বোরখাওয়ালি || আহমদ মিনহাজ

বোরখাওয়ালি || আহমদ মিনহাজ

এমন এক শহরের গল্প লোকে সেখানে টিয়া পাখি পুষতে ভালোবাসে। খাঁচায় পোরা টিয়া পাখি ঘরের ছাদ, উঠান অথবা বারান্দায় তারা ঝুলিয়ে রাখে এবং নিজেরা তার চারপাশ ঘিরে পাক খায়। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে আমি সেই শহরে একদিন ঢুকে পড়ি। খাঁচাবন্দি টিয়া পাখির সঙ্গে লোকজনে-বোঝাই শহরকে আমার কাছে প্রাণবন্ত মনে হলো। শহরের অলিগলি তাদের হট্টগোল আর টিয়া পাখির ‘টিয়া টিয়া’ শব্দে গুলজার হয়ে আছে। রাস্তার ফুটপাত ঘেঁষে সারবাঁধা দোকানপাটের সঙ্গে পাকা লঙ্কা ভক্ষণে ব্যস্ত টিয়া পাখিরা দিব্যি মানিয়েছে! মানুষ ও টিয়া পাখির সহাবস্থানের সঙ্গে তাল দিয়ে শহরের চতুর্দিক থেকে উঠে আসা শব্দগুঞ্জনে আমার মাথা ধরে যাওয়ার উপক্রম হয়। ধাতস্থ হওয়ার পর বুঝতে পারি শহরটিকে আমার তেমন খারাপ লাগছে না!

বিচিত্র শব্দে স্পন্দিত শহরকে আবিষ্কারের উত্তেজনা আমায় গ্রাস করে। কানে-তালা-লাগানো শব্দের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা নিছক মন্দ নয়। আমি যে-শহর থেকে এসেছি সেখানে লোকজন জানেই না কেমন করে শব্দ করতে হয়! নীরবতা সেখানে পাথরের মতো ভার হয়ে লোকের বুকে চেপে থাকে। বিড়বিড় করে কেউ কথা বললেও আওয়াজটা কানে খট করে বাজে। গণ্ডগোলে ভরতি এই শহরে ঢোকার পর থেকে মনে হচ্ছে শ্বাসরোধী নীরবতায় জম্বি হয়ে থাকার চেয়ে মাথাখারাপ হট্টগোল বরং ঢের ভালো। শহরটি জৈবিক। জীবনের তাপে সে লেলিহান। আমার নিজের শহরকে এদিক থেকে গরিব মানতে হয়। মানুষের বানিয়ে তোলা সাজানো-গোছানো নীরবতায় সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকে! লোকজন সেখানে এমনভাবে চলাফেরা করে — দেখে মনে হবে দম-দেওয়া পুতুল সব! মানুষের বেঁচে থাকার রকমারি কাণ্ডকারখানা থেকে উৎসারিত গুঞ্জন সেখানে ঘড়ির কাঁটার টিক টিক শব্দে সেকেন্ড-মিনিটের হিসাব কষতে থাকে। আমার কাছে এটা দুচোখের বিষ মনে হয়।

আমি তাই কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। এমন কোনো শহরের খোঁজে বেরিয়েছিলাম যে কিনা প্রচণ্ড সব শব্দ করতে জানে এবং তারা সেখানে ধরাবাঁধা নিয়মের অনুগামী নয়। এই শহরে আমি সেটা খুঁজে পেয়েছি। বিচিত্র আওয়াজ এখানে তরঙ্গিত হচ্ছে এবং তার ধকল সামাল দিতেই বেলা পার হয়ে যায়। ঘটনাটি আমার ভালো লাগতে শুরু করে। অনেকদিন পর কেউ আমার হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ি দিয়ে দুমদুম করে পেটাচ্ছে আর নীরবতায় অবশ সেই হৃৎপিণ্ড এত জোরে চলে যে মনে হচ্ছিল আমি মারা পড়তে যাচ্ছি! মৃত্যুর ঝুঁকি থাকলেও ঘটনাটি বেশ উপভোগ্য। নতুন কিছু হয়ে আমি এখানে জন্ম নিতে যাচ্ছি। সুশৃঙ্খল নীরবতা যাকে আর কোনোদিন অবশ করে দিতে পারবে না। সত্যি বলছি, হট্টগোল বা চিলচিৎকার মাথা ধরালেও শহরটিকে আমি ভালোবাসতে শুরু করি।

খানিক বেলা করে হলেও প্রাতরাশ সারতে রেস্তোরাঁয় ঢুকি। খাঁচাবন্দি টিয়া পাখিরা সেখানেও ঝুলছে! খদ্দের আর ওয়েটারদের হাঁকডাকে তাল দিয়ে বাচাল টিয়াগুলো সমানে চিৎকার করে যায়। রেস্তোরাঁটি মনে হলো শব্দের চাপ সইতে না পেরে এই বুঝি উড়ে যাবে! তেমন কিছু ঘটছে না দেখে নিজেকে আহাম্মক মনে হচ্ছিল। আমার এক বন্ধু আগে শহরটি ঘুরে গেছে। আমি সেখানে যাচ্ছি শুনে বলেছিল, ‘এমন এক শহরে যাচ্ছো যেখানে ঢোকার পর মনে হবে এভাবে এত কিছু সয়ে এটা কেমন করে টিকে আছে! পরে তুমি নিজের ভাবনার জন্য লজ্জা পাবে। কারণ তুমি বুঝে যাবে একবার নরকে পৌঁছে গেলে টিকে থাকা নামে কোনো ব্যাপার সেখানে থাকে না। শহরটি নরক হওয়ার কারণে পতনের ভয় থেকে মুক্ত আর এভাবে চিরজীবী।’

বন্ধুর কথায় উপহাসের আভাস পেয়ে আমার ভালো লাগেনি। এখন, এখানে ঢোকার পর মনে হচ্ছে শহরটি নরক হলেও ভয়ানক নয়। মাথাখারাপ হইচইয়ে সরগরম হলেও তার প্রতি পরতে আবেশ লেগে আছে। সমস্তটা টগবগ করে ফুঁসছে। সে হলো আজদাহা, যার কথা পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে। সে নাকি সব কোলাহল গ্রাস করে ও পরে আবার ফিরিয়েও দেয়। রেস্তোরাঁর নরক গুলজার পরিবেশে বসে আমার ঝিম ধরে। আমাকে গনগনে চুল্লিতে ঢুকিয়ে সেঁক দেওয়া হচ্ছিল আর ক্ষণিক পরে আকরিক-গলানো খাঁটি ইস্পাত হয়ে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসি।

মিথ্যে বলব না, কষ্টকর হলেও নরকযন্ত্রণাটি আমি উপভোগ করছিলাম। এ-রকম শহরে শব্দের তীব্রতা বা মাথা ঘুলিয়ে দেওয়া কোলাহলের নিজস্ব এক চরিত্র থাকে। কানে একবার সয়ে গেলে নীরবতাকে তখন বিষ মনে হয়। আমার ক্ষেত্রে সেটা ঘটছিল। আমি বুঝতে পারলাম শহরের লোকজন নিজেকে এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ঘটনায় ইতোমধ্যে সিদ্ধি লাভ করেছে! হট্টগোল ও চেঁচামেচিকে পাত্তা না দিয়ে কী করে জীবন পার করতে হয় সেটা তাদের শেখানোর দরকার হয় না। আপনা থেকে ওটা তাদের রক্তে ঢুকে যায় ও তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ওই তো সবাই বকবক করছে আর শব্দের মিলিত তরঙ্গ রেস্টুরেন্টের চার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খাঁচাবন্দি টিয়াগুলোর দিকে ছুটছে। টিয়াও বসে নেই। ধাবমান শব্দতরঙ্গের মোকাবিলায় তারস্বরে ‘টিয়া টিয়া’ চিৎকার জুড়ে দিয়েছে সবাই। একে বলে ‘বিশৃঙ্খলা’! বিশৃঙ্খলা স্বয়ং কী করে শৃঙ্খলা বজায় রাখার নিয়ামক হয় সে আমার অজানা নয়। মাথার ওপরে যে-মহাকাশ ঝোলে সেখানে লক্ষ-কোটি তারার দল অযুত শক্তিকণা উগড়ে দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফারিত হয় এখন। সেই বিশৃঙ্খলা থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রাণ নতুন শৃঙ্খলা। আমি আর রেস্তোরাঁকে নরক করে তোলা লোকগুলো অথবা বাচাল টিয়া পাখি, আমরা সকলে হয়ত এভাবে জন্ম নিয়েছি একদিন! আমার মনে হলো এখানে আসার পর আরেকবার নতুন করে আমি জন্ম নিয়েছি!

ক্যামেরা চালু করে ভোজনরত লোকজনের ছবি তুলতে শুরু করলাম। ছবি তোলার ব্যাপারে তাদেরকে যথেষ্ট উদার মনে হলো। আমি ছবি তুলছি দেখে কেউ বাধা দিলো না। আমার হাবভাব ও চেহারা বুঝিয়ে দিচ্ছে আমি আগন্তুক, যে কিনা পেশাদার আলোকচিত্রী হয়ে শহরে ঢুকে পড়েছে এবং তাদের জগৎকে বুঝতে চাইছে। আগন্তুক হিসেবে আমার প্রতি তাদের মনোভাবকে সদয় বলতেই হচ্ছে। আমি তাদের ছবি তুলছি আর তারা পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে পটাপট সেলফি তুলছিল। তারা নিজেকে ক্যামেরায় তুলছে আর আমি তাদেরকে তুলছি; — ঘটনাটি সত্যিই উপভোগ্য!

ছবি তোলা ও খাবারের পালা চুকিয়ে শহরটি ঘুরে দেখার জন্য আমি বেরিয়ে পড়ি। মুঠোফোনের জিপিএস চালু থাকায় শহরের অলিগলি বা দ্রষ্টব্য চিনে নিতে অসুবিধা হচ্ছিল না। ঘুরতে-ঘুরতে কত কী দেখেছি সে-ফিরিস্তি এখন আর দিতে ইচ্ছে করছে না। তারচেয়ে বরং কত রকম শব্দ কানে আসছিল তার বিবরণ মনে হয় আকর্ষণীয় হবে। মোটরগাড়ির ভেঁপু আমার কাছে বিরক্ত লাগে এবং শহরে এর বিলক্ষণ উৎপাত রয়েছে। রিকশা নামের তিনচাকার যানটি মনকাড়া। হাইড্রলিক হর্নের বিকট চিৎকারে ত্রিচক্রযানের ক্রিং ক্রিং শব্দ কানে মধুর গুঞ্জন তুলছিল। মনে হচ্ছিল তারা আমাকে এই শহরে স্বাগত জানাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর মাইকের আওয়াজ কানের দু-পাশে আছড়ে পড়ছে। এই আওয়াজ শুনতে-শুনতে কানে ঝিম ধরে যায়। রাস্তায় ভিড়ের কমতি নেই। লোকজনের দ্রুত ও বিক্ষিপ্ত ছুটোছুটি থেকে যেসব শব্দ কানে ঢুকছিল আমায় বধির করে দিতে তারা যথেষ্ট ছিল।

একজন পকেটমারকে দ্রুত সটকে পড়তে দেখলাম। লোকজন ‘ধর ধর’ শব্দে আশপাশ সচকিত করে তাকে তাড়া করল। উত্তেজনায় মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি সেখানে। পকেটমারকে তাড়া করা জনতার সঙ্গে তাল দিয়ে ‘ধর ধর’ শব্দটি এভাবে মুখস্থ হয়ে গেল! আমি দেখলাম শহরের ব্যস্ত সড়কের অর্ধেক দখল করে এক লোক মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। তার গলায় জোর আছে বোঝা যায়। কণ্ঠস্বর মধুর নয়। কেমন যেন গুমগুম আওয়াজ স্রোতের মতো কানের দু-পাশ দিয়ে ঢুকে পড়ে ও তারপর হুশ করে বেরিয়েও যায়। আমার মনে হলো ঘোর বর্ষায় ব্যাঙের পালকে এভাবে ডাকতে শুনেছি। বক্তার একটি শব্দও বুঝতে পারছি না। তার কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠস্বর সড়কের চারদিকে ছিতরে গিয়ে খানখান ভেঙে পড়ে! অভিজ্ঞতাটি ভালো নয় আবার খারাপ বলাও মুশকিল।

শহরের অলিগলি ধরে হাঁটার সময় আমার কান এভাবে বিচিত্র শব্দতরঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। চাকা ফেঁসে গিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে বসে পড়া গাড়ির শব্দ শুনে চমকে উঠতে হয়। মনে হলো বোমা ফাটছে। লোহা দিয়ে তৈরি জানালার গ্রিল ঝালাইয়ের শব্দ থেকে পোড়া মবিলের গন্ধ বের হচ্ছিল। রকমারি সওদা ভ্যানে চাপিয়ে ফেরিওয়ালারা শহরের চারদিকে চরকির মতো পাক খাচ্ছে। তাদের টানা স্বরের হাঁকডাকের শব্দে কান ঝিমঝিম করে ওঠে। গায়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া মিছিল থেকে কোরাসের শব্দ আসছিল। ওদিকে মাইকে আজানের শব্দ ভেসে আসে। সবজি ও মাছমাংসের মিলিত গন্ধে ভরা কাঁচাবাজারকে পাশ কাটিয়ে আগানোর সময় রগরগে ভোজনবিলাসীর ঢেঁকুর তোলার আওয়াজ কানে ঘাই দিয়ে গেল! গলিরাস্তায় বালকদের ছুটাছুটি, শিশুর একঘেয়ে নাকিসুরের কান্না আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইলেকট্রিকের তারে বসা কাকের ঝাঁক ‘কা কা’ রবে শূন্যে উঠে পড়ে। দোকানপাট ও ঘরবাড়ি থেকে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখিদের ‘টিয়া টিয়া’ শব্দের দাপটে আমি তখন ক্রমশ বধিরতায় গুম হয়ে হাঁটছি।

শব্দতরঙ্গের আবেশ ও উত্তেজনায় পাক খাওয়ার মুহূর্তে গলিরাস্তার মোড়ে এসে আমায় দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। বিকাল তখন শেষ হতে চলেছে। গলির মোড় আশ্চর্য মন্ত্রবলে সুনসান ও নীরব। শহরে ঢোকার পর এই প্রথম নীরবতার দেখা পেলাম। মোড়ের প্রবেশমুখে পেল্লাই সাইজের বাড়ি বেখাপ্পা নীরবতাকে ব্যঙ্গ করছিল। বাড়ির সামনে খাঁচাবন্দি দুটি টিয়া পাখির পাশ ঘেঁষে তিনজন বোরখাওয়ালিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠি। তাদের দু-জন মাঝবয়সী এবং মাঝখানে যে-মেয়েটি দাঁড়িয়ে সে কৈশোর পার করছে এখনো। টিয়া পাখিদের তিনজনের সংযোগ রয়েছে বলে মনে হলো না। এমনকি যে-বাড়ির সামনে তারা দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে তাদের সম্পর্কটি আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হলো। তারা কী ওই বাড়িতে বসবাস করে? কোথাও যাবে বলে বের হয়েছে? যদিও তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে সে-রকম লক্ষণ বা তাড়া নেই। নিশ্চিন্ত মনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেমানান নৈকট্যে পরস্পরের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমায় দেখছে!

পরিধেয় বোরখার সঙ্গে তাদের কেন যেন মানানো যাচ্ছে না। খাঁচাবন্দি টিয়া পাখিগুলোর মতোই বেমানান। একজন ঘাড় ঘুরিয়ে আমার মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে আর অন্যজন সোজা শূন্যে তাকিয়ে থাকে। সব মিলিয়ে বুকের ভিতর আজব ঝড় বইছিল। বোরখাওয়ালিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ঝোঁক আমায় তাড়া করে। হাতের ক্যামেরা দেখিয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিতে চাইলাম আমি তাদের ছবি তুলতে চাইছি। তারা কী ভেবে সম্মতি দিলো জানি না, হয়ত বুঝতে পেরেছিল আমি হচ্ছি সেই আগন্তুক যে এই শহরে ঢোকার পর খাঁচাবন্দি টিয়া পাখিরা যত্রতত্র ঝুলে দেখে প্রথমে অবাক হয়ে যায়! মাথা-ধরানো কোলাহল তাকে দিশেহারা করে তোলে এবং ধাতস্থ হওয়ার পর বোঝা-না-বোঝার প্রহেলিকাগুলো হাতের ক্যামেরা ঘুরিয়ে তুলতেই থাকে। শহরটি আজব চিড়িয়াখানা আর আগন্তুক সেখানে ঘুরছে খাঁচাবন্দি টিয়া পাখি, খামখেয়ালী মানুষজন আর রগরগে উত্তেজনার বারুদে ঠাসা আওয়াজগুলোকে ক্যামেরাবন্দি করার লোভে।

টিয়া পাখির খাঁচা ঘেঁষে বাম ও ডান দিকে আড়াআড়ি দাঁড়ানো দুই বোরখাওয়ালি ক্ষণিকের জন্য মুখের ঊর্ধ্বভাগ অনাবৃত করে। তাদের মাঝখানের মেয়েটি অবনত মুখে দাঁড়িয়েই থাকে। মাঝবয়সী বোরখাওয়ালিদের মুখের রেখায় হাসির আভাস টের পাই। তারা দু-জনে কেন হাসে সেটা বুঝতে পারি না। হতে পারে ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় হাসতে হয়; — পরিচিত এই বিশ্বাস তাদের রক্তে সহজাত। ওদিকে কিশোরী মেয়েটিকে লাজুক ও বিপন্ন দেখাচ্ছে। অবনত মুখ করে নিজেকে ঢাকা দিয়ে রাখে সে। আমার উপস্থিতি হালকা-পাতলা গড়নের মেয়েটির মনে অস্বস্তির জন্ম দিয়ে থাকতে পারে। খাঁচাবন্দি টিয়া পাখিদের দেখে বুঝতে বাকি নেই দিনের-পর-দিন খাঁচায় ঝুলে থাকার চাপ তারা নিতে পারছে না! নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে তারা এখন নির্লিপ্ত হয়ে পড়ছে। চেনা বা অচেনা কোনো মানুষের উপস্থিতিতে তাদের আর কিচ্ছুটি যায় আসে না!

আমি বুঝতে পারছি যা করার দ্রুত করতে হবে। হাসি ও নির্লিপ্তির অদ্ভুত মুহূর্তকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে হাতের ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়। ছবি তোলা শেষ হলে বোরখাওয়ালী ও টিয়া পাখিদের কাছ থেকে বিদায়নিলাম। আমি যখন কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি খাঁচার বামপাশ দখল করে দাঁড়িয়ে থাকা বোরখাওয়ালি তার ঝকঝকে চোখ মেলে আমায় দেখছিল। বিদায় নেওয়ার মুহূর্তে তার গলার স্বরশুনতে পাই। আমায় লক্ষ করে বলছে, ‘তারা দেখে ফেলার আগে এখান থেকে পালাও।’

সে আমায় কেন পালাতে বলে সেটা তখন বুঝিনি। পরে বুঝেছি বিচিত্র শব্দগুঞ্জনের খনি শহরটি খাঁচাবন্দি টিয়া পাখিদের সঙ্গে বোরখাওয়ালিদের শহরও বটে। টিয়া পাখিরা শহরের হালচাল সম্পর্কে নির্বিকার থাকলেও বোরখাওয়ালিরা সেটি এখনো রপ্ত করতে পারেনি। অচেনা আগন্তুক শহরে ঢুকলে মুখের নেকাব সরিয়ে তাকে তারা একপলক দেখে নেবে। বোরখার ফাঁক দিয়ে জগৎ দেখার পিাপাসা তাদের আজো মিটেনি। এখনো তারা হাসে ও অন্যকে হাসাতে জানে। মাথা ঘোরানো কোলাহল উপেক্ষা করে গলির মোড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে জানে। তারা কোথাও যেতে চাইছে কিন্তু ঠিক কোথায় যাওয়া যায় স্থির করতে পারছে না। ছবি তোলার পর মনে হলো বোরখাওয়ালিদের জীবনে এইসব মুহূর্ত এভাবে আচমকা আসে আর তখন তাদের খুব ছবি তুলতে ইচ্ছে করে! তারা তখন ভীষণভাবে চায়, — অচেনা কেউ এসে তাদের লাজুক হাসিমাখা বিব্রত মুখের ছবি তুলতে ক্যামেরা চালু করুক।


ব্যবহৃত আলোকচিত্রের উৎস : The world as seen by legendary photographer Inge Morath; উৎস : pictony.com


অন্তকথা : ইনজেবার্গ হারমিন মোরাথ ওরফে ইনজে মোরাথএর আলোকচিত্র  সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তাঁর স্বামী প্রখ্যাত নাট্যকার আর্থার মিলার বলেছিলেন, — ‘অর্ধশতক ধরে মানুষ ও তাদের বসত ঘিরে সে কবিতা লিখে চলেছে।’ জন্ম-ভ্রামণিক মোরাথ পঞ্চাশের দশক থেকে কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে জীবনের অপার বৈচিত্র্য ও খুঁটিনাটি ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করার নেশায় একা দুনিয়া ঘুরেছেন। মেরিলিন মনরো বা আর্থার মিলারের মতো খ্যাতিমান ব্যক্তি থেকে শুরু করে নামগ্রোত্রহীন মানুষের মুখচ্ছবি ও জীবনযাপনের টুকিটাকি তাঁর ক্যামেরায় স্মৃতিবন্দি হয়েছে। মোরাথের ছবিগুলো যেন-বা মৌন কবিতা! সাদা-কালোর পরিসরে ইশারামুখর এইসব বাক্যহীন ছবি দর্শকের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, আর ওদিকে দর্শককে বাধ্য করে নতুন বাক্য বিরচেনে।

তাঁর আলোকচিত্রের জগৎটি অবিরত কাহিনির আভাস জাগিয়ে নীরবতায় নিজেকে গুম রাখে। মনকে কাব্যভাষার রূপক-প্রতীকের রথে সওয়ার হতে প্রেরণা জাগায়। বিষাদ ও যাতনার বিরাট ব্যাপ্তির মাঝে জীবন উচ্ছ্বল ও রূপময়। মোরাথের ক্যামেরায় এইসব প্রবাহ অনুষঙ্গ বা উপসর্গ রূপে এভাবেই বারবার ফিরে আসে। মেরিলিন মনরোর আবেদনঘন যেসব আলোকচিত্রের সঙ্গে দর্শকের নিত্য সহবাস, তার সিংহভাগের রচয়িতা রূপে মোরাথের নাম ফিরে-ফিরে অনিবার্য হয়। এছাড়াও সাধারণের বিপুল বিশ্ব ও দিনযাপনের তরঙ্গমুখর আলোকচিত্ররা কাহিনি বয়নের কুশলতায় মনকে কৌতূহলী করে রাখে। মোরাথ কেবল ছবি তোলেন না, ছবিকে ঘিরে নতুন বয়ান সৃজনে দর্শককে উসকানি দিয়ে যান। গল্প বা কবিতা লেখায় তিনি কদাপি হাত দেননি কিন্তু তাঁর কাজের ধরনে বুদ্ধিদীপ্ত লেখকের আভাস পেতে অসুবিধে হয় না। জীবনের গল্পগুলো স্থিরচিত্রে স্মৃতিময় রাখবে বলে এই লেখক ক্যামেরা হাতে নিয়েছিল।

রচনালেখ্যে ব্যবহৃত ছবিটি দেশবিদেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানোর দিনগুলোয় তিনি তুলেছিলেন। আজকে স্ট্রিট ফটোগ্রাফি  বলতে লোকে যেমন বোঝে মোরাথ তাঁর দীর্ঘ পেশাদারী জীবনে এ-রকম অসংখ্য ছবি তুলেছেন। সাদা-কালোর মনবাহার কারুকাজের সঙ্গে আলোছায়ার সুষম ব্যবহার ও সেইসঙ্গে দুর্দান্ত ফ্রেমিং আলোকচিত্রটির আবেদনকে আজো অমলিন রেখেছে। যে-জীবনের গল্প সে বলে যায় সেটা প্রথমে সকল মনোযোগ কেড়ে নেয়। দর্শককে অনুমানের রথে সওয়ার হতে বাধ্যকরে। শিল্পকর্ম সার্থকতা লাভ করে যখন রসভোক্তা তাকে নিজের মনের উপযোগী করে ভাবে ও নতুন বয়ানে পাঠ করতে থাকে। এ-রকম মুহূর্তের প্রেরণাবশে বক্ষ্যমাণ রচনাটির উদ্ভব।

বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করি, মোরাথের মূল সৃষ্টির সঙ্গে রচনালেখ্যের মিল বা সাযুজ্য না খোঁজাই উত্তম। মোরাথ তাঁর নিজস্ব দেশকালের পরিসরে বিচরণের ক্ষণে স্থিরচিত্রটি ধারণ করেছিলেন। বর্তমান আলেখ্য চলমান মুহূর্ত ও স্থানকালে তার প্রাসঙ্গিকতা বুঝে নিতে চেয়েছে। কাজেই মোরাথের আলোকচিত্র থেকে প্রেরণা নিলেও রচনাটি তাঁর অনুপম শিল্পীশক্তির প্রতিনিধি নয়। ভবিষ্যতে হয়ত অন্য কোনো দর্শক অনন্যমাত্রিক আলোকচিত্র থেকে সেই রচনা নিষ্কাশন করে নেবেন যা ইনজে মোরাথের শিল্পকর্মের যোগ্য বি-নির্মাণ রূপে পাঠকমহলে নন্দিত হবে।


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you