নেমেসিসের গান ঠিক কখন থেইকা শুনতে শুরু করছি, এইটা মনে করা কঠিন। প্রায় ছাব্বিশ বছরের পুরানো ব্যান্ড। কিছু সলো সহ এখন পর্যন্ত মিউজিক অ্যালবাম রিলিজ করছে চারটা। সর্বশেষ অ্যালবাম ভিআইপি (VIP) বের হইছে সপ্তাহদুই আগে। ইউটিউব সহ এই অ্যালবামের গান অ্যাভ্যাইলেব্যল অলমোস্ট সব সোশ্যাল-প্লাটফর্মে। মূলত এই অ্যালবাম নিয়া কবি জাহেদ আহমদের সাথে এপ্রিলের একদম শেষের দিকে তারাপুর চাবাগানে কথা বলতেছিলাম। কালভার্টের পাশে। সাথে ছিল সন্ধ্যাপরবর্তী টাটকা আঁধিয়ার আর থিওডর র্যাটকির ব্যাটস। ‘When the gentle twilight comes / He strikes the streetlights with his wings’ (the bat, roethke) অন্যদের কথা ভাবি না আমি। ভাবতেছিলাম, অ্যালবামটা কি আমার আত্মার সাথে কথা বলবে?
মিউজিক যেন ফ্রস্টের কবিতায় পাওয়া কাঠের ওই অন্ধকার জঙ্গল—যার নৈশব্দ কথা বলতে থাকে নির্ভয়ে, যখন আমি চাই। মিউজিক যেন জেমেকিসের সিনেমায় ধারণ করা একের পর এক মায়াবী দৃশ্যের রঙিন খাতা, যেইখানে শুধু আমার জন্য কিছু-একটা কেউ লিখতে থাকে, শোর করতে থাকে—অগোচরে। আচ্ছা, মার্কেজের ওই নভেলার কথা মনে আছে—‘No One Writes to the Colonel’? মিউজিক যেন বৃদ্ধ কর্নেলের ওই অপেক্ষার মতো। তবু চিঠি আর আসে না। ঘাসের রঙের মতো কিশোরীর মুখ মলিন হইতে থাকে ধীরে। ঝাপসা হইতে থাকে ক্যামেরার লেন্স। অথবা পরিচালকের চোখ। প্রতারণার নতুন ভাষায় আরো এক নতুন আইসা অধিকার করতে থাকে সময়ের শূন্যস্থান। সিগিরিয়ার পাহাড়ে দুর্ভেদ্য দূর্গের মন্ত্রমুগ্ধ সুন্দরে ক্লান্ত হইতে থাকে রাজা কাশ্যপা। কীসের অপেক্ষায়? মিউজিক এইখানে সবচেয়ে বিশ্বস্ত রেফিউজ।
নেমেসিসের প্রথম অ্যালবামের নাম অন্বেষণ। রিলিজ ২০০৫। ফেরদৌসের কথায় ‘না-ঘুমদের গান’ নামের গানের কথা এইরকম :
আজ আর নয় তো কোনো গান
নয় তো কবিতা
স্তব্ধতার অরণ্যে
ঘুম আসে না চোখে
তাই তো জেগে রই
স্বেচ্ছানির্বাসনে
ঘুমিয়ে গেছে পৃথিবী
নিথর ক্লান্ত সমাধি
অন্ধকার আর আমি রই জেগে।
আলোটাকে জব্দ করে
একা ঘরে রাতদুপুরে
কেন আমি কোন কারণে
দূর নিশির ডাকে
আমি নিমগ্ন হই
শার্শির আড়াল থেকে
আর ক্ষয়ে-যাওয়া চাঁদ
তার একমুঠো আলো
ডুবছে অবছায়াতে…
নতুন, খুবই স্বকীয় এক স্বরে শুনতে পাই তরুণ হাহাকার। এই অ্যালবামের সব গান যেন তরুণসত্তার আত্মকথা। তরুণের বেদনা, ইনসিকিউরিটি, শূন্যতা, স্বপ্ন, আশা। নেমেসিসের ভোকাল জোহাদ। তার কণ্ঠ মনের মানুষের মতো। সেরিন। গ্র্যাভিটির টানে আত্মসমর্পনের পরে ধীরে ধীরে কোথাও উধাও হইয়া যাওয়ার মতো। নেমেসিসের টিউনিং খুবই ইন্ডিভিজ্যুয়াল। ওদের যে-কোনো ধুন অনেকদূর থেইকাও নেমেসিসের এমব্ল্যম নিয়া ভাসে।
আমার মনে হয়, নেমেসিসের সিগনেচারঅ্যালবাম তৃতীয় যাত্রা। মোট নয়টা ট্র্যাকের এই অ্যালবামের সবকয়টা মনে রাখার মতো গান। প্রথম অ্যালবাম প্রকাশের ছয় বছর পর ২০১১-তে নেমেসিস হাজির হয় এই অ্যালবাম নিয়া। এইটা এমন এক সময় যখন সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্য মাইনা নিতে শুরু করতেছে সবাই। অ্যান্ড্রয়েড আর স্মার্টফোনের আক্রমণে বেহাত হইতেছিল অ্যানালগ সকল এফোর্টস। ক্যাসেটের যুগ অনেক আগে শেষ। ডিস্কও শেষের দিকে। ডিজিটাল সবকিছু ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক ওয়েভে নিজেদের অমরত্ব ঘোষণা করতেছিল । ন্যাশনাল টিভিচ্যানেল তখন আর্কাইভের মতো স্মৃতি হাতড়ানোর ভাগাড় একটা। মুহুর্মুহু প্রাইভেট টিভিচ্যানেলের আবির্ভাবে দর্শকদের মেন্টাল-স্পেইসে ব্যক্তিরুচিজাতীয় একপ্রকারের খুবই অন্তঃস্থীয় ঘটনার উদ্ভব ঘটতে থাকে। অবশ্য এতে সোসাইটির নিজস্ব সৃষ্টি-চিন্তা ডেভেলপড হইছে কি না, এই সময়ে বইসা ঠিক নিশ্চিত হইতে পারতেছি না।
অ্যানিওয়ে, অ্যালবাম তৃতীয় যাত্রার প্রথম ট্র্যাক ‘কবে’। বিউটিফুল। সুর ও স্বরে ‘আমি আর তুমি’ এই দুই খুবই ইন্টেন্স স্পেইস থেইকা দূরে সইরা এইদুইয়ের ভিতরকার ভাষা আর যোগাযোগের তুমুল অভিপ্রায় যেন এই গান। যেন বন্দিত্ব ভাঙার বাসনা। একটা অসাধারণ গিটার সলো সহ গানের মিউজিক কম্পোজিশন সবসময় আপনার ভিতরে বাজবে। সুদিনে অথবা মেঘলা দিনে। আপনে এড়াইতে পারবেন না। জোহাদের ভয়েস আপনার অস্তিত্ব হইয়া উঠবে। সেকেন্ড ট্র্যাক ‘বীর’। এই গানের একটা লাইন খুব ইন্টারেস্টিং। ‘মনের ভেতর পারবে নতুন মন বানাতে?’
নেমেসিসের গানে একধরনের যাত্রার কথা আছে। বোহেমিয়ান। দূরে কোথাও সফরে যাওয়ার আকুলতা। যেন কেউ কিছু একটা খুঁজতেছে কোথাও। কী সেইটা? তৃতীয় যাত্রাটা কী? অ্যালবামের প্রচ্ছদে, গ্রাফিক্সে একটা কাক উইড়া যাইতেছে। আর তার পালক খইসা পড়তেছে। এই যাত্রায় কি অন্ধকার মুইছা যাবে? এই অ্যালবামের বেইজ, ইলেক্ট্রিক গিটারের সাউন্ড, মিউজিক ভ্যারিয়েশন দারুণ। সপ্তম ট্র্যাক নির্বাসনে এক-একটা স্ট্যাঞ্জায় এক-একটা সাউন্ড আসে। আসে এক-একটা ধুন। যেন যারে খুঁজতেছে মন, তারে মনের সবকিছু দিয়া ডাকা।
তৃতীয় যাত্রা অ্যালবামের নবম বা শেষ ট্র্যাক ‘শেষ গান’ যেইটা আমার প্রিয়। মানে ঠিক যেই কারণে আমি লিখি। যেইভাবে মিউজিক আমার আত্মায় টোকা দেয়। ফর দ্য রিজন আই ফিল দ্যাট আই এগজিস্ট। গানের কথা জোহাদ হিমসেলফ।
চাঁদের দড়ি দিয়ে বেয়ে উঠি
তারই আলো দিয়ে তোমায় খুঁজি
খুঁজতে গিয়ে আমায় আমি ভুলি
তবে তোমায় পেয়ে আমি সুর তুলি
থমকে তাকিয়ে থাকি দাঁড়িয়ে
সুর খুঁজতে গিয়ে যাই হারিয়ে
শোনাব শেষবারের মতো এই সুর
এই ভাঙা সুর দিয়ে যাব কতদূর?
খুবই স্লো এই গান। পিওর পোয়েট্রি যেন। স্লো গিটার। অ্যাকোস্টিক অ্যান্ড ইলেক্ট্রিক একসাথে। যেন একটা মহল তৈরি হয়। একটা মোমেন্ট। ভাইবা দেখছি, জোহাদ ছাড়া স্বকীয় সুরে এই গান তোলা খুবই কঠিন একটা কাজ। জোহাদের গায়কী এইখানে স্ট্যান্ড আউট করে। ইউনিক। ওয়ান অব আ কাইন্ড। অরিজিনাল।
নেমেসিসের থার্ড অ্যালবাম ‘গণজোয়ার’। গানের সংখ্যা দশ। অ্যালবামের নামে প্রথম ট্র্যাক গণজোয়ার খুবই পরিণত এবং সময়রে আঘাত করা একটা মাস্টারস্ট্রোক। ২০১৭-তে রিলিজ হওয়া এই অ্যালবামের এই একটা গানই যথেষ্ট নেমেসিসের লিগ্যাসি বয়ানে। গণতন্ত্র, সবার মন্ত্র। ভোকাল, লিরিক্স, গিটার, ড্রামস, টোটাল মিউজিক কম্পোজিশন সবকিছু স্নাইপারের লক্ষ্যভেদী নৃশংস বুলেটের মতো আপনার ভিতরে আঘাত করবে। নেমেসিস থাকবে কারণ তারা গণজোয়ার বানাইছে। এই গান জাস্ট লার্জার দ্যান লাইফ।
নেমেসিসের গান তার চারপাশ সম্পর্কে ধারণা রাখে। স্যাটায়ার আর সরাসরি বয়ানে তীক্ষ্ণ। ইন্ডিভিজ্যুয়াল থেইকা সোসাইটি সবখানে নেমেসিসের ধারালো ভাষা যাইতে চায়, স্ক্র্যাচ করতে চায়। এই অ্যালবামের সেকেন্ড ট্র্যাক ‘জানালা’ অনেকটা এইরকম। অ্যালবামের পঞ্চম ট্র্যাক ‘স্বপ্নসুর’। আমার খুবই প্রিয়। যেন আমার মনের অদেখা স্বর। বরাবরের মতো এইখানেও জোহাদের গায়কী অতুলনীয়। সবার চেয়ে আলাদা। জোহাদ আমার অস্তিত্ব হইয়া ওঠে।
সুরের স্বপ্নের মাঝে সে বসে থাকে
তারই এক সুরে আমাকে ডাকে
তার ডাক শুনে আমি যাই ছুটে
ফিরে দেখি সবকিছু আঁধারে
সব ভুলে যাব কতদূর
সবাই খোঁজে তারই স্বপ্নসুর
সুরগুলো আজ সুরের মতো নয়
ভুল করা আজ আমাদের ভয়
কতগুলো গল্প বলে দিয়ে যাব
মনে কি রাখব তারই সুর?
কত ভুলে-যাওয়া জায়গা
কতগুলো আয়না তবু দেখা যায় না
তারই ভুল…
যা-ই হোক, নেমেসিসের নতুন অ্যালবাম বের হইছে। ভিআইপি। এইটা তাদের চতুর্থ অ্যালবাম। মোট গান দশটা। ‘ভিআইপি’ নামে প্রথম গানটা মূলত একটা সোশ্যাল স্যাটায়ার। যদিও অ্যালবামের সব গান একই ধারার না। তৃতীয় অ্যালবাম রিলিজের প্রায় আট বছর পর এই অ্যালবাম। নেমেসিসের নিখুঁত, পরিশীলিত লিরিক্সের তুলনা হয় না। তবুও এই অ্যালবামের গান শুনতে শুনতে আমার মনে হইলো, কিছুটা আউট অব দ্য বক্স । মিউজিক কিছুটা আর্টিফিশিয়্যাল মনে হইছে কোথাও। নট শিওর। কিন্তু শেষ আট বছর এমন একটা সময় যেইখানে জোহাদ অ্যান্ড হিজ ফ্যামিলি, ব্যান্ড নেমেসিস, আমাদের জন্য অনেক বড় এক অনুপ্রেরণা হইয়া হাজির হন।
নেমেসিস গ্রিক পুরাণের নিয়তি। আর আমাদের মায়াবী সুর। আমাদের কল্পরাজ্যে যাত্রার সঙ্গী। ছাব্বিশ বছরের দীর্ঘ সফর যেন মুহূর্তে শেষ হইয়া যায় নেমেসিসে। নতুনে, তারুণ্যে। আরো ছাব্বিশ হাজার বছর এইভাবে গান গাইবে নেমেসিস।
‘Well then, if we agree, it is not odd
that one man’s devil is another’s god
or that the solar spectrum is
a multitude of shaded grays; suspense
on the quicksands of ambivalence
is our life’s whole nemesis. (Love is a Parallax, Plath)
মে ২০২৫
হাসান শাহরিয়ার রচনারাশি
গানপারে নেমেসিস
- অজ্ঞাতনামা, লাশ ও রাষ্ট্র, লাশের ভিতর জিন্দেগির পোস্টমর্টেম, ভুয়া সেক্যুলার প্রজেক্ট, ভালো সিনেমা… || হাসান শাহরিয়ার - June 23, 2025
- কাল সকালে, ইরোটিক সোসাইটি, মালতির অ্যাবনর্মালিটি… || হাসান শাহরিয়ার - June 16, 2025
- কোরবানি ২০২৫ - June 14, 2025
COMMENTS