হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য কেমন? এক–রকম সাহিত্য আছে যা শুধু দৃষ্টিনন্দন, আরামজাগানিয়া, শিল্পের আঁটির উপর আমের নরম স্বাদ যেন। এগুলো মানুষ খাওয়ার জন্য খায় এমনি-এমনি। আরেক-রকম সাহিত্য আছে, যা সেই–সময়ের প্রজন্মকে নিয়ে বেড়ে ওঠে। সেই সাহিত্য সময়ের মানবিক গাইড বই। মানুষ পড়ে আর বেঁচে থাকাটা শেখে।
মুরাকামির ‘নরোয়েজিয়ান উড’ জাপানের ১০০% লোকের পড়া। কথাটা যত না বাস্তব, তার থেকে বেশি প্রতীকী। মানে উপন্যাসে মুরাকামির তৈরিকৃত যে জীবন দেখার উপায়, তা দিয়ে একটা প্রজন্ম ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল। শুধু এই বই না, তার বহু উপন্যাস ও চিন্তা দিয়েই তিনি জাপানী তরুণদের জীবন প্রভাবিত করেছেন বলে মনে করা হয়। যারা প্রজন্মকে নির্দেশনা দিতে পারে এমন লেখক আমাদের সমাজেও চাই। তবে কই?
হুমায়ূন সেই রকম জাতীয় প্রজন্ম গড়ার লেখক হতে পারতেন। তার মতো অভেদ্য সহজ অথচ মর্মস্পর্শী ছোট ছোট বাক্যের বাংলা লেখার যোগ্যতা, ক্ষমতা, সাহস কয়জনের আছে! আমাদের বড় লেখকদের জীবন যায় শিল্প শিল্প করতে, নিরীক্ষা নামক গার্বেজ লিখতে লিখতে। কিন্তু ধারণা হয়, ‘নন্দিত নরকে’ প্রথম উপন্যাস থেকে যে বাংলা তিনি লিখেছেন শেষ উপন্যাসেও সেই একই বাংলা লিখেছেন। যদিও আমার পড়া হয়নি তার শেষ উপন্যাস। তার ভাষা উত্থানপতনহীন ও নিরীক্ষাবর্জিত। লেখকরা এই রিস্ক নিয়ে লেখে না। কারণ অমরত্বের প্রত্যাশার জন্য সে নানা কায়দাকানুনে লিখে থাকে। আশার কথা হুমায়ূন সেই অমরত্বের আশায় লিখেন নাই। এটা তার বড় শিক্ষা লেখককূলের জন্য। তিনি তার সময়ের লেখাটা লিখে জীবদ্দশায় ষোলোআনা আয় করে নিতে চেয়েছেন। এইটাই তার সাহস। জনপ্রিয় লেখক–শিল্পীদের জন্য এ তেমন নতুন না।
তবে মোদ্দাকথা এই দেশের সবাই শিল্পীই হতে চায়। তারা বিরাট–কিছু ছাড়া লিখতেই চায় না। ফলে তাদের কথাসাহিত্য তারাই পড়ে যারা অন্তত কথাসাহিত্য করে। সেই হিসাবে হুমায়ূন বিরাট ব্যতিক্রম। তরুণদের থেকেও তরুণতম। কিন্তু হুমায়ূন এক বিরাট, বিপুল অপচয়। পাঠকনন্দিত ঔপন্যাসিকরা যে-কোনো রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু হুমায়ূনের লেখা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বহীন। আগেই বলেছি, একজন বড় লেখক তার প্রজন্ম প্রস্তুত করে। যে–লেখক পাঠকের বেডরুমে প্রবেশ করতে পারে না, সে বড়জোর ভালো লিখিয়ে, মহান লেখক না। হুমায়ূন বাংলাভাষার শেষ বেডরুমে প্রবেশে সক্ষম লেখক। কিন্তু সেখানে তার কোনো ক্রিয়াকাণ্ড নাই। হিমুর মতো নির্বিষ অথর্ব পলায়নপর এক জীবনের হতাশাই তিনি তরুণ প্রজন্মকে দিয়েছেন।
তিনি বড় লেখক হিশেবে প্রজন্মকে কী দিয়েছেন? কিছুই না। এটাই হুমায়ূনসাহিত্যের বিরাট ছোটত্ব। তার সাহিত্য বড়জোর আর ২০ বছর। যে আধা–মফস্বলী জীবন তিনি এঁকেছেন তা এই প্রজন্ম ভুলে যেতে কয়দিন নেবে আর? রিনিউয়্যাল হবার মতো কোনো সারবস্তুও তো নাই। তখন তার মতো লেখককে আমরা কোথায় খুঁজে পাবো? তার মতো বড় বাজারি লেখক!
… …
- কায়মাসুদ : মাসুদ খানের জড়সাধনা || মৃদুল মাহবুব - February 15, 2020
- মুখোমুখি গুন্টার গ্রাস || মৃদুল মাহবুব - January 6, 2020
- হেমিংওয়ে, তোমার চিঠি এসেছে || মৃদুল মাহবুব - December 15, 2019
COMMENTS