প্রাচীন সমাজে নয়, নিকট-অতীতে আমাদের নিম্নবিত্তের প্রাণবন্ত শৈশবে-তারুণ্যে ঈদসংখ্যার গুরুত্ব ছিল। আমরা অপেক্ষা করতাম। একেকজন একেকটা ঈদসংখ্যা কিনতাম। ভাগাভাগি করে পড়তাম। ঈদসংখ্যার খসড়া লেখাগুলোর জন্যও আমাদের খুব আগ্রহ ছিল। লেখাগুলোতে একজন লেখকের আগামী দিনের লেখালেখির প্রকাশ ও প্রস্তুতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। পশ্চিমবঙ্গের লেখকেরাও আমাদের ঈদসংখ্যাগুলোয় লিখতেন। মানে ভাগ বসাতেন। বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখকের লেখা ও অনুবাদগুলো স্থান পেত সংকলনে। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদ যে-সংকলনে লিখতেন সেই সংকলনটির আলাদা গুরুত্ব ছিল তখন। হুমায়ূন আহমেদের লেখা যে-কোনো সংকলনকেই ঔজ্জ্বল্যমণ্ডিত করত।
ঈদসংখ্যা কেনা এবং পড়াটাকেও আমরা উৎসবের অংশ মনে করতাম। সংখ্যাগুলোকে কেনা এবং পড়ার মধ্যে একটা সামাজিক স্মার্টনেসও ছিল। সেইসব সংখ্যাযর মাধ্যমে কত কত লেখক আর কত কত লেখার সঙ্গে যে পরিচিত হতাম! এখন সময় ও সমাজটার মতো ঈদসংখ্যাও মরে গেছে। আগের সংখ্যাগুলোর মতো এখনকার সংখ্যাগুলোকে তেমন আর সমৃদ্ধ মনে হয় না।
ঈদ উপলক্ষে শিল্পীদের গান রিলিজ করার ব্যাপারটিও মরে গেছে। আমরা ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন শিল্পীর ক্যাসেট কিনতাম। সেসব ক্যাসেটের বিবরণপৃষ্ঠায় দেয়া থাকত গানের লিরিক, গীতিকার-সুরকার-শিল্পীর পরিচয়। টেবিলে কিংবা শোকেসের কোনায় সেসব ক্যাসেটের বাকশ সাজিয়ে রাখতাম। সারাবছর ধরে শোনা হতো গান। শেষ হয়ে গেছে ক্যাসেটের যুগ।
দৈনিকের সাহিত্যপাতা যেমন মরে গেছে তেমনি মনে হয় ঈদসংখ্যাও মরে গেছে। কেমন যেন প্রাণহীন, দায়সারা, বের করার জন্য বের করা কিংবা বিজ্ঞাপনের লাভালাভির জন্য বের করা — চেতনহীন কলেবরে এভাবেই সংখ্যাগুলো বেরোচ্ছে। অথচ আগে ঈদসংখ্যাগুলোর ভেতর দিয়েই একজন লেখক পাণ্ডুলিপি গোছাতেন।
এখনো হয়তো লেখক ঈদসংখ্যার ভেতর দিয়ে তার চিন্তা এবং পাণ্ডুলিপির খসড়া তৈরি করেন। কিন্তু পাঠকেরা ঈদসংখ্যা থেকে অনেক দূরে চলে গেছেন। আমাদের ছোট মফস্বল শহরগুলোতে ঈদসংখ্যা নিয়ে আর তেমন আগ্রহ কিংবা হইচই দেখি না। আমাদের ছোট শহরগুলোতে ঈদসংখ্যা তেমন আসে না। মানে পাঠকের চাহিদা নেই, আগ্রহ নেই বলেই আসে না। এর জন্য হয়তো কন্টেন্ট কিংবা যথার্থ কন্টেন্ট নেই বলে পাঠকের মৃত্যু ঘটেছে।
এই রোজার বিকেলে ঐতিহ্যের (ঐতিহ্য প্রকাশনীর) ঈদসংকলন ‘চানরাত’ পেলাম। কী প্রচ্ছদ, কী অলঙ্করণ, কী ছাপাছাপি, লেখক ও লেখার বিষয় নির্বাচন সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ একটি সংখ্যা বের করেছে ঐতিহ্য প্রকাশন। সবচেয়ে বড় কথা ঐতিহ্য ঘোষণা দিয়েছে তাদের এই সংকলনটি বিজ্ঞাপনমুক্ত। সেজন্য এই সংকলনটির আলাদা গুরুত্ব আছে। সবাই যেখানে বিজ্ঞাপন নিয়ে কাড়াকাড়িতে লিপ্ত সেখানে ঐতিহ্য লেখক ও লেখার বিষয়বস্তুকে গুরুত্ব দিয়েছে।
কালার কাগজে রয়্যাল সাইজের ঈদসংখ্যাটি যে-কাউকেই মুগ্ধ করবে। প্রায় সব সাহিত্যপাতাতেই কবিতা সবসময় গুরুত্বহীনভাবে ছাপা হয়। এক পৃষ্ঠাতে চাপাচাপি করে ৪-৫-৬ জনের কবিতা যুক্ত করা হয়। পড়তেও ভালো লাগে না। দেখতেও ভালো লাগে না। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে ঐতিহ্য একটি বিপ্লব সাধন করেছে। প্রত্যেক কবির জন্য আলাদা আলাদা করে ১ পৃষ্ঠা বরাদ্দ হয়েছে। বড় আকৃতির সেই পৃষ্ঠাতে একজন কবির দুটি করে কবিতা ছাপা হয়েছে। পৃষ্ঠাটির দিকে তাকালেই মন ভালো হয়ে যায়। কবিতাগুলো পড়তে আগ্রহ হয় খুব। নিঃসন্দেহে বাংলা ঈদসংখ্যায় এটি একটি নতুন ধারণা, নতুন উদ্যোগ। মহৎ এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক।
গল্প-উপন্যাস-অনুবাদ-গদ্য-ফিচার সব মিলিয়ে অনন্য একটি ঈদসংকলন করেছে ঐতিহ্য। নামকরণ করেছে ‘চানরাত’। ছোটদের কথা ভেবে চানরাতের সূচিতে যুক্ত হলো শিশুকিশোরদের জন্য ‘ছোটদের চানরাত’। এ-রকম একটি নান্দনিক ঈদসংখ্যার জন্য আরিফুর রহমান নাঈম, ঐতিহ্য প্রকাশনীর আধিকারিক নাঈমভাইকে ধন্যবাদ।
ঈদসংখ্যাগুলো বেঁচে থাকুক। ঈদসংখ্যাগুলো আমাদের উৎসব ও আনন্দের ঐতিহ্য। পাঠকেরাই পারেন দীর্ঘদিনের সমৃদ্ধ এই ঐতিহ্যকে বাঁচাতে। পাঠকের আগ্রহ থাকলে ঈদসংখ্যা কোনোদিন মরবে না।
সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপার ঈদ সংকলন
- ভাট কবিতার দিনলিপি || সরোজ মোস্তফা - June 1, 2025
- ফকিরের রত্নরাজি || সরোজ মোস্তফা - May 21, 2025
- মুস্তাফা জামান আব্বাসী : অবদান তাঁর অবিনাশী - May 14, 2025
COMMENTS