অজ্ঞাতকুলশীলের নজরুল

অজ্ঞাতকুলশীলের নজরুল

তখনকার বাংলাদেশ টেলিভিশনে, বলছি দুইযুগ আগের কথা, প্রায়ই নীলুফার ইয়াসমিন গাইতেন সন্ধ্যাকালীন সংগীতের সেশনগুলোতে। বেশ কয়েকটা ধাঁচের গানই নীলুফারজিকে গাইতে দেখা যেত। উনি তো মূলত টপ্পা-ঠুম্রি কিসিমের গানেই ছিলেন অধিক অভ্যস্ত, দুর্দান্ত লাগত ওই আমাদের ব্যান্ডশোতোলপাড় দিনরাতগুলোতে নীলুফার ইয়াসমিনের গলার কাজ। কীর্তন আঙ্গিকের গান নীলুফারজির গলায় খেলত অসাধারণ, অধিকাংশই বিটিভিস্মৃতি নিবন্ধকারের এবং অ্যালবাম খরিদ করে ব্যান্ডগান ছাড়া আর-কিছু শোনা শুরু হয় নাই তখনও, বস্তুত পশ্চিমবঙ্গের মৌসুমী ভৌমিকের আগে মিডলক্লাসের ড্রয়িংরুমে এই নিলুফারজির অ্যালবামবাহিত কীর্তন/কীর্তনভাঙা গান পৃথক মর্তবায় গৃহীত হয়েছিল। নজরুলের গানও নীলুফারজি গেয়েছেন তার অননুকরণীয় গলায়, ডিস্টিংক্ট গায়কী দিয়ে। কেবল টপ্পা-ঠুম্রি-কীর্তন নয়, কেবল পুরাতনী বাংলা গান নয়, নীলুফার ইয়াসমিন গাইতেন নজরুলের গান। অজ্ঞাতকুলশীল এই নিবন্ধকার তার বিকাশের দিনগুলোতে নীলুফারের গায়কী ও গলা ভালোবেসেছিল। নজরুলের গীতি কিংবা সাংগীতিক রচনারাজির অন্তত কয়েকটা কাজের সঙ্গে এই নিবন্ধকারের পয়পরিচয় যেটুকু যা হয়েছে সেসবের পেছনে নীলুফারজির কন্ট্রিবিউশন অনস্বীকার্য।

‘তোমার কুসুমবনে আমি আসিয়াছি ভুলে’ — এই ছত্র রয়েছে যে-গানটার সূচনায়, নীলুফার ইয়াসমিনের কণ্ঠে এইটা আজ থেকে দুই দশক আগে শোনা হয়েছে। এরপর একই গান আরও অনেকের কণ্ঠে শোনা হলেও, পুরুষ ও নারী উভয় কণ্ঠেই, নীলুফারজির রেন্ডিশনে এর স্মৃতি নিরুপম অম্লান আজও। হয় এমনটা হামেশাই যে একেকটা গান একেকজনের গলায় এতই ফিট করে যায় যেইটা হাজার উন্নত পরিবেশনা সত্ত্বেও অন্য আরেকজনের গলায় সেভাবে সুখশ্রাব্য হয় না। কাজীগানের ক্ষেত্রে যেমন, রবিগানের ক্ষেত্রেও, অতুল-রজনী-দ্বিজেন্দ্র প্রমুখ সক্কলের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা ট্রু যে এদের সব গান সবার কণ্ঠে সমান সুখশ্রাব্য হয় না। সাংগীতিক শর্তাবলি ক্ষুণ্ণ না করে এবং সর্ববিধ নৈপুণ্য বজায় রেখেও অপেক্ষাকৃত অসবলভাবে গাওয়া গানটা আনুকূল্য পেয়ে যায় শ্রোতার, অনেক সময়, এর পেছনে ক্রিয়াশীল সেই গায়কীর ম্যাজিক। ‘তোমার কুসুমবনে’ গাইবার বেলায় নীলুফারজির গলায় সেই ম্যাজিক ক্রিয়া করেছে। এই গানটা কাজীগীতির আর-দশটা গানের চেয়ে ভিন্ন দ্যোতনায় নিবন্ধকারের লাইফের সঙ্গে রিলেইটেড; পরে এই রিলেশনটা, গানটার সঙ্গে নিবন্ধকারের লাইফের রিলেশন, আমরা খানিক খুঁজে দেখবার প্রয়াস হয়তো পাবো; হয়তো বর্তমান নিবন্ধে, হয়তো অন্য কোথাও, এই নিবন্ধ থেকে বেরিয়ে পরবর্তী নিবন্ধে কখনো।

নজরুলসংগীত/নজরুলগীতি ঠিক ওইভাবে অ্যালবাম খরিদ করে কখনো শোনা হয়েছে বলিয়া মনে পড়ে না। যা-কিছু নজরুলের গানবাজনা শোনা হয়েছে সেসবই বিটিভিতে, রেডিয়োতে, বেশকিছু শোনা পাড়ায় টিস্টলে। একটা বড় উৎস ছিল, নজরুলগান শোনার সাম্বৎসরিক উৎস, মহল্লার বিজয়-স্বাধীনতা-ভাষাদিবসের উদযাপনী ইভেন্টে কিংবা ইশকুলের বার্ষিক ক্রীড়ায় মাইকের মারফতে ভেসে-আসা গানের সুর ও কলি : ঠিক এই প্রক্রিয়ায় শোনা গানের সংখ্যা হাতে-গোনা আর পুনরাবৃত্ত কয়েকটামাত্র হলেও প্রত্যেক বছর পুনঃপুনঃ ওই গানগুলো শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে আদ্যোপান্ত। উদাহরণ দিতে যেয়ে মনে পড়ছে “শাওনরাতে যদি / স্মরণে আসে মোরে / বাহিরে ঝড় বহে / নয়নে বারি ঝরে” গানটার কথা। আরও মনে পড়ছে “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে / বিরাট শিশু আনমনে” কিংবা “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে”, “তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে” প্রভৃতি গান। সমস্তই নিজের মহল্লা বা পার্শ্ববর্তী মহল্লার আলোচনাসভা-অন্তে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসা। হার্মোনিয়ামের হাওয়া আর চোঙা মাইকের বিশেষ কিসিমের আওয়াজে সেইসব গানের আবেদন ভিন্নতর রূপায়িত হয়েছে সবসময়। কাজী নজরুল ইসলামের গান, অস্বীকার করি না আমি অন্তত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে কম শোনা হয়েছে। এর কারণ কি, কিংবা আদৌ কোনো কারণ আছে কি না, আপাতত সে-বিষয়ে আলাপ না-বাড়াই। কিন্তু ফ্যাক্ট এইটাই যে, রবীন্দ্রসংগীতের চেয়ে কাজীগীতি/কাজীসংগীত শোনা হয়েছে অনেক অল্প।

নজরুলের গান শোনা হয়েছে মুখ্যত বিটিভি মারফতে। ক্যাসেটযুগে ব্যান্ড ও অন্যান্য সোলো মডার্ন গানের অ্যালবাম খরিদ করেছি, যেমন রবীন্দ্রসংগীতেরও প্যপুলার কিছু অ্যালবাম কিনে শুনেছি ইয়াদ হয়, কিন্তু নজরুলগানের অ্যালবাম বাজার থেকে কেনা হয়নি কোনোদিনই। বিটিভির অনুষ্ঠানেই শুনেছি ফিরোজা বেগম থেকে শুরু করে সোহরাব হোসেন, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, খায়রুল আনাম শাকিল, শাহীন সামাদ, ফেরদৌস আরা, শাকিলা জাফর, সাদিয়া আফরিন মল্লিক, শারমিন সাথী ইসলাম প্রমুখ অনেকেরই কণ্ঠে নজরুলের গান। গুটিকয়েকেরই নাম মনে আছে, বেশিরভাগ শিল্পীর মুখ মনে গেঁথে থাকলেও নাম বা গান/গায়কী কিছুই মনে নাই। কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের শিল্পীদের নাম একনিঃশ্বাসে একত্রিশটা বলে যেতে পারব হড়বড়িয়ে এ-মুহূর্তেই। ঠিক বলতে চাইছি না যে কাজীর গান রবির গানের চেয়ে দেড়দাগ নিরস; ওইভাবে বিচারের কোনো যৌক্তিকতা নাই। কিন্তু লক্ষ করে দেখেছি যে মিডলক্লাস বাঙালির ভিতর রবিগান যতটা স্ট্যাটাস সিম্বল, নজরুলগান তত নয়। কেন হয় এমনটা? আল্লা মালুম।

তবে নজরুলগানেরও রয়েছে ব্যাপক কাটতি, বিপুল জনপ্রিয়তা, বিরাট মার্কেট। রবীন্দ্রগানের মার্কেটের চেয়ে নজরুলগানের মার্কেট শতাংশে কত বড় বা কত ছোট, এহেন কোনো জরিপ কি আছে? হেরি নাই নজরে। বেশ কয়েকটি দিক বিবেচনায় নেয়া যায় নজরুলগানের কম্পারেটিভলি কম বাজার-উপস্থিতির কারণ নির্ণয়ে। এক হচ্ছে, সেভাবে কোনো ফ্যুলটাইম ডেডিকেইটেড নজরুলগানের প্রচারপ্রসারকারী প্রতিষ্ঠান নাই যেমনটা ঠাকুরের আছে। কেন, বলবেন আপনি, নজরুল ইন্সটিট্যুট? জন্ম যদি তব বাংলাদেশে, হে সংগীতপথিক, এইসব ইন্সটিট্যুট-অ্যাকাডেমি ইত্যাদি ধ্বজভাঙাদের চাকরিস্থল লইয়া খামোশ রওয়াই ভালো। অধুনা বাংলাদেশে ব্যবসায়িক উদ্যোগে একটা আর্টকালচার ফাউন্ডেশন হয়েছে, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নামে, সেখান থেকে কে.এন. ইসলামের বেশকিছু সংকলন রিলিজ হয়েছে সিডি ফর্ম্যাটে; এইখানেও কৌতূহলী হলে দেখা যাবে যে অ্যালবামসংখ্যায় ঠাকুরগান আগায়া আছে। এছাড়া আছে পুরাতনী বাংলা, আধুনিক ও অন্যান্য সংগীতের পসরা সাজানো এদের ব্যবসায়। কে.এন. ইসলামের গানসম্ভার এখানেও কম্পারেটিভলি কম।

রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান গেরস্তঘরে গরহাজির, এমন হাউজহোল্ড শহুরে মিডলক্লাসের মধ্যে বের করা আদতেই ডিফিকাল্ট হবে। দেখা যাবে এগারোটা হাউজহোল্ডের সাতটাতেই গীতবিতান মিলবে। কে.এন. ইসলামের গীতিসংকলনের গ্রন্থরূপ খুব সুলভ বলা যাবে না। হাউজহোল্ডগুলোর মধ্যে, এগারো ঘরের মধ্যে, এক-দেড়টাতে একটা পাওয়া যাইতেও পারে। কে.এন. ইসলাম জাতীয় কবি … বিদ্রোহী কবি … ইত্যাদি আদুরে সম্বোধনে ভূষিত হয়ে অর্ধশতাব্দ অতিক্রম করতে চলেছেন অত্র ল্যান্ডে, এখনও উনার আওতা বাড়তে দেখলাম না। ছাত্রসখা পাঠ্যবইয়ের সুবাদে ছেলেবুড়োর কানে উনার নামের প্রচার আছে বটে। এত সমৃদ্ধ হয়েও উনার গানের প্রচারপ্রসার মনে হয় না আছে এখানে।

কেন রবীন্দ্রস্যঙের মতো নজরুলস্যঙের প্রসার অতটা নাই ইন-প্র্যাক্টিস, তলিয়ে দেখা আবশ্যক। বর্তমান প্রতিবেদকের হিম্মতে এহেন তল্লাশি চালানো সম্ভব নয়। কিন্তু গবেষণা যারা করেন, শ্রোতাজরিপ-ক্রেতাজরিপ তথা সাহিত্যসংস্কৃতিক্রিয়ার ভোক্তাজরিপ বলিয়া আদৌ যদি কিছু থাকে এখানে, এই দেশে, খোঁজা দরকার নজরুলসংগীতের কমন কতিপয় আইটেম ছাড়া সাধারণের ভিতরে কেন প্রসারটা নাই সেভাবে। এদেশে নজরুল ইন্সটিট্যুট থাকা সত্ত্বেও কেন নজরুলগীতের সহজলভ্য শোভন একটা কাগুজে-ছাপানো বই রিটেইলার ব্যুকশপগুলোতে গরহাজির; মোদ্দা কথা, গীতবিতানের ন্যায় একটা গোছানো সংকলন নাই কেন নজরুলগানের লিরিক্সের? হয়তো আছে, কে জানে, ক্রেতাসাধারণের নাগালে সেভাবে নাই বললে আলবৎ অত্যুক্তি হয় না।

তা, বাংলাদেশ টেলিভিশনে তো প্রচার আছে রেগ্যুলার নজরুলের গানাবাজানার; প্রসার তো হওয়ার কথা অতএব, হয় নাই? হয়েছে তো, হচ্ছেও, রবীন্দ্রগীতির তুলনীয় ভোক্তাগ্রাহ্যি কিংবা প্রসার না-হওয়ার নেপথ্যে নজরুলগীতিরই অন্তর্গত প্রয়োগপদ্ধতি দায়ী কি না, ভাবা দরকার। ব্যাপারটা নিয়া আলাপ হলো কয়েকজনের সঙ্গে। এদের সবার বক্তব্য এই প্রতিবেদনে পেশ করা যাচ্ছে না আপাতত। শুধু দুইজনের বক্তব্য, পরিচয় অপ্রকাশ রেখে, উপস্থাপন করা যাক নিচে।

এদের একজন বলছিলেন, নজরুলের গীতি কিংবা তার সংগীতের প্রসার রবীন্দ্রসংগীতের তুলনায় কম হবার পেছনে একটা কারণ হতে পারে ট্র্যাডিশন্যাল সংগীতশিক্ষার ক্লাসগুলো। কীভাবে? যেমন, সংগীতশিল্পের শিক্ষার্থী হিশেবে ছোটবেলায় বা তাদের বেড়ে-ওঠার সময় যারা তালিম নেন হার্মোনিয়্যমে, এদের প্রত্যেকেরই হাতেখড়ি হয় সাধারণত নজরুলগান শেখার মাধ্যমে; এবং উস্তাদজি/শিক্ষক কর্তৃক বাছাই-করা গানগুলো প্রতিটি শিক্ষার্থীর গানের খাতায় দেখতে পাওয়া যায়। এক-সময় এরা যখন বড় হয়, ক্যারিয়ার গড়ে তোলে কণ্ঠশিল্পী হিশেবে, আর্লি দিনের অত্যন্ত পরিশ্রমে শেখা গানগুলো সম্পর্কে একটা বীতশ্রদ্ধা তাদের ভিতরে হয়তো-বা কাজ করে; যে-কারণে তারা ওইদিক থেকে মুখ ফিরায়া রাখে। এই বক্তব্য আন্দাজনির্ভর হলেও বক্তার সারল্য ও সাংগীতিক সততা সম্বন্ধে প্রতিবেদকের আস্থা থাকার কারণে এক্সপেরিয়েন্স হিশেবে ফেলে দেয়া যাচ্ছে না বক্তব্যটুকু। অন্যজন অবশ্য বলছিলেন আরেকটু উঁচা জায়গা থেকে। এহেন প্রত্যাশিত প্রসার না-হবার কারণ হিশেবে তিনি নজরুলের সংগীতকাঠামোয় ব্যবহৃত রাগপ্রণালিগুলোর ওপর গুরুত্ব দেন। বলেন, রবীন্দ্রনাথের গানে রাগনিচয় যেভাবে ভেঙে ব্যবহৃত হতে দেখি, ঠিক উল্টো নজরুলের গান/সংগীত; সরাসরি রাগের অরিজিন্যাল কাঠামোটা কাজীর সংগীতে ব্যবহৃত বলেই শ্রোতাকানে সেসব চটজলদি বিক্রিয়া করতে ব্যর্থ হয়। কালোয়াতি জিনিশটা কাজী নজরুলের কাজে যেমন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তেমনি কিছুটা প্রাণ সংহারও তো করে বৈকি। দ্বিতীয় বক্তার আলাপে লিরিকের ব্যাপারটাও উঠে এসেছে। তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন কম্প্যাক্টনেস থাকে লিরিকের, নজরুলে একেবারেই তা আলগা। দারুণ সুন্দর অনেক গীতিকা থাকলেও নজরুলের গীতিভাগের কথাগুলো ঘনবুনটের নয়। এলানো। প্রক্ষিপ্ত। সর্বোপরি রয়েছে দেশি সুর ও শব্দোপাদানের পাশাপাশি প্রচুর বিদেশি তথা পারস্য সুর ও উর্দু-ফর্সি শব্দের প্রেজেন্স। এইসব কারণে শ্রোতা ভাবসাযুজ্য খুঁজিয়া পায় নজরুলগানের চেয়ে রবীন্দ্রগানে বেশি। ঠিক জোরালো যুক্তি না-হলেও কথাগুলো খতিয়ে দেখার মতো শক্তি নিশ্চয় ধারণ করে। সেসব খতিয়ে দেখাদেখি নিশ্চয় কেউ করবে এক-সময়। যেমন আরেকটা আকছার ব্যক্ত কথা এই-বাবতে শুনে থাকি আমরা যে, নজরুলের গান সমষ্টির আর রবির গান ব্যক্তির। নজরুলের গানগুলো যেন মুজরোয় ঝাড়লণ্ঠনের আলোয় কেউ গাইছে শ্রোতা মাতাইতে, এদিকে রবীন্দ্রনাথের গান একলা ব্যক্তিমানুষ জানালাগ্রিলে চোখ ঠেকিয়ে যেন নিজেরেই উদযাপিতে গেয়ে উঠছে। যেহেতু মানুষ মূলত একা, কাজেই সে নিজের মুহূর্তটায় ঠাকুরের গানে বেশি দিলচস্পি ফিল করে। কে জানে, স্টেইটমেন্ট হিশেবে এইটা আদৌ কোনো গ্রাহ্য সূত্রের থিসিস কি না; তবে এমনটাই কিন্তু বলা হয়ে থাকে।

এখানে এইটুকুই নিবন্ধকারের স্বীকারোক্তি হতে পারে যে নজরুলের গান ও সংগীত উদার বৈচিত্র্যের ও বৈভিন্ন্যের একটা আকর। এই আকরের উদঘাটন হয়েছে অল্পই। বিচিত্র সমস্ত জনপদ ও নৃগোষ্ঠীর সুরধারা নজরুলে যেভাবে এসে জায়গা জুড়েছে, এর তুলনা পাওয়া ভার। রণসংগীত থেকে শুরু করে গজলের ফর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন সংরূপ নজরুল ইন্ট্রোডিউস করেছেন বাংলায়। সাক্সেসের গ্র্যাফটাও অত্যন্ত উঁচুতে এসব ক্ষেত্রে। এরপরেও নজরুলের গানবাজনার প্রসার ততটা প্রাচুর্যবহ নয়। এখনও প্রথানুবর্তী কিছু কণ্ঠশিল্পীর গলায় ফর্ম্যাল কায়দায় গানগুলো গীত হয়ে থাকে। উদাহরণ হিশেবে বলা যায়, রবীন্দ্রগানের প্রেজেন্টেশন যতটা আধুনিক শিল্পীরা বা ব্যান্ডশিল্পীরা করে থাকেন স্বেচ্ছাবৃত হয়ে, নজরুলের দুই-তিনটা সাম্যগীতি কিংবা ডাইরেক্ট অ্যাকশন টাইপের তালাভাঙা গানের বাইরে সেভাবে আর-কোনো পরিবেশনায় তাদেরে দেখা যায় নাই। এখনও নজরুলের গান শুনতে যেয়ে পুরাতনী দিনের শিল্পীরাই লিস্টের অগ্রভাগে থাকেন শ্রোতা হিশেবে আমাদের দৈনন্দিনতায়।

ইন্টার্নেট অ্যাক্সেসের এই যুগে এসে ইউটিউব ইত্যাদির কল্যাণে আমরা নজরুলের আদিযুগের রেকর্ডগুলোও শোনার সুযোগ পাই প্রত্যহ। শুনি ইন্দুবালা, আঙুরবালা, কমলা ঝরিয়া, কানন দেবী, যুঁথিকা রায় প্রমুখের কণ্ঠে। শুনি ফিরে ফিরে ফিরোজা বেগম। অন্যদিকে কে. মল্লিক, মানে কাসেম মল্লিক, ধনঞ্জয়, মানবেন্দ্র, সতীনাথ, ধীরেন্দ্রচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্র, শচীনদেব প্রমুখ নজরুলের গানে যে-মাধুর্য পুরে রেকর্ড করে গেছেন, শুনি তা-ই ফিরে ফিরে। যেমন শুনি আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে নজরুলের ইসলামি সংগীত। অথবা সোহরাব হোসেন শুনি হামদ-নাত শুনতে যেয়ে। এদের পরবর্তীকালের কয়জন পেরেছেন নজরুলসংগীত গেয়ে শ্রোতাকান হরণ করতে? সেই-তো যুঁথিকা রায়ের কণ্ঠে ‘আমার ভুবন কান পেতে রয়’ কিংবা ফিরোজা বেগমের কণ্ঠে ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ কিংবা ‘দূরদ্বীপবাসিনী’ শুনি বারেবারে।

এইসব কথাবার্তা আপাতত মুলতবি রেখে এই নিবন্ধকারের শোনা নজরুলগানের যেগুলো সবচেয়ে বেশি হৃদয় কেড়েছে, এর কয়েকটার প্রথম ছত্র উল্লেখ করে এই নিবন্ধের যবনিকা টানা যাক। দশটা গানের একটা তালিকা বানানোর কোশেশ করব : ‘বুলবুলি নীরব নার্গিসবনে’, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’, ‘ওগো শুভ্রবসনা রজনীগন্ধা’, ‘কেন দিলে এ-কাঁটা যদি গো কুসুম দিলে’, ‘মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর’, ‘আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া’, ‘কে বিদেশি মন-উদাসী’, ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’, ‘মুসাফির মোছো রে আঁখিজল’, ‘কেন আজ মধুকর’ … এই গানগুলো বহুবার শোনা হয়েছে সেকেলে গ্রেইটদের কণ্ঠে একেলে টেক্নোলোজির কৃপায়। আরও আছে নিশ্চয়, ‘তোমার কুসুমবনে’ তো শুরুতেই বলেছি, ‘পদ্মার ঢেউ রে’ সহ অনেক আছে আরও, ইত্যাদি। কিন্তু নজরুলসংগীতে একেলে গ্রেইট একজনেরও নাম কেন মনে পড়ছে না, ভাবতে বসব অবসর পেলে। এখন এই নিরবসর হন্তদন্ত হররোজকার হ্যাপা সামলানোই প্রায়োরিটি। অগত্যা।

লেখা : সুবিনয় ইসলাম

… …

সুবিনয় ইসলাম
Latest posts by সুবিনয় ইসলাম (see all)

আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you