আমার দেখা শারদীয় উৎসব || শেখ লুৎফর

আমার দেখা শারদীয় উৎসব || শেখ লুৎফর

[ভারতের জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের বন্ধুদের স্মরণে]


জীবনে নির্মম সত্য হলো মৃত্যু। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার শৈশবের যেসব বন্ধুরা জান-মালের নিরাপত্তার অভাবে তাদের পরিবারের সাথে নিজের সাতপুরুষের ভিটা ছেড়ে, রাতের অন্ধকারে চোরের মতো পালিয়ে গেছে ভারতের পথে তারাও আজ আমার কাছে মৃত। কারণ জীবনে আর কোনোদিন তাদের সাথে দেখা হবে না! যেদিন মায়ের কোল থেকে নেমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি, ইন্ডিয়া নামক একশ তিরিশ কোটি মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া তাদের কেউ কেউ ছিল আমার সেই দিনের বন্ধু।

হাজার হাজার বছর ধরে মাথার উপর মৃত্যুর থাবা নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, মানুষের আবিষ্কারপ্রবণ মন আর দুর্মর মানসিক শক্তি অন্ধকার মন্থন করে নতুন নতুন আলোর দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মানবসভ্যতার এইসব বিজয়গাথার আনন্দ থেকেই মানুষের জীবনধারায় মিশে গেছে নানান রকম উৎসব। মানুষ তার সাধারণ গৃহস্থালির একঘেয়ে জীবনকে এইসব উৎসব নামক রঙিন হীরা-জহরতের বর্মে সাজিয়ে, মানসিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছে বিষাদের বিরুদ্ধে, মৃত্যুর বিরুদ্ধে।

বাঙালির প্রাণদায়ী এইসব উৎসবের একটি হলো দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার আগে সার্বজনীন শব্দটা উচ্চারণ করা হয়। এই থেকে বোঝা যায় বাঙালির জীবনে সার্বজনীন দুর্গাপূজা কথাটার প্রভাব ও প্রিয়তা কত গভীর। আমি জীবনে প্রথম দুর্গাপূজা দেখতে আমার ভাইয়ের বন্ধুর ঘাড়ে চড়ে আখড়ার মণ্ডপে গেছিলাম। মা বলেছে তখন নাকি আমার বয়স ছিল মাত্র আড়াই। তেমন স্মৃতিটিতি নাই। সেই থেকে শুরু।

দশ-বারোটা পরিবারের বিশাল একটা বাড়িতে আমরা ছোটদের একটা দল ছিল। বারো-তেরোজনের দলে আমিই ছিলাম সবার ছোট। তাই আমার উপরে সবাই সর্দারি ফলাত।

আখড়ায় ঢাকের শব্দ হলেই আমরা সব ছুটতাম। তিন-চারটা ক্ষেত পেরোলেই পূজামণ্ডপ। বৃষ্টিটিষ্টি নাই। শীতও নাই, গরমও নাই। খাওয়ার সময় বাদে আমরা সারাদিন থাকতাম আখড়ায়। মন্দিরের সামনে বাঁশের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে শুধু চেয়ে চেয়ে মুর্তিগুলা দেখতাম। দুর্গাদেবী দশ হাতে নানান জাতের দশটা অস্ত্র নিয়ে কী করতে চায়? অসুরের বুক থেকে কেন রক্ত ঝরছে?

আমাদের বয়সী সাথের হিন্দু বন্ধুরা বেশ পণ্ডিতিচালে তাদের সাধ্যমতো বুঝিয়ে দিত। তাতে আগ্রহ ও আমোদ দুইটাই বেড়ে গেল। এত ছোট বয়সে রাতে বাইরে যাওয়ার কোনো পথ না পেয়ে, আমি মাত্র ছয়-সাত বছর বয়সে চুরি করে পূজায় যাওয়ার পথ আবিষ্কার করেছিলাম। ছোট বলে আমি ঘুমাতাম মায়ের পাশে। শিথানে খোলা জানালা। অষ্টমীর চাঁদের আলোয় দুনিয়া ভেসে যাচ্ছে! আখড়ামণ্ডপের সামনে আরতির বাজনা বাজছে! ঢাকের দ্রিমদ্রিম শব্দ আমার ছোট্ট বুকে ঝড় তুলছে।

খুব সাবধানে আমি মায়ের পাশ থেকে উঠে পড়ি। সংসার নিয়ে সারাদিন মায়ের হন্তদন্তর শেষ নাই তাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি জানালার শিক ধরে দক্ষিণের দিকে তাকিয়ে আছি। ফটফটা জোছনায় দুনিয়াটা ভেসে যাচ্ছে, ঢাকের শব্দে বুঝি উড়াল দিতে চাইছে! আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করছে জানালার শিকগুলা ভেঙে ফেলি।

জানালাটা পুরাতন। শিকগুলার গোড়া জঙ্গারে খেয়ে ফেলেছে। অভিমানে আমি একটা শিকে মোচড় দিতেই উপরের মাথা থেকে ঝুরঝুর করে জঙ্গারের গুড়া পড়ে! আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। আমি আরো জোরে মুচড়াতে মুচড়াতে একটা শিক খুলেই ফেলি। তারপর খুব আস্তে আমার ছোট্ট দেহটা দুই শিকের মাঝের ফাঁকটুকু দিয়ে গলিয়ে দেই।

বাড়ির সামনের খলা পেরিয়ে রাস্তায় নামতেই বাঁ-দিকে দাদির কবর। আমার বুকটা ধড়াস করে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। ভয়ে সারা শরীর বারকয় শিউরে উঠে একদম ঠাণ্ডা হয়ে আসছে! অইদিকে ঢাকের শব্দ থেমে গিয়ে আখড়ায় কন্সার্ট শুরু হয়েছে। রূপবান! সকাল থেকে অনেকের মুখেই শুনেছি আজ আখড়ায় রূপবানগান হবে। বিকালে বন্ধুদের সাথে গিয়ে মঞ্চ, গ্রিনরুম সব ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছি। আমাদের রাখাল ছেলেটার সাথে বসে গফুর বাদশার পালাগান দেখেছি, আলোমতিপ্রেমকুমারের পালাও দেখেছি কিন্তু দেখা হয়নি রূপবান। পাড়ার অনেকের মুখে শুনেছি, ‘আমগর বাড়ির দক্ষিণ ধারে গ, অ ধাইমা কিসের বাদ্য বাজে’ গানটা গাইতে। এইটাই রূপবানের গান। বারো বছরের রূপবান নাকি বারোদিনের রহিম বাদশাকে বিয়ে করে বনবাসে চলে যায়! হায়, আমি যদি রহিম বাদশা হয়ে যেতাম! তাহলে তো রূপবান আমাকে কোলে নিয়ে গহীন বনে হাঁটত।

দর্শকরা নাকি রূপবানের দুঃখে জারে জারে কাঁদে। আজ সেই রূপবানের পালা! দেখতেই হবে। ছোট হউক বড় হউক না-পাওয়াকে পাওয়ার স্বপ্নই মানুষের সবচে বড় সম্বল। আমিও শরীর-মনের সব শক্তি দিয়ে দিলাম এক দৌড়।

আমাদের ঘরের জানালার অই ফাঁকটুকু ছিল বাইরের বিশাল পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের সহজ ও নিরাপদ পথ। এই পথটা আমার সারাটা কৈশোরের আনন্দযাত্রার সুড়ঙ্গপথ ছিল।

 মানুষের জীবনে শৈশব হলো ভিত্তি। সুস্থ চিন্তার একজন রুচিবান মানুষের সমস্ত মানবিক গুণাবলির বুনিয়াদি পত্তন হয় শৈশবেই। আমারও সুখ-দুঃখ, সহমর্মিতা ও ভালোবাসার শেকড়বাকড় মাটির গভীরতা খুঁজে পেয়েছিল পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কয়েকজনের সাথে। তাদের সাথে অসংখ্য মধুর স্মৃতি আমাকে মাঝে মাঝে তাড়া করে।

আমাদের মাঝে বাচ্চু ছিল সবচে দুরন্ত। মাথার চুলগুলা একটু লম্বা লম্বা শ্যামলা চেহারার বাচ্চুর হালকা-পাতলা শরীরটা বাতাসের আগে ছুটত। গোল্লাছুট খেলায় কিংবা মার্বেল খেলায় তার সাথে পেরে উঠতাম না। বোশেখ মাস আসলেই আমরা গলাগলি করে কান্দিগ্রামের কামারবাড়ি চলে যেতাম আমকাটার ছোট্ট দা বানানোর জন্য। তারপর থেকেই হাফপেন্টের এক পকেটে আমকাটার দা আরেক পকেটে কাগজে জাড়ানো লবণ। বাচ্চু ছিল চরম কাণ্ডা। সব খেলাতেই সে কাণ্ডামি করে আমাকে ঠকাবে। তো একদিন রাগ করে বাচ্চুকে কয়টা কিল মেরেছিলাম। শেষ কিলটা ছিল সবচে জোরালো এবং মেরেও ছিলাম পিঠে। বাচ্চু ‘অ বাবা রে…’ বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছিল। এখন হঠাৎ করে কোনোদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে এবং যদি আর সহজে ঘুম না আসে তাহলে নানান ভাবনা ভাবতে ভাবতে একসময় আমার দেশত্যাগী বন্ধুদের কথা ভাবি। একে একে সবগুলা মুখ মনে পড়ে। জানি সহজে আর ঘুম আসবে না। তাই আমি বিছানা ছেড়ে টেবিলে বসে কবিতা লিখতে চেষ্টা করি। এইভাবে ভারতে চলে যাওয়া আমার প্রত্যেক বন্ধুর নামে আলাদা আলাদা কবিতা আছে। আবার সবাইকে নিয়ে লেখা দীর্ঘ কবিতা আছে বেশ কয়টা। যেখানে শুধু আমার হাহাকার! হাহাকার! তাই আমি সার্বজনীন দুর্গাপূজা দেখতে যাই না আজ বহু বছর। বাবা কালি, বাচ্চু, প্রদীপ, শিউলি, মীরারা যদি কোনো কারণে মরে যেত তাহলে হয়তো তাদের স্মৃতি আমার কাছে এতটা কষ্টের হতো না। কিন্তু তারা দেশত্যাগী হয়ে আমার ছোট্ট আর পাঙসা জীবনটার মাঝে একটা দুঃখের কালো তিল হয়ে আজো জেগে আছে। তাই শারদীয় উৎসবের ঢাকের শব্দ আমার কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটার মতো।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you