কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ৪ || জয়দেব কর

কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম ৪ || জয়দেব কর

শেয়ার করুন:


অতীত নিয়ে অনুতাপ আর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা করে দিন কাটলে বর্তমান আর থাকে কই। জন্মান্তর ভাববাদীদের আশ্রয়, যাদের কোনও বর্তমান নেই। বর্তমানের মধ্যে থাকতে পারলে কোনও অনুতাপ অথবা শঙ্কার জায়গা হবে না। ‘বর্তমান’ থেকে বিচ্যুত হলে অনুতাপ-শঙ্কাই বর্তমান হয়ে ঘাড়ে চেপে বসে রক্তপিপাসু দানবের মতো।


পুঁজিবাদ ও মৌলবাদের নিকট নতজানু রাষ্ট্রে সমাজ তো মূল্যবোধহীন মানুষ তৈরি করবেই। এটাই স্বাভাবিক। তেঁতুল হুজুর, ইয়াবা বদী, শেয়ারবাজারের দরবেশ এসব নিয়ে চলছে বেশ!

তেঁতুল তত্ত্ব বাস্তবায়ন করছে যারা তারা কারা? ধর্ষক না রাষ্ট্র?


গ্রন্থদাস আস্তিক ও নাস্তিক দু-দলই বিপজ্জনক।


বাউল বাংলার নিজস্ব ধর্ম। এর আরেক নাম সমন্বয়। এই পরমতসহিষ্ণু মতবাদ যদি রাষ্ট্রধর্ম হয় তবে রাষ্ট্রধর্ম শব্দটি কিঞ্চিত যৌক্তিকতা লাভ করে।


আমাদের সংস্কৃতি ইরান-তুরানের দান নয়। চর্যাপদ আমাদের নিজস্বতার জ্যান্ত গোলাপ।


গোলাপের সৌরভকে কিন্তু জবার সৌরভ বলা যাবে না। কারণ উৎসগতভাবে তারা ভিন্ন। ঠিক এই জায়গায় সংস্কৃতি বাগানের মতো।


যৌনতাবাজারে নারী পণ্য। পুরুষ দোকানদার নাহয় খদ্দের।


উচ্চম্মন্যতা ও হীনম্মন্যতা—দুটোই মানসিক অসুস্থতা।


মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মানুষের বিকাশের সাথে সাথে মানবমনের দুইটি ধারা ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। এ দুইটি ধারাকে নামকরণ করা যায় ‘সু’ ও ‘কু’ বলে। ‘সু’ ও ‘কু’-এর দ্বন্দে ‘কু’-এর আধিপত্য দুনিয়াজুড়ে। সমাজ-রাষ্ট্র ‘কু’-দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সারাবিশ্বে। ব্যক্তিমানুষ অনেক সময়ই হয়তো ‘কু’ থেকে মুক্ত হচ্ছেন তবে তাতে করে সমাজ-রাষ্ট্র মুক্ত হচ্ছে না। বরং দিনের পর দিন ‘কু’-এর উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে সবখানে। ‘কু’-এর সবচাইতে শক্তিশালী খুঁটি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ-উপকরণ, যার সবচাইতে ভয়াবহ উদাহরণ হচ্ছে পারমাণবিক অস্ত্র। এত অস্ত্রের তো প্রয়োজন ছিল না মানুষের। অস্ত্রের প্রয়োজন মানুষের ততদিনই ছিল যতদিন মানুষকে হিংস্র পশুর সাথে লড়াই করে টিকতে হয়েছিল। প্রকৃতির এই ভয়াবহ শক্তিপরীক্ষার অধ্যায় মানুষ পেরিয়ে এসেছে অনেক আগেই। আগে মানুষ বাধ্য ছিল অস্ত্র ধরতে। এখন মানুষ বাধ্য নয়, এখন অস্ত্র ধান্দার জন্য ধরে। এই ধান্দার নাম পুঁজি।


একজন প্রাজ্ঞ আলোচক যদি কোনও বিষয়ে সমালোচনা করতে যান, অবশ্যই তিনি তার নিজস্ব কৌশলে অগ্রসর হন। তবে তিনি যেভাবেই তা করেন না কেন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করতে হলে অবশ্যই একটি মৌলিক নীতিকে আশ্রয় করতে হবে। তার আলোচনা অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্টতা থেকে মুক্ত থাকতে হয়। তাকে স্তুতি ও নিন্দার পথ ছেড়ে বিষয়ের যথার্থ স্বরূপ নির্ণয় করতে হয়। বিষয়ের গভীরে না গিয়ে স্তুতি ও নিন্দা করা মূলত অপরিপক্কতা অথবা ধূর্ততার দরুণ ঘটতে পারে। কোনো বিষয় যদি সুন্দর বলতে হয় তবে যুক্তি ও তথ্য সহ বলতে হয়। ঠিক তেমন, অসুন্দর বলতে গেলেও একই পন্থা নিয়ে বলতে হয়। এবং মনে রাখা জরুরি, যে-বিষয় নিয়ে কথা বলা হচ্ছে তার ভিতরের ভালো-মন্দ বের করাই সমালোচকের কাজ। এই সাধারণ জ্ঞান যার নেই তিনি সমালোচনা নামক শিল্পের ভুবনে নিতান্ত অন্ধের হাতি-দর্শনের মতো ঘটনা ঘটাতেই পারেন!


বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করতে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন তা আমাদের ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকদের নাই। তাই সংসদ বসিয়ে সুবিধামতো কাটাছেঁড়া করতে হয়। এটি পঁচাত্তর-পরবর্তী সকল শাসকগোষ্ঠীর স্বভাব।


নন্দনতত্ত্ব মাস্টারদের বিষয়, কবির নয়। তত্ত্ব মেনে মাস্টারি সম্ভব, নন্দনচর্চা নয়। নদী দেখতে চোখ লাগে, দূরবীন নয়।


বাগানের মালি গাছের গোড়ায় জল ঢালেন প্রয়োজনমতো, আগাছায় নয়। আগাছা উপড়ে ফেলেন, বৃক্ষ নয়। নির্বোধ ক্ষমতাপূজারীরা তা বোঝেন না কেন?


পরিবর্তনশীলতা নিজের মধ্যে যেমন বিদ্যমান তেমন বিদ্যমান তোমার পারিপার্শ্বিকতায়ও। কিন্তু বাইরে তাকাও হয়তো ঘনঘন, ভেতরের খবর কি নাও কখনও নিবিড়? ভেতর ও বাইরের স্রোত দেখো বয়ে যায় একই ছন্দে, একই লয়ে। তুমি কেবল এক তুখোড় বাঁশিওয়ালা।


রাষ্ট্র তোমাকে বদলে যেতে দেয় না। তাই প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে আঁতাত করে তোমাকে দমিয়ে রাখে। আর রাষ্ট্রের মালিকানা থেকে করে পুরোপুরি বঞ্চিত। কিন্তু তুমি তো মানুষ—‘ধ্বংস হতে পারো, পরাজিত কখনও নয়’।


লিখিত কথাগুলো যে-কোনও লেখা থেকে পড়া ও বলা খুব সহজ হতে পারে। ওখানে যে-কথাটি লিখিত হয়নি, গুপ্ত বা সুপ্ত সে-কথাটি উদ্ধার করে প্রকাশ করতে কিন্তু এক বিশেষ দৃষ্টির অধিকারী হতে হয়—আর এ দৃষ্টিটির নামই বোধহয় শিক্ষা!


ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী সকলেই বিশ্বাসরোগে আক্রান্ত।


নিজের ধারণায় বদ্ধমূল মানুষের সাথে আলোচনা নিষ্ফল। ভরা পাত্রে আপনি যতই জল ঢালবেন ততই উপচে পড়ে যাবে।


প্রাচ্যের বস্তুবাদকে ভাববাদ বলে সাব্যস্ত করে দেয়া বন্ধুগণ মূলত পাশ্চাত্যের চিন্তাদাস এবং জন্মগত হীনম্মন্য। এই কারণেই প্রাচ্যদেশীয় অধিকাংশ বস্তুবাদীর নিয়তি হয় শেষজীবনে ঘোরতর ধার্মিক হয়ে ওঠার।


কিছু বামপন্থী আছে যারা কথায় কথায় ‘ভাববাদ’, ‘বস্তুবাদ’, ‘বুর্জোয়া’, ‘প্রলেতারিয়াত’ এই সমস্ত শব্দ প্রয়োগ করে এক বিশেষ আবহ তৈরি করতে চায়। মাঝে মাঝে অমুক রায় তমুক পালের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজেকে মার্ক্সের সমতূল্য করে তুলতে চায়। লালন হাছনকেও তারা ভাবনাশত্রু মনে করে। এদের আমার বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই মনে হয়, যারা সাঁতার জানে না কিন্তু নৌকার মাঝির সাথে খুব বিদ্যার বাহাদুরি করে।


আধুনিকতা কোনও কালের নাম নয়, বোধের নাম, যা জড়িয়ে আছে মানবিকতার সাথে। একটি কাল তখনই আধুনিক বলে চিহ্নিত হতে পারে যখন ঐ কালের অধিকাংশ লোক মানবিকতার চর্চাকে জীবনের পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে।


কথাফুল অথবা ফুটন্ত ম্যাক্সিম পর্বগুলো
জয়দেব কর রচনারাশি
গানপার সদুক্তিনিচয়

শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you