসে। এইসবের কন্সিক্যুয়েন্সেস্ তো থাকবেই। টিউবোয়েল সিলেটে এত বেশি যে ব্যক্তিপিছু নলকূপের সংখ্যা সার্ভে করলে একাধিক বারায়া আসবে। এরই মধ্যে এই শহরে কয়েক লক্ষ ডিপটিউবোয়েল হয়ে গেসে। একটা বাড়ি একটা ডিপ নলকূপ। কই পাবা পাতালের পানি? সিলেটে প্রত্যেকটা ফকিন্নিবাড়িতেও জোড়াপুকুর থাকত, সামনে এক পিছনে এক, ছোট-বড়-মাঝারি দিঘি প্রায় প্রত্যেকটা গ্রামে, এখন সিলেটের শনৈ শনৈ নির্মিত লক্ষ লক্ষ মসজিদের একটাতেও কোনো পুকুর নাই, বাড়িঘরে পুকুর থাকা তো দূরের কথা, খাল নাই বিল নাই ছড়া নাই ঝর্ণা নাই ইঁদারা নাই … আছে সেলিব্রিটি সোয়াম্প ফরেস্ট একটা, অথচ অণ্ডকোষ-খোয়ানো বলদগুলা জানে না গোটা সিলেটটাই একটা সোয়াম্প ফরেস্ট। এইসবের একটা কন্সিক্যুয়েন্স তো থাকবেই। সিলেটের শ্রীমন্ত শরীরের উরু-উদর-স্তন-যোনি কিছুই শ্রীসম্পন্ন নাই আর। ভূগর্ভস্থ তরল-কঠিন-বায়বীয় সবই নিঃশেষ। জল-তৈল-কয়লা-পাত্থর-বালি-গ্যাস খনন করতে করতে এখন এই শ্রীহট্ট মরমি গানের মতো ‘শূন্যের মাঝার’ ভাসতেসে। এসবের একটা কন্সিক্যুয়েন্সেস্ তো থাকবেই। সিলেটের ধ্বংসযজ্ঞ-ভগ্নস্তূপের উপর দাঁড়ায়া প্রাইম ও পাতি মিনিস্টাররা বাইট পাবে টেলিভিশনের, মেয়র করবে মেয়রগিরি, ইঞ্জিনিয়ার তার শিক্ষিত হোয়াইট-কলার ঝাড়াঙ্গি দিয়া আলোকিত সিলেটের প্ল্যান শেয়ার করবে, লুটেরা পারিবারিক ঐতিহ্যের বৃদ্ধ লোলচর্ম মন্ত্রী তিলোত্তমা নগরী বানাবার খায়েশ প্রকাশিবে ডায়নোসোরের মতো মুখবিবর উদাম করে। বেজির বিলুপ্তপ্রায় গাতায় একআধটে বেজিও যদি ইস্রাফিলের শিঙার আওতার বাইরে বেঁচে যায়, সার্ভাইভ করে, একটি সিলেটি বেজি নিয়া আসমুদ্রহিমাচল কবিসাইত্যিকদের স্তুতিকথা গাঁথা হবে, ফেসবুক উপচাবে ক্যাচরম্যাচর কমেন্টে, কেউ হয়তো-বা গানও ফেঁদে বসবে এবং তা ফালতু উদীচীর জনবিচ্ছিন্ন শ্রোতাবিরল কোনো রোডসাইড ফাংশনে অ্যানশিয়েন্ট ব্রজবুলি কি হিব্রু সুরে এবং অসহনীয় উচ্চারণে রেন্ডার করা হবে। একটা ভ্যারিয়েন্টই থাকবে ‘সিলটি ভাইছাব’ স্পিশিজের, যারা লান্ডান-ব্রিকলেইন-ফিলাডেলফিয়ায় বাহ্রাইন-আবুধাবি-লিবিয়ায় জার্মানি-ইরান-রাশিয়ায় বেচতেসে ঘাম ও রক্তঘন জৈবনিক আয়ু। রোদন করবে তারা, কাঁদবে বেড়ালের মতো কুঁইয়া কুঁইয়া। আচ্ছা, ভালো কথা, বাংলাদেশ বাঁচবে তো? সবার ভাবেসাবে তা-ই মনে হয়, বাংলাদেশ বেঁচে যাবে, খালি সিলেটই মিলায়া যাবে স্পেসে মহাশূন্যে। এইসবই লিটারেইট বাংলাদেশের ইমার্জিং চিত্র। গোবরগণেশের দেশে একটা আস্ত অঞ্চল গত একদশক ধরে প্রায় প্রতিমাসে কেঁপে কেঁপে উঠতেসে, নেপাল ক্যুয়েইকের সময় প্রায় প্রত্যেকটা ঝাঁকুনি সিলেটে টের পাওয়া গেসে, এদিককার সীমান্তপারানো মনিপুর-ইম্ফল-শিলং অঞ্চলগুলার প্রত্যেকটা ঝাঁকুনিই সিলেটে টের পাওয়া যায়। সিলেটে এই ডিজ্যাস্টার থ্রেট থেকে বারায়া আসবার কোনো প্রোগ্র্যামপ্রচেষ্টা নাই। সিলেটের পাতালসমাধি ইজ্ অ্যা ম্যাটার অফ টাইম নাউ। সো হোয়াট? আমরা রাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ইমপ্লিমেন্ট করি। বিল্ডিং বানাই গায়ে-গা। পাহাড় উড়ায়া দেই হাওয়া। গাঙ ফৌৎ করি। বিমানবন্দর বানাই নিধুয়া পাথারে।
লেখা / জাহেদ আহমদ
আগেরবারের ভূমিকম্প প্রতিবেদন
জাহেদ আহমদ রচনারাশি
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS