করোনা অতিমারির দুর্দিনে ফ্লয়েড-ঝড়ে উত্তাল মার্কিন দেশের চালচিত্র আর বিশ্ব জুড়ে লোকের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে ২০২০ ক্রমশ এক ঝড়ো বছরে রূপ নিতে চলেছে। যত আবর্জনা সকলে মিলে জমা করেছি তার সব উগড়ে দিতে বাধ্য করছে যে-ঝড়। অতিমারি ও লকডাউনে নাকাল মানুষের রাজ্যপাট। ওদিকে আমপান ও নিসর্গের ঘূর্ণি দাপটে দিশেহারা জিডিপি, পার-ক্যাপিটা আর ডিজিটাল উন্নয়নের ঢক্কানিনাদে বিভোর রাষ্ট্রসংঘের হৃদয়। ফসলের খেতে পঙ্গপালের হানা কিংবা পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কী করা যায় সে-চিন্তায় কাতর রামরাজ্যের স্বপ্নে বিভোর কোতোয়াল। চলমান এইসব চালচিত্রের মধ্যে সহসা ধেয়ে-আসা জর্জ ফ্লয়েডের তোড়ে চাপা পড়েছে সদ্য বা বিগত বছরগুলোর ঘটনাবহুল বক্তিমা-বিবৃতির ঝড়।
Make America great again-র স্বপ্নে বিভোর হোয়াইট সুপারমেসিস্টের কানের ফোকর গলে ঢুকে পড়েছে ফ্লয়েড নামের ঘেয়ো মাছি। ‘Hey Man! Do you hear me? I can’t breathe’ বলে জ্বালিয়ে মারছে গেল কিছুদিন ধরে। ভনভন সেই ঘেয়ো মাছির দাপটে বিগত বছরগুলোয় যেসব ঘটনা গুরুতর উত্তেজনার রসদ বয়ে এনেছিল এই করোনামারি ও ফ্লয়েডঝড়ে তারা এখন ম্লান। ব্রেক্সিটের কথাই ভাবা যাক। রোডরি মার্সডেন নামে গায়ক ডিস্কো সিম্ফনির ছকে তামাশার সুরে এ-নিয়ে গান বেঁধেছিল গেল বছর। মিথ্যে নয়, ব্রেক্সিটজালে প্যাঁচ খাওয়া আংরেজদের সেই জাল কেটে বেরোনোর রাস্তা খোঁজা সহজ কম্মো ছিল না। মার্সডেন বেয়াদব গাইয়ে। গানবাজনা করে বলে তার কাছে আক্কেলজ্ঞান আশা করা বাতুলতা। অ্যালবামের গানগুলোর মধ্যে দুম করে যা বলেছিল তার মোদ্দাকথা নিরীহ ঠেকলেও ভিতরের পরিহাসটা কিন্তু চাপা থাকেনি :
ধুস! ব্রেক্সিট মানে তো আর কিছু নয়, আস্ত কেক থেকে একটি টুকরো কেটে নিতে চাইছে সবাই। তাই না? কাজটি কী এমন কঠিন শুনি? বুঝতে পেরেছি, কেকের শরিকদের কথা চিন্তা করে সকলে দোটানায় পড়ে গেছে। এত দোনোমোনার কি আছে বুঝি না বাপু। মনে করো তুমি আপেলপাই খেতে চাইছ। ছুরি দিয়ে কেটে মুখে পুরে দাও। ল্যাঠা চুকে গেল। তারপর বিদায় বলে দিও শরিকদের। তারাও রেহাই পাবে আর দোটানার হাত থেকে তুমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। সেই তখন থেকে ভুজুংভাজুং চলছে, — এভাবে নয় ওভাবে কাটতে হবে! বকবক শুনে মাথা ধরেছে ইয়ার! আমি বলি কি, বাতেলা ছেড়ে সবাই লাইনে আসো। ঝটপট সমঝে নাও আংরেজরা কুকুরের মতো পথেঘাটে মরতে যাবে কোন দুখে? কাঠের টুকরোর মতো আরও কিছুদিন না-হয় আলগা হয়ে ভাসব জলে। অনেক হয়েছে, ভ্যানতারা ছেড়ে কেকটা কেটে ফেলো আর টা টা বাই বাই জানাও শরিকদের। ভুলে যাচ্ছ কেন ‘Saying goodbye is easy as pie.’
ব্রেক্সিট নিয়ে মার্সডেনের ইয়ার্কিঘন নিরীহ শ্লেষের ঝাঁঝ করোনা ও ফ্লয়েডঝড়ের দিনে গৌণ স্মৃতি। যেমন গৌণ অং সান সু চি! অনেক চেষ্টা করে খোঁপায় ফুল গুঁজা বর্মি সুন্দরীর দেখা মিলছে না। মিয়ানমার নামের দুর্বোধ্য দেশে সেনাঘেরাও শান্তির দূত এখন খোঁপায় গুঁজা ফুলসমেত স্থবিরজাতক। ঝাপসা কাচের দূরবীনে কেবল ধরা পড়েছে ভূমধ্যসাগরে খেলনা নৌকায় ভাসছে আরও শ-পাঁচেক রোহিঙ্গা। মহাথিরের দেশে ঢুকতে না পেরে বাংলাদেশের কুতুপালং শিবিরে সোদর-ভগ্নি আরও পনেরো বা বিশ লাখ রোহিঙ্গার দলে ভিড়ার আশায় সাগরে ভাসছিল। যে-রকম, অনেক কসরতের পর ক্ষুধায় কাতর ইয়েমেন যদি-বা দূরবীনে ধরা পড়েছে, সকল নষ্টের গোড়া হুতি বিদ্রোহীরা সেখানে কোন চুলায় গেছে সে কেবল জানে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও সৌদি যুবরাজ। করোনা আর ফ্লয়েডঝড়ে টালমাটাল দুনিয়ায় রোহিঙ্গা ও ইয়েমেনিরা তাই আপাতত বাতিল প্রসঙ্গ।
অনেককিছু গোল্ডফিশ এখন। ফসলের নাড়া পোড়ানোর ধুম আর দীপাবলির আতশবাজির হল্লায় দিল্লি শহর ছাইয়ে ঢাকা পড়েছিল কিছুদিন। ওয়ান ফাইন মর্নিংয়ে ডিজিটাল ম্যান ও লেডিরা ক্যাসিনো ম্যান বা লেডিতে রূপায়িত হয়েছে দেখে বিউটিফুল স্লিপ থেকে সদ্য চোখ কচলে জেগে ওঠা টেলিপর্দার টকিং টম ও ফেবুবাসীরা ব্যাপক হৈ হৈ আর হল্লাবোল্লার মওকা পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার খুশিতে আয়রন লেডির গোষ্ঠী উদ্ধারে সক্রিয় ছিলেন হরদম! ওদিকে অগ্নিমান্দ্যে কাতর অগ্নিদেবতা মহাভারতের পৃষ্ঠা ফুঁড়ে আচমকা হানা দিলেন আমাজন ও অস্ট্রেলিয়ায়। মাসের অধিক নিযুত বৃক্ষ ও পশুপাখি সাবাড়ের পর তার সেই বিমারের বেগ থেমেছিল বটে! জগৎ জুড়ে সক্রিয় চালবাজদের ষড়যন্ত্রে বহুদিন ধরে ভোঁতা-বিবশ স্নায়ু ও সহ্যশক্তিকে তাতিয়ে তোলার মতো ওইসব ঘটনা পটভূমিতে নতুনের প্রবেশ ঘটার কারণে এখন স্মৃতির অতলে বিলীন।
আইএসজঙ্গির ফাঁদে আটক বেথলান গ্রিনের জিহাদি কিশোরী শামীমার সিরিয়ার শরাণার্থী শিবির থেকে দেশে ফিরতে না পারার জটিল অঙ্ক মিলানোর খেয়াল মানুষকে তাতিয়ে রেখেছিল কিছুদিন। যদিও আইএসপাণ্ডা বাগদাদির দেখা পাওয়ার আশা এখন দুরাশার নামান্তর। মার কাটকাট জঙ্গি মহড়ায় ড্রপসিন পড়ার নিয়মে বেচারা ভ্যানিশ মহাকালের ঠিকানায়! সাগরতটে মুখ-থুবড়ে-পড়া আশ্চর্য দেবশিশু আইলান কুর্দিকে অবশ্য চাইলেই দেখা সম্ভব। ওই তো ঈশ্বরের কোলে বসে খিলখিল হাসছে। আহা দেবশিশু! ঈশ্বর তোকে করুণা করেছে। গোল্ডফিশ মানুষের দঙ্গলে শামিল হওয়ার ক্ষণে তুলে নিয়েছে নিজের কোলে। তুই সেখানে ভালো থাকবি জানি। তোর জন্য করোনা ও ফ্লয়েডঝড়ে টালমাটাল মানুষের পৃথিবীটা যোগ্য ছিল না। তারচেয়ে অসীম অনন্ত ওই নিরাকার জগতের সকল শিশুর যোগ্য ঠিকানা জানিস।
তো এই হচ্ছে সদ্য বিগত ও চলমান বছরগুলোর খতিয়ান। করোনামারির প্রকোপে আশু মন্বন্তর আর নিযুত বেকারির শঙ্কা যখন রাষ্ট্রসংঘের গলা টিপে ধরতে যাচ্ছে ঠিক তখন ফ্লয়েডঝড়ে লণ্ডভণ্ড মার্কিন মহাদেশ। ঘটনা যেখানে র্যাপ গানের তালে দ্রুতলয়ে ঘটে সেখানে ওয়াল্টজের মধুর ঘূর্ণি, কত্থক বা ফ্ল্যামেঙ্কোর লোমকূপে–কাঁপন–তোলা ছন্দরা খাপছাড়া দেখায়। র্যাপের তালে উত্তাল এই ফ্লয়েডঝড় অবশ্য অনিবার্য ছিল। ওটা ঘটতই! দোকানিকে জাল নোট গছানোর অপরাধে পুলিশ যাকে দেগে দিলো, মিনিয়াপোলিসের সেই ফ্লয়েড অথবা তার নকলি শিকাগো বা আটলান্টার শান্ত-সুবোধ ফ্লয়েডকে দাপুটে হাঁটুর নিচে চেপে ধরা ডেরেক চৌভিন এবং অবিকল তার মতো দেখতে চৌভিনরা আজ নয়তো কাল ডায়ালগ ঠিক ঝেড়ে দিত, ‘খোদার দুনিয়ায় দুই কিসিমের আদমি রয়েছে ইয়ার। একদল গুলিভর্তি বন্দুক নিয়ে ঘোরেফিরে আর অন্যদল নিজের কবর খুঁড়তে থাকে।’
তামেশগিরে ভরা এই খোদার দুনিয়ায় বন্দুকবাজরা হচ্ছে ‘ধলা’ মিয়ার দল। ওদিকে নিজের গোর খুঁড়তে ব্যস্ত আদমিদের আপাতত ‘কালা’ মিয়ার দল বলে স্বীকার যাওয়াই যুক্তিসংগত। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ‘দ্যা গুড, দ্যা ব্যাড অ্যান্ড দ্যা আগলি’ নামের রংবাজ আমেরিকাকে আরেকবার চিনিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মনে করিয়ে দিয়েছে, আমেরিকা আজ বহুদিন হয়ে গেল তালজ্ঞান ও মাত্রাছাড়া ঘটনার শিরোনাম। শোধরানো বা মেরামতের অযোগ্য এক যন্ত্র সে। সেই যন্ত্র, ‘We’ll make America great again’-র মিথ্যা প্রবচনে যে কিনা আজও বিশ্বাস রাখে! দেমাগে যার মাটিতে পা পড়ে না। তুখোড় বল্লেবাজ হওয়ার সুখে মগ্ন থাকার দোষে এখনও ভাবে :
আমি শ্রেষ্ঠ বা মহান, অন্যরা নিকৃষ্ট। আমি আরোপ করি, অন্যরা তা গ্রহণ করে। আমার সুরক্ষায় শঙ্কা ঘনালে বাকিরা যেন বুঝে নেয় কেন তারা অরক্ষিত। আমি নীরব হওয়া মানে অশনির আভাস আর মুখরতা মানে তাদের নীরবতা। আমি মহান, তাই আমার গায়ের রং স্বীকৃত। অন্যরা হীন হওয়ার কারণে অস্বীকৃত।
আমি দণ্ডদাতা, বাকিরা দণ্ডিত। অস্ত্র ও পারমাণবিকে আমার অধিকার নিরঙ্কুশ রাখতে অন্যরা শিরস্ত্রাণহীন থাকবে এটাই নিয়ম। আমার পদভারে মাটি যেদিন কেঁপে উঠবে না সকলে যেন বিলাপ করে, — ‘পৃথিবী এখন থেকে বন্ধ্যা ও মৃত!’ আমি রাজা! আর রাজা মরে গেলে কী লাভ প্রজার বেঁচে থাকায়?
‘আমিত্ব’-র ফাঁদে ঘেরাও এই আমেরিকা ভুলেই গেছে জর্জ ফ্লয়েড নামে লোকটির জাল নোট গছানোর কোনও প্রয়োজন ছিল না। মিনিয়াপোলিস, নিউইয়র্ক, শিকাগো, আটলান্টা কিংবা মিসিসিপির তীর ঘেঁষা শহরগুলোয় চরে বেড়ানোর কথা ছিল না তার। আমেরিকা তাকে এখানে উপড়ে নিয়ে এসেছিল একদিন। আফ্রিকার লম্বা ঘাসে ছাওয়া জঙ্গলে ফ্লয়েড অথবা তার মতো দেখতে ফ্লয়েড তখন সিংহের পাল ফাঁকি দিয়ে হরিণ শিকারকে নিশানা করেছিল। আহা! মনোরম সেই মুহূর্তে আমেরিকা তাকে চালান করে দিলো জাহাজের খোপে। অতঃপর সেই থেকে ফ্লয়েড অথবা বিশ্বভূগোল জুড়ে তার মতো দেখতে ফ্লয়েড নিজের ফেলে-আসা মহাদেশের নাম স্মরণ করতে পারে না!
এখন, চৌভিনের হাঁটুর নিচে চাপা পড়ার ক্ষণে মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েড সাভানার হরিৎ প্রান্তরে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। ‘Mama’, ‘Please’, ‘I can’t breathe’ — টুকরো ছন্দে গাঁথা জবানির অন্তিমে পৌঁছে তার বোধের উদয় ঘটেছে। চোখের দূরবীন দিয়ে দেখতে পাচ্ছে আফ্রিকার অগাধ প্রান্তরে তার মতো দেখতে ফ্লয়েড তাকে কাঁধে চড়িয়ে ঘুরছে। ফ্লয়েডের কাঁধে সওয়ার মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েড জিরাফের মতো গলা বাড়িয়ে দুই চোখ ভরে শুষে নিচ্ছে আফ্রিকা : — The everlasting beginning paradise of the human race; from where once upon a time the journey has begun; when this Earth was melting like pure fragrance!
…
এটা তাই নিশ্চিন্তে বলা যেতে পারে চৌভিনের হাঁটুর নিচে দম আটকে মরে যাওয়ার ক্ষণে ফ্লয়েডের সব মনে পড়েছিল। সে ফেরত গিয়েছিল তার মতো দেখতে অঢেল ফ্লয়েডের দেশে। আফ্রিকার তালপাতায়–ছাওয়া কুটিরে যে-ফ্লয়েডরা এখনও গায়ে রং মেখে মদিরামাতাল ছন্দে নাচেগানে মেতে ওঠার হ্যাডম রাখে। গোঁয়ার চৌভিনের কাছে ফ্লয়েড ফেরত চাইছিল তার সেই হারানো দিনগুলো, আমেরিকা রাজা যা তার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে চিরতরে। মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েড আফ্রিকার ফ্লয়েডদের কাছে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছিল, যারা তার সোদর ছিল কোনও-একদিন! ঘটনাটি নিশ্চয় ঘটেছে, চৌভিনের হাঁটুর চাপে নিঃস্ব হওয়ার ক্ষণে এই সত্যটি সে বলে যেতে পেরেছিল : — Hey motherfucker, you fuck me up to the nail. Wanna back which I lost forever.
আফ্রিকা থেকে মার্কিন দেশে চালান ফ্লয়েড সাভানায় চরে বেড়ানোর দুঃখ ভুলতে নামকরা বাস্কেটবল ড্রিবলার হওয়ার স্বপ্নটি দেখেছিল। করিম আব্দুল জব্বার, মাইকেল জর্ডান আর কোবি ব্রায়ান্টের মতো দুরন্ত ডজ ও ড্রিবলে সকলকে ছাড়িয়ে বল জালে ঢোকানোর স্বপ্নে বিভোর ছিল মন। তাদের মতো জগৎবিখ্যাত হওয়ার আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে অবসরে যাওযার ক্ষণে ফ্লয়েডের মনের কোণে হয়তো উঁকি মারছিল আফ্রিকা! সে ফেরত যেতে চাইছিল লম্বা ঘাসে ছাওয়া সেই তৃণভূমির জগতে; কোনও-একদিন তার মতো দেখতে ফ্লয়েড তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে দেখিয়েছিল জলের সন্ধানে হাতির দল কী করে পাড়ি দেয় হাজার মাইল!
দৃশ্যটি পুনরায় ফেরত পাওয়ার রোখ চেপেছিল মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েডের মনে। ঘটনাটি নিশ্চয় ঘটেছিল, বাস্কেটবলে ইস্তফা দিয়ে ঘরে ফেরার দিন থেকে ফ্লয়েডের মনে চতুর সেই ‘নিগার’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। দোকানিকে জাল নোট গছিয়ে আমেরিকা রাজাকে একবার হলেও আশ মিটিয়ে চোদার শপথে নিজের মন অটল করেছিল সে : — Hey Man! It’s to me commando that I have gonna fuck Americans one day. আফসোস! আমেরিকা রাজা ততক্ষণে তাকে জব্দ করে ফেলেছে হাঁটুর চিপায়। সে তখন তার দূরের সোদর নাইজেরিয়ার কালাকুটা রিপাবলিকের স্বঘোষিত সম্রাট ফেলা কুটি-র জায়গায় দাঁড়ানো ছিল না এবং তাকে মনে করতে পারছিল না। আমেরিকা রাজার Democracy-র খেলাকে যে-লোক চোখের পলকে Democrazia নামে দাগিয়ে দিতে তিলেক দ্বিধায় ভোগেনি সেদিন!
আফ্রিকার কোন ভাষায় কথা বলা উচিত সেটা ঠিক করার ভার সাদা ও তাদের পোষা কাকাতুয়া দেশি সাহেবমেমদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে ফেলা নিজের ঘাড়ে নিয়েছিল। কালাকুটা রিপাবলিকে তার বাড়ি নাইজেরিয়ার দেশি সাহেবরা পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো। ট্রাম্পেটে সুর ফোঁকা আদুল গায়ের ফেলা সেই ছাইভস্মের মধ্যে বসে নির্বিকার চিত্তে সিগারেট ফুঁকছিল তখন, আর মনে-মনে ভাবছিল : — সায়েবসুবোর ভাষা আফ্রিকার জন্য উলটাপথে যাত্রার শামিল। গণতন্ত্রের আফ্রিকান ভাষা অদ্যপি জীবিত এ-মহাদেশে; যে-ভাষা সঙ্গে করে মায়ের পেট চিরে তারা ধরায় আসে : — So I fuck the demonstarion of craziness, that you people called Democracy. To me, it’s only and purely Democrazia; the everlasting fucking system of the human soul, unluckily made by the great Americans.
আদুল গায়ে ট্রাম্পেট ও সেক্সোফোনের সুরেলা ভেঁপুর ঝড় তোলা একরোখা ফেলা কুটি অবলীলায় বাতিল করে দিয়েছিল সেইসব প্রকল্পনা যারা এখন সাদা সাহেবমেমদের প্রতিনিধি হয়ে আফ্রিকার পথেঘাটে মানুষকে ডেমোক্রেসি শেখায়; ন্যাশনালিটি মারায়; ফেমিনিজম কপচায়; এডুকেশন আওরায়; এবং পোভার্টি ও ইংরেজির বাও বুঝে কেমন করে মহাদেশের অগণিত সাদাসিধে কালা আদমির পুটকি মারা যায় সেইটা শেখায়। ফেলা কুটি হচ্ছে সেই মতিচ্ছন্ন ভবঘুরে, কালাকুটাকে নিজের রিপাবলিক বলে ঘোষণা দিতে দু-বার ভাবেনি। অতিকায় নাইজেরিয়ার মানচিত্রে কালাকুটা যেন পৃথক নাইজেরিয়া আর ফেলা তার সর্দার বটে! সাদা ও দেশি সাহেবমেমরা তখন ‘Power matters’ বলে আগুনরাঙা ওয়াইনে চুমুক দিয়েই চলেছে; ওদিকে আদুল গায়ের পপগুরু সিগারেট হাতে উঠে পড়েছে স্টেজে। সেক্সোফোনে শিস কেটে অক্লেশে জিগির তুলছে : — Power matters; but you ladies and gentleman, you have to know VIP in Power.
ফেলা-র ভাষাবোধের জগতে VIP হচ্ছে সিগন্যাল। সাহেবদের শেখানো বুলি এটা নয়; যেমন নয় Very Important Person-কে ক্ষমতার মসনদে বসানোর কোনও খেলা! VIP মানে হলো ‘Vagabonds In Power’। ফেলা কুটি-র ইডিয়মের জগতে সেই VIP সিঙ্গুলারিটি বা একবচনে বন্দি কোনও বিধেয় নয়। ওটা প্লুরালিটি বা বহুবচনের দ্যোতক। একবচনের ফ্রেমে বাঁধাই করা VIP অর্থাৎ Very Important Person যদি পুরুষলোক হয় তবে ফেলা তাকে ‘Sir’ ডাকার ছলে ‘সাহেব’ নামে বিদ্রূপ হানে; আর মহিলা হলে ‘মেম’ না বলে ‘Lady’ নামে দাগায়। যদিও সেই Lady পপ গানের কলিতে কৃষ্ণরমণীর উপমা হয়েই আসে।
Lady মানে সেই রমণী যে কিনা সাদা মেমসাব হওয়ার খায়েশে প্রাণপাত করছে আর কম্মোটি সারতে গিয়ে সায়েবসুবোর নকলি করে তুলেছে নিজেকে। একজন সায়েবসুবো অবশ্য মনে-মনে এটাই চায়। সাহেব হওয়ার খেলা তাকে ক্ষমতাছকের চূড়ায় উঠার সুযোগটি করে দিয়েছে। এই খেলা তাকে এখন জাতে উঠতেও সাহায্য করছে। জাতে উঠবার পর তার তো বনবাদাড় আর জলাজঙ্গলার কটু গন্ধমাখা রমণী দিয়ে কাজ চলবে না। এমন রমণী তার চাই যে ওসব থেকে দূরে সরে এসেছে এবং নিজেকে পৃথক ও পরিচ্ছন্ন রাখার কেতাগুলো লবজ করে নিতে দেরি করেনি। গানের আপাত নিরীহ শব্দছকে ফেলা সেই Lady-কেই সবাক করে তোলে।
এই Lady সায়েবসুবোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষমতার ভাগ চায়। ময়মুরব্বিদের সামনে পায়ের ওপর পা তুলে সিগারেট ফোঁকাটাকে সে এখন আর তমিজের বরখেলাপ ভাবে না। ঘরে ঢোকার সময় বেটাছেলেরা আগ বাড়িয়ে তাকে সালাম জানাক, নিজের এই চাওয়াটা সে সাফ-সাফ বলে দিতে পারে। রন্ধনশালায় পুরুষরাও খাটনি দিক, তার জন্য ডিনার রেডি করে রাখুক, সিঙ্কে জমানো বাসনকোসন সফা করার কাজে হাত লাগাক, — কথাগুলো জোয়ান কিংবা বুড়ো-হাবড়াদের মুখের ওপর বলে দিতে তার আটকায় না। সমান অধিকারের কথা যখন উঠছেই, কেতাদুরস্ত পুরুষগুলোকে সালাম-আদাবের পরোয়া না করে সেই Lady চেয়ারে বসে পড়ে : — ‘She wan salute man, she go sit down for chair’। সায়েবসুবোরা যেহেতু মনে-মনে চাইছে তার পছন্দের রমণী ল্যাভেন্ডার ও পারফিউমের সুগন্ধে Lady রূপে নিজেকে সাজিয়ে তুলুক, তাদের উচিত নিজের রমণীকে আগ বাড়িয়ে সেই কাজে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।
ফেলা-র গানের কলিতে Lady এইভাবে ঠিকরে বেরোয়; শুনে মনে হবে পপগুরু খুব করে চাইছে গোত্রপিতার শাসনছকে বন্দি আফ্রিকার মেয়েরা ছক কেটে বেরিয়ে আসুক এবং জবরদস্ত Lady হয়ে উঠার পথে বনবাদারের ময়লা সাফ করে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ও প্রসাধিত রাখুক। অন্যদিকে গানের কলির নিরীহ শব্দছকের আড়াল থেকে উঁকি মারে আফ্রিকা মহাদেশে মেয়েগুলোকে সায়েবসুবোর নকলি করে তোলার এইসব Feminism ও মেমগিরি নিয়ে ছুপা বিদ্রূপ। যেহেতু, Lady বনে উঠার এই খেলা প্রকারান্তরে Very Important Person বলে নিজেকে জাহির করার পুরাতন ছক বৈ অন্য কিছু নহে।
ফেলা-র আজিব গায়নভঙ্গিতে পরিবেশিত Lady তাই অবিরত টটোলজি বা দ্বিরুক্তির সূত্রপাত ঘটায় মনে। গোত্রপিতা শাসিত আফ্রিকার কুটিরে বন্দি কৃষ্ণ রমণীর মনে Lady হওয়ার চোরা লোভ জাগিয়ে তোলে সে। অন্যদিকে সাদা কিংবা অধুনা কালো মেমসাহেবদের শেখানো Feminsim-র মইবন্দি Lady-র কাজকারবারকে আমজনতার কাছে মিমিক্রি ও গিমিকের বিষয় করে তোলে। ব্যাপারটি যেন এমন, ফ্লয়েড ও তার মতো দেখতে অগণিত আম-ফ্লয়েড Lady হওয়ার ফান্দায় ফতুর এইসব কুঁচবরণ রমণীকে দেখে চোখ টিপে হাসার পরক্ষণে স্ল্যাং ঝেড়ে প্রেমের প্রস্তাব সারে : — Hey ladies! Wanna fuck you baby to my commando?
আফ্রিকা মহাদেশের আরণ্যিক নিয়মের ছকে গড়া কর্মবিভাজনের ধরতাই আর কৃষ্টির মাঝে সায়েবসুবোর নকলি মেমসাবগণ যে-কারণে আমজনতার মনে যৌনতার সুড়সুড়ি জাগায়। আফ্রিকার আমপাবলিকের জন্য Lady একাদিক্রমে বিপত্তি ও রসিকতার উপমা। ফেলা সেখানে ব্যতিক্রম নয়। জনতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে নিজেও পিউরিটান; যতটা ও যে-পরিমাণে পিউরিটান এই মহাদেশের অতিকায় বৃক্ষসারি, লম্বা ঘাসে ছাওয়া তৃণভূমি, দুর্দান্ত বৃহৎ জীবজানোয়ার, দুঃসহ তাপে দগ্ধ লাল মাটি, আর বিচিত্র রংচংয়ের বাহারে কিম্ভূত আদুল গায়ের ওইসব অঢেল গোত্র বা ট্রাইবস। সাহেবমেমদের Feminism তাই আফ্রিকা মহাদেশে প্রবেশের পর হাসির খোরাক হয়। Puns অর্থাৎ ঠাট্টাইয়ার্কির ছলে Lady নামধারী Feminist বচন ও সিনটেক্সকে ফেলা আর ফ্লয়েডরা মিলে যাচ্ছেতাইভাবে ঠাপায়; অতঃপর ঘোর পিউরিটান ও প্যাগান হওয়ার বৃত্তে তাদের যাওয়া-আসা চলতেই থাকে!
জগতে কালা আদমিরা সকলে কমবেশি আমুদে। Very Important Person হওয়ার পরিতৃপ্তির গোয়া মেরে আদুল গায়ে Vagabonds In Power-এর স্বপ্নে মত্ত হয়ে বুনো নৃত্যের ডম্বরু বাজায়। সত্য বৈকি, এই সিনটেক্স চৌভিনদের শেখানো আংরেজি দিয়ে বোঝা কারও কম্মো নয়। আফ্রিকানরা মানুষ হলেও মানুষের সংজ্ঞা থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় বিপথগামী রাখে। অ-সভ্য মোটেও নয়, তবে সভ্যতা থেকে যখন-তখন দুম করে বেরিয়ে ঢুকে যেতে পারে গহীন কোনও বনে, রুক্ষ মরু কিংবা লম্বা ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরে। সভ্যভব্য চৌভিনদের পক্ষে এটা নেওয়া কঠিন। তাই হয়তো চোখনাক কুঁচকে মাঙ্কি ও গরিলা বলে ফেলা ও ফ্লয়েডদের উপহাস করতে তাদের বিবেকে বাঁধে না; যা এমনকি প্রযুক্তির এই বিশ্বায়নের যুগেও অবিকল রয়ে গেছে!
সম্প্রতি পৃথিবী জুড়ে মৃত কিংবা সচল এ-রকম অসংখ্য মানুষের মুখচ্ছবির ডেটাবেজ থেকে বাস্তবে হদিশ মিলে না এমন মানুষের মুখচ্ছবি বানানোর চল উঠেছে বিশ্বে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে নিযুত মানুষের মুখ নিমিষের মধ্যে চিনে ফেলা আর নতুন মুখচ্ছবি ম্যানুফ্যাকচারের সেই দৌড়ে গুগল মহাশয় যোগ দিয়েছেন বৈকি। সাদা সাহেবমেমদের মুখচ্ছবি বুঝে নিতে পারঙ্গম গুগল অ্যাপস (Deep Learning) কালা-শ্যামলা কিংবা বাদামিকে চিনতে গিয়ে হরদম গোলযোগ পাকায়। কৃষ্ণ রমণীর মুখচ্ছবির সঙ্গে ‘গরিলা’-র তফাৎ নাকি সে এখনও ধরতে পারে না! একবার জনৈক কৃষ্ণ রমণীর মুখচ্ছবি শনাক্ত করতে গিয়ে তাকে ‘গরিলা’ বলে নেটে হাজির করেছিল অ্যাপস। বাদ-প্রতিবাদের ঝড় উঠায় Fatal Error ইত্যাদি অজুহাতে সে-যাত্রা নিজের দায়িত্ব এড়িয়েছিল গুগল।
ফেলা, ফ্লয়েড ও তাদের মতো দেখতে অগণিত কালা আদমিরা সাদা সাহেবমেমদের এইসব শেখানো বুলি একফোঁটা বিশ্বাস করে না। সেই বুলির জগতে দাঁড়ানোর জায়গাটি তাদের কাছে তাই আজিব মনে হয়। সাহেবমেমদের সিনটেক্স দিয়ে কালা আদমিকে সম্যক মানুষ বলে চেনা যে-কারণে দুষ্কর ঠেকে। যদিও এটা এখন অবধি ধ্রুব সত্য, দুনিয়া জুড়ে ছড়ানোছিটানো কালা আদমিরা যতটা মানুষ তারচেয়ে বেশি ‘আফ্রিকান’। এইটে হচ্ছে সেই ইডিয়ম যা তাদেরকে চিনিয়ে দিতে সাহায্যের হাত বাড়ায়।
ভবঘুরে দুনিয়াবির জগতে ফেরত যাওয়ার বার্তা দিয়ে ফেলা-রা এভাবে যুগ-যুগ ধরে নিজেকে VIP বলে প্রমাণ করেছে। আফ্রিকা মহাদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি ছড়ানো এইসব ভবঘুরের অঢেল দুনিয়াবিকে স্বীকার ও লালন করতে পারে এমন এক ক্ষমতাছকের স্বপ্ন তারা দেখেই চলেছে জনমভোর। আধা ভাঙা ইংরেজি বুলির শরীরে ইউরোবা ভাষা জুড়ে ফেলা কুটি যেমন নিজের জয়কার গাওয়ার ছলে তার মতো দেখতে অসংখ্য ফেলা-কে পপ গানের কলিতে নিমিষে জাগিয়ে তোলে। ক্ষমতার মসনদে যে-লোকটি বসেছে সে VIP জরুর, কিন্তু সাদা ও দেশি সাহেবমেমদের শেখানো VIP-র সঙ্গে তার ফারাক আকাশ-পাতাল। এ হচ্ছে সেই লোক যে তার নিজের মধ্যে তার মতো দেখতে অসংখ্য ভবঘুরের ছবি দেখতে পাচ্ছে। পপ গানের কলিতে Very Important Person-এর প্রচলিত ইডিয়মকে ফেলা তাই ‘Vagabonds In Power’-এর নতুন ইডিয়মে অবিরত উহ্য ও বিলুপ্ত করে যায়।
ফেলা-র এই VIP মনে করিয়ে দেয় : — আফ্রিকা নামে মহাদেশ একবচনে বন্দি কোনও ট্রাইবের দখলিস্বত্ব নয়, এটা বরং বহুবচনে ধৃত ট্রাইবের দুনিয়াবি। একবচনে মহিমান্বিত কোনও গোত্র সেখানে নেই। ছোট-বড়ো সকল গোত্রের মিলন-বিরোধ আর সন্ধি-সংঘাত থেকে যে-Power মহাদেশের আনাচকানাচে ঠিকরে ওঠে সেটাকে একত্রে দেখা না গেলে আফ্রিকার গণতন্ত্রের ভাষা বুঝে ওঠার সাধ্যি কারও বাপের নেই। ফেলা সেই গণতন্ত্রের জিগির তোলে গানে। যার অভাবে আমেরিকা রাজার রাজ্যপাটে ঢোকা ফ্লয়েডের কপালে বলাৎকার ছাড়া আজোবধি কোনও ডিগনিটি জোটেনি।
…
সাহেবদের শেখানো ইংরেজিকে ফেলা তার মরণতক ভাঙচুর করে গেছে। এই ভাঙচুর সাচ্চা এক কালা আদমিকে নজর করায় যে-আদমি নিজের রমণীকে প্রহারের ক্ষণিক পরে ঘাসে-ছাওয়া কুটিরে ‘তালমদিরামাতাল’ ভালোবাসায় তাকে অনায়াসে বিদ্ধ করতে জানে। ইংরেজি ইডিয়মের কেতাদুরস্ত জগতে ইউরোবা ভাষার দৃঢ় পুরুষাঙ্গ ফেলা কুটি জোরে ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল সেই সর্দারির জোরে। তার সেক্সোফোন বা ট্রাম্পেট তো কেবল বাদ্যযন্ত্র নয়, ওগুলো হচ্ছে মেশিনগান! উত্থিত শিবলিঙ্গের প্রতীক। রঙচঙে আফ্রিকান রমণীর উত্তাল দেহভঙ্গির বাঁক প্রদর্শনের জোয়ারে ভেসে যাওয়ার মুহূর্তে সেই গানের কলিরা মনে করায়, — কালা আদমি ‘ন্যাশনাল’ শব্দে ভরা জাতীয়তার ছক ভেঙে ‘ইউনিন্যাশনাল’ হওয়ার খিদে মিটানোর জন্য মায়ের পেট চিরে ধরায় আসে।
জর্জ ফ্লয়েডের সোদর রক্তে-মাংসে ইউনিন্যাশনালের জিগির তুলে বিশ্বকে একদিন জানিয়ে দিয়েছিল : — সাচ্চা কোনও আফ্রিকান ন্যাশনাল বোঝে না; খ্রিস্টের গোয়া মারায়; মোহাম্মদের ইসলামে নাচগান ও মূর্তির উপদ্রব জুড়ে দিয়ে ওটাকে বিকৃত করে; সে কেবল এইটা বোঝে : — তার জন্ম-মৃত্যু, বিবাহ বা রমণ, খাদ্য ও উৎসব, অথবা নৃত্যগীতি … সোজা কথা দেহের প্রতিটি খাঁজে-ভাঁজে ছলকে ওঠা চোখের নাচন, কাঁধ-নাচানোর ভঙ্গি, হাঁটার মুদ্রা ও গলার স্বরগ্রামের ষোলোআনা সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ট্রাইবের চিরন্তন অভ্যাসের প্রতিধ্বনি। সে এই চিহ্নগুলো নিয়ে ধরায় গড়িয়ে পড়ে এবং সাহেবমেমগণের দ্বারা বিচিত্র উপায়ে নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও আজীবন সেখানেই থিতু থাকে। আফ্রিকান হচ্ছে সেই মানুষ যাকে তার জন্মভূমি থেকে বিচ্যুত বা নির্বাসিত করা হলেও সে নিজেকে লিওপোল্ড সেঙ্ঘর বা এমে সেজেয়ার ভাবার ক্ষমতাটি এখনও রাখে।
এই আফ্রিকানকে সাহেবি কেতায় চিনুয়া আচেবে, আমোস তুতুওলা, এলেচি আমাদি, ওলে সোয়েঙ্কা কিংবা বেন ওকোরি বানানোর পরেও ট্রাইবের অলিগলির মধ্যে অবিকল এক-রকম দেখতে কিন্তু স্বভাবে বুনো আচেবে, তুতুওলা, আমাদি, সোয়েঙ্কা ও ওকোরিতে ফেরত যায়। Africanity তাই বানোয়াট কোনও জাতীয়তার উপমা নয়। এর শিকড় প্রোথিত সাভানার লম্বা ঘাসে ছাওয়া প্রান্তরে। সিংহরা সেখানে বসে হুঙ্কার ছাড়ে; যার আওয়াজ এমনকি সেই মহাদেশের আধুনিক মেট্রোপলিসে বসেও একজন আফ্রিকান ঠিক শুনতে পায়। বিদেশি কেতায় অভ্যস্ত এবং সেখানে নির্বাসিত কোনও আফ্রিকান দেশের কথা যখন ভাবে তার চোখে আকাশঢাকা গাছের ছবি ভাসে খালি। গরিয়ান বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে সে তখন সেজেয়ার হয়ে ওঠে। তার মনে হতে থাকে সে নিজে আফ্রিকার আকাশঢাকা বৃক্ষ বৈ অন্য কিছু নয়।
ফেলা কুটির মধ্যে সর্বপ্রাণবাদী সেই মিথ সত্তুরের উত্তাল দশকে নবজীবন লাভ করেছিল। সেই মিথ চৌভিনের হাঁটুর নিচে চাপা পড়া ফ্লয়েডের ফুসফুসে আপনা থেকে তরঙ্গিত হওয়ার কারণে সে বেছে নিতে পারে সেই জীবন যে-জীবন কানে দুল পরে, গলায় চেইন ঝুলিয়ে র্যাপের ছন্দে হাঁটু নাচায়, ভরাট গলায় সাদা কিংবা কালো মেমদের কাঁধ নাচিয়ে রমণ সারার প্রস্তাব দিয়ে বসে : — Hey girls, Wanna suck the commando? Let’s do it. সাহেবমেমদের ইডিয়মে যেটি শ্লীলতা বলে চিরকাল গণ্য হয়ে এসেছে ফ্লয়েডরা সেটাকে অশ্লীলতা বলে উপহাস করে থাকে। ধলা ও কালার সিনটেক্স আর তাদের দেহ-মনের ভঙ্গির মাঝে তফাতটা সেখানেই।
আফ্রিকার বুনো প্রান্তরের হাওয়ায় ঠাসা কালা আদমিরা বহুভাবে পশ্চিমা সভ্যতার চাপে নিয়ন্ত্রিত হলেও অজেয় আদিমতার জোরে তাকে নাকচ করতে জানে। এটা হচ্ছে তাদের শক্তির দিক। এই শক্তির তোড়ে ভাসা আমেরিকানরা শিখেছে কেমন করে ব্লুজের দরদি বিষণ্ণতায় খাটনিভরা ভালোবাসার বাখান জুড়তে হয়। অজেয় এই Africanity মার্কিনি সাদা সাহেবমেমদের শিখিয়েছে দেহকে কীভাবে দেখার বিষয় করে তোলা যায় জ্যাজ, পপ আর র্যাপের ছন্দে। চৌভিন নামের কাঠগোঁয়ার যবে ফ্লয়েডকে হাঁটুর নিচে চেপে ধরেছে তখন ফ্লয়েডের হয়তো বলতে ইচ্ছে করছিল :
বাতেলা ছাড়্ না ইয়ার! সুন্দরী মেমকে কী করে প্রেম করতে হয় সেটা এই কালা আদমি তোকে শিখিয়েছে। কেমন করে তাকে চুদবি, যেন চোদনের পয়লা ধাক্কায় তোকে সে একটা পাক্কা পুরুষ বলে মানে, সেই খেলা এই বান্দার দান। নিরস জমি কী করে আবাদ করবি ভেবে যখন হয়রান ছিলি তোর দাস হয়ে বান্দা হাজির ছিল সেখানে। ফ্লয়েড কোথায় নেই বলতে পারিস? মিলকারখানায় বেগার খাটে কে? — ফ্লয়েড। বাস্কেটবলে ড্রিবল করে কে? — ফ্লয়েড। ফুসফুসে দম ভরে টেনিসকোর্টে শক্ত হাতে সার্ভ করতে জানে কে? — সে তো ওই ফ্লয়েডের ভ্রাতা ভগ্নি হয় বটে! বক্সিং রিংয়ে প্রজাপতির নাচন আর মোক্ষম পাঞ্চের খেলায় কে বেশি দড়? — ফ্লয়েড ছাড়া আর কে! একশো মিটার স্প্রিন্টারে চিতার বিক্রমে যে সবার আগে দৌড়টা সেরে ফেলে সে কি ফ্লয়েড নয় বল্?
বাতেলা ছাড়্ ইয়ার। তোকে নাচেগানেঅভিনয়ে মাতিয়ে রাখে যারা তারা এই ফ্লয়েডের রক্তের সোদর। তোর হয়ে রণাঙ্গনে অকাতরে মরে ফ্লয়েড। লাসভেগাসের জুয়া আর এস্কটে টাকার খই উড়ছে রাতদিন। বাজি ও এস্কট চাঙ্গা রাখার মেশিন বলতে এই ফ্লয়েড। অথবা ধর, ছুটকো চুরিচামারির দায়ে কাউকে তোর খুব পেটাতে ইচ্ছে করছে। বান্দা কিন্তু সেখানেও হাজির। তোর শখ হয়েছিল কালা মাগি চোদার। কুছ পরোয়া নেহি ইয়ার, ফ্লয়েডের বউ-ঝিরা খেদমতে হাজির।
তবু তোর খাই মিটে না। এবারের মতো যদি ছাড় পাই তবে এইটা পাক্কা জানিস, — ফ্লয়েড বদলা নেবে। তারপর তোদের এই জাহান্নাম ছেড়ে ভাগা দেবে নিজের দেশে। আমেরিকা রাজা নয়, আফ্রিকা হলো এই ফ্লয়েডের সাচ্চা ঠিকানা।
এখন আর জানার উপায় নেই, তবে এটা নিশ্চিত, মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েড সেদিন ফেলা কুটি-র নাম স্মরণ করতে না পারলেও ফেলা-র গানের কলিতে উছলে-পড়া দুনিয়াবির সাথে নিজেকে ঠিক জুড়ে নিয়েছিল। সেই গানের আদি মালিকানা যাদের সেই কালা আদমিরা এখন ন্যাশনালের ঘোরচক্করে বহুভাবে বিভক্ত হলেও কী-করে-যেন ওটার গোয়া মেরে একসা করে ছাড়ে। পৃথিবীর যত কালা আদমি রয়েছে তারা সব্বাই তাই ইউনিন্যাশনাল। আবিশ্ব প্রকৃতির ছেলেমেয়ে সব্বাই। এবং এটাই আফ্রিকা! এটা সেই কালা আদমির জীবন যাকে কোনও সাদা সাহেব নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। তাকে এই প্রশ্নটি করার সাহস কারও নেই, — সে কেন গানের কলিতে Again Again না বলে Pansa Pansa-র জিকির তুলছে? হ্যাঁ, কারও ক্ষমতা নেই তাকে পোছার, — বিবাহ বা যৌনতার প্রশ্নে কালারা একগামী না হয়ে বহুগামী কী কারণে? কেন ফেলা কুটি এত সেক্সিস্ট? কী সেই কারণ যার চক্করে পড়ে বিলেতফেরত ফেলা-র কামবাই কিছুর পরোয়া করে না?
এসবের একটাই উত্তর ছিল সবসময় : — আফ্রিকা হচ্ছে সেই কেন্দ্র যেটি সাদা সাহেবমেমদের Monogamy ঘিরে বিদ্যমান খ্রিস্টান শুচিবায়ুকে Polygamy-র ধাক্কায় সপাটে নাকচ করে দিতে তিলেক ভাবে না। আফ্রিকার বনবাদাড়ের সংস্কৃতিতে বহুবিবাহ আদৌ কোনও নৈতিক উদ্বেগ অথবা শুচিবায়ুর বিষয় নয়। উদ্বেগ সেইসব সাহেবমেমদের থাকে যাদের গায়ের রং ধবল অথবা যাদের পাল্লায় পড়ে নিকষ কালো আদমরা অনেকদিন ধরে সাহেবমেমদের মতো খ্রিস্টান হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কালাকুটা রিপাবলিকের ফেলা কিংবা মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েড এখানেই অভিন্ন সোদর। তারা একযোগে কণ্ঠ নাচিয়ে বিশ্বকে বার্তা পাঠায় :
ওহে মার্কিনি সাহেব, ও আমার বিলেতি মেমসাহেব, আমাদের সিনটেক্সে প্রেমেকামে অকাতরে রমণীর যেমন-খুশি ব্যবহার মোটেও যথেচ্ছাচার নহে। আমরা রমণে সহজাত, যেমন সহজাত জিরাফ ও জেব্রা। আমাদের রমণীরা তাই বলে বোকা নয়। কোনটা রমণ আর কখন তা বলাৎকার সে-জ্ঞানে বিলক্ষণ পাকা। আফ্রিকা ব্ল্যাক মাম্বার মহাদেশ। রমণীরা সেই সরীসৃপের কুটুম। তারা জানে শত্রুর শিরায় কী করে বিষ ঢুকাতে হয়, যদি সে তাকে পেতে চায় গায়ের জোরে খাটিয়ে।
দেশি সাহেবমেমগুলো ছাড়া প্রমত্ত এই মহাদেশের কালা আদমির প্রতিটি রন্ধ্র থেকে কাম চুঁইয়ে পড়ছে। মহাদেশের বৃক্ষ, জীবজন্তু ও মানুষ … তারা সকলে রক্তকোষের প্রতি কোণায় কামবাই বহন করে সহজ অভ্যাসের দোষে। আফ্রিকার জন্য ওটা হচ্ছে জীবন আর কালা আদমির জন্য Power : — ক্ষমতার প্রতীক। একমাত্র আমরাই সপাটে বলে দিতে পারি : — ‘To call me a sexist … for me it’s still not a negative name. If I’m a sexist, it’s a gift. Not everybody can fuck two women every day. So if I can fuck two women every day and they don’t like it, I’m sorry for them. I just like it.’
সাদা কিংবা তাদের পোষ্য দেশি সাহেবমেমদের সিনটেক্সে এটা হয়তো মাসকুলিনিটি। ফেলা ও তার দূরের সোদর ফ্লয়েড সেখানে উগ্র পুরুষ। আংরেজি সিনটেক্সে a male chauvinist pig নামে দেগে দিয়ে সাহেবমেমরা ঘেন্নায় নাক কুঁচকায়। ফেলার কাছে মাসকুলিনিটি নামের ব্যাপারটা নিছক দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক। সে এটা পছন্দ করছে এবং তার বিশ্বাস অন্যভাবে তার পছন্দের রমণী একে কাম্য বলে মেনে নিতে আপত্তি করে না। একজন আফ্রিকানের পুরুষাঙ্গ নিছক জননযন্ত্র নয়। ওটা রমণীকে তার নিজের দিকে প্ররোচিত করার অমোঘ অস্ত্র। ওটা Love; এবং ওটা সেই হরিৎ তৃণভূমি যাকে সাহেবমেমরা আজও পড়তে শেখেনি। আফ্রিকানের একমাত্র মারণাস্ত্র এই লিঙ্গ, যেটি দিয়ে সাদা সাহেবমেমের চাপানো বুলির তোড় ঠেকানোর লড়াইটি এখনও জারি রেখেছে সে। ওর লিঙ্গটা বৃহৎ তাতে কোনও সন্দেহ নেই! কঙ্গো বেসিনের আকাশঢাকা বৃক্ষসারি যদি বৃহৎ হয়ে থাকে আফ্রিকানের লিঙ্গ সেই নিয়মের ছকে বৃহৎ হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
সেই কবে ডেভিড লিভিংস্টোন নামের ইংরেজ কঙ্গোর ঘন নিবিড় অরণ্যে ঢুকে মূক-বধির ছিল অনেকক্ষণ। আফ্রিকার নারী-পুরুষরাও এমনি নিবিড় ও ঘনীভূত পরস্পরের! প্রকৃতিদেবতা যেমন করে বনকে সাজায় তার সাথে তাল দিয়ে আফ্রিকান পুরুষের জননাঙ্গ শিবলিঙ্গের আকারে বাড়ে। আফ্রিকা মানে হচ্ছে সেই কর্ষিত উর্বরতা যেখান থেকে গোটা বিশ্বের মানবদঙ্গল একদা নিজের যাত্রা শুরু করেছিল। হয়তো-বা সে-কারণে ডাই এন্টওর্ড নামের অকালপক্ক র্যাপার অবলীলাক্রমে খৎনাকে তার পুরুষত্বের বিক্রম শুরু হওয়ার দিন বলে সাড়ম্বরে জাহির করতে পারে। মনে রাখতেই হচ্ছে, খৎনার আদি প্রচলন মিশরে ঘটেছিল একদিন। হেরোডোটাসের ঐতিহাসিক ভ্রমণলিপিতে এর অনুপুঙ্খ বিবরণ মিলে। এ-কালের এঁচড়ে-পাকা এন্টওর্ডকে এই খৎনা মনে করিয়ে দিচ্ছে রমণী এখন থেকে তাকে Evil Boy নামে ডাকতে বাধ্য বটে : —
Yooo evil boy!
Why is your incanca (penis) so big?
All the better to love you with!
No glove no love!
If you don’t believe me
Take your dirty hands off my umthondo wisizwe! (*penis of the nation)
এঁচড়ে-পাকা সেই বালক এখন আর তালপাতায়-ছাওয়া কুটিরে থাকে না। তালের রস থেকে বানানো মদিরায় তার রুচি উবে গেছে। ফেলা-র মতো উদোম গায়ে থাকার অভ্যাস সে ভুলতে বসেছে। তাতে কি? তার রক্তে আফ্রিকা সমানে বহমান। সেই প্রবাহের জেল্লায় বালক নিজেকে রিলেট করেছে আফ্রিকার গহীন বনে জীবিত ট্রাইবের সাথে। সে ফেরত যাচ্ছে সেখানে। জানিয়ে দিচ্ছে খৎনাকাণ্ড ঘটার পর তার ‘ওটা’ আর কেন্নোকেঁচো থাকবে না। Penis বা শিশ্ন হয়ে থাকবে না। ওটাকে এখন থেকে Dickhead অথবা ‘বাড়া’ বলে ডাকাটাই সংগত হবে। খৎনা ওটাকে একটি জাতির মতো ‘অতিকায়’ করে দিয়েছে, এবং সেই জাতির নামটি হচ্ছে ‘আফ্রিকা’। অতিকায় সে-আফ্রিকাকে হারিয়ে ফেলার পরিণাম ‘ব্ল্যাকি’, ‘নিগ্রো’ অথবা ‘নিগার’। সায়েবসুবোর দেওয়া এই শব্দগুলো কালা আদমির জন্য অপমানকর; যার মধ্যে জ্বলজ্বল করছে শত-শত বছর ধরে তাদেরকে দাবিয়ে রাখার দগদগে ঘায়ে ভরা সব ইতিহাস।
ফ্লয়েড, এ বড় দুখের যে, নিজের শক্তির জায়গাটি ধরতে দেরি করে ফেলেছিল। চৌভিনের হাঁটুর চাপ তীব্র হওয়ার মুহূর্তে সে বুঝতে পেরেছিল অনেকদিন ধরে অনেকভাবে ওরা তাকে শিকড় থেকে ছিটকে নিগার বানিয়ে দিয়েছে। এই নিগার গেটোয় থাকে। চাকুবাজিতে হাত পাকায়। চুরিচামারি ও ছিনতাইয়ে দড় হয়ে ওঠে। মাদকে বুঁদ হয়ে নিউইয়র্ক থেকে ডেট্রোয়েটের পথেঘাটে ঝামেলা করে। সে উচ্ছৃঙ্খল। এই নিগারের লিঙ্গটি যেন অ্যানাকোন্ডা! ওটা ভাড়া খাটে নীল ছবির জগতে। রমণীর পিচ্ছিলতায় তেড়েফুঁড়ে ঢোকে এবং বহুযুগ ধরে বুভুক্ষু মেমসাহেবদের দেহের রন্ধ্রে বুনো ও অসভ্য শিৎকারের আমোদ জাগায়। আমোদের ঠেলায় সাদা মেমসাব O God! Fuck me! Fuck me hard ইত্যাদি প্রলাপে ডার্টি সেই নিগারকে নিজের অজান্তে ঈশ্বরের মহিমায় সিক্ত করে চলে। এই নিগার আর কিছু না বুঝুক এইটা কিন্তু বিলক্ষণ বোঝে, চোদনের এই ক্ষমতাটি তার জন্য মারণাস্ত্র, যার মহিমায় সম্মোহিত সাহেবমেম তাকে ঈশ্বরের আসনে বসাতে দ্বিধা করে না।
নিগার নামের এই ঈশ্বর এক রাগী পশু। হয়তো উইলিয়াম ব্ল্যাকের বিখ্যাত সেই রহসঘন বাঘের উপমা : — ‘Tyger Tyger burning bright, / In the forests of the night: / What immortal hand or eye, / Dare frame thy fearful symmetry?’ [Tyger by Willaim Blake, Songs of Innocence, 1794]। নিকষ আঁধারে যে-বাঘ জ্বলজ্বল করে জ্বলে তাকে দমিয়ে রাখতে হলে এইভাবে হাঁটুর নিচে চেপে ধরতে হয়। যেন দম আটকে মরে বানচোদ। যেন অবাধ্য হওয়ার অপরাধে ফুসফুসে অম্লজান টানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় চিরজনম। যেন বিশ্ব দেখতে পায়, ফ্লয়েড নামের রাগী ও অবাধ্য নিগারকে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছে চৌভিন। সে তার সোদর ফেলা কুটি-র জায়গায় নেই যে সোচ্চারে বলবে : — ‘Confusion break the body’। আমেরিকা রাজার দেশে থাকতে গিয়ে নিজের মৌলিকতার অনেকখানি সে হারিয়ে ফেলেছে। ফেলা কুটি-র মতো মেডিসিন পড়তে লন্ডনে গিয়ে মিউজিকে হাত পাকানোর কপাল করে আসেনি। মিউজিকে দুরস্ত হওয়ার পর তার মতো ফেরত যায়নি নাইজেরিয়ায়। দুম করে মুখের ওপর বলে দিতে পারেনি, — সাহেবরা তোমায় বিভ্রান্ত করার আগে নিজেকে ভাঙো; — Let break the body wanna back to freedom.
ফ্লয়েডঝড় এ-কারণে এতটা মর্মঘাতী হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। আমেরিকা রাজার তখতে-তাউস, যেটি কেবল নির্ধারণ করতে শিখেছে কিন্তু নির্ধারিত হতে কভু নয়, তার সিংহাসন টলে উঠার সংকেত আজ না-হয় কাল অমোঘ হবেই। সেই অমোঘতায় কালো কিংবা বাদামিরা নয়, সেইসব সাদা মানুষরাও শরিক বটে যারা ন্যাশনাল থেকে ইউনিন্যাশনালের সড়ক ধরে হাঁটতে চাইছে। তারা বুঝে গেছে ধলা-কালা-শ্যামলা কীবা বাদামি মানুষ বলে কোনও কথা নেই, তাকে নিজের হাঁটুর নিচে চেপে ‘Mama’, ‘Please’, ‘I can’t breathe’ বলতে বাধ্য করার স্বাধিকার স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই। এই অনুভব যেসব ধলা-কালা-শ্যামলা কীবা বাদামির হলো তারা হলেন আগামী দিনের সাচ্চা মানুষ। যাদের এই বোধদয় হল না এবং অনেক চেষ্টার পরেও হবে বলে মনে হচ্ছে না, তাদের দাওয়াই আপাত অন্তহীন এক নৈরাজ্য। ফ্লয়েডের সোদর মুনওয়াকার মাইকেল জ্যাকসন নিজের পুরুষাঙ্গে সপাটে হাত ঘষে সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল অনেকদিন আগে : —
Just beat it, beat it, beat it, beat it
No one wants to be defeated
Showin’ how funky and strong is your fight
It doesn’t matter who’s wrong or right
Just beat it, beat it…
…
ফ্লয়েডঝড়কে উপলক্ষ করে আমেরিকানদের বিস্ফোরকের মতো ফেটে পড়া তাই কাকতালীয় ঘটনা নয়। সত্য বটে, আমেরিকা অনেকদিন বাদে ষাট-সত্তুরের উত্তাল সময়টিকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। অনেকদিন ধরে নিজেকে খুইয়ে ফেলা ধলা-কালা-বাদামি মানুষগুলো আবার জেগে উঠেছে সেখানে। প্রাইভেট জেট ছিনতাই করে আকাশে উদ্দেশ্যহীন পাক-খাওয়া আর সমুদ্রের বালিয়াড়িতে মানব-মানবীর অভিভূত মিলনদৃশ্যের সিলুয়েটে অস্থির-উন্মূল যে-দেশটিকে ধরার জন্য সত্তুরের গোড়ায় মিকেলএঞ্জেলো আন্তনিওনি ক্যামেরায় সচল ছিলেন, সেই Zabriskie Point আবার ফিরতে চলেছে।
শ্বাসরোধী যান্ত্রিকতায় এখান-থেকে-সেখানে উদ্দেশ্যহীন উড়ান ও অবতরণের ছকে দেশটি অনেকদিন ধরে ঘুরছিল। উড়ান কোনওভাবে নিয়ন্ত্রক-কক্ষের মাতব্বরদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ হওয়ার বিষয় নয় জেনেও আকাশে উদ্দেশ্যহীন পাক খাচ্ছিল। উড়ান মানে আকাশের নীলে মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার সুখ। আত্মিক সেই উড়ান মার্কিনিরা অনেকদিন পর ফিরে পেতে চাইছে। ক্ষণিকের ঘটনা হলেও এই বিস্ফারণকে তাই এত সুন্দর লাগছে দেখে! যদিও দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়া ক্ষুব্ধ মানুষের লেলিহান এই Chaos আর মুক্ত আত্মার অগাধ আলোড়ন কেন জানি বহুবিধ ষড়যন্ত্রের ফাঁদবন্দি ভোঁতা হৃদয়কে ভেদ করে লেলিহান দাবানল হতে পারছে না এখনও।
আমেরিকার রাজপথে Vandalism দেখছি আর মন চলে যাচ্ছে বিগত শতকের কুড়ির দশকে; যে-দশকে আমেরিকা নামের দেশটি আজকের আমেরিকা হওয়ার প্রাকমুহূর্ত সারছিল ঘটা করে। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধী তখন আনমনা হয়ে পড়েছেন। প্রমত্ত এই ভূবর্ষে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলোয় দশচক্রে ভগবান ভূত হয় বলে একটি প্রবাদ কানে এসেছিল। দীর্ঘদিন সেই অবস্থায় তাঁর দিন কেটেছে। এখন মনে হচ্ছে তিনি সেই দশা পেরিয়ে অনেক উপরে উঠে গেছেন। আকাশের নীলে পুঞ্জ-পুঞ্জ সাদা মেঘের ভেলায় বসে চরকায় সুতো কাটছেন। তাঁর দেহ শান্ত, মন স্থির ও অটল। বোধিস্বত্ব লাভের পর গৌতম বৌদ্ধ নিজের মধ্যে অটল হয়েছিলেন শোনা যায়। তিনিও দশচক্রে ভগবান ভূত হওয়ার বিপাক সামলে নিঃসীম নীলিমায় অটল হয়েছেন। সেখানে বসে দেখছেন নীলিমায় পৌঁছানোর জন্য ভারতবর্ষের মানুষগুলো হিন্দু-মুসলমান-হরিজন সকলে একে অন্যের ঘাড়ে পা দিয়ে দীর্ঘ মই বানিয়ে নিয়েছে। সেই মইয়ে ভর করে তারা সবাই তাঁকে ধরার চেষ্টা করছে আর হুড়মুড় করে নিচে গড়িয়ে পড়ছে বারবার। তাদের পতন, রোনাজারি আর হাহাকারের শব্দে তাঁর চরকার সুতো বারবার ফেঁসে যাচ্ছে। তিনি তবু অটল চিত্তে চরকা ঘুরিয়েই যাচ্ছেন!
নিজের পরিণাম ভেবে গান্ধীজি যখন উদ্বিগ্ন তখন মার্কিন মুল্লুকের নিউইয়র্ক শহরে চার্লস সি এ্যাবেটস নামের আমেরিকান সাহেব শহরের সবচেয়ে উঁচু দালানের ঊনসত্তুর ও নির্মাণাধীন সত্তুরের মাঝখানে পাতা লোহার চওড়া পাতের ওপর এগারোজন নির্মাণশ্রমিককে বসিয়ে ছবি তোলার কাজটি শেষ করে এনেছে। দালান তোলার যজ্ঞে নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে ওই এগারোজন রাতদিন খাটনি দিয়েছিল। পল, জন, মার্টিন, স্মিথ, রিকার্ডো, মিখাইলভ, গনজালেস কিংবা অন্য নামেও তাদেরকে ডাকা যেতে পারে। ভাগ্যের তালাশে কবে কখন নিজ দেশ ছেড়েছুড়ে এই শহরে পা রেখেছিল সেটা তাদের অতশত মনে নেই। শুধু খাটনিটা মনে আছে। এই দেশে পা রাখার দিন থেকে রাস্তা ও দালান তোলায় খাটনি দিচ্ছে সকলে। মহামন্দার দশকে মার্কিন মুল্লুকের ব্যস্ত শহরে দালান উঠার বিরাম নেই। উঠতে-উঠতে ঊনসত্তুর তলা অবধি পৌঁছে গেছে। আকাশকে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালে ছোঁয়া যাবে। মাটিকে মনে হচ্ছে পেছনে ফেলে আসা বিন্দু, যেটা তারা ফেলে এসেছে অনেক নিচে, যেখানে আবার নামতে হলে ডরভয় জয় করে ওপরে ওঠা ছাড়া উপায় নেই।
পল, জন-দের মতো অসংখ্য এগারো যারা এই দেশের শহরগুলোয় স্রোতের মতো ঢুকছে, তারা প্রথম বেপোরোয়া হয়েছিল দেশ ছাড়ার ক্ষণে। দ্বিতীয়বার বেপোরোয়া হয়েছে আকাশচুম্বি দরদালানের গাঁথনি তোলার কামলা খাটতে গিয়ে। দালানের মালিক জানে এই হতভাগারাই হচ্ছে তার তুরুপের তাস। শুধু দালান বানিয়ে ব্যবসা ও মুনাফা তোলার দিন শেষ। তুমি মস্ত দালান বানিয়েছ আর লোকজন হুমড়ি খেয়ে সেটার ফ্লোরগুলো ভাড়া নিচ্ছে, সেই দিন আর নেই! তাদেরকে অন্য বার্তা দেওয়ার সময় আসন্ন। লোকজনের মনে ভরসা ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে হবে : — এই শহর এই মার্কিন মুল্লুক আকাশচুম্বি দালানের মতো দৃঢ় ও সুরক্ষিত। মজবুত এই দেশ! আকাশছোঁয়া উচ্চতায় বসে থাকলেও যেখানে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই।
দালানের মালিক জানে ইংরেজরা ফতুর হওয়ার পথে। ইউরোপ মহাদেশের নতুন কিছু দেওয়ার ক্ষমতা তলানিতে ঠেকেছে। পৃথিবীর আনাচকানাচ থেকে মার্কিন দেশে যারা জড়ো হয়েছে তাদেরকে এই বার্তায় সম্মোহিত করার সময় হয়েছে : — ভাগ্যের দেবী সর্বদা সাহসীদের পক্ষে থাকে। মার্কিন মুল্লুক হচ্ছে সাহসের প্রতীক। এখানে যারা ব্যবসা করবে, গতর খাটবে, আকাশের নীল ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন দেখবে … দেশটি তাদের দিকে হাত বাড়াবে চিরকাল। আকাশের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় সেটা এই দেশের চেয়ে ভালো কেউ জানে না। শূন্যতায় নিজেকে সুরক্ষিত রাখার স্বস্তি কেবল এই শহর দিতে জানে।
এ্যাবেটসের বুঝতে বাকি থাকেনি অত্যাশ্চর্য দালানের পেছনে যে-লোকগুলো অঢেল পুঁজি ঢালছে তারা আসলে কী চায়। সাহসী শ্রমিকদের মধ্য থেকে তাকে বেছে নিতে হবে, যারা আকাশ ও মাটির মাঝখানে ভীতিকর শূন্যতায় অনায়াসে চলাচল করতে পারে। কোনোকিছুর পরোয়া না করে উপরে উঠতে তাদের বুক কাঁপে না। গোরা সাহেব পাকা মাথার পেশাদার। পল, জন, স্মিথ অথবা মিখাইলভকে দিয়ে কাজটি সে ঠিক আদায় করেছে। ওই তো পল ও স্মিথ রক্ত–হিম–করা–উচ্চতায় পলকা লোহার পাতের ওপর বসে সিগারেটে কাঠি ঠুকছে। জন ও মার্টিন মিলে কী জানি কথা কইছে! রিকার্ডো, গনজালেস, মিখাইলভ আর বাদবাকিদের চোখে-মুখে ভয়ের লেশ মাত্র নেই! ডরভয় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে সকলে খোশগল্পে মেতে রয়েছে। তারা হয়তো নিজের ছেড়ে-আসা দেশ নিয়ে কথা বলছে। সংসার ফাঁদার গল্পটি করছে। বাড়তি কোনও অবলম্বনের সাহায্য ছাড়া আকাশস্পর্শী উচ্চতায় পা দুলিয়ে বসে থাকার জন্য হ্যাডম লাগে। বোধিস্বত্ব লাভের চেয়ে কঠিন সেই কাজ। এ্যাবেটস সাহেবের মডেলরা সেদিক থেকে বোধিস্বত্বই বটে। আকাশের গা ঘেঁষে বসে থাকার সময় তাদের গা ঘুলিয়ে ওঠে না। অত উঁচু থেকে নিচে পতনের ভয় মনকে কাবু করতে পারে না।
এ্যাবেটস সাহেবের ক্যামেরা চাইছে তারা আরও বহুক্ষণ মাটি ও আকাশের মাঝখানে ভীতিকর শূন্যতায় ডরভয়হীন চিত্তে মার্কিনি পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকুক। সে জানে এতকিছুর পরেও এই লোকগুলো কখনও এ-দেশের মালিক হয়ে যাবে না। কদাপি এমন উঁচু দালানের গর্বিত ব্যবসাদার বনে যেতে পারবে না। কিন্তু লোকগুলো মাটি কামড়ে এই শহরে পড়ে থাকবে চিরকাল। মাটি ও আকাশের মাঝ-বরাবর শূন্য খাদের কোনও–এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে মার্কিনি পতাকা উড়াবে, যাতে করে এই শহর অথবা এই তামাম মুল্লুক যেখানে ধবল-কৃষ্ণ-বাদামিরা মিলে বিচিত্র তরঙ্গে প্রতিদিন আছড়ে পড়ছে সেটা একদিন সেরাদের সেরা হয়ে ওঠে।
সাহেব জানে খবরের কাগজ হয়ে এগারোজনের ছবিগুলো পৃথিবীর সব দেশে অচিরেই ছড়িয়ে পড়বে। বিশ্বকে এই বার্তা দিয়ে যাবে : — মহামন্দার ঘোর অমানিশা সরিয়ে নতুন দেশ জেগে উঠছে। সে জেগে উঠছে আসন্ন আগামীর ওপর নিজের দাপট দেখানোর জন্য। নতুন এক রাজা পেতে যাচ্ছে দুনিয়া! পল, জন, স্মিথ আর গনজালেসদের খাটুনিভরা দুঃসাহসে ভর করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সেই রাজা! যুগের নবীন সম্রাট! খবরের কাগজে ছবিগুলো পাঠানোর সময় এ্যাবেটস নিজের নাম-পরিচয় গোপন রাখবে মনস্থির করেছে। মালিকপক্ষের সঙ্গে তার চুক্তির ধারাটি ও-রকমই। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ্যাবেটস মার্কিনি হলেও এটা বিলক্ষণ বোঝে নতুন এই সাহসী শহরে পল, জন, স্মিথের চেয়ে সে আলাদা কিছু নয়।
ম্যানহাটন নামের দ্বীপভূমিটি এখন নিউইয়র্ক বলে নাম কিনেছে। শহরটি গোরা-রং সাহেবদের হলেও অন্যভাবে কালো-বাদামি এবং অন্যদেরও। সকলে মিলে অখণ্ড এক পরিচয়কে ধারণ করতে যাচ্ছে সে। কয়েক দশক পরে যেটি দিয়ে লোকে এই শহর অথবা তামাম মুল্লুককে চিনে নিতে চাইবে। কেউ আর বলবে না এই মার্কিন মুল্লুক একদা ওইসব পাহাড়ি লাল-মানুষদের ছিল, যারা এর প্রতিটি নদী, উপত্যকা ও অরণ্যে ছড়িয়েছিটিয়ে বসবাস করত। কলম্বাস অনেক আগে সেই মামলা তামাদি করে দিয়েছে। লোকে হয়তো সেদিন বলবে : — ওহ্ নিউইয়র্ক! আরে ওটা তো অভিবাসী শ্রমিকদের কারখানা।
নিজেকে শূন্যতায় নির্ধারণকারী এই রাষ্ট্র কালপ্রবাহে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে এভাবে অন্যকে অবিরত উহ্য ও গৌণ করেছে। এটি সেই রাষ্ট্র যে তার নিজেকে ‘আমেরিকা’ থেকে ‘মেরিকা’–য় নির্দিষ্ট ও অমোঘ করার জন্য এখনও ছুটছে। এই আত্মমেহন তাকে সাদা ও কালোয়, নাগরিক ও অভিবাসী ইত্যাদি অমোচনীয় সব জাতীয়তার ফাঁদে বন্দি করে রেখেছে। Knowledge ও Working Class-এর গণ্ডি ভেদ করে নিজেকে ‘মেরিকা’-য় শোভন ও অবলুপ্ত করতে মরিয়া হয়েছে। ফ্লয়েডের ঘটনা সেই উহ্যায়নের চাপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা বিস্ফার। এটি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, বিশ্বকে সংলাপের টেবিলে বসিয়ে যে-রাষ্ট্র এত মাতব্বরি ফলায় সে নিজে তার অন্দরমহলে বিমূর্ত ও সংলাপবিহীন! ফ্লয়েডকাণ্ডের মোদ্দা উপকার এই মুহূর্তে এটুকু।
…
অতঃপর এ-প্রশ্নটি ওঠে : — ষাটের দশকে প্যারিসে ছাত্রআন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো কি অন্যভাবে রিপিট হতে চলেছে এখানে? উত্তরটি পেতে খানিক সময় লাগবে। প্যারিসে সংঘটিত আন্দোলন তুঙ্গ আকার ধারণ করার আগের বছর ‘লা শিয়োনেজ’-র Witty Camouflage-এ জাঁ-লুক গদার সে-ঝড়ের ইঙ্গিতটি দিয়েছিলেন। ছাত্রআন্দোলন জংধরা স্মৃতির তলানিতে চাপ পড়ার ক্ষণে জানি না কী ভেবে বার্তোলুচ্চি The Dreamers-এর পশ্চাদপটে এটিকে আবার জুড়ে দিয়েছিল। বিশ্ব দেখল, ফরাসি শিখতে প্যারিসে আসা মার্কিনদেশি ম্যাথু পাক্কা ফরাসি যমজ ভাইবোন থিও ও ইসাবেলের পাল্লায় পড়ে নিষিদ্ধ যৌনতার রোমাঞ্চে কেমন বুঁদ হয়ে গেল! যদিও ভিয়েতনাম যুদ্ধের খোঁয়ারি তখনও কাটেনি এবং আমেরিকার তরুণ প্রজন্ম উদ্বেগহীন জীবনের আরাম-আয়েশ ছুঁড়ে ফেলে ছেঁড়া জিন্স আর হাশিসে নির্বাণের উপায় খুঁজছিল।
ফাঁকা বাড়িতে অকালপক্ক তারুণ্য নিষিদ্ধ সম্পর্কের ট্যাবু ভেঙে দেহকে আবিষ্কারের খেলায় যবে মত্ত হলো ততক্ষণে তাদের ঘরের বাইরে বিশ্ব ফেটে পড়ছে। দুটি ঘটনাই এখানে শারীরিক। অপরিমেয় হিংস্র শিহরণ আর উত্তেজনার বারুদে ঠাসা। আপাত সম্পর্কহীন হওয়ার পরেও পরস্পরকে তারা সেদিন আলিঙ্গন করেছিল। বাইরে বিস্ফারিত সবকিছু পালটে দেওয়ার লড়াইয়ের সঙ্গে সংযোগহীন থিও, ম্যাথু ও ইসাবেল বাপমা-র কাছে ধরা খেয়ে আত্মহত্যা করবে বলে মনস্থির করে নিয়েছিল। যদিও সেখান থেকে তারা ফেরত আসতে বাধ্য হয়। ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে গর্জে ওঠা আত্মহত্যার ভাষার সঙ্গে নিজের সংযোগ ম্যাথু এবং তার সুবাদে থিও ও ইসাবেল শেষতক উপলব্ধি করতে পেরেছিল। তাদের হাতে যখন মলোটেভ ককটেল উঠে এসেছে ততক্ষণে প্রতিবাদের গনগনে আঁচ নিভিয়ে দিতে প্রতিপক্ষরা মারমুখী ও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে!
মনে রাখতে হবে কাহিনির শুরুতে ওরা তিনজন বাইরে ধূমায়িত অসন্তোষকে ভায়োলেন্স ভেবে জাস্ট সরে গিয়েছিল; অভিভাবকরা তাদের ট্যাবু ভাঙার খেলাটি জেনে গেছে দেখে আত্মহত্যায় নিরাময়ের উপায় খুঁজছিল; এবং বার্তোলুচ্চির হয়তো উচিত ছিল কাহিনি সেখানে খতম করা। দুটি ঘটনাই মানুষের সমাজ ঘিরে তৈরি-হওয়া ট্যাবুর শিকলভাঙা বিস্ফারকে চিনিয়ে দিচ্ছিল। এ-রকম আত্মহননের মুহূর্তে যেসব তোড়ভাঙা দৃশ্যের জন্ম হয় সেখানে এই বিস্ফারগুলো অমরত্ব পায়। গনগনে ক্ষোভ, আগুনরাঙা বিদ্রোহ, লেলিহান প্রতিবাদ, সীমাহীন ভাঙচুরের অবধারিত ফলাফল যে-নৈরাজ্য সেটি সব উগড়ে দিতে বাধ্য করায় বলে তাকে এত ভালো লাগে। তবে ফ্লয়েডের ঘটনায় এখন অবধি যতটুকু নৈরাজ্য ছলকে উঠেছে সেটা নৈরাজ্যের গভীরতাকে সাথর্কতা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়। বিশ্বের এখন সেই নৈরাজ্য দরকার যেটি লা শিয়োনেজ কিংবা ড্রিমার্সকে রিপিট করছে না। যেটি হয়তো এই প্রথম ইতিহাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নতুন ছন্দে দ্রুততালের কোনও র্যাপের জন্ম দিতে যাচ্ছে, যা মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য রীতিমতো প্রহার করবে একদিন : — তাজা হাওয়া ফুসফুসে টানার অধিকার আজও কেন সকলের জন্য সমান নয়?
ফ্লয়েডঝড়কে ঘিরে সক্রিয় এই নৈরাজ্য ক-দিন বাদে মরিচাধরা স্মৃতির অবশিষ্টে যদি ঠিকানা খুঁজে নেয়, সেক্ষেত্রে বলতেই হবে, — ইতিহাসে আরেকটি বিষাদমাখা অমরত্ব যোগ হল বটে কিন্তু মানুষ ও তার সমাজ কি নিজেকে পালটে নিতে পেরেছে? আন্দোলনে সেই লক্ষণ এখনও দৃশ্যমান নয়। ফ্লয়েডবিস্ফারকে চালিত করতে পারে যে-শক্তিপুঞ্জ, হার-না-মানা যেসব অঙ্গীকার, পোড়খাওয়া নেতা বা রাজনীতি, যারা সকলে একযোগে মার্টিন লুথারের মতো ঘোষণা দেবে, ‘আমার একটি স্বপ্ন রয়েছে। আমাদের সকলের অধিকার সমান হোক।’ সমবেত সেই ঐকতান ফ্লয়েডঝড়ে আপাতত অনুপস্থিত। বিপরীতে হাঁটুর জোর ক্রমেই সংঘবদ্ধ ও চতুর হচ্ছে এবং সেটা খেয়াল করা প্রয়োজন।
জরুরি এই Chaos-কে যদি সার্থকতা পেতে হয় তবে লম্বা সময় ধরে তাকে জারি থাকতে হবে, যেন ঘুণেধরা কাঠামোর বনেদ ও অজেয় হাঁটুর চাপ চুরমার করে মানুষকে নতুন সমাজ এনে দিতে পারে। নতুবা আরেকটি বাধভাঙা উত্তেজনার সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও ধলা-কালা-শ্যামলা বা বাদামি রংয়ে ভরা মানববিশ্ব যথারীতি অতীতবৃত্তে ফেরত যেতে বাধ্য থাকবে। অতঃপর স্থানে-অস্থানে চৌভিন এবং তার মতো দেখতে চৌভিনদের হাঁটুর চাপ সহ্য করার পর মনে হবে এই বিভ্রমটি বোধহয় সত্য : — I can breathe। ফ্লয়েডের সত্যবচনের মৃত্যু ঘটবে সেদিন; যে কিনা মরার আগে অন্তত বলতে পেরেছিল : — I can’t breathe.
…
ফার্নান্দো পেসোয়া পড়ছি বলে হয়তো পরিসংহারে এসে তাঁর এই কথাটি ফ্লয়েডঝড়ের সঙ্গে জুড়ে নিয়ে ভাবতে বেশ লাগছে। নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনারাশির সড়ক ধরে হাঁটতে-হাঁটতে পেসোয়া ওরফে বার্নার্দো সোয়ারেজের মনে হচ্ছে, বেশ তো এইবার নিজের এইসব লেখার জায়গাজমি নিয়ে দু-ছত্র ভাবা যাক। নিজেকে সে দুটি নীতির মধ্যে সেখানে খুঁজে পাচ্ছে। প্রথমটি অনুভূতিকে উগড়ে দিতে সাহায্য করে। তার মনে হচ্ছে এটাই সই। মন যা বলতে চাইছে তাকে সেটি বলার সুযোগ দিতে হবে। যদি মনে করো পরিষ্কার করে গুছিয়ে বলতে পারছ তাহলে সেভাবেই বলো। যদি মনে হয় যা বলতে চাইছিলে সেটা এখনও যথেষ্ট পরিষ্কার নয়, তবু থেমো না; অগোছালো সে-কথাগুলো অকপটে বলে ফেলো। কিন্তু এমন যদি মনে হয় অনুভূতিরা বিভ্রান্ত করছে, অসুবিধা নেই, বিভ্রান্তি বা হেঁয়ালিভরা কথাগুলো কিছুর পরোয়া না করে বলতে থাকো।
দ্বিতীয় নীতি হচ্ছে নিজেকে সেই রোমের সম্রাটের মতো ভাবা। তার বাক্যে ব্যাকরণের দোষ ধরলে সবাইকে সে মনে করিয়ে দিত, ‘মনে রেখো, আমি হচ্ছি রোমের সম্রাট এবং সকল ব্যাকরণের ঊর্ধ্বে।’ পেসোয়ার কাছে এটা হচ্ছে Supergrammaticam। ব্যাকরণের কাছে দাসখত লিখে দিয়ে অনুভূতির প্রকাশ প্রকারান্তরে আত্মহত্যার নামান্তর। কেননা ব্যাকরণ লেখার উপকরণ মাত্র, কোনও আইন অথবা নিয়ম নয়।
হাঁটুর চাপে দম-অটকে-মরা ফ্লয়েডের ‘I can’t breathe’ বাক্যটিও সে-রকম। আমেরিকা রাজার বানানো ব্যাকরণের হাঁটু তাকে চেপে ধরেছে; সে টের পাচ্ছে বাঁচতে হলে বশ্যতা স্বীকার করা উচিত। Transitive Verb অর্থাৎ সকর্মক ক্রিয়ায় নিজেকে সক্রিয় করার পরিবর্তে Intransitive Verb বা অকর্মক ক্রিয়ার অধীন হলে হয়তো বেঁচে যেতেও পারে। আমেরিকা রাজার দেশে Transitive হয়ে তার মতো কালা আদমিরা বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। সুতরাং হার স্বীকার করা উত্তম। এতে অন্তত প্রাণটা রক্ষা পাবে। সমস্যা হচ্ছে চৌভিনের হাঁটুর চাপ সহ্য করে হলেও ফ্লয়েড সেদিন সকর্মক থাকতে চেয়েছিল। ফুসফুসে তাজা হাওয়া টেনে নেওয়ার এই ঔদ্ধত্য অবিকল তার মতো দেখতে অ্যালেক্স হ্যালির কুন্তা কিন্তে-র সোদর বলে তাকে সেদিন চিনিয়ে দিচ্ছিল। ফ্লয়েডঝড়ের এও এক নতুন রূপ বটে!
ফ্লয়েডের সোদর কুন্তা কিন্তে সাদা সাহেবের দেওয়া নামকে জীবনের শেষ দিন অবধি স্বীকার করেনি। জীবনভোর সেই নামকে সে অস্বীকার করে গিয়েছে। বুক ফুলিয়ে অবিরত একটি আওয়াজ ছুঁড়ে দিয়েছে সাদা সাহেবমেমদের পানে : — আমি কুন্তা কিন্তে। এই আমার পরিচয়। এটাই আমার ব্যাকরণ। মিনিয়াপোলিসের ফ্লয়েড একই কাণ্ড ঘটিয়েছে এখানে। আমেরিকা রাজার বানোয়াট ব্যকরণকে শেষ দম অবধি ঠাপিয়েছে। দলাপাকানো রক্তের পুটুলিতে অকর্মক হয়ে পড়ার ক্ষণেও তার কণ্ঠ থেমে থাকেনি। ওর ‘I can’t breathe’ বাক্যটি তাই কোনও পরাজয়ের স্মারক নয়; বরং এটাই বিজয়। শেষ দম অবধি লড়ে-যাওয়া জর্জ ফ্লয়েড নামের কালা আদমির অবধারিত Supergrammaticam।
যারা এখন আগুনরাঙা পুষ্পের মতো আমেরিকার রাস্তায় নিজের পাপড়ি মেলে ধরেছে, তারা কোনও-এক ফুৎকারে যদি ক-দিন বাদে নিভে যায়, তবে বলতেই হবে ‘I can’t breathe’ বাক্যের ফ্রেমে বাঁধা সেই অজেয় ব্যাকরণ, মানবাত্মার সার্বভৌম স্বেচ্ছাচার, সেই ফ্রিডম, বুকভরা অনুভূতির বাঁধনহারা উল্লাস, সৃষ্টিসুখের চিৎকার আবারও গদারের Witt আর বার্তোলুচ্চির Suicide-এর খোরাক যোগাবে মাত্র। ফ্লয়েড সেদিন পূর্ণতা পাবে যেদিন সকলে মিলে এই নৈরাজ্যকে জারি রাখতে পারবে; অন্তত ততদিন অবধি, যতদিন ‘I can’t breathe’ বাক্যে ধরা-খাওয়া ক্রিয়াকে I can breathe, everyone here can breathe-এর সহজাত ক্রিয়ায় পালটানো সম্ভব হচ্ছে না।
…
প্রতিবাদ যদিও ‘অগ্রসর’, হাঁটুর মালিকরা কিন্তু জোরকদমে ‘আগুয়ান’। ‘অগ্রসর’ ও ‘আগুয়ান’ সমার্থক মনে হলেও তারা কেন বা কী কারণে সমার্থক নয় সেটা ধরতে হাইনরিশ বোল-এর ‘ক্যাথরিনা ব্লুমের হারানো সম্মান’ নভলেটে ঘুরে আসা কাজে দিতেও পারে। ধর্ষণের সুবিচার চাইতে গিয়ে ধর্ষিতা ক্যাথরিনের এই অভিজ্ঞতা হলো যে পুলিশ, আদালত ও গণমাধ্যম মিলেঝুলে এমন এক ভাষার জগৎ সেখানে গড়ে নিয়েছে যেটি ধর্ষণের তীব্রতাকে কথার প্যাঁচে লঘু করতে কিছু বাকি রাখে না। কথার এইসব ঘোরপ্যাঁচের ফোকর গলে অপরাধী ঠিক পার পেয়ে যায়। ক্যাথরিনার বেলায় তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে ‘অগ্রসর’ ও ‘আগুয়ান’ শব্দের প্রয়োগ নিয়ে তারা গোল বাঁধাল। তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল ধর্ষক তার দিকে ‘অগ্রসর’ হয়েছিল এই বক্তব্যে সে যেন স্থির থাকে। সাক্ষ্যে ‘আগুয়ান’ শব্দের প্রয়োগ শ্রুতিকটু শোনায়। তদন্ত ও বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতার স্বার্থে এ-রকম শব্দ পরিহার করাই উচিত। এ-রকম শব্দ মনে ভ্রান্তি ও ধাঁধা জাগিয়ে তোলে। ‘আগুয়ান’ এমন একটি শব্দ যার মধ্যে বিচারিক বিধিকে প্রভাবিত করার যথেষ্ট উসকানি রয়েছে। সুতরাং ক্যাথরিনার উচিত হবে ‘আগুয়ান’-এর বদলে ‘অগ্রসর’-এ সুস্থির থাকা। এর ফলে আদালত নিরপেক্ষ মন নিয়ে বিচারকার্য সমাধা করেছেন সেটা প্রমাণিত হবে।
ক্যাথরিনার কাছে এটা ডাহা মিথ্যা বৈ অন্য কিছু ছিল না। বলাৎকারের সময় ধর্ষকের দেহভঙ্গির মধ্যে ‘অগ্রসর’ হওয়ার পরিবর্তে ‘আগুয়ান’ ভাবটি সে প্রকট হতে দেখেছিল। লোকটি মরিয়া ছিল তখন। সেই স্মৃতি স্মরণ করে ক্যাথরিনা তার ওপর অন্যায় এই বলপ্রয়োগকে ‘অগ্রসর’ বলে মেনে নিতে কিছুতেই রাজি হলো না। সে বলেছিল, শেষ দিন অবধি কথাটি তাকে বলতে হবে, লোকটি তার দিকে অব্যাহতভাবে ‘আগুয়ান’ ছিল। সুতরাং ‘আগুয়ান’-এর জায়গায় ‘অগ্রসর’ বসিয়ে বলাৎকারের তীব্রতাকে লঘু করার সুযোগ এখানে নেই। ঘটনাটি ছিল একটি মেয়ের জীবনে নরকতুল্য পীড়নের সমান। সেই পীড়নকে ‘অগ্রসর’ ভাবা তার পক্ষে ইহজীবনে সম্ভব নয়।
জর্জ ফ্লয়েডকে ঘিরে উত্তাল আন্দোলনে যারা রয়েছেন তারা যেন এই ‘অগ্রসর’ ও ‘আগুয়ান’ শব্দের ক্যামোফ্লেজ সম্পর্কে সচেতন থাকেন সেজন্য এই প্রসঙ্গের অবতারণা। জনতা এখন অবধি ‘অগ্রসর’ হচ্ছে; বিপরীতে চৌভিনের আমেরিকা রাজা ‘আগুয়ান’ হলো বলে। খোলনলচে পালটে দেওয়ার মতো ঘটনা জন্ম দিতে হলে ‘অগ্রসর’ জনতাকে নিজের রূপ পালটে ‘আগুয়ান’ হতে হবে। আমেরিকা রাজার সাঙ্গোপাঙ্গোদের বেদম পিটুনি দেওয়ার জন্য আরও মারমুখী হওয়া ছাড়া নৈরাজ্য তার সত্যিকার গভীরতায় পৌঁছায় না। সেই সমরকৌশল নিশ্চিত না হওয়া অবধি রাজপথ ছেড়ে ঘরে ফেরা মানে হচ্ছে আত্মহনন। ফ্লয়েডের ‘I can’t breathe’-এর ডিগনিটি জারি রাখতে হলে প্রতিবাদী পক্ষের এই Supergrammaticam লম্বা সময় ধরে বজায় থাকা জরুরি।
মনের অবসাদ তাই কাটছে না এ-কথা ভেবে, Supergrammaticam হওয়ার লড়াইয়ে ধলা-কালা-বাদামি এবং যত রঙ্গভরা মানুষ দেখি দুনিয়ায়, তারা কেন সবকিছু পালটে দেওয়ার জন্য ‘আগুয়ান’ হওয়ার মন্ত্রে বেশিখন টিকতে পারে না! আগুনরাঙা এইসব প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ কেন দ্রুত দম হারায়! ফ্লয়েডঝড়কে উপলক্ষ করে রাষ্ট্রের খোলনলচে পালটে দেওয়ার তেজে সেভাবে ‘আগুয়ান’ হতে না পারলেও এই আশাটি করা যায়, — কোনও একদিন সবাই ঠিক বুঝে যাবে ‘I can’t breathe’-এ নিহিত সত্যকে কেমন করে ‘আগুয়ান’ হলে পরে উল্লাসভাঙা ব্যাকরণে বদলানো সম্ভব। যেন দ্রুতলয়ের কোনও র্যাপারকে আর কখনও গাইতে না হয় : — I can’t breathe / I’m struggling finding the balance between what I want and I need.
ঈশ্বর সেই দিন দেখার সৌভাগ্য মানুষকে দিন। বাস্তবে যদি না হয়, আপাতত স্বপ্নে সেটা জারি থাকুক। জগতের মারখাওয়া ফ্লয়েডদের জন্য নিজেকে ফিরে পাওয়ার আয়ুধ বলে গণ্য এই অমোঘ পঙক্তি ‘Mama! I can’t breathe’ আরও বহুকাল ধরে এইভাবে মানুষের হৃদয়ে ঝড় তুলুক। এটা জারি থাকুক অযুত বছর। যতদিন–না চৌভিনরা নিশ্চিহ্ন হবে এই ধরা থেকে ততদিন ‘Mama! I can’t breathe’-কে ফিরে-ফিরে স্মরণ করার প্রয়োজন হবে; এবং ততদিন, যতদিন-না সকলে বুক ভরে সমানে দম নিতে পারছি!
… …
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS