আমাদের ছোটবেলায় আমরা জানতাম পদ্মফুল মা পদ্মাবতী বা মনসার প্রিয় ফুল। মা পদ্মাবতী বা মনসা যিনি সকল সাপের অধিপতি বা সর্পমাতা নামেই পরিচিত। পদ্মাবতী বা মনসাকে নিয়ে পদ্মপুরাণ বা মনসামঙ্গল খুব পুরাতন কাব্যগ্রন্থ নয়। মনসা ও চাঁদ সওদাগরের কাহিনি আবহমান বাংলায় খুবই জনপ্রিয়। চাঁদ সওদাগর মনসাকে দেবী বলে মেনে না নেওয়ায় মনসা বিষধর কালনাগ দিয়ে চাঁদ সওদাগরের সাত পুত্রকে ধ্বংস করেছিলেন। চাঁদ সওদাগরের সকল বাণিজ্যিক তরী সাগরে ডুবিয়েছিলেন। কিন্তু শিবের আশীর্বাদপুষ্ট চাঁদ সওদাগর তবুও মনসাকে দেবী বলে স্বীকৃতি দেয়নি।
চাঁদ সওদাগরের সর্বশেষ পুত্র লখিন্দর। বেহুলার সাথে বিবাহের দিনেই মনসা তাকে বাসর ঘরে কালনাগের দংশনে হত্যা করবেন বলে ঘোষণা দেন। চাঁদ সওদাগর খুবই সতর্কতার সাথে বিবাহকার্য সম্পাদন করেন। সেইসাথে চাঁদ সওদাগর এমন একটি যজ্ঞের আয়োজন কর, সেই যজ্ঞের প্রভাবে পৃথিবীর সব সর্প উড়ে উড়ে এসে আগুনে পড়তে থাকে। অনেক ছলনা করে শিবকে বশ করে মনসা সেই যজ্ঞ বন্ধ করতে সমর্থ হন।
এবার বাসর ঘরের পালা। চাঁদ সওদাগর লোহা দিয়ে বাসর ঘর বানালো ছেলের জন্য। কিন্তু যে কর্মকার লোহার বাসর ঘর বানালো সেই কর্মকারকে মনসা তার সর্পবাহিনী নিয়ে শাসিয়ে গেলেন। মনসার আদেশ লোহার বাসর ঘরে ফুটো রাখতে হবে। অপরদিকে লোহার বাসর ঘরে ফুটো রাখলে চাঁদ সওদাগর মারমারকে কাটকাটকে কুত্তা ম্যায় খাইয়ে দেবে। অবশেষে বুদ্ধি বের করে কর্মকার একটা ফুটো রাখল বটে, সেটা ঢেকে দিলো পাতলা লোহার আস্তরণে।
বিষধর কালনাগের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে পাতলা লোহার আস্তরণ গেল উড়ে। কালনাগ লখিন্দরের বাসর ঘরে। ঘুরছে আর কাঁদছে। কি করে শিবের বরে জন্ম-নেওয়া এমন সুন্দর পবিত্র সদ্যবিবাহিত লখিন্দরকে সে দংশন করবে! বিধি বাম। হঠাৎ করে বেহুলার শাড়ির আঁচলে লাগল নিভুনিভু প্রদীপের পোড়াতেল। প্রদীপ গেল নিভে। এবং সেই পোড়াতেল-লাগা শাড়ির আঁচল লাগল লখিন্দরের গায়। শরীর হলো অপবিত্র আর সেই সুযোগে বিষাক্ত কালনাগের উপর্যুপরি দংশনে নীল হলো লখিন্দরের নধরকান্তি শরীর। যদিও সতী বেহুলার অসাধ্য সাধনে বেঁচে উঠেছিল মৃত লখিন্দর। সেই থেকে শুরু হলো মনসাপূজার প্রচলন, যা আজ অব্দি বাংলার হিন্দু গৃহস্থরা বাংলা শ্রাবণ মাসের শেষ তারিখে মনসাপূজা করে থাকেন।
এই হলো আবহমান বাংলার মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের কাহিনি। যতটুকু ধারণা করতে পারি আমাদের এই গাঙ্গেয় বদ্বীপের সহজসরল মানুষেরে সর্পাঘাত থেকে বাঁচানোর কেউ ছিল না। যেমনি করে গাজীকালু, বনবিবি সহ নানা ধরনের মিথোলোজির সৃষ্টি হয়েছে কালে কালে, তেমনি মনসামঙ্গলও একটি প্রাচীন কাহিনি। মনসামঙ্গল নিঃসন্দেহে একটি দুর্দান্ত কাব্যগ্রন্থ। তবে মনসামঙ্গলের সবচেয়ে বাস্তব রূপ হচ্ছে মনসা নিজেকে জোর করে দেবী বলে স্থাপন করার বিষয়টা। চাঁদ সওদাগরকে নানাভাবে নাস্তানাবুদ করে অবশেষে তিনি তার দেবিত্বের সম্মান আদায় করেছিলেন, যা আজকের সমাজে খুবই চোখে পড়ে। বিষয়টা এমন যে ধর্ম মানতে হবে না-হলে চাপাতির কোপ। ধর্ম মানতে হবে না-হলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেবো। বশ্যতা স্বীকার করতে হবে না-হলে সাগর ডিঙিয়ে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের যারা কখনোই বাঁচেনি।
তবে আমাদের শৈশবে-কৈশোরে মনসাপূজা ছিল অন্যতম আনন্দের খোরাক। আমরা ছোটরা মিলে মনসার চাতলের জন্য স্টেজ বানাতাম। চাতলা হলো কুমোরের তৈরি মনসার এক ভিন্ন ধরনের অবয়ব। একটা মাটির কলসের উপরে নারকেলের মালার মতো মাটির বল দিয়ে কুমার বানাত সর্পদেবীর মস্তক, আর কলসের দুইপাশে ফুটো করে কাঠির উপরে সর্পমস্তক দিয়ে তৈরি করত দেবীর হাত। পুজোর আগের দিন সন্ধ্যায় বেতের নতুন টুকরিতে চাতল বসিয়ে মস্তকে করে দেবীকে নিয়ে আসা হতো। পুজোর দিনের জন্য আমরা কলাগাছ কেটে তোরণ বানাতাম, সেই কলাগাছের তোরণে রঙিন কাগজ কেটে ঝাঝর আর তিনকোনা করে রঙিন কাগজ কেটে আঠা দিয়ে সুতোয় লাগিয়ে তৈরি হতো লেইস। নাগেশ্বরগাছের বিচি শুকিয়ে বাঁশের কাঠির মধ্যে গাঁথা হতো। তারপরে সামান্য কেরোসিনতেলে চুবিয়ে আগুন ধরিয়ে মশালের মতো সেই কাঠি গেঁথে দেওয়া হতো কলাগাছের তোরণে। মধ্যরাত পর্যন্ত চলত পয়ার ছন্দে মনসামঙ্গল পাঠ। শ্রাবণ মাসের শুরুতে পড়া শুরু হওয়া মনসামঙ্গল পুঁথির পূর্ণা দেওয়া হতো সেই রাতে। যে-অংশে বেহুলার নৃত্যকলায় মুগ্ধ হওয়া স্বর্গের দেবতাদের অনুরোধে মনসা আবারও জীবনদান করেন লক্ষ্মীন্দরকে। আবহমান বাংলার সতীসাধ্বী বেহুলারা সেই থেকে আর কোনোদিনই বিধবা হন না।
শ্রাবণী পুজোর দুপুরবেলা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে কচুরমুখি, কাকরোল, আউশা লাউ আর পুঁইডাটা দিয়ে মুগডালের খিচুড়িতে যখন লোহার হাতা গরম করে মা সর্ষেতেলে শুকনো মরিচ আর পাঁচফোড়ন দিয়ে ছোঁক দিতেন তখন খিচুড়ির সসপ্যান জুড়ে শুরু হতো আমছৈল। মনে হতো শ্রীকৃষ্ণ কালীয় নাগ দমন করতে কদমবৃক্ষ থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন কালিন্দীর জলে। তারপরেই ঢেলে দেওয়া হতো ঘরে-প্রস্তুত খাঁটি গাওয়াঘি। আমাদের একান্নবর্তী উনুনের চারদেয়াল ভেদ করে মৌ মৌ সুবাস ঘুরপাক খেতো আমাদের গোটা প্রাগৈতিহাসিক বাস্তুভিটার চারপাশে।
কাকরোলকে সেদ্ধ করে মাঝের মালমশলা চামচ দিয়ে তুলে নিতেন মা৷ পড়ে থাকত শুধু কাকরোলের নৌকা। সেই তুলে-নেওয়া মালমশলা সর্ষেবাটা হলুদ-মরিচ আর লবণ দিয়ে মেখে আলতো ভেজে বোঝাই করা হতো সেই কাকরোলের নৌকায়। ভেজানো চাল আর ডাল পাটায় পিষে হালকা হলুদ-লবণ মাখিয়ে পোস্ত দিয়ে বোঝাই করা কাকরোলের নৌকো সিলগালা করে মচমচে ভাজা হতো তেলে।
পেঁয়াজ ছাড়া কালোজিরা দিয়ে ডালবাটা মেখে তৈরি হতো ছোট সাইজের ডালের বড়া। সেই বড়া দিয়ে তৈরি হতো আলুপটলের আচানক সোয়াদঘন ঝোল। হতো কাঁঠালবিচি দিয়ে নালীগিট্টু। নালীশাক হলো পাটশাকের আরেক নাম। পাটশাকের কচি মাথা তুলে এনে হাতের তালুতে তেল মেখে সেই কচি মাথা রোল করে দেওয়া হতো গিট্টু। তেল মাখার কারণ হলো তাতে সহজে গিট্টু দেওয়া যায়। এবার সেই গিট্টুগুলোকে সেদ্ধ দেওয়া হলো। তারপরে শুকনো খোলায় খোসা সহ কাঁঠালবিচি ভাজা হলো। সেই ভাজা কাঁঠালবিচির খোসা ছাড়িয়ে কেটে সেদ্ধ করা হলো। ভাজার কারণে সুন্দর একটা গন্ধ লেগে থাকত অনেকটা বরুণার বুকের সুগন্ধি রুমালের মতো। এরপরে পাঁচফোড়ন আর ঘন সর্ষেবাটা দিয়ে তৈরি হতো রসনা বশের ব্রহ্মাস্ত্র নালীগিট্টু। সাথে থাকত চৌকো করে আলুভাজা, বরাক উপত্যকার নামজাদা গন্ধজামির বা জাড়ালেবু আর শেষপাতে পায়েশ।
চেরাপুঞ্জির ওপারে সিলেট অঞ্চলের চিরায়ত বাদলি তখনও চলছে। থামার নাম নেই। আমরা সব কাজিনরা আমাদের বিশাল টংঘরে (পুরানো দিনে বিচারকার্য হতো যে-ঘরে) নানা ধরনের খেলাধুলার ফাঁকে ক্রমাগত চোখ রাখছি কখন কাঁসর বাজবে আর মা মনসার ভোগ লাগবে। কাঁসর বাজার শব্দ শোনা মাত্রই মা মনসাকে প্রণাম করে শুরু হতো খাবারের উপর আমাদের বৃহৎপরিবারের আক্রমণ।
এসব ছোট ছোট উদযাপনের সমষ্টি জীবন। একজীবনের ছোটখাটো না-পাওয়াকে স্টুয়ার্ট ব্রডের বল মনে করে যুবরাজের মতো হাঁকিয়ে মাঠের বাহিরে ফেলে আনন্দস্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবন। এভাবেই বেঁচে থাকি, এভাবেই স্মৃতিরা বেঁচে থাকাকে আনন্দময় করে তোলে।
বাই দ্য ওয়ে, আজ লন্ডনের মাটিতে আসন্ধ্যা বাদলি ঝরছে। আজকে লন্ডনের বৃষ্টিস্নাত দুপুরে কাকরোলের পুর, ফুলকপির পাকোড়া, আলুভাজা আর ছোঁক-দেওয়া খিচুড়ি মায়ের হাতের মনসাপুজোর অপরূপ স্বাদের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। একনিমেষে চলে গেলাম মনসাপুজোর দিনগুলোতে। ছোঁক-দেওয়া খিচুড়িতে হলো রসনা বশ। আর মনের মধ্যে বাজছিল বিজয় গুপ্তের লেখা মনসামঙ্গলের পয়ার ছন্দের পঙক্তিমালা …
তুমি চলি যাও কোথা আমারে ফেলিয়া হেথা
হেথা রব আর কি সাহসে
মনসাচরিতগীত শুনিলে সে সুললিত
গাইলেন মনসার দাসে।।
… …
- দিবারাত্র দুর্গাপুজো || অসীম চক্রবর্তী - October 5, 2019
- ঠাকুরবন্দনা || অসীম চক্রবর্তী - August 9, 2019
- জলধামাইল || অসীম চক্রবর্তী - August 1, 2019
COMMENTS