গভীর নির্জন পথে, হে পথিক, তিষ্ঠ ক্ষণকাল!

গভীর নির্জন পথে, হে পথিক, তিষ্ঠ ক্ষণকাল!

অল্প কয়েকটি বই পৃথিবীতে সবসময়ই থাকে, যেগুলো পুনঃপুনঃ পড়া যায়। এমন নয় যে সেইসব বই লিস্টি করলে এক-দুইটা বই সবার ক্ষেত্রে সমান পাঠপ্রিয় বলে বিবেচিত হবে। একেকজনের ক্ষেত্রে এমন বইতালিকা একেকরকম হবে। সেইটাই স্বাভাবিক। তবে এইটাও ঠিক যে, যে-বইটা আমার কাছে এমন পুনঃপুনঃপাঠেও সমান অম্লান ও প্রিয়, মনে হয় সেটা আমার পাড়াপড়শীকেও পড়াই, নিশ্চয় তাদেরও পছন্দের কাতারে স্থান করে নেবে বইটা! তা না-ও হতে পারে অবশ্য, হয়ও খুব কম, স্বাভাবিক। তবে এমন বইলিস্ট যার যার তার তার, প্রত্যেকের একেকটা, আলাদা আলাদা। আপনার যেমন আছে, তেমনি আমারও। ‘গভীর নির্জন পথে’, লেখক সুধীর চক্রবর্তী, তেমনই বই একটা, যা আমি ফিরে ফিরে পড়ি, বিগত দুই দশকেরও বেশিদিন ধরে পড়ে চলেছি, যে-কোনো সময় যে-কোনো অধ্যায় থেকে পড়া যায়, পড়লে শান্তি হয়, যাকে বলে চিত্ত প্রশান্ত হয়ে আসে। এখন তো বই বাইর করা স্ট্যাটাস-সিম্বল কিংবা সামাজিক জাহিরিপনা, গুটিকয় আছে এর বাইরে, খালি কিছু বই মাঝেমধ্যে মেলে যেইগুলা পড়ে একটু হলেও বইলেখালেখির সাংস্কৃতিক ষণ্ডামি নিয়া সংকোচ হয়। এই বইটা হচ্ছে তেমন বই যা পড়ে মনে হয় কী হবে এত বইটই লিখেটিখে? এমন একটা বই একটু সুস্থির পড়লেই তো হয়। এই বইটা, আরও কয়েকটা আছে এমন অভিজ্ঞতাভুক্ত আমার, বারবার পড়বার মতো। গদ্য স্বাদু ও বয়ানভঙ্গি মৃদু তরঙ্গস্নিগ্ধ। বয়ান, তথা নানা বিষয়ের ইন্টার্প্রিটেশন, অভিনব সুন্দর। লোকধর্মের বহুকিছু সম্পর্কে এমনধারা প্রাঞ্জল রচনাগুচ্ছ বিরল। প্রথমবার পড়ার সময় মনে হয়েছিল, না, মানুষের সঙ্গে কথা বলার পরিসর ও প্রাণ না-থাকলে খুব বেশিকিছু, খুব বড়কিছু, কোনোদিন লেখা যাবে না। আজও অপরিবর্তিতভাবে তা-ই মনে করি। কী দুর্দান্ত সব তফসির-ইন্টার্প্রিটেশন তুলে আনা যায় সাধারণ মানুষের মুখ থেকে! এই ঝকমারি দুনিয়াদারি সম্পর্কে গূঢ় কত জটিলতার হৃদয়সাধ্য-মননবোধ্য সমাধান! কী অতুলনীয় দর্শন, তত্ত্বকথা, আর তালগোলপাকানো গোলকধাঁধার মাঝখান চিরে বের-করা তালশাঁস, জীবনগভীরতা! তার মানে এ-ও নয় যে, বিষয়বৈগুণ্যে এই বই একমেবাদ্বিতীয়ম্। তবে এইটা জানা থাকা চাই যে, এই বইটার আনন্দ পাব্লিশার্স কর্তৃক প্রথম সংস্করণ প্রকাশ ১৯৮৯ সন, তখন পর্যন্ত সহজিয়া বাউল-ফকির মানুষদের জীবনচর্যা নিয়া অনেক বই বাজারে থাকলেও ঠিক এমন বই ছিল না। মানে, এতদিন, এ-ধারার বইগুলো সবই ছিল পদ্ধতিগত গবেষণাপূর্বক প্রণীত গ্রন্থ। ওরেব্বাবা! শ্বাস আটকায়া যায় এমনিতেই। কিন্তু সুধীর চক্রবর্তীর লেখাপত্র, শুধু এই বই-ই নয় তাঁর — এছাড়াও অন্যান্য সমস্ত — অতি জীবন্ত কিছু, অথবা সামথিং অধিক দ্যান দ্যাট। ধরেছেন তিনি এমনকিছু মনুষ্যজীবন তাঁর এই এবং অন্যান্য বইতে, যার কোনো আর্কিটাইপ নেই। ডিফ্রেন্ট স্টাইল নিয়ে এলেন তিনি, রীতিকৃত্যগীতে একদম অন্যরকম ও অনন্য অন্ত্যজ এই মানুষগোষ্ঠী ও তাদের প্রান্তীয় জনপদের জীবনধর্মযাত্রা ধারণের কাজে, এবং এই শৈলী ক্রমশ একসময় স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়াতে লাগল। লোকধর্মের লজিকগুলো সবটাই-যে গানে গাঁথা, পানির ন্যায় ক্লিয়ার এই কথাটা আমি হৃদয়ঙ্গম করেছিলাম এই বইখানা পাঠোত্তর। বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের কোনো দর্শন নাই বলে একটা প্রচার চালু আছে, এক্কেরে মিথপ্রতীম সেই প্রচার, এবং ভুল-ইংরেজিতে-কথা-বলিয়ে সেইসব বর্বর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ভদ্রলোকসমাজের প্রোপাগ্যান্ডায় বাংলা বেসামাল। অথচ দর্শনের বাপদাদা বসে আছে যুগ-যুগান্ত ধরে এইসব সহুজে গানে, সুফি-বৈষ্ণব-নাথ-উদাসীদের মর্মরহস্যসুরে। এইসব কথা আমি ভাবতে পেরেছিনু সুধীর চক্রবর্তীর সৌজন্যে। এবং শুরু হয়েছিল ‘গভীর নির্জন পথে’ দিয়া আমাদের পারস্পরিক আলাপ শুরু। খোদ সুধীরবাবু আউলবাউল নিয়া জীবনভর লিখেছেন, লিখে আজও চলেছেন, তবু ‘গভীর নির্জন পথে’ তাঁর শীর্ষগ্রন্থ, বলব আমি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তবু জ্ঞানার্জন নয়, এহেন অর্জন এখন হরেদরে গ্যুগল টিপলেই বেরোয়, সেজন্য বই পড়া লাগে না; — আনন্দের জন্য, যখন-তখন মনটা বাগে আনতে, ভেগে-যাওয়া মানুষের মতি ঘোরাতে, এলোথেলো হৃদয় একজায়গায় জড়ো করতে, এই বই তুলনাহীনা।

লেখা / জাহেদ আহমদ ২০১৩

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you