সকল গানের ওপারে  || আহমদ মিনহাজ

সকল গানের ওপারে || আহমদ মিনহাজ

পুত্র আলী আকবর খান অথবা শিষ্য রবিশঙ্কর নয়, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ’র সুরের আশিস পেয়েছিলেন কন্যা রওশন আরা বেগম। ওস্তাদ আমির খান যেমন মানছেন — সেতারে রবিশঙ্কর এবং সরোদে আলী আকবর খানের শানদার বাদন ক্ষণিক দিশা হারায় যখন আলাউদ্দিনদুহিতার চম্পক আঙুল সুরবাহারে বেজে উঠত রাগ খাম্বাজ কিংবা কৌশিকী। বাবা আলাউদ্দিন যেন ছায়া হয়ে মিশে থাকতেন কন্যায়; বীণাপাণি যখন ঝঙ্কার তুলতেন সেতারের সহোদর বলে খ্যাত সুরবাহারে।

বহুযন্ত্রী আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন সুরের বিশ্বকর্মা। আঙুলের অনায়াস টানে বেজে উঠতেন সেতার, সরোদ, বেহালা, এস্রাজ ও সুরবাহারে। সরোদের চকিত আরোহন স্মরণ করিয়ে দিত,-কান পেতে যে শুনেছে কী করে শিশির শব্দ করে ঝরে রাতে, চোখ বুজলে যে টের পায় দূর দিগন্তে অমল-ধবল হাওয়ায় পাল তুলেছে শরতের ছিন্ন মেঘমালা, মন যার আকুল হয়েছে বেদনায় যখন চরাচর লুপ্ত করে যেন বিসমিল্লা খাঁ’র সানাইয়ে বিধুর দিবাকর অস্ত গেছে দিকচক্রবালে, — তার কাছে বাদ্যযন্ত্র বাহন মাত্র হয়, সে আসলে সংবেদী আপন মনের অনুভবে। আলাউদ্দিন খাঁ অনুভবের সম্রাট, হয়তো পণ করেছিলেন কন্যার মধ্যে রেখে যাবেন এ-জীবনের জমানো সকল সুরবাহার।

পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাঁধার ক্ষণে রওশন আরা বেগম অন্নপূর্ণা দেবী হয়েছিলেন বাবার ইশারায়। নৃত্যগুরু উদয়শঙ্কর চাইছিলেন ছোটভাই রবির সঙ্গে আলাউদ্দিনদুহিতা জুড়ি বাঁধুক। উদয়শঙ্করের ইচ্ছায় সায় দিয়ে শিষ্যের কাছে সুরবাহারে সরস্বতীকে সম্প্রদানের ক্ষণে ঈর্ষার দেবী করুণ হেসে আলাহিয়া বিলাবলের কোমল নিষাদে ঈষৎ বক্র হয়েছিলেন সেদিন। পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণার মধ্যে প্রণয়ের আভাস আলাউদ্দিন খাঁ টের পেয়েছিলেন কি না সে এখন জানার উপায় নেই। প্রজাপতির নিবন্ধন তাঁর কাছে হয়তো দুই যন্ত্রীর যুগলবন্দি হয়ে ধরা দিয়েছিল। শিষ্যের সঙ্গে কন্যার জুটি সেতার ও সুরবাহারকে একতারে বাঁধবে, হরগৌরি হয়ে ওরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে ব্যাকুল থাকবে চিরকাল, সুরসম্রাটের মনে সে-আশা উঁকি দিয়েছিল সেদিন। রাগমালার আত্মকথনে পণ্ডিতজি অবশ্য জানাচ্ছেন তাঁর জীবনে অন্নপূর্ণা দেখা দিয়েছিলেন দুর্বিপাক হিসেবে। বাবার সম্মুখে বসে একসঙ্গে বাজালেও ওকে দেখে প্রেমের চোরাটান তার মনে নাকি কখনও জাগেনি। পণ্ডিতজির কথা সত্য হলে মানতে হয় দুজনের বিবাহ-বন্ধন ছিল আকস্মিক। অগ্রজ উদয়শঙ্কর আর খেয়ালি গুরু আলাউদ্দিন খাঁ’র ইশারায় রবিশঙ্কর সেদিন বাধ্য হয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন সুরবাহারে সাক্ষাৎ বীণাপাণি রওশন আরাকে অন্নপূর্ণা নামে সাতপাকে বেঁধে নিতে।

অন্নপূর্ণা পিতার ছায়া ছিলেন বটে! বাবার মেজাজ পেয়েছিলেন। খেয়ালি কন্যা নিজের মর্জিমাফিক যখন-তখন বেজে উঠতেন সেতার ও সুরবাহারে। স্বরসপ্তকের শুদ্ধ বাদনে ছিলেন পিতার মতোই আপসহীন আর সুরবাহারে রাগ বাজানোর ক্ষণে ধ্যানী ঋষি। এহেন সুরের সাধিকা আলাউদ্দিন খাঁ’র প্রিয় শিষ্যের সঙ্গে জুটি বাঁধবার ক্ষণে হয়তো অন্যকিছু চেয়েছিলেন। সেতারিয়া রবিশঙ্করের সঙ্গে তাল দিয়ে ইমন কল্যাণ রাগের শুদ্ধ নিষাদে বেজে উঠলেও মনে-মনে চাইতেন পণ্ডিতজি তাকে বাজাক ভালোবাসার ভুলচুকভরা এক কোমল নিষাদে। রাগমালার বিবৃতি সঠিক হলে বহু রমণীর সান্নিধ্যে স্বচ্ছন্দ রবিশঙ্করের মনে অন্নপূর্ণার জন্য প্রেম ছিল না মানতে হয়; যদিও মনে-মনে ঠিক জানতেন, অন্নপূর্ণা যখন সুরবাহারে বাদন তোলে তখন অচিন বৃক্ষের ডালে বসা পাখি উড়ে যায় দূর দিগন্তে আর প্রেম হয়ে ওঠে অনুক্ত প্রতীক্ষার নাম। প্রতীক্ষা তার জন্য যে দাঁড়িয়ে থাকে সকল ‘গানের ওপারে’। এই প্রতীক্ষার নাম ঈর্ষাও দেয়া যেতে পারত। অন্নপূর্ণার প্রেমে জখম হওয়ার চেয়ে রবিশঙ্কর ঈর্ষার কাঁটায় বিদ্ধ হতেন ভেবে, ওর আঙুল কেমন অনায়াস ডানা ঝাপটায় ভোর ও রাত্রির রাগমালায়। সহোদর আলী আকবর খান অকপটে উক্তি করেছেন, — ‘বাবার এমনকিছু রাগ ও বাজাতে পারত যেটা আমি বা অন্য শিষ্যরা কখনও ঠিকঠাক রপ্ত করে উঠতে পারিনি। ওর মধ্যে বাবার ঐশ্বর্য ভর করেছিল।’ ওস্তাদ আমির খান তো রাখঢাক না করেই বলে গেছেন, ‘অন্নপূর্ণা দেবীর মধ্যে আলাউদ্দিন খাঁর প্রতিভার আশি ভাগ ভর করেছিল, সত্তুর ভাগ পেয়েছিলেন আলী আকবর খান, আর রবিশঙ্কর মেরেকেটে চল্লিশ ভাগ।’

অনুমান অসঙ্গত নয়, রবিশঙ্কর যুগপৎ মুগ্ধ ও ভীত ছিলেন খেয়ালি অন্নপূর্ণার লয়দার বাদনে, যে-বাদন শুনে মনে হয় আলাউদ্দিন খাঁ মঞ্চে ফিরে এসেছেন কর্নাটকি রাগ-রাগিণীতে নিজের কেরামতি দেখাতে; বাগেশ্রী ও মালকোষ অঙ্গের স্বরসপ্তক একত্রে জুড়ে লয় তুলছেন রাগ কৌশিকীর মীড় ও গমকে; যেন পণ করেছেন কর্নাটকি আধ্যাত্মিক সংগীতের অন্যতম পুরোধা শ্যামা শাস্ত্রীর হাতে নবজীবন পাওয়া আনন্দভৈরবী রাগে যে সদা সচ্চিদানন্দ ভাব সর্বদা তরঙ্গ খেলে তাকে ধরবেন সরোদে। অন্নপূর্ণার সুরেলা বাদনের সম্মোহনে বিচলিত রবিশঙ্কর ভীত ছিলেন সেই প্রতিদ্বন্ধীর কথা ভেবে যে সুরবাহার হাতে নিলে অচিন্ত্যনীয় অনুভবের রস চুইয়ে পড়ে রুক্ষ প্রান্তরে, যে তাকে পরাভূত করার শক্তি ধরে হাতের কোমল আঙুলে। অন্নপূর্ণা সে-প্রমাণ বহুবার রেখেছেন পরে। নিখিল ব্যানার্জি, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ও বসন্ত কাবরার মতো গুণী শিল্পীদের শিখিয়ে-পড়িয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বাবার হয়ে। গৃহকর্মে ছিলেন সুনিপুণ। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ সব করেছেন নিজ হাতে। রান্নাবান্না কিংবা ঘর ধোয়া-মোছার কাজের মধ্যেও শিষ্য ভুল সুরে রেওয়াজ করছে শুনলে চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘বসন্ত, তুমি কিন্তু বেসুরা গাইছ, নিষাদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি না কেন?’ সুরের স্বর্গধামে বসে পিতা নির্ঘাৎ প্রসন্ন হতেন মেজাজি কন্যার এহেন তিরস্কারে। মেজাজি এই তিরস্কার সহ্য করে শিল্পী স্বর্ণবণিক হয় আর সংগীত ব্রহ্মবিদ্যায় নিজের অংশ কলায়। রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খান সে-পাঠ নিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দিনের সান্নিধ্যে। শিষ্যের জন্য এই তিরস্কার হচ্ছে সেই আশিস যার কল্যাণে মনের সকল দ্বিধা ও দূরত্ব ঘুচে যায়; পুরুষ ও প্রকৃতি অভিন্ন সুর তোলে হৃদয়ে; আর সংগীত হয়ে ওঠে স্বরব্রহ্ম, যে নিনাদিত করে মিলন, যার নাম হচ্ছে ‘প্রেম’। আলাউদ্দিন খাঁর ইশারায় রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণা সুরের ইন্দ্রজালে হরগৌরি হয়েছিলেন কিন্তু সংসারের ইন্দ্রজালে দুজনেই বেসুরো স্বরে সঙ্গত করে গেলেন জীবনভর।

আলাউদ্দিন খাঁ নিজের জীবনে সংসার ও সংগীতের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে পেরেছিলেন। যে-হাতে বাজার করতেন সেই হাতে সরোদ বা বেহালায় মরুবেহাগের রাগিণী জুড়েছেন ক্ষণিক পরে। নিয়মমাফিক নামাজ সেরে সরোদ হাতে নিয়েছেন দেবগিরি বিলাওলের মধুর সুরে জগদীশ্বরে একীভূত হওয়ার বাসনায়। সুরের খেয়ালি টান অনায়াস ঘুচিয়ে দিয়েছে সংসারপাঁকে নিমজ্জিত মনের মলিনতা ও দূরত্ব। সরোদ, বেহালা কিংবা সুরশৃঙ্গার হাতে আলাউদ্দিন খাঁ সুরসুন্দরম, সুন্দরের ধ্যানে মগ্ন ঋষি। ঋত্বিক ঘটক সেই অভিজ্ঞতার বয়ান রেখে গেছেন সেলুলয়েডের ফিতায়। খাঁ সাহেবকে ধারণ করতে ছুটে গিয়েছিলেন মাইহার। জানতে চেয়েছিলেন সংগীত কেমন করে প্রকৃতির সঙ্গে অভিন্ন করে নিজেকে, রাগ-রাগিণীর তানালাপে ব্রহ্মাণ্ড কী করে বিলীন হয় ব্রহ্মে। আলাউদ্দিন খাঁ সেদিন চকিত হাতে তুলে নিয়েছিলেন ভায়োলিন। খেয়ালখুশির লাগাম তুলে ছড় টানছেন বয়োবৃদ্ধ অগ্রজ ফুলঝুরি খানের সম্মুখে আর সেটা দেখে বসন্তের ফল্গুধারা বইছে ওস্তাদজির হৃদয়ে, হাসির ছটায় ঝরে পড়ছে অনুজের প্রতি অনুক্ত ভালোবাসা। এই ভালোবাসার নাম সংগীত, এর অর্থ অনুক্ত সেই রাগিণী যার টানে যুবক আলাউদ্দিন মুক্তাগাছার জমিদারবাড়ি থেকে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতা, সেখান থেকে সুদূর মাইহার। তবলায় অশেষ পারদর্শী ছিলেন, যেমন অনায়াস সিদ্ধি ছিল সেতার, সরোদ, বেহালা, এস্রাজ সহ রকমারি যন্ত্রে। ওস্তাদ ওয়াজির খানের কাছে শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে মরিয়া হয়েছিলেন। ওয়াজির খান তাকে ফিরিয়ে দিলে আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়নি। মহারাজের হস্তক্ষেপে সেটা এড়ানো গিয়েছিল। মরিয়া শিষ্য গুরুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে সেই সুর শেখান যার টানে মনের সকল দূরত্ব ও মলিনতা ঘুচে যায়, রাম  ও রহিম  অভিন্ন হয় প্রেমে, হরি  ও আল্লা  একসুরে লয় তোলে ওমকারে,  দ্বিধা ও দূরত্বের প্রাচীর ঘুচে যায় জগতের সমুদয় বাদ্য ও বাদকের মধ্যে। সরোদ সেখানে নিজেকে অভিন্ন করে সেতারে, আর সেতার নিজেকে অভিন্ন হতে দেখে বেহালা, সুরবাহার আর এস্রাজে।’

কন্যার মধ্যে সুরের আকুতি তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন এভাবে; শুদ্ধ সংগীতের জন্য আপসহীন ভালোবাসার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন চপলা কিশোরীকে; কিন্তু যে-মানুষ এই সুরের কারিগর তাকে কেমন করে প্রেমশরে জখম করতে হয় সেই মন্ত্র অন্নপূর্ণার অজানাই থেকে গিয়েছিল। কন্যা কেবল শিখলেন তবলার মিঠে বোলের সঙ্গে তাল দিয়ে কী করে বাজতে হয় সেতারে, কেমন করে গম্ভীর নির্ঘোষ তুলতে হয় সুরশৃঙ্গার অথবা সুরবাহারে। সুরশৃঙ্গারে আলাউদ্দিন খাঁ সাক্ষাৎ ঈশ্বর। মনে হয় বড়ে গোলাম আলী খান ‘ওম’ ধ্বনির সারগাম জুড়েছেন সরোদের সহচর সুরশৃঙ্গারের মন্দ্র তারে, কিংবা ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’-এর ভজনে বিভোর পণ্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পলুস্কর দরদি আওয়াজ তুলছেন নিচুলয়ে বাঁধা ধ্রূপদ অঙ্গের রাগ-রাগিণীর সুরে। সুরব্রহ্ম আলাউদ্দিন খাঁ সুরের সঙ্গে সুরের বিবাহ ঘটালেন কিন্তু সকল সুর ছাপিয়ে প্রেমের যে অনুভব দুটি হৃদয়কে একীভূত করে সেই প্রেম রবিশঙ্করের মাঝে খুঁজে পেলেন না অন্নপূর্ণা। যে প্রেমপিপাসা আলাউদ্দিন খাঁর হৃদয়ে ঝরে পড়ত শিষ্যের সঙ্গে কন্যাকে সুরবাহারে বাজতে শুনে সেটা স্বর্গের চেয়ে দামি হলেও সংসারের বাসনাঘন যে প্রেম দুটি মানুষকে একত্রে বেঁচে থাকার ভরসা যোগায় সেই প্রেম অধরাই থেকে গিয়েছিল অন্নপূর্ণা দেবীর জীবনে!

রবির সঙ্গে দাম্পত্যের খুনসুটিভরা কলহে হরগৌরি হয়ে জীবননাট্যে সুর তুলতে পারলেন না আলাউদ্দিনদুহিতা। অসুস্থ পুত্র শুভকে ঘিরে দুজনের কলহ তখন চরমে উঠেছে। মেজাজি অন্নপূর্ণা অনাদর ও অবহেলার অভিযোগে বিদ্ধ করলেন রবিকে, — ‘সংগীতের জন্য তুমি বিবাহে মত দিয়েছিলে। আমাকে ভালোবাসা তোমায় দিয়ে হওয়ার নয়!’ আলাউদ্দিন খাঁ কি টের পেয়েছিলেন কোথাও বেসুরো কিছু ঘটছে দুজনের জীবনে? নাকি স্বভাবখেয়ালে সুরশৃঙ্গার হাতে তুলে নিয়েছিলেন নট বেহাগে বিবাগী বিরহের স্বর জুড়বেন বলে? মাইহারের মহারাজা বড় তন্ময় হয়ে শুনতেন এই বিবাগী নির্ঘোষ, আলাউদ্দিন খাঁ যখন সুরশৃঙ্গার হাতে ধ্যানী হতেন নট বেহাগে।

রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণার একমাত্র সন্তান শুভেন্দ্র সরকার ওরফে শুভ শরীরে দুরারোগ্য ত্রুটি নিয়ে জন্ম নিয়েছিল। চিকিৎসায় সেটা সারলেও অবুঝ শিশুটি সারারাত কাঁদত। রবিশঙ্কর তখন খ্যাতির সুবাসে ডুবে আছেন। সুনাম ধরে রাখতে কঠোর রেওয়াজি। দিনে দশ ঘণ্টা রেওয়াজ করছেন সেতারে। আর ছিঁচকাঁদুনে শিশুকে সামলানোর ধকলে ক্লান্ত অন্নপূর্ণার রেওয়াজে বসার ফুরসত ছিল না একপল। সুরের সাধনায় শিশুটি দেখা দিলো উৎপাত হয়ে। কলহের দেবী সেধে চড়াও হলেন বাধ সাধতে। সেই কলহ যেদিন থামল সেদিন রওশন আরা নামেই শুধু অন্নপূর্ণা, তিক্তস্মৃতির ভার নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন পিতৃগৃহে, আর রবিশঙ্করের জীবনে নিয়মমাফিক উঁকি দিতে শুরু করেছেন অন্য রমণীরা। অন্নপূর্ণার হয়তো জানার বাসনা ছিল কে সেই প্রেমিক যে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে সকল ‘গানের ওপারে’? কে সেই অচিন ঘাতক যার জন্য সংসারের যজ্ঞে নিজেকে বলি দিতে রমণী কুণ্ঠা বোধ করে না? কে সেই প্রেমিক পুরুষ যে আসবে বলে প্রতীক্ষায় ক্লান্ত রমণী পিতার হাজার বারণ সত্ত্বেও সুরবাহারে তরঙ্গ তোলার সহজ অভ্যাস ছাড়তে দ্বিধা করে না? উত্তর পাওয়ার জন্য সব ছাড়তে মরিয়া ছিলেন অন্নপূর্ণা; তার সঙ্গে যুগলবন্দি রবিশঙ্করের অস্বস্তির কারণ হচ্ছে টের পেয়ে পণ করলেন জনসমক্ষে রবির সঙ্গে কখনও বাজাবেন না। সেই পণ বিচ্ছেদের পর স্থায়ী রূপ নিয়েছিল। জেদি ও খেয়ালি অন্নপূর্ণা গৃহবন্দি করলেন নিজেকে। তার জন্য পড়ে রইল কেবল সুরবাহার, কেবল বাবার রেখে-যাওয়া শিষ্যদের শিখানোর ভার, আর সকল ‘গানের ওপারে’ যে দাঁড়িয়ে থাকে সেই প্রেমিক পুরুষের জন্য তিক্ত প্রতীক্ষা।

রবিশঙ্কর এই ধারণায় বদ্ধমূল হলেন অন্নপূর্ণা সুরের সরস্বতী হলেও ভালোবাসতে জানে না, তাই এত ঈর্ষা ওর মনে; এক বাতিকগ্রস্ত রমণী যে জানে না কী করে ভালোবাসতে হয়; তার সঙ্গে অন্য রমণীর নাম শুনলে যে রাগে ফেটে পড়ে; আর অন্নপূর্ণা বুঝে গেলেন পণ্ডিতজির সময় নেই তাকে ভালোবেসে কাছে টানার। কমলা শাস্ত্রীর জন্য সময় থাকলেও তাকে সময় দিতে তিনি অপারগ। তারা দুজন একে অন্যকে নিয়ে বিরক্ত ছিলেন বহুবছর। সেই বিরক্তি ঘুচল সুরের জাদুকর আলাউদ্দিন খাঁ সরোদ-বেহালা-সুরবাহার সব ফেলে রেখে চিরতরে চোখ বোজার কয়েক বছর আগে। রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খান তখন জগৎ মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন, আর অন্নপূর্ণা নামের অতলে হারিয়ে যাওয়া রওশন আরা নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন চিরতরে। তার জন্য পড়ে থাকল ঘরভর্তি বাবার অজস্র ছবি, ব্রোঞ্জের আবক্ষ মূর্তি, পোষা পায়রা আর সেইসব শিষ্য যারা বিশ্বাস করতেন একমাত্র অন্নপূর্ণা পারেন বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র মেজাজি স্নেহ ও তিরস্কারে তাদেরকে সারগামের শুদ্ধ জগতে তুলে দিতে। তার সঙ্গে জুটল শুভ। ওকে শেখানোর দায়িত্ব নিলেন যেন সে বাবা রবিশঙ্করের চেয়েও ভালো বাজতে পারে সেতারে।

মানুষের প্রেম অন্নপূর্ণার পাওয়া হয়নি জীবনে, খেয়ালি কন্যা এবার ডুব দিলেন সুরের সাধনায়। শিষ্যরা ব্যতীত তার ঘরে কারও প্রবেশের অধিকার রইল না, কারও সাধ্য রইল না তাকে দিয়ে জনসমক্ষে বাজায়। ইহুদি মেনুহিনের সাধ ছিল কাছে বসে অন্নপূর্ণার বাদন শুনবেন, তাঁকে বিনয়-বচনে বিমুখ করলেন সুরবাহারের সরস্বতী। ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে মেনুহিন ও জর্জ হ্যারিসনেক যদিওবা নিজগৃহে ডাকতে সম্মত হয়েছিলেন অন্য ঝামেলায় পড়ে মেনুহিন সময় দিতে পারেননি সেদিন। হ্যারিসন নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারেন। তাকে কাছে বসিয়ে সুর তুলেছিলেন সেতার ও সুরবাহারে। হ্যারিসনের জন্য এটা রবিশঙ্কর বা আলী আকবর খানের বাদন শোনার চেয়ে বড় বিস্ময় হয়ে ধরা দিয়েছিল। ছোট্ট করে উক্তি করেছিলেন, ‘ডিভাইন!’

অন্নপূর্ণার স্বেচ্ছানির্বাসন ইঙ্গিত করে রবিশঙ্কর বিব্রত ছিলেন অন্নপূর্ণার সুরসাধনায়। ওস্তাদ আলী আকবর খানের সঙ্গে যুগলবন্দি বরং শ্রেয়তর ছিল তার কাছে। রাগ নট ভৈরবে বিভোর আলাউদ্দিন খাঁ ভর করেছিলেন আলী আকবর খানের স্বভাবে। ভৈরোর কোমল নিখাদ আলাউদ্দিনপুত্রের সরোদের প্রতি অঙ্গে ফোটে। বচনে মৃদুভাষী কিন্তু সরোদে বাবার মতোই চকিত আরোহনে উঠে পড়তেন রাগিণীশৃঙ্গে। রবিশঙ্কর স্বচ্ছন্দ ছিলেন আলী আকবর খানের সঙ্গে, হয়তো এটা মনে করিয়ে দিতে — সেতার ও সরোদ প্রকারে আলাদা হলেও তারা যখন একপ্রাণ হয় তখন সরোদের চঞ্চল অনুভবে এসে মেশে সেতারের গম্ভীর নির্ঘোষ। অন্নপূর্ণা এই দুজনের মধ্যে এক পৃথক লয়দার। চকিত ঢুকে পড়তেন সুরবাহার নিয়ে, অনায়াস তরঙ্গিত হতেন ইমন কল্যাণ কিংবা পূরবী ঠাটের দূরবিস্তারী রাগ-রাগিণীর আলাপনে। অন্নপূর্ণার বাদনে ইমন কল্যাণ কিংবা পূরবী রাগ শ্রবণ ওস্তাদ আবদুল করিম খানের কণ্ঠে জিনজ্যোতি রাগে ‘পিয়া বিন চেইন নাহি’ শোনার মতোই শিহরণকর অভিজ্ঞতা জাগায় মনে, যেমন ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের কণ্ঠে ‘যমুনা কে তীর’ শ্রবণের পর রুদ্ধবাক হাহাকারে আবিষ্ট হয় মন। অন্নপূর্ণার বাদনের বিস্তারগুণে চকিতে এলোমেলো হয়ে যেত রবিশঙ্করের রেওয়াজসিদ্ধ সেতারের বোল, হয়তো মনে হতো তাকে চমকে দিতে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ আচমকা সরোদের তারে অচেনা বাদী স্বর জুড়েছেন, সেই স্বরের সঙ্গে পাল্লা দিতে এখন তাকেও কিছু করতে হবে, সেতারে জুড়তে হবে সম্বাদী স্বর। এহেন চকিত অনুপ্রবেশ বিপাকে ফেলে সুরসিদ্ধ শিল্পীকে। রবিশঙ্করের জন্য অন্নপূর্ণা আকস্মিক দুর্বিপাক ছিলেন বটে! এক ছাদের নিচে বহুবছর কাটালেও সেই দুর্ঘট দুজনের পিছু ছাড়েনি, বরং সময়ের সঙ্গে বেড়ে গিয়েছিল পরস্পরের প্রতি তিক্ত সন্দেহ ও অবিশ্বাস।

সংগীতের ইতিহাসে রবিশঙ্কর ও অন্নপূর্ণার যুগলবন্দি কী ঘটাতে পারত সে-সম্ভাবনা কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে চিরতরে। হয়তো একে অন্যকে হারানোর খেলায় মন্দ্রসপ্তকে স্বর জুড়তেন দুজন, হতে পারে অন্নপূর্ণা ছাড়িয়ে যেতেন রবিশঙ্করকে আর পণ্ডিতজির মনে ঈর্ষার পারদ চড়ায় উঠত। পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় বুঝি সেকথা মাথায় রেখে ‘অভিমান’ ছবিটি মুক্তি দিয়েছিলেন সিনেপর্দায়! সাফল্যের শিখরে থাকা সুবীর কুমারের (অমিতাভ বচ্চন) পেশাদারী সংগীতজীবনে ধস নামার পর স্ত্রী উমা (জয়া বচ্চন) সংসারের হাল ধরতে সংগীতের পেশাদার মঞ্চে গাইতে শুরু করে। গানের প্রতিভায় স্বামীকে ছাড়িয়ে যেতে থাকলে সুবীরের মনে ঈর্ষার দেবী হানা দিলেন। ‘অভিমান’-এর পরিসমাপ্তি অবশ্য মিলনাত্মক ছিল। সুবীর ওর মনে জেগে-ওঠা ঈর্ষার কাঁটা উপড়ে ফেলে উমার কাছে ফিরে যায়। দর্শকমঞ্চে উমার সঙ্গে ‘তেরি মেরি মিলন কি ইয়ে রেহনা’র মধুর সঙ্গত দিয়ে ঋষিকেশ কাহিনির ইতি টেনেছিলেন। রবি ও অন্নপূর্ণার চলার পথ শুরু থেকে কণ্টকাকীর্ণ ছিল। ছবিমুক্তির অনেক আগে থেকে বেসুরো লয়ে জীবনসংসারে সঙ্গত করছিলেন দুজন। ‘অভিমান’ মুক্তি পেলো তেহাত্তুর সালে আর ওরা দুজন ‘মিলন’ শব্দে আপত্তি জানিয়ে পৃথক হয়ে গিয়েছিলেন ষাট দশকের শেষার্ধে। ঋষিকেশ বাবুর ছবিটি অন্নপূর্ণা পরে দেখেছিলেন বৈকি। সখেদে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ঋষিকেষ বাবু বেশ তো ওদের দুজনকে মিলিয়ে দিলেন। ঈর্ষার আগুনে পুড়ে মরতে হয়নি উমাকে। আমার জীবনে মিলন  যে অধুরাই থেকে গেল!’

মিলন অধুরা বুঝে সুরের দেবী হয়তো দুজনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন চিরতরে; এমনকি পুত্র শুভর সঙ্গে যোগাযোগ রইল না রবিশঙ্করের। ওকে তিনি পুনরায় আবিষ্কার করলেন মুম্বাইয়ের রেকর্ডিং স্টুডিওয় বসে। কানে এল পাশের ঘরে কে যেন সেতারে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র তৈরি করা রাগ বাজাচ্ছে, যে-রাগ তিনি ও নিখিল ব্যনার্জি ছাড়া কারও পক্ষে বাজানো কঠিন। রবিশঙ্করের জন্য সেদিনটি লজ্জার ছিল। অন্য লোকের মুখে পুত্রের সংগীতপ্রতিভার খবর তাকে শুনতে হয়েছিল। স্টুডিওর লোকজনের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পণ্ডিতজি নিজের পুত্রের বাজনা সম্পর্কে এতটাই বেখবর! পিতা সেদিন পুত্রকে হোটেলে ডেকে নিয়েছিলেন বিদেশে একসঙ্গে বাজানোর প্রস্তাব দিতে। জগৎবিখ্যাত পিতার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার সাহস শুভর ছিল না। অন্নপূর্ণা ওকে সুর উজাড় করে দিয়েছিলেন কিন্তু বাবার মতো নিজেও ব্যর্থ হলেন পুত্রকে সেই সুর শেখাতে যে-সুর দিয়ে অভিমানী পুত্র পিতাকে প্রশ্ন করতে পারে,-মানুষ কী করে এত উদাসীন হয় আত্মজে? কেন এই অনাদর তাকে সইতে হল এতটি বছর? কেন সারগামের সাধনায় মায়ের কঠোর শাসনকে লঘু করে পিতা একটিবার বলতে পারলেন না, — ‘অন্নপূর্ণা অনেক তো মেজাজ দেখালে, এবার ওকে আমার হাতে দাও, আমিও কিছু শেখাই! বাবা যে স্নেহ ও প্রশ্রয়ে আমাকে শিখিয়েছেন সেটা ওর পাওনা বটে।’

অস্থিরমতি সন্তানকে অন্নর্পূণা নিজের সঞ্চিত সুর উজাড় করে দিলেও সেই প্রেম দিতে পারেননি যে-প্রেম সকল ঈর্ষা ও খ্যাতির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে জীবনে। ‘রাগমালা’ সত্য হলে শুভ ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল মায়ের কঠোর শাসন থেকে রেহাই পেতে, যেহেতু মা চাইছেন না প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার আগে শুভ তার পিতার সঙ্গে বিদেশে বাজাক। অন্যদিকে ম্যান’জ ওয়ার্ল্ডকে দেয়া অন্নপূর্ণার বক্তব্য ছিল বিপরীত। শুভর শোবার ঘরে ঘুমের ঔষধের কৌটা তিনি অনেক খুঁজেও পাননি। ঘুমের ঔষধ খাওয়ার ঘটনাটি ছিল নাটক এবং রবিশঙ্করের পরামর্শে সে এই কাণ্ড ঘটিয়েছিল। কুৎসার দেবী এবার মেজাজি অন্নপূর্ণার বিড়ম্বিত ভাগ্যে চড়াও হলেন, দিকে-দিকে রটে গেল সেই মায়ের গল্প যে তার সন্তানকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করছে সকল ‘গানের ওপারে’ দাঁড়িয়ে-থাকা প্রেমের সুবাস না পেয়ে, যে তার বঞ্চিত জীবনের তিক্ততা দিয়ে পুত্রের বিখ্যাত হয়ে ওঠার পথে বাধ সেধেছে।

শুভর স্বপ্ন পূরণ হওয়ার ছিল না। শুদ্ধ স্বরের সাধনায় মগ্ন শিল্পীর প্রহর কাটে ধ্যানের সাহচর্যে, ভিতরের খাদ গলিয়ে নিখাদ স্বর্ণের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হয় যখন সে তার নিজেকে পোড়ায়। পোড়ানোর এই কঠোরতা শুভর পক্ষে বহন করা সম্ভব হয়নি। ওর মনের মধ্যে সকল সুর ছাপিয়ে হয়তো চপল এক ভালোবাসার হাহাকার জেগে ছিল, সারগামের সাধনায় কঠোর মায়ের কাছে সেটা হয়তো অনেক চেয়েও পুরোটা পায়নি, রবিশঙ্কর হয়তো পুত্রের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে সেই ভালোবাসার সুরে বেজে উঠেছিলেন। মা ওকে আরও বছর দেড়েক সময় নিতে বলেছিলেন, যেন সে নিজে স্বনির্ভর হয় বাদনে, যেন ধরতে পারে আরোহী ও অবরোহীর মোক্ষম ক্ষণ, যার গুণে শিল্পী জানে কখন এবং কীভাবে স্বর তীব্র বা মোলায়েম করে জুড়তে হয় যন্ত্রে, যেন অনুভূতির বিস্তারে সংগীতের সুরে এসে লাগে জগৎপ্লাবী হর্ষ ও বিধুরতা, যার গুণে সংগীত ব্রহ্ম হয়, যে ব্রহ্ম ‘ওম’ ধ্বনিতে নিনাদিত করে চরাচর।

সংগীতকার হচ্ছে সুরের ঈশ্বর, সেই ঈশ্বরকে ধরতে হলে শিল্পীর হৃদয়-প্রকৃতির মধ্যে জমানো সকল রাগ-রাগিণীকে একীভূত করতে হয় সুরের ঐকতানে। রবিশঙ্কর ওকে বিদেশে নিয়ে গেলেন বৈকি, সংগীতের শানদার মহলে পৌঁছেও দিলেন, কিন্তু শুভ ততদিনে নিভে যেতে শুরু করেছে। মায়ের সঙ্গে ওর পুনরায় দেখা হয়েছিল কুড়ি বছর পর। কোকাকোলা ও জাঙ্ক ফুডে আসক্ত শুভ নাকি সেদিন মাকে বলেছিল, ‘মা, আমি আবার শিখতে চাই। শিখাবে?’ অন্নপূর্ণা, যেন কিছুই ঘটেনি এমন স্বরে বলেছিলেন, ‘বেশ তো, সেতারটা নাও, হ্যাঁ, এইবার শুরু করো।’ পথহারা বালকের জীবন ছন্দে ফেরার ক্ষণে রবিশঙ্কর দেখা দিলেন পুনরায়। পুত্রকে নিয়ে পুনের এক আসরে দুজন একত্রে বাজিয়েছিলেন। শুভ যেন খেই পাচ্ছিল না, বেসুরো বাজিয়েছিল সেদিন। ম্যান’জ ওয়ার্ল্ডকে দেয়া অন্নপূর্ণার বিবৃতি সত্য হলে মানতে হয় যে-ছেলে কিছুদিন আগে রাগ দেশ চমৎকার বাজিয়েছিল সে কি করে এতটা বেসুরা বাজায়! মাইক্রোফোন পরিকল্পিতভাবে বিগড়ে দেয়া হয়েছিল এবং সেখানে রবিশঙ্করের হাত থাকা বিচিত্র নয়। কেন নয়? অন্নপূর্ণা সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন শুভর মৃত্যুর পর, — ‘ঈর্ষা! পণ্ডিতজি আমার সঙ্গে বাদনে বিব্রত হতেন, মনে ভয় ছিল আমি ওকে সুরের খেলায় হারিয়ে দেবো, শুভর মধ্যে তিনি আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন, ওকে জিততে দিলে চলবে কেন!’ অন্নপূর্ণার এহেন বক্তব্য এই জনশ্রুতিকে খানিক রঙিন করে, ঈর্ষায় অন্ধ রবিশঙ্কর নাকি অন্নপূর্ণার হাতের আঙুল কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন, যেন সে কখনও সুরবাহার হাতে সুর তুলতে না পারে।

রবি ও অন্নপূর্ণার মধ্যে কে সত্যকথন করছেন সে-প্রশ্ন এখন অর্থহীন। যেমন অর্থহীন রওশন আরা থেকে অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠার ক্ষণে বাবা আলাউদ্দিন খাঁ কেন টের পেলেন না সুরে-সুরে বিবাহ দিলেই মানুষ অভেদ হয় না, হরগৌরির আলিঙ্গনে সাক্ষাৎ ব্রহ্ম হয়ে ওঠে না, সুরের মায়াজাল অতিক্রম করে সেই জগৎ দুটি মানুষের মাঝে বেজে ওঠা চাই যার জোরে ওদের মিলন ঘটবে জীবননাটকের মঞ্চে আর রচিত হবে ভালোবাসার ঐকতান, যার আলিঙ্গনে শ্মশানচারী রুদ্র শিব পার্বতীর সঙ্গে মিলনের পিপাসায় ভৈরো রাগে উতলা হয়ে ওঠেন আর পুরুষ-প্রকৃতির এই মিলনকে ‘শিবসুন্দরম’ বলে প্রণাম করেন জগতের সকল শাস্ত্রীয় সংগীতকার।

শুভ যখন চিরঘুমের দেশে, রবিশঙ্করের মনের তারে কী সুর খেলা করছিল একমাত্র বিধাতা জানেন। অন্নপূর্ণা হয়তো সজল নয়নে ভাবছিলেন তিক্ত এই জীবনে তার জন্য সুর ব্যতীত কিছু পড়ে রইল না। তার জন্য রইল বাবা আলাউদ্দিন খাঁর আবক্ষ মূর্তি, পোষা পায়রা, নিরলে বসে পুরনো দিনের হিন্দি ছবির গান শোনা, পিতার রেখে-যাওয়া প্রতিভায় দামাল একঝাঁক শিষ্য, এ. আর রহমান ‘রোজা’ ছবিতে ‘মনবাহার’ সুর করেছেন বলে চকিত মন্তব্যে শিষ্যদের বুঝিয়ে দেওয়া হাল জামানার গানবাজনার খবর তিনি রাখেন, আর রইল শুভর ঘুমঘোর মুখচ্ছবির সঙ্গে পিতার রেখে-যাওয়া সুরবাহার! তিনি যখন সেতারে পারঙ্গম হয়ে উঠছেন বাবা আলাউদ্দিন মেয়েকে কাছে ডেকে বলেছিলেন,-এবার সময় হয়েছে বেটিয়া সেতার ছেড়ে সুরবাহার হাতে নেয়ার। সেতার টমেটোর মতো বেটি, সবার পছন্দ ও আদরের। শ্রম দিলে ওতে সুরের ফল্গুধারা বহানো কঠিন কিছু না। রুদ্রবীণার মতো সুরবাহারও দেখতে জবরদস্ত, ওটাকে সামলানো সকলের কাজ নয়। হৃদয়ের গভীর পাতালে যে-সুর তরঙ্গ বহায় তাকে বের করতে হলে ওই জবরদস্তকে তোমার চাই। আমি বিশ্বাস করি বেটি, তুমি পারবে সুরবাহার নিয়ে খেলতে। শুধু নিচুলয়ে বাঁধা ধ্রুপদ অঙ্গের রাগ-রাগিণীর আলাপ অংশ বাজানোর জন্য তুমি ওটা ব্যবহার করবে তা না, রাগ সম্পূর্ণ করতে ওকে সঙ্গী করে নিও। আজ থেকে সুরবাহার তোমার গন্তব্য, সেতার নয়। কিশোরী রওশন আরা সেদিন নতমুখে জবাব করেছিলেন, ‘আপনার যেমন আদেশ বাবা।’

বাবা আলাউদ্দিন খাঁ যখন কন্যার হাতে সুরবাহার তুলে দিলেন ততদিনে রুদ্রবীণার যুগ অস্তমিত হওয়ার পথে। ভগবান শিব স্বয়ং এই বীণা হাতে সৃষ্টি ও প্রলয়ের সুর তুলতেন বলে ইতিহাসে লেখে। পারস্য থেকে সেতারের মূর্ছনা যখন মুঘল সম্রাটদের দরবারে ক্রমশ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে সেইক্ষণে মিয়া তানসেনের হাতে রুদ্রবীণা নাকি পুনরায় নবজীবন ফিরে পেয়েছিল, যদিও উনিশ শতকে এসে সেতারের পরাক্রমের কাছে হার মানতেই হলো শেষতক। সেতারে ধ্রুপদ অঙ্গের আলাপ বাজানোর সহোদর রূপে সুরবাহার সেইক্ষণে দেখা দিয়েছিল উপমহাদেশে; যদিও জনপ্রিয়তায় সেতার, সরোদ ইত্যাদিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। বিংশ শতকে এসে ওস্তাদ দবির খান ও এরকম দু’চার জন ছাড়া রুদ্রবীণা বাজানোর জন্য লোক বিশেষ রইলেন না, ওদিকে সুরবাহার বাজাবে এমন লোকেরও আকাল দেখা দিয়েছিল সেই সময়। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ এই যুগসন্ধিক্ষণের যন্ত্রী ছিলেন। প্রতিভার গুণে সেতারের কামলাখাটা সুরবাহারকে নিয়ে গেলেন অন্য উচ্চতায়। তার বাদনের গুণে নিচুলয়ের তারে বাঁধা সুরবাহার সেতারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমতালে ঝঙ্কার তুলত শ্রোতার মনে। ঠিক যেরকম জিয়া মহিউদ্দিন ডাগর বিংশ শতকে দেখা দিয়েছিলেন রুদ্রবীণার ত্রাতা হয়ে; ভগবান শিবের বীণা নবযৌবন ফিরে পেয়েছিল ডাগর ঘরানার ধ্রূপদ বাদনে।

রুদ্রবীণা হাতে জিয়া মহিউদ্দিন ডাগর ইমন কিংবা মালকোষ ঠাটের রাগে ধ্রূপদ স্বর জুড়ছেন — এই অভিজ্ঞতা স্বর্গীয় ছিল! ইমন ঠাটের রাগ-রাগিণীর সঙ্গে ডাগর পরিবার অবিচ্ছেদ্য ছিলেন। জিয়া মহিউদ্দিন ডাগর নিজের খেয়ালে মাঝেমধ্যে বলে উঠতেন, ‘আমি ইমন রাগটাই শুধু জানি। রুদ্রবীণায় এই রাগ বাজানোর জন্য আমায় কিছু করতে হয় না। ওটা হাতে নিলে ইমন আপনা থেকে তানালাপ জুড়ে হাতের আঙুলে।’ শাস্ত্রীয় সংগীতে ঘরানার গুরুত্বটি এখানেই নিহিত। শেখার প্রয়োজনে বিচিত্র রাগ-রাগিনী রপ্ত করলেও ঘরানার গায়কি গুটিকয় রাগকে শেষপর্যন্ত আপন করে নেয়। জিয়া মহিউদ্দিন ডাগর যেমন ইমন ঠাটের রাগগুলোকে জীবনের আরাধ্য করে নিয়েছিলেন। রুদ্রবীণা হাতে ইমন ছিল তার মাস্টারস্ট্রোক। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ এইসব যুগবিবর্তনের সাক্ষী হয়ে দায় সারার লোক ছিলেন না। নিজের হাতে গড়া মাইহার ব্যান্ড-এর বাদনপ্রণালিতে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে রুদ্রবীণাও স্থান করে নিয়েছিল। যদিও সরোদ, বেহালা ও সুরবাহারের প্রতি সহজাত ঝোঁকের কারণে রুদ্রবীণা হাতে কালেভদ্রে বাজিয়েছেন। সুরবাহারকেই ধ্রূপদ অঙ্গের রাগ ফুটিয়ে তোলার জন্য ঘষামাজা করে নিয়েছিলেন খাঁ সাহেব, আর অন্নপূর্ণাকে দান করে গিয়েছিলেন সেই সুরের আশিস, যেন বীণাপাণি ধ্রূপদের মহিমায় অবিরল বাজতে পারে সুরবাহারে।

শুভ চলে যাওয়ার ক্ষণে অন্নপূর্ণা দেখছেন তার জন্য ওই সুরবাহার ছাড়া কিছু পড়ে নেই। শুভ চলে গেছে নিরুদ্দেশে। সত্য বটে যখন মায়ের কোলে ছিল সারারাত কাঁদত, আর এখন সকল কান্না তার কাছে জমা রেখে পাড়ি দিয়েছে অচেনা গন্তব্যে। অন্নপূর্ণা টের পাচ্ছেন, রাত্রির রাগ মেঘমালার মতো ঘনীভূত হয়ে জমছে সুরবাহারে। যেন স্বরসম্রাট আব্দুল করিম খান ও তারাবাই মানের আদরের কন্যা চম্পাকলি ওরফে হীরাবাই বারোদকার ছায়ানট রাগের শমে এসে চঞ্চল প্রজাপতির ডানা মেলে উড়ছেন ভাসমান মেঘের ভেলায়, আর বিষ্ণু দিগম্বর পলুস্কর সুরদাসী মালাহারে খুব দরদ মিশিয়ে গাইছেন ‘গরজতে আয়ি বাদরাওয়া’; যেন ভাই আলী আকবর খান সরোদে ভুল সুর জুড়লেন দেখে চপলা কিশোরী রওশন আরা ভাইকে শুধরে দিচ্ছে, ‘ভাইয়া, ঠেরো, মধ্যম-মে জায়দা কমি শুনা দেতি। বাবা-নে ইস তরিকাসে নেহি, এয়সা শিখায়া।’

আলী আকবর খান ভুল করে অথবা পিতার শেখানো নিয়মের বাইরে গিয়ে বাজানোর কৌতূহলে মধ্যমে খানিক মৃদু হয়েছিলেন কি না সে এখন আর জানার উপায় নেই। বড়ে গোলাম আলী খান যদি ওই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত থাকতেন তবে চপলা কিশোরীর কাণ্ড দেখে প্রসন্ন হতেন বৈকি। ওই বয়সে শোনার কান যার এত পাকা তাকে আশীর্বাদ করতেন প্রাণভরে। পাতিয়ালা ঘরানার স্বরসম্রাট বিশ্বাস করতেন ওস্তাদের শরণাপন্ন হয়ে সংগীতের বাও রপ্ত করতে হয়, কিন্তু সংগীতকার হয়ে ওঠার জন্য কানকে সবার আগে তৈরি করা জরুরি। যে শিল্পী তাকে তাই প্রচুর শুনতে হবে, যেন সুরের অনুলোম বিচ্যুতি তার কানে খট করে এসে লাগে। বড়ে সাহেব আজীবন এই বিশ্বাসে স্থির ছিলেন, — সংগীতের জ্ঞান হচ্ছে ঈশ্বর সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের অনুরূপ; ধরাবাঁধা নিয়মের ছকে ফেলে সেই জ্ঞানকে যাচাই করা যায় না; অজানা ঈশ্বরকে মানুষ যেভাবে অনুভব ও চর্চা করে সেটাই তার জন্য ঈশ্বরজ্ঞান; রাগ-রাগিণীর সুর লাগানোর ক্ষণে শিল্পীর মনে অনুভবের যে তরঙ্গ ওঠে কণ্ঠ এবং বাদনে সেই সুর মূর্ত হওয়া প্রয়োজন।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এ-কারণে হয়তো কাঠামোয় আবদ্ধ রাগ-রাগিণীর স্বর ফোটানোর শর্তে বিমুখ থেকেছে চিরকাল। স্বরের জন্ম হয় শিল্পীর শ্রবণ ও অনুভূতির জগতে, যে বিশেষ মুহূর্তে সে নির্দিষ্ট কোনো রাগ বেছে নিচ্ছে সেই মুহূর্তটি কীভাবে তার শ্রবণ হয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করছে তার ওপর স্বরের প্রয়োগগুণ নির্ভর করে। যে-কারণে বলা হয় রাগিণীরা প্রতি মুহূর্তে নতুন করে জন্মগ্রহণ করে এবং মুহূর্তের ঘোর কেটে গেলে অস্তমিত হয় পুনরায় নতুন কোনো রূপে জন্ম নেওয়ার তাড়নায়। এই সংগীত অতীতে প্রতিষ্ঠিত কোনো নিয়মকে রোমন্থনের জন্য গাওয়া হয় না, শিল্পীর শ্রবণ ও অনুভব থেকে উৎসারিত স্বর এটাকে অবিরত নবীন ও প্রবহমান রাখে। অবশ্য এর জন্য ওই শিল্পীকে রাগ-রাগিণীর স্বরে সুরের শুদ্ধ অনুভব ধরার ক্ষমতায় দীক্ষিত হতে হবে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র বাদনপদ্ধতিকে অন্নপূর্ণা তার নিজের জন্য সহি স্থির করে নিয়েছিলেন বলে হয়তো ভাইয়ের বাদনে মধ্যমের কমতিকে সংশোধন করতে তিলেক দ্বিধা করেননি। সে যাহোক, সুরের মায়াজালে বন্দি কন্যা টের পাচ্ছেন রাত্রির আকাশে মেঘ ঘন হচ্ছে আর বাবার শেখানো সকল সুর তরঙ্গ তুলছে সুরবাহারে। তিনি এখন ওটা নিয়ে বসবেন,-সকল ‘গানের ওপারে’ যার নিবাস যদি তার দেখা পান সেই আশায়।

… … …

নিবন্ধে ব্যবহৃত কিছু তথ্যসূত্র :


১. Ustad Allauddin Khan: The Legend of Music by Anuradha Ghosh, 1990; ২. Annapurna Devi: The Tragedy And Triumph Of Ravi Shankar’s First Wife, Mans world, May 2000 Issue; ৩. Genius and enigma of Annapurna Devi, Tathagata Ray Chowdhry, Telegraph India, October 2018 Issue; ৪. Ustad Allauddin Khan : A documentary By Ritwik Ghatak, Sangit-Natok Academy; Source: YouTube; ৫. Annapurna &  Ravi Shankar Duet in Raga Yaman Kallayan, Source: YouTube; ৬. Annapurna Devi, Raga Manj Khamaj & Kaushiki, Surbahar, Source: YouTube; ৬. YouTube সূত্রে প্রাপ্ত বাবা আলাউদ্দিন খাঁ’র বাজানো রাগসমূহ : ভৈরবী (সরোদ), আলাহিয়া বিলাবল (সরোদ), দেবগিরি বিলাবল (সরোদ), নট বেহাগ (সুরশৃঙ্গার); ৭. Allauddin Khan: Selected ragas in Sarod & Violin, Source: YouTube; ৮. সম্মিলিত বাদন (যুগলবন্দি) : রাগ ভাটিয়ারা : ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আলী আকবর খান, পণ্ডিত নিখিল ব্যনার্জী, আশিষ খান ও কান্তি মহারাজ, Source: YouTube; ৯. Ali Akbar Khan & Ravi Shankar, Concert 1972, Source: YouTube; ১০. আলী আকবর খান ও পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জী, রাগ বৈরভী, Source: YouTube; ১১. Ali Akbar Khan, Forty Minutes Raga, Source: YouTube; ১২. পণ্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পলুস্কর : ভজন, রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, Source: YouTube; ১৩. পণ্ডিত বিষ্ণু দিগম্বর পলুস্কর : সুরদাসী মালাহার (ভজন) : গরজতে আয়ি বাদরাওয়া ও বাদরাওয়া বরষন লাগি, Source: YouTube; ১৪. রাগমালা : রবিশঙ্কর, আনন্দ পাবলিশার্স।

… … 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you