জন ডেনভারের (John Denver) গোটা-একটা অ্যালবাম আছে ‘অ্যা ক্রিসম্যাস ট্যুগেদার’ নামে, ১৯৭৯-রিলিজড অ্যালবাম, সেখান থেকে একুনে তিনটা গানের বাংলা রাখা হয়েছে এখানে। একদম টায়েটায়ে অ্যালফ্যাবেট মিলিয়ে অক্ষরানুবাদ নয় এগুলো, বলে নেয়া ভালো, মোটামুটি ধার-দূর ঘেঁষে একেকটা আইটেম বাংলায় নামানো কোনোমতে। স্রেফ সিজন-সেলেব্রেইটিং এফোর্ট এসব। মূলের শিরোনাম রইল বাংলাগুলোর সঙ্গে। শিরোনামের বাংলা করা হয় নাই, যেন ‘অরিজিন্যাল মিলিয়ে দেখে’ এগুলো ভোগ করা যায় বা না-দেখে বেমালুম মিথ্যে বলে একটা ধাপ্পাবাজ পড়ুয়াশ্রেণিও বাংলায় বেঁচেবর্তে থাকে সুখে নোয়াপাতি ভুঁড়িটি কেলিয়ে।
যেইটা বলছিলাম যে, ‘অ্যা ক্রিসম্যাস ট্যুগেদার’ অ্যালবামের গান এগুলো, ডেনভারের গাওয়া গান। অন্তত একটা গান তারই লেখা; ‘সাইলেন্ট নাইট, হোলি নাইট’ গানটা, বাকি দুইয়ের একটা অন্য দুই গীতিকারের এবং একটা সম্ভবত ট্র্যাডিশন্যাল স্যং। সম্ভবত বলছি, নিশ্চিত নই; পয়লা গানটা ট্র্যাডিশন্যাল ক্রিসম্যাস-স্যং হতে পারে। অ্যানিওয়ে। গেয়েছেন ডেনভার, কথা এইটাই।
ক্রিসম্যাস ক্যারল তো আছেই, ক্রিসম্যাসের সময় আলাদাভাবে অ্যালবাম রিলিজ করার চল ইংরেজিগানে আছে, এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিল, বর্তমানে কেমন অবস্থা তাকাইয়া দেখি নাই। ইউটিউবযুগে তো রোজই মিনিটে মিনিটে গান বাইরায় একেক শিল্পীর। ফলে সেভাবে থ্রিলটা আলাদা থাকার কথা না ক্রিসম্যাস বা সিজন্স গ্রিটিংকালে। অ্যালবাম খরিদ করিয়া গান শোনা বাংলাদেশগেরাম থেকেও উধাও হয়েছে সেই কবে!
ডেনভার নয় কেবল, সকল স্টলোয়ার্ট শিল্পীদেরই ক্রিসম্যাসগান আছে রেকর্ডেড। সেসবের ভিতরে ট্র্যাডিশন্যাল যেমন আছে, তেমনি বিস্তর মৌলিক গানও রয়েছে সিঙ্গার-স্যংরাইটারদের নিজেদের কম্পোজিশনে। লেননের, ডিলানের, কোহেনের এবং চেনা-অচেনা আরও অসংখ্যজনের। এইখানে শুধু জন ডেনভারের তিনটা গান রইল বাংলায়। অ্যালবামটাতে আরও ডজনখানেক গান রয়েছে, পেনড্ বাই ডেনভার বা ট্র্যাডিশন্যাল বা আর-কারো রচনায়। অ্যানিওয়ে। প্যারান্তরে যাই।
ঈদে, পূজায়, ক্রিসম্যাসে টেলিভিশনের সেটে এক-ধরনের সংগীতানুষ্ঠান হতো, — বলছি বিটিভিযুগের কথা। আজও হয় কি না তার খোঁজ রাখি না। বাজারে কি বিটিভি আছে এখনও? তো, ওইসব অনুষ্ঠানে অ্যাডাল্ট এবং শিশুকিশোর শিল্পীদেরকে নাচগান করতে দেখতাম। উৎসব উপলক্ষ্য করে একটা আনন্দফুর্তির বিনোদনব্যবস্থা। খারাপ লাগত না। আজও মনে হয় না খারাপ লাগবে দেখতে পেলে। এখন জীবন যেমন, টেলিভিশনটিশন দেখা হয় না। ছায়াছবি কিছু দেখা হয় মাঝেমধ্যে নেটদৌলতে। এবং ঈদে-পূজায়-ক্রিসম্যাসে একটা ভালো অবকাশ তো পাওয়া হয়েই যায় মালিকের ঘরে মাসোহারা মাইনের কাজে। এবং তখন আরও বেশি গৃহবন্দী নিদ্রায়-তন্দ্রায় সিনেমাসানেমা দেখেই আয়ু ফুরায়। কিন্তু একদিন ছিল যখন আমরা টেলিভিশনে সেঁটে রাখতাম চোখ, অবকাশকালে, ইশকুলবন্ধের দিনগুলোতে। এবং দেখতাম যত-সমস্ত বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের নামে দায়সারা গানের প্রোগ্র্যামস্। তবু অনুষ্ঠানগুলোর সুবাদে বেশ-দুইয়েকটা ভালো উৎসবগানও পাওয়া যাইত। বর্তমানে ট্রেন্ডটা আগের ন্যায় পালে হাওয়া পায় না বলেই মনে হয়।
কেবল টিভিশো নয়, অ্যালবাম বেরোনোর মোচ্ছব লেগে যেত পরবে-ফেস্টিভ্যালে। সেসব অনুষ্ঠান বলি বা অ্যালবাম বলি, ঠিক যে-ধরনের গান থাকত, দুইটা ক্যাটিগোরিতে ফেলা যায় গানগুলো। এক হচ্ছে যেগুলোকে বলে রেগ্যুলার গান, আরেক হচ্ছে যেগুলোকে বলা যায় উৎসবকেন্দ্রী। ঈদে যেমন ‘মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ’ ইত্যাদি গানের আদলে ঈদের মাহাত্ম্য-বর্ণনাকারী বিস্তর গান, ঐশী বিধানব্যবস্থার পাশাপাশি রিচ-পিয়্যপলের সঙ্গে ভেদাভেদহীনতার জিকির-তোলা গরিব-মিসকিনের সাম্যবাদস্তুতি ইত্যাদি; ঠিক একইভাবে দুর্গাপূজায় নানাবিধ ভজন-কীর্তন; পূজায় এবং ক্রিসম্যাসে এদেশের টিভিতে এক-দেড়দিনের মেয়াদে এক-দুইটা গানের অনুষ্ঠান হতো বটে; সেখানে মহিষাসুরমর্দিনীর বীরত্ব এবং জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতায় ক্রাইস্টের রক্তাক্ত পরিণতি ইত্যাদি নিয়া নাটিকা থাকত, নাটিকার ফাঁকে ফাঁকে বেশকিছু ভক্তিগীতিও। সংক্ষেপে এইটুকুই স্মৃতির বিবরণী।
ক্রিসম্যাসের তিনটা গানের বাংলা প্রার্থনাটুকু সমস্ত ভুবন জুড়ে, ব্যক্তি-গোষ্ঠী-আস্তিক-নাস্তিক সকলের তরে, সত্য হউক। প্রত্যেকে আমরা পরের তরে, — এই নীতিপদ্যপঙক্তির বাংলা মানেটাও মনে একবার অকেশন্যালি উঁকি দিক। সমাজ ও রাষ্ট্র হোক একান্তভাবে ঐহিক। পুনঃপুনঃ নতুন বছরের প্রাক্কালে একবার অন্তত কায়মনোবাক্যে এইসব পরহিতবাসনার কথা আমরা যেন উচ্চারিয়া যাই, নিজেরই জন্যে, যেন নিজেরেই আরেকবার মনে করায়ে দেই।
__________________
ক্রিসম্যাস ট্যুগেদার
তিনটা গানের বাংলা :: জন ডেনভার
দি ক্রিসম্যাস উয়িশ (The Christmas Wish) ।। সাইলেন্ট নাইট, হোলি নাইট (Silent Night, Holy Night) ।। হ্যাভ ইয়োরসেল্ফ অ্যা মেরি লিটল ক্রিসম্যাস (Have Yourself A Merry Little Christmas)
অ্যালবাম : অ্যা ক্রিসম্যাস ট্যুগেদার
প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৯
বাংলায় ভূমিকা ও তর্জমা : জাহেদ আহমদ
____________________________
দি ক্রিসম্যাস উয়িশ
জানি না তোমার আছে নাকি নাই ক্রিসম্যাসে বিশ্বাস
উপহার রাখা আছে নাকি নাই ক্রিসম্যাসগাছতলায়
আস্থা তোমার থাকে যদি শুধু অশর্ত ভালোবাসায়
তাহলেই হবে এসো দুইজনে সেলিব্রেইট করি ক্রিসম্যাস
ভালোবেসে যেই বিনিময় তা-ই অমূল্য প্রীতিউপহার
দরিশন আজও করি নাই নিশার আকাশে খ্রিস্টতারকার
যদিও উজালা আলোর ফোয়ারা, তারাগুলো পোড়া দাগ
ভস্মবক্ষ তবু উছলায় যেনবা আলোর ফাগ
ক্রিসম্যাস হলো পরস্পরের কাছে আসবার মরশুম
ভেদাভেদ ভুলে হৃদয়ে-হৃদয়ে মেলা বসানোর ধুম
দুইহাত প্রসারিয়া আমিও তো দূরেরে নিকটে ডাকি
ক্রিসম্যাসে আমি নিকটজনেরে প্রেমডোরে বেঁধে রাখি
যেই মন্ত্রটা বাঁধিয়া রেখেছে একত্রে আমাদেরে
সত্যের সেই সহজ মন্ত্র মুনাজাত হয়ে ফেরে
এই মুনাজাতই চিরবরাভয় চিরশান্তির ধারা
ভালোবেসে যাও বছরজুড়িয়া হইয়া আত্মহারা
জানি না তোমার আছে নাকি নাই ক্রিসম্যাসে বিশ্বাস
ক্রিসম্যাসগাছতলায় কেবল শোনো এই ফিসফাস :
আসছে বছরে আসুক শান্তি ঘুচুক জরা ও মারী
বয়ে যাক এই বিপুলা ভুবনে ব্যাপক শান্তিবারি
সাইলেন্ট নাইট, হোলি নাইট
নিশ্চুপ রাত, পবিত্র রাত
প্রশান্ত লোকালয় আলোর প্রপাত
গরবিনী মাতা মেরি আর তার পুত
খড়ের গাদায় দ্যাখো শিশু দেবদূত
স্বর্গের আভা নিয়ে সেই শিশুঘুম
চক্ষু চুমিয়া যায় তারার কুসুম
নিশ্চুপ রাত, পবিত্র রাত
ঘুম থেকে মেষপাল জেগেছে হঠাৎ
তারাদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক
দৈব আভায় ভেসে যায় চারিদিক
খোয়াবের মতো দ্যাখো ঐশী বাথান
দল বেঁধে দেবদূত গায় সামগান
“ধরাধামে এসেছেন সদাত্রাতা প্রভু
ছাড়িয়া না-যাইবেন আমাদেরে কভু”
নিশ্চুপ রাত, পবিত্র রাত
স্রষ্টার পুত্র, প্রেমসওগাত
মুখে তার ফোটে দ্যাখো অবাক আলোক
সঙ্গে শিশুর হাসি মমতার চোখ
বহিছে শান্তিবায়ু স্বর্গীয় সুর
লোকালয়ে ভাসে মুখ স্বয়ং যিশুর
হ্যাভ ইয়োরসেল্ফ অ্যা মেরি লিটল ক্রিসম্যাস
শুভ বড়দিন জানাও সকলে, দাও হৃদয়ের জ্যোতি
ঘুচে যাক যত বালামুসিবত দূর হোক ক্ষয়ক্ষতি
শুভ বড়দিন জানাও সকলে, আলোয় ভুবন ভরুক
শোকতাপ সব দূর হয়ে যেয়ে সকলের ভালো হোক
পুরাতনী সেই দিনের মতন সোনালি আলোর রেখা
আবার সকলে একত্র হব রইব না কেউ একা
কপালে লিখন কি আছে জানি না, জানি কথা একটাই
মিলিব সকলে একদিন ঠিকই, মিলনেরই গান গাই
মিলনের গানে গলা মিলাইয়া গাহি ক্রিসম্যাসগীতি
ঘৃণার গরল দূরেতে ঠেলিয়া কাছে ডাকি সম্প্রীতি
শীতের রাত্রে মিটমিটে তারা ঝুলে আছে উঁচা ডালে
মেরি ক্রিসম্যাস বলো সমস্বরে বৃন্দগানের তালে
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS