সেইন্ট জর্জেসে অকাল বোধন || অসীম চক্রবর্তী

সেইন্ট জর্জেসে অকাল বোধন || অসীম চক্রবর্তী

পড়ছিলাম কানাডার অন্টোরিও প্রদেশে সেইন্ট জর্জেস নামের একটি ছোট শহরের একটি অতিমানবিক ঘটনার কথা। আয়তনে খুবই ছোট সেইন্ট জর্জেস শহরের একটি ছোট ছেলে, নাম ইভান লেভার্সেইজ। ২০১৫ সালের এক অক্টোবরে ছোট গোলগাল ইভানের ব্রেইন ক্যান্সার ধরা পড়ল। ডাক্তার বললেন, হাতে মাত্র কয়েকটা দিন। সেই কয়টা দিন ফুরোলেই ইভান অগ্যস্তযাত্রা করবে মহাসিন্ধুর ওপারে।

কিশোর ইভানকে জানানো হলো তার জীবনের সবচেয়ে ট্রাজেডিপূর্ণ এই ঘটনা। ইভান খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাল না বটে। তবে একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দ্যাট মিনস, আই উড নট বি অ্যাবল টু সি খ্রিস্টমাস অ্যানিমোর।”

ছেলের শেষইচ্ছা পূরণের জন্য ইভানের বাবা-মা নিকটআত্মীয়দের বললেন, এই অক্টোবরেই তারা খ্রিস্টমাস পালন করবেন। প্রাথমিক পরিকল্পনা হলো নিজেদের বাসায় অকাল বোধনের মতো অক্টবরেই খ্রিস্টমাস পালন করবেন। কিন্তু এর মধ্যে ঘটে গেল এক মহাঘটনা। নিকটআত্মীয় এবং সোশ্যাল মিডিয়া মারফত ইভানের শেষইচ্ছার ঘটনাটি জানাজানি হয়ে গেল গোটা সেইন্ট জর্জেস শহরের প্রায় সাঁইত্রিশ হাজার মানুষের কাছে। সবাই ইভানের পরিবারের কাছে দাঁড়াল জোরপায়ে, গলা ছেড়ে বলল, ইভান উই লাভ ইউ। তারপরে বাকিটা ইতিহাস।

গোটা শহর ইভানের জন্য অক্টোবরে উদযাপন করল খ্রিস্টমাস। সারাশহরে খ্রিস্টমাসট্রি লাগানো হলো, এবং আলোকসজ্জা হলো, শপিংসেন্টারগুলোতে খ্রিস্টমাস সেইল শুরু হলো। সমস্যা হলো তুষারপাত নিয়ে। প্রতিবছর খ্রিস্টমাসে সেইন্ট জর্জেসে তুষারপাত হয়। কিন্তু এই অক্টোবরে তুষার পাওয়া যাবে কোথায়? সেই সমস্যার সমাধান করতে স্পেশাল-এফেক্ট-তৈরিতে-উস্তাদ একটি কানাডিয়ান ফিল্ম কোম্পানি শহরজুড়ে তৈরি করল কৃত্রিম তুষার।

ঘুম থেকে উঠে ইভান দেখতে পেলো তার বাড়ির সামনে তুষারে তুষারে দুধশাদা হয়ে যাওয়া আলোকসজ্জাময় খ্রিস্টমাসট্রির নিচে শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত সান্তা ক্লজ দাঁড়িয়ে আছেন ইভানের জন্য মহাকালের উপহার নিয়ে। সান্তা তাঁর রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে ইভানকে নিয়ে আলোকসজ্জাময় শহরে সারাসন্ধ্যা ঘুরে বেড়ালেন। সারা শহরের মানুষ সান্তার ঘোড়ার গাড়ির পেছনে পেছনে চোখের জলে শোভাযাত্রা করে পরিভ্রমণ করল সারাশহর। এভাবেই একটা ইটপাথরের শহর মানবতার দৃষ্টান্ত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এভাবেই একটা শহরের একদল মানুষ হয়ে ওঠে একটি বৃহত্তর পরিবার।

এর ঠিক অন্যপ্রান্তে আছে ভিন্ন চিত্র। সেই একই পৃথিবীর ঠিক অন্যপ্রান্তে অন্য-একটি শহরে চলে শিশুনির্যাতন, চলে শিশুশ্রম। সেই শহরের ফুটপাতে অযত্নে অবহেলায় না-খেয়ে ঘুমোতে হয় হাজার হাজার শিশুকে। অসাধু ব্যবসায়ীরা শিশুখ্যাদ্যে মেশায় মেলামাইনের মতো বিষাক্ত ক্যামিক্যাল। শিশুদের প্রিয় ফলে মেশায় ফরমালিন, কার্বাইড সহ প্রাণহন্তারক রাসায়নিক দ্রব্য। টাকার জন্য চিকিৎসার নাম করে ভুল চিকিৎসা এবং ভেজাল ওষুধ তৈরি করে খুন করে চলে নিষ্পাপ শিশুদের। আসলে মানুষ হওয়া কি খুব কঠিন? ব্যক্তিগত অভিমত হলো, মানুষ হয়ে ওঠা সম্পূর্ণটাই নিজের উপর নির্ভর করে। আপনি নির্ধারণ করবেন আপনি কি সেইন্ট জর্জেসের মতো ছোট শহরের মানুষগুলোর মতো হবেন নাকি আপনার শহরের মানুষের-মতো-দেখতে কতিপয় অমানুষের মতো হবেন।

… …

অসীম চক্রবর্তী

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you