ছুরির ডগায় মধু / শিন ইউন :: ভাষান্তর / জয়দেব কর

ছুরির ডগায় মধু / শিন ইউন :: ভাষান্তর / জয়দেব কর

শেয়ার করুন:

 

বুদ্ধ-মতবাদে জীবনকে শুষ্ক কূপের সাথে তুলনা করে একটি নীতিগল্প চালু রয়েছে। এক পথচারী বাঘের ধাওয়া খেয়ে বাঁচার জন্য প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার পাশে একটি শুকনো কুয়ো দেখতে পেয়ে গাছের লতা ধরে ঝুলে নামতে লাগল এর ভেতর। কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাওয়া মাত্র কূপের তলদেশে দৃষ্টি দিতেই দেখে চারটা ভয়ঙ্কর সাপ। ভয়ে এমন জমে গেল যে নড়তেচড়তে পারছিল না। ত্রিশঙ্কুর মতো ঝুলে রইল। ধীরে ধীরে কিছুক্ষণ পর উপরের দিকে চোখ নিতেই দেখে আরেক বিপদ। দেখে যে দুটি ইঁদুর লতাটি কাটছে। একটা সাদা, আরেকটা কালো। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! ঠিক এই মুহূর্তে পাঁচটা উড়ন্ত মৌমাছি পাঁচফোটা মধু বরাবর তার মুখে ফেলে যায়। মধুর মিষ্টি স্বাদ পেয়ে পথিক তার সমূহ বিপদের কথা বিস্মৃত হয়ে পড়ে।

এই নীতিকথা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, আমরা ‘অনিত্যতা’ নামক ভয়ানক পশুর তাড়া খেয়ে জীবন-মৃত্যুর শুষ্ক কূপে বেঁচে থাকি। কর্মের রশি বেয়ে নেমে পড়ি কূপে যেখানে চার বিষধর সাপ রয়েছে (চার সাপ চার মহাভূত : আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের প্রতীক)। আমরা এমনভাবে ঝুলে থাকি যেন রশিটি যে-কোনও মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে। এখানে দুটো ইঁদুর দিনরাত্রির প্রতীক যা আমাদের আঁকড়ে-থাকা রশিটি কাটতে থাকে। ঠিক এই সময়ে মৌমাছি আমাদের মুখে পাঁচফোটা মধু ফেলে সম্ভাব্য সকল বিপদের কথা ভুলিয়ে দেয়। আর একেই বলে ছুরির ডগায় মধু। এর মিষ্টত্বের জন্য আমরা সহজেই জিহ্বা কেটে যাওয়ার বিপদ ভুলে যাই। এটাই আমাদের জীবনের চিত্র।

ছুরির ডগায় মধুটা কী? অর্থ, যৌনতা, খ্যাতি, খাদ্য ও ঘুম : পঞ্চকামনা। জাগতিক জীবনে সব ধরনের দুঃখ রয়েছে। শারীরিক দুঃখগুলোর মধ্যে জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু রয়েছে। আর মানসিক দুঃখের মধ্যে রয়েছে লোভ-দ্বেষ-মোহ। এছাড়াও জগতে রয়েছে ভালো-মন্দ, প্রেম-ঘৃণা, সঠিক-বেঠিক ও যুদ্ধ-দুর্যোগ প্রভৃতির হাঙ্গামা। এই সমস্ত কিছুর জন্মই হয় পাঁচফোঁটা মধুর সাময়িক তৃপ্তির ফলাফলস্বরূপ। আমরা এমন কিছু করি যাতে মনে হয় দুঃখভোগের জন্য যেন আমরা মুখিয়ে রয়েছি।

আমাদের সংক্ষিপ্ত ও ভ্রান্তিপূর্ণ জীবনে যখন ভাবি, “সূর্যাস্ত খুবই মনোরম, রাত্রির নিকটবর্তী হচ্ছে”,  এর মানে জীবন হলো, “খুবই অল্প জলে বেঁচে থাকা একটি মাছ; এখানে আনন্দ কোথায়?” আমাদের মূল্যবান জীবনের মুখোমুখি দাঁড়াতে গিয়ে দুঃখ ও অনিত্যতার ভয়ে পরাজিত হওয়া চলবে না। প্রাণপণ প্রচেষ্টা করে যাওয়া উচিত এবং সংক্ষিপ্ত জীবনের মূল্য বোঝা উচিত। কখনওই ছুরির ডগার মধুর লোভে পড়া উচিত নয়, যার ফলে আমরা জীবন-মরণকে ভুলে যাই।

গাথায় আছে, “ঝরে পড়ার অপেক্ষা না করে, ফুটন্ত অবস্থায়ই ফুল চয়ন করতে হয়।” আর  সংক্ষিপ্ত মানবজীবন সম্পর্কে এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের থাকা উচিত।

শিন ইউন


জয়দেব কর রচনারাশি

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you