হিমুর হুমায়ূন (পর্ব ৪)

হিমুর হুমায়ূন (পর্ব ৪)

জলসাঘরে শাহ আবদুল করিম

হুমায়ূনস্যার ১৯৯৪ সালে ‘হাসন লোক-উৎসব’-এ এসে রাতের আড্ডায় বাউল শাহ আবদুল করিমের গান আমার কণ্ঠে প্রথমবারের মতো শোনেন। গানের পাশাপাশি শ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক ও স্যারের ঘনিষ্টজন সালেহ চৌধুরীও তাকে বাউল করিমের বিষয়ে অবগত করেন। স্যারের মনের ভেতরে ঢুকে পড়ে করিমের একতারার সুর। বিটিভির ঈদ স্পেশাল ম্যাগাজিন ‘জলসাঘর’ অনুষ্ঠানে তাকে দিয়ে গান গাওয়ানো ও গানের ফাঁকে তার সাক্ষাৎকারের কথা বলেন স্যার। আমার কাঁধে দায়িত্ব পড়ে বাউল করিমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার। আমি বারবার করিমভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করেও তাকে ধরতে পারি না।

তখন সুনামগঞ্জ থেকে দিরাই হয়ে উজানধলে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। সারাদিন লেগে যেত উজানধলে পৌঁছাতে। ক্ষ্যাপা বাউল করিম সঙ্গীসাথি নিয়ে গান গেয়ে বেড়ান এখানে-সেখানে। সবসময় গিয়ে দেখা হয় না। দেখা হলেও বলেন, সামনের মাসে ঢাকা যাব। কিন্তু তার আর ঢাকা যাওয়া হয় না। শেষমেশ বহু চেষ্টার পরে ১৯৯৭ সালে তাঁকে একপ্রকার ধরেই ঢাকায় নিয়ে যাই। তিনি সঙ্গে আরো কয়েকজন বাউল নেন। জলসাঘরে কেবল তাঁর গান ও কথাই প্রচারের পরিকল্পনা ছিল অনুষ্ঠানে। তাঁর সঙ্গীদের গাওয়ার কথা ছিল না। অনুষ্ঠান পরিকল্পনা এমনভাবেই সজানোগোছানো ছিল। ফলে সঙ্গী বাউলরা অনুষ্ঠানে গান গাইতে না পেরে বাউল করিমের কান ভারী করেন। তাছাড়া স্যারের প্রোডাকশন টিমের একজন সহকারীর আচরণে বিরক্ত হয়ে বাউল আবদুল করিম ক্ষুব্ধ হয়ে চলে আসতে চেয়েছিলেন। পরে সেই কর্মী তাঁর হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে তাকে শান্ত করেছিল। এভাবে মান-অভিমান ও সঙ্গী বাউলদের মনোক্ষুণ্ণের মধ্যেই প্রায় ঘণ্টাখানেক তার গান রেকর্ডিং হয় হুমায়ূনস্যারের বাসায়। বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা বর্তমানে প্রয়াত আবুল খায়ের তাঁর সাক্ষাৎকার নেন।Humayun Ahmed, Shah Abdul Karim & Abul Khayer জলসাঘর অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই এটি ছিল টেলিভিশনে শাহ আবদুল করিমের প্রথম অনুষ্ঠান। একজন লেখকের লেখায় সেদিন পড়লাম এই অনুষ্ঠানে গান প্রচারের জটিলতা থেকে শাহ আবদুল করিমকে বিটিভিতে এনলিস্টেড গীতিকার করা হয়। কারণ তখন বিটিভিতে এনলিস্টেড আর্টিস্ট বা গীতিকার ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া যেত না এটি সত্যি। কিন্তু জলসাঘর অনুষ্ঠানটি ছিল প্যাকেজ আওতার অনুষ্ঠান। প্যাকেজ অনুষ্ঠানে শিল্পী এনলিস্টেড করার কোনো জটিলতা ছিল না। যিনি ঘটনাটি লিখেছেন তিনি ভুল লিখেছেন। আরো ভুল লিখেছেন শাহ আবদুল করিমের ছেলের কথার সূত্র ধরে। স্যার ড্রাইভারের মাধ্যমে শাহ আবদুল করিমকে খামের মধ্যে সম্মানী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বলে ওই লেখক উল্লেখ করেন। তাঁর এ বর্ণনা নির্জলা মিথ্যা। আমি আগেও বলছি স্যারের অগোচরে স্যারের প্রোডাকশন টিমের একজনের আচরণ এবং সঙ্গী বাউলরা গান গাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় শাহ আবদুল করিমের কান ভারী করেছিলেন। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন করিম তাই এ-কারণে কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এই লেখক তার আরো একটি লেখায় বলেছেন ছাতকের গিয়াস উদ্দিনের ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ গানটি আরেকজন প্রথমে হুমায়ূন আহমেদকে শুনিয়েছেন। কিন্তু এই গানটিও করিমের ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’-এর মতো স্যারকে প্রথমে গেয়ে আমিই শুনিয়েছিলাম। হুমায়ূনস্যারের ঘনিষ্ঠজন ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী ২০১৩ সনে অন্বেষা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘হুমায়ূন ও আমি’ গ্রন্থে এর বর্ণনা দিয়েছেন।

শাহ আবদুল করিমকে জলসাঘর অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া থেকে বাড়ি পাঠানো পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত ছিলাম আমি। শাহ আবদুল করিমকে পারিশ্রমিক এবং ঢাকায় আসা-যাওয়া সহ সকল ব্যয়ভার বহন করা হয় প্রোডাকশন থেকে। বাউল করিমের মৃত্যুর পর কিছু মানুষকে এ-ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে কিছু অতিরিক্ত বক্তব্য দিতে দেখা যায়, যাতে হুমায়ূনস্যারকে অনেক ক্ষেত্রে খাটো করা হয়েছে। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে স্যার বাউল করিমের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। তিনি তাঁর গানের এক মুগ্ধ এবং ভক্ত শ্রোতা ছিলেন। তার একাধিক নাটক-সিনেমায় তাঁর গান রেখে সেই পছন্দ ও মরমি সাধকদের প্রতি নিজের মুগ্ধতার পরিচয় দিয়েছিলেন দুই দশক আগেই।

জলসাঘরে সুবীর নন্দী ‘আমি কুলহারা কলঙ্কিনী’, দিলরুবা খান ‘আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা’, আমি ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’, সেলিম চৌধুরী ‘এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা’ এবং বেবী নাজনীন ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো’ গেয়েছিলাম। অনুষ্ঠানটি খুবই জনপ্রিয় হয়। অনেক শিল্পী ও বাউল-অনুরাগীদের মনে শাহ আবদুল করিমকে নিয়ে নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়। তাঁর সঙ্গে মিশে তাঁর কালজয়ী গানের সান্নিধ্যে আসেন তারা। আধুনিক গানের জনপ্রিয় শিল্পীদের অনেকেই এই অনুষ্ঠান প্রচারের পরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর গান গাওয়ার অনুমতি নিয়েছিলেন। এতে হুমায়ূনস্যার আরো খুশি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে স্যার শাহ আবদুল করিমের খোঁজ নিতেন আমাদের মাধ্যমে।

হুমায়ূনস্যার প্রতিভা তৈরি করতেন। তিনি যেমন নিজে ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান, তেমনি প্রতিভা গড়ার কারিগরও ছিলেন। তাই তার শিল্পিত মন প্রতিভাকেও খুঁজে বের করতে পারত। বিটিভির জলসাঘরে শাহ আবদুল করিমের গান যখন আমাদের কণ্ঠে রেকর্ডিং হয়েছিল তখন বারী সিদ্দিকী বাঁশি বাজিয়ে ছিলেন। বাঁশি বজিয়ে তিনি বেশ সুনামও কুড়ান। রেকর্ডিঙের একফাঁকে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে আমরা রেকর্ডিং স্টুডিওতেই আড্ডা দিচ্ছিলাম। এ-সময় বারী সিদ্দিকী আমাদের গান শোনান। তাঁর ভরাট কণ্ঠে ফোকগান শুনে আমরা মুগ্ধ হয়ে পড়ি। পরে একসময় আমরা হুমায়ূনস্যারকে বিষয়টি অবগত করি। স্যার পরে বারীভাইয়ের গান শোনেন। ভালো লাগে তাঁর। পরে স্যারের বাসার ছাদে বারী সিদ্দিকীর একক সংগীতসন্ধ্যার আয়োজন করে তাঁর গান শুনিয়েছিলেন নিজের পরিচিতজনদের। আরও পরে স্যারের সাড়াজাগানো ছবি ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ তাঁকে গাইতে সুযোগ দেন। তিনি এ-ছবিতে গান গেয়ে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পান। এভাবে স্যার নতুন ও পুরাতনদের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সৃষ্টিকে জনপ্রিয় করে গেছেন।

(চলবে)

হিমুর হুমায়ূন ( পর্ব ১ )
হিমুর হুমায়ূন ( পর্ব ২ )
হিমুর হুমায়ূন ( পর্ব ৩ )

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you