মানুষের পৃথিবীতে রাক্ষসের উপস্থিতি একদিন স্বাভাবিক ছিল বলে ইতিহাসে লেখে। অনেকে এতে আপত্তি তোলেন। তাদের মতে ওটা ইতিহাস নয় বরং জল্পনা নামে ডাকা সংগত। সভ্য হওয়ার পর থেকে মানুষের যে-ইতিহাস সেটি হরকিসিমের বিবরণে ঠাসা হলেও রাক্ষস প্রজাতির সুলুক সেখানে মিলে না। অগত্যা রাক্ষসের তালাশ পেতে জল্পনা একমাত্র ভরসা। জল্পনার সেই ইতিহাস জানায় মানুষ নাকি একসময় রাক্ষসভাবিক ছিল। মানুষের সঙ্গে রাক্ষসের মিলমিশ নিয়ে যারা মাথা ঘামান তাদের মাঝে দাবির সত্যতা নিয়ে বিস্তর মতভেদ অবশ্য চোখে পড়ে। কে রাক্ষস আর কে নয় সে-নিয়ে ঝগড়া-ফ্যাসাদ জল্পনার ইতিহাস ঘাটলে হাজারে-বিজারে মিলে। সেই ইতিহাস লেখে রাক্ষসরা বন্য প্রজাতি। তারা বিকট। মানুষের দেহ ধারণ করলেও ঠিক মানুষ নয়। তাদের কুলোর মতো কান। মূলোর মতো দাঁত। চোখ দুটি ইটের ভাটা হয়ে সারাক্ষণ জ্বলছে। রাক্ষসরা অসভ্য। কাঁচা মাংসে খিদে মেটায়। সুযোগ পেলে মানুষ ধরে খায়। মানববসতির বিস্তার বাড়লে সেখান থেকে পালায়। ঘন অরণ্য বা দুর্গম দ্বীপে আশ্রয় নেয়। গুহায় তাদের দিন কাটে। দিনের অর্ধেক শিকার খোঁজে। বাকি অর্ধেক ঘুমিয়ে কাটায়। রাতে রাক্ষসরা পারতপক্ষে বের হয় না, তবে মানুষের গন্ধ পেলে নিশাচর হয়ে পড়ে। মানুষ খেতে ওরা খুব পছন্দ করে। তাদের দেহে প্রচণ্ড শক্তি। দুই আঙুলে মানবছানাকে চেপে ধরে মুখে পুরতে সময় লাগে না। একবার মুখে ঢুকালেই হলো, তারপর কড়মড় করে চিবিয়ে খায়।
জল্পনা এভাবে রাক্ষসকে মানুষের থেকে আলাদা প্রজাতির মহিমা দান করেছে। বানরকুলের সঙ্গে মানুষের বংশগতির মিল রয়েছে বলে বিজ্ঞান দাবি করে। তা-বলে বানর ও মানুষ এক বস্তু নয়। মস্তিষ্কের বিকাশ চিন্তা করলে দুজনে আলাদা। মেধা আর উদ্ভাবনী শক্তির বিচারে বানর প্রজাতিকে পেছনে ফেলে মানুষ বহু দূর পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। বংশগতির মিলঝুল থাকলেও মানুষ তাই আলাদা প্রজাতি। রাক্ষসরাও সেরকম। তারা বন্য ও কদাকার। জল্পনার ইতিহাস তাদেরকে হিংস্র জন্তুর থেকে বেশি পৃথক করেনি। রাক্ষস হচ্ছে সেই জন্তু বেটাছেলে পেলে গপ করে গিলে ফেলে। রাজপুত্র হলে তো পোয়াবারো! রক্ষসের খিদে তখন তীব্র হয়ে ওঠে। তার কাছে বাংলার রাজা বিজয় আর পাইক-পেয়াদায় তফাত নেই। ওরা বেটাছেলে। ধরো আর মুখে পুরো। তবে মানবী হলে কথা ভিন্ন। বিজন বন কিংবা দ্বীপে মানবীর দেখা পেলে রাক্ষস কাতর হয়ে পড়ে। রূপসী রাজকন্যা হলে তো কথাই নেই! রাক্ষস তাকে চুরি করবে। নিজের গুহায় নিয়ে তুলবে। তাকে প্রেম নিবেদন করবে। রাক্ষসের পক্ষে যতটা কাতর হওয়া সম্ভব তার সব উজাড় করে রাজকন্যার পূজো করবে। প্রয়োজনে গোপন কৌটায় রাখা প্রাণভোমরার তথ্য ফাঁস করে দিতে পিছপা হয় না সে। জল্পনার এই রাক্ষসটি প্রেমিক। সে মাংসভুখা নয়। সৌন্দর্যের কদর করতে জানে। তাকে নিজের আবাসে চিরকাল বন্দি রাখতে চায়। সে হয়তো পুষ্প বুঝে না কিন্তু মানবীকে পুষ্প বলে ভাবে। তাকে পুষ্পের কদরে নিজের করতে চায়।
জল্পনা এভাবে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাসকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে। রাক্ষস ও মানুষের রেষারেষি সেখানে অন্য ইঙ্গিত উঠায়। জল্পনা থেকে বোঝা যায় পৃথক দুটি প্রজাতির মধ্যে একসময় অহরহ দেখাসাক্ষাৎ ঘটেছে। লড়াই ও আশনাই সমানে চলেছিল। জল্পনায় এমন রাক্ষস প্রজাতির দেখা মিলে যারা মানুষের চেয়ে নিজেকে উন্নত ভাবতে অভ্যস্ত ছিল। পৌরাণিক সাহিত্য ‘রামায়ণ’-এ মুদ্রিত জল্পনার কথাই ভাবা যাক। লঙ্কার অধিপতি রাবণ ধর্মদোষে রাক্ষস নতুবা মানুষ থেকে তাকে ভিন্ন ভাবতে যাবো কোন দোষে! তার রাজ্য মানবের সুমহান কীর্তির সঙ্গে তুলনীয়। লঙ্কার গরিমা ও পরাক্রম রামের চোখে ঘোর এনেছিল। জল্পনা সেটা গোপন করেনি। আমেরিকা দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ভাণ্ডার দেখে ঘোরগ্রস্ত হয়েছে, লঙ্কার গরিমা ও ঐশ্বর্য রামের চোখে তেমন ঘোর এনেছিল। সামাজ্র্যহারা ইংল্যান্ড এখন আমেরিকার চাটুকারি করে। পরাশক্তির সঙ্গে জোট বেঁধে যখন-তখন আগ্রাসনে নামে। রামের হয়ে হনুমানজি এই কাজটি সেকালে করেছিল। রামের জন্য সীতাহরণ মোক্ষম ইস্যু ছিল। লঙ্কা দখলের ওটা চাবি হয়ে উঠেছিল সেদিন।
সাদ্দাম কুয়েতে ঢুকে বোকামি করেছিল আর সীতাকে হরণ করে রাবণ নিজের সর্বনাশ ঘটায়। সাদ্দামের বোকামি মধ্যপ্রাচ্যে নিজের কায়েমি স্বত্বে বহাল থাকার সুযোগ বুশকে করে দিয়েছিল। আরবদেশের দুয়ার ঠেলে আমেরিকা সেই যে ঢুকে পড়েছিল তারপর থেকে আর যাবার নাম করে না! টালবাহানা করে সেখানে রাতদিন ঘোঁট পাকিয়েই যাচ্ছে। রাম হচ্ছে সেকালের বুশ। স্ত্রীকে উদ্ধার করার বাহানায় লঙ্কার দখল নিয়েছিল। সীতার ভাগ্যে যদিও কলঙ্ক আর দুর্ভোগ ছাড়া বেশি কিছু জোটেনি। পর-পুরুষের হেরেমে বন্দি থাকায় লোকনিন্দা সইতে হয়েছিল বেচারিকে। সতীত্ব প্রমাণের জন্য অগ্নিপরীক্ষায় ঝাঁপ দিতে হলো। এতেও শেষরক্ষা হয়নি। নির্বাসন আর পাতাল-প্রবেশের দুর্ভোগ মেনে নিতে হয়েছিল! লোকনিন্দা ও রাজত্ব হারানোর ভয়ে ভীত রাজা স্ত্রীর অপমান মুখ বুজে সহ্য করেছে। সীতার দুর্ভোগে নিজেকে শামিল করেনি।
কলঙ্কের দায়ভার রামের চেয়ে সীতার কাঁধে চাপানো সেই যুগে সহজ ও ধর্মসংগত ছিল। এতে রাজ্য রক্ষা হয়েছে। প্রজার কাছে রাজার ভাবমূর্তি নিষ্কলুষ গণ্য হতে পেরেছে। ধর্ম মহিমান্বিত হয়েছেন। একালে ব্যতিক্রম কই? কলঙ্ক সবার আগে রমণীর ঘাড়ে চাপে। ক্লিনটনের চেয়ে মনিকাকে অধিক গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। তাকে আর নির্দোষ ভাবতে ইচ্ছে করে না। ছলনাময়ী ভাবতে মন টানে। ক্লিনটনের কামপীড়া মনিকা দেখে তীব্র হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির ভিতরে রাক্ষস জেগে উঠেছে, ব্যক্তিগত সচিবের সাধ্য নেই তাকে থামায়! দেবরাজ ইন্দ্রের কামপীড়া জাগ্রত হলে স্বর্গের অপ্সরী চিরকাল বশ মেনেছে। ক্লিনটন দেবরাজ। মনিকা একালের মেনকা। তার সাধ্য কি রাষ্ট্রপতির চোখ চেপে ধরে; ব্রীড়ানত কণ্ঠে বলে,-‘আমাকে উদোম করো না। নগ্ন করে দেখো না আমায়। বড়ো লজ্জা হয়!’ রাষ্ট্রপতির চোখে রাক্ষস জেগেছে। ইন্দ্র ও ক্লিনটনে কালের ব্যবধান মুছে গেছে। একালের ইন্দ্রের কণ্ঠে সেকালের ইন্দ্র প্রতিধ্বনি তুলছে,-‘নাজুক আঙুলে ক’টা চোখ চেপে ধরবে রমণী! আমি দেবরাজ। এক চুমুকে ত্রিশ হ্রদ সোমরস পান করি। আমি দেবরাজ ইন্দ্র। সহস্র চক্ষু মেলে নিরীক্ষণ করি স্বর্গ-পাতাল-মর্ত্য। দু’হাত দিয়ে তুমি স্বর্গ ও পাতাল ঢাকা দিয়েছ। মর্ত্য দিয়ে দেখে নিচ্ছি ওই কুচযুগল। ওয়ি সুনিতম্বিনী, তোমার নগ্নতা বড়ো কামঘন। সম্ভোগে মানা করো না।’ জল্পনারা মানুষের মাঝে রাক্ষসের মহিমা বাড়ায়। রাক্ষস হলেই কেবল কামপীড়া জাগে। নতুবা সৌন্দর্য সম্ভোগের ক্ষুধা নৈতিক বিকারে আবিল হয় মাত্র।
রামের চেয়ে রাবণ তাই অধিক প্রেমিক। তার সীতাহরণে নৈতিকতার বালাই ছিল না। নিজেকে সাধু প্রমাণের বাহাদুরি ছিল না সেখানে। সীতাকে হরণ করেছিল বীরের উল্লাসে। রাবণের সীতাহরণে দোষ ধরার কিছু নেই। বীরের রীতি কি সেটা ছিল না সেকালে? বোনের অপমানের বদলা নিতে রাক্ষসরাজ রামের কুটিরে অবতরণ করে। রামকে পায়নি। পেলে গপ করে গিলে নিতো। বেটাছেলে রামের বদলে মানবীকে পেয়েছিল। জল্পনার রীতি মেনে তার রূপে আবিষ্ট হয়েছে রাক্ষস। গণ্ডি কেটে হরণ করেছে সীতাকে। ছিন্ন করেছিল জটায়ুর পাখা। সৌন্দর্য হরণে রাবণ ভানভণিতার তোয়াক্কা করেনি। বিবেকপীড়ায় বিপন্ন হয়নি। ক্ষত্রিয়ের রীতি অনুসারে এটা অধর্ম হতে যাবে কোন দোষে! ক্ষত্রিয়রা জন্মায় জয় করে নিতে। হরণ করে জয়ী হওয়া ধর্ম সেখানে। রাবণ রাক্ষস হওয়ার কারণে যত গোল বেঁধেছিল। রমণী তাকে ক্ষত্রিয় ভাবতে পারেনি। সীতার বেঁকে বসার মাঝে অপহরণের আতংক ছাপিয়ে লোকনিন্দার ভয় ও আতংক বড়ো হয়ে উঠেছিল। পাপবোধ মনকে পীড়া দিচ্ছিল। হতে পারে রামের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা রাবণের প্রতি তাকে বিমুখ করে তুলেছিল। মানবীর পক্ষে অসূরের প্রেম-নিবেদন সহ্য করা সহজ নয়। সীতা সেটা নিতে পারেনি। রাবণ রাক্ষস না হয়ে মানুষ বা ক্ষত্রিয় হলে ঘটনা হয়তো অন্যদিকে গড়াত। সেক্ষেত্রে রামায়ণ হতো না।
জল্পনার রাজ্যে রাক্ষসরা সকলেই একাধারে প্রেম ও কামভাবিক। কামক্ষুধা ওরা গোপন রাখতে জানে না। রাক্ষসী শূর্পণখা রাম ও লক্ষণের প্রেমে কাতর হয়েছিল। ভীমকে দেখে হিড়িম্বা কামপীড়ায় জর্জরিত হয়। রাম ও লক্ষণ মিলে শূর্পণখাকে উপহাস না জুড়লে এবং দুর্মতি লক্ষণ ওর নাক কেটে রসভঙ্গ না-ঘটালে সীতাহরণ ঘটে না। লক্ষণ হচ্ছে সে-যুগের ফ্যানাটিক। শক্তিমানের ওরকম দু-একটা ফ্যানাটিক থাকতে হয়। রামের ছিল লক্ষণ, আমেরিকার ইসরায়েল। সারাক্ষণ আমেরিকার সঙ্গে লটকে থাকে। বড়ো ভাইকে ভক্তি-টক্তি করে। শলা-পরামর্শ দেয়। টাকা-পয়সার তবিলদারি করে। বিনিময়ে নিজের ফায়দা হাসিল করে। রামভক্ত লক্ষণ তার বৌদিকে গণ্ডি কেটে ঘরের উঠানে বন্দি করেছিল। যেহেতু সে বিশ্বাস করে নারীর সৌন্দর্য ও সতীত্ব ঘরের আঙিনায় সুরক্ষিত থাকে। গণ্ডি থেকে বাইরে বের হলে নারী পরপুরুষের প্রলোভনে দূষিত হতে পারে। লক্ষণের ভক্তি সুস্থমস্তিষ্কের নয়। তার বিশ্বাস নারীকে কারাগারে কয়েদ রাখতে চায়। রমণীকে অসূর্যস্পর্শা রাখা তার কাছে পুণ্য গণ্য হয়। জার-জমিন-জারাকে গণ্ডি কেটে সংকুচিত করা সেখানে লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এতে নাকি ধর্ম রক্ষা হয়েছিল! লক্ষণ সেকালের ইসরায়েল। প্যালেস্টাইনকে সংকুচিত রাখার মাঝে নিজের নিরাপত্তা সে খুঁজে বেড়ায়। ইসরায়েলের কাছে এটি দোষের কিছু নয়। ইহুদিকুলের সুরক্ষার জন্য পারলে প্যালেস্টাইনকে মানচিত্র থেকে মুছে দিতে সে হয়তো পিছপা হবে না।
লক্ষণের তুলনায় ভীম বরং সহনীয়। কুন্তিপুত্র লঘুচিত্ত হতে পারে কিন্তু ফ্যানাটিক নয়। ক্ষত্রিয় হলেও স্বভাবে রাক্ষসভাবিক। হিড়িম্বার প্রস্তাব পেয়ে অধিক টালবাহানা করেনি। রাক্ষসীকে প্রথমে মারতে গিয়েছিল, অতঃপর যুধিষ্ঠিরের বাক্য বুঝে আর আপত্তি করেনি। মানব ও রাক্ষসীর মিলন থেকে ঘটোৎকচের জন্ম হলো। কুরু-পাণ্ডবের ঘোর রণে পাণ্ডবরা এই জন্মের উপকারিতা টের পেয়েছে। ঘটোৎকচের পিতৃভক্তি তুলনারহিত! হিড়িম্বা রাক্ষসী হলেও বিচক্ষণ ছিল। পুত্রকে রাক্ষসের আলয়ে বড়ো করে তুললেও মানবের গুণাবলি শেখাতে ভোলেনি। ময়দানবের উল্লেখ না করা বোধহয় অন্যায় হবে। রাক্ষসভাবিক দানব বিরাট স্থপতি ছিল। শিল্পী-প্রতিভা দিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে মনোহর প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল সে। প্রাণসংশয়ের ক্ষণে মায়াবী সেই পুরীতে আত্মগোপন করে পাণ্ডবরা প্রাণে বেঁচেছিল। ময়দানব যেনোতেনো স্থপতি ছিল না। জল্পনা মতে রাবণের স্ত্রী মন্দোদরি তার কন্যা লাগে। লোকে বলে লঙ্কাপুরী এই দানবের অবদান। রাবণের প্রাসাদ তার প্রতিভা দিয়ে মোড়ানো।
জল্পনার সে এক যুগ গেছে বটে! পশু, রাক্ষস ও মানুষে বিলক্ষণ তফাত ছিল। তা-বলে মিলমিশ ও বিনিময়ে খামতি ঘটেনি। ত্রিরত্নে লড়াই ও আশনাই সমানে চলেছে। কালের গতিতে সেই যুগ আর নেই। ওইসব প্রমত্ত বীর ধরাধাম থেকে কবে বিলুপ্ত হয়েছে! সেকালের বিচারে তারা সেলিব্রেটি ছিল। ঘটনা ও রটনার বিস্তারে মহাকাব্যিক হতে পেরেছিল। মহাকাব্যের নিয়মে তারা সকলে অধঃপাতে গিয়েছে। বিনিময়ের ভারসাম্যে হানি ঘটলে কী হয় সেই জ্ঞান রেখে গেছে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির জ্ঞানী হয়েছিল বানপ্রস্থে যাওয়ার পরে। কুরু-পাণ্ডবের লড়াই শেষ হলে কুরুক্ষেত্রে নির্বেদ ঘনায়। স্ত্রী ও ভাইদেরকে সঙ্গে নিয়ে ধর্মরাজের স্বর্গযাত্রা শুরু হলো। স্বর্গের পথ অতি দীর্ঘ! পদে-পদে বিপদ আর পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। দীর্ঘ পথযাত্রায় যুধিষ্ঠির ছাড়া বাকিরা টিকতে পারেনি। স্বর্গে ঢোকার আগে সকলে একে-একে মৃত্যুর কোলে মাথা রাখে। যাত্রার শুরুতে দ্রৌপদী ঢলে পড়েছিল। নিজের শ্যামাঙ্গী লাবণ্যে পঞ্চপাণ্ডবের প্রিয় পাঞ্চালীর মুগ্ধতার অন্ত ছিল না! অর্জুনমোহে কাতরা ছিল শ্রীকৃষ্ণ সখী। লাবণ্যের গর্ব আর প্রেমের মোহ এখন পথেই ভূলণ্ঠিত! ভগবান কৃষ্ণের প্রিয়সখী হওয়ার বড়াই কাজে আসছে না। অর্জুনের প্রতি গোপন মোহ ও অন্যায় পক্ষপাত দোষে বিদুষী পাঞ্চালী স্বর্গ পেল না!
ভীম তাকে এতটুকু কম ভালোবাসেনি। পাঞ্চালী সেটা আমলে নেওয়ার ঠেকা বোধ করেনি কোনোদিন। দ্রুপদ রাজের কন্যা ভীমের আবেগ নিয়ে খেলা করেছিল মাত্র! শিশু যেমন খেলনা নিয়ে খেলে! রমণীর ছদ্ম অভিমান ও কটাক্ষ সামাল দেয়ার সাধ্য বৃকোদর ভীমের কি আর আছে! চপলমতি রমণীর কাছে সে বালক বৈ কিছু নয়। রমণী তাকে প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে। দুর্যোধন ও দুঃশাসনের প্রতি ভীমকে ক্রোধে অন্ধ করে তোলায় পাঞ্চালীর ভূমিকাই মুখ্য। প্রেমের বাণে বশীভূত বালকের মনে শত্রুর প্রতি ঘৃণারে আগুন উসকে দিয়েছিল সে। বস্ত্রহরণের ক্ষণে ভীম শপথ করে কুরুক্ষেত্র ঘনালে দুঃশাসনের বুক চিরে সে রক্ত পান করবে। দ্রৌপদীকে অপমানের বদলা নেবে। যুদ্ধ শুরু হলে দুঃশাসনের রক্ত পান করে রাক্ষস তার শপথ পুরা করেছিল। ভীমকে দিয়ে কৃষ্ণসখী নিজের অপমানের শোধ তোলে তৃপ্ত হয়েছিল সেদিন। এখন, স্বর্গযাত্রার ক্ষণে এসব কাজে দিচ্ছে না। দ্রৌপদী ঢলে পড়েছে নীরবে! সৌন্দর্য ও প্রতিহিংসা একসঙ্গে ঢলে পড়েছে মৃত্যুর শিয়রে!
এবার অর্জুনের পালা। সব্যসাচী বীরবাহুকে অস্ত যেতে হচ্ছে অহমিকার দায় মাথায় নিয়ে। নিজেকে বীরশ্রেষ্ঠ ভাবার কারণে। হয়তো-বা কর্ণকে অন্যায় হত্যার অপরাধে। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের বিধি সে ভঙ্গ করেছিল। কৃষ্ণের পরামর্শে সকল নীতিনিয়ম পায়ে ঠেলে কর্ণকে হত্যা করেছে। অর্জুনের জানা ছিল না আপন ভাইকে সে হত্যা করছে। ভগবান কৃষ্ণের অবশ্য সেটা জানা ছিল। তার জানা ছিল কর্ণ পাণ্ডবের কে হয় আর কীবা তার পরিচয়! কুন্তির প্রথম সন্তান এই কর্ণ। বয়স বিচারে পাণ্ডবদের অগ্রজ। সূর্যদেবের ঔরসে তার জন্ম। সূর্য নির্লজ্জ দেবতা। রমণী সম্ভোগে রাক্ষসভাবিক। কুমারী কুন্তিকে দেখে দিবাকরের হৃদয়ে রাক্ষস জেগে উঠেছিল। দেবতাকে উপেক্ষার শক্তি অবলা কুন্তি কোথা পাবে! সূর্যরাক্ষসের লেলিহান তাপে রমণীর সকল লজ্জা ছিন্ন হলো! দুরাচারী বীরের বীর্যে সিক্ত হলো শূরসেন দুহিতা। কামক্ষুধা নিবারণ শেষে সূর্যদেব অস্ত গেল পটে। লোকচক্ষুর আড়ালে কুন্তিকে নিজের প্রথম সন্তান প্রসব করতে হয়েছিল। লোকনিন্দার ভয়ে তাকে রমণী নদীতে ভাসায়। বেতের পেটিকায় করে শিশুকে নদীতে ভাসিয়ে মা নিজ হাতে শত্রুতার বীজ বুনে দিয়েছিল।
ভীষ্মের রথের সারথি অধিরথ নদীর বুকে ভাসমান শিশুকে সেদিন উদ্ধার করে। সন্তানস্নেহে তাকে লালন-পালন করে। কাকপক্ষী টের পায়নি! সময় হলে কর্ণ নিজের আত্মপরিচয় ঠিক বুঝে নিয়েছিল। সূর্যদেবের কল্যাণে মাকে চিনতে তার বিলম্ব ঘটেনি। পিতার সঙ্গে সম্পর্ক মধুর ছিল। বাপ-বেটার সখ্যে কদাপি ছেদ পড়েনি। অথচ মাকে ধরা দিতে রাজি ছিল না অভিমানী বালক! মায়ের অপরাধ অভিমানী পুত্র এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি। কুন্তির সমাজভীতি ও পাপবোধ মেনে নিতে পারেনি। কর্ণের মধ্যে রাক্ষস জাগ্রত হওয়ার দোষ সূর্য ও কুন্তির ওপরেই বর্তায়। দুর্যোধনের কুলবিনাশী অন্যায়ে স্বেচ্ছায় নিজেকে শামিল করেছিল হতভাগা।
কর্ণের পাণ্ডব-বিদ্বেষ তাই অকারণে ঘটেনি। অর্জুনের সঙ্গে বিরোধ কেবল ক্ষমতার দম্ভ থেকে বাড়েনি। নিচু বংশের খোঁটা তাকে জনমভর শুনতে হয়েছে। স্বয়ংবর সভায় যোগ দিয়ে দ্রৌপদীর খোঁটা ও প্রত্যাখান সহ্য করতে হয়েছিল। যোগ্যতার পরীক্ষায় পাশ দিয়েও লোকের টিটকারি কর্ণের পিছু ছাড়েনি। সূতপুত্র মহাবীর পাণ্ডবের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল কুন্তি ও দ্রৌপদীর কল্যাণে। নিজেকে দুরাচারে শামিল করেছিল সন্তানের প্রতি মায়ের অবিচার সইতে না পেরে। রাজা পাণ্ডুর সন্তান লাভের ইতিহাসে কর্ণ অনুচ্চারিত বিষাদের নাম। পাণ্ডু নিজেও দুর্ভাগা। ছয়টি সন্তানের একটিও রাজার নিজের নয়। মৃগয়ায় বেরিয়ে ভ্রমবশে মৈথুনলিপ্ত হরিণীকে তীরবিদ্ধ করেছিল। সেই অভিশাপে সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারায়। কামসুখ ভণ্ডুলকারী রাজাকে ধনুকবিদ্ধ হরিণী অভিশাপ দিয়েছিল:-‘রে মূঢ়, তোর পরিণাম আমা থেকে ভিন্ন হবে না। তুই অস্ত যাবি রমণী মৈথুনের ক্ষণে।’ পাণ্ডুর সন্তানরা দেবতার ঔরসে জন্ম নিয়েছে। কুন্তি ও মাদ্রি দেবতার বীর্য ধারণ করে বংশরক্ষা করেছিল। সেকালে দেবতাকে রোখার সাধ্য মানবের ছিল না। দৈবের লিখন খণ্ডানোর স্পর্ধা মানুষ ভুলেও ভাবেনি। দেবতাকুলের মানবী মৈথুনে রাজার আপত্তি থাকার কথা নয়। পাণ্ডুও বাধ সাধেনি, বরং খুশি হয়ে সম্মতি দিয়েছিল। মাদ্রির সঙ্গে মৈথুনের শিহরিত ক্ষণে রাজা ঢলে পড়েছিল স্ত্রীর বুকে। হরিণের শাপ ষোলকলা পূর্ণ করে মাদ্রির নগ্ন বুকে রাজা পাণ্ডু চিরকালের জন্য অস্ত যেতে বাধ্য হলো।
গল্পের পেছনে গল্প থাকে। মাদ্রির বুকে ঢলে পড়ার দিনেও রাজা জানতে পারেনি তার প্রথম সন্তান যুধিষ্ঠির নয়, সে হচ্ছে কর্ণ। কুন্তির কুমারী বয়সের পাপ এই কর্ণ। সূর্যদেবের লাম্পট্যের ফল এই কর্ণ। দুখী কুন্তির জীবনে কর্ণ এক দীর্ঘশ্বাসের নাম। কেলেঙ্কারি ও লোকনিন্দার ভয়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখেছিল শূরসেন দুহিতা। সত্য প্রকাশের সাহস করতে পারেনি। কুরুক্ষেত্রে এর মূল্য তাকে দিতে হলো! ভ্রাতৃহত্যার পাপে অর্জুন নিজেকে ততক্ষণে কলঙ্কিত করে ফেলেছে। ভাই হত্যা করেছে ভাইকে। সব জেনেশুনেও কর্ণ প্রতিরোধ করেনি। নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল। কর্ণবধের পর দুর্ভাগা পুত্রের জন্য কুন্তির শোক লোকলজ্জার পরোয়া করেনি। এক পুত্রের হাতে আরেক পুত্রের মরণ দেখে মা এবার শোকের আগল ভেঙে স্বরূপে প্রকাশ্য হলেন। কর্ণের সত্য-পরিচয় প্রকাশের পর শোকের মাতম আর থামেনি। শান্তিপর্বে ফিরে-ফিরে হাহাকার উঠেছে।
যুধিষ্ঠির এই প্রথম রমণীকুলকে অভিশাপ দিয়েছিল। জল্পনা জানায়, ধর্মরাজের শাপে সেই দিন থেকে জগতের রমণীরা মুখরা। পেটের তারা কথা গোপন রাখতে জানে না। স্বর্গযাত্রায় অর্জুনের বীরত্ব ও যুদ্ধকৌশল নিরর্থক প্রমাণিত হচ্ছে। পথের ধুলায় লুটিয়ে পড়া এখন সব্যসাচীর নিয়তি। বৃকোদর ভীম টিকছে না পেটুক স্বভাব আর কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বভাবে বশীভূত হওয়ার দোষে। হয়তো-বা দুর্যোধনকে অন্যায় গদাঘাতে নিহত করার অপরাধে। ওটা যুদ্ধের নিয়মে পড়েনি। শত্রু-সংহারের নীতি মেনে ঘটেনি। দুরাচারকে বধ করার ক্ষণে ধর্মের কথা বিস্মৃত হওয়া ধর্মের বিধানে পড়ে না। পবনদেবের পুত্র ভীম তার মূল্য দিচ্ছে পথে শুয়ে। নকুল ও সহদেব লাভ করেছে যোগ্য পরিণতি। রূপের অহংকার দোষে মাদ্রি পুত্ররা পথেই মরেছে।
কুন্তিপুত্র যুধিষ্ঠির এখন একা! প্রিয়জন কেউ নেই সঙ্গ দিতে। সঙ্গী বলতে এক পথের কুকুর। স্বর্গযাত্রার শুরু থেকে ধর্মরাজের পিছু নিয়েছিল। এক মিনিটের জন্য সঙ্গ ছাড়েনি। কুকরকে নিয়ে যুধিষ্ঠির স্বর্গের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেল। সেখানে কুকুরের প্রবেশ নিষেধ। এদিকে নিজের জেদে যুধিষ্ঠির অটল, ‘পথের সঙ্গী ছেড়ে স্বর্গে যাব না। নরকযাতনা সইতে হয় সইব, তবু সঙ্গী ছাড়া স্বর্গবাসের অভিলাষ রাখি না।’ কুকুর এবার স্বরূপে প্রকটিত হলেন। যুধিষ্ঠিরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মানবজীবনের শুরু ও সমাপ্তির অভিজ্ঞতায় তিক্ত ধর্মরাজ দেখে সাক্ষাৎ ধর্ম তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পিতা প্রস্তুত পুত্রকে স্বর্গে নিয়ে যেতে।
রগচটা দুর্বাসা মুনি সেই কবে রাজা শূরসেনের প্রাসাদে অতিথি হয়েছিল। রাজকন্যা কুন্তির সেবাযত্নে সন্তুষ্ট মুনিবর কুমারী কন্যাকে অমূল্য বরদান করে। কুন্তি ইচ্ছে করলে যে-কোনো দেবতার হৃদয়ে কামপীড়া জাগাতে পারবে। কুমারীকে দেখে নির্লজ্জ সূর্যদেব প্রথমে অভিভূত হয়েছিল। কামরাক্ষসে বশীভূত দেবতা মানবীর সঙ্গে রতিসুখে বিলম্ব করেনি। ধর্ম, পবন ও দেবরাজ ইন্দ্র একে-একে সাড়া দিয়েছিল কুন্তির আহবানে। তার অনুরোধে অশ্বিনী সাড়া দিয়েছিল মাদ্রিকে। পাণ্ডব বংশে মানব-মানবীরা জন্মলগ্ন থেকে মুনি ও দেবতাসঙ্গে বেড়েছে। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাদবেস এই বংশের আদিপিতা বটে! দেবতা ও মানবের মিলনে দেবগুণ সঞ্চারিত হয়েছে মানবদেহে। পাণ্ডব বংশে ঘটনাটি নতুন নয়। প্রপিতামহ ভীষ্মের যুগ থেকে ধারাটি চলছে। ভীষ্ম বিবাহ ও রমণীসঙ্গে বিমুখ ছিলেন। তার হয়ে বংশরক্ষা করতে হয়েছিল মুনি ব্যসদেবকে। দেব, মানব আর মুনিতে ফিরে-ফিরে তাই মিলন ঘটেছে। যুধিষ্ঠির সেই বরদানের ফল। ধর্মের পুত্র নামে সকলে তাকে জানে। ধর্মরাজ নামে সে খ্যাত দেশে ও বৈদেশে।
স্বর্গের প্রবেশদ্বারে জন্মদাতা পিতাকে দেখে যুধিষ্ঠিরের হৃদয় শান্ত হয়ে আসে। সুস্থিরচিত্ত ধর্মরাজ বিলীন হয় নিরাকারে। কুরুক্ষেত্র এভাবে শেষ হলো বানপ্রস্থে এসে। যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে ধর্ম মানুষকে আরেকবার মানুষের মহিমা দেখালেন। এই ধরায় তার আবির্ভাব, যাপন ও পরিশেষের খেলাটি খেললেন। মানুষ যেন মনে রাখে,-বেলাশেষে কিছু টেকে না। পশু, রাক্ষস, মানব ও দেবতার একই পরিণাম! সকলকে বিলীন হতে হয় ঘনঘোর নির্বেদে। তারা সমাধি লাভ করে হয়তো নিরাকারে! বৈরাগ্য বা নিরর্থকতায়!
…
যুধিষ্ঠিরের যুগ অনেক আগে ধরা থেকে বিদায় নিয়েছে। কলের যুগ চলে এখন। ধর্ম ও মানুষে মাখামাখি আজো ঘটে। পশু ও মানুষ বাঁধা পড়ে প্রয়োজনে। কুরুক্ষেত্র ঘটে নিরন্তর, শুধু বানপ্রস্থটা অস্তাচলে গিয়েছে চিরতর। শান্তিপর্ব এখন আর নামে না শহরে। এখন আর স্বর্গ নেই। স্বর্গযাত্রা নেই। তাতে কি, নরকযাত্রা সমানে চলেছে। যুধিষ্ঠিরের যুগ সংশ্লেষণের ছিল। মানব ও দেবতায় সংঘাত আর সংযুক্তির যুগ ছিল সেটা। পশু, মানুষ ও রাক্ষসের বিবাদ নিরাকারে ডুবেছে, বিলীন হয়েছে ধর্মের সাগরে। নির্জ্ঞানে সমাপ্তি টেনেছে। নিখোঁজ হয়েছে অতল অজানায়। সেকালে ধর্ম ছিল ধারণকারী। স্থাবর ও জঙ্গম একদেহে লীন হতো সেখানে। অস্ত যেত ধর্মের সাগরে। কলের যুগে ধর্মটা পোশাকি। ধর্মসাগর জীর্ণশীর্ণ নদী। নদী রূপ নিয়েছে ডোবায়! কলের যুগে ধর্ম নেই, ধর্মের কঙ্কাল চাটে মানুষ। রকমারি আকারের ঘূর্ণিতে নিরাকার স্থিত নেই নিরাকারে। ওটা এখন কেতাবি। পোশাকি! নিরাকার নামে রকমারি লজেন্স চুষে মানুষ।
কলের যুগে পশুরা ক্রমশ মানুষ থেকে দূরে সরে গেছে। রাক্ষসরা দৃশ্যপট ছেড়ে উধাও। দেবতারা নিখোঁজ পৌরাণিক ইতিহাসে। এখন চলে মানুষের যুগ। এই মানুষ গ্রাম ও নগরে থাকে। মেট্রোপোলিসে সাঁতার কাটে, আসলে সাঁতরায় কারাগারে। এই মানুষটা কলবন্দি। এই মানুষ ঘড়িবন্দি। বন্দি সে রকমারি আকারের কারাগারে। অভ্যস্ত নতুন আকারের উপাসনায়। যুধিষ্ঠিরের যুগ ছিল মহাকাব্যের। কলের যুগ খণ্ডকাব্যেই সুখী। ওটা ছিল অখণ্ড হওয়ার যুগ। মানুষ এখন খণ্ড বিশ্বাসে সুখী ও নিশ্চিন্ত।
রূপান্তরের কালে যুধিষ্ঠির ধর্মরাজ বলে সুনাম কিনেছিল। দেব ও মানব, পশু ও রাক্ষসে যেমন-খুশি-সাজা’র যুগে ধর্মের সবক নিয়েছিল। কলের যুগে সাজতে হচ্ছে নিয়ম মেনে। যুধিষ্ঠিরের কালে যেমন-খুশি-সাজা’র প্রয়োজন পড়েনি। নাটকের অঙ্ক বুঝে মানুষ ‘যেমন খুশি’ সেজেছে। দেবতা, মানব আর রাক্ষসে পাল্টাপাল্টি স্বাভাবিক ছিল। দেবতা ও অসুরে সমানে টক্কর লেগেছে। দেবাসুরের সেই টক্কর গিয়ে পড়েছে মানবের ওপর। সন্ধি ও মিলন ঘটেছে নাটকের অঙ্ক বুঝে। সেকালের নাট্যমঞ্চে সৃষ্টিরা নাট্যকার ছিল না। তারা নটে ছিল। নাট্যকার হয়তো-বা নিয়তি। অথবা ভগবান! নিয়তিমঞ্চে খেলা করেছে মানবী ও দানবী, দেবী ও রাক্ষসী। নিয়তি এখন অবসন্ন। ভগবান মৌন। তার সাধ্য নেই মানুষকে নটে বানিয়ে নাচায়। তার সীমানা নির্দিষ্ট। নিয়তি ও ভগবানকে নির্ধারণ করে বিজ্ঞান। ক্ষমতার জটিল ছকে তারা নির্ধারিত হয় অবিরাম। শরশয্যার দিন এখন আর নেই। ত্রিকালজ্ঞরা ভূমায় মিশে গিয়েছে। এই ভূমি ভীষ্মের নয়, এ হলো মেকিয়াভেলির। শরশয্যায় ড্রপসিন পড়ে গেছে। ভীষ্মের যুগ অস্তমিত। যুগটা এখন নিছক মেকিয়াভেলির।
পাণ্ডবদের কাল অন্যরকম ছিল। তাদের দিন কাটত গুরুসঙ্গে। জীবনের দীক্ষা শুরু হতো গুরুকে প্রণাম জানিয়ে। ওটা ছিল জীবনবৃক্ষের যুগ। গুরুর মধ্যে জীবনের মহীরুহ অবলোকনের যুগ। সে-যুগে ভক্তি ছিল জ্ঞানের সোপান। পরশুরামকে কর্ণের এবং দ্রোণাচার্যকে একলব্যের গুরুদক্ষিণা অকারণে ঘটেনি। এর মধ্যে লুকানো ছিল জ্ঞানকে বোঝার প্রকৃতি। মায়া ও অবিদ্যা চিনে নেওয়ার জীয়নকাঠি। গুরু তোমায় পীড়ন করছে এটা বুঝাতে, মহাবীর হওয়ার ধৈর্য তোমার আছে এবং মহাবীর হওয়ার পর কারো মাথা তুমি কিনে নাওনি। ওহে একলব্য, হাতের আঙুল কেটে প্রমাণ করো তুমি গুরুর প্রেমিক। প্রমাণ করো গুরুর অন্যায় আবদারে তুমি নিয়তির খেলা দেখো। মায়া ও অবিদ্যার জগতে মোহের ছলনা বুঝো। আঙুল কেটে প্রমাণ করো তুমি কর্মফল জানো। হে বৎস, আমি তোমায় শিখিয়েছি তীর-ধনুকের ছলাকলা,—এবার গুরুদক্ষিণা দাও। হাতের আঙুল কেটে গুরুকে দক্ষিণা দাও। ওহে একলব্য, আমি তোমার আঙুল কেটে নিচ্ছি। নিজেকে অর্জুনের সমকক্ষ ভাবতে তোমায় নিষেধ করছি। প্রিয় বৎস, পাণ্ডবদের স্বার্থরক্ষা করছি আমি। জানি অন্যায়, তবু করছি। কারণ আমি অর্জুনকে তোমার চেয়ে অধিক ভালোবাসি।
এটা ঠিক, কুরুক্ষেত্রে আমি পাণ্ডবের পক্ষ নেব না, লড়ব দুরাচার দুর্যোধনের হয়ে। যদিও আমি নিহত হব সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের মিথ্যাবচনে কান দিয়ে। ওহে একলব্য, এইসব কেন ঘটবে জানো? কারণ, আমরা তুচ্ছ মাংসের পুঁটলি মাত্র! ওই দেখো তোমার আঙুল বিসর্জন আর আমার জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে কর্মফলের কাটাকাটি হয়ে গেল! আমি তোমার আঙুল নিয়েছি অর্জুনের স্বার্থরক্ষা করার জন্য। নিয়তি আমায় কেড়ে নিচ্ছে তোমার প্রতি অবিচারের অপরাধে। আমরা ভঙ্গুর মানব হে একলব্য। আমাদের কর্ম ও পরিণামের ফল ভোগ করি মাত্র। অন্তিমে কেউ জ্ঞানী নই, বিপন্ন মানব মাত্র!
ওহে একলব্য, তোমার আঙুল কাটা গেছে বলে দুঃখ করো না। অর্জুনকে অতিক্রম করতে পারলে না ভেবে মনে কষ্ট নিও না। অতিক্রমের ক্ষণে সংযম বজায় রাখা জরুরি। অতিক্রমের নেশায় বুঁদ হয়ে নিজের সর্বনাশ ঘটিও না বৎস। নেশা থেকে ঈর্ষার উৎপত্তি ঘটে। ঈর্ষা তোমায় অর্জুন করে তুলবে। তুমি অহংকারী হবে নিজের বীরত্বে। দিনশেষে ভাইকে হত্যা করবে নিজ হাতে। এরচেয়ে আঙুল বিসর্জন ভালো। তুমি বেঁচে গেলে অন্যায় হত্যার ফাঁদ থেকে। বীর ও জ্ঞানী হওয়ার চাইতে বিনয়ী হওয়া উত্তম নয় কি বৎস? অর্জুন হতে পারছ না বলে দুঃখ করো না। অর্জুন আমায় প্রভাবিত করছে দেখে মনে কষ্ট নিয়ো না। গুরুকে অভিযুক্ত করো না অভিশাপে। তোমার শক্তি হরণ করে অর্জুনের লাভ হয়নি বৎস। কর্ণকে ছলনায় দমিয়ে রেখে তার কপালে পুরস্কার জোটেনি। অর্জুনের হাত রক্তাক্ত আপন ভাইয়ের রক্তে। গুরুর রক্তে সে সিক্ত করেছে তার গাণ্ডীব। ভাই ও গুরুকে হত্যার আগে নিজের আঙুল কেটে ফেলা উত্তম ছিল নাকি বৎস? ঈর্ষা হলো নেশা। ঈর্ষা খালি ঈর্ষা বাড়ায়। ঘৃণায় বাড়ে ঘৃণা। নাই-বা হলে তুমি মহাবীর। হাতের আঙুল কেটে প্রমাণ করেছো তুমি জ্ঞানী। মনে রেখো বৎস, জ্ঞানের লক্ষ্য জ্ঞানী হওয়া নয়, জ্ঞানীরা জ্ঞানী হয় জ্ঞানকে বিসর্জন দিয়ে। যত বিসর্জন তত জ্ঞান। ওতেই শান্তি!
একলব্য তুমি শিখে নাও গুরুমন্ত্র :— জ্ঞানীরা বিসর্জনের জ্ঞান শিখে চিরকাল জ্ঞানী হয়েছে এই ভবে। অবিদ্যার ঘোর কাটে বিদ্যার মোহ কেটে গেলে। জ্ঞানের লক্ষ্য বিনয়; অহং কিংবা আত্ম-অভিমান নয়। বিনয়ী না হলে ভবে জ্ঞানী কেউ হয় না। জ্ঞানের লক্ষ্য আক্রমণ নয়। অস্ত্রের লক্ষ্য নয় অকারণ হত্যা। অস্ত্র আত্মরক্ষা করায়, হত্যা করায় না। যদি দেখো অস্ত্র তোমায় হত্যার ডাক দিচ্ছে তবে হাতের আঙুল কেটে ফেলো। এই বিসর্জনে তুমি পরিশুদ্ধ হবে। শান্তি পাবে জীবনে। অর্জুন পাপ করেছে কৃষ্ণের প্ররোচনায়। কৃষ্ণ ধ্বংস হয়েছে দ্বারকায়। পালা চুকেছে ভগবানের মানবরূপে লীলা দেখানোর। মানুষকে দীক্ষা দেয়ার পাঠ শেষে কৃষ্ণ ফিরে গেছে নিরাকারে। ওহে একলব্য, জীবনের কুরুক্ষেত্র থেকে গুরুমন্ত্র শিখে নাও। মনে রেখো অন্তিমে কিছু টিকে না। বিসর্জন ছাড়া কিছু বাকি থাকে না। কর্মফল ছাড়া কিছু পড়ে থাকে না ভবে।
যুধিষ্ঠিরের যুগ ছিল কর্মফলের। ওটা ছিল বৈরাগ্য ও নির্বেদের যুগ। শিক্ষা গ্রহণের যুগ। জ্ঞানকে বিসর্জন করে জ্ঞান আহরণের যুগ। আত্মত্যাগের অন্য অর্থ ছিল তখন। গুরুদক্ষিণার ভিন্ন মানে ছিল সেকালে। দ্রোণাচার্যরা তার উপমা হয়ে বিরাজ করেছে কুরুক্ষেত্রে, অস্ত গিয়েছে যুদ্ধের রণডংকারে। তারা কেউ শস্তা খ্যাতির কারবারি ছিল না। তারা ছিল মানুষের সঙ্গে জগতের সম্পর্ক বোঝার চাবি। যুধিষ্ঠিরী এ-যুগে অচল। দ্রোণাচার্যরা একে-একে লাদেন হয়েছে। একলব্যরা জঙ্গি। জ্ঞান বিসর্জন দিতে তারা এখন ঘোর অনিচ্ছুক। জ্ঞানের রূপান্তর মেনে নিতে বিমুখ। একালের মহাবীরগণ রক্তপিপাসু। নিজেকে শ্রেষ্ট ও অন্যকে নিকৃষ্ট প্রমাণের প্রতিহিংসায় ব্যাকুল। নিজেকে তারা জ্ঞানী ভাবে, অন্যদের অজ্ঞ। তাদের কাছে নিজের ঈশ্বর কেবল সত্য, বাকিরা মিথ্যা। ঈশ্বরজ্ঞানে একালের দ্রোণাচার্যরা একরোখা। ঈশ্বর বন্দি রকমারি আকারের আবেষ্টনে। জ্ঞান বন্দি বিশ্বাসের কাণ্ডজ্ঞানহীন কারাগারে। মানুষরা কেউ আর রাক্ষসভাবিক নয়, তারা শুধুই মানব!
…
নিছক মানবের যুগে রাক্ষসের অস্তিত্ব আমাদের বিব্রত করে। তার অদৃশ্য উপস্থিতি স্নায়ুকে বিকল করে তোলে। অবিশ্বাস্য চাপে আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি। রাক্ষসের উপস্থিতি আমাদের সুস্থিরতা বিনষ্ট করায়। নিশ্চিন্ত জীবনে অনিশ্চয়তার ঝড় বয়ে আনে। তাকে আমরা ছুঁতে পারি না। স্মৃতি থেকে মুছে দিতে পারি না। বিকল হৃদয়ে কেবল অনুসরণ করে চলি। আমরা বুঝি রাক্ষস আমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ঘুরিয়ে মারছে। দ্বৈত অস্তিত্বের চাপ নিতে বাধ্য করছে। রাক্ষসকে জীবিত রেখে সুস্থির থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাকে মুছে দিতে পারলে সভ্যতায় ফেরত যাওয়া যাবে। নিজেকে মানুষের সংসারে নিশ্চিন্ত রাখা সম্ভব হবে। সভ্যতার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার অবকাশ হয়তো জুটবে তখন! কিন্তু তার আগে রাক্ষস-সমস্যা সমূলে উপড়ে ফেলা প্রয়োজন। একালের মানুষ অগত্যা জল্পনার রাক্ষসকে মুছে দিয়ে কেবল মানুষসঙ্গে বাঁচার খিদেয় যাপন করে দিন!
- হাসিনাপতন : প্রতিক্রিয়া পাঠোত্তর সংযোজনী বিবরণ || আহমদ মিনহাজ - September 4, 2024
- তাণ্ডব ও বিপ্লব || আহমদ মিনহাজ - August 10, 2024
- তাৎক্ষণিকা : ১৮ জুলাই ২০২৪ - August 8, 2024
COMMENTS