হ্যারি দ্য ক্যালিপ্সোসম্রাট

হ্যারি দ্য ক্যালিপ্সোসম্রাট

খুব-একটা জানাবার কিছু নাই যা বাজারের কেউ জানে না। হ্যারি বেলাফন্টেকে চেনে না, বাংলায় এমন গানশ্রোতা অ্যাক্সিডেন্ট্যালি মিলতে পারে। হ্যারির গান শুনে কেউ পণ্ডিতমার্কা আলাপ তুলবে, এমন গণ্ডমূর্খ পণ্ডিত মহাবিশ্বে বিরল। হ্যারির গান শুনে কেউ মহাসমুজদারের ভঙ্গিতে হ্যারিকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে, এমন মদন সমুজদার সম্ভবত খুব বেশি মিলবে না আল্লার দুনিয়ায়। হ্যারির গান পুরাটা না শুনে কেউ কান ফেরাতে পারে না অন্যদিকে। ক্যালিপ্সোমুদ্রার সংক্রামক বৈশিষ্ট্য এত প্রবল যে এর আওতায় কেউ শরীর স্থাণু করে রাখতে পারে না। হ্যারি বেলাফন্টে এভারগ্রিন ক্যালিপ্সোকিং।

উইকিপিডিয়ায় হ্যারি সম্পর্কে যে-তথ্যাবলি আছে, একজন ব্যক্তি সম্পর্কে জানার এরচেয়ে বেশি কিছু তো থাকতে পারে না। হাজার হাজার অনলাইন সোর্স থেকে হ্যারি সম্পর্কে জেনে নেয়া যায়। হ্যারির অফিশিয়্যাল ওয়েবসাইট তো রইলই। মিউজিশিয়্যানের লাইফস্টোরি জানতে চাইলে এমন অজস্র সূত্র গ্যুগল্ করে নেয়া যায়। কিন্তু কেউ যদি হ্যারির কাজ সম্পর্কে একটা আন্দাজ করতে চায়? রাস্তা একটাই, গান শোনা। হ্যারির গান সংখ্যায় প্রচুর। স্টুডিয়োরেকর্ড অ্যালবাম আছে তিরিশটার মতো। ডিস্কোগ্র্যাফির হিসাব খতিয়ানে দেখলাম গুনে গুনে। এছাড়া আরও আছে সিঙ্গেলস্, কোলাবোরেশন, লাইভ অ্যালবাম ইত্যাদি।

কিন্তু কোথায় শোনা যায় হ্যারির গান? আশ্চর্য! এই প্রশ্নও শুনতে হলো? সমস্তই উন্মুক্ত বর্তমান প্রযুক্তিস্ফীত দুনিয়ায়। ইউটিউবে বেশিরভাগ গানই অ্যাভেইলেবল। সর্বসাধারণের জন্যে এরচেয়ে সোজাসাপ্টা লোকেশন আর নাই। ফ্রি এবং ইজি অ্যাক্সেসিবল। এছাড়া আরও লোকেশন আছে, পে-অ্যাক্সেস তো সবসময় রিলায়েবল। অ্যানিওয়ে।

হ্যারি বেলাফন্টের লগে আমার প্রথম পরিচয় হয় আজ থেকে আড়াইযুগ আগে একটা বাংলাদেশি ব্যান্ডের মধ্যস্থতায়। এক্স্যাক্ট সন-তারিখ বলতে পারব না আমাদের ফার্স্ট মিটিঙের, তবে সে-বছর ‘সোলস’ ব্যান্ডের একটা অ্যালবাম বেরিয়েছিল যেখানে নাসিম আলী খান একটা গান গেয়েছিলেন হ্যারির ‘জ্যামাইকা ফেয়ারোয়েল’ অবলম্বনে। বাংলা গানটায় কেবল ক্যালিপ্সো নর্তনমুদ্রার আবহ ও অরিজিন্যাল সুরটাকে ক্যাপ্চার করা হয়েছিল। মূল গানটার কথাগুলো এই তর্জমাপ্রবাহের আওতায় বাংলা করা হয়েছে।

“সাগরের ওই প্রান্তরে / গিরিপর্বতচূড়ায় চাঁদ জাগে / জলপথে আমি দিই পাড়ি / ভিড়ি চাঁদজাগা ওই বন্দরে / চলেছি ব্যথার মন নিয়ে / ফিরব না অনেকদিনেও আমি / ভারী হৃদয় নিয়ে পিছু দেখি / ফেলে-আসা সেই মনটাকে / আনন্দ আর উল্লাসের ভিড়ে / দেখা আমার তার সাথে” … ইত্যাদি কথায় লতিয়ে বাংলায় জ্যামাইকা ফেয়ারোয়েল  গেয়েছিলেন নাসিম আলী খান। বলা বাহুল্য, মূল গানের বাপ-মেয়ের বিচ্ছেদব্যথাটা বাংলায় রাখা হয় নাই সোলসকম্পোজড গানটায়, তার পরিবর্তে প্রেমিক-প্রেমিকার বিচ্ছেদ-বিরহটাই উপজীব্য হয় বাংলায়। খারাপ হয় নাই তা বলে।

হ্যারির গানগুলোর বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত নজরকাড়া। গ্রামীণ একটা আবহ থাকে, প্রায়শ দরিদ্র মেহনতি মানুষের কথা বলে, একদম লোকায়ত মোটিফ গানগুলার, সমুদ্র ও সৈকতের ছবিনির্ভর দৃশ্যমালা, নারকেল আর দ্বীপদেশের নিসর্গ, কালো মানুষের মুখরতা, ভালোবাসা আর হাসাহাসির ভিতর চোরা দুঃখের হাল্কা আভাস। সবকিছুই থাকে একটা আশ্চর্য ফুর্তির বাতাসে ভাসা। মানুষের ফুর্তি। জীবনফুর্তি।

ঠিক সিঙ্গার-স্যংরাইটার ছিলেন না হ্যারি। নিজের গানগুলার জন্য গীতিকার ছিলেন নির্দিষ্ট কয়েকজন। এছাড়া ট্র্যাডিশন্যাল গান তো অনেক তুলেছেন গলায়। খালি ক্যালিপ্সো নয়, ক্যালিপ্সো ছাড়াও অন্যান্য অনেক জন্রায় হ্যারি গান গেয়েছেন। সেসব কথা আপাতত অবলা থাক। উইকিতালাশে যে-কেউ অনেক তথ্য পাবেন।

তবে হ্যারির গান সম্পর্কে একটা কথা না বলে এই বৈঠক থেকে বিদায় নিতে পারব না। হ্যারির গান শুধু শুনলে এক আনন্দ, আর চোখ দিয়ে দেখলে সেই আনন্দের পারদ তূরীয় অবস্থায় যায়। হ্যারির স্টেজকন্সার্টগুলো, স্টুডিয়োকন্সার্টগুলো, সমস্তই ইউটিউবে দেখা যায়। একটু টাইম নিয়া শান্তমনে লিস্নাররা ট্রাই করতে পারেন।

হ্যারি বেলাফন্টে সেই বিরল সিঙ্গারদের একজন যার গান দারাপুত্রপরিবার একলগে সোফায় বসে বা পালঙ্কে উল্টাপাল্টা আড়াআড়ি শুয়ে শোনা যায়। একটাই সমস্যা। নাচ কন্ট্রোল করে রাখা যায় না দীর্ঘক্ষণ। শরীর দুলে উঠবেই। কিন্তু এই দোলা পপরকের দোলা নয়। এইটা আলগ কিসিমের দোলা। আর খুব সহজেই রিদমটা চারায়া যায় শরীরে। একটা নার্সারিরাইমের স্বতঃস্ফূর্ত দোলা। হেডব্যাঙ্গিং নয়, বডিব্যাঙ্গিং বলা যায়। ফ্যামিলি ড্যান্সম্যুভ।

ক্যালিপ্সোসম্রাট বলা হলো রচনার শিরোনামে, বেশ বাংলা ভাবসাব বজায় রইল ফলে। যেমন আমরা বাউলসম্রাট বলি কাউরে আদর করে। এর মানে এ নয় যে ক্যালিপ্সো অন্য কেউ অতটা অ্যাডপ্ট করে নাই। ইংরেজি গানবাজনায় ক্যালিপ্সোধাঁচে অসংখ্য নামিদামি শিল্পী কাজ করেছেন। কান্ট্রিমিউজিকে ক্যালিপ্সো অত্যন্ত পরিচিত একটা ধারা। হ্যারি বেলাফন্টেকে কিং অফ ক্যালিপ্সো সম্বোধন করা হয় ইংরেজি মিউজিকের লিট্রেচারে। এবং সকলেই স্বীকার করেন তা প্রায় নিরাপত্তি।

তিনটা গানের বাংলা আমরা নিচে পড়তে পারব। পড়ার পাশাপাশি গানত্রয় শুনে নিতে পারি ইউটিউবে। সেজন্যে গানগুলার শিরোনামের বাংলা করা হয় নাই যাতে শিরোনাম ইংলিশে লিখে সার্চ দিয়া গানটা বার করা যায় সহজেই।

জ্যাম্যাইকা ফেয়ারোয়েল্
দূরদিগন্তে দীর্ঘ পথের শেষে
যেখানে রাত্রি চিরশোভাময় বেশে
এবং সূর্য বসে রয় যেথা পাহাড়ের শিরে টিপ
সেই বিদেশের নৌপথে আমি চলিয়াছি ভেসে ভেসে
পেছনে মুছিয়া যাইছে একটি বিষণ্ণ বদ্বীপ

আমারও হৃদয়ে বিষণ্ণ ঘন মেঘ
বহুদিন-বাড়ি-ফিরিব-না উদ্বেগ
দুঃখছোঁয়ায় দু-চোখ ব্যাকুল বর্ষার জলধারে
ফিরে ফিরে দেখি পিছনের পথরেখ
যাই ফেলে রেখে পেছনে আমার ছোট্ট মেয়েটারে

এদিকে জাহাজে ব্যাপক ফুর্তিফোয়ারা
নাচে থৈ থৈ নাবিকের সহকারিণী
হৃদয় আমার কান্নায় দিশাহারা
গাঢ় সমুদ্র যদিও আমার ঘরবাড়ি চিরদিনই

কী করে তাড়াই ভিতরের এই বিষণ্ণতার মেঘ
বহুদিন-বাড়ি-ফিরিব-না উদ্বেগ
দুঃখছোঁয়ায় দু-চোখ ব্যাকুল বর্ষার জলধারে
ফিরে ফিরে দেখি পিছনের পথরেখ
কত দূরে ফেলে এসেছি আমার ছোট্ট মেয়েটারে

ভিড়েছে জাহাজ বহুদূরে এক মাতোয়ারা বন্দরে
নেমে যেয়ে দেখি শিসে ও রভসে কেনাকাটি করে লোকে
তেল-নুন-চিনি-পিঁয়াজ সুলভ বেজায় শস্তা দরে
একেকটা পাঁইট পানির দামে কেনো মদ মহাসুখে

কেমন করিয়া ঝাড়ি বলো এই বিষণ্ণতার মেঘ
কতদিন-বাড়ি-ফিরিব-না উদ্বেগ
দুঃখছোঁয়ায় দু-চোখ ব্যাকুল বর্ষার জলধারে
ফিরে ফিরে দেখি পিছনের পথরেখ
বহু দূরে ফেলে এসেছি আমার ছোট্ট মেয়েটারে

.
.

উইল্ হিজ্ ল্যভ বি লাইক্ হিজ্ রাম্?
হবে নাকি প্রেম তার রাঙা গাঢ় মদ?
হবে নিশ্চয়, হবে নিশ্চয়
রাতভর দিনভর তাগড়া মরদ?
নহে সংশয়, নহে সংশয়

এসো করি দুইহাত তুলে মুনাজাত
খোর্মা-খাজুর খেয়ে দোয়া করি এসো
বর-কনে দুজনের এক করি হাত
বলি ভাই চিরদিন দোঁহে ভালোবেসো

কবে যেন দুজনার দেখা হয়েছিল?
ভরা বর্ষায়, ভরা বর্ষায়
কবে হলো বিনিময় অঙ্গুরীয়?
চৈত্রহাওয়ায়, চৈত্রহাওয়ায়

নারীটি কি নিখিলের সেরা রাঁধুনি?
নিশ্চয় তাই, নিশ্চয় তাই
প্রিয় পুরুষেরে পেটে পটাবে কি শুনি?
সন্দেহ নাই, সন্দেহ নাই

হবে সে কি সাধ্বী ও সংসারপ্রিয়?
হবে তো বটেই, হবে তো বটেই
রাখিবে পতির মন শ্রমে সক্রিয়?
অন-আয়াসেই, অন-আয়াসেই

বিবাহবাসরে তবে উল্লাস কই?
ধিতাং-ধিতাং, ধিতাং-ধিতাং
পোলাও-কোর্মা খাই করি হৈচৈ
পিং-পং-পাং, পিং-পং-পাং

.
.

কিংস্টন্ মার্কেট
দেখেছ কখনো দিগন্তে রংধনু?
অথবা বাগিচা পুষ্পপল্লবিত?
কোদালের কোপে কীর্ণ শস্যতনু
মজুরের গানে শাবল উত্তোলিত?

চলো চলো যাই দেখে আসি সব্বাই
ব্রিজের কিনারে প্রাণের রঙবাহার
ভবের মেলায় দিলখোলা দেখে যাই
মিলনের সুরে ধন্যি মিনাবাজার

দরকারি তরিতরকারি নিয়া নাও
সতেজ সূর্যালোকিত সব্জি-ফল
তরতাজা মাছ রাতামুর্গার ছাও
থলে ভরে নাও করোলা ও কাকরোল

চলো চলো যাই দেখে আসি সব্বাই
ব্রিজের কিনারে প্রাণের রঙবাহার
ভবের মেলায় দিলখোলা দেখে যাই
মিলনের সুরে ধন্যি মিনাবাজার

পথ দিয়া যায় গাঁয়ের তরুণী হেঁটে
রঙচটা জামা হাসিখুশি উজ্জ্বল
জলঝর্ণার ধ্বনি আর ধুলো ঘেঁটে
দয়িতার দেহে দোয়েলের শোরবোল

চলো চলো যাই দেখে আসি সব্বাই
ব্রিজের কিনারে প্রাণের রঙবাহার
ভবের মেলায় দিলখোলা দেখে যাই
মিলনের সুরে ধন্যি মিনাবাজার

শুনেছ কখনো বটপাকুড়ের গল্প?
অথবা কিচ্ছা মামদোভুতের কান্না?
ভোরবেলাকার দেখেছ চিত্রকল্প?
খেয়েছ কখনো গঞ্জের হাটে রান্না?

চলো চলো যাই দেখে আসি সব্বাই
ব্রিজের কিনারে প্রাণের রঙবাহার
ভবের মেলায় দিলখোলা দেখে যাই
মিলনের সুরে ধন্যি মিনাবাজার


ভূমিকা ও তর্জমা : জাহেদ আহমদ

বব ডিলান কুড়িটা গান ১
বব ডিলান কুড়িটা গান ২
কুড়িটা গানে বব মার্লি 
বারোটা গানে লেনার্ড কোহেন
জন ডেনভার পাঁচটা গান
জন লেনন দুই ডজন
জন লেনন হাফ ডজন 

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you